ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯২তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো আটত্রিশ

………………………………………………………

ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের কেমিস্ট্রি বইতে সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন নামে একটা বন্ধন আছে। এটা কী? সহজ করে বলি। কেমিস্ট্রিতে বন্ধন হল, অন্তত ২টি পরমাণু কিংবা রাসায়নিক ‘অন্যকিছুর’ (অন্যকিছু মানে, আয়ন হতে পারে, যৌগমূলক হতে পারে। বামপাশের লাইনটি যারা বোঝেননি, তাদের ওটা বোঝার চেষ্টা করারও দরকার নেই।) মধ্যে একসাথে থাকার একটা বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়ায় ইলেকট্রন নামে একটা জিনিস লাগে, যেমন মানবিক বন্ধনে ভালবাসা লাগে, ওরকম। আর সমযোজী বন্ধন হল, সমবায় সমিতি টাইপের একটা ব্যাপার। মানে, ওই বন্ধনে যারা থাকবে তারা তাদের বন্ধন গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান ইলেকট্রন সমান সংখ্যক শেয়ার করবে। এটাই বন্ধন গঠনের শর্ত। এ বন্ধনে সবাই সমান, কারণ সবার কন্ট্রিবিউশন সমান সমান। কেউই কারোর উপর কোন খবরদারি করতে পারবে না, এটাই নিয়ম। কিন্তু আয়নিক বন্ধনের বেলায়, ইলেকট্রন দেবে একজন, গ্রহণ করবে আরেকজন। একজন প্রভু, অন্যজন দাস। যে প্রভু, সে প্রভুত্ব করবে, দাস সেটা চুপচাপ মেনে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ দাসের যে ইলেকট্রন নেই, ও কীভাবে উঁচুগলায় কথা বলবে? যে কখনওই রেস্টুরেন্টে বিল দেয় না, সে আবার নিজের ইচ্ছেমত মেন্যু অর্ডার করে কোন আক্কেলে? এরকম আরকি!

সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধনটা একটু অন্যরকমের। এখানে, দুজন ইলেকট্রন শেয়ার করে বন্ধন গঠন করে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে, ওদের এই সহাবস্থানে দুজনেরই সমান সমান অধিকার, ওরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে দিব্যিই আছে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এ বন্ধনটা কিছুটা আয়নিক টাইপের। আয়নিক বন্ধনের মতো এখানে ইলেকট্রন কেউ দেয় না, নেয়ও না, এইটুকু ঠিক আছে। সমস্যাটা অন্যজায়গায়। যে ইলেকট্রনগুলো শেয়ার-করা অবস্থায় থাকে, সেগুলো আসে শুধু একজনের কাছ থেকে। যার কাছ থেকে আসে, বন্ধনে থাকার সময়ে সে ইলেকট্রনগুলো ব্যবহার করে। আবার যার ইলেকট্রন দেয়ার ক্ষমতা নেই, সেও ওই ইলেকট্রনগুলো সমান অধিকারে ব্যবহার করে। এখন কথা হল, এই যে একজন ইলেকট্রন দিল, আরেকজন কিছুই দিল না, আবার দুজনই ইলেকট্রনগুলো শেয়ার করছে সমান অধিকারে, এখানে দুজনেরই স্ট্যাটাস পুরোপুরি একই হবে, এটা তো আর হতে পারে না, তাই না? হয়ও না।

ধরা যাক, কোন ছেলে কোন মেয়ের বাবার কাছ থেকে টাকাপয়সা কিংবা উপহার নিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করল। বিয়ের পর ছেলেটা, মেয়েটা কিংবা মেয়েটার বাপের বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে সরবে কিংবা নীরবে খোঁটা শুনবে না, এটা কি হয়? ও ঘরজামাই হয়ে থাকুক আর না-ই বা থাকুক, ও কিন্তু আত্মসম্মান কিছুটা হলেও বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে। তাই ওর দায়িত্ব, চুপচাপ অনেক বড় বড় হক কিংবা না-হক কথা সহ্য করা। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, আহা! সুখের পরিবার! সুখের, ঠিক আছে। কিন্তু সে পরিবারের কর্তাটির পৌরুষ আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে আছে। বিয়ের পর মেয়েটি প্রায়ই ছেলেটিকে আঙুল উঁচিয়ে বলবে কিংবা অ্যাটিচিউডে প্রকাশ করে দেবে, “তুই তো আমার বাপের টাকায় খাস!” সে উঁচানো আঙ্গুলটা কিন্তু সারাজীবনের জন্য। এক্ষেত্রে ছেলেটি সবসময়ই মেয়েটির এবং মেয়েটির বাপের ফ্যামিলির কাছে ‘ইয়েস স্যার! ইয়েস স্যার!!’ অ্যাটিচিউডে থাকতে বাধ্য। শ্বশুরবাড়ির আদর হয়তো থাকবে, কিন্তু সম্মানটুকু নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। প্রকৃত পুরুষ সম্মানহীন আদর দীর্ঘদিন সহ্য করতে পারে না। মেয়ের ভাইও নিজের বোনের জামাইকে কখনওই মন থেকে সম্মান করতে পারবে না। বলতে পারেন, না না, এমন হয় না! আমি বলি, আরে ভাই, শোনেন! মেয়ের ভাই এত ভাল হলে তো আর লোকে মেয়ের ভাইকে ‘শালা’ বলত না!!

তো, যে প্রসঙ্গে ছিলাম। সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন। এ বন্ধনেও যার কাছ থেকে ইলেকট্রনগুলো আসে, সে আরেকজনের দিকে সবসময়ই স্বাভাবিকভাবেই একটা আঙুল উঁচিয়ে রাখে। মানে, যেহেতু শেয়ার-করা ইলেকট্রনগুলো আসলে ওর, তাই সে একটা অ্যারো সাইন দিয়ে ওকে বারবারই মনে করিয়ে দেয়, “তুই তো আমার বাপের টাকায় খাস!” বাকিজনের কিচ্ছুটি বলার থাকে না, কারণ ঘটনা তো সত্যি। এই উঁচানো-আঙুল, মানে অ্যারো সাইনটির ‘তাৎপর্য’ আশেপাশের সবাইই বোঝে, কিন্তু এমন ভাব দেখায় যে, এতে কোনকিছু মনে করার কিছুই নেই। মেয়ের বাবা তো মেয়ের জামাইয়েরও বাবা। আমিও বলি, অবশ্যই বাবা। কিন্তু পিতৃত্বের দাবি যেন পিতৃত্বের দায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে না থাকে। ওরকম কিছু হলে সহজ সম্পর্ক আর সহজ নাও থাকতে পারে।

আমি দেখেছি, মেয়ের বাবা ধনী হলে উনি পৃথিবীর সব ছেলেকেই দরিদ্র প্রেমিকের মতো ভাবেন, যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেই শ্বশুরবাড়ির বাজারটাজার করে দেয়ার জন্য। ওরা বিয়ের পর বিনা নিমন্ত্রণেই যখনতখন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে বলবে, “মা, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে! ঘরে যা আছে, তা-ই দিয়ে ভাত দ্যান।” উনি ধরেই নেন, পৃথিবীর সব ছেলেরই একমাত্র ধান্দা, বিয়ের পর উনার সম্পত্তির কিছু অংশ হলেও বগলদাবা করা। শ্বশুরবাড়ির কাজটাজ করে দেয়া কোনোভাবেই অশোভন কিছু নয় যদি সেটা ভালবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকে হয়, দায় থেকে নয়। এ ধরণের মেয়ের-বাবারা ছেলে কিংবা ছেলেপক্ষকে নিজে কিংবা কারোর মাধ্যমে নিজের অ্যাসেটের হিসাব দিতে বসেন। উনাদের ধারণা, সব ছেলেরই বুকের ওপরে একটা অদৃশ্য ট্যাগ লাগানো আছে : ফর সেল!

বিয়ের এই বাণিজ্যিক রূপটির জন্য কিন্তু কোনোভাবেই মেয়ের-বাবা এককভাবে দায়ী নন। আমাদের সামাজিক চালচলনই উনাদেরকে ওরকম করে ভাবতে বাধ্য করে। অনেক ছেলেকেই দেখেছি, নিজেকে বিক্রির জন্য সদাপ্রস্তুত। ভাববেন না, এটা শুধু অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত ছেলেরাই করে। আমি আমার ম্যাট্রিক-ইন্টারে ‘ডবল স্ট্যান্ড-করা’ ডাক্তার বন্ধুকে দেখেছি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বিয়ের সময় শ্বশুরের কাছ থেকে একটা ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি, আর নিজের চেম্বারের জন্য নগদ ৪০ লক্ষ টাকা নিয়েছে ‘আপন ভেবে’। আইবিএ’তে এমবিএ করার সময় অনেকেই পেয়েছি, যারা বলত, “বিয়ের সময় টাকা নেবো না কেন? আমার কি কোন দাম নেই?” এ কথা শুনতাম আর কোরবানির হাটের নাদুসনুদুস তেলতেলে গরুর কথা মনে পড়ে যেত। কত যত্নআত্তি করে গরুগুলিকে কোরবানির জন্য রেডি করা হয়! লোকে বেশি দাম দিয়ে গরু কিনবে, আর জবাই করার সময় গরুটি হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করলেও কিচ্ছুটি না বলে ‘ওরে আমার লক্ষ্মীসোনা, যাদুর কণা’ বলে বলে আহ্লাদ করে চুম্মা খাবে, এরকম তো হওয়ার কথা নয়। অনেক ছেলেকে দেখেছি, ওরা অপেক্ষা করে থাকে শ্বশুরের টাকায় সেটেল্ড হওয়ার জন্য। খুব হিসাবনিকাশ করে প্রেমে ফেলে বড়োলোকের বোকাসোকা আবেগি কোন মেয়েকে। এসব স্বাধীনতা আর আত্মসম্মান বিকিয়ে দেয়া ছেলেরাই মেয়ের বাবাদের মনের মধ্যে একটা স্টেরিওটিপিক্যাল চিন্তাভাবনা তৈরি করে দেয়। একটা সময়ে ওরা বিশ্বাস করে ফেলেন, সব ছেলেই বোধ হয় মেরুদণ্ডহীন।

