ক্রাশ মানে না কোনও বয়স। যেকোনো বয়সের মানুষের উপর যেকোনো সময়েই ক্রাশ খাওয়া যায়; কারণে, কিংবা অকারণেই। কোনও বাধাই ক্রাশের সামনে এসে দাঁড়াতে পারে না—ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বয়সের, কোনও কিছুই না! অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ক্রাশ খাওয়ার সময়। মেয়েরা স্যারদের উপর, আর ছেলেরা ম্যাডামদের উপর। ক্রাশ, প্রেম, মায়া, ভাললাগা, ভালোবাসা, বিয়ে, সেক্স—-এই ৭টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ৭টি জিনিস। এদের যেকোনোটিই যেকোনোটিকে ছাড়া থাকতে পারে।
এখনও মনে আছে, ম্যাডাম কেন বয়সে আমার চাইতে বড়, এ দুঃখ নিয়ে আমি চুয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে ফিজিক্সের ক্লাস করতাম। কোনও ক্লাসে ম্যাডামের একটা লেকচারও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। ম্যাডাম পড়াতেন, আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ম্যাডাম হঠাৎ-হঠাৎ হাসতেন। আহা! সে কী হাসি! ঝর্ণার জলের ধারার মতো কলকল শব্দের সে হাসির জন্য জীবন দিয়ে দেয়া যায়! আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকতাম, কখন ম্যাডাম একটুখানি হেসে উঠবেন! মনে-মনে ঈশ্বরকে বলতাম, “ঠাকুর, ম্যাডামকে একটু হাসাও না! ম্যাডাম যদি হাসেন, আজকে তোমার মন্দিরে সন্ধ্যায় মোমবাতি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দেবো।” আমি যেদিকে বসতাম, সেদিকে যদি একবার ম্যাডামের চোখ পড়ত ভুলেও, আমি এটা ধরে নিয়ে এক ধরনের শান্তি পেতাম, ম্যাডাম যেন আমাকেই দেখছেন! অথচ, ম্যাডাম হয়তো আমাকে চিনতেনই না! একবার ম্যাডাম সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে চোট পেয়েছিলেন। আমি দূর থেকে ওটা দেখি। দেখে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। প্রতিদিনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম, যাতে উনি ম্যাডামের পায়ের ব্যথা সারিয়ে দেন। এখনও মনে আছে, আমার এক ব্যাচমেট ম্যাডামের অ্যাপিয়ারেন্স নিয়ে কিছু বাজে-বাজে শব্দ ব্যবহার করে কথা বলায় আর কোনোদিনই ওর সাথে কথা বলিনি। কথা না বলার সেই সংকোচ এখনও কাটেনি। আমি আজও ওর সাথে কথা বলতে পারি না। অল্পবয়সে কথাবলা বন্ধ করে দেয়ার অস্বস্তি সহজে কাটে না। কী সিলি, না? কিন্তু ওটাই ছিল আমার অল্পবয়সের আবেগ! অল্প বয়সের আবেগ অনেকদিন টিকে থাকে।
ম্যাডামের হাজব্যান্ডকে দেখলে কী যে রাগ হতো সে সময়! দেখলেই মনে হত, এমন কদাকার মানুষের ভাগ্যেও এমন বউ জোটে! আমার কখনোই কোনো সুন্দরীর হাজব্যান্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ডকে হ্যান্ডসাম মনে হয় না। ‘শবনম’ পড়ার পর থেকে মুজতবাকে আরও বেশি কুদর্শন মনে হয়। ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’ পড়ে সুনীলের ভুঁড়িটা আরও বেশি বিশ্রী করে চোখে পড়ত। বারবারই মনে হয়, আমিই বেটার! এসবই খেলত মনে মনে। পাগলের সুখ তো মনে মনেই! কখনোই ম্যাডামের সামনে গিয়ে কিছু বলার সাহস হয়নি আমার। ম্যাডাম আমাদের প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসও নিতেন। যখনই আমাদের গ্রুপের কাজ দেখতে আসতেন, তখনই আমার মাথা পুরোপুরি ব্ল্যাংক হয়ে যেত! একেবারে সহজ-সহজ প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারতাম না, দিলেও অবলীলায় ভুলভাল উত্তর দিতাম। ম্যাডাম হয়তো ভাবতেন, “ইসস!! ছেলেটা কী গাধা! এটাও পারে না!” গাধাই তো! গাধা না হলে কি প্রেমে পড়তাম! তাও আবার অমন নিরর্থক প্রেমে!
