একদিন হঠাৎ ইনবক্সে—-
শিওর?
মানে? কী শিওর?
লিমাকে বললে না? ভুলে গেছ? কবে দেখা করতে চাও?
উফফ্! ও আপনাকে এটাও বলে দিয়েছে?
ওরকমই। দেখাটা হচ্ছে কোথায়?
আপনি কী বলছেন এইগুলি?
যা বলছি, তা-ই। বল।
আমি জানি না। আপনি বলুন। দেখুন, আমি কিন্তু দেখতে অত ভাল না, ছবিতে ভাল দেখায়। আর আমার তেমন কোনও গুণটুণও নেই। আপনি হতাশ হবেন। সত্যি বলছি!
বুঝেছি। একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। অ্যাক্সেপ্ট করলে ভাল লাগবে।
সে নাহয় করলাম, কিন্তু আপনি আমার কথার ঠিক মত রিপ্লাই করছেন না কেন?
আমার রিপ্লাই-ই ওটা। আচ্ছা, তোমার এখন কোন ইয়ার চলছে?
থার্ড।
পলিটিকাল সায়েন্সে তো?
হুঁ৷ আপনি তো দেখছি জানেনই। আচ্ছা, আপনি ইংলিশে ছিলেন না?
অনেক দিন আগে। আমাদের অনার্সই ছিল ৮ বছরের। এক সাবজেক্টেই ডাবল অনার্স বলতে পার। হাহাহাহাহা……
আপনি আমার অনেক সিনিয়র।
হ্যাঁ। তো?
এত সিনিয়র কারোর সাথে দেখা করতে ভয় লাগে।
কেন? ধমক দেবো?
যদি দেন?
দিলামই নাহয় একটু! আপত্তি?
কেঁদে ফেলবো একদম! আপনাকে অনেক ভাল লাগে। কিন্তু সামনে যাওয়ার কথা কখনওই ভাবিনি।
ভাবতে পারো। আমি কিছু মনে করব না। কত দিন হল আমাকে লুকিয়ে দেখ, পড়?
অনেক দিন। হায়! এটাও বলেছে লিমা? ওকে আমি সত্যি-সত্যি খুন করে ফেলব!
রিকোয়েস্ট দিয়েছি, এখনও ঝুলে আছে ওটা। কেন?
আমি খুব অবাক হচ্ছি। যিনি কিনা মেয়েদের রিকোয়েস্ট ঝুলিয়ে রাখেন, তিনি আমাকে রিকোয়েস্ট দিচ্ছেন! দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি শুভ্র অমিত! আমার কি খুশিতে কেঁদে ফেলা উচিত? বুঝতে পারছি না।
কিচ্ছু করতে হবে না, অ্যাক্সেপ্ট করলেই হবে আপাতত। এত রাতে ফেসবুকে কী, শুনি? ঘুম নেই?
আছে, কিন্তু আপনি যে আছেন, তাই ওকে আসতে দিচ্ছি না। একঘরে দুই প্রেমিক ভাল লাগে না।
হাহাহাহা…….. সুন্দরীরা সবাই ডাম্ব হয় না দেখছি!
আহ্! একসাথে এতটা নিতে পারব না। কম-কম করে একটু-একটু দিলে ভাল হয়। আর ওরকম করে বললে তো আরামে দুচোখে রাজ্যের ঘুম নামে! আচ্ছা, আপনার জেলা কি বিক্রমপুর?
হ্যাঁ। তোমার?
সিলেট।
হলের জীবনটা কেমন?
ভালই! কেটে যায়।
ঝগড়াটগড়া হয় না তোমাদের মধ্যে?
হয় না আবার! আচ্ছা মশাই, মেয়েরা ঝগড়া করবে না কেন, বলুন তো? ওটা না করলে করবেটা কী? মেয়েরা হয় ঝগড়া করে, নাহয় প্রেম করে। এ দুটো ছাড়া কোনও মেয়েই থাকতে পারে না।
কে বলল?
বলতে হবে না, আমি জানি। আমি মেয়ে তো!
শিওর?
কী শিওর?
ওই যে বললে, তুমি মেয়ে?
মানে কী?
মানে কিছু না। ঠিক আছে, আমি চেক করে নেবো।
ভীষণ দুষ্টু আপনি!
আমি তো বলিনি আমি সুবোধ!
তবুও! ওরকম করে বলতে হয় না, মিস্টার। আপনি কি জানেন আপনাকে কত মেয়ে পছন্দ করে?
সবাই তো ওরকমই বলে শুনি!
শোনাশুনির কিছু নেই, ওটাই সত্যি। আমিও পছন্দ করি। আপনি দেখতে ভাল, এটা কথা নয়। ভাল চাকরি করেন, সেটাও কিছু নয়। ব্যাপার হল, আপনি ভাল লেখেন, সুন্দর করে ভাবেন। দ্যাটস ইট!
দেখতে ভাল? বাহ্ বাহ্! জেনে ভাল লাগল! ওটার জন্য কোনও মার্কস নেই বুঝি?
মেয়েদের কাছে নেই। মেয়েদের চোখ আগে যায় ছেলেদের মাথায়, মুখে নয়।
বুঝলাম। তো ম্যাডাম, কফিটা খাচ্ছি কবে? কোথায়?
আপনি বলুন। আপনি হোস্ট তো!
গেস্ট বলুক!
কিছুতেই না। হোস্ট শুড হ্যাভ দ্যাট প্রিভিলেজ!
ওকে আমি সময়টা বলছি। কালকে সন্ধে ছটায়। এখন তুমি ঠিক কর, কোথায়।
মাথায় কিছু আসছে না। আপনি বড্ডো নাছোড়বান্দা দেখছি! ঠিক আছে, আমি কালকে সকালে টেক্সট দেবো। মশাই, মাথায় ঢুকিয়ে দিলেন তো একটা পোকা! ওটা যে আর বেরুবেই না। ভাল কথা, টেক্সটটা কি ফেসবুকেই দেবো?
না, নাম্বারটা রাখো। ০১৭১২******। তোমারটা এই নাম্বারে টেক্সট কর।
ওকে স্যার! আমি জানাবো সকালে। আপনি সত্যি-সত্যি খাওয়াবেন নাকি?
মিথ্যে-মিথ্যে কীভাবে খাওয়ায়?
না, আসলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! আপনি সেলিব্রিটি মানুষ।
আমি ছেলেবেটি? হাহাহাহা…….. আচ্ছা ভাল কথা, ওটাই ব্যাপার? নাকি, বয়ফ্রেন্ড বকবে?
বকার মতন কেউ থাকলে তো হতই! ওরকম কেউ নেই। ভয় পাবেন না।
হাহাহাহা……ভয় কীসের আবার? তুমি কি ভীতিকর টাইপের কিছু? ভয়ে প্রিয়তম পালিয়েছে?
পালায়নি। আমিই সরে এসেছি।
কীরকম?
সে অনেক কথা। আরেকদিন বলব। আচ্ছা, আপনি প্রেম করেননি?
কেন? অভিজ্ঞ প্রেমিকের অগ্রাধিকার আছেটাছে নাকি?
জ্বি না। প্রেম সবাইই করে। কেউ-কেউ লুকায়, এই আরকি!
লুকানোর মত প্রেম করলে লুকাবেই তো! তোমরা মেয়েরা কি খুব সহজে সব কিছু মেনে নাও নাকি? লুকাবে নাতো কী করবে?
ইয়েস স্যার! আমরা নিই, আপনারা নিতে পারেন না। নিজে ১০টা প্রেম করে এলেও কিছু হয় না, প্রেমিকার একটা পুরনো প্রেমের কথা জানতে পারলে অমনিই ফোঁস করে ওঠেন! এ-ই হল পুরুষমানুষ!
বুঝলাম। এখন সিঙ্গেল তাহলে?
সেটাই তো মনে হয়। সাথের টিকটিকিটা হারিয়ে গেলে মেয়েরা তো সিঙ্গেল হয়ে যায় বলেই জানি!
টিকটিকি, না? হাহাহাহা…….
এছাড়া আর কী? ডাকলেও অস্বস্তি, না ডাকলেও। টিকটিকিই তো! মাথায় বাজতে থাকে টিকটিকটিক………..
ভাল ভাল। আমাকে টিকটিকি বানাবে? নতুন টিকটিকি?
তাই নাকি? আমি তো এখুনিই রাজি!
ওকে। তাহলে কালকে সন্ধে ছটায়। ঠিক আছে?
জানি, ফান করছেন। এটা নিয়েও শুভ্র অমিতের একটা স্ট্যাটাস আসবে। সবাই মজা পাবে। সেখানে জুঁই হয়ে যাবে জেসমিন। সাথে কিছু বাঁশ ফ্রি, কফির বদলে। সারাজীবনই কফি খাওয়ার সময় বাঁশ-বাঁশ গন্ধ আসবে জুঁইয়ের কাপ থেকে। এ-ই তো, না?
বুঝেছি, তুমি আগ্রহী নও। ঠিক আছে, লাগবে না। ভাল থেকো। টা টা।
এই এই এই! কোথায় যাচ্ছেন? প্লিজ দাঁড়ান! বলুন, কোথায় আসতে হবে? আমি আসব।
ওটা তো তোমার ঠিক করার কথা।
ও আচ্ছা, তাইতো। ঠিক আছে, আমি জানাবো।
এবার ঠিক আছে। এত ভাব নাও কেন? যা বলার, সরাসরি বলবে। কথা এত ঘোরালে ভাল লাগে না।
ওকে ডান! অ্যাত্তো রাগ কেন, বাবা? আমি জানাচ্ছি কাল সকালের মধ্যেই।
কয়টায় জানাবে? কয়টার মধ্যে ফিরতে হবে হলে?
হলে ফিরব না। রাতে আপুর বাসায় থেকে যাব। আর সকাল ১০টার আগেই জানাব।
আপুর বাসা কোথায়?
মগবাজার। কেন?
আমি পৌঁছে দেবো, তাই। একটা দায়িত্ব আছে না?
সো কাইন্ড অব ইউ, স্যার! আচ্ছা, একটা কথা বলি যদি রেগে না যান?
বল।
কাল না হয়ে পরশু হলে হয় না? কাল আমার ২টা টিউশনি আছে। তার মধ্যে একজনের মা খুব কড়া টাইপের। একদিন মিস করলেও বড় কথা শোনায়।
হয়। সময়টা কি একই সময়ে?
ইয়েএএএএএ…… আপনি অনেক অনেক ভাল! খুব খুশি হলাম। হ্যাঁ, একই সময়েই। সেদিন হাতে কোনও কাজই রাখব না। সেদিনের সন্ধেটা শুধুই আপনার জন্য।
প্লেস? এখন বলা যাবে?
আপনিই ঠিক করুন না প্লিজ!
