ঘর আলোকিত করে একটা পুতুল এল। সারা ঘরদোর যেন খুশি বন্যায় ভাসতে লাগল। বাবার দুচোখে বেয়ে স্বপ্ন ঝরল। ওকে না দেখে এক মুহূর্তের জন্যও বাবা থাকতে পারতেন না। পুতুলের মতন দেখতে হয়েছিল বলে সবাই ওর নাম দিয়েছিল পুতুল। বাবা প্রতিদিনই নতুননতুন নামে ডাকতেন আদরের একমাত্র কন্যাকে। সারাক্ষণই ছোট্ট পুতুলসোনাকে নিয়ে মেতে থাকতেন। মা বলতেন, “বড় হয়ে গেলে তো মেয়েকে পরের বাড়িতে যেতে দিতে হবে। তখন কী করবেন?” বাবা হেসে বলতেন, “যেতে দিতে হবেই কেন? আমার মেয়েকে আমি কক্ষনো বিয়ে দেবো না। ও সবসময়ই আমার সাথে থাকবে। কার কী?” বাবার চোখে, পুতুলের মতন সুন্দর মেয়ে পৃথিবীতে কোনওদিনই জন্মায়নি। মুগ্ধ দৃষ্টিতে পুতুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। পৃথিবীর সবকিছু ভুলে পুতুলকে নিয়েই সারাদিন মেতে থাকতেন। ওর বয়স যখন ছয় মাস, তখন পুতুলকে কোলে নিয়ে অফিস করতেন। টেবিলের উপর শুইয়ে রেখে কাজ করতেন। পুতুলের মা ছিলেন খুবই শান্ত প্রকৃতির অভিজাত একজন মহিলা। উনি একটা কলেজে বাংলা পড়াতেন। বাবা কাজ করতেন সমাজসেবা অধিদপ্তরে। পুতুলের জন্মের পর খুব জরুরি কাজ পড়ে না গেলে বাবা কখনওই অফিস থেকে দেরি করে ফেরেননি। কোনওদিন যদি ফিরতে একটুও দেরি হত, ছোট্ট পুতুল মায়াবী চোখজোড়া বড়-বড় করে মেলে মায়ের কোলে না ঘুমিয়ে শুয়ে থাকত। বাবাকে দেখামাত্রই খুশিতে হাততালি দিত আর খিলখিল করে হাসতে থাকত। মায়ের কোল থেকে গোলগোল হাত দুটিকে বাবার দিকে এগিয়ে দিত কোলে নেয়ার জন্য। কোলে নিয়ে ওর হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে বাবা যখনই ভাবতেন এই হাতে একদিন মেহেদির রং রাঙাবে, তখনই তাঁর চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ত। মা বলতেন, “এত ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন মেয়ে হওয়ার পর?” বাবা বলতেন, “আমার ঘরে আমার মা এসেছে যে, আমি তো ছেলেমানুষ হবই।”
সেই ছোটবেলা থেকেই পুরো বংশের মধ্যে সবচাইতে আদরের ধন ছিল পুতুল। সবাই ভীষণভাবে আদর করত। এমন আদরে-আদরে পুতুল বড় হচ্ছিল প্রচণ্ড জেদ আর ঔদ্ধত্য নিয়ে। ছেলেদের চাইতে তেজি আর রাগী হয়ে পুতুল বেড়ে উঠতে লাগল। পুরো বংশের সবাইই ভয় পেত পুতুলের কান্না আর কষ্টকে। ওকে কখনওই কেউ কিছুই বলত না। অতি আদরে আর আহ্লাদে ছোট্ট পুতুলের মনের মধ্যে এই ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে গেল, ও যা বলবে তা-ই ঠিক, ও যা চাইবে তা-ই ওকে সাথেসাথে দিতে হবে, যেখান থেকেই হোক, দিতেই হবে। ওর একবার টনসিল ফুলে খাওয়াদাওয়া বন্ধ, আর অমনিই ওর বাবাও রাগ করে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলেন। কেউই কিছু খাওয়াতে পারছিল না উনাকে। শুধু মেয়ের কাছে বসে-বসে কাঁদেন। ডাক্তারকে ঘণ্টায় কয়েকবার ফোন করে অস্থির করে তুললেন। ওর বয়স যখন ৪, তখন ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে গেলে ও জেদ করল, ও কিছুতেই নার্সারিতে ভর্তি হবে না, ও ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবে, নার্সারিতে তো বাচ্চারা পড়ে, ও তো আর বাচ্চা না। স্কুলের ম্যাডামরা কোনও মতেই ওকে সরাসরি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু বাবা জোর গলায় বললেন, “আমার মেয়ে যা বলছে তা-ই করতে হবে।” উনি ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, উপরের মহলের সাথেও ভাল যোগাযোগ ছিল, স্কুলের বিভিন্ন ধরনের অনুদান পাইয়ে দিতেন নানান জনকে ফোন করেটরে। উনাকে এলাকার মানুষ সবাই বেশ সমীহ করে চলত। “আমার মেয়ে নিশ্চয়ই পারবে। ওকে ক্লাস ওয়ানেই নিন। না পারলে আমি দেখব।” পুতুলের সামনেই স্কুলের হেডমিস্ট্রেসকে বলে এলেন, “দেখুন, আমার মেয়ে কোনও অপরাধ করলে ওকে কিছুই বলা যাবে না। আমাকে বলবেন, আমি শাসন করে দেবো।” বাবা পুতুলকে প্রতিদিন সকালে রেডি করিয়ে দিয়ে ৮টার মধ্যেই স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এরপর ৯টার মধ্যে অফিসে যেতেন। ওর রেশমি চুলের ঝুঁটি দেখে ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত, “বাহ! কী সুন্দর! এটা কে করে দিয়েছে?” ও ভীষণ খুশি হয়ে উঠত। ডগমগ করতে-করতে বলত, “আমার পাপা!”
