নির্জন গহনে: ১১


৫১.


‘আমি’-বোধই গুরু, উপাস্য ও মুক্তির দিকচিহ্ন। ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানকেই উপাসনা করো—ঈশ্বররূপে, গুরুরূপে, মুক্তির দ্বাররূপে। কারণ এই ‘আমি’ই তোমার চেতনার প্রথম দীপ্তি, আর এ-ই একমাত্র উপলক্ষ্য, যার মাধ্যমে তুমি পৌঁছোতে পারো নিজের ঊর্ধ্বতর স্বরূপে।


উপনিষদ বলেন: “আচার্যবান্ পুরুষো বেদ”—যিনি গুরুর সহচর হন, তিনিই সত্যকে জানতে পারেন। আর এই গুরু এইখানে ‘আমি’-রূপে বিরাজমান। শুরুতে যা ছিল, তা ছিল এক নির্বাক বোধ—“আমি আছি”, অথচ বলা হয়নি। সেটাই ছিল প্রথম সত্তার অভিজ্ঞান, যা তোমাকে জাগিয়ে তুলেছিল। তারপর ভাষা এল, “আমি অমুক” এল, চিন্তা এল, স্মৃতি এল—আর শুরু হলো মনের অবিরাম প্রবাহ।


এখন, সাধনা হলো এই প্রবাহকে উলটে ফেরা—প্রথমে স্থিত হও শব্দযুক্ত ‘আমি’-তে, তারপর সেটিকেও পার হয়ে গিয়ে পৌঁছে যাও সেই শব্দহীন, নির্জন, প্রাক্‌-ব্যক্তি ‘আমি’-তে। সেই অবস্থায় তুমি বুঝবে—তুমি এই ‘আমি’ নও, নও মনের প্রবাহ, নও শব্দ, নও চিন্তা—তুমি সেই, যার উপরে সব কিছু এসেছিল আর মিশে গেছে।


উপনিষদ বলেন: “ন স প্রাণেন, নাপানেন, মর্ত্যো জীবতি কশ্চন। ইতেন তু জীবন্যেন, যেনাশ্মিতঃ অনুভূতঃ”—তুমি বেঁচে আছ—না দেহে বা শ্বাসে; তুমি বেঁচে আছ সেই জ্ঞানে—“আমি আছি”, আর তার ঊর্ধ্বে স্থিত হয়েই তুমি মুক্ত। তাই এই ‘আমি’-বোধকে উপাসনা করো, সে-ই তোমার প্রথম গুরু, প্রথম ঈশ্বর, তাকেই ধ্যান করো, আর ধীরে ধীরে তাকে পেরিয়ে যাও। আর তখন তুমি জানতে পারবে—তুমি ‘আমি’ নও, তুমি চিন্তা নও, তুমি ঈশ্বরধারণাও নও—তুমি সেই পরম মৌন চৈতন্য, যার উপর সব আসে, আর সব লীন হয়।

৫২.


‘আমি’ এক স্মৃতি, তুমি তারও পূর্বে—পরম। এই মুহূর্তে তুমি যা ধরে রেখেছ, তা এক স্মৃতি—“আমি আছি”। এই স্মৃতিই ধারণ করে রেখেছে তোমার ব্যক্তিগত সত্তাকে, এই বোধই বজায় রাখছে “আমি মানুষ”, “আমি দেহ”, “আমি কর্তা” এই ভ্রমকে। উপনিষদ বলেন: “স্মৃতি-রূপম্ অনৃতং”—স্মৃতি নিজেই অনিত্য, আর যা অনিত্য, তা সত্য নয়।


তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু প্রতিক্ষণ তুমি নিজের ভিতরে এই স্মৃতিকে ধরে রাখছ—“আমি আছি”, “আমি সেই”, “আমি এই”। আর এই ধরে রাখার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে ব্যক্তিত্ব, দ্বন্দ্ব, দুঃখ। কিন্তু এখন গুরু তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেন—“তুমি এই ‘আমি’ নও। তুমি সেই—যার আগে ‘আমি’ এসেছে, আর যার পরেও ‘আমি’ থাকবে না, কিন্তু তুমি থাকবে।” চিন্তা করো—তুমি নিজের অস্তিত্ব স্মরণ না করেও থেকেছ না? ছোটোবেলায়, ঘুমের মধ্যে, গভীর নিদ্রায়—সেই অবস্থায়ও তুমি ছিলে, কিন্তু “আমি” ছিল না। তবু তুমি ছিলে—এটাই তো তোমার প্রকৃত সত্তা।