পারব না। তুমি বল। ডেটিংয়ে দুজনেরই সমান সমান অধিকার।
আমি না সত্যিই ওভাবে করে চিনি না। একটু অধিকার ছেড়ে দিচ্ছি মশাই। আপনিই বলুন কোথায় আসব। যেখানে খুশি!
প্রথমদিনেই যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া যায় না। প্রথম ডেটিংয়ে যেতে হয় ভদ্র পরিবেশে। প্রথমদিনের ভালোবাসা থাকে শুধুই চোখে। প্রথমদিনের ভালোবাসা ঊর্ধ্বগামী ভালোবাসা। এরপর আস্তেআস্তে ভালোবাসা অধোগামী হয়। ভালোবাসা সর্বদাই নিম্নগামী। কী বুঝলে? হাহাহাহা……….
আপনি আসলেই একটা খারাপ লোক।
হ্যাঁ, ওরকমই। এসো না খারাপ লোকের কাছে। এখনও সময় আছে। ভাবো।
না, আসব। শুভ্র অমিত ডেটিংয়ের অফার নিশ্চয়ই সবাইকে দেয় না! ঠিক আছে, পরশু সন্ধ্যায় বেইলি রোডে ক্যাফে দোভানায়। ডান?
ওকে ডান!
আপনার মূল্যবান সময়ের কিছু আমাকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এত ফর্মাল হলে দেখা করব না।
না না ঠিক আছে, আমি একেবারেই ইনফর্মাল হয়ে যাব। একদম পাক্কা! প্রমিজ!
বি ফ্রি অ্যান্ড ইজি। ওকে?
ওকে। এই যে স্যার! আপনার কালকে কলেজ নেই?
আছে, দুপুরের পর ক্লাস।
তাই বুঝি চুটিয়ে ফ্লার্ট করা হচ্ছে?
বলে কী মেয়েটা?
ঠিকই তো বলে! এত সময় পরপর রিপ্লাই আসছে যে তাহলে?
আসলে আমার এখানে নেট একটু স্লো। তুমি যা ভাবছ, তা নয়।
বুঝি বুঝি, সবই বুঝি। ব্যাপার না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ঠিক করে দেবো। ঘুমিয়ে পড়ুন, রাত সাড়ে ৩টা বাজে। শরীর খারাপ করবে।
ঠিক আছে। তুমিও শুয়ে পড়। শুভ রাত্রি।
কফি খাওয়াবেন পরশু সন্ধে ঠিক ছটায় ক্যাফে দোভানায়। মনে থাকে যেন, স্যার!
থাকবে থাকবে। আসি আজকে।
ওকে বাই। সুইট ড্রিমস্!
এই শোনো! আছ?
হ্যাঁ।
তোমার নাম্বারটা দিলে নাতো!
ওকে দিচ্ছি। আপনার ফোনের ইনবক্স চেক করুন।
হুম পেলাম। সো নাইস অব ইউ।
মাই প্লেজার, স্যার! শুনুন, আপনি কফি না খাইয়ে প্রয়োজনে টং দোকানের চা খাওয়ালেও চলবে। বাট পরশু দেখা হওয়ার প্ল্যানটা ক্যানসেল করে দেবেন না, প্লিজ।
কী যে বল! আই রিয়েলি ওয়ানা ডেট ইউ! ভয়টয় পেয়ো না কিন্তু!
এহহ্! ভয় পাব কেন? ২০১৬’তে এসে মেয়েরা ভয় পায় না, ভয় দেখায়।
হুহ্! জানি জানি, ম্যাডাম খুব সেয়ানা। ব্রেকাপ হয়ে গেছে একবার, এখনও একটা ডেটিং প্লেস ঠিক করতে পারে না। আবার বড়-বড় কথা!
আপনি বুঝি প্রেম করেননি কখনও? নিজে ঠিক করতে পারেন না?
আমিই তো ঠিক করলাম! আর তাছাড়া আমি প্রেমটেম করিনি।
ও রিয়েলি? অবশ্য, সেলিব্রিটিরা প্রেম করবে কেন? ওদের সাথে সবাই প্রেম করবে। সেলিব্রিটিদের প্রেম বলে কিছু নেই, সব কিছুই মিডিয়ার সৃষ্টি! প্রেম যা কিছু আছে, তার সবই হচ্ছে ওদের জন্য অন্যদের প্রেম।
বেশি কথা কম বল! মাথায় বুদ্ধি নাই তোমার। একটা প্রেম করার জায়গার নাম জানে না, তার নাকি আবার প্রেমও ছিল!
দেখুন স্যার, আমরা বেশিরভাগ সময়ই রিকশায় ঘুরতাম। আর সে ছিল দুনিয়ার নিরামিষ! দুএকবার দিয়া বাড়ি আর আশুলিয়ায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। এই তো!
দেখ, আমি কিন্তু দুনিয়ার আমিষ! ডেট করবে কিনা আরেকবার ভেবে নাও।
আপনি সেলিব্রিটি, আপনি নিরামিষ হওয়ার কোনও কারণই নেই। সমস্যা নেই। আমি ভেবেই বলেছি। তো মিস্টার আমিষ মানুষ, ডেটিং প্লেস ঠিক করার দায়িত্বটা আমাকে নেয়ার জন্য অমন পীড়াপীড়ি করছিলেন কেন? ভদ্রতা করে?
ভুল হয়েছে বাবা! তোমাকে একটা ডার্ক রেস্টুরেন্টের নাম বলা দরকার ছিল! তাহলে ঠিক হত।
না গুরুজি, আগেরটাই থাক! এইবার ভয় পেলাম! এত বেশি আমিষ জুঁই সহ্য করতে পারবে না।
লম্বা মানুষের বুদ্ধি কম জানতাম, সহ্য ক্ষমতা কম, এটা তো জানতাম না।
জুঁই লম্বা, এটা অমিত জানল কীভাবে? লিমা বলেছে। রাইট?
ওরকমই। ৫ ফিট সাড়ে ৪ এর মেয়েকে নিয়ে ডেটিংয়ে যাচ্ছি, এটা আগে থেকে না জানলে টেকনিক্যাল সমস্যাও তো হয়ে যেতে পারে!
জ্বি না স্যার, দেড় কম হয়ে গেল!
বাব্বাহ! সাড়ে ৫? ইম্প্রেসিভ!
আপনার কত?
৫ সাড়ে ৭ থেকে বেশি, ৮ বলতে পার।
খারাপ না, চলে!
চলে মানে? বাংলাদেশের ছেলেদের হাইট এর চাইতে বেশি আর কী হবে?
আমি বলিনি আপনার হাইট খারাপ। আমি বলেছি, এটা অ্যাভারেজ, কিংবা একটু বেশি। আমাকে অনেকক্ষণ সময় দিচ্ছেন! ভাবতেও ভাল লাগছে। এই খুশিতে আমার আজকে ঘুম হবে না।
কী যে বল না! তুমি হয়তো জানো না যে তোমাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি।
চাপা, না? শুভ্র অমিতের জুঁইকে চেনার তো কোনও কারণই থাকতে পারে না! আমিই বরং আপনাকে চিনি অনেক দিন ধরেই। আপনার লেখা পড়ি, ভাল লাগে। লাইক দিই না, যদি ওতে আপনার ভাব বেড়ে যায়, তাই। কোনওদিনই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইনি, কারণ জানিই যে অ্যাক্সেপ্টেড হবে না। আমার বান্ধবীদের ঝুলিয়ে রেখেছেন। ওরা তো আপনাকে সহ্যই করতে পারে না!
মেয়েদের ওরকম ঝুলিয়ে রাখাই উচিত। শোনো, আমি কিন্তু তোমাকে সত্যি-সত্যি চিনতাম।
কীভাবে সম্ভব? আমি তো আপনার মতন লিখিটিখি না।
তোমার সাথে তো আমার অনেক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে, ওদের পোস্টে লাইকটাইক দিলে সেটা আমারও চোখে পড়ে। ওরকম করেই কয়েকবার তোমার প্রোফাইলে ঘুরে আসা!
সত্যি সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। কখনও নক করার সাহস হয়নি।
সাহস হয়নি কী আবার? নক না করলে জানব কীকরে? আচ্ছা, এইজন্যই আমার বান্ধবীকে নক করা, না? আমি তো অবাকই হয়েছিলাম আপনার টেক্সট দেখে!
শুধু এটাই না। তোমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছিল, ঘোরারও। সংকোচে কিছুই বলা হয়নি।
ঘোড়ার ডিম! আমি এমন কে যে আমার সাথে শুভ্র অমিতের ঘোরার ইচ্ছে হতে পারে? আমি ভার্সিটির নামকরা স্টুডেন্ট নই, দেখতেও যে একেবারে আহামরি সুন্দরী, সেটাও নয়। কিছু মনে করবেন না, একটু বেশিই বিরক্ত করে ফেলছি মনে হয়।
ঘুরতে হলে কি ওসব লাগেই? তুমি শিওর?
না, তা নয়, তবুও। এত মানুষের ভিড়ে আমাকে খেয়াল করলেন! ভাল! রাতে খেয়েছিলেন তো?
হ্যাঁ। তুমি?
হ্যাঁ। আচ্ছা, আমরা অনেকক্ষণ আগে শুভ রাত্রি বললাম না? ঘড়ির কাঁটা ৫টা ছুঁইছুঁই কিন্তু!
এরকমই হয়! আচ্ছা, আসি। ভাল থেকো।
আপনিও! শুভ ভোর! হিহিহিহি……….
ওদের দেখা হল। জুঁই একটা গাঢ় নীল শাড়ি পরে এসেছিল। হলুদ পাঞ্জাবির অমিতের মোবাইলে সেলফি উঠল, কফি হল, এর আগে পিৎজা। অনেক আড্ডা হল। সন্ধ্যার পর একসাথে রিকশার হুড ফেলে কিছু সময়ের জন্য ঘোরাঘুরি শেষে অমিত জুঁইকে ওর আপুর বাসায় দিয়ে এল। রিকশার অন্ধকারে দুইজোড়া ঠোঁট যখন একসাথে মিশে যাচ্ছিল বারবার, সেই মুহূর্তগুলির জন্য ওরা ধরেই নিয়েছিল, ওদেরকে কেউই খেয়াল করছে না। ভালোবাসার সময়ে দুজন অন্ধ হয়ে যায়; আর শারীরিক প্রেমের সময়ে দুজন ধরে নেয়, আশেপাশের সবাই অন্ধ হয়ে গেছে।
সেদিন রাতের আলাপ।
আপনি ভীষণ দুষ্টু! আমার শরীর এখনও কাঁপছে!
শরীর কাঁপার মতই তো কিছু হয়েছে, তাই না? কাঁপতে দাও।
এমন করলেন কেন, বলবেন?
ভালোবাসা থেকে নয় নিশ্চয়ই! দেখতে ভাল লেগেছে, কাছে টানতে ইচ্ছে করেছে, তাই। আর কোনও কারণ নাই।
আচ্ছা। খাওয়া হয়েছে?
