দামোদর: শাস্ত্রে ও তত্ত্বে / ৯



জৈন ধর্মে এই অবস্থাই আধ্যাত্মিক সাধনার পরম লক্ষ্য—মোক্ষ বা নির্বাণ। সেখানে জ্ঞান ও কর্মের সব দ্বন্দ্ব লুপ্ত হয়ে যায়; আত্মা থাকে কেবল নিজের প্রকৃত স্বচ্ছতায়—অখণ্ড, নিরাকুল (উদ্‌বেগহীন, শান্ত বা প্রশান্ত), চিরজাগ্রত এবং অসীম করুণায় পূর্ণ।

জৈন ধর্মে জ্ঞানচর্চা মানে বই পড়া নয়, বরং আত্মাকে শুদ্ধ করা। প্রতিটি পাঠ, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি তর্ক হলো অন্তরের ধূলি ঝেড়ে ফেলার এক-একটি উপায়। গুরু ও শিষ্যের মধ্যে তত্ত্বআলোচনা মানে দু-জনের মিলিত আত্মশিক্ষা—একজনের প্রশ্নে অন্যজনের জাগরণ ঘটে। ধীরে ধীরে শাস্ত্র, দর্শন ও আত্মোপলব্ধি একে অপরের মধ্যে মিশে যায়, আর সন্ন্যাসী উপলব্ধি করেন—জ্ঞান মানে না-জানা জিনিস অর্জন করা নয়, বরং নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা জ্যোতিকে জাগিয়ে তোলা।

তখনই জ্ঞান হয়ে ওঠে মুক্তির সোপান, দর্শন পরিণত হয় দৃষ্টিশুদ্ধিতে, আর আচরণ রূপ নেয় করুণার নিস্তব্ধ স্রোতে। এই সম্পূর্ণ চর্চাই জৈন সাধকের জীবনের কেন্দ্র—যেখানে চিন্তা, কথা ও কর্ম একই সুরে মিশে যায়, আর আত্মা ধীরে ধীরে ফিরে পায় তার নিজস্ব, অসীম, স্বচ্ছ আলো।

এই সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য ব্রহ্মচিন্তা নয়, বরং আত্মচিন্তা—কারণ জৈন দর্শনে কোনো সর্বব্যাপী সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্ম নেই। এখানে ধ্যানের কেন্দ্রে থাকে আত্মা নিজেই—যে-আত্মা অসীম জ্ঞান, দর্শন, সুখ ও শক্তিতে পরিপূর্ণ। সন্ন্যাসীরা গভীর ধ্যানের মাধ্যমে চেষ্টা করেন নিজের আত্মাকে সেই মূল অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করাতে, যেখানে কোনো কষায় বা কার্মিক বন্ধন নেই। এই আত্মানুসন্ধানের মধ্যেই তাঁরা অনুভব করেন যে, জীবমাত্রই পবিত্র, সমান ও চিরন্তন—কোনো প্রাণ অন্য প্রাণের চেয়ে উচ্চ নয়, নিম্ন নয়। এই চেতনা থেকেই জন্ম নেয় অহিংসা, করুণা ও সমতা—জৈন জীবনের মূল নীতি।

এই আত্মমুখী অনুশীলনের চূড়ান্ত ফল হলো মোক্ষ—যা সংসারচক্র থেকে চিরমুক্তি। আত্মা তখন সমস্ত কর্মবন্ধন ত্যাগ করে শুদ্ধ অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেখানে না আছে জন্ম, না আছে মৃত্যু, না আছে আনন্দ, না আছে বেদনা—আছে শুধুই বিশুদ্ধ চৈতন্যের দীপ্তি।

