জৈন দর্শনের এই ত্রয়ী কোনো বিতর্ক-কৌশল নয়, একটি জীবন-কৌশল। অনেকান্তবাদ আমাদের চোখ বড়ো করে, নয়বাদ পা মাটিতে গেঁথে দেয়, আর স্যাদ্বাদ জিভে বিনয় আনে। চোখ প্রসারিত, পা স্থির, জিভ নম্র—এই ত্রিসংযমেই সম্যগ্দর্শন টেকে, সম্যগ্জ্ঞান ধারালো হয়, আর সম্যগ্চারিত্র দৈনন্দিন ব্যবহারে দীপ্যমান থাকে। তখন সত্য কোনো বৈরি শাসন নয়, বরং এক সহচর—যার কাছে যেতে হলে আমাদের কণ্ঠে বিনয়, বুদ্ধিতে শৃঙ্খলা, আর হৃদয়ে সহিষ্ণুতা রাখতে হয়।
এসব নীতির আলোয় জ্ঞানচর্চা একপ্রকার আধ্যাত্মিক সংযমে পরিণত হয়। কেউ যখন শাস্ত্র পাঠ করে, সে কেবল তথ্য সংগ্রহ করে না; নিজের চিন্তাকে পরিশীলিত করে, অজ্ঞানতার আবরণ পাতলা করে। এই শিক্ষার ফলেই ক্রমে আত্মায় উন্মোচিত হয় সেই আলোকিত চৈতন্য, যাকে বলা হয় কেবলজ্ঞান—সব আবরণ ঝরার পর আত্মার স্বাভাবিক সর্বজ্ঞ দীপ্তি। যদিও এটি চূড়ান্ত সাধকের লক্ষ্য, তথাপি প্রতিটি সৎ জ্ঞানচর্চাই আত্মাকে সেই দিকে অগ্রসর করে।
কেবলজ্ঞান (Kevala-jñāna) জৈন দর্শনের সর্বোচ্চ জ্ঞানাবস্থা—যেখানে আত্মা সমস্ত কার্মিক আবরণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে, নিজের অসীম স্বরূপে দীপ্ত হয়ে ওঠে। ‘কেবল’ শব্দের অর্থ “সম্পূর্ণ” বা “অখণ্ড,” আর ‘জ্ঞান’ মানে “উপলব্ধি”। অর্থাৎ, কেবলজ্ঞান হলো সেই অবস্থান, যেখানে আত্মা সীমাহীন জ্ঞানে উদ্ভাসিত—কোনো প্রতিবন্ধকতা, অজ্ঞান বা বিকৃতি ছাড়াই সমস্ত বাস্তবতাকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করে।
জৈন দর্শনের মতে, প্রতিটি জীবাত্মাই স্বভাবে সম্পূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ও দীপ্তিমান। তার প্রকৃত স্বরূপ অনন্ত জ্ঞান (অসীম জানা), অনন্ত দর্শন (অসীম দেখা), অনন্ত শক্তি (অসীম সামর্থ্য) এবং অনন্ত সুখ বা আনন্দ (অসীম শান্তি) দ্বারা নির্ধারিত। অর্থাৎ, আত্মা নিজে-নিজেই এক নিখুঁত জ্যোতিষ্ক, যার মধ্যে জ্ঞান, দর্শন, শক্তি ও আনন্দের উৎস নিজস্ব স্বরূপেই নিহিত। কিন্তু সংসারে আবদ্ধ অবস্থায় আমরা এই দীপ্তিকে সরাসরি অনুভব করতে পারি না, কারণ আত্মার উপর জমে থাকে এক সূক্ষ্ম ও গভীর স্তর—কার্মিক পদার্থের আচ্ছাদন, যা আত্মার প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতাকে আড়াল করে রাখে।