স্কুল থেকে ফিরে ছোটাছুটি করে সারা ঘর মাতিয়ে রাখত। ওকে কোনওদিনও কেউই একটুও গলাউঁচু করেও কথা বলেনি। খেলনা ভেঙে ফেললে আবারও নতুন খেলনা কিনে দিতেন বাবা। সারা ঘরে পুতুল ছড়ানো ছিল। রাজ্যের পুতুল ছিল ওর চারপাশে! পুতুলের পুতুলখেলায় বাবা পুতুলের বিয়ের বরযাত্রী সাজতেন। ঘোড়া সেজে পুতুলকে সারা ঘরময় ঘোড়ার পিঠে চড়াতেন অফিস থেকে ফিরেই। অফিসের কোনও কাজ করার সময়েও পুতুলকে কোলে বসিয়ে কাজ করতেন। বাবার কোলে বসে বাবাকে পুতুল রাজ্যের সব আজব-আজব প্রশ্ন করত। ওর ধারণা ছিল, ওর বাবা পৃথিবীর সবচাইতে জ্ঞানী মানুষ। “বাবা, আজকের আকাশটা এত নীল কেন? প্রজাপতিটা কেন ওড়ে? ঠাকুর কি সত্যি-সত্যি আমার সব প্রার্থনাই শুনতে পান? আমি বড় হব কখন? বড় হলে আমি তোমার মতন হব, নাকি মায়ের মতন? আমি কি একদিন অনেক লম্বা হয়ে যাব, বাবা? আমি পড়াশোনা না করলে কী হবে?” সন্ধ্যায় যখন সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলত, তখন ছোট্ট পুতুল মায়ের পাশে বসে-বসে মায়ের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সান্ধ্য প্রার্থনাসংগীত গাইত। বাবা একটু দূরে বসে দেখতেন আর হাসতেন। দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামত, স্বপ্নের আর আনন্দের অশ্রু। “ঈশ্বর, আমার নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার মেয়েকে এরকম হাসিখুশি রেখো সারা জীবন।” এই প্রার্থনা বাবার হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসত। মেয়ের মঙ্গলকামনায় বাবা প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি করে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালাতেন। সকালসাঁঝে ওর দুষ্টুমি দেখে ভাবতেন, “আমি ওকে ছাড়া বাঁচব কীভাবে?” ওর পড়তে ইচ্ছে হলে ওকে পড়াতে বসাতেন, ইচ্ছে না হলে সেদিন ছুটি। এভাবে করেই ও বড় হচ্ছিল। বাবার পৃথিবীটা হয়ে গিয়েছিল পুতুলময়। কখনও-কখনও ওর মনটা উদাস হয়ে গেলে জানালার সবুজ গ্রিলটাতে মাথা ঠেকিয়ে রাতের বাগানটার দিকে তাকিয়ে থাকত এক দৃষ্টিতে। জুঁই, কামিনী আর কাঁঠালচাঁপার মাতালকরা গন্ধের সাথে মিশে জ্যোৎস্না খেলা করত। চাঁদের আলোয় বাগানের পাশের হ্রদটা মুহূর্তেই হয়ে উঠত বিশাল একটি থালা। পুতুলের নিজস্ব পৃথিবীতে বাবাই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ওকে একটু হলেও বুঝতেন। অমন মনখারাপের রাতে বাবা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আর ভায়োলিনে সুর তুলতেন। একটা সময়ে বাবার কোলে মাথা রেখে ও ঘুমিয়ে পড়ত।
বাবা ওকে কবিতা পড়তে শিখিয়েছিলেন, উত্তম-সুচিত্রার মুভির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ক্লাস নাইনে উঠেও ও বাবার কাছে রাজ্যের বায়না ধরত। এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও। মায়ের প্রবল নিষেধ সত্ত্বেও পুতুলের কথায় বাবা ওকে দামি মোবাইল ফোন কিনে দিলেন। দেখতে ভীষণ সুন্দরী হওয়ায় রাজ্যের ছেলেরা ফোন করত। কখনও-কখনও ও কারও-কারও সাথে গল্প করত রাতের পর রাত। সাথে ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ তো ছিলই। পড়াশোনা করত না ঠিক মত। নতুন-নতুন ড্রেস পরে-পরে ঘুরে বেড়াত, গল্পের বই পড়ত আর মুভি দেখত সারাদিন, রাজ্যের রূপচর্চা করত। স্কুলে সব মেয়ের সাথেই মাস্তানি করে বেড়াত নিজের খেয়ালখুশি মত। ও জানত, ওকে কেউ কিছু বলবে না। ছুটির দিনগুলিতে বাবা ওকে শহর ছেড়ে দূরের গ্রামে নদীর ধারে, পাহাড়ে নিয়ে যেতেন। বাবা আর মেয়ে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গান ধরত। মা দেখে বলতেন, “ঠাকুর, আমার লক্ষ্মীটি যেন সারাজীবন এমন লক্ষ্মীই থেকে যায়।” পুতুলের কোমরছড়ানো ঘন কালো চুল ছিল। বাবা ওকে খোঁপা করা শিখিয়েছিলেন। বিয়ের পর-পর পুতুলের মায়ের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের খোঁপা করা শিখে নিয়েছিলেন। পুতুলের মাকে সেইসব খোঁপা করে দিতেন, এখন দেন মেয়েকে। পুতুলের খোঁপার আশ্চর্য নান্দনিকতা দেখে ওর বন্ধুরা বলত, “ইস! তোর বাবাটা যদি আমার হত!” শুনে পুতুল বলত, “এহহ্! কিছুতেই না!” পুতুলের চোখে অনেক যত্ন করে কাজল এঁকে দিতেন। পুতুল কোনওদিনও কোনও আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে এক রাতও থাকতে পারত না। বাবা অস্থির হয়ে উঠতেন আর নিজেই গিয়ে বাসায় নিয়ে আসতেন। কখনও ওর জ্বর এলে রাতের পর রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিতেন।
জন্মের সময়ে পুতুল ওর বাবার বাম হাতের বুড়ো আঙুলটা ওইটুকুন হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। সে দৃশ্য দেখে বাবার সে কী খুশি! বুকের কাছে জড়িয়ে নিয়ে স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, “এভাবে করেই সারাটি জীবন মেয়েকে বুক দিয়ে আগলে রাখব।” পুতুলকে বাবা প্রায়ই ডাকতেন খুকুমণি বলে। পুতুল বাবার কাছ থেকে হারমোনিকা বাজাতে শিখেছিল, ভায়োলিনেও চমৎকার সুর তুলতে পারত। আর ১০টা মেয়ের মত, বাবাই ছিল পুতুলের প্রথম প্রেম। বাবার চাইতে স্মার্ট সুদর্শন পুরুষ সে কোনওদিনই দেখেনি। সে নিজের জীবনে ওর বাবার মতই কাউকে খুঁজে ফিরত মনে-মনে। বাবা পুতুলকে বলতেন: “রংধনুটা ছুঁয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখতে শিখিস, সাথে এটাও শিখে নিস কোন রাস্তা ধরে কখন কীভাবে কেন আবার ঘরে ফিরে আসতে হয়। তুই পুরো পৃথিবীটাকে তোর মত করে পাবি, কিন্তু এটা জেনে রাখিস, আমি ছাড়া আর কেউই তোকে এভাবে করে পাবে না। তুই আমার ছোট্ট মেয়ে হয়েই থাকবি সারাজীবন। তুই কখনওই আর বড় হবি নারে! আমি বুড়ো হয়ে যাব, কিন্তু তুই এই ছোট্টটিই থেকে যাবি রে মা। তোর একটুখানি হাসির জন্য আমি জীবনও দিয়ে দিতে পারি। তুই কখনওই আমাকে এমন কোনও কষ্ট দিস না যেটার জন্য তোকে নিয়ে কারও কাছে আমাকে ক্ষণিকের জন্যও মাথানত করে থাকতে হয়।” এসব কথার