বেদের আলোয় অদ্বৈত: উনিশ



অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে অবিদ্যার স্বরূপ সংক্রান্ত প্রধান আপত্তিগুলি এবং অদ্বৈতের যুক্তি-সংরক্ষণগুলি নিম্নরূপ বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

১. আশ্রয়ের অনুপপত্তি:

সমালোচকের আপত্তি (পূর্বপক্ষ): মূল আপত্তি হলো, যদি ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং শুদ্ধ হয়, তাহলে জ্ঞান বা অজ্ঞানের মতো দ্বৈত ভাব ব্রহ্মে কিভাবে থাকতে পারে? অবিদ্যা কোনো অপবিত্র বা অসত্য ধারণা হলে তা শুদ্ধ ব্রহ্মের আশ্রয় হতে পারে না, কারণ এতে ব্রহ্মের শুদ্ধতা ক্ষুণ্ন হয়। ব্রহ্ম নির্গুণ, নিরাকার এবং সকল বিকার থেকে মুক্ত; সেখানে অবিদ্যার আশ্রয় গ্রহণ যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।

অদ্বৈতের খণ্ডন-কৌশল (সিদ্ধান্ত): অদ্বৈতবাদীরা এই আপত্তির উত্তরে বলেন যে, ব্রহ্মই অবিদ্যার আশ্রয়। তবে অবিদ্যাকে 'অনির্বচনীয়' বলা হয়। অনির্বচনীয় মানে যা 'সৎ' (সত্য) বা 'অসৎ' (মিথ্যা) কোনোটিই নয়, বরং উভয়ের বাইরে এক অদ্ভুত সত্তা। এটি 'ভাবরূপ অজ্ঞান' নামেও পরিচিত, অর্থাৎ এটি একটি ইতিবাচক বা বিদ্যমান সত্তা, যা কেবল জ্ঞানের অভাবে থাকে না, বরং একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে কাজ করে। যেহেতু অবিদ্যা অনির্বচনীয়, তাই এটি ব্রহ্মকে স্পর্শ করে না বা ব্রহ্মের স্বরূপে কোনো পরিবর্তন আনে না। অবিদ্যা ব্রহ্মের মায়াশক্তি মাত্র। যেমন, একটি দড়িকে অন্ধকারে সাপ মনে হলেও, দড়ির স্বরূপ পরিবর্তিত হয় না। তেমনই, ব্রহ্মে অবিদ্যা থাকলেও ব্রহ্মের শুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ থাকে। অবিদ্যা ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি ভ্রমমাত্র, যা ব্রহ্মের প্রকৃত সত্তাকে প্রভাবিত করে না।

২. স্বরূপের অনুপপত্তি:

সমালোচকের আপত্তি (পূর্বপক্ষ): সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন যে, অবিদ্যার স্বরূপ কী? অবিদ্যা হয় 'সৎ' (সত্য), নতুবা 'অসৎ' (মিথ্যা) হতে হবে। তৃতীয় কোনো মধ্যবর্তী অবস্থান সম্ভব নয়। যদি অবিদ্যা সৎ হয়, তাহলে এটি ব্রহ্মের মতোই নিত্য এবং শাশ্বত হয়ে যাবে, যা অদ্বৈতের ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এই মতবাদের পরিপন্থী। আর যদি অবিদ্যা অসৎ হয়, তাহলে এর কোনো অস্তিত্বই থাকে না এবং এটি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না, যা আমাদের অজ্ঞানতার অভিজ্ঞতার বিরোধী।

অদ্বৈতের খণ্ডন-কৌশল (সিদ্ধান্ত): অদ্বৈতবাদীরা বলেন যে, অবিদ্যা 'মিথ্যা'। তবে এই মিথ্যাত্ব প্রচলিত মিথ্যাত্বের ধারণা থেকে ভিন্ন। অদ্বৈতমতে, মিথ্যা মানে যা অনুভূত হয় (অর্থাৎ যার অস্তিত্ব প্রতীয়মান হয়), কিন্তু জ্ঞান দ্বারা যা বিনাশযোগ্য। এটি সৎ-অসৎ থেকে ভিন্ন এক অদ্ভুত সত্তা। অবিদ্যাকে 'সদসৎ-বিলক্ষণ' বা 'অনুবচনীয়' বলা হয়। এর অর্থ হলো, এটি যেমন সম্পূর্ণ অসৎ নয় (কারণ এর অস্তিত্ব প্রতীয়মান হয়, যেমন স্বপ্নের জগৎ), তেমনই সম্পূর্ণ সৎও নয় (কারণ যথার্থ জ্ঞান দ্বারা এর বিনাশ ঘটে)। অবিদ্যা একটি ভ্রমকালীন অস্তিত্ব ধারণ করে, যা একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে বিলীন হয়ে যায়। যেমন, মরিচিকার ভ্রমে জল দেখা যায় এবং তার প্রতি মানুষের পিপাসা জন্মায়, কিন্তু কাছে গেলে তার অস্তিত্ব থাকে না। তেমনই অবিদ্যাও ততক্ষণ বিদ্যমান থাকে, যতক্ষণ না ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়।

