শূন্যবাদীরা সাধারণত জীবনের নিম্নলিখিত দিকগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা সরাসরি অস্বীকার করেন:
অস্তিত্বের অর্থ (Existential Nihilism): জীবনের কোনো নির্ধারিত বা উচ্চতর উদ্দেশ্য বা কারণ নেই। মানুষের অর্জন, সৃষ্টি বা দুঃখ-কষ্ট—সব কিছুই চূড়ান্তভাবে অর্থহীন।
নৈতিক মূল্য (Moral/Ethical Nihilism): নৈতিকতা বা নৈতিক মূল্যবোধের কোনো বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তি (objective foundation) নেই। কোনো কাজই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক বা ভুল নয়; ভালো-মন্দ সবই মানুষের তৈরি আপেক্ষিক ধারণা।
জ্ঞান (Epistemological Nihilism): চূড়ান্ত সত্য বা জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব। যা-কিছু জানা হয় বা বিশ্বাস করা হয়, তা সবই কেবল ব্যক্তিগত বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
বাস্তবতা (Metaphysical Nihilism): চরম অর্থে, হয়তো এই জগতের কোনো বস্তু বা বাস্তবতারই অস্তিত্ব নেই, অথবা বিশ্বজগত মানুষের বোধগম্যতার কাছে সম্পূর্ণ উদাসীন এবং অবোধ্য।
শূন্যবাদকে প্রায়শই চরম হতাশাবাদ বা সম্পূর্ণ সংশয়বাদ হিসেবে দেখা হয়, যা ব্যক্তি-মানুষকে নিরাশ, অনুপ্রাণিতহীন বা উদাসীন করে তুলতে পারে। তবে, কিছু দার্শনিক (যেমন ফ্রিডরিখ নিটশে) শূন্যবাদকে একটি সংকট হিসেবে দেখেছেন, যা অতিক্রম করে মানুষ নিজেই নতুন মূল্যবোধ তৈরি করার স্বাধীনতা পেতে পারে। শূন্যবাদের প্রধান কিছু প্রকারভেদ হলো:
নৈতিক শূন্যবাদ (Moral Nihilism): কোনো বস্তুনিষ্ঠ ভালো বা মন্দ নেই—কোনো নৈতিক সত্য বা সঠিক-ভুল নেই।
অস্তিত্ববাদী শূন্যবাদ (Existential Nihilism): জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই, মানুষের অস্তিত্বের কোনো গভীর অর্থ নেই।
জ্ঞানতাত্ত্বিক শূন্যবাদ (Epistemological Nihilism): জ্ঞান বা সত্য অর্জন করা অসম্ভব—সত্য বা জ্ঞানের কোনো চূড়ান্ত ভিত্তি নেই।
রাজনৈতিক শূন্যবাদ (Political Nihilism): রাষ্ট্র, আইন, শৃঙ্খলা—এসবকেই অস্বীকার করে।
ফ্রিডরিখ নিটশে, ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী জার্মান দার্শনিক, তাঁর বিখ্যাত উক্তি "ঈশ্বর মৃত"-এর মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতার নৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তির পতনকে নির্দেশ করেছিলেন। তাঁর মতে, আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় মূল্যবোধকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে, যার ফলস্বরূপ মানবতা একটি মূল্যবোধহীন শূন্যতার মুখোমুখি হয়েছে। এই ধারণাটি কেবল ঈশ্বরের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি ছিল না, বরং এমন একটি গভীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, যেখানে মানবজীবনকে চালিত করার জন্য আর কোনো চূড়ান্ত বা সর্বজনীন ভিত্তি নেই।