অর্থ পুতুল কিছু বুঝত, কিছু বুঝত না। বাবা খুব ধীরে-ধীরে কথাগুলি বলে যেতেন, একটুখানি হাসির আভা ছড়িয়ে থাকত সারা মুখে, আর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে কিশোরী পুতুল গালে হাত রেখে বাবার কথা শুনে যেত। ও ঘুমিয়ে পড়লে ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বাবা বলতেন, “ঘুমো মা। আমার এই লক্ষ্মীসোনাটাকে আমি অনেকবেশি ভালোবাসি।” কখনও-কখনও বাবা ভাবতেন, “একদিন এক রাজপুত্র আসবে আর আমার খুকুমণিকে আমার কাছ থেকে চাইবে। আমি শুধু এমন কারও হাতেই ওকে তুলে দেবো, যে ওর জীবনটাকে পূর্ণ করে দেবে ভালোবাসা দিয়ে। যার হৃদয়ে কবিত্ব থাকবে, বাহুতে থাকবে নিরাপত্তা, চোখে থাকবে সিংহের তেজ। ওকে হতে হবে একজন ভালমানুষ, সব অর্থেই। আমি শুধু তার সাথেই মেয়েকে বিয়ে দেবো যে আমার মেয়েকে আমার মতন করে ভালোবাসতে পারবে।” এসব ভাবতে-ভাবতে বাবার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায় যেদিন পুতুল প্রথম বাবাকে হাত ধরে টানতে-টানতে ছাদে নিয়ে যায় আর চোখের কোণায় খুশির নাচন জাগিয়ে সমস্ত শরীরমন দিয়ে অনুভব করে বলে, “বাবা, দেখ দেখ, চাঁদটা কী সুন্দর!” বাবার সেদিন মনে হয়েছিল, “আমার পুতুলটা কি তাহলে বড় হয়ে যাচ্ছে? একদিন সে কোনও ছেলের হাত ধরে নদীর ধারে চাঁদ দেখাতে নিয়ে যাবে। চাঁদের নরোম আলোয় স্নান করতে-করতে বলে বসবে, ভালোবাসি!” এইসব মনে করতে-করতে বাবার চোখের দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ঘুমিয়েপড়া পুতুলের গোলাপি গালের উপর। বাবার খুব ইচ্ছে করল সেই ছোটবেলার মত করে পুতুলকে রূপকথার গল্প শোনাতে। ওর মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে এটা কিছুতেই ভাবতে ইচ্ছে করল না যে ওর রূপকথার গল্প শোনার দিনগুলি ফুরিয়ে গেছে। এ পৃথিবীতে বাবার ভালোবাসার চাইতে শক্তিশালী আর কিছুই হয় না। সে ভালোবাসার বাঁধনে পুতুলকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবেন বাবা। বাবার মনে পড়ে যায়, যে পুতুল হাঁটতে শেখার পর বাবার বড়-বড় জুতো পরে সারা ঘর থপথপ করে হেঁটে বেড়াত, সে পুতুল যখন ক্লাস সেভেনে, তখন বাবা অফিসে যাওয়ার সময় বাবার জুতোর উপরে পায়ের আঙুলগুলিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলত, “ভাল থেকো, বাবা। দুপুরে মনে করে খেয়ে নিয়ো। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” বাবার মনে হত, “এত সুন্দর চুমু পৃথিবীতে আর কেউ কোনওদিনও পায়নি।” আর কিছু হোক না হোক, শুধু এমন একটা মিষ্টি চুমুর জন্যও তো বেঁচে থাকা যায়! বিপিন বাবুর বাঁচার সাধটা হঠাৎ করেই তীব্র হয়ে উঠল।
বাবার ছোট্ট পুতুলটি একদিন গার্লস স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কম্বাইন্ড কলেজে গেল। প্রেমভালোবাসার মত সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলি এতদিন পর্যন্ত বই, গান আর সেলুলয়েডের ফিতেতেই আবিষ্কার করে এসেছে পুতুল। সেই মেয়েটিই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে এক খৃষ্টান ছেলের প্রেমে পড়ল। ফেসবুকে পরিচয়, চ্যাটিং, ফোনে কথাবলা, দেখা হওয়া, এরপরই টিনএজের হৃদয় উথালপাথাল-করা কঠিন প্রেম! ছেলেটি জন, ঢাকায় থাকে, বাংলাদেশ মেডিক্যালে থার্ড ইয়ারে পড়ে। পুতুলের জন্যই জন যশোরে আসত প্রায় প্রতি উইকেন্ডেই। সারাদিন ওরা একসাথে ঘুরত যশোরের আশেপাশে—-নড়াইলে, মাগুরায়, ঝিনাইদহে; যদি কেউ দেখে ফেলে, ধরা পড়ে যায়, সে ভয়ে। বাসায় জানত, স্যার ম্যারাথন ক্লাস দিয়েছেন, মডেল টেস্ট নিচ্ছেন, পুতুল ওর ক্লাসমেটদের সাথে গ্রুপস্টাডি করছে, আর কখনও জানত, ও বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গেছে। পুতুলের ভেতরেবাইরে সবখানেই ঝড় বয়ে যেতে লাগল। সম্পূর্ণই নতুন একটা অনুভূতির জগত। পুরো পৃথিবীটাকেই মনে হতে লাগল রঙিন। ভালোবাসার রঙে সে নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করল প্রতিটি মুহূর্তেই। পুরো পৃথিবীর চাইতেও বড় সত্যি হয়ে ধরা দিল ওর প্রেম। যে মেয়েটি স্কুল পর্যন্ত সব ছেলেকেই তুড়িতেই উড়িয়ে দিয়েছে, সে মেয়েটিই এখন এক মুহূর্তও জনের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না। পড়াশোনা শিকেয় উঠল। একদিন নড়াইল থেকে সন্ধ্যায় ফেরার সময় পুতুলের বাবার এক কলিগ বাসে ওদেরকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখলেন। পুতুলের বাবাকে ব্যাপারটা জানালেন। বাবা অনেক আগেই পুতুলের আচরণ আর কথাবার্তায় কিছু পরিবর্তন খেয়াল করেছিলেন। পুতুলের মাকে ওটা জিজ্ঞেস করলে উনি তেমন কিছু বলতে পারেননি। এরপর পুতুলের কাছ থেকে জানতে চাইলেন, “মা, তোর কি কিছু হয়েছে? আমাকে বল মা।” পুতুল জীবনে প্রথমবারের মত বাবাকে মিথ্যে বলল। প্রেমভালোবাসা পুতুলদের নিপুণভাবে মিথ্যেবলা শিখিয়ে দেয়। বাবা আর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেননি। ধরেই নিয়েছিলেন, “ওই বয়সের মেয়েদের মাঝেমধ্যে ওরকম হয়। ঠিক হয়ে যাবে।” কলিগের কাছ থেকে ওকথা শোনার পর খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন, পুতুল কখনওই শুক্রবার-শনিবার পড়তে যায় না, একটা মডেল টেস্টও ঠিক মত দেয় না, বাসায় বলেছিল ৫ জন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, কিন্তু আসলে পড়ে ৩ জন স্যারের কাছে, সেখানেও ঠিকমত ক্লাস করে না। কলেজেও রেগুলারলি ইরেগুলার। পুতুলের মায়ের এক প্রিয় ছাত্রকে দিয়ে পুতুলের উপর নজরদারি করে জানতে পারলেন সত্যিই পুতুল প্রায় সপ্তাহেই বিভিন্ন জায়গায় একটা ছেলের সাথে ঘুরতে যায়। ছেলেটি কৌশলে জনের পরিচয় জেনে নিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা জানার পর পুতুলের বাবা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। উনি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। যে মেয়েকে উনি