৩. প্রত্যভিজ্ঞা (Recognition): অদ্বৈতের এই ব্যাবহারিক বাস্তববাদ প্রত্যভিজ্ঞা বা “এটি সেই একই বস্তু, যা আমি আগে দেখেছিলাম”—এর মাধ্যমে সমর্থিত হয়। এই প্রত্যভিজ্ঞা আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যখন কোনো বস্তুকে পুনরায় দেখি, তখন আমাদের মনে হয়, এটি সেই একই বস্তু, যা আমরা পূর্বে দেখেছিলাম। বস্তুর এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে, বস্তুটি কেবল উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল নয়, যা আত্মগত ভাববাদের (Subjective Idealism) মূল দাবিকে খণ্ডন করে। এই যুক্তি অদ্বৈতকে নিছক আদর্শবাদ থেকে একটি ব্যাবহারিক বাস্তববাদী দর্শনে উন্নীত করে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বস্তুর ধারাবাহিকতা এবং পুনরাবর্তন অভিজ্ঞতা এই ব্যাবহারিক বাস্তবতাকে শক্তিশালীভাবে সমর্থন করে।
অদ্বৈত বেদান্তের দার্শনিক আলোচনাটি ধারাবাহিক আপত্তি ও তার সুসংগঠিত খণ্ডন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তার চূড়ান্ত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। এই খণ্ডনগুলি মূলত তিনটি কৌশলের উপর নির্ভরশীল:
সত্তার স্তরভেদ (Sattā-Traya): অদ্বৈত আপেক্ষিক (ব্যাবহারিক) এবং পরম (পারমার্থিক) সত্যকে পৃথক করার জন্য সত্তার তিনটি স্তর ব্যাখ্যা করে। প্রাতিভাসিক সত্তা (স্বপ্ন বা ভ্রমের বাস্তবতা), ব্যাবহারিক সত্তা (জাগতিক বাস্তবতা যা অধিকাংশ মানুষের কাছে সত্য) এবং পারমার্থিক সত্তা (ব্রহ্মের চূড়ান্ত বাস্তবতা)। এই স্তরভেদ বোঝায় যে, জাগতিক বস্তুসমূহ ব্যাবহারিক স্তরে সত্য হলেও, পরম অর্থে তা ব্রহ্ম ভিন্ন নয়।
অবিদ্যাকে ভাবরূপ ও অনির্বচনীয় সত্তা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা: অদ্বৈত অবিদ্যাকে একটি ইতিবাচক (ভাবরূপ) এবং অনির্বচনীয় (যা সৎ বা অসৎ কোনোটিই নয়) সত্তা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে যৌক্তিক অসামঞ্জস্য এড়িয়ে যায়। অবিদ্যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি শক্তি, যা জগৎকে প্রক্ষেপিত করে, কিন্তু তা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়।
অন্বয়-ব্যতিরেক পদ্ধতির মাধ্যমে আত্মার নিত্যতা প্রমাণ করা: এই পদ্ধতিতে আত্মার নিত্যতা এবং ব্রহ্মের সাথে তার অভিন্নতা প্রমাণ করা হয়, যা মুক্তিলাভের পথ উন্মুক্ত করে।
অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে "একজীব তত্ত্ব" (eka-jīva-vāda) জীব এবং জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে এক স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই তত্ত্ব অনুসারে, বাস্তবে কেবল একজন জীবই সত্য, এবং বাকি সমস্ত জীব, এমনকি ঈশ্বর ও গুরুও, সেই একক জীবের মনের দ্বারা সৃষ্ট স্বপ্ন-মূর্তিমাত্র।
একজীব তত্ত্বের মূল যুক্তিগুলো নিম্নলিখিত ধারণাগুলির উপর প্রতিষ্ঠিত:
একক জীব এবং স্বপ্ন-সৃষ্টি: এই মতবাদ অনুসারে, সমগ্র জগৎ এবং এর অন্তর্ভুক্ত সমস্ত জীব (ব্যক্তি, প্রাণী, এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক গুরু) একজন মাত্র জীবের মনের কল্পনা। ঠিক যেমন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা স্বপ্নে অসংখ্য চরিত্র, ঘটনা এবং পরিবেশ দেখতে পায়, অথচ সে একাই সেই স্বপ্নের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা, তেমনি একমাত্র জীবই নিজের অবিদ্যাপ্রসূত কল্পনায় এই বিশাল বহুত্বপূর্ণ জগতকে সৃষ্টি করে। এই জগত সেই একক জীবের মনের বাইরে স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নয়।