ম্যাডামের চেহারাটা ভারি মিষ্টি ছিল। চশমাটাও মিষ্টি ছিল। তাকানোটাও মিষ্টি ছিল। হাই তোলাটাও মিষ্টি ছিল। লজ্জা পাওয়ার ধরনটাও মিষ্টি ছিল। বকাটাও মিষ্টি ছিল। চুলগুলিও মিষ্টি ছিল। গালের গোলাপি আভাটাও মিষ্টি ছিল। কী মিষ্টি ছিল না, মনে নেই। একদিন অনেক-অনেক সাহস সঞ্চয় করে ম্যাডামের রুমে গিয়েছিলাম। যে ছেলে কখনোই ক্লাসের পড়া বাসায় গিয়ে পড়ত না, সে ছেলেটিই ২ সপ্তাহের ফিজিক্সের সব লেকচার ফটোকপি করে শুক্র আর শনিবার সারাদিন বাসায় বসে-বসে পড়েছে। চুয়েটে পড়ার সময় জীবনেও কোনোদিন কোনও সেমিস্টার ফাইনালের পড়া দুইদিন পড়িনি। শুধু উনার সাথে কথাবলার প্রস্তুতি নিতেই অতো কিছু! ম্যাডামের কাছ থেকে পড়া বুঝিয়ে নেয়ার ছুতোয় ম্যাডামের রুমে গিয়েই মাথাটা পুরোপুরি ব্ল্যাংক হয়ে গেল যখন নিজের কানে ম্যাডামকে বলতে শুনলাম, “সুশান্ত, কী খবর? বল, কেন এসেছ?” ম্যাডাম আমার নামও জানেন! কীভাবে সম্ভব! “ম্যাডাম, আমার মনে হয়, ফিজিক্স খুব ভাল জিনিস। আমাদের সবারই ফিজিক্স পড়া উচিত!” এটা বলেই, “ম্যাডাম, আমি শুধু এটা বলতে এসেছিলাম।” কথাটি ঠিক মতো বলে শেষ করার আগেই অনেকটা দৌড়ে রুম থেকে পালিয়ে আসি। ম্যাডাম আমার কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। সেদিনের পর আর কোনও দিনও ম্যাডামের চোখের দিকে তাকাতে পারিনি।
আমার কথা থাক! আমাকে দিয়ে কখনও কিছু হয়ওনি, হবেও না।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কিছু নন-ডিপার্টমেন্টাল সাবজেক্ট পড়তে হয়। এই যেমন, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথস, সোশোলজি, ইকোনমিক্স, অ্যাকাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট, এরকম আরও কী কী সব যেন! সাত্যকি স্যার ইলেকট্রিক্যালের ছিলেন না, কিন্তু উনি ওদেরকে সেকেন্ড সেমিস্টারের একটা কোর্স পড়াতেন, ইকোনমিক্সের। আরশি যখন ফার্স্ট ইয়ারে, তখন উনি ডাবল মাস্টার্স কমপ্লিট করে অলরেডি ৩ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। প্রতি ব্যাচের মতো ওদের ইকোনমিক্সটা সাত্যকি স্যারই নিতেন। আরশির চাইতে স্যারের বয়স ছিল অন্তত ১২ বছর বেশি। স্যারের মতন অতো সুদর্শন, মার্জিত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, মেধাবী, সুবক্তা, রুচিশীল, পড়ুয়া মানুষ আরশি আর কখনো দেখেনি। ‘ন হন্যতে’ উপন্যাসটি ৬বার পড়ার পরেও আবারও পড়তে ইচ্ছে করে যে মির্চা এলিয়াদের জন্য, আরশি প্রতিটি মুহূর্তেই সাত্যকি স্যারের মধ্যে সেই এলিয়াদেকে খুঁজে পায়। স্যারের ক্লাস করার সময় নিজেকে ভাবে মৈত্রেয়ী দেবী। প্রায় প্রতিদিনই ক্লাস থেকে রুমে ফিরে ব্যক্তিগত ডায়রির পাতায় স্যারকে একটা করে প্রেমপত্র লিখত আরশি। সেসব চিঠির পাতায় পাতায় কত অনুযোগ, আবদার, আহ্লাদ, প্রেম ছড়িয়ে ছিল, সেটা কেউই কোনোদিনও জানতে পারেনি।
স্যার স্টুডেন্ট হিসেবে অনেক ভাল ছিলেন। ম্যাট্রিক আর ইন্টারে ডাবল স্ট্যান্ডকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফিফ্থ আর মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলেন। স্যারের রুমের পাশেই ছিল আরশিদের স্টাডিরুম। ক্লাসনেয়া ছাড়া বাকি সময়টাতে স্যার উনার রুমে বসে-বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়তেন। অবশ্য, বেশিরভাগই অর্থনীতির বই। আরশি প্রায়ই লুকিয়ে-লুকিয়ে দূর থেকে দেখত, একজন অদ্ভুত রকমের সুন্দর মানুষ স্যামুয়েলসনে মুখ গুঁজে বসে আছেন। ওর জীবনে দেখা সবচাইতে সুন্দর দৃশ্যগুলির একটি ছিল, স্যারকে বই পড়তে দেখা। শুধু স্যারের জন্যই আরশি ক্লাস ফাঁকি দিয়েও স্টাডিরুমে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্যার যে স্টাইলে বইয়ের পাতা ওল্টাতেন, আরশিও সেই স্টাইলে বই ওল্টানোর চেষ্টা করত। প্রায় মনে-মনে ভাবত, যদি প্রতিদিনই ঘুম ভাঙলে সে দেখতে পেত, তার প্রিয় মানুষটি চুপচাপ বসে বসে বই পড়ছেন, তবে তার চাইতে সুখী এ পৃথিবীতে আর কেউ হত না। আর কিছু হোক না হোক, ঘুমভেঙে এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্যও ঘুমিয়ে পড়া যায়! এসব ভাবতে-ভাবতে আরশি ওর ব্যাগের মধ্যে মুখ লুকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকত। ভাবত, ইসস্! স্যার যদি দেখে ফেলতেন! যদি স্যারের কাছে একটু ধরা পড়ে যেত আরশি!