পুরো পৃথিবীর চাইতেও বেশি বিশ্বাস করেন, সে মেয়ে এখন নিয়মিত মিথ্যা কথা বলে। বাবার কাছ থেকে প্রতিমাসে স্যারদের বেতনের টাকা নিয়ে সে টাকায় প্রেম করে বেড়ায়। পুতুলদের পরিবার ছিল যশোরের হিন্দু পরিবারগুলির মধ্যে সবচাইতে অভিজাত। বিপিন বাবু প্রয়োজনে মৃত্যুকে মেনে নেবেন, তবুও কিছুতেই মেয়ের সাথে খৃষ্টান ছেলের বিয়ে দেবেন না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এটা সম্ভব নয়। একদিন সন্ধ্যায় পুতুলের রুমে গিয়ে অনেক আদর করে করে বিভিন্ন কথা বলার ছলে ওকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ও কি কারও প্রেমে পড়েছে কি না। পুতুল অনেক আহ্লাদ করে কৌশলে ব্যাপারটি অস্বীকার করল। বাবা যখন দেখলেন, কোনওকিছুতেই কোনও কাজ হচ্ছে না, তখন সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “জন কে? ওর সাথে তোর কীসের সম্পর্ক?” পুতুল মাথা নিচু করে স্বর নামিয়ে বলল, “বাবা, আমি ওকে ভালোবাসি।” “ওকে ভুলে যা মা, ওর সাথে তোর কোনও সম্পর্ক হওয়া সম্ভব নয়।” “কেন বাবা? ও অনেক ভাল ছেলে।” “হতে পারে। কিন্তু ও তো খৃষ্টান। আমাদের সমাজে এটা হয় না। আমাকে সবার কাছে ছোট করে দিস না, মা।” “কেন? খৃস্টানরা কি মানুষ নয়? ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না, বাবা। তোমরা ওকে মেনে নাও। ওর জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি।” অবিচল দৃঢ় কণ্ঠে এই কথাগুলি বলে গেল পুতুল। বাবা যখন দেখলেন মেয়েকে কোনওভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না, তখন একটু ধমকের সুরেই বলে ফেললেন, “আমার কাছে পৃথিবীতে সবার আগে আমার সম্মান। জীবনে কোনওদিনও কারও কাছে মাথা নোয়াইনি। কেউ কখনওই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস করেনি। তোর জন্য আমি সবার কাছে ছোট হতে পারব না। ওই ছেলেকে ছাড়, নাহলে তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো। লাগবে না তোর পড়াশোনা!” এইটুকু বলেই দ্রুত মেয়ের রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন বিপিন বাবু। ভাবলেন, মেয়ে নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত বদলাবে। বাবার সুখের জন্য পুতুল সবকিছুই করতে পারবে। বাবাকে সবার চোখে ছোট হতে দেবে না কিছুতেই। “আমার মেয়ে আমার কথা শুনবে না, এটা অসম্ভব!” উনি বিশ্বাস করতে চাইলেন না, পৃথিবীর অন্য কোনও ছেলে পুতুলকে উনার চাইতে বেশি বুঝতে পারে, ভালোবাসতে পারে।
পুতুল বেশ ভাল ছাত্রী ছিল। দুটো সরকারি বৃত্তি পেয়েছিল ট্যালেন্টপুলেতে, এসএসসি’তে গোল্ডেন এপ্লাস। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই বাবা পুতুলকে বিয়ে দিয়ে দেবেন, এটা পুতুল কিছুতেই বিশ্বাস করল না। মাকে বলল, “বিয়ে দিলে দিয়ে দাও। তবুও আমি জনকে ছাড়তে পারব না।” স্ত্রীর কাছ থেকে মেয়ের গোঁয়ার্তুমির কথা শুনে উনি সত্যি সত্যিই পুতুলের জন্য ছেলে খুঁজতে ওর চাচাদের আর মামাদের বলে দিলেন। সব শুনে পুতুলের প্রেমিক জন বলল, “ঢাকায় চলে আস। আমার সাথে থাকবে। আমরা বিয়ে করে ফেলব। কী? পারবে না?” প্রিয়মানুষের এমন প্রস্তাবে ‘না’ বলার মতন বুদ্ধি কোনও কিশোরীর মাথায়ই থাকে না। পরদিন যখন বাবা অফিসে, মা কলেজে, তখন পুতুল কাউকে কিছুই না জানিয়ে গোপনে ব্যাগে কিছু কাপড়, দরকারি জিনিসপত্র আর আলমারি থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে দরোজায় বাইরে থেকে তালা মেরে ঢাকায় চলে গেল। সেসময়ে একটিবারের জন্যও বাবার মুখটা ওর মনে এল না। মায়ের আদরের কথা ভুলেও মাথায় আসেনি। ওর সামনে তখন শুধুই জনের মুখটি, প্রিয়মানুষের সাথে সারাজীবন একসাথে থাকার রঙিন স্বপ্ন। কারও প্রতি অতিপ্রেম এবং মোহ কখনও-কখনও রক্তের সম্পর্ককেও ভুলিয়ে দেয়। মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই বিচিত্র। এইখানে নতুন ভালোবাসার আবির্ভাবে পুরনো ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায় নিমিষেই। বাবা-মা’য়ের ভালোবাসার চাইতে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয় প্রেমিকের কিংবা প্রেমিকার ভালোবাসা। কিন্তু কেন? নতুনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তীব্র বলে? বাবা-মা’য়ের ভালোবাসা যতটা মানসিক, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা ততধিক মনোদৈহিক। এটা একটা কারণ হতে পারে।
পুতুল ঢাকায় গিয়ে জনের মেসে উঠল। বাবাকে ফোন করল। জানাল, সে তার সিদ্ধান্তে অটল। বাবা বললেন, “তুই ফিরে আয় মা। তুই কি আমার চাইতেও ওই ছেলেকে বেশি ভালোবাসিস? তুই চলে গেলি মা, আমি তো আর বাঁচব না।” “আমি জনকে অনেক অনেক বেশিই ভালোবাসি। আমাকে ছোটবেলা থেকেই তো সবসময়ই হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েছ। আর কত? এখন আমি আর ছোট নই। আমি ফিরে আসব তো, তোমরা শুধু জনকে মেনে নিয়ো।” এরকম আরও কিছু সময় ধরে মেয়েকে বিভিন্নভাবে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ঢাকায় কোথায় আছে, সেটা জানার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। একটা সময়ে বাবার সাথে খুব উচ্চস্বরে বড়-বড় কথা শোনাতে শুরু করল পুতুল, যা সে আগে কোনওদিনও করেনি। রাগে আর বিরক্তিতে পুতুল ফোনটা কেটে দিলে বিপিন বাবু বাচ্চাদের মতন কাঁদতে থাকেন। এরপর পুতুলের মা পুতুলকে বারবার ফোন করেও আর পেলেন না। পুতুলের বাবা-মা যখন কপাল চাপড়াচ্ছেন আর গুমরেগুমরে কাঁদছেন, সে মুহূর্তে পুতুল জনের সাথে অপার্থিব স্বপ্নসুখে ডুবে আছে। প্রেমের কাছে বাবা-মা’য়ের মৃত্যুও কিছু নয়। আর এখানে পুতুলের বাবা-মা তো এমনি এমনিই কাঁদছেন। বাবা-মা হলে ওরকম একটু কাঁদতে হয়। পুতুলের নিজের একটা লাইফ আছে। ওসব সনাতনী ধ্যানধারণাকে তোয়াক্কা করার সময় কোথায় ওর? ওর ডিসিশনকে যারা দাম দেয় না, তাদের ওসব ফালতু ইমোশন আর আদিখ্যেতা সহ্য করার কী মানে?