এখনও না।
কখন খাবেন? ১১টা বাজে প্রায়।
খাব খাব। তুমি কিন্তু অনেক অনেক হট। আমার ভাল লেগেছে।
জানি না আমি কী। শুধু এইটুকু জানি, আমি ঠিক নেই। আমি এলোমেলো হয়ে গেছি। আপনার প্রতিটি স্পর্শ আমাকে টানছে এখনও!
ব্যাপার না। ওরকম হয়, হওয়ারই কথা।
এতটা হয়? আমার ভীষণ নেশানেশা লাগছে। এখনও ঘোরের মধ্যে আছি। স্যার, আপনার স্ট্যাটাস দেখলাম। আপনি তো রমণীকূলের রোষানলে পড়ে গেলেন! সবাই আপনাকে একেবারে ধুয়ে ফেলছে।
আমার লেখার গায়ে ময়লা তো, তাই ধুচ্ছে। ব্যাপার না, ধুতে দাও। তা, আজকে কেমন লাগল?
আপনি বোঝেননি? আপনার কেমন লাগল?
লিখে বোঝাতে পারবো না। অনেক বেশিই ভাল। তোমাকে একান্তে পেতে ইচ্ছে করছিল খুউব!! আই রিয়েলি লাইকড ইট!
আপনি পুরুষমানুষ। স্পর্শ পর্যন্তই সবকিছু! আমি তো মেয়ে। আমার দহন শুরু হয় স্পর্শের পরে; শরীরের, মনের। আমি কী করব? আজকে এতকিছু হয়ে যাবে, আমি ভাবতেও পারিনি।
নেভার রিগ্রেট! যা হয়েছে, হয়েছে।
রিগ্রেট করছি না। তোমাকে আমার অনেক ভাল লেগেছে। তুমি অনেক কেয়ারিং, অ্যাডোরেবল। কিন্তু একটা কথা ভাবছি।
কী সেটা?
তোমার আমাকে শুধু হটই লাগল, ভাল লাগেনি, তাই না?
সবকিছু মিলিয়ে ভাল লেগেছে। তোমাকে অনেক-অনেক মিস করছি!
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি! একটা কথা বলি?
বল।
তোমার শরীরের ঘ্রাণটা অনেক নেশা জাগায়!
তোমারটাও! রীতিমত ইনটক্সিকেটিং!!
শোনো না, কালকে গাজীপুরে চলো, নুহাশ পল্লীতে। যাবে?
কী করবে ওখানে?
ঘুরব। তোমাকে অনেক ভালোবাসব।
শুধু ঘোরা তো? আর কিছু নয় তো?
আগে যাই।
না সোনা। জানো, আমার না অনেক ভয় লাগে। একবার ধাক্কা খেয়েছি তো, তাই।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যা-ই চাইবে, তা-ই হবে।
কখন ফিরব?
সন্ধ্যায়। তুমি আপুর বাসায় থাকবে। ঠিক আছে?
কিন্তু কালকে ডিপার্টমেন্ট থেকে কক্সবাজারে স্টাডিট্যুরে যাচ্ছে। ৪ দিনের ট্যুর। আমি টাকাও দিয়ে ফেলেছি অলরেডি। কী করব বুঝতে পারছি না। তোমার কথা শুনে আমার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। কালকে তোমার ক্লাস নেই?
আছে, যাব না। বলব, অসুস্থ। সিক-লিভ নেবো।
ওরে বাবা! আমার জন্য অফিস মিস?
আমার মনে হচ্ছে, তোমার জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি সোনা। আজকে অনেক ভাল লেগেছে। তোমার লাগেনি?
অনেক ভাল লেগেছে। তাইতো ভয় হচ্ছে। পারব তো নিজেকে সামলাতে? আমি আমাকে ছাড়া আর কাউকেই ভয় করি না। জানো, আজকে তোমাকে ছাড়তেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু এতকিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
আমারও ইচ্ছে করছিল না। আর ওই চুমুগুলি তোমার জন্য অপ্রস্তুত গিফট! হাহাহাহা……….
সুন্দর একটা সন্ধ্যা দিয়েছ আমাকে। আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।
ছেড়ো না। কালকে চলো তাহলে।
ভাবছি, ফ্রেন্ডরা কী বলবে! আমি যাব বলে কয়েকজন রেজিস্ট্রেশন করেছে।
কী আর বলবে? তোমার তো সমস্যা থাকতেই পারে, তাই না?
হুম, তা পারে। কিন্তু……..
আচ্ছা, তোমার ইচ্ছে করলে, যাও।
রাগ কর কেন সোনা? আচ্ছা, যাব। ওদেরকে বানিয়েটানিয়ে কিছু একটা বলতে হবে।
বলে দাও। আচ্ছা, তোমার স্কাইপ আছে?
নেই। কেন?
একটা অ্যাকাউন্ট খুলো তো! তোমাকে মাঝেমধ্যে দেখব।
আমার লজ্জা করে।
ইসস্ লজ্জা! এত লজ্জা কীসের? ভেতরে যা আছে, বলতে পার না? আজকে আমি অ্যাপ্রোচ না করলে তো কিছুই হত না। তুমি তোমার চাহিদার কথা বলতে নিজ থেকে?
অমিত, চাহিদার কথা বোলো না। শব্দটা বড় বাজে শোনায়। তোমাদের জন্য যা চাহিদা, আমাদের জন্য সেটাই ভালোবাসা। তোমরা এটা কোনওদিনই বুঝলে না। একটা জিনিস দিচ্ছি। ওয়েট।
…………এটা কখন তোলা?
এই মাত্র তুললাম। আমার সাজুগুজু ছাড়া পিকচার। কেমন লাগছে?
অনেক অনেক সুন্দর! একটু পোড়াও না।
কীভাবে?
তোমার সেলফির আগুনে। আমি পুড়তে চাই।
পারব না! আপু বকছে, রুমের লাইট জ্বালিয়ে রেখেছি, তাই। ঘুমিয়ে পড়তে বলছে।
এমন কর কেন? দাও প্লিজ! নাহলে কিন্তু খুব রাগ করব!
আচ্ছা, কর। দেখি তো রেগে গেলে তোমাকে কেমন লাগে! তোমাকে ফোন দিচ্ছি, ধরো।
(অমিত ফোনে আরেকটা মেয়ের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ল হঠাৎ।) ………….কোথায় তুমি? ওয়েটিং কেন? কই?
সরি সরি! আমার এক বন্ধু ফোন করেছিল আমেরিকা থেকে। ওখানে তো এখন দুপুর, তাই ফোন করে একটা জরুরি কথা সারল।
ও আচ্ছা, তাই বল। আমি তো ভাবলাম, কার সাথে টাংকি মারছ!
ছিঃ জুঁই! আমি ওরকম না। ওরকম হলে কয়েক ডজন গার্লফ্রেন্ড থাকত আমার!
কী জানি! আমার তো তোমাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে!
করতে পার। একেবারে শতভাগ বিশ্বাস করতে পার!
ভেবেছিলাম, আর কোনওদিনও কোনও ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারব না। কিন্তু তোমাকে বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। ভয় হয়, যদি হারিয়ে ফেলি। এত অল্প সময়ে এত প্রেম জাগল! অল্প সময়ের প্রেমের স্থায়িত্বও অল্প। যা ঝড়ের গতিতে আসে, তা সামান্য বাতাসেই উড়ে যায়। তাই আরও বেশি ভয় হয়। আমি তো তোমাকে অনেক দিন ধরেই পছন্দ করি। আমারটা স্বাভাবিক। কিন্তু তোমারটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে কোনওদিনও কষ্ট দিয়ো না, কেমন? আমি অনেক বেশি আবেগি। একেবারেই শেষ হয়ে যাব ওরকম কিছু হলে।
হবে না সোনা, হবে না। আমিও যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি!
একদিনে ভালোবাসা হয় না, সোনা! ওটা স্রেফ ইনফ্যাচুয়েশন!
আমি কোনও ব্যাখ্যা শুনতে চাই না। প্রথম দেখাতেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি!
ইসস!! ঢং!! এই জানো, আমি যাচ্ছি না বলে আমার বান্ধবীরাও কেউ যাচ্ছে না। অনেক মন খারাপ করেছে ওরা। একটু আগে মেসেঞ্জারে বলল। ওরা রাগ করে বসে আছে। কী এক জ্বালা! আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না।
কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে না? নুহাশ পল্লীতে? নাকি, ট্যুরে?
ট্যুরে।
আচ্ছা। তার মানে, আমরা যাচ্ছি কালকে সকালে?
পরশু যাই? প্লিজ!
না, কালকেই! কেন কালকে কী সমস্যা?
আমি একটু ভাবতে চাচ্ছি।
তুমি আমাকে ভালোবাসো না সোনা, আমি বুঝেছি। ঠিক আছে। সরি ফর এভ্রিথিং!
প্লিজ পরশু চলো না সোনা। তোমাকে অনেক ভালোবাসি, সত্যি বলছি!
পরশু আমাকে যশোরে যেতে হবে কলেজের একটা কাজে। পরশু পারব না। কালকেই চলো লক্ষ্মীটি!
গিয়ে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসা যাবে তো?
নিশ্চয়ই! আমি তাহলে কালকের প্ল্যানটা গুছিয়ে ফেলি। ওকে?
ওকে। কালকে আমরা কয়টার দিকে যাব?
এই ধর ৭টা। পারবে না?
ওকে, ঠিক আছে। কিন্তু আপুকে কী বলব?
আমি কী জানি? বুদ্ধি বের কর।
আমি বের করব, না? তুমি আছ কী করতে?
আচ্ছা ঠিক আছে। বলবে, জরুরি কাজে সকাল-সকাল ভার্সিটি যেতে হচ্ছে।
হ্যাঁ, তা বলা যায়। কিন্তু একটু আড়চোখে তাকাবে। আমি অত সকাল-সকাল ক্যাম্পাসে যাব, এটাই বিশ্বাস করতে চাইবে না।
তাহলে? আর কোনও ওয়ে আছে? কোনওভাবেই ধরা পড়া যাবে না, সোনা।
যদি ওখানে গিয়ে ধরা পড়ে যাই? তোমার তো আর ফলোয়ারের অভাব নেই।
কিছুতেই পড়ব না। ওখানে খোলার দিনে কেউ যাবে না।
এত দূরে একা-একা আমি কখনওই যাইনি। একা যাওয়া কি ঠিক হবে?
আরে বাবা, একা তো আর যাচ্ছ না, আমি আছি সাথে। আমি কি তোমার পর?
সেটা বলিনি। তবুও……..
ওকে যেতে হবে না।
আচ্ছা, না যাই!