ওদের ব্যাচে যে কয়েকটি মেয়ে স্যারের উপর ক্রাশ খেয়েছিল, তাদের একজনকেও সহ্য করতে পারত না আরশি। ও মনে-মনে ঠিক করে ফেলেছিল, বিয়ের পর ওর যদি মেয়ে হয়, তবে মরে গেলেও মেয়ের নাম সাদিয়া, সিলভিয়া, মৌরি, নুসরাত, সঙ্গীতা রাখবে না। পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত নাম এগুলি। স্যার অবশ্য কাউকেই পাত্তা দিতেন না। তবে আরশি প্রায় সময়ই এটা বিশ্বাস করে আনন্দ পেত, স্যার বোধহয় ক্লাসে ওর চোখে চোখ পড়লেই ফিক্ করে হেসে উঠতেন। এটা ভেবে কী যে খুশি হত সে! মৌরি স্যারের সাথে একটু কথা বলার জন্য, একটুখানি সামনে যাওয়ার জন্য কত-কত বাহানা যে খুঁজত! আরও অনেকেই এরকম করত। এসব দেখলেই রাগে আরশির গা জ্বলত! মনে হত, মেয়েগুলিকে গলাটিপে মেরে ফেলতে পারলে অসীম শান্তি লাগত! সে নিজে কোনোদিনও স্যারের সামনে যেতে পারত না। অনেক দিন অনেক প্ল্যানট্ল্যান করেও শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি। শুধু দূর থেকে দেখেই শান্তি পেত। অনেকসময়ই এমন হত, ওদের সব ক্লাস শেষ, আর আরশি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কমনরুমের দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্যারকে এক পলক দেখতে! দেখতে পেলেই নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব আড়াল করে ফেলত, যাতে স্যার ওকে দেখে না ফেলেন! স্যার কোন দিন কোন সময়ে কোন করিডোরের সামনে দিয়ে যেতেন, কোথায়-কোথায় উনার ক্লাস থাকত, কোন-কোন পথে উনাকে হাঁটতে হত, এর সবই আরশির মুখস্থ ছিল। অনেক দিনই লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে স্যারকে ফলো করতে-করতে স্যারের কোয়ার্টার পর্যন্তও লুকিয়ে-লুকিয়ে গিয়েছিল। সাথে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড লিমা থাকায় কেউ কিছু বুঝতে পারত না। লিমা ওকে সবসময়ই সাত্যকি স্যারের সম্পর্কে সব রকমের ইনফো দিত আর তার বিনিময়ে আরশি লিমাকে ফুচকা খাওয়াত। স্যারের মোবাইল নাম্বারও লিমা আরশিকে যোগাড় করে দিয়েছিল। সেই নাম্বারটি ও একটি কাগজে লিখে রেখেছিল। প্রতি মুহূর্তে সেটিকে ছুঁয়ে দেখা আর চুমু খাওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুই আরশি কোনও দিনই করতে পারেনি। আরশির মোবাইল ফোন ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল, টিউশনির টাকা জমিয়ে শুধু স্যারকে ফোন করার জন্যই একটা মোবাইল ফোন কিনবে সে।
ও সবসময়ই ভাবত, কীভাবে স্যারের সামনে যাওয়া যায়, কী বুদ্ধিতে স্যারের সাথে একটুখানি কথা বলা যায়, পৃথিবীতে এমন কোনও কাজ কী আছে যেটা করলে স্যার ওর দিকে তাকিয়ে ২ সেকেন্ডের জন্য হলেও হেসে উঠবেন! কিন্তু কিছুতেই কিছুই হয় না। ‘যদি স্যারের সামনে গেলে স্যার ওর মুখ দেখে কোনও ভাবে বুঝে ফেলেন যে ও স্যারকে পছন্দ করে, তাহলে তো সব শেষ!’ এটা ভাবত, আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর পাশে স্যারকে কল্পনা করে করে খুব খুশি হয়ে উঠত! প্রথম আলো’তে ‘পাটশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ নিয়ে স্যারের একটি লেখা এসেছিল, সেটা আরশি অন্তত কয়েকশবার পড়ে ফেলেছে, অথচ ওরকম একটি লেখা দুইবার পড়ারই কিছু নেই। স্যারকে নিয়ে ওর সামনে কেউই কিছু বলতে পারত না। সাথে সাথেই ফোঁস করে উঠত! স্যার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত আরশি লিমাসহ। স্যার কোনও দিন ফিরেও তাকাননি। একদিন লিমা বলল, “আরশি, একটা কাজ করলে কেমন হয়?” “কী?” “স্যারের মোবাইলে একটা ফোন কর।” “দোস্ত, মরেই যাবো। উনি আমাকে খুন করে ফেলবেন!” “তাহলে এক কাজ কর। আমি স্যারের রুমের পিএবিএক্স নাম্বারটা যোগাড় করে দিচ্ছি। এরপর সাহস করে ফোন দিয়ে দে। অনেকেই তো করে!” মুখে “আমি কিছুতেই পারব না।” বললেও সেটাই করে বসল আরশি। “স্যার, একটা হেল্প লাগবে। প্রিভিয়াস ইয়ারের কোয়েশ্চেনগুলি কোথায় পাবো?” রোবটের মতো বলে গেল আরশি। “কেন? তোমাদের লাইব্রেরিতেই তো আছে। ক্লাসে বললাম না সে….?” স্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই খট করে ফোনটা রেখে দিল আরশি। আর কোনও কথাই খুঁজে পেল না। স্যার যখন কথা বলছিলেন, তখন ওর বারবারই মনে হচ্ছিল, যেন স্যার ওকে দেখে ফেলছেন। এটা মনে আসতেই খুব লজ্জা লাগছিল। আর মনে হচ্ছিল, এক্ষুনিই বুঝি ও একটা বকা খাবে! তবে স্যার যে ওর মনের কথা কিছুটা বুঝে ফেলেছিলেন, সেটা আরশি বুঝতে পারল পরের দিন বিকেলে ঠিক একই সময়ে ফোন করার পর। ফোন করে কিছুই না বলে চুপ করে রইল। স্যারও অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শেষে বললেন, “তুমি সে মেয়েটা না যে কালকে ঠিক এসময়ে ফোন করেছিল?” “হুম!” আরশির মনে হচ্ছিল, সে বুঝি ভয়ে কেঁদেই ফেলবে! “আচ্ছা। তা ফোনটা যখন করেই ফেললে, তখন চুপ করে না থেকে একটু কথাও বলে ফেল।” “জ্বি।” “তোমার নাম কী?” আরশি চুপ করে রইলো। আরও দুইবার জিজ্ঞেস করার পর ও নাম বলবে না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন সেমিস্টারে? কোন ডিপার্টমেন্ট? সিভিল? নাকি, ইলেকট্রিক্যাল?” “স্যার, সেকেন্ড সেমিস্টার, সিভিলে।” ভয়ে ডিপার্টমেন্টের নামটা ভুল বলে ফেলল আরশি। “তুমি অ্যানি না?” “নাহ্।” “পিংকি?” “নাহ্।” “তাহলে লোপা শিওর!” “না স্যার। আজকে রাখি।” বলেই ওর ভবিষ্যৎ মেয়ের সম্ভাব্য নামের তালিকা থেকে আরও ৩টি নাম বাদ দিয়ে দিল। মনে মনে ভাবল, সিভিলের ওই ৩টা মেয়েকে সে “দেখে নিবে!” কিন্তু কীভাবে যে দেখে নিবে, সেটা নিয়ে কোনো প্ল্যানই আরশির মাথায় আসল না।
যে ফোনের প্রাথমিক সংকোচটা কেটে যায়, সে ফোন আর বন্ধ হয় না। ওভাবে করে প্রায় প্রতিদিনই টুকটাক কথা চলতে লাগল। প্রতিটি কলের শতকরা ৭০ ভাগ কথাই স্যার বলতেন। তবে আরশিকে কিছুতেই ওর নাম আর ডিপার্টমেন্টের নামটা স্যার বলাতে পারেননি।
একদিন। সকালে রুমের দরোজা খোলার সময় সাত্যকি স্যার দরোজার নিচে হলমার্ক থেকে কেনা একটা গ্রিটিংকার্ড আবিষ্কার করলেন। বৃষ্টিতে একটা মেয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখটাকে ছাতা দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। কার্ডটা দাঁড়ানো অবস্থাতেই খুললেন সাত্যকি স্যার। I have hidden my face and my name, too. But one thing I can’t hide anymore, that’s my love for you…. a secret admirer. স্যারের বুঝতে বাকি রইল না সেই সিক্রেট অ্যাডমাইরারটি কে। “ওই একটি কণ্ঠস্বর ছাড়া যে আমি ওর আর কিছুই জানি না!” হঠাৎ করেই উনি অসহায়বোধ করতে লাগলেন। রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে কার্ডের লেখাটি অন্তত ২০-২৫ বার পড়ে ফেললেন।
