দুঃখের সৌন্দর্য

 দুঃখের চাইতে তীব্র আকর্ষণীয় আবেগ আর কী আছে! মানুষ দুঃখের প্রেমে পড়ে যায়, মানুষ দুঃখ দুঃখ খেলায় মেতে ওঠে। নেতিবাচকতা থেকে যদিও সবাই পালায়, তবু দুঃখকে অনুভব করার বেলায় সবার একটাই রং। হ্যাঁ, মানুষ নিজেই দুঃখের পায়ের কাছে মাদুর পেতে বসে পড়ে, সেখানেই বসে থাকে দীর্ঘসময়, দুঃখকে অনুভব করে এবং ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে ধারণ করে।
  
 দুঃখ মানুষকে শেখায়, দুঃখ মানুষের হাত ধরে তাকে সুখের পথের দিকে নিয়ে যায়। আপনি যখন দুঃখী কারও সঙ্গে গল্প করবেন, তখন একসময় দেখবেন, আপনি নিজেও তার দুঃখটা অনুভব করতে পারছেন; নিজের এমন একটা দুঃখ দূর হয়ে যাচ্ছে, যা সেই দুঃখী মানুষের দুঃখের চাইতে ছোটো। দুঃখের কথা শুনতে শুনতে পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। আপনার চিন্তাধারা, আপনার জীবনযাপন, আপনার অভিজ্ঞতা, আপনার সব কিছুই দুঃখকে গ্রহণ করে নেয়। দুঃখের যে সৌন্দর্য, তার মধ্যে একবার ডুবে গেলে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। দুঃখের নেশা বড়ো নেশা।
  
 দুঃখ দুঃখ যে ভাবটা, তাকে এড়িয়ে চলা খুব শক্ত। এটা আপনাকে গ্রাস করবেই করবে! খুব ধীরে ধীরে দুঃখ আপনার প্রতিটি রক্তকণায় মিশে যাবে, আপনাকে আপন করে নেবে। আপনি হঠাৎ করেই বুঝতে শুরু করবেন, দুঃখ দেখতে কেমন, দুঃখ কোথা থেকে আসে, দুঃখ কীভাবে বাড়ে কমে, দুঃখ কতটা কোথায় থেকে যায় সবার চোখের আড়ালে। দেখবেন, আপনার এই দুঃখের জন্য দায়ী যে মানুষটা, আপনি একসময় তার দিকে অভিযোগের অসংখ্য তীর একের পর এক ছুড়তে থাকেন।
  
 যখনই আপনি আপনার সামগ্রিক অবস্থাটিকে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে ফেললেন, তখনই দেখবেন, আপনার দুঃখটা আরও বাড়ছে। আপনি সেই ব্যক্তি কিংবা উৎসকে ঘিরেই আপনার ভাবনাগুলিকে আবর্তন করতে থাকবেন। আপনি একসময় একটা চক্রে আটকে যাবেন। আপনি চাইলেও এখান থেকে বেরিয়ে সুখী অবস্থায় ফিরে যেতে আর পারবেন না।
  
 ঝামেলাটা আরও বেড়ে যাবে, যখন দেখবেন, এমন মন খারাপ করে থাকতেও আপনার ঠিক ভালো লাগছে না। কীরকম জানি উদাস উদাস লাগছে। আপনি তখন দ্বিধায় পড়ে যাবেন। সব কিছুকেই দেখতে খুব বিরক্ত লাগবে। মনে হবে, সবই মূল্যহীন, গুরুত্বহীন। এইসবের কোনও মানে নেই। আপনার চারপাশের কেউ আপনাকে নিয়ে ভাবে না, সবাই আপনার শত্রু। ক্রমেই আপনি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবেন। এমনকী কেউ আপনাকে বন্ধুর মতো সাহায্য করতে এলেও আপনি তাকেও আঘাত করে বসবেন। আপনি কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারবেন না।
  
 আপনি তখন ঠিক বুঝতে পারবেন না, এই দুঃখ চলে গেলে আপনি ভালো থাকবেন, না কি এখনই আপনি ভালো আছেন! হ্যাঁ, অদ্ভুতভাবে, আপনি দুঃখকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইবেন। আপনার কাছে তখন দুঃখের যন্ত্রণাটাও মধুর মনে হবে। দেখবেন, আপনি দুঃখকে রাখতেও চাইছেন, আবার দুঃখের হাত থেকে পালাতেও চাইছেন।
  