মানে, আমি অলরেডি ছুটি নিয়ে ফেলেছি ফোনে। ঠিক আছে, লাগবে না, যেতে হবে না। ভাল থেকো। বাই।
ওমা ওমা! আমি কী করলাম? সব কথা তো তুমিই বলছ! বেশি ঢং বাবুটার, না? বাচ্চাদের মত রাগ করে খালি। আমি কী এমন বলেছি? আমি যাবই যাব। আমাকে নিয়ে যেতে হবে। হুঁউউউ!
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন ঘুমিয়ে পড় তো চুপচাপ। খেয়েছ রাতে?
না, খাব। একটা কথা বলি?
বল।
‘শেষ পর্যন্ত’ মুভিতে ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ গানটাতে বিশ্বজিতকে দেখে অনেকদিন আগে ক্রাশ খেয়েছিলাম। তোমাকে এক সাইড থেকে দেখতে কিছুটা ওর মতন লাগে। তেল মারছি না, সত্যি-সত্যি বলছি।
ইসস!! এই শোনো না, আমাকে কালকে ভোরে ডেকে দিতে পারবে?
আচ্ছা, দেবো। আচ্ছা, তুমি আমাকে ভালোবাসো তো?
হ্যাঁ বাসি। কেন?
আমার সাথে ডেটিং করছ আর ফেসবুকে এখনও সিঙ্গেল? হবে না হবে না। ওটা চেঞ্জ কর। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করে দাও।
হাহাহাহা…… আচ্ছা আচ্ছা, দেবো। এখন ঘুমিয়ে পড় বাবু। উম্মাহহ্!!
শুভ রাত্রি।
পরদিন ওরা নুহাশ পল্লীতে ঘুরল, আশেপাশের আরও দুএকটি রিসোর্টেও গেল। অমিত হঠাৎ দেখতে পেল, ওর এক এক্স-গার্লফ্রেন্ড কাছেই একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ভূত দেখার মতন চমকে উঠে ভয় পেয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার সময়েই সে দেখতে পেল, মেয়েটি এক ছেলের হাত ধরে ওখান থেকে খুব দ্রুত অন্য জায়গায় চলে গেল। আহা! পুরনো প্রেম যে ভয়টা পাইয়ে দেয়, নতুন প্রেম সেটা থেকে কী সুন্দর করে বাঁচিয়ে দেয়! সবই প্রেমের মাহাত্ম্য! সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলের পর ওরা দুজন মিলে একটা ডার্ক রেস্টুরেন্টে গেল। সুইটহার্ট ইন। অমিতের পরিচিত রেস্টুরেন্ট। ওয়েটাররা ওকে প্রতিবারই দেখে নতুন কাস্টমার হিসেবে দেখার নিপুণ অভিনয় করে যায়। এটাই ওখানকার অলিখিত নিয়ম। অবশ্য বকশিসের বেলায় ও একটু উদারই থাকে। এই রেস্টুরেন্টে আসাই বলে দিল, ওরা বিয়ে করবে না। এই ডার্ক রেস্টুরেন্টটিতে গত ৫ বছরে যত ‘অবিবাহিত’ কাপল এসেছে, তার ৫টাও বোধহয় শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেনি। ডার্ক রেস্টুরেন্টে যাওয়ার সাথে বিয়ের সম্পর্কটা বিপরীতমুখী। যে অন্ধকারের সূচনা বিয়ের আগেই, সে অন্ধকার বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় কম।
একদিন দুপুরে।
মিসিং ইউ বাবু।
মিসিং ইউ টু।
কোথায় তুমি?
টিচার্স রুমে। তুমি কই?
আমি হলে যাচ্ছি। ক্লাস শেষ। রুমে গিয়ে ফোন দিই?
আচ্ছা দাও, বাবুসোনা।
…………………………
হ্যালো! ক্লাস নেই আজকে?
না, শেষ। রুমে পৌঁছে গেছ? একটা সেলফি দাও তো।
আমি ড্রেস ছাড়তে ছাড়তে কথা বলছি। পরে দেবো।
এখনই দাও। একটা কিস করি।
আচ্ছা, তোমার কি ওসব ছাড়া আর কোনও কথাই বলতে ইচ্ছে করে না?
ঢং, না? যাও লাগবে না।
না না, আমি সিরিয়াসলিই বলছি। আমার মনে হয়, আমরা যা করছি, সেটা ঠিক নয়। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই, শুধুই প্রেম আছে, তাও অনেকটাই শারীরিক।
প্রেম তো শারীরিকই হয়।
হয় শুধু ছেলেদের বেলায়। কিন্তু আমি যে মেয়ে! আমার একটা মনও আছে।
আমার নেই, না? তোমাকে ভালোবাসি বলে যা মুখে আসছে, তা-ই শুনিয়ে যাচ্ছ?
প্লিজ অমিত, ভুল বুঝো না। আমার ইদানিং কী জানি হয়েছে। কিছুই ভাল লাগে না। আমার কিছু ভাল লাগে না—এটাই একটা রোগ, ‘ভাল লাগে না’ রোগ। এমনকি তুমি আদর কর, সেটাও ভাল লাগে না। তুমি রাগ করে ফেল, তাই অভিনয় করি ভাললাগার।
এই রোগটার একমাত্র ওষুধ হচ্ছে সেক্স। করে দেখ, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বিয়ের আগে কিছুতেই ওটা পর্যন্ত যাব না, মরে গেলেও না।
তুমি না আমায় ভালোবাসো? তবে এই তোমার ভালোবাসা? বিশ্বাসই কর না আমাকে, আবার বল, ভালোবাসি!
বিশ্বাসের কথা নয় অমিত, এটা আমার সংস্কার। আমি কিছু সংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। হয়তো আমি ব্যাকডেটেড। হোক, তবুও!
ঠিক আছে, তবে তা-ই হোক। তবে আমি এখনও পুরোপুরি সেটেল্ড না। চাকরি হয়েছে মাত্র ৪ বছর হল। তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারব না। আমরা কোর্ট ম্যারেজ করব। পরে একসময় বাসায় বুঝিয়েশুনিয়ে তোমাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা করব। রাজি?
আচ্ছা ঠিক আছে। কালকেই আমরা বিয়ে করব।
ওকে। কাল সকাল ১১টায় টিএসসি’তে এসো।
ওকে।
অমিত কলেজে পড়ায়। ভাল পড়ায় বলে কলেজে ওর একটা সুনাম এর মধ্যেই হয়ে গেছে। ফেসবুকে ভাল-ভাল কথা লিখে, কয়েক হাজার ফলোয়ার আছে। দেখতে ভাল আর সুন্দর করে কথা বলতে পারে বলে মেয়েরা খুব সহজেই আকৃষ্ট হয় অমিতের দিকে। কলেজের শিক্ষকদের একটা মস্ত বড় সুবিধে আছে। অমিতের মতন ‘বড় হৃদয়ের’ শিক্ষকদের কোনও কলেজই কখনও খালিহাতে ফেরায় না। বড় হৃদয়, বড় জায়গা, বেশি প্রেয়সী। কলেজের শিক্ষকদের বয়স বাড়ে, কিন্তু ওদের ছাত্রীদের বয়স কখনওই বাড়ে না। শিক্ষকদের বয়স ৪০ ছাড়ায়, ৫০ পেরোয়, ছাত্রীদের বয়স কিন্তু ওই ১৬ থেকে ২৪ এর মধ্যেই। অনেক অপশন, অনেক সুযোগ। অল্প বয়সি মেয়েদের মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধিও কম থাকে, সাথে বোনাস হিসেবে একটুআধটু ছিটও থাকে। আর সুন্দরী হলে তো কথাই নেই! সুন্দরীরা উল্টাপাল্টা ভুল করবেই করবে। হয়তো এটাই ওদের রূপের অন্যতম পূর্বশর্ত। যে মেয়ের মাথাখারাপ নয়, সে মেয়ে সুন্দরী হতে যাবে কোন দুঃখে? সুন্দরীরা ওয়েট করে বসেই থাকে কখন ওদের জন্য কেউ ফাঁদ পাতবে, আর ওরা মহানন্দে সে ফাঁদে ধরা দেবে। যে ছেলেরা ফাঁদ পাততে জানে না, সুন্দরীরা ওদেরকে পছন্দই করে না। ওদেরকে হাতের নাগালে রাখার টেকনিকগুলি জানলে শুভ্র অমিতরা খুব একটা নিরাশ হয় না। কলেজে পড়ার সময় বাবা-মা’কে বানিয়ে-বানিয়ে মিথ্যে বলে, কিংবা লোকাল গার্ডিয়ানদের কিছু একটা বুঝিয়ে নিরুদ্দেশ ডেটিং চালিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু নয়। ভবিষ্যতের কথা ভাববার বয়স কলেজের মেয়েদের বয়স না। এ বয়স সবকিছুতেই রং খুঁজে ফেরার বয়স। এই রঙের খোঁজ যে পুরুষের কাছে যত বেশি, সে তত বড় প্রেমিক। এ কাজে অমিতের নৈপুণ্য একদিনের নয়।
ওদিকে অমিতকে বিয়ে করে জুঁইয়ের স্বস্তির সীমা নেই। যে কাজটি করতে আগে অপরাধবোধ কাজ করত বলে সে করতে পারত না, এখন সেই কাজটি করার বৈধতা পেয়ে নিজেকে হাল্কা ভাবতে শুরু করেছে। ভার্সিটি লাইফে যে কত ছেলেমেয়ে গোপনে বিয়ে করে, সে খোঁজ রাখা সত্যিই অসম্ভব। এসব বিয়ের কথা সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়ার ভয়ে মেয়েরা অনেক কষ্টে হলেও চেপে রাখে। বাইরের লোক তো দূরের কথা, ঘরের মানুষও কোনওদিনই জানতে পারে না। অমিতরা তাই সবসময়ই নিরাপদ। জুঁই এখন শহরে টিউশনি করতে এসে অমিতের মেসে থেকে যায়। যেদিন-যেদিন ও থাকে না, সেদিন-সেদিন প্রায়ই কেউ না কেউ অমিতের সাথে থাকে। অমিত যে বিবাহিত, একথা অমিতের ‘স্ত্রী’ জুঁই ছাড়া আর কেউই জানত না। বিবাহিত পুরুষের উপর অনেক মেয়েই ক্রাশ খেতে অস্বস্তিবোধ করে। তাই অমিত এভারব্যাচেলর ইমেজ নিয়েই থাকতে চায়। তাছাড়া বিয়ের ব্যাপারটা সবাই জেনে গেলে ওতে অমিতের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে, ব্যাচের স্টুডেন্ট কমে যেতে পারে, গার্লফ্রেন্ড কমে যেতে পারে। অমিতরা সর্বকালেই এভারগ্রিন।