অবিদ্যা এবং কল্পিত জগৎ: ওই একমাত্র জীবই অবিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে। অবিদ্যা বলতে এখানে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞানতাকে বোঝানো হয়েছে। এই অবিদ্যার প্রভাবেই জীব নিজেকে ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন মনে করে এবং ঈশ্বর, গুরু, অন্যান্য জীব ও সমগ্র জাগতিক অভিজ্ঞতাকে কল্পনা করে। এই কল্পনা তার জাগতিক জীবন এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তি তৈরি করে। জাগতিক সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু—সবই এই অবিদ্যার খেলা।
মুক্তি এবং বিলুপ্তি: যখন এই একমাত্র জীব স্ব-স্বরূপ জ্ঞান লাভ করে এবং তার অবিদ্যা সম্পূর্ণভাবে নাশ হয়, তখন সে মুক্তি লাভ করে। এই মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই তার দ্বারা কল্পিত সমস্ত সৃষ্টি বিলুপ্ত হয়ে যায়, কারণ তাদের বাস্তবতা সেই একমাত্র জীবের উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল ছিল। এই অবস্থায়, কেবল অদ্বিতীয় ব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকে। একজীব তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, যেহেতু অন্যান্য সমস্ত জীব কেবল সেই একমাত্র জীবের কল্পনা, তাই সেই একমাত্র জীব মুক্ত হলেই কল্পিত জগত শেষ হয়ে যায় এবং কল্পিত জীবদের পৃথক মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর হয়ে পড়ে।
একজীব তত্ত্বের বিপরীত মতবাদ হলো "বহুজীব তত্ত্ব" (aneka-jīva-vāda)। এ তত্ত্ব বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি জীব স্বতন্ত্র এবং তাদের প্রত্যেকের একটি নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। এই মতবাদে, প্রতিটি জীব তার নিজের সাধন, কর্ম এবং জ্ঞানের মাধ্যমে একে একে মুক্তি লাভ করে। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি জীবের ব্যক্তিগত সাধনার ফলস্বরূপ মুক্তি ঘটে। এই মুক্তির ফলে একটি জীবের জন্য সৃষ্টি শেষ হয়, কিন্তু অন্যদের জন্য তা চলতে থাকে। একজীব তত্ত্ব বহুজীব ধারণাকে নাকচ করে দেয়, কারণ এটি বহু জীবের পৃথক অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
একজীব তত্ত্বের বিরুদ্ধে বেশ কিছু শক্তিশালী আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, যার প্রত্যেকটিরই অদ্বৈতপক্ষ যুক্তিপূর্ণ জবাব দিয়েছে:
এক জীব মুক্ত হলে সবাই মুক্ত—এই আপত্তি: এই আপত্তি মূলত বহুজীব ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। অদ্বৈতপক্ষ এটিকে অযৌক্তিক বলে মনে করে। যদি বহুত্বই মায়া হয়, তবে "সবার মুক্তি" এই প্রশ্নটিই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, "সবাই" বলতে যা বোঝানো হচ্ছে, তা সেই একক জীবের কল্পনারই অংশ। একমাত্র জীব যখন মুক্ত হয়, তখন তার কল্পিত "সবাই" স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলীন হয়ে যায়, কারণ তাদের নিজস্ব কোনো স্বতন্ত্র বাস্তবতা নেই। তাদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র সেই একক জীবের উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল। আমাদের অনুভূত বহুত্ব একটি ভ্রম এবং চূড়ান্ত সত্যে, কেবল অদ্বৈত ব্রহ্মই বিদ্যমান। এই তত্ত্ব ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে জীবাত্মার পরম মুক্তি এবং সকল উপাধি থেকে স্বাধীনতার পথ নির্দেশ করে। যদিও এটি প্রথম দর্শনে বিতর্কিত মনে হতে পারে, এর দার্শনিক ভিত্তি এবং যুক্তি অদ্বৈত বেদান্তের মূল নীতিগুলির সঙ্গে গভীরভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।
দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় বহু জীব দেখা যায়—এই আপত্তি: প্রাত্যহিক জীবনে আমরা অসংখ্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তাদের সুখ-দুঃখ অনুভব করি। অদ্বৈত মতে, এটি স্বপ্নের বহুত্বের মতো। যেমন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেকে ছাড়া আরও অনেক মানুষকে স্বপ্নে দেখে, কিন্তু বাস্তবে তারা সবাই তার স্বপ্নেরই অংশ, তাদের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। তেমনি, একমাত্র জীব নিজেকে ছাড়া যে অসংখ্য জীব দেখে, তারা তার অবিদ্যার কারণে সৃষ্ট ভ্রমমাত্র। স্বপ্নদ্রষ্টা যেমন একমাত্র বাস্তব সত্তা, বাকিরা তার স্বপ্নের শিকার। আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতাও সেই স্বপ্নবৎ।
কোনো শরীরের জীব সত্য, বাকিরা মিথ্যা—এটা কীভাবে হয়? এই আপত্তি বা প্রশ্নটি ওঠে, যখন শরীর ও আত্মাকে মিলিয়ে ফেলা হয়। অদ্বৈত মতে, জীব বলতে বোঝায় অবিদ্যা-সীমাবদ্ধ চৈতন্য, শরীর নয়। শরীর নশ্বর এবং জড়। তাই, কার শরীর সত্য আর কারটা মিথ্যা, এই প্রশ্নটিই অবান্তর। জীব হলো চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম, যা অবিদ্যার উপাধি দ্বারা আচ্ছন্ন। যে-জীব অবিদ্যা মুক্ত হয়, সেই তার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। শরীর কেবলমাত্র সেই অবিদ্যার বাহন।
একজীব তত্ত্বের সমর্থনে উদাহরণ হিসেবে অনেকে বলেন, একজন যোগী একজীব হলেও বহু দেহ ধারণ করতে পারেন (যোগিক সিদ্ধির মাধ্যমে)। তিনি নিজের সত্যতা বোঝেন এবং অন্য দেহগুলোকে মিথ্যা বলে জানেন। এই উদাহরণে, যিনি চৈতন্য, তিনিই স্বীকারকারী বা দ্রষ্টা, এবং বহুরূপ দেহ কেবল তাঁর কল্পিত। অদ্বৈতপক্ষ এই উদাহরণটি ব্যবহার করে ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝায়: একইভাবে ব্রহ্ম-চৈতন্য অসংখ্য বহুরূপ জগত কল্পনা করে, কিন্তু নিজে একক ও অদ্বিতীয়। জগৎ ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়, বরং ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি প্রতীতি, অর্থাৎ একটি আপাতদৃষ্টি।
শরীর-অবভাস ও চৈতন্য: শরীর এবং চেতনার সম্পর্ক নিয়েও অদ্বৈত দর্শন গভীর আলোচনা করে। একই শরীরের মধ্যেই আমরা দেখি যে, পায়ের ব্যথা মাথায় অনুভব হয় না, অথবা এক অঙ্গের সীমাবদ্ধ চৈতন্য অন্য অঙ্গের ব্যথা জানে না। এই ধরনের সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করে যে, চৈতন্য একাধিক নয়, বরং শরীরভেদে বিভিন্ন অনুভব আমাদের বিভ্রান্ত করে। তাই, বহুজীব তত্ত্ব শরীরকে আত্মা হিসেবে ধরে নেবার ফল। বস্তুত, চৈতন্য-আত্মা সব জীবের মধ্যে এক এবং অভিন্ন। শরীরের সীমাবদ্ধতা বা বৈচিত্র্য আত্মার বহুত্ব প্রমাণ করে না, বরং অবিদ্যার প্রভাবে সৃষ্ট উপাধির সীমাবদ্ধতাকেই নির্দেশ করে।
বিশ্ব (ব্যাবহারিক সত্তা) এবং মরীচিকা (প্রতিভাসিক সত্তা) উভয়েরই স্বাধীন অস্তিত্ব causal condition অর্থাৎ অবিদ্যা-র ওপর নির্ভরশীল। এই কারণ বা অবিদ্যা পরিবর্তিত হলে তাদের অস্তিত্বের অভাব ঘটে। অর্থাৎ, অবিদ্যার বিনাশ হলে এই জগতগুলোও বিলীন হয়ে যায়। "বস্তু কেবল প্রতীতি-নির্ভর"—এই মতের সঙ্গে অদ্বৈতবাদের গভীর সংযোগ রয়েছে।