নিজেকে, নিজের পরিবারকে আর স্ত্রীকে চালানোর মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোন ছেলেরই বিয়ের কথা মাথায় আনাও ঠিক নয়। যে এখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, সে আরেকজনকে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা দেবে কীভাবে? জীবনটা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতো নয়। প্রেম করলাম, আর ছেলেমানুষের মতো কাজী অফিসে গিয়ে ধুম করে বিয়ে করে ফেললাম! এসব কাজী-অফিসের-বিয়েটিয়ে কিংবা কোর্ট-ম্যারেজ কয়টা টেকে শেষ পর্যন্ত? আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন। এসব বিয়ে তো সাধারণত গোপন থাকে, তাই হয় ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মেয়েটার আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়, কিংবা এর আগেই নিজেদের মধ্যে ঝামেলাটামেলা বাধিয়ে ছেলেটা কিংবা মেয়েটা সম্পর্কটা আর রাখতে চায় না। জীবনের প্রত্যেকটা খামখেয়ালি বড় সিদ্ধান্তের জন্য আপনাকে চরম মূল্য দিতে হবে, এটাই নিয়ম। বিয়ের কাগজপত্র দেখিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেটা কিংবা কখনও কখনও মেয়েটা ব্ল্যাকমেইল করেছে, এমন ঘটনাও তো কম ঘটে না। স্রেফ ভালোবাসার জোরে বিয়ে টিকেছে কয়টা? যেগুলো টিকেছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেগুলোতে মেয়েটা কিংবা ছেলেটা ঘর ছেড়েছে। পরিবার আর সমাজ থেকে পালিয়ে পালিয়ে জীবন কাটানো তো আর বীরপুরুষের কাজ নয়।

ওপরের কথাগুলোর ভূরি ভূরি ব্যতিক্রমও আছে। প্রেমে পড়ার পর পুরোপুরি বদলে গেছে, এমন ছেলেও কম নয়। একেবারে বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো ‘চৌধুরী সাহেব’কে দেখিয়ে দিতে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছে, এরকম আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ছেলেরা নিঃসন্দেহে স্যালুট ডিজার্ভ করে। প্রেম পুরুষমানুষকে যেমনি দুর্বল করে দেয়, তেমনি সবল হতেও শেখায়। তবে দ্বিতীয়টির জন্য রিকশাভাড়া আর ফুচকার বিলটা দিতে জানতে হবে। সাধারণত প্রেমিকার টাকায় প্রেম-করা ছেলেরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে কম। ‘বিয়ের সময় শ্বশুরের কাছ থেকে হাতঘড়িটাও নেবো না’ এমন আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে নিজেকে পুরোপুরি বিয়ের যোগ্য করে তোলার আগেই বিয়ে? নৈব চ, নৈব চ!!

ভাবনা: ছয়শো উনচল্লিশ

………………………………………………………

এক।

একটাসময়ে ভার্সিটির টিচার হওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করতাম না, রেজাল্ট ছিল অতি খারাপ (২.৭৪), বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর বিন্দুমাত্র শিক্ষাগত যোগ্যতাও আমার ছিল না। এই একটা আফসোস ছাড়া আমার জীবনে আর তেমন কোনো আফসোস ছিল না।

আফসোস কেন? বলছি। একটাসময়ে এই সিক্রেটটা বলার মতো সাহস ছিল না। এখন আছে, তাই বলছি।

আমার দাদু অবিনাশ চন্দ্র পাল। বাংলার যশস্বী অধ্যাপক, কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে পড়াতেন। উনার বিশাল জমিদারি ছিলো মহেশখালীতে৷ এলাকায় দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দাদুকে যে কত মানুষ শ্রদ্ধার সাথে আজও মনে করে! দেখলেই গর্ব হয়! দাদু ছিলেন আবৃত্তিকারও। শৌখিন অভিনেতাও ছিলেন, মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। লেখালেখিও (‘ও’ যোগ ক’রেছি, কারণ সব অধ্যাপকই তো আর লেখেন না৷) করতেন মাঝে মাঝে৷ যুদ্ধের সময় উনার সব পাণ্ডুলিপি আর বইয়ের সংগ্রহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। উনার ব্যক্তিত্ব, রুচিবোধ আর শৌখিনতা ছিলো খেয়াল করার মতো। দেখতেশুনতে অতি সুপুরুষ ছিলেন। উনার পৌরুষ কিংবা ব্যক্তিত্বের ধারেকাছেও আমরা নাতিরা কেউ যেতে পারিনি। অল্প বয়সে মারা যান। দাদুর মৃত্যুর আগের একটা ঘটনা শেয়ার করছি……

“শালা হারামজাদা মীরজাফরের বাচ্চা!!” যারা সেইদিন নাটক দেখছিলো, তাদের ছুঁড়ে-মারা জুতা-স্যান্ডেলের আঘাতে দাদুর নাক-কপাল ফেটে রক্ত ঝ’রেছিলো৷ নাটকটা শেষ পর্যন্ত আর শেষ করা যায়নি৷ দাদুর আবৃত্তির ঢঙে বাংলা পড়ানোর তারিফ করতে শুনেছি অনেককেই৷ কানুনগোপাড়ায় কোয়ার্টারস্’এ থাকতেন, শখের বশে নাটক ক’রতেন৷ মামাদের মুখে শুনেছি, অনেক দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন দাদুর অভিনয় দেখতে আসতো৷ সেইদিনের সিরাজউদ্দৌলা নাটকে দাদুর অভিনয় দর্শকদের খেপিয়ে তোলে৷ সেইদিনের ঘৃণা দাদুর অভিনয়জীবনে অভিনব নয়৷ দাদু নেগেটিভ রোলে অভিনয় ক’রতে বেশি পছন্দ করতেন৷ মঞ্চনাটকে দর্শকদের ভালোবাসা সবসময় প্রত্যক্ষ না হলেও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই প্রত্যক্ষ৷ আমার দাদুর যে কয়েকজন বন্ধু, কলিগ ক্ষিপ্ত দর্শকদের সাথে হাঙ্গামা বাধানোর উপক্রম করছিলো, দাদু অনেক কষ্টে নিজেই তাদের বুঝিয়েশুনিয়ে নিবৃত্ত করেন৷

দাদু যখন মারা যান, তখন আমার মায়ের বয়স ৪ বছর, আমার ছোটমামার ৬ মাস। ভাইবোন সবাই পড়াশোনা করছে তখনও। সংসারের হাল ধরতে দাদুর মৃত্যুর পর আমার বড়মামা দীপক কুমার পাল একই কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন। পরে আরও কিছু সরকারি কলেজে ছিলেন। উনি চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতেন। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে উনি অপেক্ষা করতে পারেননি। মামা ফিজিক্স পড়াতেন। চেহারা আর শরীরের গঠন ছিল আলাদা করে চোখে পড়ার মতো সুদর্শন। অত্যন্ত আদর্শবাদী নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। অনেক স্টুডেন্টকে ফ্রি প্রাইভেট পড়িয়েছেন। অগণিত মানুষকে সাহায্য করেছেন। বড়মামাকেও বাংলাদেশের অনেকেই চেনেন।

দাদু আর বড়মামা এঁদের কেউই দীর্ঘজীবী ছিলেন না, দুইজনেই অপরিণত বয়সে মারা যান। কিন্তু উনারা এখনও অমর। অনেকেই উনাদের নাম শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে চোখের পানি মোছেন। দাদু-মামা’র স্টুডেন্টদের অনেকেই সমাজের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ছোটবেলা থেকে এসব দেখে দেখে বড় হয়েছি। সেই শিশুমনের মনের গভীরে এমন বড় হওয়ার একটা বাসনা প্রোথিত ছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু উপায় ছিল না। আমি যে একেবারেই নোবডি ছিলাম! তাই আফসোসটুকু বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা আমি করতে পারছিলাম!

এখন তাও আর নেই। বিভিন্ন ভার্সিটিতে আমন্ত্রিত হয়ে কথা বলতে যাই, স্বপ্ন দেখতে শেখাই। সবচাইতে বেশি স্টুডেন্ট ছিল রাজশাহী ভার্সিটির প্রোগ্রামে, অন্তত ২৫০০। ওরা বসে থাকে, ৬-৭ ঘণ্টা ধরে কথা শোনে। আমি ভাবি, এ বয়সে এত সময় ধরে বসে থাকে কীভাবে? স্যাররাও শোনেন। উনারা বলেন, এসবকিছু ভার্সিটিতে শেখানো হয় না। আপনি শেখান, আমরা সাথে আছি। স্যারদের ধন্যবাদ।

কখনও কখনও চোখের কোনায় জমে-ওঠা জল লুকাতে লুকাতে ভাবি, স্রেফ বেঁচে থাকলেও কতকিছু পাওয়া যায়! জীবন কাউকেই খালিহাতে ফেরায় না। As I can’t teach how to get grades, I’ve decided to teach how to live life. সবাই তো আর সবকিছু পারে না। হাতি গাছে চড়তে পারে না বলে যদি আমরা বলি, ও তো কিচ্ছু পারে না! তবে সে দোষ তো আর হাতির নয়।

গতকালকে এক ছেলে ফোন করল। ওর এবং ওর আশেপাশের সবার বিশ্বাস, ও জীবনে কিছু করতে পারবে না। কেন? জন্মগতভাবে ও বাম চোখে কিছু দেখতে পায় না, ডান চোখে একটু একটু দেখে। এরকম যারা, ওদের কেউ ভালবাসে না, শুধু করুণা করে। ওর ক্ষেত্রেও সবসময়ই এ-ই হয়ে আসছে। মানুষের অবহেলা ওকে পথের কাঙাল করে ছেড়ে দেয় প্রতি মুহূর্তেই। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন করে একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করতে থাকে, তেমনি করে একটুখানি ভালবাসার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে! ওকে কেউ কখনো ভালবাসেনি। এর ফলে ও সবসময়ই এসব নিয়েই ভাবতে অভ্যস্ত, ওর যা কিছু নেই, কোন কোন চাকরি ওর জন্য নয়, ওর কাউকেই কোনোকিছুই দেয়ার নেই। ওর সমস্ত ভাবনার শতকরা আশিভাগই কী কী ওর জন্য নয়, তা নিয়ে। প্রচণ্ড হতাশা, কষ্ট আর বিষণ্নতায় ওর প্রায়ই মনে হয়, চলে যাই। যাকে এ পৃথিবীতে কেউই চায় না, সে থাকেই বা কীভাবে? . . . . . . ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম। ওকে শেখালাম, কীভাবে করে সেই আশিভাগকে বিশভাগে নিয়ে এসে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। এ পৃথিবীতে শুধু কান্নাই ব্যক্তিগত। এটা নিয়ে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর সমান। কান্না সবার সাথে ভাগাভাগি করতে হয় না। সবাই আপনার কষ্টের দাম বুঝবে না। থাকুক না কিছু কান্না ব্যক্তিগত! কষ্টের শক্তি অনেক বড়। এর খোঁজ করতে জানতে হয়। . . . . . এমন আরো অনেককিছু বললাম। ওকে এটা বিশ্বাস করিয়ে দিলাম, পৃথিবীতে ওর মূল্য অনেক। যাদের কাছে ওর দাম নেই, তাদেরকে ইউজড টিস্যুপেপারের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। সাহসী হতে শেখালাম, শক্তি চিনতে শেখালাম। দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলে হেরে যাবে কেন? আমি চাই, কেউই হারিয়ে না যাক। যখন ওকে বললাম, ভাই, তুমি চাকরি পাওয়ার পর প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে মিষ্টি খাওয়াবে কিন্তু! তখন সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। আমি জানি, চোখের জল কখনো মিথ্যে বলে না। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, ও পারবেই!

