ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা (৯১তি অংশ)

ভাবনা: ছয়শো একত্রিশ

………………………………………………………

ইনবক্সে মাঝেমাঝে এমন টেক্সটও আসে যেগুলোর রিপ্লাই দিচ্ছি কী দিচ্ছি না, এ নিয়ে যিনি টেক্সটটা পাঠাচ্ছেন, তাঁর কোনোই মাথাব্যথা নেই। উনি যে টেক্সটা পাঠাচ্ছেন, এটাকে উনি ধরেই নিয়েছেন নিষ্কাম কর্ম হিসেবে। নিষ্কাম কর্ম কী? এমন কাজ, যেটাতে বিন্দুমাত্রও বৈষয়িক প্রাপ্তির আশা থাকে না। এই যেমন, মায়ের ভালোবাসা। আচ্ছা, এর মানে কী? প্রাপ্তি কি থাকেই না? একটুও? থাকে থাকে! ধরুন, আপনি কোনো ধরণের প্রাপ্তির আশা কিংবা স্বার্থ ছাড়াই কাউকে হেল্প করলেন। এতে আপনি কী পেলেন? কিছুই না। আসলে কি কিছুই না? একটু ভাবুন তো, কাউকে হেল্প করতে পারলে নিজের মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব আসে না? এই যে সুখের অনুভূতি, এর দামও কিন্তু লক্ষ টাকা। এটা আপনার আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আপনার প্রাত্যাহিক জীবনযাপন আর কাজকর্মে ক্লান্তি আসে কম। হাসিমুখে কম সময়ে কম ভুল করে কাজ করা যায়। এর দাম নিশ্চয়ই আপনি কোনো দামের বিনিময়ে কাজটি করলে যে দাম পেতেন তার চাইতে অনেক অনেক বেশি। যে সুখ পয়সা দিয়ে কেনা যায় না, সে সুখের দাম সবচাইতে বেশি।

আচ্ছা, লোকে ফকিরকে পয়সা দেয় কেন? হেল্প করতে? বেশিরভাগ সময়েই এর উত্তরঃ না। তবে কেন দেয়? দোয়া পেতে। সব ফকিরই কি দোয়া করে মন থেকে? নাতো! অনেকে তো পয়সা কম দিলে বদদোয়াও দেয়। তবে? কাউকে সাহায্য করলে নিজের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি হয়, কাউকে হেল্প করার সামর্থ্য ও সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই সৌভাগ্যের জন্য শুকরিয়া! যত বেশি শুকরিয়া আদায় করবেন, তত বেশি ভাল থাকবেন। মনে অহংকার কাজ করবে কম। আরো বেশিদূর যাওয়ার ইচ্ছে জন্মাবে। ওয়েটারকে একদিন ১০ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা বকশিস দিয়ে দেখুন তো কেমন লাগে? রিক্সাওয়ালাকে একদিন খুশিমনে ৫ টাকা বাড়িয়েই দিলেন না হয়! কী এমন কমে যাবে আপনার? কিছুই না! Giving is an art. এরপর বাসায় ফিরে দেখুন তো কেমন চমত্‍কার একটা ভাললাগা কাজ করে! যে কাজটিই করবেন, সেটিই মন দিয়ে করতে পারবেন। ৬ ঘণ্টার পড়াশোনা হবে ২.৫ ঘণ্টায়। হিসাব করে দেখুন, লাভ কিন্তু আপনারই বেশি। মানুষ দানে ধনী হয়।

আমাকে যাঁরা বলেন, আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, তাঁরা লাইফের আসল ম্যাজিকটাই ধরতে পারেন না। শুধু আর্থিক লাভটাই দেখলে আজীবন দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকদিক দিয়েই অনেককিছু পেয়েছি। এই যেমন, বাংলাদেশের যেখানেই ঘুরতে যাই না কেন, আমার সাথে ঘোরার জন্য কাউকে না কাউকে পেয়ে যাই। এটা কি প্রাপ্তি নয়? মানুষের ভালোবাসা আমাকে আরো ভালভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। এখানেই শেষ নয়। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের দোয়া কাজে লাগে। আর যদি সেই মানুষটি হয় কারোর পিতা, মাতা, কিংবা বড় ভাইবোন, তবে সেই দোয়া অবশ্যই অনেক বড় দোয়া। যাঁরা আমার কথায় কিংবা লেখায় তাঁদের কোনো ব্যথা কিংবা কষ্ট ভুলে জীবনে সুন্দর ও সুস্থভাবে বাঁচার অর্থ খুঁজে পান, তাঁদের কাছের মানুষেরা, বিশেষ করে বাবা-মায়েরা আমার জন্য দোয়া করেন। অনেকেই আমাকে ফোন করে বাসায় দাওয়াত দেন, মনপ্রাণভরে দোয়া করেন। আমাদের বাবা-মায়েরা সাধারণত ধার্মিক ও ভালমানুষ। এ ধরণের মানুষের দোয়া অবশ্যই কবুল হয়; হয়তো আমরা তা জানতেও পারি না কোনদিন। আমি আমার জীবনের অনেক বিপদআপদ থেকে বেঁচে গেছি স্রেফ মানুষের দোয়ায়। এই যে বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি, সেটা আমার বাবা-মা’র পুণ্যের ফল। একটা মজার ফ্যাক্ট শেয়ার করি। বিসিএস কী, এটা নিয়ে আমার মায়ের কোন ধারণাই ছিল না। মা শুধু জানতেন, আমি একটা চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। এ পরীক্ষা কতটা কঠিন আর প্রতিযোগিতাপূর্ণ, সেটা মা একটুও জানতেন না। মা না বুঝেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ঠাকুর, তুমি আমার ছেলেকে বিসিএস ফার্স্ট করে দাও। বিসিএস পরীক্ষা সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা থাকলে মা এই দোয়া করার সাহসও হয়তো করতেন না। কী আশ্চর্য দেখুন! সেই দোয়াই কবুল হয়ে গেছে। একটা লাইফ সিক্রেট শেয়ার করি। যখনই আল্লাহর কাছে কোনোকিছু চাইবেন, ছোটোকিছু চাইবেন না। আমাদের প্রতিদিনের প্রার্থনা কিংবা ইচ্ছের ১০% কবুল হয়ে যায়। আপনি মনে মনে আইসক্রিম খেতে চাইলেন। কোন এক উছিলায় আইসক্রিমই পেয়ে যাবেন। আপনার তকদিরে হয়তো ব্যুফেমিল ছিল, সেটা আর পাবেন না। অবচেতনভাবেও ভাববেন না, আপনাকে দিয়ে কোনকিছু হবে না। আপনার ভাবনা কবুল হয়ে যেতে পারে! কোনদিন বুঝতেও পারবেন না, মুহূর্তের ভুলে জীবনে কী হারিয়েছেন!

তো যে প্রসঙ্গে ছিলাম! আমি প্রতিদিন যে পরিমাণ খুব চমত্‍কারভাবে গোছানো টেক্সট পাই, সেগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে অনায়াসেই কয়েকটি ‘সবিনয় নিবেদন’ কিংবা ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ লিখে ফেলা যায়। মজার ব্যাপার হল, এসব চমত্‍কার মেসেজে রাগ থাকে, অভিমান থাকে, অনুরাগ থাকে, ভালোবাসা থাকে, ভয় থাকে, শ্রদ্ধা থাকে। একেকটা মেসেজ হয়তো বা আগের অনেক আনআনসারড্ মেসেজের কন্টিনিউয়েশন। আগে ভাবতাম, মানুষ মেসেজের রিপ্লাই না পেয়েও কেন মেসেজ পাঠিয়েই যায়? এখন বুঝি। আসলে মানুষ কখনো কখনো নিজের মনেই কথা বলে মজা পায়। কথোপকথনের সুবিধার জন্য আরেকজনকে দরকার, তাই না? টম হ্যান্কসের ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ মুভিটা দেখেছেন তো? মুভিতে একলা দ্বীপে নায়ক নানা এনটিটিকে সামনে এনে কিংবা কল্পনাতে এনে দিব্যি কথা চালিয়ে যায়। সে মিথস্ক্রিয়ায় রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, অনুরাগ, বিরক্তি, সুখদুঃখ সবই থাকে। মানুষের যে সবসময়ই সঙ্গী দরকার তা কিন্তু নয়। বরং মাঝেমাঝে সঙ্গীহীনতাই বেশি সুখের। পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন পড়ে পড়ে কিংবা লাভ স্টোরি, বিফোর সানরাইজ, বিফোর সানসেট এসব দেখে দেখে আমি প্রায়ই কোন এক মুজতবার শবনম কিংবা শঙ্খসুনীলের মার্গারিটার সাথে মনে মনে কথা বলতাম। এখনও বলি। এই ব্যাপারটা আমাকে একধরণের সুখ দেয়। আমার কথা শুনে আমি যেরকম করে ভাবি, সেরকম করে কেউ যদি কথা না বলত, তবে কি ভাল লাগত অতটা যতটা লাগে একা একা মনের মত রিপ্লাই ভেবে ভেবে কথা বলে যেতে? মনের কথাগুলো যে অনেক দামী! যদি কেউ ওসব কথা শুনে মন-খারাপ-করে-দেয়া রিপ্লাই দিত কিংবা অবহেলা করত, তবে মন কতটা খারাপ হয়ে যেত, ভাবতে পারেন? এর চাইতে কি রিপ্লাই না পাওয়াও ভাল নয়? এই ‘বলছেও ও, শুনছেও ও’ ধরণে কথা চালিয়ে গেলে কিছু অহেতুক মনখারাপের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যায়। এ করেই যদি ভাল থাকা যায়, তবে এতে ক্ষতি কী?