নিটশের এই চিন্তাধারা বিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রারম্ভিক বিন্দু হিসেবে কাজ করেছিল। জ্যঁ-পল সার্ত্র এবং আলবেয়ার কামুর মতো অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদরা নিটশের শূন্যবাদের সমস্যাকে স্বীকার করলেও, তাঁরা এর একটি ভিন্ন সমাধান প্রস্তাব করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর বা কোনো পরম সত্তার অনুপস্থিতি মানুষকে অর্থহীনতার দিকে ঠেলে দেয় না, বরং এটি মানুষের স্বাধীনতা ও দায়িত্বের ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে।
সার্ত্রের মতে, "অস্তিত্ব সারসত্তার পূর্বে", অর্থাৎ মানুষের কোনো পূর্বনির্ধারিত সারসত্তা বা উদ্দেশ্য নেই। মানুষ প্রথমে অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপর নিজের কর্ম ও পছন্দের মাধ্যমে নিজের সারসত্তা নির্ধারণ করে। এই ধারণার ফলস্বরূপ, মানুষকে তার জীবনকে অর্থপূর্ণ করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। এই স্বাধীনতা মানুষকে এক ধরণের "নিঃসঙ্গতা" বা "উদ্বেগ"-এর মুখোমুখি করে, কারণ তাকে নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী থাকতে হয়।
অন্যদিকে, আলবেয়ার কামু তাঁর "মিথ অফ সিসিফাস" গ্রন্থে জীবনের অর্থহীনতা বা "অ্যাবসার্ডিটি"-এর ধারণাকে অন্বেষণ করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, মানুষের চিরন্তন অর্থ অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা এবং মহাবিশ্বের উদাসীনতার মধ্যে একটি মৌলিক অসামঞ্জস্য রয়েছে। এই অসামঞ্জস্যই জীবনের অ্যাবসার্ডিটি। তবে, কামু এই অ্যাবসার্ডিটিকে অস্বীকার করতে বা এর থেকে পালাতে পরামর্শ দেননি, বরং তিনি একে "আলিঙ্গন" করার কথা বলেছিলেন। সিসিফাসের পৌরাণিক কাহিনির মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন যে, একজন ব্যক্তি তার নিয়তির অর্থহীনতা জেনেও তার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে এবং এর মধ্যেই একধরনের বিদ্রোহ ও আনন্দ খুঁজে পেতে পারে।
সুতরাং, যেখানে নিটশে ঈশ্বরকে মৃত ঘোষণা করে পশ্চিমা মূল্যবোধের সংকট তুলে ধরেছিলেন, সেখানে অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদরা এই শূন্যতার মধ্যে মানুষের জন্য নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁরা জোর দিয়েছিলেন যে, যদিও কোনো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য নেই, মানুষ তার নিজস্ব পছন্দ, কর্ম এবং দায়িত্বের মাধ্যমে নিজের জীবনের অর্থ তৈরি করতে সক্ষম। এই দর্শন মানুষকে নিষ্ক্রিয় শূন্যতার পরিবর্তে সক্রিয় স্বাধীনতা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দিকে পরিচালিত করে।
বৌদ্ধ দর্শনে 'শূন্যতা' (śūnyatā) ধারণাটি প্রচলিত অর্থে নিহিলিজম বা সর্বনাস্তিকতা নয়, যেখানে সব কিছুকে অর্থহীন বা মূল্যহীন বলে মনে করা হয়। বরং, বৌদ্ধ দর্শনের শূন্যতা এক গভীর দার্শনিক ধারণা, যা সব কিছুর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং অনিত্যতা বোঝায়। এর অর্থ হলো, কোনো বস্তুর নিজস্ব, স্বাধীন বা অপরিবর্তনীয় কোনো সত্তা নেই; সব কিছুই অন্যান্য কারণ ও শর্তের উপর নির্ভরশীল।