জৈন শাস্ত্রে এই আচ্ছাদনকে বলা হয় কর্মাশ্রবণ ও বন্ধ। “আশ্রবণ” মানে কর্মপদার্থের প্রবেশ; আর “বন্ধ” মানে সেই পদার্থের সঙ্গে আত্মার বন্ধন। জীব যখন অজ্ঞান, আসক্তি, ক্রোধ, লোভ, মান বা মায়ার বশে চিন্তা করে, কথা বলে বা কাজ করে—তখন সেই বিকারময় গতি আত্মার সূক্ষ্ম পরিসরে কর্মপদার্থকে টেনে আনে। এই পদার্থগুলি আত্মার উপর স্তরে স্তরে জমে যায়, যেমন নির্মল আয়নার উপর ধুলোর আস্তরণ পড়লে তার প্রতিফলন নিস্তেজ হয়ে যায়। আয়না নিজে অন্ধকার নয়, কিন্তু তার উপর জমা ধুলো তাকে আলোর প্রতিফলন থেকে বঞ্চিত করে। আত্মাও তেমনি অজ্ঞান নয়; কিন্তু কার্মিক অশুচিতা তার জ্ঞান ও আনন্দকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
এই অবস্থায় মানুষ যতই চিন্তা, যুক্তি, অধ্যয়ন বা ধর্মাচরণ করুক—যতক্ষণ না আত্মা নিজের এই ধুলো সরাতে পারে, ততক্ষণ সত্য উপলব্ধি সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তাই জৈন সাধনার মূল লক্ষ্য হলো এই কার্মিক আবরণ ঝরানো। গুপ্তি, সমিতি, তপ, প্রতিক্রমণ, উপবাস, দান—এই সমস্ত অনুশীলন আসলে আত্মাকে হালকা করার প্রক্রিয়া; প্রতিটি সংযম, প্রতিটি সহিষ্ণুতা ধীরে ধীরে একটি সূক্ষ্ম কর্মকণাকে আলগা করে দেয়। যেমন বায়ুর মৃদু প্রবাহে আয়নার ধুলো ক্রমে উড়ে যায়, তেমনি সংযম ও সচেতনতার হাওয়ায় আত্মার আসল দীপ্তি ফুটে ওঠে।
যখন এই কার্মিক আবরণ সম্পূর্ণ বিলীন হয়, তখন আত্মা নিজের প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়—যেখানে আর কিছু জানার বাকি নেই, কিছু দেখার সীমা নেই, কোনো ইচ্ছা বা বন্ধন অবশিষ্ট থাকে না। এই অবস্থাই কেবলজ্ঞান—আত্মার স্বরূপে সম্পূর্ণ জাগরণ, যেখানে জ্ঞান আর বাহ্য উৎস থেকে আসে না; আত্মা নিজেই জ্ঞানের অক্ষয় উৎস হয়ে ওঠে।
সাধনার উদ্দেশ্য সেই ধুলো সরানো—অর্থাৎ কষায় (ক্রোধ, মান, মায়া, লোভ)-এর বিকারকে ক্ষয় করা, গুপ্তি-সমিতি-তপস্যা-প্রতিক্রমণের মতো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনে আত্মাকে হালকা করা। ধীরে ধীরে কর্মফল ঝরে গেলে আত্মা তার নিজস্ব উজ্জ্বল জ্ঞানরূপে ফিরে আসে—এবং সেই পরিপূর্ণ অবস্থা-ই কেবলজ্ঞান।
এই জ্ঞান কোনো ইন্দ্রিয়নির্ভর নয়, কোনো চিন্তাপ্রক্রিয়ার ফলও নয়। এটি অপ্রতিহত প্রত্যক্ষ—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, সূক্ষ্ম ও স্থূল, নিকট ও দূর—সব একসঙ্গে আত্মার অন্তর্জ্যোতিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জৈন তত্ত্ব অনুযায়ী, কেবলজ্ঞানী আত্মা “সর্বজ্ঞ” বা সর্বদর্শী; তাঁর উপলব্ধিতে আর কোনো সীমা বা অন্ধকার থাকে না। কিন্তু এই সর্বজ্ঞতা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পায় না জাগতিক ইন্দ্রিয় দিয়ে—এটি সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ, নিঃশব্দ, সর্বব্যাপী চৈতন্যের দীপ্তি।