ভাবনা: ছয়শো বত্রিশ

………………………………………………………

আমি তোমায় ভালোবাসি।

এর মানে কী? এর মানে হল, আমি তোমার ভালতে বাস করি। ভালোবাসায় মন্দবাসাও থাকে। একটা মানুষের সবকিছু ভাল হওয়া সম্ভব নয়। ভালোবাসায় ভাল দিকগুলোকে পছন্দ করার ব্যাপার থাকে। আমাদের প্রায়ই এরকম মনে হয় না, এত সুন্দর একটা মেয়ে এরকম খ্যাত্টাইপের একটা ছেলের সাথে ঘুরে কেন? হয় হয়, সবারই হয়। সুন্দরী নারীর অন্য প্রেমিকমাত্রই তো খ্যাত্! পরস্ত্রীমাত্রই তো অপরূপা! খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওই ছেলেটির এমনকিছু ব্যাপার আছে যা মেয়েটি মনে মনে খুঁজছিল। হায়! অবশ্য এমনও হয়, ৭ বছরের ভাললাগার করুণ সমাপ্তি ঘটে ৩ মাসেই; বিয়ের পর। কাছে এলেই দূরের মোহটা কেটে যায়। সেটার কথা না ধরলে, ভালোবাসার সমীকরণ সাধারণত অসংজ্ঞায়িত। সাধারণত ছেলেরা রূপের পূজারি, মেয়েরা গুণের। একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে ভালোবাসে, তখন শুধু মেয়েটার ভালগুলোকেই ভালোবাসে। আর একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে ভালোবাসে, তখন ছেলেটার ভালমন্দ সবকিছু মিলিয়েই ভালোবাসে। এখানেই মেয়ের ভালোবাসা আর ছেলের ভালোবাসার পার্থক্য।

হ্যাঁ, যে কথায় ছিলাম। ধরুন, এই ছোট্টো একটা টোনাটুনির সংসার। ভালোবাসা যদি থাকেই, তবে ছোটখাট না-পাওয়াগুলোকে ভুলে গেলে কিংবা ভুলে থাকলেই ভাল। এই যেমন, রুটিটা একটু গোলাকৃতি না হলই বা! কী এসে যায় ওতে? গোলরুটি আর এবড়োথেবড়ো রুটি, দুটোর যেকোনোটিই খেলে তো পেট ভরে। এটা কেন বলতেই হবে, অমুক ভাবির বানানো রুটিটা খুব চমত্‍কার হয়? আপনি কি জানেন আপনার স্ত্রীর এমনকিছু গুণ আছে যা নিয়ে অমুক ভাবিই প্রচণ্ড ঈর্ষান্বিত? নিজের স্ত্রীর ভাল দিকগুলোর প্রশংসা আপনি নিজে না করলে কেউ না কেউ করবেই, আর সেটা যদি একবার আপনার স্ত্রীর মনে ধরে যায়, তখন কী হবে, ভাবতে পারেন? এভাবেই তো সবকিছু ভেঙে পড়ে। মেয়েরা খুব ছোট ছোট সুখ পেয়েও অনেক সুখী হয়। একটা বুদ্ধি দিই, কেমন? খরচ হবে মাত্র ২৫-৩০ টাকার মত। আজকেই অফিস থেকে ফেরার পথে পাঁচটি কদম ফুল হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখুন তো কী হয়? বৃষ্টি হচ্ছে তো! প্রকৃতির সব সৃষ্টিতেই কিছু না কিছু ম্যাজিক লুকিয়ে থাকে। হোক রোদ্দুর কিংবা বৃষ্টি! ম্যাজিকটা খুঁজে নিতে জানতে হয়।

অফিস থেকে বের হওয়ার পর থেকে আপনার স্ত্রীকে কতকিছু সামলে রাখতে হয়! কাজের ফাঁকে একটু করে ওই একটু জিবাংলা-স্টারপ্লাস দেখে, রান্নার বইটই নাড়াচাড়া করে, শুধু এটাই মাথায় রাখেন কেন? একটা মেয়ে কি সবসময়ই কাজ করবে নাকি? সবাই যে আবার বইও পড়তে ভালোবাসে না। তো? কী করতে বলেন বেচারিকে? আপনার সাথেও তো ফোনে প্রেম করা যাবে না, আপনি অফিসে ব্যস্ত। অন্যকারোর সাথে প্রেম করলে সেটা কি ভাল হবে? আপনি নিজে অফিসে যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণই কি কাজ করেন? আক্ষরিক অর্থেই? যদি করেন, তবে আপনি একটা বলদ। আপনি বলদ, তাই বলে আরেকজনকেও বলদ হতে হবে কেন?

ছোটবেলা থেকেই আমার মাকে দেখেছি। সত্যি বলছি, মহিলাদের ঘরেবাইরে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, সেটার জন্য পারিশ্রমিক দিতে হলে আপনার স্ত্রীর বেতন হত আপনার বেতনের কমপক্ষে দ্বিগুণ। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে ব্রেকফাস্টটা আর বাসায় ফিরেই কফির মগটা ঠিকমতো পান তো, তাই গায়ে লাগে না আরকি! ধরুন, একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখলেন, ঘরময় ধুলো, কিচ্ছু ঝাড়মোছ করা হয়নি, বিছানার চাদরটি এলোমেলো হয়ে আছে, রান্না হয়নি, নাস্তাটাও বানিয়ে খেতে হচ্ছে, আপনার ছোট্টো পুতুলের মতন আদরের মেয়েটির রেশমি চুলগুলো আঁচড়ানো হয়নি, ময়লা ড্রেস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেমন লাগবে বলুন তো? এই অস্বস্তি আর বিরক্তির দাম কি আপনার বেতনের চাইতে অনেকগুণ বেশি নয়? এসব ঠিকঠাক করে রাখা কি সহজ কথা? ঘর টিকে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসায়। আমার নিজের বাসার গল্পই বলি। বাবাকে কোনদিনও মায়ের রান্নাকে বাজে বলতে শুনিনি। বাবা বলতেন, তোর মা সারাদিন ঘর সামলে রাখে বলেই তো আমি বাইরে কাজ করতে পারি। বাবা মা’কে বলতেন (এবং এখনো বলেন) হোম মিনিস্টার। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। বাসায় শুধু ডাল-আলুভর্তা রান্না করলে যে খাবারের টেবিলে বসে মা’কে জিজ্ঞেস করতে হয়, “আর কিছু নেই?” এটা ছোটোবেলা থেকে কখনোই শিখিনি। বরং মা যে সারাদিন আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এই অসুস্থ শরীরেও ব্যস্ত সময় কাটান, বাবা সেটা অ্যাকনলেজ করতেন বারবার। মায়ের সব কাজের প্রশংসা করতেন। মা ছোটো বাচ্চাদের মতো খুব খুশি হয়ে উঠতেন আর সমস্ত কষ্ট ভুলে বাবার কাছে গল্প করতে বসে যেতেন সারাদিনে কী কী হল। বাবা বলেন, “মেয়েরা বড্ডো ছেলেমানুষ হয়। ওদের মনে কষ্ট দিলে সেটা বহুগুণে ফেরত আসে।” আমার মা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতেন। এটা করতেন স্রেফ শখে। আমাদের নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা, বাসার সব কাজ সামলে রাখা, সামাজিকতা ঠিক রাখা, এইসবও মা’কেই করতে হত। আমার মনে হয়, যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেন, তবে এর ফল আপনি না পেলেও আপনার ছেলেমেয়ে পাবে। আমি এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। ফ্যামিলিতে যিনি পয়সা আয় করেন না, তিনিও কিন্তু আপনার মতোই টায়ার্ড ফিল করেন। পয়সা আয় করা বা না-করার সাথে ক্লান্তিবোধ করা না-করার কোনো সম্পর্ক নেই। জীবনের ছোটো ছোটো সুখগুলোকে যদি ভালোবাসা দিয়ে উপভোগ করা যায়, তবে জীবনের সব হিসেব তো মিলেই, সাথে বোনাসও মেলে। খাবার খেতে ভালো লাগে স্বাদে নয়, ভালোবাসায়। তাই বুঝি সবার মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সবচে’ সুস্বাদু রান্না। যারা অনেকদিনের জন্য ঘরের বাইরে আছেন, তারা তো জানেন মায়ের হাতের মসুরের ডাল আর বেগুন ভাজি খাওয়ার লোভে পৃথিবীর সব ঐশ্বর্যকেও কতো সহজেই গুডবাই বলে দিতে ইচ্ছে হয়!

তো, যেখানে ছিলাম! ভালোবাসায় ছিলাম। মানে ভালতে বাস করায় ছিলাম। জীবনে আমরা যাদেরকে নিয়ে বাঁচি, যা কিছু নিয়ে চলি, এর কিছুই পারফেক্ট না। তবুও এসব নিয়েও খুব সুন্দরভাবে বাঁচা যায়। জীবনটা ছোটো তো! আমরা বাঁচবোই বা আর ক’দিন! আফসোস নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কোথায়? আপনার স্ত্রী যদি চাকরি করেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, উনাকে আপনার তুলনায় অন্তত ৩ গুণ বেশি কাজ করতে হয়। আপনার স্ত্রী সবচাইতে বড় যে কাজটি করেন, সেটি হল উনি আপনাদের সন্তানদের মানুষ করেন। সুসন্তান গড়ে তোলা একজন মানুষের সারাজীবনের সবচাইতে বড় অর্জন। এই মহান কাজটিই করে দেন আপনার স্ত্রী। আপনার ছোট্টো খোকনটি স্কুলে পড়া ঠিকমতো পারে কিনা সে খোঁজ কি কখনো রেখেছেন? ঘরে ভাল রান্না না হলে মাঝে মাঝে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসলে কী হয়? আপনি একটুআধটু ঘরের কাজগুলো গুছিয়ে রাখলে তো গিন্নী ঠিকই থাইস্যুপ রান্না করে দিতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমার ফিমেল কলিগরা কী যে টেনশনে থাকেন বাচ্চাকে নিয়ে! চাকরির পাশাপাশি সন্তানকে মানুষ করা বড্ডো ঝক্কিঝামেলার কাজ। শিশুর প্রাথমিক জীবনদর্শনের সিংহভাগই গড়ে ওঠে মায়ের জীবনদর্শন থেকে। পৃথিবীর পথে হাঁটতে গিয়ে যে জীবনদীক্ষা প্রয়োজন হয় সেটার গোড়াপত্তন হয় সেই ছোটবেলাতেই, মায়ের কাছে। মায়েরা আমাদের ভাবনার কারিগর। আমি দেখেছি, আমার যদি শরীর খারাপ থাকে, সেটা বাবার আগেই মা কেমন করে জানি টের পেয়ে যায়। আমার ফোন করতে মনে থাক না থাক, মা ঠিকই ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, “বাবা, দুপুরে খেয়েছিস?” আমি অনেকবার দেখেছি, না খেয়ে ‘খেয়েছি’ বললে মা কীভাবে যেন ঠিকই বুঝে ফেলেন। সৃষ্টির সময় স্রষ্টা পুরুষদের এসব ইনট্যুইশন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাননি। ছেলেরা জন্মে মাত্র ২বারঃ জন্মানোর পর আর বাবা হওয়ার পর। আর মেয়েরা জন্মে ৩বারঃ জন্মানোর পর, বিয়ের পর আর মা হওয়ার পর। জন্মের দায় আর যন্ত্রণা যে কী তীব্র, সেটা মেয়েদেরকে খুব স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করতে হয়। প্রত্যেকটা মেয়েই ঘর বাঁধার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। এই যে ঘরে ফেরা! ঘরে মা না থাকলে ঘরে ফেরার আকুতিটা কি থাকত অতো? এই এক নারীই কখনো হরিণীচঞ্চলা প্রেমিকা, কখনো দক্ষ কর্মী, কখনো নিপুণ রাঁধুনি, কখনো স্নিগ্ধ ঘরণী, কখনো ঈশ্বরের প্রতিভূ মা। এ বড় কঠিন কাজ!