এই শূন্যতা ধারণা জীবনকে অর্থহীন বলে না। বরং, এটি মানব অস্তিত্বের একটি মৌলিক সত্য উন্মোচন করে, যা আসক্তি ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথ দেখায়। যখন আমরা বুঝতে পারি যে, সব কিছুই অনিত্য এবং কোনো কিছুরই স্থায়ী সত্তা নেই, তখন আমরা জাগতিক বস্তুর প্রতি আমাদের প্রবল আসক্তি কমাতে পারি। এই আসক্তিই দুঃখের মূল কারণ বলে বৌদ্ধ ধর্ম মনে করে। শূন্যতার উপলব্ধি মানুষকে অহংকার, লোভ, ঘৃণা এবং অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে, যা নির্বাণ লাভের পথে অপরিহার্য। এটি মানুষকে এমন এক জীবনযাত্রার দিকে পরিচালিত করে যেখানে সহানুভূতি, প্রজ্ঞা এবং উদারতা মুখ্য হয়ে ওঠে।
শূন্যবাদ হলো এক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে জীবন, সত্য বা নৈতিকতার কোনো নিরঙ্কুশ, সর্বজনীন ভিত্তি নেই বলে মনে করা হয়। তবে এর পরিণতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন—কারও কাছে এটি একধরনের হতাশা, আবার কারও কাছে এটি নতুন সৃজন ও স্বাধীনতার সুযোগ।
অদ্বৈত বেদান্ত সত্তাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করে ব্রহ্ম ও অজ্ঞানের আপাত বিরোধের চূড়ান্ত সমাধান প্রদান করে। এই বহু-স্তরীয় দৃষ্টিভঙ্গি এটিকে শূন্যবাদ (nihilism) থেকে আলাদা করে, যা দাবি করে যে সব কিছুই সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব। অদ্বৈতের মতে, জগৎ মিথ্যা হলেও তা শূন্য নয়; বরং এটি একটি আপেক্ষিক বাস্তবতা, যা চূড়ান্ত বাস্তবতার উপর আরোপিত। সত্তার এই স্তরগুলি হলো:
পারমার্থিক সত্য (Pāramārthika Satya): এটি চূড়ান্ত বা পরম সত্য। এই স্তরে কেবল ব্রহ্মই বিদ্যমান, যা অবিনাশী এবং অপরিবর্তনীয়। এটি এমন বাস্তবতা, যা অন্য কোনো অভিজ্ঞতা দ্বারা বাতিল (বাধিত) হতে পারে না। যেমন একজন ব্যক্তি যখন উপলব্ধি করে যে, সে সর্বদা একটি সিংহ ছিল, তখন তার মেষ হওয়ার মিথ্যা জ্ঞান বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু তার সিংহ-স্বরূপটি চিরকাল একই থাকে। এই স্তরে দ্বৈততার কোনো স্থান নেই, কেবল এক অদ্বৈত ব্রহ্মই সত্য।
ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika Satya): এটি আমাদের জাগতিক বা অভিজ্ঞতামূলক বাস্তবতা। এটি আমাদের জাগরণকালে অনুভূত হয়, যেখানে বস্তুগত জগৎ, জীব এবং ঈশ্বর সবই বাস্তব বলে মনে হয়। এই স্তরের বাস্তবতা, যেমন একটি মাটির পাত্র, অন্য কোনো একক মনের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি সবার জন্য সমানভাবে বিদ্যমান। এই স্তরটি পারমার্থিক সত্যের তুলনায় আপেক্ষিক এবং ক্ষণস্থায়ী। এই স্তরেই মায়া ও অবিদ্যার কার্যকারিতা বিদ্যমান এবং এখানেই জগৎ, জীব ও ঈশ্বরের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুভূত হয়। যতক্ষণ না পারমার্থিক জ্ঞান লাভ হয়, ততক্ষণ এই ব্যাবহারিক জগৎ সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়।
প্রাতিভাসিক সত্য (Prātibhāsika Satya): এটি আপাত বা অলীক বাস্তবতা, যা কেবল মনের উপর নির্ভরশীল, যেমন স্বপ্ন, হ্যালুসিনেশন বা দড়িতে সাপ দেখার বিভ্রম। এই বাস্তবতা কেবল ব্যক্তির মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং এটি সহজেই বাতিল হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্বপ্নে একটি বাঘের অস্তিত্ব কেবল সেই স্বপ্নদ্রষ্টার মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এবং এটি অন্য কোনো বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল নয়। এই স্তরের বাস্তবতা কেবল সেই ব্যক্তির জন্য সত্য, যে এটি অনুভব করে, এবং উচ্চতর জ্ঞানের দ্বারা এটি তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল হয়ে যায়।