পুতুল বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ৩ দিনের মাথায় বিপিন বাবু ব্রেইনস্ট্রোক করলেন, ৪ দিনের মাথায় যশোর মেডিক্যালে মারা গেলেন। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে জ্ঞান এসেছিল। পুতুলের মাকে ইশারায় কাছে ডেকে অনেক কষ্টে টেনেটেনে কিছু কথা বলেছিলেন। “সুপ্রিয়া, আমার মেয়েটি বড় ছেলেমানুষ, অভিমানী। ও কিছুই বোঝে না। ওর পার্থিব বুদ্ধি নেই, সহনশীলতা কম, ওকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা। আমার মা’টা তো বোকা আমার মতন, দুনিয়াদারি চিনে না, যে যা-ই বলে, তা-ই বিশ্বাস করে। ওকে তুমি আগলে রেখো সকল বিপদআপদ থেকে। আমার মা এখনও অনেক ছোট, ছেলের উপর অভিমান করে চলে গেছে। আমি জানি, আমার মা আমার কাছে ফিরে আসবেই আসবে। আমার মা’কে কখনও কষ্ট দিয়ো না, সুপ্রিয়া। ওকে বুকের মধ্যে রেখে দিয়ো আমার যদি কিছু হয়ে যায়! আর কিছু না হলে আমি নিজেই ঢাকায় গিয়ে ওকে বুঝিয়েশুনিয়ে নিয়ে আসব। ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, আদর করতে ইচ্ছে করছে, আমার মা’টা……..” আর কিছুই বলতে পারলেন না। চলে গেলেন।
পরদিন ছিল বিপিন বাবুর ৪৩তম জন্মদিন। আগের জন্মদিনে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পুতুল বলেছিল, “বাবা, তোমার নেক্সট বার্থডেতে তোমাকে ৪৩টা গোলাপ কিনে দেবো, কেমন?”
হ্যাঁ, বাবা মারা গেলেন। অভিমানী মেয়েটি একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে এসে বাবাকে অনেক ডাকাডাকি করল, চিৎকার করে কাঁদল, বলল, “বাবা, আমি এসেছি, দেখো না। উঠো না বাবা! আর কত ঘুমাবে? উঠো বাবা! উঠো!” বলেই হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চোখেমুখে চুমু খেতে লাগল। “বাবা, তুমি কোথায় চলে গেলে? বাবা! আমি আর কোনওদিনই তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। একদম প্রমিজ! সারাজীবন তোমার পাশে থাকব। বাবা, কথা বল, বাবা………!!!” ঠিক ওই মুহূর্তে আশেপাশের কোনও একটা বাসায় বাজছিল সন্তোষ সেনগুপ্ত: জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল……….. আত্মীয়স্বজনরা পুতুলকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। মৃতদেহের সৎকার করতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দিন কেটে যায়। সবাই-ই জানে, পুতুলই দায়ী বাবার মৃত্যুর জন্য। কিন্তু কেউই কিছু বলার সাহস পেল না, কারণ পুতুলকে আগলে রাখলেন ওর মা। এটাই যে পুতুলের বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল! এভাবে করেই মৃত্যুর পরেও পুতুলকে সর্বক্ষণ ছায়া দিয়ে আগলে রাখলেন বিপিন বাবু। “মা, তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে রে। কতদিন তোকে ভাত খাইয়ে দিই না। এখন তুই নিজের হাতে ঠিকমত খাস তো মা? মনখারাপ হলে কী করিস এখন? মায়ের সাথে ঝগড়া হয় এখনও? তোর মা বড় ভাল রে। আমি তো কিছুই করতে পারলাম না তোর জন্য। এই বুড়ো খোকাকে ক্ষমা করে দিস মা! তুই কোনও চিন্তা করিস না, চোখ বন্ধ করলেই আমাকে দেখতে পাবি, আমি সবসময়ই আছি তোর সাথে। তুই ভাল থাকিস, আমি আর কিছুই চাই না, মা।” প্রায় রাতেই বাবা স্বপ্নে আসেন, অনেক দিন হয়ে গেল, পুতুলের ঘুম হয় না ঠিক মত। আস্তে-আস্তে পুতুল মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। হাইপার টেনশনের রোগী হয়ে গেল। বাবার সমাধিমন্দিরে ওকে কেউ যেতে দেয় না না, ওখানে গেলেই ও এলোমেলো হয়ে ওঠে, সামলানো যায় না। সারাক্ষণই মনে মনে বলে, বাবা এখুনিই ফিরে আসবে! বাবার ফাঁকা রুমটাতে গিয়ে দেখে, বাবা খাটের উপর শুয়ে আছেন কি না। আগের মতন কেউ আর বলে না, “ওমা! আমার লক্ষ্মী মামণি নাকি? এদিকে আয় মা, বোস।” ডাক্তার আর পথ্য দুটোই চলছিল, সাথে মায়ের সেবা। কিছুটা সুস্থ হল, এইচএসসি দিল, টেনেটুনে ‘এ’ পেয়ে পাশ করে গেল। জন মাঝেমাঝে ফোন করত। কখনওই বাড়ির অন্যকারও কথা জিজ্ঞেস করত না, শুধুই পুতুলের খবর নেয়ার জন্যই ফোন করত। স্বামীর মৃত্যুর পর সুপ্রিয়া দেবী একেবারেই চুপ হয়ে গিয়েছিলেন, কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দেন, কাউকেই কিছু বলতেন না, শুধু নীরবে ঘরের কাজগুলি করে যেতেন। এর মধ্যে একদিন পুতুল মাকে বলল, “আমি জনের সাথে ছিলাম, এটা ঠিক। কিন্তু তোমাদের অমতে ওকে বিয়ে করিনি। তবে, আমি ওকে বিয়ে করব।” মা কোনও বাধাই দিলেন না, মেনে নিলেন। নির্লিপ্তভাবে শুধু এইটুকু বললেন, “তোর যা ইচ্ছে!”