গতকাল থেকে আজকে পর্যন্ত অসংখ্য অনুরোধ পেয়েছি, যেন মা দিবসে মা’কে নিয়ে কিছু না কিছু লিখি। বন্ধুদের এই চাওয়াটুকু ফেলা যায় না। আমার লেখার জন্য কেউ প্রতীক্ষা করে আছে, এই তাড়নাটি তীব্র। কালকে ব্যস্ত ছিলাম, তাই আজকে লিখলাম।

পৃথিবীর সকল মা’কে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। মায়েরা খুব ভাল থাকুক।

মা দিবসে আমার একটাই চাওয়াঃ হে ঈশ্বর! আমার আয়ু থেকে কিছুটা আয়ু আমার মা’কে দিয়ে দিয়ো।

ভাবনা: ছয়শো তেত্রিশ

………………………………………………………

২ নভেম্বর ১৯৮৪। শাহরুখ খানের জন্মের ঠিক ১৯ বছর পর আমি জন্মেছিলাম। ঠিক আগেরদিনে জন্মনেয়া ঐশ্বরিয়া কেন ১ দিনের ছোট আমাকে ফেলে ৩ বছরের ছোট অভিষেককে বিয়ে করল, সেই দুঃখ নিয়ে কথা বলতে আমি এই স্ট্যাটাসটা লিখতে বসিনি। ক্লাস নাইনে যখন আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন হচ্ছিল, তখন আমাদের ক্লাসটিচার আমার বাবাকে এই সুবুদ্ধি দিয়েছিলেন যে আমার জন্মের সাল যেন দুএক বছর পিছিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কিছু সুবিধা পেতে সবাই সাধারণত তা-ই করে। বাবা কোনকালেই ঘোরানোপ্যাঁচানো চিন্তাভাবনা করতে পারতেন না। কেন বয়স কমাতে হবে, এটা বুঝতে না পেরে বাবা স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? বয়স না কমালে কি পরীক্ষা দিতে কোন সমস্যা হবে?” স্যার হেসে বললেন, “না না দাদা, তা কেন হবে? ও তো ক্লাসের ফার্স্ট। আমরা আশা করি, ও ভবিষ্যতে ভালকিছু করবে। যদি কখনো সরকারি চাকরিটাকরি করে, তাহলে সার্টিফিকেটে বয়সটয়স একটু কম থাকলে কিছু সুবিধা পাবে। সবাই তো কমিয়ে দিচ্ছে। এই আরকি!” বাবার উত্তরটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। “ও যদি ওর নিজের যোগ্যতায় চাকরি না পায়, তবে যেটা ওর যোগ্যতায় কুলায়, সেটাই করে খাবে। ওর জন্য আমি কেন একটা মিথ্যা তথ্য দেবো? আমি চাই না আমার ছেলের জীবনটা একটা মিথ্যা দিয়ে শুরু হোক। আমি অরিজিন্যালটাই দেবো।” স্যার একথা শুনে হেসে বলেছিলেন, “আপনার কথা শুনে ভাল লাগল। আশীর্বাদ করি, সুশান্তকে কোনদিনও কোন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কিছু করতে না হোক।” অনেকদিন পরে যখন বয়স কমানোর আপাত সুখগুলো বুঝতে শিখেছিলাম, তখন বোকা বাবার উপর খুব রাগ হতো। এটা কোন ব্যাপার! কত দেখি, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দিয়ে দিব্যি চাকরি করছে, উপজাতি সার্টিফিকেট দেখিয়ে বুয়েটে পড়ছে, যে জীবনেও কোনদিন ফুটবলে একটাও লাথি মারেনি সেও খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়ে যায়। আরো কত কী! সামান্য একটা বয়স কমালে এমন কী ক্ষতি! বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় কখনো কখনো মনে হতো, আমি তো মাত্র(!) ৪বার বিসিএস দিতে পারবো! বাবাটা এমন কেন?

এ ব্যাপারে বাবা বরাবরই অন্যগ্রহের মানুষ। ‘৭১য়ে বাবার বয়স ছিল ২২-২৩। বাবা সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন, শাকসবজির ঝুড়িতে লুকিয়ে অস্ত্রগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে দিয়ে আসতেন। আমাদের গ্রামে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের রেজিস্ট্রেশন হচ্ছিল, তখন বাবাকে অনেকেই বলেছিল, একটা সার্টিফিকেট নিয়ে রাখতে, ভবিষ্যতে আমাদের দুই ভাইয়ের কাজে লাগবে। বাবা কিছুতেই রাজি হননি। তাঁর একটাই কথা, আমি তো যুদ্ধ করিনি! রেজিস্ট্রশনের কাজটা যাঁরা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমাদের অনেক নিকটাত্মীয় ছিলেন। তাই কাজটা করা বাবার জন্য সহজ ছিল। ওইসময়ে আমাদের গ্রামে অনেক নব্য মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়েছিল। আমার বোকা বাবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আর জন্মালেন না।

সালটা ‘৯৪ কী ‘৯৫। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ভর্তি হবো। ভাল স্কুলগুলোতে ভর্তি হওয়াটা বড় কঠিন। এর জন্য প্রচুর প্রিপারেশন নিতে হয়। আমি কেজি থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি সানি টিউটোরিয়্যাল স্কুলে। ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে আমার দাদা মারা যান। সেই শোকে এর কয়েকদিনের মধ্যেই আমার দাদীমাও মারা যান। সেসময় আমাদের পুরো পরিবারকে অনেকদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল। আমার আর ভর্তি কোচিং করা হয়নি। বাবা পরিবারে সবার বড়। মা আমাদের পরিবারের বড়বৌ। মাকে অনেক কাজ সামলাতে হত বিধায় মা আমাকে নিয়ে পড়াতে বসার সময় পেতেন না। এতে অবশ্য আমি অত্যন্ত খুশিই ছিলাম। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম। সেসময় বড় সুখের সময়। কী মজা! কী শান্তি! পরে ভর্তি পরীক্ষার আগে ১ সপ্তাহের মতো বাসায় মায়ের কাছে পড়াশোনা করি এবং চট্টগ্রামের সেরা স্কুলগুলোর অন্যতম কলেজিয়েট স্কুলে ‘চান্স পেতে’ ব্যর্থ হই। পরে বাবা খবর নিয়ে জানলেন, যে মার্কস পেলে আমি চান্স পেতাম, আমি সেটির চেয়ে হাফ মার্কস কম পেয়েছি। বাবাকে কোন এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছিলেন, ১০ হাজার টাকা ‘ডোনেশন’ দিলে আমি কলেজিয়েটে পড়তে পারব। আমার চাইতে অনেক কম মার্কস পেয়েও অনেকেই নাকি ওভাবে করে ‘ব্যাকডোর’ দিয়ে ভর্তি হচ্ছে। সেদিন লজ্জায় বাবা উনাকে কিছুই বলেননি। বাবা উপকার করেছেন, এমন অনেক বড় বড় লোক বাবাকে খুবই পছন্দ করতেন। কিন্তু বাবা কারোর মাধ্যমেই কাউকে রিকোয়েস্ট করেননি। বাবাকে কোনদিনও আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য কারোর কাছে অন্যায়ভাবে অনুরোধ কিংবা মাথা নত করতে দেখিনি। একটাসময়ে বাবার উপর অনেকবেশি রাগ হত। বারবারই মনে হতো, বাবা একটা অথর্ব মানুষ। সততার ফালতু পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জীবনে নিজেও কিছু করতে পারলেন না, আমাদের জন্যও কিছু করলেন না। এখন বুঝি, জীবনে অথর্ব হওয়ার গুরুত্ব কত বেশি! ছেলেমেয়েদের সাময়িক সুখের মোহে ওদের পাপের ভাগীদার হওয়াটা নিতান্তই মূর্খের কাজ। আমাদের পঙ্গু করে দেননি বলেই আজকে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। আরেকজনের কাঁধে ভর দিয়ে চলার অভ্যাস যার, সে কখনো মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে পারে না। ভর দেয়ার কাউকে না পেলে সে চলতেই পারে না।

আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করার সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটা মাস্টার্স করতামঃ এমডিএস। একই সেশনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক মাস্টার্স করা যায় না। আমার সেশন ভিন্ন ছিল। এমবিএয়ের ২০১০-‘১১; এমডিএসয়ের ২০১১-‘১২। তাই অফিসিয়ালি কোন সমস্যা থাকার কথা না। কিন্তু এমডিএস কর্তৃপক্ষ এটা কিছুতেই মানছিলেন না। ওদের একটাই কথা, না, একইসাথে দুটো মাস্টার্স করা যাবে না। কয়েকজন স্যার বুদ্ধি দিলেন, আমি যদি অফিসিয়ালি এমবিএ করার ব্যাপারটা ‘হাইড’ করি, তাহলে আর কেউ কিছু বলবে না। উনারা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হইনি। বিধি মোতাবেক আমি দুটো মাস্টার্স করতে পারি। আমি কেন মাথা নিচু করে চোরের মতো লুকিয়ে মাস্টার্স করবো? ৩ মাস ফার্স্ট সেমিস্টারে ক্লাস করার পর আমাকে এমডিএস ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হল। এতদিনে আমার নামের পাশে দুটো নামকরা মাস্টার্স থাকার কথা। এখন আছে একটা। সত্যি বলছি, এতে আমার বিন্দুমাত্রও কোন আফসোস নেই। যতদিন বাঁচব, সত্যের জোরে মাথা উঁচু করে বাঁচব।

আমার বোকা বাবাকে ধন্যবাদ।

ভাবনা: ছয়শো চৌত্রিশ

………………………………………………………

দাদা, তিনটা কাজ কখনো করবি না। এক। কারোর শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে ওর মানসিকতা বিচার করবি না। দুই। কারোর পরীক্ষার গ্রেড দিয়ে ওর মেধা যাচাই করবি না। তিন। দুর্জন যতই বিদ্বান হোক, দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ওর কাছ থেকে সরে আসবি, শুধু বিদ্বান বলে সাথে থেকে যাবি না।