এই কাঠামোতে, ব্রহ্ম ও অজ্ঞানের বিরোধটি পারমার্থিক স্তরে কোনো সমস্যা নয়, কারণ সেই স্তরে অজ্ঞানের কোনো অস্তিত্বই নেই। সমস্যাটি কেবল ব্যাবহারিক স্তরেই বিদ্যমান, যেখানে জীব অজ্ঞানের দ্বারা নিজেকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক মনে করে। এই স্তরবিন্যাস অদ্বৈতকে একটি শক্তিশালী দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করে, যা একই সাথে জগতের আপাত বাস্তবতা এবং ব্রহ্মের পরম সত্যতাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
অদ্বৈতের বিবিধ সমাধান বিবর্ত (Vivarta) এবং বাধ (Badha) নামক দুটি মূল ধারণার উপর নির্ভরশীল।
বিবর্ত (Vivarta): এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো বস্তু তার প্রকৃত স্বরূপ পরিবর্তন না করেই অন্যরূপে প্রতিভাত হয়। দড়ি সাপের মতো দেখানোর উপমাটি এর একটি নিখুঁত উদাহরণ। দড়িটি সাপে পরিবর্তিত হয় না; কেবল সাপের একটি প্রতিভাস তার উপর আরোপিত হয়। একইভাবে, জাগতিক জগৎ ব্রহ্মের একটি বিবর্ত, অর্থাৎ এটি ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি প্রতিভাস। এখানে কারণ (ব্রহ্ম) তার উপাদানে কোনো পরিবর্তন না করেই কার্যের (জগৎ) মতো দেখায়। এই প্রক্রিয়া ব্রহ্মের নির্গুণতাকে অক্ষত রাখে এবং জগৎকে তার কার্য হিসেবে ব্যাখ্যা করে, যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি ভ্রম।
বাধ (Badha): এটি জ্ঞান দ্বারা একটি মিথ্যা ধারণাকে বাতিল বা দূরীভূত করার প্রক্রিয়া। অদ্বৈতের মতে, বাধ কেবল সেইসব ধারণাকে বাতিল করে, যা আপাত বাস্তব মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে নয়। যে-জিনিসটি বাস্তব, তাকে বাতিল করা যায় না, এবং যা সম্পূর্ণ অবাস্তব (যেমন বন্ধ্যা নারীর পুত্র), তাকে বাতিল করার প্রয়োজন হয় না। যখন একজন ব্যক্তি দড়িটিকে সাপ মনে করে, তখন সঠিক জ্ঞানের দ্বারা সাপের অস্তিত্ব বাতিল হয়, কিন্তু দড়িটির নয়। এই প্রক্রিয়াটি ‘নেতি, নেতি’ (neti, neti) নামে পরিচিত, যার অর্থ "এটি নয়, ওটি নয়"। এই প্রক্রিয়াটি বস্তুকে প্রত্যাখ্যান করে না, বরং তার সীমাবদ্ধতা ও মিথ্যা পরিচয়ের প্রতি আমাদের ধারণাকে অস্বীকার করে। বাধের গভীর তাৎপর্য হলো এই যে, এটি চূড়ান্তভাবে কোনো কিছু বিলীন করে দেয় না, বরং তার আসল প্রকৃতি উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। জাগতিক বাস্তবতাকে বাধিত করার অর্থ এটিকে শূন্য করে দেওয়া নয়, বরং এটি যে ব্রহ্মেরই একটি রূপ, তা উপলব্ধি করা। চূড়ান্ত জ্ঞান লাভের মাধ্যমে যখন জীব তার ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি করে, তখন মায়া ও অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট জগৎ, জীব ও ঈশ্বরের সকল দ্বৈততা বাধিত হয় এবং ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।