“জানো, আমি তোমাকে শুধু একটিবার সামনে থেকে দেখতে চেয়েছিলাম, সেকথাই বলেছিলাম লিমাকে। কী চাইলাম, আর কী হয়ে গেল! তুমি অনেক ভাল একটা ছেলে সব দিক দিয়েই। তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে, ভালোও বেসে ফেলেছি। তাই তোমাকে ‘না’ বলতে ভয় পাই। যদি দূরে সরে যাও! আমি আমার এক্স-বয়ফ্রেন্ডের সাথেও ওটা করিনি। ওটা আমি করতেই পারবো না বিয়ের আগে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি, মৃত্যু পর্যন্ত তোমার পাশে থেকে যেতে রাজি আছি, কিন্তু বিয়ের আগে ওটা কিছুতেই নয়। আমি একবার ভালোবেসে ফেললে আর কোনওভাবেই সরে আসতে পারি না। অনেক কষ্ট হয়। আমি জানি, ছেলেরা ওটা একবার পেয়ে গেলে মেয়েদের ইউজ্ড টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আমি বলছি না, তুমিও ওরকম। দেখ, আমাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত স্ট্রং কোনও কমিটমেন্ট নেই, ভালোবাসার বন্ধন নেই। আমি সারাদিন তোমার হাত ধরে ঘুরতে পারব, কিন্তু তোমার সাথে ওটা করতে পারব না। আমাকে ভুল বুঝো না। আমি সেই মানুষটিকেই সবকিছু সমর্পণ করে দেবো, যে মানুষটি আমাকে ভালোবাসবে, সারাজীবন আমার পাশে থাকবে। জানি, এসব পড়ে তোমার ভীষণ মেজাজখারাপ হচ্ছে, আমাকে খুব বকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি আর ১০টা আধুনিকাদের মত হলে এত কষ্ট করে শহরে এসে ৪টা টিউশনি করতে হত না, ছোটবেলায় ঘর ছেড়েছি যখন তখনই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারতাম। তোমাকে একটা কথা বলার সুযোগ হয়নি। বলছি, শোনো। আমি যখন খুব ছোট, তখন আমার মা’কে আমার বাবা যৌতুকের জন্য খুন করেছিলেন। পাড়ায় সবাই জানত, ওটা সুইসাইড কেইস। এরপর বাবা আরেকটা বিয়ে করে। সৎমায়ের সংসার ছিল পুরোপুরিই সৎমায়ের সংসার, সেখানে বাবার ভূমিকা ছিল অতি গৌণ। আমি বাবার ঘরে বড় হইনি, আমি বড় হয়েছি অন্য মায়ের ঘরে। আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমাকে কেউ কোনওদিনই আদর করে এক কাপ দুধ খেতে দেয়নি। নতুন মায়ের ছেলেমেয়েরা দুধ-ডিম-মাংস সবই পেয়েছে, আমি কোনওদিনই পাইনি। যে তরকারিটা বেঁচে যেত, সেটা দিয়েই আমি ভাত খেয়ে নিতাম। আমি কোল্ড ড্রিংকস খুব পছন্দ করতাম। ক্লাস এইটে ওঠার আগ পর্যন্ত আমি কখনওই পুরো এক বোতল কোল্ড ড্রিংকস খেতে পারিনি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের কাজগুলি গুছিয়ে দিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরে আবারও কাপড়ধোয়া থেকে শুরু করে সব কাজই করতাম। ঘরের কাজে কোনও ভুল হলে আমার মৃত মায়ের নাম ধরে গালাগালি শুনতে হত। সে ভয়ে আমি খুবই সতর্কভাবে কাজ করার চেষ্টা করতাম। কখনও অসাবধানতায় একটা চীনেমাটির কাপ ভেঙে ফেললেও নতুন মা আঙুলের ওপরে বেত দিয়ে খুব মারতেন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আমি বাবাকে আর কোনওদিনই চিনতে পারিনি। আমার জামাকাপড় দিয়ে আমার ওইঘরের ভাইবোনরা টেবিলচেয়ার মুছত। আমাকে সবসময়ই খাওয়ার খোঁটা শুনতে হত। আমার গায়ে হাততোলা ছিল আমাদের বাড়িতে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমি ক্লাস এইটে ওঠার পর আমার জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ আসে। বাবা মনস্থির করে ফেললেন, উনি আমাকে বিদেয় করে আপদমুক্ত হবেন। ছেলের বাবা আমার বাবার কাছ থেকে লাখখানেক টাকা পেতেন। আমি ওই ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হলে সে টাকাটা আর ফেরত দিতে হবে না। আমার জীবনের দাম ছিল অতই কম! বিয়েতে রাজি হলাম না, পড়াশোনা করতে চাইলাম। বাবা আমাকে বেত আর বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে-পিটিয়ে গায়ে কালকাল দাগ করে ফেলেছিলেন। মার খেয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে নতুন মা এসে আমার চুলের মুঠি ধরে ইচ্ছে মত চড়থাপ্পড় দিলেন। সারা শরীরের ব্যথায় ১ সপ্তাহ নড়তে পারলাম না। এদিকে বাবা রাগ করে আমার পড়াশোনার সমস্ত খরচ বন্ধ করে দিলেন। আমি বাধ্য হয়ে টিউশনি করা শুরু করলাম। বাড়ি থেকে একটা পয়সাও নিতাম না। উল্টো বাড়ির জন্য এটাসেটা কিনে নিয়ে আসতাম। আমার ওই ছোট ভাইবোনদের আইসক্রিম চকোলেট কিনে দিতাম। তাতেও কোনওদিনও বাড়ির কারও কাছ থেকে একটাও দয়াভরা কথা শুনিনি। আমি এভাবে করেই বাপের ঘরে দাসীর মতন বড় হয়েছি। আমার জীবনের সকল অর্জন কিংবা ব্যর্থতা আমার একার। আমার সব ভাল কিছুর জন্য যেমনি আমি দায়ী, তেমনি সব মন্দ কিছুর জন্যও। আমি সবসময়ই অতিসাধারণ ছিলাম, আছি, থাকব। আমি বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই। আমি আধুনিক জীবনদর্শনে অভ্যস্ত আধুনিকা হতে পারব না, অমিত। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। মনে-মনে অনেক গালি দিয়ো, তবুও ওটা করতে বোলো না। আমি সত্যিই পারব না। আমাকে যে শাস্তি দিতে চাও, দাও। বেদনাও মধুর হয়ে যাবে তুমি দিলে। আমার কাছে ভালোবাসার যন্ত্রণাও পবিত্র ও স্বর্গীয়। আমরা পরস্পরকে কতটুকুই বা চিনি, বলো! তুমি যদি কাছে এসে আবারও দূরে সরে যাও, তবে আমি অনেক অনেক অনেক বেশি কষ্ট পাব। আমি তোমার সব কিছুকেই ভালোবাসি—তোমার ছেলেমানুষি, তোমার রাগ, তোমার অভিমান, তোমার স্পর্শ, তোমার উপস্থিতি, তোমার অনুপস্থিতি। আমি তোমাকে অনুভব করতে শিখে গেছি। আমি জানি, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ যে আমি অনর্থকই কথা বাড়াচ্ছি। আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ। আমার এই অপারগতাকে ক্ষমা কর। আমার মা’কে যখন আমার বাবা খুন করেন, তখন আমার মায়ের বয়স ২১। আমি তো ২১ অলরেডি পার করে ফেলেছি। তাই আমি এখন থেকে যে কয়টা বছর বাড়তি বাঁচব, তার পুরোটাই আমার জন্য বোনাস! আমার আর জীবনের কাছ থেকে কিছুই চাওয়াপাওয়ার নেই। বেঁচে যে আছি, এই তো বেশি! আমার ভাগ্যটাও তো আমার মায়ের মতই হতে পারত। আমি কিছুই চাই না অমিত, শুধু তুমি পাশে থেকো।”
এই চিঠিটা অনেক আগে অমিতের পাওয়ার কথা ছিল। ডেটিংয়ের দিনে অমিত সবসময়ই দেরি করে আসত। দেখা করার আগে জুঁইকে অমিত রাস্তায় অপেক্ষা করিয়ে রাখত। অমিতের সাথে দেখা করার জন্য একটা টিউশনি ক্যানসেল করে যতটা সময় ওয়েট করতে হত জুঁইকে, ওইসময়ে খুব সহজেই স্টুডেন্টটাকে পড়িয়ে আসা যেত। অমিতের সাথে রিলেশন হওয়ার পর থেকে জুঁই স্টুডেন্ট পড়ানোর পুরো সময়টাতেই মেসেঞ্জারে, ভাইবারে, ইমোতে, হোয়াটসঅ্যাপে থাকত। স্টুডেন্টের গার্ডিয়ান ব্যাপারটা দেখেও বেশিরভাগ সময় কিছুই বলতেন না, তবে মাঝেমাঝে সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকলে জুঁই কিছুটা সংকোচে পড়ে যেত। শক্ত করে জুঁইকে কিছু বলতে না পারার পেছনেও কখনও-কখনও কিছু কারণ ছিল। যেমন একটা টিউশনিতে স্টুডেন্টের মা হাজব্যান্ডের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে জুঁইকে দিতেন সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এটা জুঁই জানত। স্টুডেন্টের মা রিকোয়েস্ট করেছিলেন যাতে এ কথা কিছুতেই ওর বাবা জানতে না পারে। সে টাকায় উনি রূপচর্চা করতেন, ফেসবুক ছেলেবন্ধুর সাথে ঘুরতে যেতেন। সে বাসায় জুঁইয়ের স্বাধীনতা ছিল অবারিত। তবে অন্য একটি বাসায় স্টুডেন্টের মা জুঁইকে আকারে-ইঙ্গিতে নানান কথা শোনাতেন। অমিতের জন্য সবকিছুকেই মেনে নিতে রাজি ছিল জুঁই, রাস্তায় প্রতীক্ষা করে থাকা তো খুব ছোট একটা ব্যাপার। প্রকৃত ঘটনা ছিল এই, অমিত অন্য মেয়ের সাথে দেখা করে জুঁইয়ের সাথে দেখা করতে আসতে-আসতে দেরি করে ফেলত। এরকম কোনও একটা বিকেলে একটা কফিশপে অমিতের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে ওপরের চিঠিটা লিখে ফেলেছিল জুঁই। সে চিঠি ভ্যানিটি ব্যাগেই রয়ে গেছে। অমিতকে দেয়ার সাহস হয়নি ওর। যদি ওটা পড়ে আবার রাগটাগ করে ফেলে!