দুই।

রেলস্টেশনে বুকস্টল কাম ফাস্ট ফুড কর্নার দেখলে বুঝে নিতে হবে, ওতে অত বই নেই, আপনি বড়জোর ‘৩০ দিনে হিব্রু ভাষা শিক্ষা’ জাতীয় কিছু বইটই পেতে পারেন। এখানে লোকজন ট্রেনের অপেক্ষায় থাকার সময়ে বই পড়ে না, বাদাম চিবোয়, একা একাই, প্রায়ই। দেশভেদে মানুষ তার আচরণ বদলায়। যে আমি কোরিয়াতে থাকার সময়ে একটা চুইংগাম খাওয়ার পর ফেলার জায়গা না পেয়ে ওটা টিস্যুতে লুকিয়ে পকেটে পুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরতাম একটা ডাস্টবিনের খোঁজে, সেই আমি কফির কাপটা না ভেবেই ইচ্ছেমতো ছুঁড়ে দিই এজন্য নয় যে এখানে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া অপরাধ হলেও প্রকাশ্যে ময়লা ফেললে কিছু হয় না, বরং এজন্য যে আমরা দেশটাকেই ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছি, তাই যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যা ইচ্ছে তাই ছুঁড়ে ফেলা যায়। এখানে ডাস্টবিনের বাইরে ময়লা থাকে, ভেতরটার দখল মানুষ আর কুকুরের। কেউ কাউকে কামড়াবে না, এই অলিখিত চুক্তিতে ওরা ওতে ঘুমায়।

পুরো দেশ ঘুরে দেখার সময় নেই, অথচ সে দেশের মানুষ কে কেমন, কী করে, কী ভাবে, কী খায়, জানতে চান? ওদের রেলস্টেশনটা একবার ঘুরে আসুন। দুঘণ্টা কাটান, জানা হয়ে যাবে। বাজি ধরে বলতে পারি, এর বাইরে কোনো ধরণের মানুষ সে দেশে নেই। সন্ত থেকে শয়তান, সবই পাবেন। মানুষের বিচিত্রতা আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। আপনার কাছে যে কাজটি করার কোনো অর্থই নেই, সে কাজটিই কেউ খুব গুরুত্ব দিয়ে করছে। এখানে অদ্ভুত সব ধান্দায় লোকজন ঘোরাফেরা করে। রাত মানুষকে বদলে দিতে পারে, রাতজাগা মানুষ আর দশটা মানুষের মতো না। সাধারণ মানুষের কাজ, রাত ১০টার মধ্যে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া।

রাত মানুষকে অন্য মানুষ করে দেয়। রাতের মানুষকে দিনের মানুষের পাল্লায় মাপতে যাওয়াটা বড্ডো বোকামি। স্টেশনে রাত বাড়ে, বাড়ে বিচিত্রতা। রাত বড় রহস্যময়। এ রহস্যের ক্ষমতা অসীম। একটা ছোট্ট পুতুলের মতন মেয়ে ওর খেলনাটা উঁচু করে ধরে এগিয়ে এল। ওর নরোম গাল দুটো টেনে দিচ্ছি, এমনসময়ে দেখলাম, পুলিশ একটা লোককে কী যেন জিজ্ঞেস করছে, আর ও কী একটা যেন পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই ভোঁ দৌড়। দেখলাম, ওটা গাঁজার পুরিয়া। দুটি অতিরূপসী তরুণী কী এক খুনসুটিতে মেতেছে। ওদের দেখছি, ভাল লাগছে, আর খুব করে চাইছি, ট্রেনটা আরো দেরিতে আসুক। হুমায়ূন আহমেদের গৌরীপুর জংশন’টা আবারো পড়তে ইচ্ছে করছে। এখুনিই!

বাইকে চেপে স্টেশন থেকে ফিরছি। একটা রাস্তার কথা বলি। নির্জন রাস্তা, সামনেপিছনে কেউ নেই, আলোও নেই। আছে কিছু জ্বলজ্বলে চোখ। ওগুলো বেড়ালের। আধাভৌতিক কিছু ছায়া। ওগুলো রাতজাগা গাছের। কয়েক টুকরা তীব্র পিলে চমকানো চিত্‍কার। ওগুলো শেয়ালের। এরকম আরো অনেককিছু। পুলিশ থামাল। আমরা কথা বলছিলাম আর ওরা জেরা করছিল। কেন জানি ওরা বেশিকিছু বলেনি। আমরা ওদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম খুব স্বাভাবিকভাবে। তাই হয়তো। সাধারণ মানুষ পুলিশ জেরা করলে ভয় পাবে, এরকম রিলাক্সড থাকবে না। এটাই নিয়ম। নিয়মভাঙা মানুষ খুব একটা সুবিধের হয় না। ওরা আমাদের সুবিধের ভাবেনি। ওসব শেষেটেষে ক্বীন ব্রিজের নীচে এলাম।

সুরমার পাড়ে বসে আছি। আশপাশের কেউ কেউ জেগে আছে, ওরা জাগেই, কোনো ধান্দায় না, এমনিতেই। ওরা দেখে রাতের নদী। রাতের নদীও কাউকে কাউকে বদলে দেয়। এখানে ওরা আসে বদলে যেতে। কেউ কেউ বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে বদলে যেতে ভালবাসে। ব্রিজের ওদিকটায় নষ্ট শরীর ঘিরে কিছু নষ্ট তরুণের মাতলামি। নষ্ট কেন বললাম? শরীর নষ্ট হয় নাকি? এ নষ্ট সমাজে শুধু প্রকাশ্য নষ্ট শরীরই নষ্ট শরীর। এর পাশেই কুকুরগুলো নোংরা ঘাঁটছে। ফুটপাথে নেই-ঘর মানুষগুলো শুয়ে আছে। নদীর জলের ছায়ায় চাঁদের সাথে রাতের বাতিগুলোর মিতালি চলছে। এইভাবে একেকটা পুরোনো রাত কেটে যায়। পাশের দোকানে চা খেতে এলাম। কালচে রঙের অতিজঘন্য চা। কুকুর সবচাইতে বিশ্রী ময়লাটা খাবে, তবুও এ চা খাবে না। সে চা আমরা খাচ্ছি বড় আয়েশ করে। মাথায় বাজছে, তুতুতু তুতু তারা, মর্জিনার বাপ মার্কা মারা . . . . . . এ অসময়ে এ গান ক্যান বাজে? হুদাই!

বাইকটা আবারো চলছে। কিছু স্বীকৃত মাথা-খারাপ মানুষ রাস্তার মাঝখানটায় নাচছে। বাইক থামল। এখন ক্বীন ব্রিজের ওপরে হাঁটছি। ব্রিজের রেলিং ধরে নিচের রাতের নদীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা এরকম, আগে জানতাম না। মনে হতে থাকে, আমিই নদী। গাড়ি ছুটে যায়, ব্রিজ কেঁপে যায়। এ রাতে যদি বাড়ি ফিরে না যাই, তবে কী হবে? কেউ তো আর আমার প্রতীক্ষায় নেই!!!

এমন একটা রাতে ২০-২৫ কিলোমিটার ভুল পথে বাইক চালিয়ে আসাটাকে মনে হতে থাকে এ মুহূর্তের সবচাইতে ঠিক কাজ। আমরা মহানন্দে ভুল করতে করতে ছুটতে থাকলাম। কিছু কিছু ভুল থাকে যেগুলো না করতে পারার আফসোসেই জীবন কেটে যায়। তীরের মতন করে ছুটে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া কাটতে কাটতে সামনের দিকে ভেসে যাওয়াটাই সবচাইতে আনন্দের মনে হতে থাকে। জীবন তো এখানেই! একটুপর ভুলে ঠিক পথ ধরে যাওয়ার আফসোসে গলা ছেড়ে বেসুরো গলায় গাইতে গাইতে মনে হতে থাকে, এ ভুল সুরও তো আরেকটা সুর, যেমনি করে ভুল পথও আরেকটা পথ। একটু আগেই ‘আজ জ্যোত্‍স্না রাতে, সবাই গেছে বনে’কে ফাইনাল কাউন্টডাউন’য়ের সুরে করলাম। খারাপ লাগেনি অতটা। বাংলাদেশি সিনেমার একটা গানের সুরে অন্য একটা গান করছি, অতি বিশ্রী স্বরে ও সুরে। পড়ে না চোখের পলক’কে গাইছি, ওই চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ’য়ের সুরে, সাথে কিছু লাইন দিয়ে সেটাকে র্যাপ সং করে ফেলছি। কখনো কখনো বিশ্রীভাবে গান গাইতে এত ভাল লাগে কেন?

নাজিমগড় রিসোর্টসে ঘুরতে এলাম। চারদিকটা এত সুন্দর! সারি সারি গাছ, মাঝখানে রাস্তা। টিলায় টিলায় সাজানোগোছানো নানানকিছু। গার্ড ভাইয়ের সাথে গল্প জমিয়ে ফেললাম। এখানে এক রাত থাকতে লাগে কমপক্ষে এগার হাজার ছয় টাকা। দেখলেই থাকতে ইচ্ছে করে! কিন্তু . . . . . . . যেখানে থাকি সেখানে ফিরলাম। গল্প করার কেউ নেই, ওই চাঁদটা ছাড়া . . . . . . . এই মোম জ্যোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি . . . . . . .

কৈফিয়ত। ‘একরাত’ কথাটি দেখে যাঁদের মনে হয়েছিলো, এই লেখায় কিছুমিছু ইয়েটিয়ে আছে, তাঁদেরকে উত্তম-সুচিত্রার ‘একটি রাত’ দেখে হতাশ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।

ভাবনা: ছয়শো চল্লিশ

………………………………………………………

কিছু সবিনয় নিবেদন—–

এক। যা বলার, সরাসরি বলবেন প্লিজ। এত ঘোরানোপ্যাঁচানো কথা বলার কিংবা বোঝার সময় নেই; সত্যিই নেই। দরকার হলে বলুন, “সুশান্ত, তুই একটা হারামজাদা।” আমি কিছুই মনে করবো না। এর ব্যত্যয় হলে একটাসময়ে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ একেবারেই চলে যাবে এবং আমি ধরে নেবো, আপনি একটা ভীতুর ডিম, যে সরাসরি কথা বলতে পারে না। আমি সাহসী মানুষ পছন্দ করি।

দুই। সাহস থাকলে আমার বুকে ছুরি চালাতে আসুন, পিঠে নয়। পিঠে হাত রাখলে যদি আপনার পেছনের মেরুদণ্ডটা এখনও অনুভব করতে পারেন, যদি পুরুষমানুষ হন, আমার চোখের সামনে আসুন, পশ্চাৎদেশের পেছনে নয়। পশ্চাৎদেশের পেছনে ঘোরাঘুরি করে শুয়োররা।

তিন। ভণ্ডামি করার ইচ্ছে থাকলে দয়া করে আমার ধারেকাছেও ঘেঁষবেন না। আমি শয়তানকেও সহ্য করতে পারি কিন্তু ভণ্ডকে কিছুতেই নয়। অন্য কোথাও যান। আপনার টাইপের পাবলিক খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমি পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ঘৃণা করি হিপোক্রিটদেরকে।

চার। পরিচয়ের সময় কোন ভুল তথ্য দেবেন না। আপনি যা, তা-ই বলবেন। আপনার সাথে আমার পরিচয় হতেই হবে এমন তো নয়। সত্যকে ভালোবাসার এবং মিথ্যাকে ঘৃণা করার —- এ দুই শক্তিই আমার অসীম! একটা কথা সোজাসাপটা বলে দিই : আপনার ছবি না দেখালে এবং আংশিক/ ভুল/ ইনিয়েবিনিয়ে পরিচয় দিলে আমি কারোর সাথেই গল্প করার বিন্দুমাত্রও আগ্রহবোধ করি না।

পাঁচ। ‘শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে’ আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী। আমার ঠিক কাজের প্রশংসা করে না, কিন্তু ভুল কাজের নিন্দা করে, এমন পরমহিতৈষী আমার দরকার নাই। ব্যক্তিগত আক্রমণকারীকে আমার ওয়ালে স্বাগতম। এতে আমার তাদেরকে লাত্থি মেরে বের করে দিতে সুবিধা হয়। বলতে পারেন, ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল’ ……… সরি বস! আমার এত্তো ভালবাসাবাসির টাইম নাই। অন্যকোনো প্রেমময় ভালবাসাময় ওয়ালে গিয়ে আপনার ভালোবাসা প্রদর্শন করুন। শুধু গঠনমূলক সমালোচনা করার যোগ্যতা থাকলে দয়া করে আমার ওয়ালে আসবেন। আমি তো কাউকেই দাওয়াত দিয়ে কিংবা পুলিশ পাঠিয়ে আমার ওয়ালে আনি না। প্রয়োজনে আমাকে ব্লক কিংবা আনফ্রেন্ড কিংবা আনফলো করে দিন।

ছয়। আমার চাকরি কিংবা আমার ব্যক্তিগত রুচি নিয়ে একটাও বাজে কথা বললে, আপনি যে শাহানশাহ-ই হন না কেন, আপনাকে সাথে সাথে ব্লক করে দেবো। আমার চাকরি আমার কাছে অনেক বড়। আমি খুবই নার্সিসিস্ট প্রকৃতির লোক এবং আমি নিজেকেই সবচাইতে বেশি ভালবাসি। আমাকে তদারকি করার আপনি কে? কারোর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমি বিন্দুমাত্রও আগ্রহবোধ করি না এবং আমি চাই, আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও কেউই কোন আগ্রহবোধ না করুক। আপনি এমন কে যে আমার ব্যক্তিগত জীবনে আপনার অযাচিত আগ্রহ কিংবা আজাইরা হস্তক্ষেপ আমি চুপচাপ মেনে নেবো? কিছু ব্যক্তিকে আমি এই অধিকার দিয়েছি। আগে নিশ্চিত হয়ে নিন, আপনি সে কিছু ব্যক্তির মধ্যে পড়েন কিনা। আপনি যখন কারোর গীবত করেন তখন দুটো ব্যাপার মাথায় রাখবেন। এক। আমার চেহারা অসুন্দর বললেই কি আপনার চেহারার সৌন্দর্য একটু বেড়ে যায়? দুই। হয়তোবা আপনার সম্পর্কে বলার মতো অতি জঘন্য বিষয় আছে কিন্তু সেসব কথা বলে বেড়ানোর মানসিকতাসম্পন্ন আপনার মতন ছোটলোকের অভাব আছে।

ওপরের কঠিন কঠিন কথাগুলো কাউকে আহত করার জন্য লিখিনি। বরং আমার এবং আপনার কারণে যাতে ভবিষ্যতে আপনি, আমি কিংবা অন্যকেউ আহত না হয়, সেজন্যই লিখেছি। আমি কোকিল-ময়না নই যে, যে কাউকেই দেখলে সাথে সাথে সুরেলা কণ্ঠে গাইতে শুরু করবো। ভণ্ডদের প্রতি আমি অতিদুর্মুখ। তাই দয়া করে দূরে থাকুন। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন, আপনি আপনার মতো থাকুন। Live & let live.

আপনাদের এবং আপনাদের পরিবারের জন্য শুভকামনা রইলো। ভাল থাকবেন।

ভাবনা: ছয়শো চল্লিশ

………………………………………………………

Life is beautiful only when we have a beautiful life.

I’m the eleventh one out of ten you can count, I can bet! . . . . I’m an optimist. I’m agree even to be the last optimist in the world. I’m born every moment. I believe life is more beautiful than we can imagine. So, I always enjoy it with others! 🙂 I’ve a personal library and a collection of music and movies. Without these treasures, my existence would become meaningless.

Let me share some lessons my life has taught me:

Among our batchmates, probably I was the first person who took the risk to explore the avenue of traditional business. But not always it’s easy to walk on the path less travelled. Educated entrepreneurs must have the guts to walk away from the apparently secured well-paid jobs and stay on that out-track at least as long as success shows its first sign. Things are not that easy. Now I’m a derailed engineer. I started with my coaching centre, later entered the stock market taking some calculated risk (God bless the investors including me! Your friend says, money is nothing? Ok fine, tell him to invest in the share market.) My succession of such attempts ended in establishing my own gift business branding by the name DOVANA. I owned 2 shops and I’d always dreamt of being a business magnet extending my domain over some other sister concerns as well till the date my dream transformed meeting newer impulses. (Lucky I’m as I did never have to regret for my new impulses.) Yes, I was planning to kill my brainchild. To become successful, you’ve to start young. It’s even more important to fail young if you really want to fail in any of your attempts. To fail successfully is an art. Now I feel, sometimes failures are good and life-saving. I always found myself in a position that I hardly seemed very comfortable with. When I saw my friends already having crossed a long way, I felt just helpless. Gradually they were becoming the top professionals in their respective sectors. If you’re not accustomed to being considered ‘Nobody’ by others since your childhood, it’s difficult to see yourself ‘Nobody’ even for a short time. I strongly felt only walking or running at least to catch them was not enough, I must take a flying leap! I was struggling to win, but fighting with small people was constantly giving me a hollow inferior feeling. I was out there alone on my own island, and I felt like I was disengaged . . . . . . . Even if you win by fighting with small people it gives you a feeling that you’re the kind of them, just a mediocre talent. Success in business is an extremely selfish game. Maybe, you’re thinking, ‘Huh! I’m already much selfish,’ but to have won more than others you would have needed to be more selfish than you really are. . . . . . . . . I always talked to my engineer batchmates (I belong to ’02batch) and used to insist we better start a software business. I found only a few really serious in words, fewer in action. The easiest way to start anything is just to start it. Everyone around me wanted to start a journey of a thousand miles; no one was willing to put even the first step. I know it’s true not always taking risks is easy especially when you’ve been brought up in a surrounding full of millions of NO’s. How easy it is to say NO to an attempt! Not always life sounds so easy as to stay indifferent to all the opportunity costs and be connected with your dream when it belongs to elsewhere contrary to common expectation. You start feeling that maybe you’re going to be a just nobody for whom just nothing is waiting. It’s horrible to be just a NOBODY to others. All the time you’re thinking, planning, hoping about your dream and at the same time wondering what would happen if you find yourself in the wrong place when it’s too late. (One thing I can tell you: Never it’s too late to realize it’s already getting late.) Life didn’t come to us with a user-manual. So, it’s our right to use and to abuse it! I can tell you for sure that playing with life is a wonderful game, but you must carefully make it sure that it remains wonderful at the end of the day. Winners stand alone only because only a few can really win. Living unremembered, unrecognized can give you the worst feeling, I can say. Not always life is so smooth as to stay complacent with, ‘I think, therefore I’m’ principle, life makes you feel the urge to start believing, ‘Others think, therefore I’m.’ Identity is more important than existence. Now I believe, deciding what you really want matters. It took me almost 2 decades to decide what I really want. When I’d decided finally, it took me only a few months to get what I really want. Whatever you do, job or business or anything else, you must work not only hard but also smartly to become successful enough to smile and not to be embarrassed seeing others smile at your previous ‘sweet failures’. Failures are never meant to be sweet. It’s your success that makes them sweet. Sometimes your best role model is only YOU in a better state you could be. Not always success is being anyone else you dream of being, rather being a new YOU better than previous YOU or not degrading your better YOU if you already are. Hardly, things not worth-challenging are worth-getting. Success is all about earning not deserving. The easiest way to make people admit you deserve something is only to earn it. Fact is, your success is what you think you earn, your failure is what others think you deserve. . . . . Success. It’s just living without sighs. It’s just dancing in the manner you want and making people think you dance well even if you don’t. It’s making your style others’ favourite brand even if it’s foolish. It’s sometimes making people laugh listening to your even worst jokes. It’s making others hear you even when you don’t speak. It’s taking the opportunity to tell others that meeting your previous millionth failure was essential, anyway. It’s making your failures worth-mentioning by you or by others. It’s just what it’s, not the opposite of failure as often popularly told and wrongly believed. Throughout my life I’ve followed a simple technique. I always have the highest respect for any peak I’m trying to reach and I make the successful persons my heroes. It gives me a great drive! Really! Even a child wants to become the hero he dreams of. It’s easy to work for something when you really admire, in any job, in any business. Your business is like your child. You cannot expect your child to be a complete man overnight. Similarly, you cannot expect your business boom before you become used to the bitter reactions from the people around you. People have a natural talent of undermining your attempts to which they are not familiar with or don’t feel comfortable about. There are some people who can never appreciate. So, it’s foolish to judge yourself by what they say. Kind words are healthier than chicken soup. Have a bowl of healthy soup—-served (if you’re lucky enough) or self-served (if you want to make your own luck). Get busy living. I’ve always found this: learnt free, lost paid. So, invest before you earn. Get inspirations from people who never stop before they cross the miles to go before they sleep. Quitters are never winners. Que sera, sera—Whatever will be, will be. Things are that they’re, things will be that they’ll be. If you quit, only you quit. Some won’t quit and will reach the peak. The easiest way to finish something is to start it. Once you start, you’re surely on the way to the end. If you finish before it finishes, you must search for another way. Not always a new way is better rather sometimes it brings newer pains. If you still don’t know what to do, ask your heart. Do what you love, love what you do. Your heart strangely somehow knows better than you. Never ask a blind man to help you cross the road because he is also trying or has failed to cross it. If you can’t see ask someone who has already seen. Better to live 1 minute with a wise man than to stay 1 hundred years with an idiot. First decide, deserve and then desire. These 3 D’s can give you what you and others want from your life. Not always life is easy, but it’s still worth-living. Tough time doesn’t last long for the tough men. Be that tough. Don’t tell the world what you can do, let the world tell it for you. Your actions speak much louder than your words. Don’t challenge others, challenge yourself because at the end of the day what all you’re left with, is only yourself. It’s never too late, rather being late is good as you’ve already paid the price for mistakes that others haven’t yet. Know what to do, learn how to do it and JUST DO IT! Be that tough guy for whom time waits as he has refused to shape his life with time, by time, for time. Remember, only your results are rewarded, not your efforts. This is the way the world accepts or rejects you.