“অপ্রতিহত প্রত্যক্ষ” (Apratihata Pratyakṣa) জৈন দর্শনের এক সূক্ষ্ম ও গভীর পরিভাষা, যা কেবলজ্ঞান—অর্থাৎ পরিপূর্ণ জ্ঞানাবস্থার—স্বভাব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। শব্দটি দুটি অংশে গঠিত—“অপ্রতিহত” অর্থ “যা কোনো বাধায় থামে না,” আর “প্রত্যক্ষ” মানে “সরাসরি উপলব্ধি” বা তৎক্ষণিক, মধ্যস্থতাহীন জ্ঞান।
“অপ্রতিহত প্রত্যক্ষ” বলতে বোঝানো হয় এমন জ্ঞান, যা কোনো ইন্দ্রিয়, মন, ভাষা, স্থান, কাল বা উপকরণের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়—যা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সরাসরি সমস্ত বাস্তবতাকে একসঙ্গে উপলব্ধি করে। এটি এমন এক অন্তর্জ্যোতি, যা কোনো মুহূর্তে নয়—বরং সময়ের ঊর্ধ্বে—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাকে একসঙ্গে প্রতিফলিত করে।
সাধারণ জীবনের জ্ঞান সবসময় প্রতিহত (বাধাপ্রাপ্ত)—আমরা চোখে দেখি, কানে শুনি, মনে বিশ্লেষণ করি, তারপর কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধ; মন ক্লান্ত বা পক্ষপাতদুষ্ট; ভাষা অসম্পূর্ণ; ফলে আমাদের জানা সবসময় আংশিক, ভাঙা এবং বিলম্বিত। এই আংশিকতার কারণেই অজ্ঞান (অবিদ্যা) ও বিভ্রান্তি জন্ম নেয়।
কিন্তু যখন আত্মা সমস্ত কার্মিক আচ্ছাদন (জ্ঞানাবরণ, দর্শনাবরণ, মোহনীয় ও অন্তরায় কর্ম) ঝরিয়ে ফেলে, তখন তার অন্তর্গত জ্ঞানধারা আর কোনো বাধার মুখে পড়ে না। তখন জ্ঞান নিজের প্রকৃতিতে অপ্রতিহত, অর্থাৎ অবাধ, পূর্ণ, অসীম হয়ে ওঠে। আর যেহেতু তা আত্মার স্বরূপ থেকেই প্রকাশিত, কোনো বাহ্য ইন্দ্রিয় বা বুদ্ধির মধ্যস্থতা ছাড়াই, তাই তা প্রত্যক্ষ—অর্থাৎ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সরাসরি উপলব্ধি।
এই অবস্থায় জ্ঞান আর “কিছু জানা” নয়—এটি সব জানা, কিন্তু কোনো প্রয়াস ছাড়াই। যেমন সূর্য আলোক দেয়, অথচ আলোকিত করার জন্য আলাদা কিছু করে না; তেমনি কেবলজ্ঞান আত্মার স্বাভাবিক দীপ্তি, যা কোনো সীমা বা প্রতিবন্ধকতা মানে না।
জৈন দর্শনে কার্মিক আচ্ছাদন (Karmic coverings) বা কর্মাবরণ মানে হলো সেই সূক্ষ্ম পদার্থ বা শক্তি, যা আত্মার স্বাভাবিক দীপ্তি—অসীম জ্ঞান, দর্শন, শক্তি ও আনন্দ—আবৃত করে রাখে। আত্মা নিজে প্রকৃতিগতভাবে শুদ্ধ, স্বপ্রকাশমান এবং অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন; কিন্তু কর্ম (karma) নামের এক সূক্ষ্ম দেহতুল্য পদার্থ তার চারপাশে জমে গিয়ে তাকে সীমাবদ্ধ করে তোলে। এই কার্মিক পদার্থকে বলা হয় কর্মদ্রব্য—যা আত্মার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে তাকে সংসারে আবদ্ধ রাখে।