 আপনি নিজেকেও আঘাত করতে পারবেন না, অন্যদেরও আঘাত করতে পারবেন না। এমনকী আপনি বেমালুম ভুলে যাবেন, দুঃখটা এ জীবনে আসার আগে আপনি কেমন ছিলেন, কে ছিলেন! দুঃখটা জীবন থেকে চলে গেলে জীবন কেমন হয়ে যাবে, তা নিয়ে ভাবতে গিয়েও আপনি খেই হারিয়ে ফেলবেন। ধীরে ধীরে অনুভব করতে‌ পর্যন্ত আপনি ভুলে যাবেন!
 আচ্ছা, ভাবুন তো, অন্ধকারে থাকতে ভালোও যদি লাগে, তবু এই অন্ধকারেই তো যত নষ্টের শুরু, তাই না? সুখকে দূরে সরিয়ে রেখে এই যে স্বেচ্ছায় দুঃখযাপন করছেন, এতে এক আপনি নিজে বাদে আর কেই-বা শেষ হয়ে যাচ্ছে? দুঃখে ডুবে ডুবে একদিন আপনার জীবনসূর্যটাই বড়ো অসময়ে ডুবে যাবে। সেইদিনটা জীবনে আসার আগেই নিজেকে নিয়ে একটু ভাবুন।
  
 যাদের দুঃখ আপনাকে সহজেই গ্রাস করে রাখে, তাদের এড়িয়ে চলতে শিখুন। হ্যাঁ, আপনি তাদের ওই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারেন, পাশে থাকতে পারেন বন্ধুর মতন, কিন্তু কোনোভাবেই নিজের সুখকে ওদের দুঃখের কাছে বিসর্জন দিয়ে দেবেন না। দিনশেষে, আপনি যেন আপনিই থেকে যান, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
  
 কাউকে গর্ত থেকে তুলতে গিয়ে নিজেই যেন গর্তে পড়ে প্রাণ না হারান! নিজেকে বার বারই বোঝান, দরকার হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শব্দ করে করে বলুন, এই পৃথিবীর আপনাকে দরকার। আপনাকে ভালো থাকতে হবে। আপনি ভালো থাকলে আপনার নিজের ও অন্য অনেকেরই বাঁচতে সুখ সুখ লাগবে। দুঃখ ও বিষাদ আপনার বন্ধু নয়। ওদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। দূরে সরিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার করুন, যদি সেগুলি কারও কোনও ক্ষতি না করে। এ নিয়ে এক নিজের মন বাদে অন্য কারও কথাই শুনবেন না, কানেই নেবেন না। আপনি দুঃখে দুঃখে মরে গেলেও কারও কিছু এসে যায় না।
  
 নিজেকে স্পষ্টস্বরে জানিয়ে দিন, এরকম বিমর্ষ থেকে যাবার জন্য আপনার জন্ম হয়নি। আপনিও ভালো কিছু করার ও পাবার সমস্ত যোগ্যতা রাখেন। আপনি যা ছিলেন এবং যা আছেন, তার চাইতে অনেক দারুণভাবে বাঁচতে আপনিও পারবেন। নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেন না, নিজেকে নিজেই শক্ত করে ধরে রাখুন। হাত বাড়িয়ে কাউকে না পেলে নিজেই নিজের দিকে সাহায্যের হাতটা বাড়ান। ভাববেন না, আপনার জন্যও জীবন অনেক কিছু রেখে দিয়েছে, যা সে আর কাউকেই দেয়নি, দেবেও না।
  
 সময়ের খেলার উপর ভরসা রাখুন। সকল ধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকুন। নিজের মনের শক্তিটাকে ক্রমেই বৃদ্ধি করুন। মনে রাখবেন, নিজেকে খারাপ রেখে সবাইকে ভালো রাখার সত্যিই কোনও মানে নেই। নিজের মনটা খারাপ করে রেখে সবার মন ভালো করার দায়িত্ব আপনাকে কেউ দেয়নি। নিজেকে ভালো রাখতে চেষ্টা করুন সবার আগে। যে নিজেকে ভালো রাখতে জানে না, সে একসময় অন্যকে ভালো রাখতেও একদমই ভুলে যায়।