~ Never take anything for granted, even your failure.

~ Never call it a day until & unless the day ends.

~ Only your results are rewarded, not your efforts.

~ Really perform when you’re performing.

~ Only your performance performs, not my prayers or curses.

~ Sometimes your luck matters much more than your performance.

~ Excuses are of no use. If you win, you need not show them. If you lose, you should not show them.

~ The game is always ON. So . . . . . . . JUST PLAY!

Good luck!

ভাবনা: ছয়শো একচল্লিশ

………………………………………………………

গ্লোরিয়া জিন্সে বসে কফির অর্ডার দিলেন। কফি এলো। ২ চুমুক দিলেন। আহ অপূর্ব! হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা বিশ্রী পোকা উড়ে পড়লো কফির মগে। এখন কী করবেন? কফিটা খেয়ে নেবেন? নাকি, ফেলে দেবেন? ফেলে দিলে তো টাকাটাও জলে গেলো। কিন্তু একটা মড়া পোকা ভাসছে, এরকম কফি তো খাওয়াও যায় না। কী করা যায়? এতো দামী কফি! টাকা জলে দেয়ার কষ্ট অনেক! ভাবছেন তো ভাবছেনই! সময় কেটে যাচ্ছে, তবু কফির দামের মোহ কাটছে না। এভাবেই কাটলো অনেকটা সময়। ওয়েটার বিল দিয়ে গেলো। বিলটা মিটিয়ে মেজাজ খারাপ করে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। আজকে শতাব্দীকে পড়াতে যাওয়ার কথা ছিলো, আন্টি আজ বেতন দেয়ার কথা, তার উপর কালকে ওর ম্যাথ সেকেন্ড পার্ট এক্সাম। দেরি হয়ে গেছে, মনমেজাজও ভালো না। আজকেও গেলেন না। গত ৩ দিন ধরেই যাচ্ছেন না। আন্টি ফোনে বলেছেন, বাবা, তুমি না পারলে শতাব্দীর জন্যে একজন ভালো টিচার খুঁজে দাও। সামনেই তো ওর ইন্টার পরীক্ষা। ভাবতে লাগলেন, টিউশনিটা আর থাকবে না বোধ হয়। শালার কফি! পুরোই ফ্রুটলেস! পয়সাও গেলো, সময়ও গেলো। মেজাজ তো খারাপ হলোই। এই বাজারে একটা টিউশনি ম্যানেজ করা যে কী কষ্ট, একে ধরা লাগে, ওকে ধরা লাগে। হাতে ধরে এভাবে কেউ টিউশনি খোয়ায়?! আরেকটু আগে বের হলেই তো টিউশনিটা আর মিস হতো না। নিজের মাথার চুল নিজের হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। থাক, না ছিঁড়ি। চেষ্টা করলে টিউশনি আরেকটা ম্যানেজ করা যাবে, কিন্তু চুল তো আর ম্যানেজ করা যাবে না। হেয়ার প্ল্যান্টেশনে অনেক খরচ! টিউশনির বেতনের ডাবল। শতাব্দীর বাবা অতো টাকা দেবেন না। শালা হাড়কিপ্টা; বেতন বাড়ায়ই না। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলেন! ম্যানহোল ছিলো, খেয়াল করেননি।

টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না, তাই অনেক চেষ্টা করে দ্বিগুণ দাম দিয়ে দুইটা টিকেট কোনোরকমে ম্যানেজ করলেন। আপনার স্ত্রী সহ মুভি দেখবেন। ব্যাপক হিট মুভি! টিকেটই পাওয়া যায় না। ভালো তো হবেই! মুভিটা সম্পর্কে কোনো রিভিউ না দেখেই তাই ২টা কিনে ফেললেন বউকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে! বাসায় ফিরেই চিল্লাচিল্লি করে বউকে বললেন, চোখ বন্ধ! দেখ দেখ কী এনেছি! তুমি কালকে সন্ধ্যায় ফ্রি তো? বউ টিকেট দেখেই অগ্নিশর্মা! তোমার রুচিবোধ এই পর্যায়ে নামলো কবে থেকে? এসব সস্তা মুভি না দেখলে তোমার হয় না? ছিঃ! আমি যাবো না তোমার সাথে। তুমি কোনো সস্তা রুচির মেয়েকে নিয়ে মুভি দেখে আসো গিয়ে। আপনি বুঝিলেন, ইহা অনুরোধ নহে, ইহা থ্রেট। ড্রেস না ছেড়েই তখুনি নেটে রিভিউ দেখতে বসে গেলেন। আসলেই মুভিটা আপনার রুচির সাথে যায় না। কিন্তু, কী যুদ্ধ করেই না টিকেটটা ব্ল্যাকারের কাছ থেকে ম্যানেজ করলেন! ভাবলেন, ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিই। দেখি, কেউ কিনে কিনা। অ্যাট লিস্ট টিকেটের দামটা অন্তত উঠুক। দিলেন স্ট্যাটাস। আপনার বন্ধুরা আপনাকে পচাতে পচাতে দুর্গন্ধ করে ছেড়ে দিলো। কেউ একজন কমেন্টে লিখলো, শালা খারুজের বাচ্চা! মুভি আর পাস না। তুই এই টিকেটও পয়সা দিয়া কিনসস! আবার কস, ডাবল দামে না বেইচ্যা অরিজিনাল দামে বেচবি! ……. দেখলেন, আপনার স্ট্যাটাসে লাইক ২টা, আর ওই কমেন্টে লাইক ১৮টা! বউ দেখে বললো, এই টিকেট বেচার স্ট্যাটাস দিতে তোমার লজ্জাও করলো না? …….. নারিকেল গাছ খুঁজতে লাগলেন, নারিকেল গাছের আগায় উঠে গলা ছেড়ে কাঁদতে পারলে অন্তত একটু শান্তি লাগতো। নাহ! একটাও নারিকেল গাছ নাই আশেপাশে, সব কয়টা ডাব গাছ। পরেরদিন সন্ধ্যায় একবুক সাহস সঞ্চয় করে বউকে জিজ্ঞেস করলেন, চলো না, না হয় দেখে আসি। বাসায় তো আর তেমন কোনো কাজ নাই। বাসায় রান্না করার দরকার নাই, আজকে আমরা বাইরে ডিনার করবো। বউ টিকেট হাতে নিয়েই ছিঁড়ে ২ টুকরা করে বললো, ওয়াও! গ্রেট! চলো, আজকে বাইরে ব্যুফে খাই! প্যাঁচা প্যাঁচা মুখ করে ভাবতে লাগলেন, হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি! শালার সিনেমার গুষ্ঠি কিলাই!!

একটু ভাবুন তো!

যদি রেস্টুরেন্টে কফিটা ফেলে রেখেই বিলটা দিয়েই উঠে পড়তেন, তাহলে কিন্তু অতো ঝামেলা আর হতো না।

টিকেটটা জাস্ট জানালা দিয়ে প্রথমেই ছুঁড়ে ফেলে দিলেই কিন্তু আপনার দুনিয়ার পেইন আর নিতে হতো না।

যে টাকাটা জলে গেছে, সেটা তো গেছেই! মানে, জলে ডুবে গেছে। The cost sank. So, it’s a sunk cost. জলে ডুবে যাওয়া টাকার জন্যে মন খারাপ করে থাকতে হয় না। কোচিং সেন্টার বন্ধ করবো করবো করেও করা যায় না। কতো সময় দিয়েছি এটাকে আজকের অবস্থানে আনতে! কী পরিমাণ কষ্ট করে না খেয়ে না ঘুমিয়ে একার হাতে এতো বড়ো একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো! কোনো কাজ শুরু করার সবচেয়ে সহজ উপায় একটাই, কাজটা শুরু করে দেয়া। একটা কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়ার একমাত্র উপায়, চিন্তাভাবনা ছাড়াই কোচিং সেন্টারটা বন্ধ করে দেয়া। টিউশনি ছেড়ে কম বেতনে চাকরিতে ঢোকার একটাই উপায়, টিউশনি ছেড়ে দেয়া। ব্যবসা ছেড়ে দেয়াটা খুব খুব কঠিন একটা কাজ। একটা দোকান নিজের সন্তানের মতো। কতো যত্ন করে, কতো ত্যাগ স্বীকার করে, কতো সময় আর টাকা ইনভেস্টমেন্ট করে, কতো মানুষের বাঁকা কথা শুনে, কতো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হয়! যদি সেটা ছেড়েই দিতে হয়, তবে ঠিক ওই মুহূর্তে ছেড়ে দেয়াই সবচেয়ে ভালো। দেরি করতে করতে বেটার অপরচুনিটি মিস হয়ে যেতে পারে (এবং যায়)। শেয়ার মার্কেটের লাখলাখ টাকা জলে গেলো, আর আমার চোখের জলে অন্য সব স্বপ্নগুলোও ভেসে গেলো। কতোজন থেকে টাকা পাই! জানি ওরা কেউই আর টাকাটা ফেরত দেবে না। তবুও আমি শুধু মন খারাপ করে থাকি, টাকার কথা ভাবতে থাকি। জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম, তার জন্যে এতটা পথ এতো কষ্ট করে পাড়ি দিয়ে আজকের দিনে যখন অন্য একটা বেটার সুযোগ পেয়েও শুধু এতোটা কষ্টকে ডুবে যেতে দেবো না ভেবে, ট্র্যাক চেঞ্জ করলাম না, পরে আফসোসে আফসোসে জীবনটা কাটলো। যার সাথে সারাটা জীবন কাটাবো ঠিক করেছিলাম, আমার নিজের জীবনটা প্রতিটি মুহূর্ত আমি হিসেব করে নিয়েছিলাম ওর মতো করে, যদি কখনো দেখি, ওর হাতে অন্য কারোর হাত; সে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে সেই কবেই, আমি বুঝতে পারিনি এতোদিন; তবুও কি নিজেকে ওর প্রতীক্ষায়ই শেষ করে দেবো, শুধু ওর জন্যে আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বলে?