৩. মুক্তির অনুপপত্তি:

সমালোচকের আপত্তি (পূর্বপক্ষ): যুক্তি ওঠে, যদি অবিদ্যা অনাদি হয় (অর্থাৎ যার কোনো শুরু নেই), তাহলে অনাদি সত্তার বিনাশ সম্ভব নয়। যা-কিছু অনাদি, তা সাধারণত নিত্য বলে বিবেচিত হয়। যদি অবিদ্যা নিত্য হয়, তাহলে জীবের পক্ষে মুক্তি লাভ করা অসম্ভব, কারণ অজ্ঞান চিরকাল বিদ্যমান থাকবে এবং জ্ঞান দ্বারা তাকে দূর করা যাবে না। এটি মোক্ষ বা মুক্তির ধারণার পরিপন্থী।

অদ্বৈতের খণ্ডন-কৌশল (সিদ্ধান্ত): অদ্বৈতবাদীরা এই আপত্তির উত্তরে বলেন যে, 'অনাদি' শব্দের অর্থ হলো, যার উৎপত্তি জানা যায় না, কিন্তু তার বিনাশ অসম্ভব নয়। অবিদ্যা অনাদি হলেও তা 'ভাবরূপ অজ্ঞান' এবং এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিত্য বিদ্যমান থাকে না। অনাদি হলেও অবিদ্যার বিনাশ জ্ঞান দ্বারা সম্ভব। অদ্বৈতমতে, জ্ঞানই অজ্ঞানকে দূর করে। যেমন, অন্ধকার অনাদি হলেও তা আলোক দ্বারা দূর হয়। অন্ধকার অনাদি, কিন্তু আলোকপাত হলেই তা আর থাকে না। তেমনই, অবিদ্যাও অনাদি হলেও ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হলে তা সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যায়। এই বিনাশ অবিদ্যার সম্পূর্ণ অবসান ঘটায়, এবং জীব তখন তার প্রকৃত স্বরূপ (ব্রহ্ম) উপলব্ধি করে মুক্তি লাভ করে। তাই অনাদি সত্তার বিনাশ সম্ভব না হলেও, অবিদ্যার মতো আরোপিত বা ভ্রমাত্মক অনাদি সত্তার বিনাশ জ্ঞান দ্বারা সম্ভব।

অদ্বৈত দর্শনে জীবের প্রকৃতি এবং ব্রহ্মের সাথে তার মৌলিক অভিন্নতা ব্যাখ্যা করার জন্য দুটি প্রধান যৌক্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়: অবস্থা-ত্রয় বিশ্লেষণ এবং একজীববাদ। এই পদ্ধতিগুলি জীবাত্মার স্বরূপ উন্মোচন করে এবং তাকে পরমাত্মার (ব্রহ্ম) সাথে একীভূত প্রমাণ করে।

১. অবস্থা-ত্রয় বিশ্লেষণ: অন্বয়-ব্যতিরেক পদ্ধতির প্রয়োগ

অন্বয়-ব্যতিরেক (Co-presence and Co-absence) পদ্ধতিটি আত্মাকে দেহ-মন থেকে স্বাধীন প্রমাণ করার জন্য একটি শক্তিশালী যুক্তি। এই পদ্ধতি জীবের বিভিন্ন অবস্থার (জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি) মধ্যে চেতনার (আত্মার) উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে।

পদ্ধতি এবং খণ্ডন:
জাগ্রত (Jāgrat) অবস্থা: এই অবস্থায় জীব বাহ্যিক জগৎ ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা লাভ করে। দেহ, মন, বুদ্ধি, এবং ইন্দ্রিয়গুলি সক্রিয় থাকে। আমরা জাগতিক বস্তুকে দেখি, শুনি, স্পর্শ করি এবং অনুভব করি।
স্বপ্ন (Svapna) অবস্থা: স্বপ্নাবস্থায় বাহ্যিক জগতের সাথে জীবের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। মন অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও বাসনার ভিত্তিতে একটি নিজস্ব জগৎ তৈরি করে। এখানেও দেহ-মন সক্রিয় থাকে, তবে তাদের ক্রিয়া ভিন্ন প্রকৃতির।
সুষুপ্তি (Suṣupti) অবস্থা: এটি গভীর নিদ্রার অবস্থা, যেখানে সমস্ত মানসিক ও শারীরিক কার্যাবলী সম্পূর্ণরূপে প্রশমিত থাকে। মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, এবং এমনকি 'আমি'-বোধও অনুপস্থিত থাকে। এই অবস্থায় জাগতিক বা স্বপ্নকালীন কোনো অভিজ্ঞতাই থাকে না।