একটু আগে খাওয়ার টেবিলে অকালপক্ব কিংবা বয়সের তুলনায় ত্রিগুণপক্ব ছোটভাইয়ের ওপরের অমৃতবচনত্রয়ের পেছনের কাহিনীটা খুব দীর্ঘ নয়। প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময় আগের কথা। কোন একটাসময়ে আমাদের বাসায় একটা পাত্রীর প্রস্তাব আসে। ওকে দেখে বেশ ভাল লেগে গিয়েছিল। ভাললাগা মানে, ভালোবাসাও। ঠিক করেছিলাম, ওকেই বিয়ে করব। পাত্রীদেখার দিনে আমার মা ওকে আশীর্বাদ করে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। (এ খবর আমি জেনেছি অনেক পরে। আগে জানলে মাকে ওই টাকা কিছুতেই দিতে দিতাম না, বরং ওটা দিয়ে বই কিনে ফেলতাম। একটা মেয়েকে দশ হাজার টাকা দেয়ার দরকারটা কী? দশ টাকার ফুচকা খাওয়ালেই তো মেয়েরা অনেক খুশি হয়। আহা! মা’টা এত বোকা কেন? অবশ্য এ কথা মা’কে বলার পর সেইরকম ঝাড়ি খেয়েছি। সেকথা থাক।) জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে— এই ৩ তো ঈশ্বরের হাতে। বিয়েটা যেকোনো কারণেই হোক, হয়নি। ওদের শিক্ষাদীক্ষা আর মানসিকতা ছিল পরস্পর বিপরীতমুখী। বড় হলে বড় বড় ভাব নিতেই হবে, আমাদের পারিবারিক শিক্ষা আমাদের দুই ভাইকে এটা কোনোদিন শেখায়নি। বাবা বলেন, “মানুষ বড় কী ছোট বুঝবি কীভাবে? যে যত বড়, তার মাথা তত নত।” যা-ই হোক, যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা চলছিল সে ছিল খুব ভাল আর অতিআঁতেল ‘আব্বুকে বলে দিবো’ টাইপ অতি ভাল-রেজাল্টের স্টুডেন্ট। সম্প্রতি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বাবার ইচ্ছে, ওই টাকাটা যেন আমরা ফেরত নিই। খুবই অদ্ভুতধরণের নীচ মানসিকতাসুলভ ইচ্ছে। আমরা এখন যে বাসায় ভাড়ায় থাকি, সেটির মালিক ওদের বৈবাহিক, মানে বিবাহসূত্রে আত্মীয় হন। উনার মাধ্যমে এ ইচ্ছেটি আমার ছোটভাই বাড়িভাড়া দিতে গেলে জানানো হয়। আমাদের বাসার মালিক ভদ্রলোকটি পেশায় একজন নামকরা চিকিৎসক। এ প্রস্তাবটি শুনে আমার ছোটভাইয়ের খুব মেজাজখারাপ হলেও ও শান্তভাবে বলে, “আঙ্কেল, এটা তো মা উনাকে আশীর্বাদ করে দিয়েছিলেন। আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। গুরুজনদের ব্যাপার, আমি কীভাবে কিছু বলি? তবে আমি মাকে আপনার কথাটা জানাব।” ওই সময়ে উনার চেম্বারে বসেছিলেন একজন মহাফাজিল বান্দরটাইপের ভদ্রলোক। উনি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এরপর উনি মাঝখান থেকে কথা বলতে শুরু করলেন। কথাগুলোর কিছু অংশ আমার নিজের মতো করে শেয়ার করছিঃ

: তো, ব্যাপারটা হল, আপনারা একটা মেয়ে দেখে পছন্দ করেছিলেন। তাই তো?

: আজ্ঞে হ্যাঁ।: তো, টাকাপয়সা দেয়ার কী দরকার ছিল? পছন্দ হলে তো বিয়েই হয়। এর মধ্যে আবার টাকাপয়সা কেন বাপু?

: আসলে এটা আশীর্বাদস্বরূপ……..: আরে বাবা, আশীর্বাদস্বরূপ তো গয়নাটয়না দেয় শুনেছিলাম। টাকাও……..

: (ডাক্তার আঙ্কেল কথাটি কৌশলে কেড়ে নিলেন)……… আরে মশাই! বুঝলেন না? আংটিটাংটি অনেকসময় ছোটবড় হয়ে যেতে পারে, আঙুলে ঠিকমতো আটকাবে না। তাই টাকা দিয়ে দিলেই তো ভাল, তাই না? পছন্দ করে কিছু কিনে নেয়া যায়…….

: ও আচ্ছা! তা বাবা, আপনারা তো পছন্দ করেই আংটিটা দিয়েছিলেন, তাই না? বিয়েটা হল না কেন? দশটি হাজার টাকা! কম নয় কিন্তু! শুধু এর জন্যেও তো বিয়ে করা যায়!

: আরে ওরকম তো কত হয়! বিয়েটিয়ে তো বিধাতার বন্ধন। উনি না চাইলে হবে কীকরে? সেসময় নিশ্চয়ই কোন না কোন কারণে বিয়েটা হয়নি আরকি! আর তাই তো, টাকাটা ফেরত দিতে চাইছে। তাছাড়া মেয়েটার বিয়েও হয়ে গেছে।

: ও আচ্ছা, বুঝলাম! মেয়ের বাপ ঋণ দায়গ্রস্ত থাকতে চাইছেন না। খুব ভাল! খুব ভাল! তা, এই ঋণ দায়গ্রস্ততা থেকে উনি তো চাইলেই আরো এক বছর আগেই মুক্ত হয়ে যেতে পারতেন। এত বড়োলোক, এ কটা টাকা দিতে এত সময় নিলেন? এই এক বছর ধরে সে টাকা ব্যবসায় খাটিয়েছিলেন বুঝি?

: আহা আহা! আপনি কী যে বলেন না মশাই! হয়তো ওদের অন্য সমস্যা ছিল, তাই…….

: সমস্যা? ও আচ্ছা! বুঝেছি বুঝেছি! উনি টাকাটা পাওয়ামাত্রই গলাধঃকরণ করে ফেলেছিলেন। আর পরবর্তীতে সেটা যোগাড় করতেই বেচারার এক বছর লেগে গেল! স্বাভাবিক। এতগুলো টাকা………(এ কথার পর ৩ জনই হাসতে লাগলেন।)

: তা শোন বাবা! তোমাদের কিন্তু উচিত টাকাটা নিয়ে নেয়া! এ কলিকালে কে কাকে অতোগুলো টাকা নগদে ফেরত দেয়? বুঝলাম, তোমার মা হয়তো সেটা আশীর্বাদ করেই দিয়েছেন। সে আশীর্বাদেই তো মেয়েটার অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়েও হয়ে গেল! ভালই! টাকাটা নিয়ে নিয়ো, বাবা।

: না মানে, আঙ্কেল, আসলে ওটার কথা আমাদের মনেই নেই। তাছাড়া ওর মঙ্গলকামনা করেই মা……….

: বুঝলাম তো বাপু! মঙ্গল তো ওর হয়েছেই! টাকাটা আর পড়ে থাকবে কেন? আর তোমরা নিতে না চাইলে আমাকে দিয়ে দিয়ো। একটা বড়সড় ছাগল কিনে বারবিকিউ পার্টি হয়ে যাবে! কী বলেন, ডাক্তার বাবু? আমরা আমরাই তো!

: উফফ! থামুন না মশাই! কী বলছেন এসব?

: আহা রেগে যাচ্ছেন কেন, ডাক্তার বাবু? আচ্ছা, বারবিকিউ বাদ! টাকাটা নিলে তো আমরা লায়ন্স ক্লাবের পক্ষ থেকে আর্তমানবতার সেবায় সেটা নেপালে পাঠিয়ে দিতে পারি। কী বলেন? আর তোমাকে বলছি। সামনে থেকে তোমার মাকে বলো, বিয়ের পর যা টাকাপয়সা দেয়ার দিতে। আশীর্বাদ বিয়ের পর করাই ভাল। নাহলে তো পুরোটাই লস!

দুপুরে খাওয়ার সময় আমার ছোটভাইয়ের কাছে এসব কথা শুনে আমার হাসতে হাসতে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা! ও এমনিতেই খুব মিমিক্রি করে করে এসব বলে। প্রথমে মানুষের ছোটলোকিতে মেজাজখারাপ হয়েছিল। ওদের পুরো পরিবারই অতি উচ্চশিক্ষিত! সবাই-ই একেবারে ফার্স্টসেকেন্ড হওয়াটাইপ! একইসাথে ঔদ্ধত্য এবং অহংকারও ছিল পুরোমাত্রায়! ওদেরকে কখনো মানুষকে খুব একটা সম্মান দিয়ে কথা বলতে দেখিনি, যা আমাদের পরিবারের সাথে একটুও যায় না। আমার, আমার অনেক সিনিয়র আইনজীবী বাবার, আমার মায়ের, কিংবা আমার ছোটভাই কারোরই অতো ভাবটাব ধরার কিংবা সহ্য করার ইচ্ছে কিংবা সময় কোনটাই নেই। ওরা চাইছিল, ঘরজামাইটাইপ গৃহপালিত ছেলে যে ধনী শ্বশুরের কথায় উঠবে, ধনী শ্বশুরের কথায় বসবে। ঠিকই আছে। এরকম কোরবানির গরুটাইপের ছেলে পাওয়া যায় বলেই তো মেয়ের বাবারা এরকম ছেলে খোঁজে। কিন্তু আমার সমস্যা ছিল, আমি প্রয়োজনে না খেয়ে মরে যাবো, তবুও কিছুতেই ওরকম হতে পারব না! মানসিকতার ভিন্নতার কারণেই বিয়েটা হয়নি। নাহলে আর সবকিছুই ঠিক ছিল। এখন বুঝতে পারছি, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি! এমন অসম মানসিকতার বিয়ে খুব একটা টেকে না। ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তো, তাই বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারতাম না। আবারো স্বীকার করছি, গীতার মূল কথাটিই ঠিকঃ “যা হয়েছে, তা ভালই হয়েছে। যা হচ্ছে, তা ভালই হচ্ছে। যা হবে, তা ভালই হবে।” ল্যাটিনে বলেঃ Que sera, sera. মানে, Whatever was, was; whatever is, is; whatever will be, will be. আমি এখনো পর্যন্ত এই দর্শনের কোনো ব্যত্যয় দেখিনি। একমাত্রই সৃষ্টিকর্তাই জানেন, কোনটা আমাদের জন্য ভাল, কোনটা খারাপ। আমরা প্রত্যেকেই একটা বিশাল মাস্টারপ্ল্যানের অতিক্ষুদ্র অংশমাত্র! মাঝে মাঝে আল্লাহ্‌ আমাদের প্রার্থনা কবুল করেন প্রার্থনা কবুল না করার মাধ্যমে।