ওরা যখন দেখা করত, তখন অমিত যা চাইত, যেভাবে করে চাইত, সেভাবে সবকিছু দিতে পারত না জুঁই। এটা নিয়ে ওদের মধ্যে প্রায়ই মনোমালিন্য চলত। অমিতকে সেসময় কোনও কিছু বলেই বোঝানো যেত না। অমিত বলত, “আমি যা চাই, তা যদি তোমার কাছ থেকে না পাই, তবে আমি তো আর বসে থাকব না। আমি আমার চাহিদাটা ঠিকই অন্য কারও কাছ থেকে পূরণ করে নেবো, প্রয়োজনে ব্রথেলে যাব। আমি অত ভালমানুষ নই। আমি অতিখারাপ একজন মানুষ।” জুঁই এসব শুনে কোনও কথাই বলত না। আর ১০টা অবোধ বাঙালি প্রেমিকার মতই ওর বিশ্বাস, “অমিত কিছুতেই ওরকম নয়। মুখে যা-ই বলুক, ও কখনওই ওরকম কিছু করতে পারে না। অমিত যতই খারাপ হোক না কেন, এই খারাপ মানুষটিকেই আমার পছন্দ। কী-ই বা করার আছে! ভালো তো বেসেই ফেলেছি!” পৃথিবীর প্রত্যেকটি নারীই কারও না কারও কাছে নিতান্তই বালিকা। অমিত অনেক দিনের অভিজ্ঞতায় খুব ভালভাবেই জানে, কীভাবে করে নারীর মধ্যে লুকিয়েথাকা কিশোরীপ্রেমের সত্তাটিকে জাগিয়ে তুলতে হয়। সেই কিশোরীপ্রেমের সত্তাটির হয় প্রেম লাগে, নতুবা বিরহ। এর যেকোনওটি ছাড়া সত্তাটি বাঁচতে পারে না যেন! বিরহের ভয় দেখালে সেই সত্তাটি নিজের অবচেতনেই প্রেমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে; হোক সেটি শারীরিক প্রেম কিংবা অশারীরিক। ডেটিংয়ের সময় অমিত কোনও কৌশলেই জুঁইকে কৌমার্যভঙ্গের ব্যাপারে রাজি করাতে পারেনি। ডার্ক রেস্টুরেন্টের অন্ধকারের আলোয় জুঁই কখনওই নিজেকে পুরোপুরি বিলিয়ে দেয়নি। অনেক কায়দাকানুন করেও অমিতের মেসে জুঁইকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এটা নিয়ে ওর মধ্যে প্রবল জেদ কাজ করত। জুঁইকে আরও বেশি করে কাছে টানতে চাইত ওর ভেতরের পশুত্বটি। যা ছিল অমিতের জন্য জেদ, তা ছিল জুঁইয়ের জন্য ভালোবাসা। ওটা পাওয়ার জন্য অমিত যেকোনও কিছু করতেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। সেখানে বিয়ে ছিল খুবই ছোট একটা ব্যাপার। ভার্সিটি লাইফের গোপন বিয়ে আর ছোটবেলার পুতুলের বিয়ের মধ্যে ভাবগত কোনও পার্থক্যই নেই। অমিতের জুঁইকে বিয়ে করার পুরো কারণটাই ছিল মূলত শারীরিক।
জুঁইয়ের ছবিতে অমিত কেন লাইক দেয়নি, এটা জিজ্ঞেস করলে অমিত বলত, “আরে বাবা, আমি তো সারাদিনই তোমার প্রোফাইলেই পড়ে থাকি। তোমার সব পোস্টই দেখি। কিন্তু তাই বলে লাইক দিয়ে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে নাকি? ওটা তো একটা ভুয়া লোকদেখানো জিনিস। ফেসবুকের লাইক মানে পছন্দ নয়, ফেসবুকের লাইক হল জাস্ট একটা বাটন! এটা বোঝো না, বোকা মেয়ে?” পছন্দের মানুষটি আদরেই হোক আর অনাদরেই হোক, ‘বোকা মেয়ে’ বলে ডাকলে পৃথিবীর সব মেয়েই আরও বোকা হয়ে নিজেকে মেলে ধরতে ভালোবাসে। বালিকাসুলভ সারল্য এসে ভর করে সমস্ত শরীরে, মনে। জুঁই ভাবত, “তাই তো! ভালোবাসা তো দেখানেপনার কিছু নয়।” আসলে অমিত জুঁইয়ের প্রোফাইলে ঢুকতই না। যে মেয়ে জীবনেই আছে, ফেসবুকেও সে মেয়ের সাথে থাকার মানে হল সময়নষ্ট করা। “অনলাইনে কী কর?” এ প্রশ্নের উত্তরে অমিত সবসময়ই বলে এসেছে, “লেখালেখি করি, পড়াশোনা করি।” মেয়েরা প্রিয় মানুষটির সব অজুহাতই বিশ্বাস করার অসীম প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। যে পুরুষ বিশ্বাসযোগ্যভাবে অজুহাত দাঁড় করাতে পারে না, কিংবা কোনও অজুহাতকে বিশ্বাসযোগ্য করতে পারে না, বুঝতে হবে সে কখনও প্রেম করেনি। অমিত কোনওকালেই অমন ‘গাধা’দের দলে ছিল না।
তবে অমিতের সাথে পরিচয়ের ফলে জুঁইয়ের একটা লাভ হয়েছিল, সেটা হল, অমিত জুঁইকে বিভিন্নভাবে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। এতে ওর নিজের সুবিধে ছিল এই, জুঁই ওকে জ্বালাত কম আর ও ওইসময়ে অন্য মেয়েদের সাথে ফোনে কথা বলতে পারত। অমিতের ১৪টা সিম ছিল। জুঁইয়ের রুমমেটের সাথেও অমিতের কথা হত। অবন্তীকে অমিত বলত, “আরে জুঁইকে তো আর আমি বিয়ে করব না। আমি তো আসলে তোমাকেই ভালোবাসি। জুঁইয়ের সাথে মাঝেমাঝে জাস্ট পড়াশোনা নিয়ে কথা হয়।” অবন্তী অমিতকে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য, ও নিজেও যে ফোনে শুধু অমিতের সাথেই কথা বলত, এমন নয়। কিছু-কিছু মেয়ে আসলেই প্রেম ছাড়া বাঁচতেই পারে না। অবন্তী ছিল সে দলে। মজার ব্যাপার হল, অবন্তীর সাথে পরিচয়ের প্রাথমিক সূত্র ছিল জুঁই। কখনও মোবাইলে চার্জ না থাকলে কিংবা ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেলে জুঁই অবন্তীর মোবাইল থেকে অমিতকে ফোন করত। অবন্তী অমিতকে বলেছিল, “ভাইয়া, আমি আপনার একটা ছোটবোন। আমাকে মাঝেমধ্যে একটু ভাল পরামর্শ দিয়ে হেল্প করবেন?” সেই ভাইবোনের সম্পর্কটি গড়িয়েছিল বিছানা পর্যন্ত। এরকম অনেক নিবিড় পাঠিকা এবং অনুরাগিণীর সাথে অমিতের ‘মধুর’ সম্পর্ক ছিল। ফেসবুকে ওর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ না করায় জুঁইয়ের কথা কেউই জানত না।
অমিতের লেখার হাত বেশ ভাল ছিল বলে ওর কোনওকালেই অনুরাগিণীর অভাব হয়নি। খুব সম্ভবত, সবচাইতে কঠিন বাংলা গান লালনের “চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে” শোনার পর ওটার সহজ ব্যাখ্যা গুগলে অনেকভাবে সার্চ করেও যখন পেল না, তখন ওটা অন্তত ২০-২৫ বার শুনে অমিত নিজেই ওটার সহজ ব্যাখ্যা লিখতে শুরু করে। টানা ৩-৪ ঘণ্টা চেষ্টা করে গানটার একটা সুন্দর ব্যাখ্যা লিখে ফেসবুকে শেয়ার করেছিল। কাজটা সত্যিই অনেক কঠিন ছিল। সে ব্যাখ্যা পড়ে মুগ্ধ হয়ে ঝুমকো নামের এক লালনভক্ত মেয়ে অমিতের প্রেমে পড়ে। জগতে কোনওকালেই বহুপ্রেমের ব্যাপারটিতে কোনও সৃষ্টিশীল পুরুষেরই আপত্তি দেখা যায়নি। প্রেমের সাথে সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক একরৈখিক। যারা সৃষ্টিশীল নয়, সেসব পুরুষেরও বহুপ্রেম থাকে, তবে তা মূলত শারীরিক। আচ্ছা, ছেলেদের প্রেম যতটা শারীরিক, মেয়েদের প্রেম কি ততটাই মানসিক হয়? সবসময়ই? অন্যরকম ব্যাপার ঘটে না?
অমিতের প্রতি জুঁইয়ের যতটা ভালোবাসা ছিল, জুঁইয়ের প্রতি অমিতের ততধিক কামনা ছিল। সে কামনার আগুনের বহিঃপ্রকাশ অমিতের কথায়, আচরণে সবসময়ই প্রকাশ পেলেও জুঁই নিজেকে এই সান্ত্বনা দিয়ে মনেমনে খুশি হয়ে উঠত যে, “ভালোবাসে বলেই তো অমন করে।” মেয়েরা শারীরিক প্রেমকে ভালোবাসারই একটা অংশ ভাবে, আর ছেলেরা ভালোবাসাকে শারীরিক প্রেমেরই একটা অংশ ভাবে। এর ব্যত্যয়ও ঘটে, তবে সেটি খুব বিরল ক্ষেত্রে। অমিতের একটা রিপ্লাইয়ের জন্য জুঁই যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেসেঞ্জারে বসে থাকত, তখন অমিত অন্য মেয়েদের সাথে বিজি থাকত। জুঁই ভাবত, অমিত বোধহয় ব্যস্ত লেখালেখিতে। অমিতের নাম্বারে অনেক বার ফোন করেও ওকে যখন পাওয়া যেত না, তখন অমিত নানান অজুহাত দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারত। “আমি ওয়াশরুমে ছিলাম, অন্যরুমে ছিলাম, ক্লাসে ছিলাম, লেখালেখি করার সময় মোবাইল দূরে রাখি, মোবাইল চার্জে ছিল, আমার ভাগ্নে মোবাইলের ডিসপ্লে নষ্ট করে ফেলেছে বলে খেয়াল করতে পারিনি, ব্যাচে স্টুডেন্ট পড়াচ্ছিলাম।” এরকম আরও অসংখ্য এক্সকিউজ! কথাগুলি বলার সময় অমিত খুব আহ্লাদ করে অপরাধীর মতন বলত। এতটাই আফসোসের সুরে বলতো যে, জুঁইয়ের নিজের মধ্যেই অমিতের কাছ থেকে কৈফিয়ত চাওয়ার জন্য খারাপলাগা কাজ করত। “আমার প্রেমিক শুধু আমারই। ও আর কারও সাথেই ফ্লার্ট করে না।” এই ভাবনাতে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চিরন্তন বাঙালি নারী ছিল জুঁই। প্রেমিককে কাছে পেলে মেয়েরা খুশি থাকে। এমনকি কাছে না পেলেও এই ভেবে খুশি থাকে যে, প্রেমিক নিশ্চয়ই অন্য কোনও জরুরি কাজে ব্যস্ত! মেয়েরা এমন, যে ছেলেকে ভালোবাসে, সে ছেলের শত ভুলের পক্ষেও কোনও না কোনও যুক্তি খুঁজে বের করে ফেলতে পারে; আবার যে ছেলেকে ভালোবাসে না, সে ছেলে যতই ঠিক কাজটি করুক না কেন, কিছুতেই সেটির পক্ষে একটিও যুক্তি খুঁজে পায় না।
পুতুলখেলার বিয়ের পর অমিতের অনেক রূপই জুঁইয়ের কাছে একটা-একটা করে ধরা পড়তে থাকে। যে কথাগুলি বিয়ের আগে আসত না, সেগুলি একে-একে আসতে থাকে। কখনও-কখনও অমিতের আচরণ রাস্তার ছ্যাঁচড়া ছেলেদের চাইতেও নিচে নেমে যেত। জুঁইকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করত প্রায়ই, কখনও-কখনও গায়ে হাত তুলত। অমিতের অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আর সোশ্যাল স্ট্যাটাস কিছুতেই ওরকম আচরণের সাথে যেত না।
আমাকে ঘরে তুলে নাও না, তুমি তো এখন ভাল পয়সা আয় করছ। প্রতিদিনই তো ব্যাচে স্টুডেন্ট বাড়ছে। বাসায় কথা বল। আমাদের ব্যাপারটা বাবা-মা’কে জানাও। আমার তোমার ঘর করতে ইচ্ছে করে খুউব!