বর্ষাবাসের এই সময় তাই জৈন সন্ন্যাসীদের কাছে এক পবিত্র তপস্যার ঋতু—যেখানে প্রকৃতির মতোই আত্মাও ধুয়ে-মুছে নবীন হয়। বৃষ্টি যেমন পৃথিবীর ধূলি মুছে দেয়, তেমনি আত্মশুদ্ধি, প্রতিক্রমণ ও আত্মচিন্তা আত্মার মলিনতা দূর করে তাকে তার স্বরূপ জ্যোতিতে ফিরিয়ে দেয়। এই নিস্তব্ধতা, এই অন্তর্মুখতা, এই আত্মস্মরণই জৈন দর্শনের অন্তর্লীন বার্তা—মুক্তি বাইরের নয়, অন্তরের নীরবতায় লুকিয়ে।

এই সময়ে সন্ন্যাসীরা কঠোর সংযম পালন করেন। মিতাহার, মৌনব্রত, ব্রহ্মচর্য এবং অন্যান্য ব্রত পালনের মাধ্যমে তাঁরা দৈহিক ও মানসিক শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। এটি তাঁদের আধ্যাত্মিক যাত্রায় অবিচল থাকতে এবং বাইরের জগতের প্রলোভন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সাহায্য করে। এই নির্জনতা ও তপস্যা তাঁদের মনকে শান্ত ও স্থির করে তোলে, যা গভীর ধ্যানের সহায়ক হয় এবং ব্রহ্মোপলব্ধির পথ সুগম করে।

বৌদ্ধ ও জৈন উভয় ধারাতেই তাই এই বর্ষাকাল এক আধ্যাত্মিক সংযম ও অন্তর্দর্শনের ঋতু—যেখানে বাইরে প্রকৃতি থেমে যায়, আর ভেতরে মন থেমে যায় দ্বন্দ্বে। চাতুর্মাস, বর্ষাবাস বা বর্ষাকাল—সব ক্ষেত্রেই এই সময়ের মূল সুর একই: চলমান জীবন থেকে সাময়িক বিরতি, আত্মদর্শনের জন্য নিজস্ব আশ্রয়ে ফিরে আসা।

চাতুর্মাস শুধু হিন্দু ঐতিহ্যের কোনো ধর্মীয় আচারের ধারাবাহিকতা নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার এক অভিন্ন স্রোত, যেখানে বেদান্ত, বৌদ্ধ, জৈন—সব ধারাই প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে মানুষের চেতনার একাত্মতা উপলব্ধি করেছে। বর্ষার নিস্তব্ধতা এখানে হয়ে ওঠে আত্মার নীরবতা, আর আত্মসংযমের এই চার মাস যেন এক অন্তর্জাগরণের প্রস্তুতিমূলক ঋতু—যেখানে দেবতা, বুদ্ধ, আর জীব—সবাই নীরবে বিশ্রাম নেন, জাগরণের অপেক্ষায়।

দার্শনিকভাবে এই চার মাস হলো চেতনার ঋতুচক্রের অভ্যন্তরীণ বৃষ্টি। যেমন আকাশে মেঘ জমে মাটিকে সিক্ত করে, তেমনি মনের আকাশে জমে থাকা ক্লান্তি, অহং, অস্থিরতা এই সময় ধীরে ধীরে ধুয়ে যায়। ভক্তি-শাস্ত্র বলে—“বহির্গমন কমাও, অন্তঃযাত্রা বাড়াও”—অর্থাৎ, এই সময় বাইরের কোলাহল থেকে সরে এসে নিজের ভেতরের আলোকে পরিশুদ্ধ করা উচিত। তাই চাতুর্মাসে বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, নতুন উৎসব ইত্যাদি শুভকর্ম সীমিত থাকে; পরিবর্তে চলে নিয়মনিষ্ঠ আচার, উপবাস, পাঠ, সেবা ও আত্মসংযম।

