আমি আজকাল কারও প্রত্যাশাকে খুব একটা পাত্তা দিই না আর, এমনকী নিজের প্রত্যাশাকেও না। প্রত্যাশার হাত ধরে ধরেই তো আজ এই আশাশূন্যতার মুখোমুখি এসে নতজানু হয়ে বসে পড়েছি! আসলে এই প্রত্যাশা ব্যাপারটাই এমন যে, সে মানুষকে অহেতুকই এটার ওটার পেছনে ছুটতে বাধ্য করে। আজ এটার পিছু তো কাল ওটার পিছু। বড্ড চঞ্চল সে, তার কোনও থামাথামি নেই। কোনও একটা নির্দিষ্ট জিনিসকে পাবো ভেবে প্রত্যাশা করে সেই জিনিসটা পেয়ে যাবার আগ অবধি নিজেকে জোর করে হলেও বাঁচিয়ে রাখি। নিজেকে বোঝাই, ‘আরে, মরে যাবার আগে ওটা কিনতে হবে না?’ ‘মেয়ের বিয়েটা ভালো করে দিতে হবে না?’ ‘একটা পিএইচডি অন্তত করি, এত কীসের তাড়া?’ ‘একটা নাচের স্কুল তো বেঁচে থাকতে থাকতেই করতে হবে!’ এরকম আরও অনেক কিছুই। ওসবকে মুহূর্তের মায়ায় ভীষণ জরুরি মনে হয়, পরে দেখা যায়, এ সবই কেবল ভ্রান্তি আর মোহ। প্রায়ই, এসব প্রত্যাশা পূরণ করাই হয় না, আর তাই মরে যাবার ব্যাপারটাকে নানান কায়দায় দূরে সরিয়ে রেখে রেখে বেঁচেই থাকা হয় শেষমেশ। আমি সুখে থাকি, যথেষ্টই সুখী আমি। দুঃখ আমায় ছোঁয়ই না। কিংবা বলা যায়, চামড়া এতটাই পুরু হয়ে গেছে যে, এখন কোনও কিছুই আমাকে আর ছুঁতে পারে না। আচ্ছা, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবারই কি এমন হতে থাকে? না কি মনের জোর কমে যেতে যেতে এরকম মনে হয়? আমি ঠিক জানি না। তবে এটা নিশ্চিতভাবে জানি, সুখের তীব্রতায় দুঃখ যখন পালাবার পথটাও পায় না, তখন থেকেই মৃত্যুর শুরু! যাক, এবার একটু নিজের কথা বলি। সেই ছোট্ট আমি’টার কথা ভাবলে নিজের জন্যই আমার ভীষণ মায়া হয়। যাকে বাবা-মা ভালোবেসে সায়ন বলে ডাকত, সেই ছোট্ট সায়নটাই ছিল আজকের সায়নী দাশগুপ্ত। যশের আড়ালে অমন আদুরে নামটা কেমন টুক করে হারিয়েই গেল! মানুষ বড়ো হতে থাকে আর তাকে ডাকনামে ডাকার মানুষ ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। তেমন কেউই যখন ডাকনামটা ধরে আর ডাকে না, তখন থেকেই বড়ো হবার শুরু। পোশাকি-নামে যারা ডাকে, তাদের সাথে ভালো থাকার সুযোগ আমাদের খুব কমই হয়, কেননা আমরা সমাজের চোখে বড়ো হতে গিয়ে আসলে অনেক নিচুমনের কেউ একজন হয়ে যাই, ফলে সেই সময়ে নীচদের সাথেই বন্ধুত্ব জমতে থাকে। লোকে যত উপরে ওঠে, ততই নিচে নামে। পোশাকি-নামকে ঠিকঠাকমতো প্রতিষ্ঠিত করাতে গিয়ে আমরা এক-একজন খারাপ মানুষে পরিণত হতে থাকি। হ্যাঁ, নাম, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত পাই সবই, কিন্তু ওসবের বদলে নিজের সমস্ত সত্তাটাকেই বিকিয়ে দিতে হয়। আত্মিক ধ্বংস ছাড়া জাগতিক পূর্ণতা কমই আসে। মাঝবয়সে এসে আমাদেরকে ডাকনামে ডাকার জন্য শুধুই বাবা-মা থাকেন। তাঁরাও একসময় চলে যান, সাথে করে নিয়ে যান তাঁদের ছোট্টসোনার অপাপবিদ্ধ ডাকনামটি। আমাদের নামডাক বাড়তে থাকে, আর ডাকনাম হারাতে থাকে। আজকাল তো দেখি, স্বামী-স্ত্রী’রাও পরস্পরকে ডাকনাম ধরে ডাকতে কেমন জানি অস্বস্তিবোধ করে! হ্যাঁ, আমি নিজেও ওরকম বোধ করি। আমার মেয়েদের বাবা আমাকে সায়ন ডাকলে আমি ভীষণ খেপে যাই। মনে হয়, ও যেন আমাকে না, অন্য কাউকে ডাকে। ওর ঠোঁটযুগল আমাকে সায়ন ডাকে, চোখদুটো নয়। ও ভীষণ অভিমান করে আর বলে, ‘আমিও তোমাকে ডাকনামে ডাকতে পারব না? আমার চেয়ে আপন এখন আর কে-ইবা আছে তোমার?’ শুনে আমি মুখ টিপে টিপে হাসি। হায়, সাতপাক ঘুরলে আর কিছু অর্থ-না-বোঝা মুখস্থ-মন্ত্র আওড়ালেই যদি কারুর আপন হওয়া যেত! আমাকে এখন সবাই আপন ভাবতে চায়। যাকে সবাই আপন ভাবতে চায়, তার আসলে আপন বলতে কেউ নেই। আমি নৃত্যশিল্পী সায়নী দাশগুপ্ত। আমাকে আপনারা চেনেন, আমি ভরতনাট্যম শেখাই ছাত্রীদের। এক নাচ বাদে আমি আর কিচ্ছু জানি না। নাচ বাদে সত্যি সত্যি আর কিছুই আমি বুঝি না, আর আমার মেয়েদের বাবা যেহেতু নাচ বোঝে না, সেহেতু সে আমাকেও বোঝে না। আমাকে সামান্যটুকুও অনুভব করতে চাইলে আগে নাচ অনুভব করতে জানতে হবে। অবশ্য একজন প্রকৃত শিল্পীকে কেউ চট করে, এমনকী সারাজীবন ঘেঁটেও বুঝতে পারবে, এটা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। তাই আমি ওদের বাবাকে দোষ দিই না আসলে। সে তার কাজ নিয়ে থাকে, আমি নাচ নিয়ে আমার মতন থাকি। এ-ও ভালো! মানুষ বোঝার অভিনয় করার চাইতে নিজের কাজ বোঝার চেষ্টা করা অধিক স্বস্তির। আমার বড়ো মেয়ে টুপুর যে নাচ পছন্দ করে না, তা সে মুখে না বললেও আমি বুঝি। আর ছোটো মেয়ে টুপুস এখনও অনেক ছোটো, নাচ বোঝার মতন বয়স ওর এখনও হয়নি। ইংমার বার্গম্যানের ‘অটাম সোনাটা’র ছায়ায় ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘উনিশে এপ্রিল’ সৃষ্টি করেছিলেন। দেখেছেন তো মুভিটা? আমার জীবনও অনেকটা ওই সিনেমার নায়িকা বাবলির জীবনের মতন। সবাই আমাকে শুধু ভুলই বোঝে। এ জীবনে আমাকে কেউই বুঝল না, এতে আমার একটুও দুঃখ নেই। এ জীবনে সবাই আমাকে ভুলই বুঝে গেল, দুঃখ শুধু এটুকই। আমরা কাউকে বুঝতে পারি না, আর বুঝতে পারি না বলেই ভুল বুঝি। না বোঝায় পাপ নেই, ভুল বোঝায় আছে। যাকে বুঝতে পারি না, কেন তাকে তার মতো করে ছেড়ে দিই না? কেন আমরা তাকে নিয়ে অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি করি আর নিজেদের পাপের বোঝা বাড়াই? ইদানীং আমার কাছে সব কিছুই খুব অদ্ভুত লাগে। আমার কাছ থেকে কেন জানি না এখনও সবাই আবেগ প্রত্যাশা করে। মেয়েরা, মেয়েদের বাবা, আমার নাচের ছাত্রীরা...সবাই। ছাত্রীদের অভিযোগ, আমি নাকি নাচতে গিয়ে বিষাদের কোনও সুরে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও কাঁদি না। নাচে কান্নার মুহূর্তগুলিকে নাকি আমি লুকিয়ে ফেলি, কাউকে ঠিক করে কিছুই বুঝতে দিই না। কিংবা কাঁদলেও আসলে কাঁদি না, চোখ থেকে জল ঝরে মাত্র! ওদের কী করে বোঝাই, একজন সায়নী দাশগুপ্ত হবার জন্য আমাকে রোজই যত কান্না কাঁদতে হয়েছে, তার সিকিভাগও ওরা দেখলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারত না! আমি এতটাই কেঁদে কেঁদে আজকের এই অবস্থানটা তৈরি করেছি যে, ছোটোখাটো আবেগে এখন আর কাঁদতে পারি না। আমার কাছে অন্য কারুর হুটহাট কান্নাকে আজকাল কেন জানি না বড্ড মেকি মনে হয়। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, আমার হাসি মিডিয়া-হাসি, আমার কান্না মিডিয়া-কান্না। ঠিকই তো আছে! এর বাইরে আর কিছুই যে আমাকে করতে হয় না একজন আর্টিস্ট হিসেবে! আমি কাঁদব কাদের সামনে? ওদেরই সামনে, আমার কান্নায় কি হাসিতে যাদের কিছুই এসে যায় না? ওরা কি আদৌ আমার কান্নার পরোয়া করে? না কি ওদের সমস্ত পরোয়া কেবলই আমার অশ্রুতে সীমাবদ্ধ? সব কান্নায় অশ্রু থাকে না, সব অশ্রুতে কান্না থাকে না। যে আমার কান্নার যোগ্য নয়, সে আমার অশ্রুতেই তৃপ্ত থাকুক। আমি খুব ছোটোবেলায় বাবা-মা’কে হারিয়েছি, আমাকে বড়ো হতে হয়েছে একাকী সব ঝড়ঝাপটা সামলে সামলে। আর দ্যাখো, সেই আমার কাছ থেকেও কিনা এ পৃথিবী আবেগ প্রত্যাশা করে বসে থাকে! যার বাবা-মা’ই নেই, সে-ও কেন কাঁদবে? কার জন্য কাঁদবে? আমার কান্নার দাম দেয় না যারা, তাদের সামনে কাঁদার মানেই তো নিজের দামটা নিজেই কমিয়ে ফেলা! স্বার্থপর পৃথিবী এই সহজ সত্যটাই বুঝতে পারে না। যার জন্য কাঁদা যায়, এমন একটিও মানুষ আমার জীবনে নেই। পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ সবচাইতে হতভাগ্য। এক, যার কাঁদার কেউ নেই। দুই, যার জন্য কাঁদার কেউ নেই। খুব সম্ভবত, আমি দুই দলেরই অন্তর্ভুক্ত। এক বাবা-মা বাদে পৃথিবীর আর কোন প্রাণীটা আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই বোকার মতন ভালোবাসে? আমাকে নিঃস্বার্থভাবে আমার মেয়েরাই ভালোবাসে না, মেয়েদের বাবার কথা তো বলাই বাহুল্য! আর বাইরের মানুষ? ওরা তো আমার জীবনে এসেছেই ওদের নিজস্ব প্রয়োজনে। হ্যাঁ, ওরা এখানে এসেছে কেবলই মাখন খেতে। মাখন খাওয়া শেষ হতেই ওরা যে যার মতো করে কেটে পড়বে। ওদের স্তুতি ও নিন্দা, দুই-ই ক্ষণিকের তাড়নায়। ওরকম কারুর ফিডব্যাক নিয়ে আমার ব্রেইন হয়তো ভাবে কিছুসময়, কিন্তু মন একমুহূর্তও ভাবে না। কেউ যখন আমাকে বলে, ‘ভালোবাসি’, তখন আমি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাই। সেই চোখে আমি সত্যিই কোনও ভালোবাসা খুঁজে পাই না। যা পাই, তার নাম মুগ্ধতা। লোকে মুগ্ধতাকে ভুল করে ভালোবাসা ভেবে বসে! যাকে ভালো লাগে, তাকে আমরা বলে বসি…ভালোবাসি! আর যাকে সত্যিই ভালোবাসি, তাকে মুখে কিছুই বলতে পারি না। বাবা-মা তো আমার প্রতিষ্ঠা-সুখ-প্রতিপত্তি কিছুই দেখে যেতে পারেনি। এ জীবনে যারা আমাকে সবই দিল, ওদেরই কণামাত্রও কিছু দেবার সৌভাগ্য আমার হলো না। এতটাই ব্যর্থ ও দুঃখিনী হয়ে বেঁচে আছি আমি! আর যাদের এত কিছু দিয়ে চলেছি, ওদের কেউই আমাকে বিনা কারণে, বিনা স্বার্থে কিছুই কখনও দেয়নি। আমার বলতে খুব ইচ্ছে করে, এ দুচোখে আজ ঘুমের বদলে নাহয় মৃত্যু নামুক, আমার মনের বৃষ্টিযাপন এবার সত্যিই থামুক! রোজই কিছু টুকরো সুখের সওদা করি, উটকো আর ঠুনকো কিছু সুখ এসে যায়, এসে এই গলাটা টিপেই ধরে, আর অমনিই ঝরঝরিয়ে শ্রাবণ আসে! হয়তো এমন দুঃখী আরও অনেকই আছে! হ্যাঁ, আছে ওরাও, দলে আমি একা নই! তবু আঁধার যখন নামেই নামে, তখন, বলো, আমার মতো আঁধার গিলে আলো কে জ্বালে? আজ ঘুম না এসে মৃত্যুই আসুক! ক্লান্ত এই বৃষ্টিযাপন এবার থামুক!