ব্যতিরেক (Co-absence): সুষুপ্তি অবস্থায় মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় এবং স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয় দেহের কার্যাবলী সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে। এটি সেই অবস্থা যেখানে কোনো প্রকার চিন্তা, অনুভূতি বা বাহ্যিক উপলব্ধির অস্তিত্ব থাকে না। সমস্ত উপাধি (limiting adjuncts) সাময়িকভাবে বিলীন হয়ে যায়।

অন্বয় (Co-presence): সুষুপ্তি অবস্থায় মন ও দেহের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও, চেতনার অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। জাগ্রত হওয়ার পর আমরা স্মরণ করতে পারি, "আমি ভালো ঘুমিয়েছিলাম" বা "আমি কিছুই জানতাম না।" এই প্রত্যভিজ্ঞা (recognition) প্রমাণ করে যে, একজন সাক্ষী (Sākṣi) বা দ্রষ্টা সর্বদা উপস্থিত ছিল, যে সুষুপ্তির অভিজ্ঞতাকে পর্যবেক্ষণ করেছে। সুষুপ্তির সময় দেহ-মনের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এই চেতনার নিত্য উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, আত্মা দেহ-মন থেকে ভিন্ন, স্বাধীন, এবং তাদের পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটি আত্মার নিত্যত্ব ও অপরিবর্তনীয়তা প্রমাণ করে।

এই বিশ্লেষণ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, আত্মা বা সাক্ষী চেতনা শরীর ও মনের উপাধি (limiting adjuncts) থেকে স্বাধীন এবং নিত্য। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.২৩) এই অবস্থানকে শাস্ত্রীয় সমর্থন দেয়: "সুষুপ্তিতে যখন দ্বিতীয় কোনো বস্তু উপলব্ধির জন্য আলাদা থাকে না, তখনও দ্রষ্টার দর্শন বন্ধ হয় না, কারণ দ্রষ্টা (আত্মা) অক্ষুণ্ণ এবং imperishable।" এই প্রমাণ তত্ত্বমসি মহাবাক্যের 'ত্বং' (তুমি) পদটিকে স্পষ্ট করে তোলে, যা জীবের প্রকৃত স্বরূপকে ব্রহ্মের অভিন্ন বলে ঘোষণা করে। জীব তার দেহ-মন-বুদ্ধির উপাধি থেকে মুক্ত হলে সে ব্রহ্মের সাথে তার অভিন্নতা উপলব্ধি করে।

২. একজীববাদ (Eka-Jīva-Vāda—EJV) এবং বহুজীবে আপত্তি

একজীববাদ অদ্বৈত দর্শনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ মতবাদ, যা দাবি করে যে, এই জগৎ একজন মাত্র জীবের (যেমন, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা) দ্বারা কল্পিত, এবং অন্যান্য সমস্ত জীব সেই স্বপ্নের অংশ। এটি দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ (The world exists only as far as it is perceived) এবং অজাতবাদ (Ajātivāda—কিছুই কখনও সৃষ্ট হয়নি)-এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। একজীববাদ অনুসারে, ব্রহ্মই একমাত্র জীব (ঈশ্বর), এবং আমরা যে অসংখ্য জীব দেখি, তারা সকলেই সেই একক জীবের (ঈশ্বরের) কল্পনার অংশ। এটি মায়ার শক্তিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, যেখানে এক ব্রহ্মই মায়ার প্রভাবে বহু রূপে প্রতিভাত হন।

আপত্তি (পূর্বপক্ষ): ‘ইষ্টসিদ্ধি’ গ্রন্থে একজীববাদের বিরুদ্ধে একটি প্রধান আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে: "ব্রহ্মই একমাত্র অবিদ্যার সাথে জড়িত এবং জ্ঞান দ্বারা মুক্ত হয়। যখন একজন মুক্ত হন, তখন সমগ্র জগৎ মুক্ত হয় (eka muktau jagan mukteh)।" অর্থাৎ, যদি একজনই জীব হয়, তবে তার মুক্তি মানে সমস্ত জীবের মুক্তি এবং জগতের বিলুপ্তি। কিন্তু ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতায় তা ঘটে না। আমরা দেখি যে, বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন সময়ে মুক্তি লাভ করে এবং একজন ব্যক্তির মুক্তি অন্যদের মুক্তি নিশ্চিত করে না। জগৎ তার মতো চলতে থাকে, এবং অন্য জীবেরা তাদের কর্মফল ভোগ করতে থাকে।