এই সময়ের সাধনার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেহ ও মন—দুইয়েরই বিশ্রাম ও পুনর্গঠন। আহারবিধি তাই পরিবর্তিত হয়: অনেকে পেঁয়াজ-রসুন, বেগুন, মাশরুম, মাছ-মাংস ইত্যাদি বর্জন করেন; কেউ কেউ একবেলা আহার গ্রহণ করেন। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে প্রতিটি মাসে নির্দিষ্ট নিষেধ পালিত হয়—আষাঢ়ে সবুজ শাক বর্জন, শ্রাবণে দই, ভাদ্রে দুধ, আশ্বিনে মাষকলাইয়ের ডাল—এইভাবে। এর পেছনে শুধু ধর্ম নয়, আয়ুর্বেদীয় যুক্তিও আছে—বর্ষার আর্দ্রতায় হজমশক্তি দুর্বল হয়, তাই হালকা ও সহজপাচ্য আহারই প্রাধান্য পায়।

তত্ত্বগতভাবে চাতুর্মাসের ভাব হলো—চেতনার মধ্যে একটি অন্তর্মুখী ঋতু সৃষ্টি করা। যখন প্রকৃতি বৃষ্টিতে পরিশুদ্ধ হয়, তখন মনও পরিশুদ্ধ হতে চায়। তাই এই সময়কে বলা হয়েছে “নিয়মের ঋতু”—যেখানে সংযম, শুদ্ধতা, সত্যবাদিতা, অল্পভাষিতা, সেবা ও ভক্তি প্রধান। ভগবানের যোগনিদ্রা এখানে একটি প্রতীকমাত্র: ঈশ্বর স্বয়ং বিশ্রামে, তাই মানুষকেও নিজের কর্মব্যস্ততা কমিয়ে অন্তরের ভক্তি ও মনোযোগ জাগাতে হবে।

চাতুর্মাসের গভীর অর্থ কোনো ঋতুচক্রের ধর্মীয় বিধিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানবচেতনার এক অন্তর্জাগরণের প্রক্রিয়া, যেখানে বিরতি মানে স্থবিরতা নয়—বরং আত্মসন্ধানের সূক্ষ্ম গতি। এই চার মাসের নিঃস্তব্ধতা যেন সেই অন্তরাল, যেখানে বাইরের শব্দ নিঃশেষ হয়ে ভেতরের ধ্বনি শোনা যায়। কঠোপনিষদে (১.২.২৩) এবং মুণ্ডকোপনিষদেও (৩.২.৩) সামান্য পরিবর্তিত রূপে পাওয়া যায়—“নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো”—এই আত্মাকে কেবল (শাস্ত্রের) উপদেশ বা প্রবচনের দ্বারা লাভ করা যায় না, বুদ্ধি বা মেধার দ্বারাও নয়, আর প্রচুর শাস্ত্র পাঠ (বহু শোনা)-এর দ্বারাও নয়। যাকে এই আত্মা নিজে বরণ করেন, (তাকে দিয়েই) তাকে লাভ করা যায়; (কারণ) তার কাছে এই আত্মা নিজের স্বরূপকে প্রকাশ করেন।

আত্মা কোনো বক্তৃতা, কোনো বাহ্য সাধনে ধরা দেয় না; সে ধরা দেয় নীরবতায়, যেখানে জানা ও না-জানার দ্বন্দ্ব থেমে যায়। চাতুর্মাসের মূল আহ্বান এই নীরবতাতেই—এক মানসিক প্রত্যাহার, এক অন্তর্মুখ প্রতিসরণ, যেখানে মন নিজের উৎসের দিকে ফিরে যেতে শেখে।

যখন শাস্ত্র বলে, বিষ্ণু এই সময়ে যোগনিদ্রায় প্রবেশ করেন, তখন সেটি কোনো পুরাণগল্পের প্রতীকমাত্র নয়। “যোগনিদ্রা” আসলে চেতনার এক গভীর সমতা—যেখানে সত্ত্ব, রজস, তমস এই তিন গুণের ঢেউ মিশে যায় এক নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তিতে। আধুনিক নিউরোথিওলজির দৃষ্টিতে, এটি স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের (Autonomic Nervous System বা ANS) একটি প্রধান শাখা প্যারাসিমপ্যাথেটিক বা পরা-সহানুভূতিশীল সিস্টেমের কার্যপ্রবাহ। প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র শরীরের "বিশ্রাম ও হজম" (Rest and Digest) প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটি সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রের (Sympathetic Nervous System, যা "লড়াই বা পালানো" অর্থাৎ "Fight or Flight" মোডে কাজ করে) বিপরীতভাবে কাজ করে।

