আমরা প্রেমে গঠিত, প্রেমেই জন্ম নিই। এই জীবনে প্রথম আসার পর মায়ের চোখের কোমল দৃষ্টি আর স্নেহের আলিঙ্গনে আমরা স্নান করি এক অগাধ প্রেমের সাগরে। সেই সময়ে কোনো সচেতনতা নেই; বাঁচতে হলে কী করতে হবে, তার কোনো ভাবনাও নেই—শুধুই স্বাভাবিক, নিঃশর্ত ভালোবাসা।
কিন্তু খুব অল্প বয়সেই এক অদৃশ্য হাত আমাদের এই সাগর থেকে তুলে আনে—তার নাম স্ব-সচেতনতা। হঠাৎই আমরা আলাদা বোধ করি, চিন্তিত হয়ে যাই। মনে হয়—“আমাকেই কিছু করতে হবে, অন্যদের খুশি করতে হবে।” ভালোবাসা আর নিঃশর্ত থাকে না, শর্তযুক্ত হয়ে যায়। “ভালো মেয়ে” বা “ভালো ছেলে” না হলে আমরা আর ভালোবাসার যোগ্য নই, বরং আবার সেটা অর্জন করতে হবে।
তারপর শুরু হয় জীবনভর অর্জনের সংগ্রাম। স্কুলের নিয়ম, সমাজের শৃঙ্খলা, কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি—সব মানতে হয়। বেরিয়ে গেলে হারাতে পারি চাকরি, ঘর, সম্পর্ক। প্রেমের সাগর থেকে আমরা ঢুকে যাই এক কারাগারে, যা আমরা নিজেরাই বানাই—সমাজের প্রভাবের এমন জন্ম আমাদেরই হাত ধরে।
কেউ কেউ সহজে মানিয়ে নেয়, ভাবে—“যা আছে, তা-ই আছে।” কেউ-বা মানাতে পারে না, তবুও টিকে থাকে বার বার ব্যর্থ সম্পর্ক, চাকরি হারানোর ভয়, আর অর্থকষ্টের দুঃস্বপ্ন বয়ে নিয়ে। আবার কিছু মানুষ বিদ্রোহ করে—এবং শেষপর্যন্ত শারীরিক কারাগারেও বন্দি হয়।
তবুও মনে হয়—সবাই অন্তরে কোথাও-না-কোথাও অনুভব করে সেই প্রেমসাগরের টান। কিন্তু বেশিরভাগই সমাজের চাপে সেটা দমিয়ে রাখে। শুধু অল্প কয়েকজন সাহস করে বেরিয়ে পড়ে সেই হারানো সাগরের খোঁজে। তাদের প্রেরণা কী? হয়তো হতাশা, হয়তো হঠাৎ পাওয়া কোনো বইয়ের লাইন, কোনো সিনেমার দৃশ্য, অথবা ভোরের এক অনিন্দ্য সূর্যোদয়।
মনে পড়ে যিশুর জলে হেঁটে চলার গল্প। হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন—“ফিরে এসো, প্রেমের সাগর তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।” অথবা হয়তো জানাচ্ছিলেন—আমরা আসলে কোনোদিনই সেই সাগর ছেড়ে যাইনি, বরং ভুল জীবনকে আসল ভেবে নিয়েছিলাম। যে-মুহূর্তে তা টের পাবো, সঙ্গে সঙ্গেই জেগে উঠব।