যা চলে গেছে, আর ফিরবেই না, যাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে প্রাপ্তি একটাই — কষ্ট, যার জন্যে আমার নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত অচেনা হয়ে যাচ্ছে, যাকে ছুঁড়ে ফেলে না দিলে হয়তো বা সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো আসার আগেই একেবারেই হারিয়ে যাবে, তা হলো সাঙ্ক কস্ট। ডুবে যাওয়া খরচ; হোক সেটা পার্থিব কিংবা অপার্থিব। শুধু প্রেমিকা ছাড়া আমি ওপরের সব ক্ষেত্রেই প্রচণ্ডভাবে অসফল একজন মানুষ। প্রেমিকা আসে-ই তো নি, যাবে কী? আইবিএ’তে ফাইন্যান্সে এমবিএ কোর্সে আমি যা কিছু শিখেছি, তার মধ্যে আমার কাছে বেস্ট কনসেপ্ট মনে হয়েছে, সাঙ্ক কস্ট। আমার জীবন থেকে যে অবিশ্বাস্য রকমের অর্থ আর সময় হারিয়ে গেছে, যেটার যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে ফিরতো দিনরাত সবসময়ই, সেটাকে তাড়িয়ে দিতে এতো সুন্দর যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমি আর কোথাও পাইনি। পুরোনো ব্যথা-ক্ষতি-কষ্ট-হতাশা-দুঃখ সবকিছু ভুলে গিয়ে ছেড়েছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে চলার জন্যে এই সাঙ্ক কস্ট কনসেপ্টটার প্রভাব অসামান্য।

ভাবনা: ছয়শো বিয়াল্লিশ

………………………………………………………

সকাল ৬:৪৫টায় ফোনটা বেজে উঠলো। ঘুমঘুম চোখে রিসিভারটা তুলতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো…. Hello! Is it Mr Paul?

Yes.

Morning. Could you please come at the 2ndfloor? RILO meeting will be held here.

Good Morning. The meeting is at 10. I’ll be there on time. Thank you.

বলেই ফোনটা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাবলাম, ব্রেকফাস্ট করতে ডাকছে বোধ হয়। এই মুহূর্তে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আরো ২ ঘণ্টার ঘুম নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

আর কেউ বিরক্ত করলো না। আরো দেড় ঘণ্টা আরাম করে ঘুমালাম। মোবাইলের ঘড়িতে যখন সোয়া ৮টা তখন চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে রিস্ট ওয়াচে দেখি সোয়া ১১টা বাজে। কিছুই বুঝলাম না। ভাবলাম, গতকাল রাত থেকে ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। রোমানসন’কে একগাদা গালাগালি করে বাথরুমে গিয়ে দেখি, রোমানসনের ভূত সেখানেও চেপেছে। এবার আর বুঝতে দেরি হলো না। মোবাইলের ঘড়িতে সময়টা ঠিক করা হয়নি। ওটা বাংলাদেশের সময়, ৩ ঘণ্টা পিছিয়ে। আমাদের দিনগুলো যেভাবে ঘড়ির ছকে বাঁধা তাতে মনে হয়, দরোজা-জানালা বন্ধ করা থাকলে ঘড়িতে ৬টা মানে সকাল ৬টা, নাকি রাত ৬টা, সেটা বোঝা মুশকিল। কতক্ষণ ঘুমাচ্ছি সেটার চাইতে বেশি জরুরি হলো, ঘড়িতে কয়টা বাজে। যে জীবন ঘড়িতে চলে, সে জীবন মাঝে মাঝে ঘড়িতেই থমকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।

এরপর শুরু হলো দৌড়। তাড়াহুড়ায় গাল কেটে শেভ করলাম। গায়ে কোনোরকমে স্যুটটা চাপিয়ে দিলাম দৌড়! আমার ভাগ্য ভালো আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেমিনার সেটারই দোতলায়। প্রথম প্রেজেন্টেশনটা তখনও চলছিলো। আমি পৌঁছার ১০ মিনিট পর ওটা শেষ হলো। এরপর কফি ব্রেক। মিস লি’র সাথে দেখা করে সরি বলে বললাম, I’d a severe headache this morning. I’m really sorry that I missed the 1st part of the presentation. মিস লি কাজপাগল মানুষ। কাজ ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝেন না। আমার এই মিথ্যেটা ধরতে পারলেন না। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, Oh! I’m sorry for you. Are you OK now? Please get the reimbursement of your airfare and other expenses. আমি তো মহাখুশি। ওরা প্লেনের ভাড়া থেকে শুরু করে সব খরচাপাতি দিয়ে দিলো। মিস লি এই অনুষ্ঠানের সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। খুব সিরিয়াস টাইপের মানুষ। উনাকে মেইল পাঠালে রিপ্লাই পেতে মাত্র বেশি হলে ২ ঘণ্টা লাগে। বিদেশিরা ইমেইলকে খুব গুরুত্ব দেয়। ওরা আমাদের মতো দিনক্ষণ দেখে শুভদিনে মেইলবক্স চেক করে না।

কফি ব্রেকের সময় ফিজি থেকে আসা বিশালদেহি দ্রিসিকে কথায় কথায় বললাম, Brother, I regret missing the early part of the previous presentation. উনি সাথে সাথেই উত্তর দিলেন, Brother, I regret not missing it. You were lucky enough to have a headache. এইসব সেমিনারে প্রেজেন্টেশনগুলো সাধারণত খুব মজার কিছু হয় না। তবে WCO থেকে আসা প্রেজেন্টার ভদ্রমহিলাকে দেখার জন্য হলেও এই প্রেজেন্টেশন শোনা যায়। উনি ড’কে দ আর ট’কে ত উচ্চারণ করেন। এই যেমন তুদে’স সেমিনার উইল অ্যাড …….

কফি ব্রেকের পরেও উনিই প্রেজেন্টেশন দিলেন। দীর্ঘ প্রেজেন্টেশন! সুন্দরী মহিলার লেকচার শোনার সবচেয়ে বড় লাভ হলো কে কী ভাবছে এটার চিন্তা না করেই সুন্দরীর দিকে দীর্ঘ সময় ধরে ইচ্ছেমতো তাকিয়ে থাকা যায়। আমি লেকচার শুনছি আর আশেপাশে কে কী করছে দেখছি। আমার পেছনেই একটা মিষ্টি চেহারার কোরিয়ান কাস্টমস অফিসার বসেছিলো। অতি চঞ্চল মেয়ে! সারাক্ষণই হাতের আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। চোখে চোখ পড়লেই চোখ পিটপিট করে মাথা নড করে হ্যালো বলে। একটু দূরে বসে ছিলো থাইল্যান্ড থেকে আসা স্বচ্ছবসনা সুন্দরী। চোখ আর মন দুটোই ওদিকে চলে যায়। কোরিয়ান ছোটোখাট গড়নের মেয়েটা পাশের চীনা কিউট ছেলেটার সাথে কিচিরমিচির ভাষায় সারাক্ষণই বকবক করছে। আমার একপাশে বসেছিলেন মিস লি আরেক পাশে ভুটান থেকে আসা আরেক ডেলিগেট। আমি RILO’র দেয়া খাতায় কোরিয়া থেকে কী কী কিনবো সেটার লিস্ট করছিলাম আর আমার নিজের চোখ দুটো কীভাবে দুইদিকে উপরে টেনে ধরলে আমাকে কাইমুরার মতো দেখাবে, সেটা ভাবছিলাম আর খাতায় মজা করে ওসব লিখছিলাম। কাইমুরা জাপান থেকে এসেছে। ও ওই ছোটো ছোটো চোখে দেখে কীভাবে কে জানে! হঠাৎ পাশের লি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, You’ve to make a presentation when you’re back to your country. So, you’re taking notes. Right? আমি ভাবলাম, এই সেরেছে রে! দ্রুত বাংলায় লেখা শুরু করে ওকে বললাম, Oh! Yes yes! I’m just taking important notes. লি Very good বলে আবার প্রেজেন্টেশনে মন দিলো। বাংলার অপার মাহাত্ম্যে আমি মুগ্ধ হলাম। লি যদি এখন আমার কাছ থেকে খাতাটা চেয়েও বসে, তাতেও কোনো সমস্যা নাই। পুরো সেমিনার হলে আমি ছাড়া আর কেউ বাংলা জানে না। প্রেজেন্টেশন শেষে ডিসকাশন পার্টে প্রেজেন্টার ভদ্রমহিলা প্রেজেন্টেশন থেকেই একটা প্রশ্ন করলেন। কম্পিউটার ডাটাবেজ নিয়ে পড়াশোনা থাকলে প্রশ্নটার উত্তর করতে সহজ হয়। অনেকে অনেকভাবে এটার উত্তর দিলো। আমারটা শুনে উনি বললেন, This method could be more effective if implemented. You’re from Bangladesh, right? Bangladeshi officers are cool! সবাই করতালি দিলো। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালোকিছু শুনতে পারাটা অনেক বড় কিছু। ওই সময়ে কী যে আনন্দ হচ্ছিলো, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমি কখনোই ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি, হইনিও; এটা নিয়ে যতোটা খুশি ছিলাম, তার চেয়ে আজকে অনেকবেশি খুশি হলাম, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলাম, এটা ভেবে। প্রিয় চুয়েট, আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হলে লোকে আমাকে দেখিয়ে তোমাকে যতোটা সাদামাটা ভাবতো, এখন তার চেয়ে অনেকবেশি গর্জিয়াস ভাবে আমি ইঞ্জিনিয়ার হইনি বলে। তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি এই অধমকে এখনো সম্মানিত করে যাচ্ছো। শেষের প্রেজেন্টার এ্যাঁ উঁ অঁ করে কোরিয়ান ভাষায় ইংরেজি বলেটলে কোনোরকমে স্টেজ ছেড়ে পালালো। ওর প্রেজেন্টেশনের সবচাইতে বোধগম্য ইংরেজি ছিলো, একেবারের শেষের থ্যাঙ্ক য়্যু’টা। ইংরেজি বলার অদক্ষতা কিন্তু বাঙালি মাত্রেরই একক সম্পত্তি নয়।