মন-দেহের স্নায়ুবিন্যাস সেই মুহূর্তে শান্ত হয়, মস্তিষ্কের হাইপারঅ্যাক্টিভিটি কমে যায়, এবং মানব-চেতনা “বিষ্ণু”—অর্থাৎ সর্বব্যাপী সচেতনতার—মন্দিরে আশ্রয় পায়। এই নিদ্রা কোনো অচেতনতা নয়; এটি সেই জাগরণ, যাকে উপনিষদে বলা হয়েছে “যঃ সুপ্তেষু জাগর্তি কামং কামং পুরুষো নির্ম্মাণঃ। তদেব শুক্রং তদ্ ব্ৰহ্ম তদেবামৃতমুচ্যতে।।” (কঠোপনিষদ ২.২.৮)—যিনি সকলের নিদ্রাকালেও জাগ্রত থাকেন (অর্থাৎ, সকল জীবের মন যখন সুষুপ্তির কারণে নিষ্ক্রিয়, তখনও যিনি সচেতন থাকেন), সেই পুরুষই (পরমাত্মা) এক-একটি কামনা (ইচ্ছা বা ভোগ) অনুসারে (জীবের জন্য) বিভিন্ন রূপ বা বিষয় সৃষ্টি করেন। তিনিই বিশুদ্ধ (শুক্র), তিনিই ব্রহ্ম এবং তাঁকেই অমৃত (অবিনশ্বর) বলা হয়।

চাতুর্মাস তাই বহির্বিশ্ব থেকে প্রত্যাহারের অনুশীলন—বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস, জৈন সন্ন্যাসীদের প্রতিক্রমণ বা যোগীর প্রাত্যাহার—সব একই অভিপ্রায়ে বাঁধা: ভেতরের আসন পুনরুদ্ধার করা।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে চাতুর্মাস হলো এক ধরনের আত্ম-সংযম ও মানসিক পুনর্গঠনের সময়কাল—এক অন্তর্মুখ আশ্রয়, যেখানে মানুষ নিজের সঙ্গে নিজের পুনরায় দেখা করে। আধুনিক মনস্তত্ত্ব যাকে বলে “self-regulation,” অর্থাৎ আবেগ, চিন্তা ও আচরণের ভারসাম্য রক্ষা, চাতুর্মাস সেই প্রক্রিয়াকে ধর্মীয় ও ধ্যানমূলক রূপে রূপান্তরিত করে।

ফ্রয়েডের ভাষায়, যে-“repression” বা মানসিক চাপ দমন মানুষের অবচেতনে বিকৃতি সৃষ্টি করে, চাতুর্মাস সেই দমিত শক্তিকেই সচেতন করে তোলে মুক্তির উপায় হিসেবে। এখানে দমন নয়, আত্মবীক্ষণই পথ—যেখানে মন নিজের অন্ধকার অংশগুলিকে চিনে আলোতে নিয়ে আসে। ইয়ুং এই প্রক্রিয়াকে বলেছিলেন “introversion,” অর্থাৎ আত্মার ছায়ার সঙ্গে সংলাপ—নিজের গোপন মানসিক স্তরগুলির মুখোমুখি দাঁড়ানো, তাদের প্রত্যাখ্যান না করে বোঝা ও রূপান্তর করা। রজার্সের “unconditional positive regard,” যে-মনোভাব মানুষকে নিজের প্রতি সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা শেখায়, এখানে হয়ে ওঠে আত্ম-সহানুভূতির অনুশীলন—নিজের অসম্পূর্ণতাকে মেনে নেওয়া, বিচার না করে বোঝা।