এই কর্মের অনেক প্রকারভেদ আছে, কিন্তু আত্মার দীপ্তিকে বিশেষভাবে আচ্ছন্ন করে চারটি প্রধান কর্ম—
১. জ্ঞানাবরণ কর্ম (Jñānāvaraṇa Karma): এটি জ্ঞানের উপর ঢেকে থাকা প্রথম পর্দা। আত্মার স্বভাবই হলো জানা—কিন্তু এই কর্ম সেই “জানার আলো”-কে বাধা দেয়। এর ফলে আমরা সব কিছু জানতে পারি না; জানলেও ভুল বা অসম্পূর্ণ জানি। যেমন মেঘ সূর্যের আলো কমিয়ে দেয়, তেমনি জ্ঞানাবরণ কর্ম আত্মার জ্ঞানশক্তিকে ম্লান করে দেয়। এর পাঁচটি স্তর বলা হয়েছে—ইন্দ্রিয়নির্ভর (মতি), শ্রুতি, অবধি (দূরদর্শী), মনঃপর্যায় (অন্যের মন জানা) এবং কেবলজ্ঞান (অসীম জ্ঞান)। এই কর্ম যত ক্ষয় হয়, জ্ঞানের পরিধি তত প্রসারিত হয়; সম্পূর্ণ ক্ষয়ে গেলে আত্মা কেবলজ্ঞান লাভ করে।
২. দর্শনাবরণ কর্ম (Darśanāvaraṇa Karma): ‘দর্শন’ মানে দেখা বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এটি জ্ঞান থেকে সূক্ষ্মতর স্তর—যে-মুহূর্তে জানার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তার আগের অবস্থাই দর্শন। এই কর্ম আত্মার “দেখার” ক্ষমতাকে ঘোলাটে করে দেয়; ফলে বাস্তবতা আমাদের কাছে ঝাপসা, অসম্পূর্ণ বা বিকৃতভাবে ধরা পড়ে। যেমন কুয়াশায় বস্তু স্পষ্ট দেখা যায় না, তেমনি দর্শনাবরণ কর্ম আমাদের দৃষ্টিকে বাধা দেয়।
৩. মোহনীয় কর্ম (Mohanīya Karma): এটি সবচেয়ে সূক্ষ্ম কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী আচ্ছাদন। ‘মোহনীয়’ মানে যা মোহ বা বিভ্রম সৃষ্টি করে। এই কর্ম আত্মাকে নিজের প্রকৃত স্বরূপ থেকে বিভ্রান্ত করে—তাকে রাগ, দ্বেষ, অহং, আসক্তি, ভয়, লোভ এবং ভুল বিশ্বাসে আবদ্ধ রাখে। এর দুটি প্রধান ভাগ—দর্শন মোহনীয় (ভুল বিশ্বাস বা মিথ্যা দর্শন সৃষ্টি করে) এবং চারিত্র মোহনীয় (নৈতিক আচরণে বিকৃতি আনে)। মোহনীয় কর্মই সংসারচক্রের মূল কারণ, কারণ এটি মানুষকে পাপ ও পুনর্জন্মের পথে টেনে রাখে। যখন মোহনীয় কর্ম সম্পূর্ণ ক্ষয় হয়, তখন আত্মা “অরিহন্ত”—অর্থাৎ অন্তরশত্রুদের বিজেতা—হয়ে ওঠে।
৪. অন্তরায় কর্ম (Antarāya Karma): ‘অন্তরায়’ মানে বাধা। এটি আত্মার প্রাকৃতিক শক্তিকে ব্যাহত করে—দান, উপভোগ, পুনঃসৃষ্টিশক্তি বা ভোগসুখের ক্ষমতাকে আটকে দেয়। কেউ দান করতে চায় কিন্তু পারে না, ক্ষমা করতে চায় কিন্তু মন টেনে ধরে—এ সব অন্তরায় কর্মের ফল। এই কর্ম আত্মার স্বাধীনতা ও প্রেরণাকে দমিয়ে রাখে। যখন এটি ক্ষয় হয়, তখন আত্মার শক্তি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হতে থাকে—আর বাধা বলতে কিছুই থাকে না।