এরপর প্রায় এক সপ্তাহ আরশি ভয়েই স্যারকে ফোন করল না। কার্ডটা দেখে যদি রাগ করে কথাবলাই বন্ধ করে দেন! যদি ফোন করলেই আরশিকে খুব শক্ত-শক্ত কিছু বকা শুনতে হয়! সেই ছোটবেলা থেকেই আরশি বকা শোনার আগেই কেঁদে ফেলে। “কোথায় ছিলে এতদিন? ফোন করনি কেন? তোমার কোনও নাম্বার বল না, পরিচয় জানাও না। এই মেয়ে! তোমার সমস্যাটা কী?” প্রচুর বকা শুনতে হল আরশিকে; কার্ডের জন্য নয়, ফোন না করার জন্য। বকা শুনতেও যে এতো মধুর লাগে, এটা আরশি জীবনে প্রথমবারের মতো অনুভব করতে পারল। ওর মনে হতে লাগল, ওর চাইতে সুখী মেয়ে পৃথিবীতে আর একটিও নেই। সাত্যকি স্যার এ পৃথিবীর সবচাইতে ভাল মানুষ। এই মানুষটির বকা শুনেও একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়! সেদিনের পর থেকে স্যারের সাথে আরশির সম্পর্কটা খুব সহজ হয়ে গেল। স্যারের কিংবা আরশির ক্লাস না থাকলে প্রায় প্রতিদিনই ওদের দুজনের সারাটা বিকেল কাটত ফোনে গল্প করে। মাঝেমাঝে শেখর স্যার বিকেলে এক্সট্রা ক্লাস দিতেন, ক্লাসে না এলে “পরীক্ষা দিতে দেবেন না” বলে ভয় দেখাতেন। উনি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ক্লাস নিতেন বলে সময়মত ক্লাস নিতে পারতেন না। তাই মাঝেমধ্যে এক সপ্তাহের ক্লাস একদিনে নিতেন। উনার উপর ওরা দুজনই চরম বিরক্ত হতো। বেচারা স্যামুয়েলসন মুখ থুবড়ে থাকত আরশির কণ্ঠে, বিকেলের পর বিকেল।
ভালোবাসা দিবসে আরশি স্যারকে ১৭টা কার্ড উপহার দিয়েছিল। একটা বিশাল বড় কার্ড, তার ভেতরে আরেকটা, সেটার ভেতরে আরেকটা, এভাবে করে সাজিয়ে দিয়েছিল কার্ডগুলি। সেগুলি নিয়ে চুপিচুপি স্যারের জানালার কাছে রেখে দিয়ে এসেছিল আরশি। এই ধরনের সারপ্রাইজ গিফটগুলি স্যার খুব পছন্দ করতেন। আরশি প্রায়প্রায়ই স্যারের জন্য কার্ড কিনত। কার্ডগুলির ভেতরে ছোট ছোট কিছু মেসেজ লেখা থাকত। মেসেজগুলির বেশিভাগই অনুযোগের। “গোলাপি শার্টটা না পড়লে কী হয়, হুঁ? জানেন, বিদেশে গে’দের কালার হচ্ছে পিংক। হিহিহি…….” “শীলা কেন আপনার রুমে আসে? আমার ভাল লাগে না। ক্লাসে পড়া বুঝে নিতে পারে না ও? যতসব ঢং! আপনি ওকে রুমে আসতে দেবেন না।” “আপনি ইদানিং কম কথা বলেন কেন? আমি কী করেছি?” “চুল কাটান না কেন?” “আমাকে বকলে কিন্তু…….” “পরশু ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে দুপুর ২টা ৪৭ মিনিটে যাওয়ার সময় ওই মেয়েগুলির দিকে ওরকম আড়চোখে তাকালেন কেন? আমি কষ্ট পেয়েছি।” “চোখের কোনায় কাল দাগগুলি খেয়াল করেননি? অতো রাত না জাগলে কী হয়?” “শার্টের ইনটা মাঝে মাঝে বেরিয়ে যায় যে?” “মারুফ স্যার আপনার অগোচরে আপনাকে নিয়ে বাজে কথা বলে। আপনি উনার সাথে বিকেলে চা খান কেন?” “আপনি লামিয়ার ফোন রিসিভ করেন কেন? ও একটা খারাপ মেয়ে।” এরকম হাজার হাজার কার্ডমেসেজ। সালটা ২০০৩। সেসময় ফেসবুক ছিল না। থাকলে অভিযোগ-অনুযোগ নিশ্চয়ই আরও বাড়ত। স্যার এসব ছেলেমানুষি দেখে একটুও রাগ করতেন না। যেদিন কার্ড আসত, এর পরদিনই ফোনে আরশির অনুযোগের কৈফিয়ত দিতেন। অদেখা প্রেমের কথোপকথন চলছিল এভাবে করেই। একজন সাত্যকি স্যার, একজোড়া টেলিফোন সেট, একজন অপরিচিতা। সেখানেই শেষ বিকেলের সূর্যটা নামত।