ভাবনা: ছয়শো পঁয়ত্রিশ

………………………………………………………

এক।

যে বৃষ্টিটা ঝরে যেতে পারতো অথচ ঝরলো না, সেই বৃষ্টিটা হেঁয়ালি কান্নার মতো যা জমতে জমতে বুকের ভেতরে নীরবে নিঃশব্দে নিশ্চুপ ধারায় অঝোরে ঝরতে থাকে; আকাশেরও নিশ্চয়ই মন আছে, নয়তো ও এরকম মন খারাপ করে থাকবে কেনো? এর দায়শোধ করার কথা ছিলো যার, সে আড়ালেই হাসতে থাকে। হয়তো জানতেই পারবে না কখনোই কতোটা বেদনাবিধুর ধূপছায়ায় কান্না পর্যন্ত ঝরতে ভুলে যায়। ট্র্যাজেডি কি এর চেয়েও ট্র্যাজিক? হবেও বা হয়তো! এই পুরোনো থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচার বয়েসি বৃষ্টির বয়েসের তো আর কোনো গাছপাথর নেই; তাই এইরকমভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কষ্টেরা ইদানীং বড্ডো বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। হায়! কষ্টেরা কষ্টে আছে! ট্র্যাজেডির নৈব্যর্ক্তিক রূপ দেখা যায় না; চুরি করে অনুভব করা যায় মাত্র। যে চুরি আড়াল করে রাখা যায় না, সেটাই কখনো কখনো ব্যক্তিগত। কীসব এলোমেলো বলছি! কথাগুলো আমি যতোটা নই, তার চাইতেও বেশি এলোমেলো হয়ে গেলো। কী সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি! সৃষ্টির কাছে স্রষ্টার কী নির্মম পরাজয়! পুরোনো বিরহের সুর এতোটা ছন্দহীন সুরহীন অতল স্বচ্ছন্দ্য তন্দ্রায় দেখা দিয়েছিলো আরো আগেই। সে কথাই বলছি …….

ভালোই যদি বাসতে, তবে কখনো ছেড়ে যেতে না। আমি তো সবসময়ই ঠিক ব’লতাম না, তুমিও ব’লতে না, কেউ-ই বলে না। তোমাকে কতো কতোবার ব’কেছি, অনেকবেশিই ব’কেছি। মনে আছে তো? তোমাকেই তো ব’কবো, আর কাকে ব’কবো? কই, ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা আমার কল্পনাতেও আসেনি কখনোই। যার জন্যে, যাকে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে বেঁচে আছি, তাকে আবার ছেড়ে যায় কীভাবে! আমি তো আমাকে ছেড়ে যেতে পারি না। দিনের শেষে আমাকে মানে তোমাকে নিয়েই তো আমাকে বসতি। আমি তোমাকে আমি ভাবতাম। এবং ভাবতাম, তুমিও ওরকমই ভাবো। ভাবনার এই স্বাচ্ছন্দ্য তো পুরোপুরি আমার কৃতিত্ব কিংবা দায় নয়, তাই না?

সেইদিনটাতে খুব রাগ হ’য়েছিলো, না? আমি যে এ্যাতোটা স্টুপিড, এটা হঠাত্ ক’রেই নতুন মনে হ’লো কেনো সেইদিন? ভালোবাসায় স্টুপিডিটি থাকবে না-ই বা কেনো? স্টুপিডিটির কত্তো কত্তো শাস্তি তোমার জানা ছিলো; আদুরে গাল দু’টো ফুলিয়ে অভিমান করে ব’সে থাকা, ফোন না করা, ফোন রিসিভ না করা, মুখে যা আসে তাই বলা, হাতের কাছে যা পাও তা দেয়ালে ছুঁড়ে মারা আর সেই শব্দ আমাকে ফোনে শোনানো, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয়া, আমি মুভি দেখার সময়ে আর বই পড়ার সময়ে ননস্টপ ফোন ক’রতে থাকা, মিষ্টি গোলাপি ঠোঁট দু’টো উল্টে ফুলিয়ে কাঁদতে থাকা, অন্য ছেলেদের খ্যাতখ্যাত ছবিতেও লাইক দেয়া, আমাকে একশোবার খারাপ লোক বলা, আরো কতো কী! সব তো এখন আর ঠিকমতো মনেও পড়ে না আমার। তোমার অভিমান ভাঙাতে তো কখনোই আমার ক্লান্তি আসেনি। কেনোই বা ভেবে নিয়েছিলে আমি ক্লান্ত? নাকি ভেবে নিতেই ভালোলেগেছিলো? ভালোবাসার অনভ্যস্ততা মানুষকে কতোটা বিস্মৃত অসহায় করে দেয়, এখন তা খুব ভালোভাবে বুঝি। ছেড়েই যদি দেবে, তবে কেনোই বা হাত ধ’রেছিলে? ছেড়ে-দেয়া হাত নতুন ক’রে আর কাউকে ধ’রতে পারে না। কারোর কারোরটা পারে হয়তো, আমারটা পারে না। আমি জানি, এটা তুমি জানতে। তবুও . . . . . . .

এখন ভাবি, আসলে তুমি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতে না। ভালোবাসলে প্রয়োজনে ব’কতে, মারতে, দ্রোহ ক’রতে, যা ইচ্ছে তা-ই ক’রতে; তবুও ছেড়ে যেতে না। ছেড়ে গেলে তো সব শেষ! তোমার ওই অহংকারী ইগোটাতে ছুরি বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে খুউব। তোমার সব ছেলেমানুষি বোকামি তো আমি মেনে নিতে শিখে গিয়েছিলাম; এটা তুমি জানতে, আমি জানতাম। অন্যকেউ তো আর জানতো না। তবে আমাদের জীবনের আয়োজনের ভার অন্য কারোর কাঁধে কেনো চাপাতে গেলে? জীবনের সব প্রশ্ন একটামাত্র উত্তরে কত সহজেই তুমি আমায় দিয়ে গেলে!

দুই।

যখন কেউ আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়, অথচ সেই সম্পর্কের কোনো নাম থাকুক, এটা চায় না, আমার কি সরে যাওয়া উচিত? উচিতই তো! আপনাকে জিজ্ঞেস করছি কেনো? সে আমাকে শুধুই হাতে রাখে, আমি সব জেনেও ওকে আমাকে হাতে রাখতে দিই। প্রথম প্রথম ভাবতাম, ওকে কিছু বলবো না, বললে যদি দূরে সরে যায়, আমি চাইতাম ও আমার ফোনটা অন্তত রিসিভ করুক, আমি আর কোনো ছেলের সাথে কথা বলে কখনোই এতোটা শান্তি পাইনি, ও যখন কথা বলতো, মনে হতো, পৃথিবীর সব সুখ যেন আমার মুঠোফোনটাতে ওই মুহূর্তে মিশে আছে; আস্তে আস্তে অধিকারবোধটা এরকম বিশ্রীভাবে জন্মে যাবে, এটা আমি আগে ভাবতেও পারিনি। জানেন, গত ৩ বছর ধরে এটা চলছে। ও আরো অনেক মেয়ের সাথে কথা বলে, ঘোরাঘুরি করে, আবার আমার সাথেও কথা বলে। আমি সব জানি, সব বুঝি; তবুও মোহ কাটে না, কিংবা আমিই কাটতে দিই না। ও আমার সাথে খুব যে ভালোভাবে কথা বলে, তা নয়; কিন্তু বলে, ৩ বছর ধরে বলে যাচ্ছে। ও আমার কাছে অদ্ভুত কথার যাদুকর! আমি সারাটাক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি, ও কখন ফোন করবে সে আশায়! মাঝে মাঝে ও আমাকে বলে, অমুক মেয়ে তমুক মেয়ে ওকে মেসেজ পাঠিয়েছে। ও দেখতে এমন, ও দেখতে তেমন, ও সুন্দর করে কথা বলে, ও সুন্দর গান করে, সাজলে ওকে সুন্দর দেখায়; আমিও তো অনেক ভালো কিছু পারি, অনেক ছেলেই বলে এটা, কিন্তু আমি যার কাছ থেকে শুনতে চাইতাম মনেপ্রাণে, মানে ওর কথা বলছি, ও কখনো ভুলেও বলতো না, আমি সাজগোজ করে ছবি দিলেও ও লাইক দেয় না, আমার তখন ইচ্ছে করে যতোগুলো লাইক পাই, সবগুলোকে ছুঁড়ে চোখের সামনে থেকে দূরে ফেলে দিই। আমি জানতাম, এবং এখনো জানি, ও আমাকে হাতে রেখেছে সবসময়ই, এবং এখনো রেখে যাচ্ছে। আমি নিজেকে স্টুপিড করে রাখি, ওকে হারাতে চাই না বলে; যদিও জানি, ওকে কখনোই পাইইনি, হারাবো কী! কুকুরকে এক রাত বাড়ির বাইরে বের করে দিন, এরপর আবার মেকি আদর করে হলেও ডেকে দেখুন, দেখবেন, ও ঠিকই চলে আসছে। ইদানীং নিজেকে পোষা কুকুরের মতো মনে হয়, তবুও ভালোবাসি, তাই সরে আসতে পারি না। আমি জানি, ও তো সরেই আছে। যে কথাগুলো ওর জন্যে স্বভাবজাত, ও অনেক মেয়েকেই বলে হয়তো, সেই কথাগুলোকে শুধু আমার জন্যেই বলা, এটা ভেবে ভেবে বিশ্বাস করে করে আমি আজকের এই দূরে চলে এসেছি, আমি আর কিছুতেই ফিরতে পারি না; মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পতঙ্গ কি আগুনের শিখাকে উপেক্ষা করতে পারে? ওর নিরাপদ অবস্থান, ও কখনোই ‘ভালোবাসি’, এটা মুখে বলেনি। আমি আগে জানতাম, এটা মুখে বলতে হয় না; এখন শিখেছি, এটাও বলতে হয়। ও আমার কাছে নেশার মতো, আর কারো কথা মাথায় এলে আমি এতোটা এলোমেলো হয়ে পড়ি না। প্রচণ্ড ভালোবাসা নিয়ে সহজ বন্ধুত্বের অভিনয় করা কঠিন। আমি জানি, ও অভিনয় করছে না, ও তো আমাকে ভালোবাসেইনি, তাই ওকে নিজের সাথে প্রতারণা করে অভিনয় করতেও হচ্ছে না। কিন্তু আমি ভাবি, এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব? আমাকে আশ্রয় দিতে পারবে না জেনেও ও এতদিন ধরে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে? কেনো? কেনো? কেনো? আমি আর পারছি না, ওকে যেকোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করে। আবার ভাবি, ফিরিয়ে আনবো কী! ও তো আর এসে চলে যায়নি যে ফিরিয়ে আনতে পারবো! অনেকদিন হলো, রাতে ঘুমের ওষুধ না খেয়ে ঘুমাতে পারি না। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা আছে বলেই বেঁচে আছি। কী আইরনি, না? মাঝে মাঝে অন্য ছেলেদের নিয়েও ঘুরে দেখেছি, ওকে জানিয়েছি কিংবা ও যাতে জানতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছি; ভেবেছি, দেখি এতে যদি একটু হলেও ঈর্ষান্বিত হয়। সে কোনো কিছুই হয়নি, ঠিক অন্য দিনের মতোই রাতে গল্প করেছে; নিরুত্তাপ নিরুদ্বিগ্ন নির্লিপ্ত নির্বিকার ভাবলেশহীন ছিলো পুরোপুরি! নিজেকে খুব ঘেন্না লাগে আজকাল; তবুও ওকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয় না। ওর বিয়ের বয়স হয়েছে, ও পাত্রী দেখছে, আবার আমাকেও স্পষ্ট করে বলছে না, তুমি বিয়ে করো, সংসারী হও। আমি আমার জন্যে ছেলে দেখতে দিই না বাসায়। মা-বাবার সাথে ঝগড়া করি, আমার পিঠাপিঠি ছোটো বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে, আর আমি সেই কবে থেকে গোঁ ধরে বসে আছি। কিসের আশায়? কার জন্যে? কেউ তো আমাকে অপেক্ষা করতে বলেনি, তবু কেনো, কীসের মোহে? আমি ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকলে ওকেই শুধু খুঁজতে থাকি। আমার আশেপাশের সবাইকে শুধু ফাঁকি দিয়েই যাচ্ছি দিয়েই যাচ্ছি। হাসছি, খেলছি, গাইছি, ঘুরছি, খাচ্ছি, চলছি, ফিরছি; সবকিছুই নিষ্প্রাণ নিস্তরঙ্গ নিস্তেজ নিশ্চুপ নিসাড়! ওকে তো কখনোই পাইনি, অথচ ইদানীং ওকে হারিয়ে ফেলার ভয় হয়। খুব কষ্ট হয়, খুউব! আমি তো কষ্ট চাইনি, আমি তো শুধু ওকেই চেয়েছিলাম। ও আসেনি, কষ্ট এসেছে।