আজকে রাতে কোরিয়ান কাস্টমসের সৌজন্যে একটা ওয়েলকামিং ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিলো। লাঞ্চে আর ডিনারে মোটামুটি পরাক্রমশালী অক্টোপাস থেকে শুরু করে নিরীহ বিস্কিট পর্যন্ত সবই ছিলো। বাঙালির ভাতের চিহ্ন ছিলো শুধুই ৮ রকমের কোরিয়ান সুসিতে। সি-ফুডের প্রাধান্য ছিলো দেখার মতো। শামুক-ঝিনুক-স্টার ফিশ-স্কুইড-টুনা ফিশ-মমের লাঞ্চন গল্পের স্যালমন ফিশ আরো বিচিত্র সব আইটেম। অনেক খাবারের নামও শুনিনি কখনোই। ব্যুফে খাওয়া শুরু হয়েছিলো রেড ওয়াইন দিয়ে, শেষ হলো কফিতে। আমি মোটামুটি সব আইটেমই টেস্ট করেছি। খাবার টেস্ট করার ধরণে নিজেকে মিস্টার বিন মিস্টার বিন লাগছিলো। কোরিয়ান মেয়েটা আমার কাণ্ড দেখে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো, তুমি যে সবকিছু খেয়ে ফেলছো, তোমার গড তোমাকে বকবে না? তোমাকে কী অনেক কান্নাকাটি করতে হবে ক্ষমা পাওয়ার জন্যে? আমি বললাম, না বকবে না। আমার সাথে আমার গডের রিলেশন ভালো। আমিও উনার কোনো কাজে মাইন্ড করি না, উনিও আমার কোনো কাজে মাইন্ড করেন না। এটা শুনে ও কিচিরমিচির করে হাসতে লাগলো। বললো, না, আমি শুনেছি, তোমার দেশের গড খুব রাগি। কিছু করলেই কঠিন কঠিন সব শাস্তি দিয়ে বসেন। ভাবতে লাগলাম, ইসশ! এই মেয়েটা এতো কিউট কেনো? এর মধ্যে কয়েকজন এসে আমার খোঁজখবর নিলেন। লি ওর কয়েকজন কলিগকে বলে দিয়েছিলো, বাংলাদেশ থেকে আসা মিস্টার পল আজকে সকালে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এখন আমি কেমন বোধ করছি। লি’র বসও এসে জিজ্ঞেস করলো, আমার কোনো মেডিসিন লাগবে কিনা, আমার রুমে ডক্টর পাঠাবে কিনা। ওদের সারল্য, আন্তরিকতা, বিনয়, আতিথেয়তা, সততা মুগ্ধ করার মতো। লি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে আমি মিথ্যে বলেছি। ওদের মাথায়ই এটা আসে না যে কেউ এটা নিয়ে মিথ্যে বলতে পারে। ওরা যেটার দায়িত্ব নেয় সেটার যত্ন নিতে জানে। মিথ্যে বলা, ঠকানো, চুরি করা, ফাঁকি দেয়া এইসব ওদের মধ্যে নেই। আজকে লি’র সাথে মিথ্যে বলে আমার যতোটা আফসোস হয়েছে, সেটা আমার জীবনের সব সত্য বলতে পারার তৃপ্তির চাইতেও বেশি। কাউকে হাজারটা মিথ্যে বিশ্বাস করানোর কষ্টের চাইতে ওর একটা মিথ্যে বিশ্বাস করার সারল্য বেশি কষ্ট দেয়। প্রচণ্ড লজ্জা আর অনুতাপ আমাকে ছেয়ে ফেলেছিলো। আমি মনে মনে ঠিক করেছি, আর কখনোই কোনো কোরিয়ানের সাথে মিথ্যে বলবো না। জাপানি ছেলেটার সারল্যও মনে রাখার মতো। ও আমার সাথে কথা বলে এতোটাই মুগ্ধ, ও আমাকে টোকিও যাওয়ার টিকেট পর্যন্ত পাঠাতে চেয়েছিলো।

রাতের খাবার খাওয়ার সময় ইন্সট্রুমেন্টাল শো’র আয়োজন করা হয়েছিলো। তিনজন নিখুঁত সৌন্দর্যের কোরিয়ান তরুণী খাইয়াকুমে ওখানকার পুরোনো ঐতিহ্যবাহী অপূর্ব সুর তুলে আজকের সন্ধ্যাটাকে স্বপ্নের আবেশে জড়িয়ে দিয়েছিলো। যন্ত্রটা বাজানো বেশ কঠিন। ওদের বাজানোর প্রতি যত্ন আর পেশাদারিত্ব যেনো পুরো কোরিয়ার সমৃদ্ধির চাবিকাঠির খোঁজ দেয়। রুমে ফিরলাম ৯টার পর। ফিরে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। আমার বিছানাটা খুব সুন্দর করে গোছানো, টেবিলে নতুন পানির বোতল রাখা আছে, এলোমেলো প্যান্টশার্টগুলো কে যেন গুছিয়ে রেখে গেছে। রুমে জিনিসপত্র ছড়ানো অবস্থায় নেই, কেউ একজন আমার অনুপস্থিতিতে পুরো রুমটাকে ঝকঝকে করে রেখে গেছে। আমার ডলারের খামটা যেমন ছিলো তেমনই টেলিফোনের পাশে আছে। ভেতরের ৭৫০ ডলারও ঠিকঠাক আছে। পাসপোর্টটাও ঠিক আছে। আমার রুমে একটা সিকিউরিটি লক আছে। সেটাতে আজকে তাড়াহুড়ায় কিছু রেখে যাইনি। জগতের সকল অসৎ লোক মিলে তালা ব্যবসায়ীদের প্রমোট করে। যে লোকটা রুম চেক করতে এসেছিলো, সে একটা দামি জিনিসও সরায়নি। কোরিয়া, জাপান এইসব দেশের মানুষ কোনো ধর্মীয় আচারআচরণ পালন করে না। ধর্মের মূলকাজগুলো কিন্তু ওরা ঠিকভাবেই করে। আমরা মৃত্যুর পর বেহেস্তে যাওয়ার আশায় ধর্ম পালন করি, আর ওরা বেহেস্তে মৃত্যুর আশায় ধর্ম পালন করে। আমাদেরটা যতোটা আরোপিত, ওদেরটা ততোধিক স্বতঃস্ফূর্ত।

ভাবনা: ছয়শো তেতাল্লিশ

………………………………………………………

একটুআগে জিমেইলে চেপে আমেরিকা থেকে কিছু কথা উড়ে এল।

সেখানে লেখাঃ

বন্ধু, খুব কষ্টে আছি। একটু দোয়া করিস। এইতো সেদিনও টানা ১৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিউটি করলাম। সেলসম্যানের চাকরি খুব কষ্ট বন্ধু, খুউব! প্রায়ই ভাবি, এখানে কেন এলাম? কতো রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না, ট্যাক্সি চালাতে হয়। ওয়েটারের কাজও করেছি, লোকজনের কাছ থেকে হাত পেতে বকশিস নিয়েছি। দেশের কথা মনে পড়ে রে বন্ধু। কিচ্ছু ভালো লাগে না। এখানে কেউ আমাকে চেনে না। তাই এসব কাজটাজ করে বেঁচে আছি বন্ধু। পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে হয়, চেহারা দেখে পাস করানোর ভার্সিটিতে ভর্তি হইনি। শেষবার কবে আরাম করে ঘুমিয়েছি, মনে পড়ে না। এখন ভাবি, আগেই ভালো ছিলাম।

বন্ধুর মেইল পড়ে কষ্ট লাগলো। আবার ঠোঁটের কোনায় নিজের অজান্তেই একটা বাঁকা হাসির রেখাও উঁকি দিয়ে গেল বোধহয়। কেন? পুরোনো একটা দিনের কথায় ফিরে যাই।

২০১০ সালের একটা বৃষ্টিস্নাত দুপুরবেলা। তখন আমি দোকানদারি করি। চট্টগ্রামের চকবাজারের গুলজার টাওয়ারের দোতলায় মুখোমুখি দুটো দোকান; আমার গিফটশপ দোভানা। আমার দোকানে একজন কর্মচারী ছিলেন; পীযূষদা। সেদিন সকালের দিকে উনার ছোটোমেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তাই উনি দুপুরের আগেই ছুটি নিয়ে চলে যান। দোকানে আমি একা। সেদিন আমার ছোটোভাই আর ওর বন্ধুও ছিল না। (আমি, আমার ছোটোভাই, ওর বন্ধু আর পীযূষদা, আমরা এই ৪ জন মিলে দোকান চালাতাম।) একা দুইটা দোকান সামলানো একটু কঠিন। যে বন্ধুটার ইমেইল পেলাম একটুআগে, আমার এ বন্ধুটা প্রায়ই আমার দোকানে আসত। গল্প করত, খাওয়াদাওয়া করত, গান শুনত, মুভি দেখত। আমার দোকানে আমি রেয়ার কিছু মুভি-মিউজিক বিক্রি করতাম। সেদিন ওকে ফোন দিলাম। অনুরোধ করলাম, ফ্রি থাকলে যাতে একটু দোকানে আসে, আমাকে হেল্প করে। ও এল। আমি একটা দোকানে বসেছিলাম, ও আরেকটাতে। দুই দোকানের মাঝখানের প্যাসেজটাতে বসে দুজন মিলে গল্প করলাম, ডিমপরোটা খেলাম। একটুপরে একজন কাস্টমার এলেন। ও যে দোকানটাতে বসেছিল, কাস্টমার সেটাতে ঢুকলেন। ও কিছুই বলছিল না, আপনমনে ফেসবুকিং করছিল। কাস্টমার নিজেই দেখেশুনে একটা ফ্লাওয়ার ভেইস পছন্দ করলেন। আমার দোকান ছিল ফিক্সড প্রাইসের দোকান। মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করতে করতে যখন আমার বন্ধুকেই দোকানের মালিক ভেবে জিনিসটা প্যাকেট করে দিতে অনুরোধ করলেন, তখন ও চোখেমুখে খুব বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বলেছিল, “কী ভাই, মানুষও চিনেন না? আমাকে দেখলে কি আপনার দোকানদার দোকানদার মনে হয়? না না, আমি এই দোকানের কেউ না। (আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে) দোকানদার ওখানে বসে আছে। ওর কাছে নিয়ে যান।” কাস্টমার একটু ভড়কে গেলেন মনে হল। আমি এগিয়ে এসে বললাম, “ভাই, এদিকে আসেন। আমি প্যাকেট করে দিচ্ছি।” কাস্টমার চলে যাওয়ার পর আমার বন্ধুটি এসে বলল, “দোস্ত, তোর এখানে থাকলে দেখি মানসম্মান থাকবে না। লোকজন তো আমাকেই দোকানদার বানিয়ে দিচ্ছে। লজ্জার ব্যাপার! তুই থাক, আমি আসি।” ও চলে যাওয়ার পর আমি একটা দোকানের শাটার নামিয়ে দিয়ে আরেকটার গ্লাসডোর বন্ধ করে ভেতরে বসেবসে ইউটিউবে গান শুনতে লাগলাম। মনেমনে খুব করে চাইছিলাম, যাতে আমার দোকানে সেদিন আর কোনো কাস্টমার না আসে। এরপর কারোর সাথে কথা বলতে গেলে আমি আর চোখের পানি লুকাতে পারবো না, নিশ্চিত কেঁদে ফেলবো।