২০০৪, জুন। ভার্সিটিতে সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়েছে মাত্র। আরশি হল ছেড়ে বাসায় চলে গেছে। বাসার ল্যান্ডফোন থেকেই কথা হত। ৯ জুন ছিল স্যারের জন্মদিন। ৮ জুন সন্ধ্যা। “আমি ১০ তারিখ বাড়িতে চলে যাচ্ছি। তুমি কালকে ভার্সিটিতে আস। যদি না আস, তবে তোমার সাথে সামনের ১ মাস কোনো কথা বলব না।” আরশির তখন এমনই অবস্থা, উনার সাথে একদিন কথা না বললেই অস্থির অস্থির লাগত। একমাস কথা না বললে তো সে দম বন্ধ হয়েই মরে যাবে! অনেক লজ্জা দ্বিধা সংকোচ আর ভয় নিয়ে ৯ তারিখ ঠিক সকাল ১১টায় ১২টি গোলাপ, একটা চকোলেটের বক্স আর একটি বার্থডে কার্ড নিয়ে ফাঁকা ক্যাম্পাসে গেল আরশি। কথা ছিল, ওইসময়ে গোল চত্বরের সামনে স্যার থাকবেন। উনি সাড়ে ১০টায়ই এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরশিকে উনি আগেই দেখেছিলেন, সবসময়ই দেখা হতো, মুখ চিনতেন, তাকাতেন, কিন্তু ওর সাথেই যে এতদিন ধরে কথা হয় উনার, সেটা জানতেন না। এমনকি একটি বারের জন্যও ওর কথা মনে হয়নি স্যারের। সেদিন আরশিকে দেখে প্রথমেই উনি যে কথাটি বলেছিলেন, সেটি হল, “তুমি!!!” আরশি অনেক করে ক্ষমা চাইল স্যারকে আধা ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। কিছুতেই স্যারের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না সে। একটা গাঢ় হলুদ রঙের সবুজপেড়ে শাড়ি পরে এসেছিল আরশি আর স্যার পরেছিলেন অফহোয়াইট শার্ট আর ব্লুজিনস। ওরা দুজন মিলে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াল। ভার্সিটি ফাঁকাই ছিল। একটা রিকশা ভাড়া করে ভার্সিটি আর এর আশেপাশের এলাকাগুলি ঘুরে বেড়াল ওরা। সেদিন রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর সময় সাত্যকি স্যার খুব আলতো করে আরশির হাতটা ছুঁয়েছিলেন। সেই ছোঁয়ায় সমস্ত শরীর কেঁপে উঠেছিল আরশির। মাথা পুরোটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, আশেপাশের পৃথিবীটা একরঙা হয়ে উঠেছিল নিমিষেই! মুহূর্তের জন্য বুদ্ধিশুদ্ধিও লোপ পেয়েছিল যেন! কিন্তু সেই ছোঁয়ায় আরশি কোনো অপবিত্রতা খুঁজে পায়নি। চোখদুটো বন্ধ করে অনুভব করেছিল শুধু! ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি শেষে আরশিকে একটা সিএনজি ঠিক করে দিয়েছিলেন স্যার। বিদায় দেয়ার সময় হুমায়ূন আহমেদের ৫টা বই উপহার দিয়েছিলেন: তিথির নীল তোয়ালে, আজ আমি কোথাও যাবনা, কবি, অপেক্ষা, বৃষ্টি ও মেঘমালা। উনি জানতেন, হুমায়ূন আহমেদের কোন কোন বইটি আরশির এখনও পড়া হয়নি।
আরশি উনাকে এতোটাই ভালোবাসতো আর সারাক্ষণই এতোবেশি বেশি উনার গল্প সবার কাছে করতো যে, ওর ক্লাসমেট বাদে ওর অন্য এমন কোনও ফ্রেন্ড, কাজিন ছিল না, যারা উনাকে চিনত না, কিংবা উনার নামটা জানত না। কী এক অজানা ভয় থেকে আরশি এক লিমা ছাড়া আর কোনো ক্লাসমেটের সাথেই সাত্যকি স্যারের কথা কোনও দিনই শেয়ার করেনি। প্রথম মোবাইল ফোন কেনার পর প্রথম ফোনটা আরশি উনাকেই করেছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে একবার, দুপুরে একবার, সন্ধ্যার আগে একবার, ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার উনার সাথে কথা বলত, উনার প্রতিটি মুহূর্তের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করত, আর সারাদিনই উনাকে মেসেজ পাঠাত। উনি বেশিরভাগ মেসেজেরই রিপ্লাই দেয়ার সময় পেতেন না, কিন্তু এ নিয়ে আরশি কখনোই মনখারাপ করেনি। ও বুঝতে পারত, “উনি ব্যস্ত।” আরশি সাত্যকি স্যারের কথা দিনের মধ্যে যতবার মনে করত, মানুষ মনে হয়, নিজের ঈশ্বরকেও অতোবার স্মরণ করে না। উনি যা-ই করতে বলতেন, আরশি যে করেই হোক, সেটা করে ফেলত। যা করতে নিষেধ করতেন, আরশি কখনোই সেটা আর করত না। স্যারের প্রত্যেকটি কাজের পেছনেই কোনও না কোনও গ্রহণযোগ্য যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলত। নিজের চাইতেও উনাকে বেশি বিশ্বাস করত। উনি যাতে ভাল থাকেন, সেজন্য দিনরাত প্রার্থনা করত। স্যারের মঙ্গলকামনায় নিয়মিত রোজা রাখত। উনার মুখটা যেন আরশির চোখের সামনেই ‘সেট’ হয়ে থাকত সবসময়ই। উনি আরশিকে অনেক ভালভাল মুভির নাম রিকমেন্ড করতেন। আরশি সেসব মুভি কয়েকবার করে দেখে ফেলত। আর গল্প কিংবা উপন্যাসের বেলায়, এক হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কারও বইয়ের নামই বলতে পারতেন না, কারণ, উনি তেমন আর কারও বইটই পড়তেন না। উনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আরশিও উনার মতোই, গানের চাইতে ইন্সট্রুমেন্টাল বেশি শুনত। ফোনে কথা বলার সময়ে কোন কথাটির পর কোন কথাটি বলবেন, সেটাও আরশি অনুমান করে ফেলতে পারত প্রায়ই। উনার মনমেজাজ বুঝেশুনে কথা বলত।
সাত্যকি স্যার আরশিকে ভালোবাসতেন, হয়তো আরশির মতো অতো বেশি তীব্রভাবে না, কিন্তু বাসতেন, এটা আরশি খুব ভালভাবেই বুঝতে পারত। আরশি একটু চাপা স্বভাবের ছিল, মুখে তেমন কিছুই বলতে পারত না। স্যার ছিলেন আরও বেশি চাপা স্বভাবের। কখনোই আবেগটা দেখাতে পারতেন না। একদিন উনি আরশিকে বললেন, “আরশি, তুমি আমাকে কিছু করতে বল। তুমি যা চাও, আমি তা-ই করবো। যদি বল, কান ধরে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে, তবে তা-ই থাকব। তোমার-আমার এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী, আমি জানি না। কিন্তু তুমি চাইলে সারাজীবন তোমার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে যাবো। তুমিই বলে দাও, তুমি কী চাও।” একথা শুনে আরশি একটু আহত হয়ে বলেছিল, “ও আচ্ছা, আমি চাইলে সম্পর্ক রক্ষা করবেন, না চাইলে করবেন না। ভাল তো! আপনার নিজের কোনো ইচ্ছাঅনিচ্ছা নেই? ঠিক আছে, দরকার নেই, আপনার যা করতে ইচ্ছে করে, আপনি তা-ই করবেন!” এতটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিল আরশি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো উনার ফোন কাটল সে। কেটেই অঝোরে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ আরশির মনে এল, এই যে এতদিন ধরে ওদের কথা হয়, ওরা পরস্পরকে ভালোওবাসে, অথচ ওরা কেউই কাউকে এখনও ‘ভালোবাসি’ বলেনি। আচ্ছা, ‘ভালোবাসি’ বলতে কত সময় লাগে? নাকি, এটা বলাই যায় না? ‘ভালোবাসি’ কি বলতেই হয়? কোনটা বেশি দরকার? ভালোবাসা? নাকি, ‘ভালোবাসি’ বলা? ‘ভালোবাসি’ না বললে কি ভালোবাসা হয়ই না? ওটা বললেই হয়ে যায়? যদি সেটাই হবে, তবে কে আগে উচ্চারণ করবে ওই কঠিনতম শব্দটি?