ভাবনা: ছয়শো ছত্রিশ

………………………………………………………

এক।

ভালোবাসতেই হবে কেন?

সবাই সবাইকে ভালোবাসতে পারে না। কার যে কী ভাল লাগে এটা কখনোই কার কী ভাল লাগা উচিত এর সাথে মেলে না। অনেক পরিশীলিত মানুষও একেবারে বোহেমিয়ান ছন্নছাড়া রেকলেস টাইপের আরেকটা মানুষকে ভালোবাসতে পারে। এতে দোষের কিছুই নেই। একটি অপূর্ব ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে চুল বড় রাখে, গালভাঙা, একটা সিগ্রেটের জ্বলন্ত শেষ অংশ থেকে আরেকটা সিগ্রেট ধরায়, সেলিব্রেশন মানেই মদগাঁজার সুখ, মেজাজ খারাপ হলেই ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দেয়, পোশাকের দিকে খেয়াল নেই, শেভটেভ খুব একটা করেটরে না, মেয়েদের দেখলেই আড়চোখে তাকিয়ে চটজলদি শিস দিয়ে দিতে পারে, দিনরাত মেয়েবন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে পারে—এমন একটা ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হতেই পারে। এতে দোষের কিছুই দেখি না। যার যার জীবন তার তার। ধরা যাক, ওসবের ধারেকাছেও নেই, এমন একটা ছেলের সাথে মেয়েটার পরিচয় হল। ছেলেটাকে ওর একটু একটু করে ভাল লাগতে শুরু করল। মেয়েটা চাইল, ছেলেটা ও যেমনটা চায়, তেমন করে বদলে যাক। ছেলেটা পারল না। চাইলেই কি হুট করে সিগ্রেট ফুঁকতে শুরু করে দেয়া যায়? গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার দায় নেয়াটা খুব সহজ হয়ে ওঠে নিমিষেই? সবাই তো আর সবকিছু পারে না। কারোর কারোর জন্য লম্বা লম্বা চুল রাখার চাইতে লম্বা লম্বা লেখা লিখে ফেলাটা সহজ। মুভির রাফটাফ নায়ক হয়ে যাওয়ার চাইতে দুপাতা মুভি রিভিয়্যু লেখাটা সহজ। রবীন্দ্রনাথকে যখনতখন ফাকিং হ্যাকনিড ওল্ডফ্যাশনড বলে গালাগালি করার স্টাইলটা কেন সবাইকেই রপ্ত করতেই হবে? ওসব করেও যে ভাল স্টুডেন্ট, মানে ভাল রেজাল্টকরা স্টুডেন্ট কিংবা ভালমানুষ হওয়া যায় না, তা কিন্তু কিছুতেই নয়। আমি এও বলছি না, এর কোনটা অন্যটার চাইতে বেশি দামি। শুধু বলছি, যে যেটাকে দাম দেয় সে সেটা রক্তে মিশে আছে এমন কাউকে খুঁজে নিক। কেউ কেউ কেন কারোর সাথে এমন খেলা খেলতে ভালোবাসে যে খেলাটাকে খুব সহজেই জীবন বলে ভুল করতে ইচ্ছে করে? মানুষ যে তার ভেতরটা বদলাতে পারে না। ওই ভেতরটাকে ভালোবাসতে পারছি না, অথচ ভালোবাসি কী বাসি না, এই ভাবতে ভাবতে ভালোবাসার অভিনয় করে গেলাম, এটা কেমন ধরণের হিপোক্রিসি? আমার কনফিউশনকে যদি আরেকজন ভালোবাসা ভেবে বসে থাকে, তবে ওর বুকচাপা অভিমান আর কষ্ট কি একটুও অভিশাপ হয়ে আমাকে দহন করবে না? সবকিছু মিলিয়ে কাউকে ভালোবাসতে পারছ না, অথচ ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে? চেষ্টা করে দেখ, ও সত্যিই বদলায় কিনা তুমি যেভাবে চাও সেভাবে, কিংবা তুমি নিজেকে বদলাতে পারো কিনা ওর মনের মতো করে। কত সময় ধরে এ ব্যাপারটার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে? ততক্ষণই যতক্ষণ ভালোবাসাটা ‘ফর গ্রান্টেড’ পর্যায়ে চলে না যায়। ভালোবাসতেই হবে কেন? কেউ কি তোমাকে দিব্যি দিয়েছে নাকি? এত কীসের দায় তোমার? শরীরের? ওটার জন্য ভালোবাসি বলতে হবে কেন? শরীর আর মনের দায়কে যে আলাদা করে বুঝতে পারে না, সে প্রেমিক নয়, বড়জোর পুরুষ; প্রেমিকা নয়, বড়জোর নারী। জোর করে ভালোবাসার অভিনয় করে যেও না। তুমি ভাল অভিনেতা/ অভিনেত্রী হতে পার, কিন্তু সবাই তো আর ভাল দর্শক না। কেউ কেউ অভিনয়টাকে সারাজীবনেও ধরতে পারে না, ভালোবাসা ভেবে ভুল করে যায়, ভুল করতেই ভালোবাসে। দোহাই তোমার, ভেবো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে, অথচ কিছুই ঠিক হবে না। কেউ কেউ কেন কষ্ট দিতে, মন খারাপ করে দিতে, কাঁদাতে এতবেশি ভালোবাসে?

দুই।

এ ক’দিনে আমার উপলব্ধি, সমরেশ-বুদ্ধদেব পড়ে চাবাগান বোঝা যায় খুব অল্পই। গল্পসিনেমায় আপনি বড়জোড় চাবাগানে বুঁদ হয়ে থাকতে পারবেন, এর বেশিকিছু নয়। চাবাগান দেখতে হলে চাবাগান দেখতেই হবে, এছাড়া সম্ভব নয়। চাবাগানকে ভাল না বেসে থাকা কঠিন। যতই দেখি, ততই শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

দেউন্দি চাবাগানে এসে প্রথমেই এলাম ম্যানেজার সাহেবের বাংলোতে। বাজি ধরে বলতে পারি, এমন সুন্দর থাকবার জায়গা পেলে আপনি খুব করে চাইবেন, এ চাকরিটাই করতে। কী নেই চাবাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে? পৃথিবীর তাবত্‍ সুন্দর গাছগুলো চারপাশে ছড়িয়ে আছে। প্রকৃতির কাছাকাছি একটা সুন্দর বাড়িতে যা যা থাকতে পারে বলে আপনার কল্পনাতে আসতে পারে, এর সবই পাবেন এখানে। শুধুই মনে হতে থাকবে, জীবন এখানেই জীবন এখানেই! আমার মুহূর্তেই মনে হল, চাকরিটা ছেড়ে দিই, চাবাগানের ম্যানেজার হয়ে যাই। এ দেশ সব-পেয়েছির দেশ। সাথে একটা বিশাল রাজ্য তো আছেই! পাইকপেয়াদা সৈন্যসামন্তেরও কোনো অভাব নেই। হাত বাড়াতে হয় না, এর আগেই সবকিছু হাজির! সমস্যা একটাই: হাফপ্যান্ট পরে থাকতে হবে! সবুজের মাঝে জীবনযাপন। চাবাগানে প্রকৃতির সবটুকু সবুজ নির্যাস একসাথেই পাওয়া যায়। টিলা, হ্রদ, পাহাড়ি পথ, মায়াবী গাছের সারি, নিজের একটা গাড়ি। একটা মিষ্টি রোদমাখা বিকেল কিংবা একটা বৃষ্টিস্নাত অলস দুপুর কাটানো, কিংবা চাঁদনী রাতে নরোম জোত্‍স্নায় সমস্ত শরীরমন ধুয়ে নেয়া। আপনার কল্পনায় রাজ্যের যত পাখি আসে, সবগুলোই ক্ষণে ক্ষণে ডেকে যায়। বউ কথা কও, ঘুঘু, কোকিল, দোয়েল, ময়না, শালিক, নওরঙ, ফিঙে! কোনটা নেই এখানে! পোকাদের একটানা ডাকের রেশে সারাদিন দিব্যি কেটে যাবে। রাতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, হঠাত্‍ই সামনে এসে পড়ল একটা প্যাঁচা, খপ করে ধরে একটা পোকা খেয়ে নিল, কিংবা কয়েকটা শাদা খরগোশ ছুটে গেল গাড়ির সামনে দিয়েই! শেয়ালেরা দূর থেকেই চিত্‍কারচেঁচামেচি করে ভয় পাইয়ে দেয়। এসব দেখলে আর ভাবলে এসব নিয়েই বেঁচে থাকতে বড্ডো ইচ্ছে হয়।

চাবাগান নিয়ে চমত্‍কার কিছু বাংলা মুভি আছে। ওগুলো দেখলে বর্ষাকালে ওখানে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসতে ইচ্ছে করে, কিংবা পড়ন্ত বিকেলে কারোর হাত ধরে হাঁটতে। বন্ধুরা, দেখি এরকম কিছু মুভির নাম বলুন দেখি। আমিই শুরু করছিঃ উত্তমকুমারের ধনরাজ তামাং

তিন।

বিষের শিশি হাতে নিয়ে প্রথমেই যে ব্যাপারটা মাথায় কাজ করছিল, সেটা হল, এটা খেয়ে ফেললে সত্যি সত্যিই যদি মরে যাই? আচ্ছা, মরে যাওয়ার সময় কি খুব ব্যথা লাগে? এই যে বেঁচে আছি, এর যে কষ্ট, মরে যাওয়ার কষ্ট কি এর চাইতেও বেশি? আচ্ছা, মরেটরে যেতে কেমন লাগে? এভাবে মরে যাওয়ার সময় কি চারপাশটা অন্ধকার যায়? বেঁচে আছি অন্ধকারে, ওতেই মরব?