জর্জ বার্কলের "Esse est percipi" (To be is to be perceived—অস্তিত্ব মানেই প্রতীয়মান হওয়া) মতবাদের সঙ্গে অদ্বৈতবাদের একধরনের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এই মতানুসারে, যদি বস্তু কেবল দেখামাত্রই থাকে, তবে অপ্রতীত অবস্থায় তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অদ্বৈতপক্ষ এই ধারণাকে আরও গভীর অর্থে ব্যাখ্যা করে:
জাগতিক বাস্তবতা ও ব্যাবহারিক সত্য: জগত ও দ্বৈততা অবিস্থিত বা অবাস্তব। কিন্তু জাগতিক অভিজ্ঞতার জন্য এটিকে ব্যবহারিক সত্য হিসেবে ধরতে হয়, কারণ জাগতিক কার্যকারিতা এর ওপরই নির্ভরশীল। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে-জগতকে দেখি, তা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা না হলেও পরমার্থিক অর্থে তা বাস্তব নয়।
জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয়ই ভ্রম: পার্থক্য শুধু এই যে, স্বপ্ন জাগরণের জ্ঞান দ্বারা লুপ্ত হয়, আর জাগ্রত জগৎ লুপ্ত হয় ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে জাগতিক অভিজ্ঞতাও স্বপ্নের মতোই বিলীন হয়ে যায়। চূড়ান্ত বিচারে, ব্যক্তির অনুভব পরাধীন বস্তু, দুঃস্বপ্নের মতোই।
স্মৃতি ও পুনঃস্বীকৃতি সমস্যা:
আপত্তি: যদি প্রতিটি জ্ঞান বিচ্ছিন্ন হয়, তাহলে কোনো বস্তু পুনরায় দেখলে কীভাবে বোঝা যাবে যে, এটিই আগের দেখা বস্তুটি? স্মৃতির মাধ্যমে আমরা কীভাবে একই বস্তু চিনে নিতে পারি, যদি তার বাস্তবতা শুধুমাত্র বর্তমান জ্ঞাননির্ভর হয়?
অদ্বৈতপক্ষ স্মৃতির ভিত্তি ব্যাখ্যা করে; যেমন অন্ধকারে দশজন ব্যক্তি একই দড়িকে সাপ মনে করে পালায়। পরে সবাই বলে, "আমরা একই সাপ দেখেছি।" কিন্তু বাস্তবে প্রত্যেকের ভ্রম ছিল পৃথক। পুনঃস্বীকৃতি কেবল স্মৃতিভিত্তিক ধারণা, বস্তুটির বাস্তব অস্তিত্বের প্রমাণ নয়। স্মৃতি শুধুমাত্র পূর্ব-অভিজ্ঞতার ছাপ বহন করে, যা বস্তুর পারমার্থিক অস্তিত্ব প্রমাণ করে না। এটি কেবল ব্যাবহারিক স্তরে আমাদের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।
আরেক আপত্তি: জাগ্রত জ্ঞান ইন্দ্রিয়নির্ভর, যখন স্বপ্ন বা দড়ি-সাপ ভ্রম অবিদ্যা-নির্ভর। তাই এই দুটিকে সমানভাবে দেখা যায় না। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে অনেকে বেশি বাস্তবসম্মত মনে করে।
অদ্বৈত দর্শন এর জবাব দেয় এভাবে: জ্ঞান উৎপাদনে চারটি উপাদান জড়িত থাকে—বস্তু, ইন্দ্রিয়, মন এবং জ্ঞানকারী আত্মা। আত্মা স্বপ্রকাশমান এবং চৈতন্যস্বরূপ; ইন্দ্রিয় ও মন জড়। ইন্দ্রিয় কেবল জ্ঞানের একটি উপলক্ষ্য বা মাধ্যম, কিন্তু জ্ঞান আত্মার প্রকাশ। স্বপ্নের ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, চোখ দিয়ে দেখছি, যদিও বাস্তবে চোখ ব্যবহার হয় না। তাই ইন্দ্রিয়-উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি উভয়ই ভ্রমের অংশ হতে পারে। ইন্দ্রিয় শুধুমাত্র তথ্যের বাহক, কিন্তু জ্ঞানের প্রকৃত উৎস আত্মা। ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ জ্ঞানও অবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, ফলে তা পারমার্থিক সত্য না-ও হতে পারে।
অদ্বৈত এই বিষয়ে জোর দেয় যে, দ্বৈত (Duality) হলো কেবল ব্যাবহারিক সত্য, যা অজ্ঞানজনিত ভ্রমের ফসল। কিন্তু অদ্বৈত (Non-duality) হলো একমাত্র পারমার্থিক সত্য। মুক্তি হলো এই স্তরগুলির বিভ্রমের নিবৃত্তি—নিজের চিরন্তন, অদ্বৈত স্বরূপকে পুনরায় উপলব্ধি করা, যা অজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে বিনাশ করে এবং সমস্ত জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্ত করে।