খণ্ডন (সিদ্ধান্ত): অদ্বৈত এই আপত্তি খণ্ডনে প্রতিবিম্ব-বিম্ব দৃষ্টান্তে নির্ভর করে।
দৃষ্টান্ত: জীবকে ব্রহ্মের প্রতিবিম্ব (reflection) হিসেবে কল্পনা করা হয়, যা উপাধি দ্বারা সীমিত। যেমন, সূর্য এক হলেও বিভিন্ন জলাশয়ে (কলস, ডোবা, নদী) তার অসংখ্য প্রতিবিম্ব দেখা যায়। এই প্রতিবিম্বগুলি জলাশয়ের আকারের উপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন দেখায়।
ব্যাখ্যা: যখন একজন জীব (একটি প্রতিবিম্ব) মুক্তি লাভ করে, তখন তা কেবল সেই একক জীবের নিজস্ব উপাধি বা বাসনা দূর করে। যেমন, একটি কলসের মধ্যে থাকা আকাশের প্রতিবিম্ব (জীব) সেই কলস ভেঙে গেলে (উপাধি দূর হলে) মহাশূন্যে মিশে যায়। কিন্তু অন্য কলসগুলি (অন্যান্য জীব) অক্ষত থাকে এবং তাদের অভিজ্ঞতা চলতে থাকে। অর্থাৎ, একটি প্রতিবিম্বের মুক্তি (উপাধি থেকে মুক্তি) অন্য প্রতিবিম্বকে প্রভাবিত করে না।

মুক্তিলাভ কেবল ব্যক্তির নিজস্ব বিভ্রম (মায়া) দূর করে, অন্য ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে বা অন্যান্য জীবের অস্তিত্বকে নয়। প্রতিটি জীব তার নিজস্ব উপাধি (অবিদ্যা, কর্ম, বাসনা) দ্বারা সীমিত। এক জীবের মুক্তি অন্য জীবের উপাধিকে প্রভাবিত করে না, কারণ প্রতিটি জীব তার নিজস্ব অবিদ্যার বশবর্তী হয়ে একটি স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতার জগৎ তৈরি করে। ব্রহ্ম এক হলেও, মায়ার প্রভাবে তিনি অসংখ্য জীবের রূপে প্রতিভাত হন এবং প্রতিটি জীব তার নিজস্ব কর্ম ও অবিদ্যা অনুসারে মুক্তি লাভ করে। এই ব্যাখ্যা অদ্বৈতের মূল নীতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে বহু জীবের স্বতন্ত্র মুক্তির ধারণাকে সমর্থন করে।

গুরু-শিষ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত আপত্তি ও খণ্ডন: অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক একটি জটিল এবং গভীর বিষয়। সমালোচকরা প্রায়শই প্রশ্ন তোলেন যে, যদি চূড়ান্ত সত্য অনুসারে গুরু এবং শিষ্য উভয়েই মায়ার অংশ হন, অর্থাৎ স্বপ্ন-দেখা চরিত্র হন, তবে গুরুর উপদেশের প্রয়োজনীয়তা বা উপযোগিতা কী? যদি শিক্ষক নিজেই জীবের স্বপ্নের অংশ হন, তাহলে তাঁর উপদেশ কীভাবে জীবের অজ্ঞানতা দূর করতে পারে এবং মোক্ষের পথ দেখাতে পারে? এই আপত্তিগুলির মূল ভিত্তি হলো, যদি সবটাই মিথ্যা বা অসত্য হয়, তবে একজন মিথ্যা সত্তা (গুরু) কীভাবে অন্য একটি মিথ্যা সত্তা (শিষ্য) কে সত্যের পথে পরিচালিত করতে পারে?

অদ্বৈত বেদান্ত এই আপত্তির একটি অত্যন্ত সুসংহত এবং ব্যাবহারিক উত্তর প্রদান করে। অদ্বৈত বলে যে, যদিও পারমার্থিক স্তরে (Ultimate Reality) সবটাই ব্রহ্ম এবং দ্বৈততা একটি ভ্রম, তবুও ব্যাবহারিক স্তরে (Empirical Reality) গুরুর নির্দেশ অপরিহার্য। এর কারণ হলো, ভ্রম দূর করার জন্য উপদেশের প্রয়োজন। যেমন, একজন মানুষ যদি স্বপ্নে একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে এবং তাতে আতঙ্কিত হয়, তখন সেই স্বপ্ন থেকে জাগ্রত হওয়ার জন্য একটি বাহ্যিক উদ্দীপনার প্রয়োজন হতে পারে, বা স্বপ্নের মধ্যে কেউ তাকে বলতে পারে যে, এটি কেবলই একটি স্বপ্ন। একইভাবে, জাগতিক জীবনে আমরা অজ্ঞানতার কারণে নিজেদেরকে শরীর, মন, এবং জগতের সঙ্গে একাত্ম মনে করি, যা একটি মৌলিক ভ্রম। এই ভ্রম দূর করার জন্য অভিজ্ঞ একজন গুরুর নির্দেশনা অত্যাবশ্যক।