আমি মৃত্যুর পরের দৃশ্যটা কী হতে পারে সেটা কল্পনাতে আনার চেষ্টা করলাম। মা বিলাপ করে করে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাবে। বাবা কোর্ট ফেলে ছুটে আসবে। বাবাও অনেক কাঁদবে। মা-বাবা কাঁদলে শরীর ভেঙে পড়ে, ভীষণ অসুস্থ হয়ে যায়। আমার ছোটভাই কিছুক্ষণ ভাববে কী করা উচিত, এরপর সেও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করবে। আশেপাশে যারা থাকবে, ওরা কষ্টে না হলেও ওদের দেখে কান্নাকাটি শুরু করবে। কান্না মাত্রই সংক্রামক। সামনে বসে কেউ কাঁদলে তার সাথে জয়েন করাটা একটা সাধারণ ভদ্রতা।

এসব ভেবেটেবে ভাবলাম, যে জীবনটা আমার মায়ের দেয়া, সেটাকে আমার নিজের হাতে হত্যা করার কী অধিকার আমার আছে? নিজের জীবনের উপরে কারোরই একচ্ছত্র দাবি থাকে না। এসব ভেবে আমার কেমন জানি খুব গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল, মন হাল্কা করা কান্না। কিন্তু প্রচণ্ড কান্না পাওয়া সত্ত্বেও কাঁদতে পারছিলাম না। সমস্ত কান্নাই যেন বুকের ভেতরে গুমরে মরছিল। চাপাকান্না। কী কষ্ট! কী কষ্ট! . . . . . .

পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগমুহূর্তের কষ্টটা কেমন, এটা নিয়ে কিছু লেখা পড়েছিলাম। সবগুলো যে কষ্টেরই, এমনও নয়। আমার চোখে পৃথিবীর সর্বকালের সবচাইতে সেন্স অব হিউমারসমৃদ্ধ লেখক অস্কার ওয়াল্ডেরটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। ওটা বিষাদের ছিল না। আসলে, সুইসাইড করার নিয়ম হল, এত চিন্তাভাবনা করা যাবে না, জাস্ট করে ফেলতে হবে। মরে যাওয়া মানে তো সবকিছু নেই হয়ে যাওয়া। মৃত মানুষের ভাল লাগা খারাপ লাগা বলে তো আর কিছু নেই। কে কাঁদল, কে হাসল, এ নিয়ে ভাববার কী আছে? তবুও ভাবনা হয়ই! বেঁচে থাকার অভ্যেস যার, মরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সে একটু ভাবতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই।

শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশন মুভির একটা কথা আমার খুব প্রিয়: Get busy living, or get busy dying. হঠাত্‍ করেই এই ভাবনাটা মাথায় এল: আর দশজন উজ্জ্বল মানুষের মত না হোক, অন্তত একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে হলেও একবার বেঁচে থেকে দেখিই না কী হয়! শীর্ষেন্দুর সাঁতারু ও জলকন্যা’র জলকন্যাটির কথা মনে পড়ছিল। এখন বুঝি, স্রেফ বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। আচ্ছা, বেঁচে থাকলে কী হয়? বেঁচে থাকলে আর কিছু হোক না হোক, অন্তত কষ্ট পাওয়া যায়। মরে গেলে তো কিছুই পাওয়া যায় না। জীবনে কিছু না পাওয়ার চেয়ে কষ্ট পাওয়াও ভাল। কষ্ট পেতে হয়, ওটা সহ্য করতে হয়, কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করতে জানতে হয়। লোকে নাকি দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ায়। আমার পিঠ তো দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল! ওই সময়ের কষ্ট যন্ত্রণা বিষাদ হতাশা বিষণ্নতা কখনোই ভোলার নয়। বেঁচে ছিলাম বলেই তো এত এত বোনাস পেলাম! তাই, যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, জীবনে সবচাইতে আনন্দের কী? সফল হওয়া? অনেক টাকাপয়সার মালিক হওয়া? বড় হওয়া? তখন আমি বলি, বেঁচে থাকাটাই জীবনে সবচাইতে আনন্দের। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, কখনো কখনো স্রেফ বেঁচে থাকাটাও কী ভীষণ কষ্টের! মৃত্যুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেয়াটা কত বড় সাফল্য!

সন্দীপনের একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম, আমাদের এই অন্ধকার দিনগুলিতে গান হবে কি? হ্যাঁ, আমাদের এই অন্ধকার দিনগুলি নিয়ে একদিন গান হবে। আমি সেইদিনটার প্রতীক্ষাতে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জানতাম, সে গান লেখা বড় কঠিন, তবুও . . . . . . .

ভাবনা: ছয়শো সাইত্রিশ

………………………………………………………

এক।

আচ্ছা, আবার শুরু কর। স্যার, এ ৪ শব্দের কথাটা পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী কথা যেটা কেউ বলে না, কেউই না। আপনাকে ভালোবাসি, কারণ আপনি এটা সবাইকে বলেন।

সবাই তো বোঝে, ভাল কাজের ফল কিংবা খারাপ কাজের ফল সে পাবেই পাবে। আমিও একসময় ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম, স্যার। ক্লাস এইটে সুনামগঞ্জ থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় থার্ড হই। গ্রামের স্কুল-কলেজ থেকে ম্যাট্রিক-ইন্টারমেডিয়েট পাস করে এমসি কলেজে কেমিস্ট্রিতে যখন ভর্তি হলাম, তখন সবাই বলেছিল, কেমিস্ট্রি অনেক কঠিন সাবজেক্ট, তুমি পারবে না। আজ ওদের কথাই তো সত্যি হল। আমি অনার্সে রেজাল্ট খারাপ করলাম। কেউ কি ইচ্ছে করে রেজাল্ট খারাপ করে, স্যার? আমি ইন্টার পর্যন্ত কড়া শাসনে বড় হয়েছি। এরপর অনার্সে এসে লাগামছাড়া হয়ে পড়লাম। বাবা-মা তো আর সাথে থাকত না। আমাকে কে পায়? আমি যা মন চায়, তা-ই করতে পারি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পড়াশোনা করতাম না, শুধু ঘুরে বেড়াতাম। এমনকি পরীক্ষার আগেও কোন কোর্সের পরীক্ষা সেটা জানতাম না। কী লজ্জার কথা! এর জন্য আমি কাকে দোষ দেবো? বাবা-মা আর ছোট বোন তো ভাবত আমি পড়াশোনা করছি। আর আমি কিনা . . . . . . ছিঃ! এখন সবাই দূর দূর ছাই ছাই করে। আমি জবের কোন ক্লাস বুঝি না, আমার স্রেফ একটা চাকরি চাই, চাকরি। হোক থার্ড ক্লাস ফোর্থ ক্লাস, চাকরি তো! আপনি বলেন না, ছোটবেলায় ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে পরিচিত হয়ে যাওয়াটা একটা বিশ্রী ব্যাপার? খুব সত্যি কথা, স্যার। সবাই শুধু লাথি দেয়। একটু ভাল কথা কারোর মুখে কোনোদিনও শুনলাম না। আমার আর কোনো আত্মসম্মান নেই, জেদ নেই, পড়াশোনার প্রতি মনযোগ নেই, কারোর প্রতিই কোন ধরণের অভিযোগ নেই। গ্রামে যেতে পারি না, সবাই শুধু কথা শোনায়। ভুল করেছি, ভাল কথা। আমাকে শোধরাবার অন্তত একটা সুযোগ দাও। না হয় মেরে ফেল, তবুও ওরকম আঘাত কোরো না। মানুষ সুইসাইড করে শুনলে একসময় হাসতাম। এখন বুঝি, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা কত বেশি হলে মানুষ আর বাঁচতে চায় না। কিন্তু আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে থেকে আপনার লেখাগুলো পড়ি। আমি বোঝাতে পারব না স্যার, আপনার প্রতি আমার কত ঋণ। আমি জানি, আপনাকে একথাগুলো অনেকেই বলে। আমি কোনদিনই কল্পনাও করতে পারিনি যে আপনাকে আমি সামনাসামনি দেখব। ঈশ্বরের অশেষ দয়া, আজকে আপনার সাথে দেখা করে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারছি।

মদিনা মার্কেটের ওদিকে চাচার টংয়ে সাস্টের ছোটভাইদের সাথে আড্ডা দিয়ে ছোটভাই গিয়াস সহ সিপি’তে চিকেনথাই আর পেপসি’র অর্ডার দিয়ে ওয়েট করছিলাম। এমনসময় দেখলাম, সুদর্শন চেহারার লম্বা এক ছেলে খুব ইতস্তত ভঙ্গিতে ঢুকে আমার দিকে অনেক সংকোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি সুশান্ত স্যার না? এরপর ওর কথাগুলো শুনতে লাগলাম। ওকে উদভ্রান্ত পরাজিত সৈনিকের মতো দেখাচ্ছিল। কথা প্রায়ই আটকে যাচ্ছিল। এক ফাঁকে আমার সাথে অনেক কুণ্ঠা নিয়ে একটা ছবি তুলল। এই মুহূর্তে যা নিয়ে সে বেঁচে আছে, তা হল নিজের ক্ষমতার প্রতি প্রচণ্ড অবিশ্বাস। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে, রুমে ফিরতে আরো দেরি হয়ে যাবে জেনেও ওর সব কথা শুনলাম, ওর সাথে কথা বললাম, ওর শক্তির জায়গাগুলো চিনিয়ে দিলাম, সবাই আসলে কী বলে কেন বলে, এর কতটা শুনতে হবে, কতটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে, সেটা বোঝালাম। ও শুনল, ভাবল, ওকেও ভাল কিছু একটা করতে হবে। ও মন থেকে চাইলেই পারবে। ওর কাজের মধ্য দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে, ও কিছুতেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার মত কেউ নয়। ও কিছুতেই হারিয়ে যাবে না। একটুপর দেখলাম, ও চোখ মুছছে। একটা সিএনজি নিয়ে ওখান থেকে দ্রুত চলে এলাম, দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে নয়, আমি এইজাতীয় দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না বলে।