এই চারটি কর্ম মিলে আত্মার ওপর এমন একটি সূক্ষ্ম পর্দা ফেলে, যার কারণে আত্মার অসীম জ্ঞান, দর্শন, আনন্দ ও শক্তি আংশিকভাবে প্রকাশিত হয়। জৈন তত্ত্ব বলে—যখন সাধনা, সংযম, তপ, ধ্যান, প্রতিক্রমণ, দান ও করুণার দ্বারা এই কর্মগুলি ক্রমে ক্ষয় হয়, তখন আত্মা ধীরে ধীরে তার আসল রূপে ফিরে আসে।
এমন অবস্থায় আত্মা আর অন্ধকারে নয়; জ্ঞানাবরণ সরলে সব কিছু জানা যায়, দর্শনাবরণ সরলে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়, মোহনীয় কর্ম ক্ষয়ে গেলে আসক্তি ও দ্বেষ হারায়, আর অন্তরায় কর্ম নিঃশেষ হলে আত্মা নিজের অসীম শক্তিতে অবাধ হয়ে ওঠে।
এই অবস্থাতেই আত্মা কেবলজ্ঞান (অপ্রতিহত প্রত্যক্ষ) লাভ করে—যেখানে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না; আত্মা নিজের প্রকৃত রূপে, আলোক, জ্ঞান ও আনন্দে চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জৈন আচার্য উমাস্বাতি তত্ত্বার্থসূত্র-এ বলেছেন—“কেবলজ্ঞানম্ সর্ববিষয়াবধিগমী, অপ্রতিহত, অনন্তম্।” অর্থাৎ, কেবলজ্ঞান এমন এক জ্ঞান, যা সমস্ত বস্তু, স্থান ও কালের পার্থক্য অতিক্রম করে—যা কিছু দ্বারাই প্রতিহত হয় না, এবং যা অনন্ত। এই “অপ্রতিহত প্রত্যক্ষ” তাই জৈন তত্ত্বে সর্বোচ্চ উপলব্ধি, আত্মার মুক্ত স্বরূপ, এবং মোক্ষ (মুক্তি)-র পূর্বচিহ্ন।
যে-সাধক কেবলজ্ঞান লাভ করেন, তাঁকে বলা হয় অরিহন্ত (Arihant)—যিনি ‘অরিহ’ বা অভ্যন্তরীণ শত্রুদের (কষায় ও কার্মিক অবিদ্যা) পরাস্ত করেছেন। আর যখন তাঁর দেহত্যাগ ঘটে, আত্মা সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চূড়ান্ত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাঁকে বলা হয় সিদ্ধ (Siddha)। তাই কেবলজ্ঞানকে মুক্তির পূর্ব-দ্বার বলা যায়—এটি আত্মার চূড়ান্ত জাগরণ, যেখানে জ্ঞান, দর্শন, শক্তি ও আনন্দের অসীম সম্ভাবনা একত্রে উদ্ভাসিত হয়।
একটি উদাহরণে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি—আমাদের আত্মা যেন সূর্য, আর কর্ম যেন ঘন মেঘ। যতক্ষণ মেঘ আছে, সূর্যের আলো বিচ্ছিন্ন, আংশিক; কোনো মুহূর্তে মেঘ সরে গেলে আলো নিজের পূর্ণতায় ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের “উদয়” আসলে নতুন নয়—সে সবসময়ই ছিল, কিন্তু আচ্ছাদনের কারণে অদৃশ্য ছিল। তেমনি, কেবলজ্ঞান আত্মার কোনো নতুন অর্জন নয়; এটি নিজস্ব স্বরূপের স্মরণ—চেতনার সেই দীপ্তি, যা চিরকালই নিজের মধ্যে ছিল, শুধু ভুলে গিয়েছিলাম।