এর মধ্যে পুতুল একটু চেষ্টা করছিল ভার্সিটি অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য পড়াশোনা করতে, যাতে যেকোনও একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায়। পড়া কিছুই মাথায় ঢোকে না, তবুও ওর বাবার আশীর্বাদে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেল। মেরিট লিস্টে ২১৪তম, ক ইউনিট। ভাইবার ডেট পড়ল, ও প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় জন ফোনে বলল, “ঢাকায় আসছই যখন, আমরা বিয়েটা সেরে ফেলি। কী বল?” পুতুল ভাবল, “মন্দ কী? আর মা তো পারমিশন দিয়েই দিয়েছেন। আমি তো আর পরিবারের অমতে জনকে বিয়ে করছি না!” মুখে বলল, “ঠিক আছে।”
ঢাকায় আসার দুএকদিন আগে একটা ফোন আসে। “পুতুল, আমি মেঘা। আমার সাথে তোমার ঢাকা নিউমার্কেটে পরিচয় হয়েছিল। কোনও এক ফ্রাইডেতে, সন্ধ্যায়। জন, আমি আর তুমি একসাথে ফুচকা খেয়েছিলাম। মনে পড়ে?” মেঘাকে পুতুল চিনত, ফেসবুকে দেখেছিল মেঘা হাসান নামে, জনের স্ট্যাটাসে কমেন্ট করত। জনের মাধ্যমেই ওর সাথে পরিচয়। ও ছিল জনের ব্যাচমেট, পড়ত সিটি ডেন্টাল কলেজে। মেঘা জনের বেস্ট ফ্রেন্ড, জনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে এটা পুতুলও জানে, কিন্তু জন শুধু পুতুলকেই ভালোবাসে, মেঘার সাথে ওর জাস্ট ফ্রেন্ডশিপ। “হ্যাঁ আপু। ভালো আছ?” “এইতো আছি! শুনলাম, তোমরা বিয়ে করছ। ভাল কথা। জন কি তোমাকে কখনও বলেছে যে ও আমাকে এ পর্যন্ত ১বার অ্যাবরশন আর ১বার এমআর করিয়েছে? হ্যাঁ, ও নিজেই ওর সন্তানকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরপর ২বার। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। তুমি চাইলে আমি দেখাতে পারি।” এটা শুনে পুতুল চিৎকার করে বলল, “ছিঃ মেঘা আপু, ছিঃ! তুমি না ওকে ভালোবাসো? ভালোবাসার মানুষের নামে এত বাজে কথা কেউ বলে? ভালোবাসা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ! ছিঃ আপু!” বলেই কলটা কেটে মেঘাকে ব্ল্যাকলিস্টে রেখে দিল। সাথে সাথেই জনকে ফোন দিল পুতুল। “আরে বোলো না, মেঘা একটা পাগল! আমি তোমাকে বিয়ে করছি শুনে আরও পাগল হয়ে গেছে। হিংসা, তুমি বুঝ না? মেয়েদের হিংসা!” পুতুলের কী জানি মনে হল, মাকে জানাল একথা। মা বললেন, “মিথ্যাই হবে রে মা, তাও একবার খবরটবর নিয়ে দেখবি নাকি?” “আরে ধুর্! বাদ দাও মা! মেয়েমানুষের হিংসা আরকি! আমাদের সুখ মেঘার সহ্য হচ্ছে না।” মুখে এটা বলে ফেললেও মায়ের কথাগুলি মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করতে লাগল। বাংলাদেশ মেডিক্যালের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাঃ আব্দুল হক যশোরের, বাড়ি পুতুলের বাড়ির পাশেই। পুতুলের বাবাকে চিনতেন, ওদের বাসায় এসেছেন কয়েকবার, পুতুলকে ভীষণ স্নেহ করতেন। কী মনে করে পুতুল স্যারকে ফেসবুকে মেসেজ পাঠাল।
“আঙ্কেল, আদাব। আশা করি বাড়ির সবাইকে নিয়ে ভাল আছেন। একটা ব্যাপার নিয়ে জানতে আপনাকে বিরক্ত করছি। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো বাবাই আপনাকে জিজ্ঞেস করত। আমি আপনার ছাত্র জনকে ভালোবাসি। জনও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের সম্মতিতেই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মেঘা নামে জনের এক ফ্রেন্ড আমাকে ফোন করে জনের নামে আজেবাজে কথা বলেছে। মা এ ব্যাপারটা নিয়ে অনেক টেনশন করছে তো তাই খুব নিরুপায় হয়ে আপনাকে লিখলাম। ভাল থাকবেন।”
সন্ধ্যার আগেই রিপ্লাই এল।
প্রিয় পুতুল মামণি,
তুমি কতটুকু কী শুনেছো, আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, অনেককিছুই ঘটেছে। ডরমিটরিতে আমার অনেক স্টুডেন্টই বিভিন্ন সময়ে ওদেরকে অশালীন অবস্থায় পেয়েছে। আমার কাছে কমপ্লেইন আসার পর আমি জনকে ডাকাই। পরে ডিরেক্টর স্যারের রুমে নিয়ে পুরো ব্যাপারটি জানালে আমরা জনকে ডরমিটরি এবং মেডিক্যাল ছাড়ার নির্দেশ দিই।
তোমার এবং ভাবীর মঙ্গলকামনা করছি।
তোমার হক চাচা
রিপ্লাই পড়ে পুতুল অঝোরে কাঁদতে লাগল। “এই ছেলেটির জন্য আমি বাসা ছেড়েছিলাম? এরকম একটা জঘন্য ছেলের জন্য আমি বাবাকে মেরে ফেললাম?” পুতুল আরও খোঁজ নিল জনের বিভিন্ন বন্ধুর কাছ থেকে। সবাই একই কথা বলল। জন ওরকম কাজ আরও কয়েকজনের সাথেই করেছে। এরপর জনকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে সবকিছু অস্বীকার করল, পরে বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে আরও ভালভাবে জিজ্ঞেস করার পর বলল, “হ্যাঁ, ওরকম কিছু হয়তো হয়েছিল, কিন্তু ওটা করতে মেঘাই আমাকে অনেকটা বাধ্য করেছিল। আমার কোনও দোষ নেই ওটাতে। তবে এটা ঠিক, ক্ষণিকের মোহে আমি একটা ভুল করেছিলাম। এখন আর কোনও মোহ নেই। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসতাম, ভালোবাসি, ভালোবাসব। আই লাভ ইউ, পুতুল।” পুতুলও ‘আই লাভ ইউ টু’ বলে ফোনটা রেখে দিল।