দুই।

কারোর কারোর প্রকৃতিবর্ণনা পড়ার সময়ে মনে হতে থাকে এই বুঝি কচি পল্লবটা ছুঁয়ে দেখছি যেন, বুনো ফুলের ঘ্রাণ যেন সত্যিই মাতাল করে দিচ্ছে, বৃষ্টির নরোম ধারা অশান্ত ঠোঁটযুগলকে শান্ত করে দিল বলে, বাগিচার সবক’টা ফুলের বাহারি রঙে এ দুচোখ জুড়াল, স্যাঁতস্যাঁতে পাতায় পাতায় সবুজ পোকাগুলো ওদের পথের রঙটাকেই ফাঁকি দিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে চোখের সামনেই, এত এত রকমের যে সবুজ জেগে জেগে ওঠে, সব পাখিরাই হয়ে ওঠে কাকভেজা, এরকম আরো কত কী! আমার সাহিত্যপাঠের ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতির একেবারে কাছাকাছি নিয়ে গেছেন এমন দুজনের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর বুদ্ধদেব গুহ। এই দুই মহান স্রষ্টার লেখা যতটা পড়া যায়, তার চাইতে অনেকবেশি হৃদয়মন দিয়ে ছোঁয়া যায়। পালামৌ সহ আরো দুএকটা সৃষ্টির কথা মাথায় রাখলে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ সাহিত্যসারল্যের যাদু এতটা নিবিড়ভাবে আর কোথাও পাই না অতটা। বুদ্ধদেব পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আমাদের পরম সৌভাগ্য আর দশটা পেশাজীবীর মতো উনি শুধু উনার পেশাতেই আড়াল হয়ে থাকেননি। ঘুরেছেন প্রচুর, ওরকম তো অনেকেই ঘোরেন। উনি লিখেছেনও। ঋভু পড়ে জেনেছি, উনি যে পরিমাণ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন, এর ফাঁকে এ বিপুলায়তন লেখালেখি করাটা সহজ ছিল না। সব লেখাই ভাল! সবিনয় নিবেদন’য়ের ঋতিকে খুব বেশি মনে না ধরলে বুদ্ধদেবের কাছ থেকে আমরা সুনীলের সুদূর ঝর্ণার জলে, ছবির দেশে কবিতার দেশে’র মার্গারিটা কিংবা মুজতবার শবনমের মতো কোনো অনন্যাকে পাইনি বটে, তবু যা পেয়েছি সে ঐশ্বর্য্যের তুলনা চলে না। প্রকৃতিসঙ্গমের সুখ সমস্ত শরীরমনকে কাঁপিয়ে দেয়। এই যেমন শুধু একটা স্থবির পাহাড়ও নতুন করে বাঁচতে ভাবতে ভালোবাসতে শেখাতে পারে। সিলেটের বৃষ্টি দেখতে পারাটা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সেরা উপহারগুলোর একটি। সিলেটের বৃষ্টির প্রকৃতি বুদ্ধদেব গুহর প্রকৃতি। গুহ পড়েছি, ভালবেসেছি, তাই বড় আপন মনে হয়। ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে সিলেটে এলাম এক সপ্তাহ হল। আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন সরকারি অফিস পরিদর্শন করি। যাই আর শুনি, দেখি ওরা কী করে, কীভাবে করে। এখন আছি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিসে। পৃথিবীর ২টা বিষয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। এক। যা আমার দরকার নেই। দুই। যাতে আমার আগ্রহ নেই। . . . . . . আজকের অফিসার ভদ্রলোকটি ভালমানুষ গোছের। উনি বলেই যাচ্ছেন আর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝিমিয়েই যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, এই ঝিমানোর সাথে রাতে ঘুম হওয়া না হওয়ার কোনো সম্পর্কই নেই। আমি মূলত ওদের দলে। আজকে ভাবলাম, ঝিমানোর চাইতে লেখালেখি করা উত্তম। তাছাড়া আমি দুটোই পারি। আজকে পরেরটায় গেলাম। কেন গেলাম? এ ক’দিনে আবিষ্কার করলাম, বেশিরভাগ সরকারি অফিসের ওয়াশরুমগুলোর ছিটকিনিতে সমস্যা থাকে। আজকেরটাতেও আছে। এ নিয়ে লিখব ভেবেটেবে কীসব নিয়ে লিখে ফেললাম। আমার প্রায়ই এমন হয়। বৃষ্টি, সিলেট; সাথে আমিও। সবচে বড় কথা, মোবাইলে চার্জও আছে। বৃষ্টিতেই সিলেট অপরূপা। ইচ্ছে আছে এমন একটা বৃষ্টিভেজা দিন চাবাগানের বাংলোয় কাটাব। দেখা যাক, কেউ দয়া করে ব্যবস্থা করে দেয় কিনা! আরো লিখতে ইচ্ছে করছে। পারছি না। জানি, পরে এ লেখা আমার আরো অনেক না-লেখা লেখার মতোই হারিয়ে যাবে। যে শিশুটি না জন্মেই চলে গেল, সে মৃত্যুর ব্যথা মেনে নেয়াটা বড় বেদনার। চাকরি বড়ো বিশ্রী জিনিস। খেয়ালখুশি মতো লিখতে দেয় না, পড়তে দেয় না, দেখতে দেয় না, শুনতে দেয় না। জীবিকার যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়, রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য হলেও চাকরিটা ছেড়ে দিই!

তিন।

এই কয়েকদিন ধরেই ক্লাসে ঘুমাই না, বই পড়ি। আজকে পড়েছি জাফর ইকবাল স্যারের ‘শান্তা পরিবার’। অসম্ভব রকমের মায়াজাগানো একটা বই। বইটা পড়েছি আর বারবারই এটা ভাবতে ভাল লেগেছে, আমিও এই শান্তা পরিবারের মতো একটা পরিবার চাই। তবে দুটো কথা। এক। শান্তাকে অবশ্যই আমার পাশে থাকতে হবে। ও মরে গেলে চলবে না। কারণ আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিনই ওকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসতে চাই। এমন মেয়েকে ভাল না বেসে থাকাটা আমার জন্য খুব কঠিন। তাছাড়া শান্তা চলে গেলে ওর বাচ্চাদের আমি কিছুতেই ওরকম করে মানুষ করতে পারব না। দুই। বাচ্চারা সংখ্যায় একটু কম হলেও আমার কোন আপত্তি নেই। ৬টাই হতে হবে, এমন নয়। শান্তার মেয়ে শাঁওলী। ভাইবোনদের মধ্যে ও সবার বড়। এই মেয়ে পুরোপুরিই মায়ের কার্বনকপি। ওকেও ভালোবেসে ফেলেছি। ও এত মায়াবী কেন? একটু বোকাও আছে। মেয়েরা একটু বোকা না হলে ঠিক মানায় না। থাক একটু বোকাসোকা। কিচ্ছু হবে না। তবে একটা সমস্যা আছে। এর জন্য আমার খুব রাগ হয়েছে। শাঁওলী টাইপের অপরিসীম মায়াবী মেয়েগুলো জাহিদ টাইপের ভয়ংকর গুণ্ডামার্কা ছেলেগুলোর কোমল দিকগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে ভালোবাসতে চায় কেন? মেজাজ খারাপ হয়। “জাহিদ আবার শব্দ করে হেসে ফেলল। সে যখন হাসে তখন তাকে ভারি সুন্দর দেখায়। সে জানে না।” এটা বইতে আছে। আশ্চর্য! জাহিদ টাইপের ছেলেদের জন্য এরকম করে লিখতে হবে কেন? আমরা যারা গুণ্ডামার্কা না, তারা হাসলে কি ভারি অসুন্দর দেখায় নাকি? এসব ভাবলে মনে হয়, লেখকরা মাথায় ছিটওয়ালা সুন্দরীদের চাইতেও বেশি মাথাখারাপ টাইপের হন। এই শান্তা পরিবারের পিচ্চি হওয়ার কথা ছিল ৬ জন; শান্তার ইচ্ছে। শান্তার অকালমৃত্যুতে সেটা ৫’য়ে থেমে যায়। এদের মধ্যে সবার ছোটটি ঝুমুর। ওর কাজই হচ্ছে পাকা পাকা কথা বলে সবার আক্কেলগুড়ুম করে দেয়া। এই পিচ্চিটা বেশিই কিউট। আমিও চাই আমার ওরকম একটা পিচ্চি হবে। আমি ওই পিচ্চিকে পড়াশোনা শেখাবো না, শুধু কিউট হওয়া শেখাবো। এরকম আরো কিছু ভাবনার খেলা আছে এই বইটিতে। এসব লেখা পড়ার সমস্যা অনেক। আমি এমনিতেই ভাল লেখকদের প্রতি অতিমাত্রায় দুর্বল। ওদের সব অপরাধ আমি অবলীলায় ক্ষমা করে দিতে পারি। ভাল কোন লেখা পড়ার সময় কেবলই মনে হতে থাকে, “এভাবে করে লেখা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।” আমার বন্ধুদের আমার লেখা পড়ানোর শাস্তি দিতে ইচ্ছে করে না।

শান্তার কথা বলছিলাম। ওর জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল, পরিবারকে ভালোবাসা, সন্তানদের আদর করা। ওর রেজাল্ট অনেক ভাল ছিল, চাইলেই ভার্সিটিতে পড়াতে পারত, মোটা মাইনের চাকরি করতে পারত। ওর কিছু জীবনদর্শন আমাকে ওর প্রেমে ফেলে দিয়েছে। তবে এমন মেয়ে যে নেই, তা কিছুতেই নয়। আমার এমন একজন মেয়ের সাথে পরিচয়ও হয়েছিল। একজন মানুষ কতটা সুন্দর করে ভাবতে পারে, ওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও ওকে আশ্রয় দিতে পারব না জেনে প্রশ্রয় দিইনি। কেন? যেমন হয় আরকি! যথারীতি মানুষের চেয়েও বড় ঈশ্বরের অমোঘ ইশারায় হৃদয়ের দাবি ধর্মের চোখ রাঙানিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। Heart proposes, religion disposes.