উপনিষদ বলেন: “যো বোধসময়ে ন বিদ্যতে, সঃ আত্মা”—যে চেতনা এমনকি ‘আমি’-বোধের সময়েও ধরা পড়ে না—সেইই আত্মা, সে-ই তুমি। এখন তুমি যদি সত্যিকারের মুক্তি চাও—তবে এই “আমি” স্মৃতিকে চিনে ফেলো—আর দেখো, কীভাবে সে তোমাকে মিথ্যা পরিচয়ের জালে আবদ্ধ করেছে। তারপর সে স্মৃতিকে আলতো করে ফেলে দাও, আর স্থিত হও সেই পূর্বস্বরূপে, যেখানে কিছু মনে রাখতে হয় না, কারণ তুমি চিরকাল থেকে গেছ নিজের ভেতরে—পরম, অদ্বিতীয়, অচঞ্চল। স্মৃতি ‘আমি’ নয়—তুমি; আত্মপরিচয় নয়—তুমি; চিন্তাও নয়, অভিজ্ঞতাও নয়—তুমি সেই, যাকে মনে রাখতে হয় না, কারণ তিনি চিরস্মরণীয়ও নন—চিরউপস্থিত।


সেই সত্য সত্তাকে আলিঙ্গন করো, আর সব কিছু ভুলে যাও—কারণ তুমি নিজেই আছ—'আমি'-রও আগে, ভাষারও আগে, জন্ম-মৃত্যুর অনেক ওপরে—পরব্রহ্মরূপে।

৫৩.


‘আমি’ উপাদানসৃষ্ট, কিন্তু তুমি উপাদানাতীত। তুমি যা অনুভব করো—“আমি আছি”, সে অনুভবটি এসেছে এক সমষ্টিগত উপকাঠামো থেকে—পাঁচ উপাদান (ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ) আর ত্রিগুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) মিলে গঠিত এই শরীর-মন থেকে। এই উপাদান ও গুণ যখন বিদ্যমান, তখনই উদিত হয় এই ‘আমি’-বোধ। কিন্তু তারা যখন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখন ‘আমি’-ও মুছে যায়।

উপনিষদ বলেন: “যৎ অনিত্যং, তৎ অনৃতম্”—যা নশ্বর, তা কখনোই সত্য নয়। তাই বিচার করো—যা-কিছু নির্ভরশীল, পরিবর্তনশীল, ক্ষণস্থায়ী, যেমন দেহ, উপাদান, গুণ, ‘আমি’-বোধ—সবই অসত্য, মায়াময়। কিন্তু তুমি তো সে নও, কারণ তুমি রয়েছ এমনকি 'আমি'-র অনুপস্থিতিতেও—যেমন ঘুমে, জড়তায়, মৃত্যুর প্রান্তে।


তুমি সেই, যার ওপর সব কিছু উদিত হয়েছে, কিন্তু যিনি নিজে কোনো কিছুর উপর নির্ভর করেন না। তোমার অস্তিত্ব নেই উপাদানে, নেই গুণে, নেই দেহে, নেই ‘আমি’-তে—তুমি চিরকালীন, নির্ভরশীলতামুক্ত, অবিনশ্বর সত্তা। উপনিষদ বলেন: “ন জয়তে, ন ম্রিয়তে”—সে জন্মায় না, মরে না—সে কেবল আছে, নিজেই নিজের মধ্যে।


দেহ আসবে যাবে, গুণ আসবে যাবে, উপাদান মিশে যাবে প্রকৃতিতে, ‘আমি’ বোধ উঠবে আবার মিলিয়ে যাবে—কিন্তু তুমি রয়ে যাবে—কারণ তুমি তা নও। তুমি সেই—যে চিরন্তন মৌন দীপ্তি, যার অস্তিত্ব নির্ভর করে না কোনো কিছুতে, কারণ তুমি নিজেই পরম সত্য।

৫৪.


‘আমি’-তে স্থিতি, ‘আমি’-র সাক্ষী, পরম অবস্থানে উত্তরণ। যতক্ষণ তুমি বিশ্বাস করো—“আমি এই দেহ”, “আমি এই মন”, ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্যান করে যেতে হবে। কিন্তু ধ্যান মানে কিছু কল্পনা নয়, কোনো চিন্তা নয়—কেবল ‘আমি আছি’—এই শব্দহীন অস্তিত্বে স্থির হওয়া। উপনিষদ বলেন: “ধ্যানে স্থিতঃ পশ্যতি আত্মনম্”—ধ্যানেই আত্মার সাক্ষাৎ ঘটে, আর সে আত্মা ভিন্ন কোনো কিছু নয়, ‘আমি’ থেকেও পূর্ববর্তী সেই চেতনা।