কথা শোনানো, এটা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর একটা। আমি এই জীবনে কখনো কাউকে কথা শুনিয়েছি বলে মনে পড়ে না। বরং লোকে কথা শুনিয়ে দিলে সেটা নীরবে হজম করেছি। নিজেকে আঘাত পেতে দিয়েছি। মনের মধ্যে জেদ চেপে গেছে, আঘাতগুলো শক্তি হিসেবে আমাকে প্রতিনিয়তই পেছন থেকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। আর আমার পিঠ দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল। আমার মা প্রায়ই বলেন, “বাবা, কখনো কাউকে নিন্দা করিস না। যে ফুল নিন্দে, সে ফুল পিন্দে।” মা খুব ঠিক বলেন। কথা শোনানোর চাইতে কথা না শোনানোর শক্তি অনেকঅনেক বেশি। আপনার কাজকে কথা শুনিয়ে দিতে দিন, আপনার মুখকে নয়। কাজের কথা শোনানোর শক্তি মুখের চাইতে হাজারগুণ বেশি।

আমার ভালো থাকার অনেকটুকু কৃতিত্ব আমার এমন কিছু অসাধারণ বন্ধুর।

জীবনে কিছু না পাওয়ার চাইতে কষ্ট পাওয়াও ভালো।

প্রিয় বন্ধু, তোকে ধন্যবাদ। ভালো থাকিস।

পুনশ্চ। অনেকেই আমাকে ইনবক্সে জানতে চেয়েছেন, ‘দোভানা’ মানে কী? তাদের বলছি, এটা একটা লিথুয়ানিয়ান শব্দ। ওই দেশে আদর করে মেয়েদের নাম রাখে দোভানা। এর মানে উপহার। (ওইসময়টাতে আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল ভাষা আর শব্দ নিয়ে খেলা। শব্দরা প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। আমি ফেসবুকে ওদের নিয়ে ইচ্ছেমত খেলতে ভালোবাসতাম।)

ভাবনা: ছয়শো চুয়াল্লিশ

………………………………………………………

(কোনো এক সাতাশে জানুয়ারিতে বাবার জন্মদিনে নিচের কথাগুলো লিখেছিলাম)

আজকে একজন সহজ মানুষের জন্মদিন। তিনি আমার বাবা।

কখনোই জিততে চাননি বলেই কখনো হারেনওনি। আশেপাশের সবাই জিতে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা বাবার মতো এতোটা খুশিমনে সারল্য নিয়ে আর কাউকে কখনো বলতে শুনিনি। আজকের দিন পর্যন্ত কোনো ব্যাপার নিয়েই বাবাকে কখনো আফসোস করতে দেখিনি। “কারো উপকার করতে না পারো, কখনোই কারো ক্ষতি কোরো না।” ছোটোবেলা থেকেই এটা সবসময়ই বাবার মুখে শুনে এসেছি। আমি বিশ্বাস করি, আমার যতো অর্জন, আমার বাবা-মা’র ভালো কাজের পুণ্যফল। জীবনের হিসাব মেলানোর চেষ্টাও করেননি কোনোদিন, তবুও সব হিসাব মিলে গেছে নিখুঁতভাবে। খুব উঁচুতে পৌঁছতে চাননি বলেই বাবার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরী হয়নি এখনো। কাউকেই কখনো ঈর্ষা না করেও ঈর্ষণীয় হয়ে থেকেছেন। খুব অল্পেও বাবাকে দেখেছি শিশুর মতো খুশিতে হাসতে। বাবা এখনো পর্যন্ত হারেননি। হারবেন কী, জিততেই তো চাননি কখনো। জেতা কাকে বলে, সেটার সবচে’ ভালো উত্তরটা পেয়েছি বাবাকে দেখে। আফসোস ছাড়া প্রতিদিন বাঁচাই জেতা।

জীবনটাকে সহজভাবে নেয়ার মতো কঠিন কাজটা কতটা সাবলীলভাবে করা যায়, সেটা বাবাকে দেখে শেখার চেষ্টা করি। ঘোরানোপ্যাঁচানো ব্যাপারগুলো বাবা বুঝতে পারেন না বলেই হয়তো জীবন তাঁর কাছে সবসময় সহজভাবে ধরা দিয়েছে। বাবার জীবনদর্শন হলো, একেবারে সাদামাটাভাবে জীবন কাটিয়ে, চিন্তার উন্মেষ ঘটানো। সবসময়ই খুব সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন। বাবাকে কখনোই অপরিচিত কাউকে ‘তুমি’ করে বলতে শুনিনি; মানুষকে প্রচণ্ড সম্মান দিয়ে কথা বলেন সবসময়। বাবাকে শেষ কবে রাগতে দেখেছি, মনে নেই; তাই, একটু মন খারাপ করে কিছু বললেও নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে। বাবা বলেন, এমন সব জিনিস জিনিস কিনো না যেগুলো তোমাকে হঠাৎ কিনতে শুরু করে। বাবার ধারণা, মা হলেন হোম মিনিস্টার, ঘরে-বাইরে তাঁর যতো অর্জন, মা-ই সব করেছেন। বাবাকে দেখেছি, উনি মা’কে সবসময়ই জিতিয়ে দেন, যতো ক্রেডিট সব মা’কে দিয়ে দেন। আমার একরৈখিক চিন্তার ধরণ বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। যা ভাবেন, বিশ্বাস করেন, তাই বলেছেন সারাজীবন। আমি হিপোক্রিসি সহ্য করতে পারি না, এটাও বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটু বেশিই খরচ করেন। নিজে ভোজনরসিক, অন্যদেরও যত্ন করে খাওয়াতে খুউব পছন্দ করেন। উইকএন্ডে বাজার বেশি হয়, মা’এর পাশে বসে মাছ মাংস তরকারি কেটেকুটে দেন, সাথে কতোকতো ঠাট্টা চলতে থাকে, মা’কে এখনো ক্ষ্যাপান সুযোগ পেলেই। (মা কি এতে আরো খুশি হয়ে ওঠেন না?) বাবাকে দেখতাম, কতো গরীব মক্কেল থেকে পয়সা নিতেন না, উল্টো আদালতের টুকিটাকি খরচ নিজের পকেট থেকে দিয়ে দিতেন। ছোটোবেলায় কেমন জানি রাগ হতো এসব দেখলে। বাবা বলতেন, দেখিস, ওদের আশীর্বাদে তোরা দুই ভাই অনেক বড়ো হবি। কেউ মামলা জিতে খুশি হয়ে বাড়তি ফি দিলে নিতেন না, এখনো নেন না। কোর্ট থেকে কখনোই খালি হাতে ফিরতেন না, আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন বাবা ফিরবেন, সন্ধ্যায় একসাথে বসে নাস্তা করবো। ব্রেকফাস্ট আর ডিনারও আমরা ৪জন একসাথে করতাম; বাসায় থাকলে এখনো করি। আমাদের এই ফ্যামিলিয়াল বন্ডেজ বাবার হাতে গড়া। বাবা বলেন, কাউকে কখনো ধার দিলে সেটা বারবার ফেরত চেয়ো না, ওতে সম্পর্ক নষ্ট হয়। আমার বই পড়ার অভ্যেস বাবাকে দেখেই। বাবা এখনো প্রচুর বই পড়েন। প্রচুর ইংরেজি শব্দ জানতেন, ছোটোবেলায় আমাদের শেখাতেন। যখন ছোটো ছিলাম, বাবার কোলে চড়ে মেলায় যেতাম, বাবা বাঁশি, পাখি, মিঠাই, আরো কীসব মাটির খেলনা কিনে দিতেন। মা বলতেন, এগুলো কিনে দাও কেনো, ভেঙ্গে ফেলবে তো! বাবা বলতেন, ওইজন্যেই তো কিনে দিয়েছি। মা-বাবা কতো লোকের উপকার করেছেন, কতো স্টুডেন্টকে ফ্রিতে পড়িয়েছেন, পার্থিব সম্পদের চাইতে মনের ঐশ্বর্য বাড়াতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কখনোই বিন্দুমাত্রও অহংকার দেখাতে দেখিনি। কতো লোকের শুভকামনা তাঁর সাথে; এখনো তেমন কোনো কষ্টে বাবাকে পড়তে দেখিনি। বাবা সবসময়ই নিজের কাজ নিজে করেন। আমাদের বলেন, নিজের কাজ নিজে করবে। নিজের কাজ নিজে না করা মানে, নিজের ভার অন্যের হাতে দিয়ে দেয়া; এটা বড়ো কষ্টের, বাবা। বাবাকে নিয়ে আমার গর্ব এই যে, শুধু নিন্দে করার জন্যেই জন্ম নিয়েছে এমন লোকজনকেও বাবাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলতে শুনিনি কখনোই।

বাবা, তুমি আমাদের অনেক অনেক হাসিখুশি সুখী স্বচ্ছল একটা পরিবার উপহার দিয়েছো। নির্ভার চিত্তের চেয়ে বড়ো বিত্ত তো আর নেই। বাবা, তুমি অনেকবেশিই সফল।

হে ঈশ্বর! আজকের এই দিনে মন থেকে প্রার্থনা করছি, বাবাকে আমার কিছু আয়ু দিয়ে দিয়ো।