পরমাত্মার প্রহরে



সাধক: আমার কঠিন উপাসনা সম্পর্কে আপনি কতখানি অবগত?
তাপসী: আপনার আত্মঘাতী, গোপন সাধনার অংশ হতে পেরে আমি ধন্য; আমার আত্মা সে বিষয়ে অবগত। আমরা বিচ্ছিন্ন নই; আপনার আরাধ্য অনুভব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা—অসম্ভব।
সাধক: আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আপনাকে দিতে চায় এক অজ্ঞাত বার্তা; এর জন্য বিশেষ উপাসনা সম্পন্ন হয়েছে। এখন আপনার বাহ্যিক স্পর্শ আমি সরাসরি আত্মায় গ্রহণে সক্ষম; আপনার পক্ষে তা অসম্ভব, কারণ আপনি কেবলমাত্র আত্মিক স্পর্শ ধারণে অভিষিক্ত।
তাপসী: এ অসাধ্যসাধন সম্ভব হলো কীভাবে?
সাধক: আপনার ‘ক্ষোভ’ নামের সামান্যতম অনুভবও ব্যর্থ করে দিতে পারে আমার এই সাধনা; আমার মৃত্যুর পীড়া বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
তাপসী: সে অনুভূতি আমার পরমাত্মায় নেই; তাই তার প্রকাশও অসম্ভব।
সাধক: এই আশ্বাসেই আমি নিজেকে নিযুক্ত করেছি কঠিন উপাসনায়; জাগতিক ও আত্মিক পীড়ার বিনিময়ে।
তাপসী: আমি অবগত; আপনার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমি আপনার ‘ভালোবাসা’ নামক অনুভূতিতে চির-অঙ্গীকারবদ্ধ; কোনো ভ্রান্তির অবকাশ নেই।
সাধক: আশ্চর্য! এ যন্ত্রণার প্রবাহ অসহনীয়; আসুন, আমার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে দিন সেই সুখের অগ্নিস্নান।
তাপসী: আপনি পরম সৌন্দর্যের আধার; আপনার বাহ্যিক মুগ্ধতা ও আত্মিক দীপ্তি আমার দৃষ্টিতে বিভ্রম সৃষ্টি করে।
সাধক: আপনি আমার শরীরী-আত্মায় স্পর্শ দিতে সক্ষম; যত তীব্র হয় এই স্পর্শ, তত গভীরে প্রবিষ্ট হয় আমার আত্মায় আপনার অস্তিত্ব।
তাপসী: আসুন, প্রবেশ করুন আমার হৃদয়ের অভিমুখে।
সাধক: আপনিই কেবল আমাকে সর্বোচ্চ সম্মোহনের শিখরে পৌঁছে দিতে পারেন; আপনার বাহ্যিক সত্তা আমার অবয়বকে উন্মত্ততায় ছুঁয়েছে, আর আমাদের আত্মা তৃপ্ত হয়েছে অনুভূতির মাধুর্যে।
তাপসী: কিন্তু সর্বক্ষণ এই অসামান্য অনুভবের স্পর্শগ্রহণ সম্ভব নয়; আপনার সুখানুভব আমার আত্মায় সীমাহীন পূর্ণতায় মূর্ছিত হয়ে আছে।
সাধক: ভালোবাসা নামক অনুভূতির তীব্রতা যত বাড়ে, আমাদের বাহ্যিক সত্তা তত স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে; আপনি ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করছেন, অনুভূতির দংশনে, অসহনীয় আবেশে।
তাপসী: ‘ভীতি’ নামক এক রেশ ছড়িয়ে পড়েছে আমার হৃদয়ের গভীরে; আপনার আবেগের স্পর্শ আমার প্রাণের প্রকোষ্ঠকে নিস্তেজ করে দিতে সক্ষম।
সাধক: আপনি আমার আত্মাকে অবশ করতে সক্ষম হয়েছেন শ্রেষ্ঠ অনুভূতির প্রয়োগে; এই সুখ—অসহ্য হয়ে উঠছে, যার ফল হতে পারে ভবিষ্যতের ভয়াবহ বেদনাবোধ।
তাপসী: আপনি ঠিক বলেছেন; আমাদের এই চরম অনুভূতি পরমাত্মার জাগরণকালের সাক্ষ্য হয়ে রইল।
সাধক: আপনার স্পর্শে আমি নিমজ্জিত এক মহাপ্রলয়ের ধ্বনিতে; সামান্য আঘাতও যদি আসে, তা পার হয়ে যাবে আমার সহনসীমা; আপনি যদি ত্যাগ করেন, আমি হারিয়ে যাব মৃত্যুর গহ্বরে।
তাপসী: যদিও প্রলয়ের অনুভব আমাদের আত্মায় উদ্ভাসিত, তবুও আপনার যন্ত্রণার ছায়া আমার হৃদয়ে দৃশ্যমান হয় কীভাবে? আমি আপনাকে কষ্ট দিতে পারি না; আপনাকে ত্যাগ করা কোনো মহাপ্রলয়ের রক্তাক্ত ক্ষণেও অসম্ভব।
সাধক: আপনার বাহ্যিক সত্তা থেকে আত্মায় যে স্পর্শ গ্রহণ করেছি, তা আমাকে এমন এক বিমোহিত সুখে ডুবিয়েছে—যার উৎস হতে পারে আপনার আমার প্রতি আকর্ষণ, আমার বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি।
তাপসী: আপনার প্রতি আমার মুগ্ধতা চিরন্তন; আমাদের পরমাত্মা মুক্ত—'ক্ষোভ' বা 'ক্রোধ' থেকে।
সাধক: কী আশ্চর্য! আপনার হৃদয়ের অভিমুখে কাঁপছে এক যন্ত্রণাদগ্ধ ভালোবাসা; আপনার আত্মায় রক্তক্ষরণ—আমার উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

[শেষাংশে দুই কণ্ঠ মিলে]
আমরা শরীরে বাঁধা নই; আমরা আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ।
এই ভালোবাসা—পীড়া, সুখ, রক্তক্ষরণ—
সবই পরমাত্মার জাগরণের নিঃশব্দ গাথা।
Content Protection by DMCA.com