এবং, এবার পুতুল পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। ভার্সিটিতে ভাইভার ডেট চলে গেল। একবছরেও ও সুস্থ হতে পারল না। “আমি খুনি, আমিই বাবাকে খুন করেছি। কেউ কিছু বলুক আর না বলুক, আমি তো জানি, আমিই খুনি। আমি জনকে বাবার চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলাম? ছিঃ!” মা কী মনে করে পুতুলের কাগজপত্রগুলো নিয়ে উনি যে কলেজে পড়াতেন, পুতুলকে সে কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি করিয়ে রাখলেন। পুতুল ৩-৪টা বছর ওর ঘরে অন্ধকারেই কাটিয়ে দিল। ওর মা-ই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এভাবে করে উনি প্রতি মুহূর্তেই স্বামীর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে যাচ্ছিলেন। ৪ বছর ধরে প্রতিটি সন্ধ্যায় মা পুতুলের কলেজের পড়ার বইগুলি ওর সামনে বসে বসে রিডিং পড়তেন। বলতেন, “শোন, তোর পড়ার দরকার নেই। আমি পড়ব, আর তুই মন দিয়ে শুনবি। ঠিক আছে?” পুতুল শুধু মাথা নাড়িয়ে বলত, “হ্যাঁ।” রাত জেগে-জেগে নিজে সাজেশনস্ রেডি করে সে প্রশ্নগুলির উত্তর নোট করে পুতুলের সামনে বারবার করে পড়তেন। মাঝেমাঝে বলতেন, “মা শোন, এই প্রশ্নটাতে একটু চোখ বুলিয়ে যা তো!” পুতুল রোবটের মতন চোখ বুলিয়ে যেত। এভাবেই চলত পুতুলের পড়াশোনা। মা যখন পড়ে যেতেন, তখন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে পুতুলের একেকটা সময় মনে হত, “অমন সুন্দর করে আর কেউ পড়তে পারে না। মা ভারি সুন্দর তো দেখতে! আগে তো কখনও খেয়ালই করিনি!” পরীক্ষা যখন শুরু হত, তখন মা প্রতিটি পরীক্ষার আগের ৩-৪ দিন বন্ধের সময় নাওয়াখাওয়া ভুলে পরবর্তী পরীক্ষার পড়াগুলি পুতুলের সামনে বসে বারবার বুঝিয়ে-বুঝিয়ে পড়ে যেতেন। পরীক্ষার হলের বাইরে বসে-বসে কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে থাকতেন, “ঠাকুর, তুমি কৃপা কর, আমি যেন উনার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারি। ও যেন ওর বাবার মতই বড় মানুষ হতে পারে।” বিপিন বাবু তখন নিশ্চয়ই ওপর থেকে এসব দেখে হাসতেন আর মনেমনে বলতেন, “সুপ্রিয়া, তুমি দেখো, আমার খুকুমণি অনেক বড় হবে, সবার কাছে তোমার মাথা উঁচু করে দেবে।”
এভাবে করেই বাবার ছোট্ট মেয়েটি একদিন ডিগ্রি পাস করল ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে। মা রেজাল্ট এনে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলেন, “মাগো, তোর বাবা আজকে অনেকদিন পর অনেক খুশি হয়েছেন। আমি পারছি উনার আদেশ পালন করতে, করে যাব যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ রক্তবিন্দুটা অবশিষ্ট থাকবে! আরও কাজ বাকি আছে। এবার একটু সুস্থ হ মা, বাইরে যা, দুনিয়াটাকে দেখ, একটু বাঁচ, বাঁচতে শিখ। চান্স পেয়েও ভাগ্যের দোষে অনার্স পড়তে পারিসনি। আমি খোঁজ নিয়েছি, তুই যে সাবজেক্ট নিয়েছিস, ওটাতেই মাস্টার্স করতে পারবি রাজশাহী ভার্সিটিতে। ওখানে তোর সেজোমাসি আছে। তোর কোনও সমস্যাই হবে না, মা। প্রয়োজনে আমিও তোর সাথে রাজশাহী চলে যাবো। তুই চান্স পাবি, আমি জানি।” হ্যাঁ, পুতুল চান্স পেল। আগের চাইতে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল। পড়ল, সেমিস্টারেও ভাল রেজাল্ট করছিল, কিন্তু পোড়াকপাল ওর পিছু ছাড়ল না। ডিপার্টমেন্টের হেড হাবিবুর রহমান স্যার, যার বয়স পুতুলের বয়সের প্রায় দ্বিগুণ, এসে বললেন, “পুতুল, আমি তো তোমার প্রেমে পড়ে গেছি! তোমাকে বিয়ে করতে চাই।” এর আগে ভদ্রলোকের দুইবার ডিভোর্স হয়েছিল। পুতুল পাত্তা না দেয়ায় প্রিভিয়াসে ফার্স্ট ক্লাস থাকলেও ফাইনালে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ওকে এমএসএস কমপ্লিট করতে হল। আবারও হতাশ হয়ে ও শুধুই হাসল। জীবন যার কাছ থেকে এতকিছু কেড়ে নিয়েছে, তার জন্য এই সামান্য ক্ষতি কিছুই নয়।
মাস্টার্স শেষ করার পর সে আবার যশোরে ফিরে গেল। মা ওর বাবার বাঁধাইকরা বড় ছবিটির সামনে প্রণাম করে বললেন, “আপনি দেখছেন, আপনার মেয়ে আজ কত বড় হয়ে গেছে! আপনার কথা মত আমি ওকে এখনও আগলে রেখেছি, কথা দিচ্ছি, সারাজীবনই আগলে রেখে যাব। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি আপনার পুতুলকে দেখে রাখব, কথা দিলাম।” পুতুল তখন খাটের উপর বসে বসে জলপাইয়ের আচার খাচ্ছিল। হঠাৎই ওর মাথায় কিছু কথা এল।
“আচ্ছা, মা কি আসলেই বাবাকে ভালোবাসে, নাকি এটা শুধুই শ্রদ্ধা? আমার বাবা বেঁচে থাকতে মাকে কী দিয়েছিল শুধু একটি সন্তান ছাড়া? কোনওদিনই তো মাকে নিয়ে বাবাকে ঘুরতে যেতে দেখিনি। মাকে কোনওদিন খাবার তুলে খাইয়ে দেয়নি। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে খাবার খাইয়ে দেয়ার সময় মা সবসময়ই বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত, দেখেছি। বাবা এর অর্থ কোনওদিনই বোঝার চেষ্টা করেনি কেন? কখনও কি মায়ের পাশে বসে বাবা খোশগল্প করেছিল? মনে পড়ে নাতো! বাবা সারাজীবন ধরে যে টাকা আয় করেছে, সবই তো খরচ করে ফেলেছে দুহাতে! আমাকে যতটা ভালোবাসত, এর সিকিভাগও ভালোবাসাও কি মা কোনওদিনও পেয়েছে বাবার কাছ থেকে? কখনওই গায়ে হাত তোলেনি, বকাঝকা করেনি, কিন্তু সব রকমের অবহেলাই তো করে গেছে মাকে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমাকে নিয়ে তাজমহল দেখতে গেছে, কিন্তু মাকে তো সাথে করে নিয়ে যায়নি। ভাইবোনদের মধ্যে মা সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই বড় আদরে মানুষ হয়েছে। মামারা যখন বলত, তুই চলে আয় আমাদের কাছে, জামাই থাক পুতুলকে নিয়ে, তখন মা ভীষণ রাগ করে মামাদের সাথে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিত। কিন্তু কী পেয়েছে এর বিনিময়ে বাবার কাছ থেকে? বাবা কি সত্যিই মাকে ভালোবাসতে পেরেছিল কোনওদিনও? নাকি, সবটাই ছিল স্রেফ একসাথে থাকার অভ্যস্ততা? আমাকে পাগলের মতন ভালোবাসত বাবা। আর মায়ের পুরো জগতটাই ছিল আমাকে আর বাবাকে নিয়ে। কিন্তু বাবার নিজস্ব পৃথিবীর কতটুকু জায়গা জুড়ে ছিল মা? মা যখন বিধবা হল, তখন মা মাত্র ৩৭। সবাই মাকে বলেছিল একটা বিয়ে করতে। এমনকি আমিও অনেক করে বললাম। কারও কোনও কথাই শুনল না। সবাইকে বকে সরিয়ে দিল। বাবার শোকে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সেলাই করত, মাসে-মাসে মামারা কিছু টাকা পাঠাত। কাকারা কেউ কোনওদিন খোঁজও নিতে আসত না। ওদের ভয় ছিল, যদি ফোন করলে মা টাকা চায়? যে পরিবারে বাবা নেই, সবাই-ই সে পরিবারকে দূরে ঠেলে দেয়, সে পরিবার বড় একা হয়ে পড়ে। স্ত্রীকে সন্তানের দায়িত্ব দিয়ে স্বামী মারা গেলে, সে স্ত্রীকে হয়ে উঠতে হয় অসম্ভব রকমের সাহসী আর শক্ত। সন্তানের জন্য মাকে যে করেই হোক, বেঁচে থাকতে হয়। কোনওভাবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করার শর্তে যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধ পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন যুদ্ধ। অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে, বাবার কথামত নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছে। কিন্তু নিজে কী পেল? আমার ভালোবাসাও যে খুব একটা পেয়েছে, এটা বলা যায় না। মাকে ছেড়ে রাজশাহী যাওয়ার পর প্রতিদিনের ফোনটা মা-ই দিত বেশিরভাগ সময়ে। আমার তো মায়ের কথা মনেই পড়ত না, অথচ মায়ের সমস্ত পৃথিবীজুড়ে শুধু আমিই ছিলাম। ভালোবাসার এমন অদ্ভুত রূপও হয়?”
এসব ভাবতে-ভাবতে পুতুলের চোখের কোণায় জল টলমল করতে লাগল। তখুনিই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, বাকি জীবনটা যে করেই হোক, মায়ের সেবা করেই কাটিয়ে দেবে। মা যা-ই করতে বলবে, তা-ই করবে। জীবন দিয়ে হলেও মাকে সুখী করবে। মা জীবনে কখনওই কিছু পায়নি, শুধু দিয়েই গেছে। এটা তো হতে পারে না। এটা ঠিক নয়। একদিন গল্পচ্ছলে মাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মা, বাবা তো বলত, আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। তুমিও কি ওটাই চাইতে? তোমার নিজের কোনও ইচ্ছে ছিল না?” “আমার আর কী ইচ্ছে মা! তোর বাবার ইচ্ছেই ছিল আমার ইচ্ছে।” “তবুও মা! তোমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার নিজের কোনও প্ল্যান ছিল না?” “ছিল একটা, কিন্তু তোর বাবা ওটা চাইতেন না। তাই আমিও আর ওটা বলতাম না। বাদ দে!” “বল না মা, কী সেটা? বল না!” “দেখ্ মা, আমি যখন তোর বাবার ঘরে আসি, তখন আমি ভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে। বিয়ের পর উনি আমাকে নিজের মতন করে পড়াশোনা করান। তোর বাবার স্বপ্ন ছিল, আমি বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হব। সেভাবে করেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম বিয়ের পর থেকেই। আমার নিজের জন্য নয় রে মা, তোর বাবার জন্যই আমি ম্যাজিস্ট্রেট হতে চেয়েছিলাম। বড় ভালমানুষ ছিলেন রে মা তোর বাবা। অমন ভালমানুষের কথা ফেলতে নেই। অনার্স পরীক্ষা দিয়েই অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিই। তুই তখন পেটে। অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু তোর বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারলাম না রে মা। অ্যাডমিনে হল না, কলেজের প্রভাষক হয়ে গেলাম। আমার ভীষণ ইচ্ছে করত, আমি নিজে যা হতে পারিনি, যদি সেটা আমার মেয়ে হত! কিন্তু তোর বাবাকে ছাড়া আর কাউকেই কোনওদিনও সেকথা বলিনি। মা, আমি জানি না কী লেখা আছে তোর কপালে। মানুষটা কিছুই না দেখে কী অভিমানে সবাইকে অমন ফাঁকি দিয়ে চলে গেল!…….” আর পারলেন না। এতটুকু বলেই মা চশমাটা খুলে শাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন।
৯ বছর হয়ে গেল পুতুল বাবার সমাধিমন্দিরে যায় না। এখন তার শুধু একটাই ইচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর মাকে জড়িয়ে ধরে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও বাবার সমাধিমন্দিরের সামনে বসে প্রাণখুলে কাঁদবে; বুকের ভেতরে অনেক চাপাকান্না জমে গেছে। এখন থেকে সে শুধুই মায়ের জন্য বাঁচবে। তাতেও যদি পুরনো পাপের বোঝাটা কিছুটা হলেও হাল্কা হয়…………