আরে বোলো না, আমার বড় আপু আমার জন্য অন্যদিকে মেয়ে খুঁজছে।
মানে?
আসলে হয়েছে কী জানো, আমাদের ফ্যামিলির অবস্থা তো খুব একটা ভাল না, তাই বিয়ের সময় কিছু টাকা পাওয়া গেলে খুব ভাল হত। তাছাড়া আমিও একটা সাইড বিজনেস দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারতাম। আচ্ছা সোনা, তুমি বাসা থেকে কিছু টাকা ম্যানেজ করতে পারবে না? এই ধর, লাখ বিশেক? তাহলে আমি তোমার কথাটা বাসায় বড়মুখ করে বলতে পারতাম।
তুমি এসব কী বলছ, অমিত? তুমি জানো না আমার অবস্থা? আমাকে টাকা কে দেবে? দুনিয়ায় আপন বলতে আছেই ওই এক খালাত বোন। আপুকে আমি কীভাবে বলব টাকার কথা? এটা কি সম্ভব? এতদিন পর এসে আমাকে এটা বলতে পারলে? আমি না তোমার স্ত্রী?
আহা, রেগে যাচ্ছ কেন? আমি তো তোমাকে স্ত্রীর সব মর্যাদাই দিচ্ছি। তোমার আর্থিক, শারীরিক, মানসিক, সব চাহিদাই পূরণ করছি। প্রতিমাসে ২ হাজার করে টাকা দিই তোমাকে। আর তাছাড়া ওই টাকাটা তো আর অন্য কেউ পাচ্ছে না, তোমারই স্বামী পাচ্ছে। আমার টাকা মানেই তো তোমার টাকা, তাই না? ওই টাকাটা ছাড়া তোমাকে ঘরে তোলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
অমিত, টাকার খোঁটাটা দিয়েই ফেললে? জুঁইকে যা কোনওদিনই কেউ বলতে পারেনি, তা-ই জুঁই আজকে শুনল তার স্বামীর কাছ থেকে! কখনও জিজ্ঞেস করেছ, মাসে আমার কত খরচ হয়? ব্যাংকে আমার একটি পয়সাও জমানো নেই। টিউশনির বেতনটা ঠিক সময়ে না পেলে খাওয়ার টাকাও হাতে থাকে না। বাসে ঝুলে-ঝুলে সন্ধ্যার পর টিউশনি শেষে শহর থেকে ক্যাম্পাসে ফিরি, বাইরে যাওয়ার ভাল ড্রেস আছে ২টা, পারফিউম আর বডিস্প্রে ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছি সেই কত আগেই। সেদিন স্যান্ডেল সেলাই করতে গেলে আমাদের ক্যাম্পাসের বুড়ো মুচিটি বলছিল, “আম্মা, এটা আর সেলাই করার রাস্তা নাই, একজোড়া নতুন স্যান্ডেল কিনে ফেলেন না!” আমি চোখের পানি আড়াল করে বলেছি, “চাচা, কিছু হবে না, ওটাই সেলাই করে দেন।” লজ্জায় ফ্রেন্ডদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাই না পয়সা খরচ করতে পারব না বলে, চশমার ফ্রেমটা রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে ফেলার পর আইকা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে ইউজ করছি, ভ্যানিটি ব্যাগটা ছিঁড়ে গেলে এখন নিজেই সেলাই করি রুমে বসে—এই ব্যাগ কাউকে দেখানো যায় না। কয়েকদিন আগে নতুন একটা টিউশনির টাকা দেয়নি বলে মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে স্টুডেন্টের মায়ের হাত ধরে কেঁদেছি পর্যন্ত। শেষ কবে বিকেলে নাস্তা করেছি, মনে নেই। বৃদ্ধ দাদিকে প্রতিমাসের টাকা বাঁচিয়ে কিছু টাকা পাঠাই; কখনও-কখনও একটা হরলিক্স, শুনতে পাই, সেটাও নাকি দাদিকে খেতে দেয় না, আমার ওইঘরের ভাইবোনরা খেয়ে নেয়। ছোটবেলায় যা আদর পেয়েছি, তার সবটুকুই তো এই একটি মানুষ থেকেই। আমার বাবা নিজের মায়ের মৃত্যুর প্রহর গুনতে-গুনতে উনাকে ঠিক মত ওষুধপত্র কিনে দেয়ার কথাই মনে রাখতে পারেন না, সেবাশুশ্রূষা তো অনেক পরের কথা! এসব খোঁজ নিয়েছ কখনও? সব সহ্য করে আছি শুধু তুমি পাশে আছ ভেবে। কত স্বপ্ন দেখেছি সামনের দিনগুলি নিয়ে! তুমি বলেছ, তোমাদের বাসায় মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করাটা পছন্দ করে না, আমার মাস্টার্স করার দরকার নেই, আমাকে চাকরি করতে দেবে না। সবকিছুই মেনে নিয়েছি। আর এখন আমাকে কী বলছ এসব?
দেখ, তুমি আমাকে অপমান করছ সামান্য টাকার জন্য। তোমাকে আমি ২ হাজার টাকার চাইতে বেশি আর কী দেবো? কয়টা মেয়েকে ওর হাজব্যান্ড প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা দেয়? খোঁজ নিয়ে দেখ তো! ২ হাজার টাকা তোমার কাছে কম মনে হয়? তোমার দাদিমা তো দুইদিন পর মরেই যাবেন। উনার পেছনে আমার এত কষ্টে আয়করা টাকা নষ্ট করার মানে কী? তাছাড়া, ইদানিং আমার হাতে বেশ কিছু ভাল-ভাল প্রপোজাল আছে। ওদের কয়েকজন দেখতেও অনেক সুন্দরী, ফ্যামিলিও ভাল, ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে, ফ্যামিলির সবাই উচ্চশিক্ষিত, ওয়েল-এস্টাব্লিশড। এক মেয়ের বাবা কালকে আপুকে ফোনে বলছেন, উনার মেয়েকে বিয়ে করলে আমাকে আর ব্যাচে পড়াতে হবে না, একটা ফ্ল্যাট আর একটা গাড়ি আমার নামে লিখে দেবেন। অটবির ফুল সেট ফার্নিচার, ৬০ ভরি স্বর্ণ। সাথে আমাকে ব্যবসা ধরিয়ে দেবেন, নগদ টাকাও দেবেন। আমি সরকারি চাকরি করি। কয় টাকা বেতন পাই, বলো? ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, জুঁই! বি প্র্যাক্টিক্যাল! আমারও একটা ফিউচার আছে। আমার একটা সিকিউরড লাইফ চাই। তোমাকে বিয়ে করলে আমি কী পাব? আমার ফ্যামিলি কী পাবে? আমার জীবনটা এভাবে করে নষ্ট করার কী অধিকার তোমার আছে? তাছাড়া আজকালকার মেয়েরা কত স্মার্ট! আর তুমি কী? তুমি নিজেই সিন্সিয়ারলি ভেবে দেখ! তোমাকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না, জুঁই। প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না।
বাহ্ শুভ্র অমিত, বাহ্! তুমি বলছ এসব? আমি তোমাকে চিনতাম এতদিন? তোমার লেখার প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকে হাজার-হাজার মানুষ? তুমি প্রগতিশীলতার কথা বলতে-বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেল না? তুমি না ইন্টারে বোর্ডস্ট্যান্ড করেছিলে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের তুখোড় বিতার্কিক অমিত বলছে এসব কথা? তোমার মতন উচ্চশিক্ষিত ছেলের এ কী মানসিকতা? তুমি কি জানতে না যে আমাকে বিয়ে করলে কিছুই পাবে না? আমি কি কিছু লুকিয়েছিলাম তোমার কাছে, বলো? তুমি কি জানতে না, জুঁই মফস্বল থেকে উঠেআসা অতিসাধারণ গরীব একটা মেয়ে? তুমি কি আগে বুঝতে পারনি, জুঁই সোসাইটির সাথে পুরোপুরিই বেমানান?
দেখ, এসব কথা বলে কোনও লাভ নেই। তোমাকে ঘরে তোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আগে যা হয়েছে, হয়েছে। এখন তুমি তোমার রাস্তায় হাঁট, আমি আমার রাস্তায়। এটাই ফাইনাল। আমি তোমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো, সাইন করে দিয়ো। তুমি নিজে জীবনে কষ্ট পেয়েছ বলে আমাকেও কষ্ট দিতে হবে, এই মানসিকতা ঠিক নয়। তোমার মা’কে তোমার বাবা মেরে ফেলেছে, এটা কি আমার দোষ? আর তোমার তো বোঝা উচিত, আমি কিছুতেই মূল্যহীন নই। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরি জোটাতে কত কষ্ট হয়, কোনও ধারণাও আছে তোমার? লোকে প্রাইমারি স্কুলেও একটা চাকরি জোটাতে পারে না, আর আমি তো সরকারি কলেজে পড়াই। কত মানুষ আমাকে সম্মান করে, এক নামে চেনে। আমার এইসব অর্জনের কি কোনও দাম নেই? আমার পরিবার আমার পাশে দাঁড়িয়েছে সবসময়ই। ওদের কি একটু ভালোভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করতে পারে না? আমি কেন ওদের এই সামান্য আবদারটুকু রাখতে পারব না? কী আছে তোমার, শুধু ওই শরীর ছাড়া, বলো? তোমাকে ঘরে তুললে আমি কী পাব? তুমি তো অনেককিছুই পাবে, কিন্তু আমার কী লাভ? আমি কী দেখে তোমাকে ঘরে তুলব? বি লজিক্যাল, জুঁই!