যখন এই ধ্যান গভীর হয়, তখন একমুহূর্তে তুমি নিজেই দেখতে পাও—‘আমি’-কে, জানো—এই ‘আমি’ও একটি অনুভবমাত্র, আর তুমি তার সাক্ষী। ঠিক সেই মুহূর্তেই তুমি দাঁড়িয়ে যাও 'আমি'-র বাইরে, আর এই সাক্ষিত্বই সর্বোচ্চ অবস্থা—সর্ববোধ, সর্বমুক্তি, সর্বতত্ত্বের পরিণতি। তখন বুঝে ফেলো—‘আমি’ একটি আলো, আর তুমি সেই আকাশ—যার ভিতরে আলো জ্বলে, আবার নিভে যায়।

উপনিষদ বলেন: “দ্বিতীয়ম্ নানপশ্যতি, সঃ আত্মা”—যেখানে দ্বিতীয় কিছু নেই, সেই অবস্থাই আত্মা, আর সেই অবস্থায় পৌঁছোতে গেলে প্রথমে ‘আমি’-কে অনুভব করো, তারপর তাকে দেখো, তারপর তাকে ছেড়ে দাও। ধ্যান করো—‘আমি’ হয়ে, তারপর ‘আমি’-র সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও, আর তখনই তুমি বুঝবে—তুমি কখনোই ‘আমি’ ছিলে না, তুমি চিরকাল ছিলে তার পরে, তার বাইরে, চিরসত্য, চিরমুক্ত, নিরসংশয় চৈতন্যরূপে।

৫৫.


‘আমি’-র পূর্বে ছিলে তুমি—সুখময়, নিঃসঙ্কট, চিরমুক্ত। এই ‘আমি আছি’—এই জ্ঞানটি এসেছে তোমার পূর্ব-অবস্থা থেকে, যেখানে কোনো শব্দ ছিল না, চিন্তা ছিল না, পরিচয় ছিল না—কেবল ছিল চুপচাপ চৈতন্যের দীপ্তি। আর এখন এই ‘আমি’-বোধই হয়েছে তোমার সমস্ত দুঃখের মূল—কেননা “আমি আছি” বলার সঙ্গেই জন্ম নেয় “আমার এটা নেই”, “আমার সেটা চাই”, “আমার ক্ষতি হবে”—আর শুরু হয় বেদনা, ভয়, দ্বন্দ্ব।

উপনিষদ বলেন: “যত্র নান্যৎ পশ্যতি, সঃ সুখঃ”—যেখানে দ্বিতীয় কিছু নেই, যেখানে শুধু সত্তা, সেখানেই আছে প্রকৃত সুখ। মনে করো—জন্মের আগের অবস্থা, বা গভীর নিদ্রা, যেখানে ‘আমি’-বোধ অনুপস্থিত বা স্থগিত। সেই সময় কি কোনো দুঃখ ছিল? না—কেননা দুঃখ আসে কেবল তখনই, যখন একজন ব্যক্তি নিজেকে অনুভব করে—“আমি আছি”।

এখন গুরু তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন—এই ‘আমি’-বোধ এসেছে, এখন তোমার কাজ—তা চিনে ফেলা, তাতে স্থিত হওয়া, এবং শেষে তা অতিক্রম করে ফেলা। কেননা ‘আমি’-র আগে তুমি ছিলে—নামহীন, আকাঙক্ষাহীন, নির্বিকল্প, এবং সেই অবস্থাতেই ছিল সত্য আনন্দ, সত্য মুক্তি।


উপনিষদ বলেন: “আনন্দম্ ব্রহ্মেতি—যো হ্বৈ এষ এতস্মিন্ মন্দে আনন্দম্ অনুভবতি, স ব্ৰহ্মা”—যিনি অনুভব করেন এই অন্তর্গত মৌন-আনন্দ, তিনিই সত্যরূপ ব্রহ্ম। অতএব, ফিরে যাও সেই ‘আমি’-র পূর্ব মুহূর্তে, যেখানে তুমি ছিলে—কোনো কিছু না হয়েও সম্পূর্ণ, কোনো চিন্তা না করেও জ্ঞানে দীপ্ত। স্থিত হও ‘আমি’ বোধে, তারপর তাকে দেখো, চেনো, এবং শেষে ছেড়ে দাও। তখনই তুমি ফিরে পাবে তোমার প্রকৃত সত্তা—চিরসুখ, চিরমুক্ত, চিরনির্মল পরব্রহ্ম।
Content Protection by DMCA.com