আর মস্‌লো-র “self-actualization” বা আত্ম-সিদ্ধির ধারণা এখানে মেলে সেই নীরব মুহূর্তে, যখন করুণা নিজের ভিতরে শ্বাস নিতে শেখে—যেখানে মানবচেতনাই নিজের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে চিনে ফেলে। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় মন ধীরে ধীরে হালকা হয়, আকাঙ্ক্ষা ও ভয় কমে যায়, চেতনা নিজের ভেতরে এক গভীর সাম্য খুঁজে পায়। তখন আচরণ বদলে যায়—অহংকারের স্থানে জন্ম নেয় সমানুভূতি, প্রতিক্রিয়ার বদলে আসে উপলব্ধি, আর আত্মা নিঃশব্দে শেখে কীভাবে জানা, থাকা ও ভালোবাসা এক হয়ে যায়।

জৈন দর্শনে এই আত্মসংযমই “সম্যগ্‌চারিত্র”—যেখানে প্রতিটি ক্রিয়া, বাক্য, মনোভাব এক নীরব করুণার শৃঙ্খলায় বাঁধা। চাতুর্মাসের সাধক এই সময়ে কষায়—”ক্রোধ, মান, মায়া, লোভ”-এর আগুন নিভিয়ে ফেলে। “অপরিগ্রহ” কেবল বস্তু ত্যাগ নয়, আকাঙ্ক্ষার মৃদু বিলয়; “অহিংসা” মানে শুধু আঘাত না করা নয়, প্রতিটি মুহূর্তে সহিষ্ণুতার চর্চা। এই সংযমই আত্মার ধুলো ঝরায়—যেমন আয়না নিজে আলো দেয় না, কিন্তু ধুলো সরলে তার প্রতিফলন আবার দীপ্ত হয়। তখন আত্মা নিজের কেবলজ্ঞান—অপ্রতিহত প্রত্যক্ষ—রূপে ঝলসে ওঠে, যেখানে জানার আর কোনো বাহ্য প্রয়োজন থাকে না, কারণ জানা ও জ্ঞানী একীভূত হয়ে গেছে।

বৌদ্ধ মননে এই আত্ম-প্রতিসরণকে বলা হয় “নিব্বান”—নির্বাণ, অর্থাৎ দহন থেমে যাওয়া। আগুন এখানে নিভে যায় বলে নয়, বরং কারণ দাহের উপাদান—তৃষ্ণা ও অহংকার—শেষ হয়ে যায়। এই অবস্থা কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে প্রকাশ পায় “চিদ্‌বিলাস”—চেতনার নিজের ভেতর খেলা হিসেবে। অভিনবগুপ্ত বলেন, “চেতনা নিজেকেই রস করে”—এই রসই আনন্দ, যা বেদান্তে “সচ্চিদানন্দ” (সৎ-চিত্‌-আনন্দ) নামে পরিচিত—অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দের অবিচ্ছেদ্য ঐক্য। যখন “আমি” আর “আমার অভিজ্ঞতা” এই দ্বৈততা বিলীন হয়, তখন চেতনা নিজের স্বরূপে ফিরে আসে—যা অদ্বৈত। “ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা” তখন কোনো নেতিবাচন নয়; এটি এক জাগরণ—যেখানে সত্য ও মায়া, শিব ও শক্তি, দর্শক ও দর্শন—সব একই প্রবাহে মিশে যায়।

এই অবস্থায় ধর্ম কোনো আচার নয়, কোনো তত্ত্বও নয়; এটি এক জীবন্ত বিজ্ঞান—চেতনার বায়োলজি, যা আধুনিক নিউরোসায়েন্সেও প্রতিধ্বনিত। যখন মস্তিষ্কের সামনের অংশ (প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) মনোযোগ ও সচেতনতা ধরে রাখে, তখন আবেগ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র (অ্যামিগডালা) শান্ত হয়, আর আনন্দ ও প্রশান্তির হরমোন (ডোপামিন ও সেরোটোনিন) ভারসাম্যে আসে। ফলে মন স্থির, শান্ত ও সুখী অনুভব করে।