অমিত, এ জীবনে কখনও কারও কাছেই হাত পাতিনি। আমাদের মধ্যে এত কিছু না হলে তোমাকে এত কথা বলার কোনও প্রয়োজনই ছিল না আমার। আমি দারিদ্র্য দেখেছি, দারিদ্র্যকে সহ্য করা শিখেছি, কিন্তু আমি দরিদ্র নই। তোমার এই অহমিকার জবাব দেয়ার মতন অবস্থান আজ আমার নেই। তোমার সম্পর্কে আমাকে অনেকেই সাবধান করে দিয়েছিল। আমি কোনওদিনই কারোর কথা বিশ্বাস করিনি। তুমি আমাকে ভুলিয়েভালিয়ে যা-ই বলতে, তা-ই বিশ্বাস করতাম। আমাকে ম্যানেজ করা ছিল তোমার জন্য জাস্ট একটা তুড়ির ব্যাপার। আমিই তোমাকে ওই বিদ্যে ফলাতে দিতাম। কোনও মেয়ে নিজ থেকে না চাইলে কোনও ছেলের পক্ষেই সম্ভব নয় ওকে যেভাবে খুশি সেভাবে করে ব্যবহার করা। কী করব, বল! ভালোবাসতাম যে! অন্ধ প্রেম জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়, শুনেছিলাম। কিন্তু কখনও-কখনও জীবনটাই যে কেড়ে নেয়, এটা নিজের জীবন থেকে শিখতে হল। আজ আমি সুন্দরী নই তোমার চোখে। অন্য মেয়েরা সুন্দরী। তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন আমাকে? আমার তো শুধু ভালোবাসা আর শরীর ছাড়া আর কিছুই দেয়ার ছিল না তোমাকে। তোমরা ছেলেরা বাসাবদলের মত করে শরীর বদলাতে পার। এক শরীরের মোহ কেটে গেলেই অন্য শরীর। এরপর আরেক শরীর। তোমাদের ভালোবাসা পথটাই স্রেফ শরীর থেকে শরীরে। তোমাদের প্রেমের নিশ্চিত গন্তব্য মেয়েদের শরীর অবধি। ভালোবাসাটা তোমরা শিখবে কবে, বলো? একবার ভালোবাসতে শিখে দেখ। নিজেকে মনে হবে এই পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাধর মানুষ। ভালোবাসা নিয়ে সবকিছু জয় করে ফেলতে পারবে, এই বিশ্বাস জন্মে যাবে নিজের মধ্যে। তুমি নিজেই বিশ্বাস কর না যে তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে। জীবনে তোমার অনেক অর্জন। সেসব অর্জনে দিনে-দিনে তোমার দাম বেড়েছে, যেমন করে কোরবানির আগে-আগে দাম বাড়ে ঘরের গৃহপালিত জন্তুটির। তুমি অনেক উপরে উঠতে চাও, তাই বিক্রি হয়ে যেতে তোমার কোনও আপত্তিই নেই। আমার ৫ তলা বাড়ি থাকলে তোমার ফ্যামিলি আমাকে মেনে নিত, না? আমাকে বিয়ে করলে তো তোমার টিউশনি ব্যবসার ক্ষতি হবে, মেয়েমার্কেটে ডিমান্ড কমে যাবে, ইন্টারের বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে পারবে না। তোমার মতন নোংরা নর্দমার কীট জুঁইকে ডিজার্ভ করে না, কোনও একটা কলগার্লকে ডিজার্ভ করে। আমি কখনওই ডিভোর্স লেটারে সাইন করব না। ভয় পেয়ো না, কোনওদিনই তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব না। আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।
হাহাহাহা……… বল বল, যা ইচ্ছা বল। ইউ আর জাস্ট অ্যা লুজার। ইউ উইল অলওয়েজ বি অ্যা লুজার বিকজ ইউ হ্যাভ লাভ ইন ইয়োর হার্ট। অল দ্য লাভারস্ আর জাস্ট লুজারস! লাভ ইজ অ্যা বুলশিট থিং! দেয়ার ইজ অনলি ওয়ান ট্রুথ, ওয়ান প্রিন্সিপল: ফাক অ্যান্ড ফরগেট! আই কান্ট বিয়ার দ্য বার্ডেন অব ইয়োর ফুলিশ লাভ অ্যানিমোর। গো টু হেল উইথ ইয়োর ডিভাইন লাভ! পারলে ভাল থেকো। বাই ফরএভার!
বাই ফরএভার!!!—-“কী সহজে হয়ে গেল বলা, কাঁপল না গলা এতটুকু…….” একটি ছোট্ট কথায় দুটি মানুষের সম্পর্কের কত সহজ ইতির সিদ্ধান্ত! দিনে-দিনে একটু-একটু করে গড়েওঠা সেতুর এই হঠাৎ ভেঙেযাওয়া! নিমিষেই! জুঁই নামের একলাচলা মেয়েটি জীবনের এই নিষ্ঠুর সমীকরণের সাথে পরিচিত ছিল না। পুরোপুরি নিজের চেষ্টায় আর পরিশ্রমে এতটা পথ পাড়ি দেয়ার সময় জীবনের অনেক কদর্য চেহারার সাথে ওর পরিচয় ঘটেছে। নিজেকে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আর বাস্তববাদীই ভাবত। নিছক আবেগের দমকা হাওয়ায় নিজের সমস্ত বাস্তববুদ্ধি লোপ পেতে সে আর কখনওই দেখেনি। এ অবস্থায় কাঁদারও কোনও যুক্তিই নেই। ভুল মানুষের জন্য কষ্ট পাওয়ার তো কোনও মানেই হয় না। বরং ভুল মানুষ জীবন থেকে যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয়, ততই মঙ্গল। ভুল মানুষের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া মানে অভিশাপমুক্ত হওয়া। জুঁইয়ের তো এখন সেলিব্রেট করার সময়! তবুও সে কাঁদতে থাকে, প্রতিদিনই। ইদানিং অন্ধকারকে ওর বড় আপন মনে হয়। এই এক অন্ধকারেই নিজের সবকিছুকে আড়াল করে নিজেকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে থাকা যায়। ছুটির দিনগুলিতে ও হলে একা-একা কাটায়। কখনও বা ছাদে গিয়ে খালি পায়ে হাঁটে আর ভাবে, “তবে এ-ই কি জীবন?” কখনও রুমমেট না থাকলে বালিশে মুখ গুঁজে একা-একা চিৎকার করে কাঁদে। চার দেয়ালের সেই অশ্রুকাব্য কোথাও কখনওই লেখা হবে না। পৃথিবীর সবচাইতে কষ্টের গাথাটি কেউই কোনওদিনই রচনা করেনি। সেটি চিরকালই সবার চোখের আড়ালেই থেকে যায়। জুঁই প্রায়ই অতিরিক্ত মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একবার অক্সিজেন-দেয়া অবস্থায় ভার্সিটির মেডিক্যাল সেন্টারে থাকতে হয়েছিল ৩ দিন। তবে প্রবল আত্মসম্মানবোধ থেকে অমিতকে আর কোনওদিনই ফোন করেনি। অসংখ্যবার ওর নাম্বারটা টাচস্ক্রিনে এনে ছুঁয়ে দেখেছে, কিন্তু কল কিংবা মেসেজ পর্যন্ত যেতে পারেনি। অমিত ওকে ব্লক করে দেয়ায় অন্য আইডি’তে গিয়ে ওর লেখাগুলি সবসময়ই পড়েছে। অমিত নাহয় ওকে কষ্ট দিল, কিন্তু লেখাগুলির কী দোষ?
পৃথিবীতে বাবা-মা বেঁচে থাকার কিংবা পাশে থাকার মত সৌভাগ্য আর হয় না। বেঁচে থাকার সবচাইতে বড় উপহারই ওটি। যার বাবা-মা নেই, এ সমাজ তার জন্য খুব একটা সুখকর কিছু নয়। আর সে যদি মেয়ে হয়, তবে সে আমাদের সমাজে একটা বেওয়ারিশ লাশের মত করে বাঁচে। সে লাশের উপর কুকুরের শেয়ালের শকুনের সমান-সমান অধিকার। সে সবার মাঝে থেকেও সবার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে থাকে যেন! আর যার মা নেই, বাবা থেকেও নেই, তাকে যখন দূরত্ব কী, এটার শৈশবপাঠের পুনর্পাঠ নিতে হয়, তখন সে একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। জুঁই ভাবে, এই দূরত্বে দূরত্বেই বাকি জীবনটা কাটবে।
আচ্ছা, এটাকে কি দূরত্ব বলে? ওরা কাছে এসেছিলই কবে যে দূরে সরে গেছে? দুজন সমানভাবে কাছে না এলে ওটাকে কি আদৌ কাছেআসা বলা যায়? ওরকম একটা ছেলেমানুষি বিয়েতে কি সত্যিই কাছেআসা হয়ে যায়? একপক্ষের কিছু মিথ্যে স্বপ্নের বুননই কি তবে কাছেআসা? ভালোবাসাশূন্য শারীরিক দূরত্বহীনতা কি মানসিক দূরত্বকে বাড়িয়ে দেয় না? একই ছাদের নিচে অসীম দূরত্বের কত যুগলই তো বছরের পর বছর একসাথে থেকে যায় স্রেফ অভ্যস্ততায়!
এভাবেই কেটে গেল দেড়টি বছর। জুঁই ভার্সিটি শেষ করে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করা শুরু করেছে। অমিত কী জানি সব কারণে এখনও বিয়ে করতে পারেনি। ওর বয়সটাও বেশ বেড়ে গেছে, এখন ৩৮ চলছে। প্রেম করার জন্য আগের মতই মেয়ে খুঁজে পেলেও বিয়ে করার জন্য আর কাউকেই পাচ্ছে না। বেশ কয়েক জায়গা থেকে রিফিউজড হয়েছে, হচ্ছেও। লজ্জা আর আত্মসম্মান, যে দুটি ওর কোনওকালেই ছিল না, সে দুটিকে বিসর্জন না দিয়ে একদিন রাতে জুঁইকে ফোন করে বসল। “আসো, সবকিছু ভুলে গিয়ে আমরা আবার নতুন করে ঘর বাঁধি। আমাকে ক্ষমা করে দেয়া যায় না? তোমাকে আমি এই দেড়টি বছর ভীষণভাবে মিস করেছি প্রতি মুহূর্তেই। আমার জীবনে তোমাকে আমার চাইই চাই। তুমি ফিরে আসো, জুঁই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আজ তোমাকে আমার বড় দরকার। আমাকে ফিরিয়ে দিয়ো না প্লিজ!” ফোনটা কানে ধরে জুঁই শুধুই শুনে যায়, কিছুই বলে না। আর ভাবতে থাকে, অমিত তাহলে সেই আগের মতই আছে, একটুও বদলায়নি!