আরশির খুব কার্ডকেনার বাতিক ছিল। প্রায়ই স্যারের রুমের নিচ দিয়ে, নাহয় স্যামুয়েলসনের বইয়ের ফাঁকে, জানালার পাশে পর্দার আড়ালে, উনার ড্রয়ারে লুকিয়ে কার্ড রেখে আসত। হলমার্ক আর অর্চিস গ্যালারির বিভিন্ন শোরুম ঘুরে-ঘুরে স্যারের জন্য কার্ড কিনত। সেগুলির মধ্যে, ৬৪টি কার্ড কখনোই উনাকে দেয়া হয়নি। কারণ, কেনার পর সেগুলিতে আরশি যা লিখেছিল, সেটা পড়ার পর ওর নিজেরই লজ্জা লাগছিল সেগুলি স্যারকে দিতে। ওর লুকিয়েরাখা প্রেমপত্রগুলির সাথে ওই কার্ডগুলিও সে রেখে দিয়েছে। এর মধ্যে উনার রুম এল-বিল্ডিংয়ে শিফট করা হল। তখন আরশি প্রায় সময়ই উনার রুমে গিয়ে গল্প করত। উনি ইনসিস্ট করতেন যাতে ও উনার রুমে আসে। প্রায়দিনই খুব সকালে, যেমন সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা/ ৯টা পর্যন্ত উনার রুমে গিয়ে আরশি গল্প করত। অনেকসময় উনার রুমটা গুছিয়ে দিত, টেবিলের উপর কিছু তাজা ফুল রেখে আসত, উনার ইনকোর্স পেপারের খাতাদেখায় হেল্প করত, নাম্বারগুলি যোগ করে মার্কসশিটে তুলে দিত। কখনও-কখনও উনি ওর সাথে কোনও কথা না বলে বই পড়তে থাকতেন, আরশি সেসময় চুপচাপ বসে মুগ্ধ হয়ে উনাকে দেখত। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আরশি যে শান্তিটা অনুভব করত, সেটি সে আর কোথাও পেত না। মাঝেমাঝে এল-বিল্ডিংয়ের নিচে যে মামাটা পাহারা দিতেন, উনার হাতে ফক্স চকোলেটের প্যাকেট দিয়ে আসত, সাথে ছোট্ট একটা চিঠি। সে চিঠিটা এমন কায়দায় ভাঁজকরা থাকত যে, না ছিঁড়ে পড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। মামার হাতে মাঝেমধ্যেই আরশি ২০-২৫ টাকা দিয়ে দিত। সে সময়গুলিতে কোনোদিনই ওরা পরস্পরকে স্পর্শও করেনি। স্যারের যে স্পর্শটির স্মৃতি আরশিকে প্রায়ই আনমনা করে দিত, সেটা সে পেয়েছিল ৯ জুন ২০০৪ তারিখে। সেইদিনটির প্রতি মুহূর্তের কথা আরশি কখনোই ভুলতে পারবে না।
২০০৬ সালে উনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউকে’তে যান এমএস করতে। পরে পিএইচডি কমপ্লিট করেন ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে। চলে যাওয়ার আগে একবার প্ল্যান হয়েছিল, সারাদিন ওরা দুজন একসাথে ঘুরে বেড়াবে; কাপ্তাইয়ে, কিংবা অন্যকোথাও। দুজনই দুজনের জন্য অনেক গিফট কিনেছিল। আর কবে দেখা হয়, না হয়। উনার সাথে এমনিতেই আরশি কখনও ঘোরাঘুরি করতে পারত না, কখন উনার কোন স্টুডেন্ট দেখে ফেলে, সে ভয়ে। সেই দিনটি এল, কিন্তু ওদের দেখা করা হল না। হঠাৎ আরশির মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আরশিকে বাসায় চলে যেতে হয়েছিল।
চলে যাওয়ার আগের দিন উনি ভার্সিটিতে এসেছিলেন। সেদিন সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত উনার রুমে দুজন কোনও কথা না বলেই চুপচাপ বসেছিল। দুজনেরই অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু কোনও কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত স্যারই নীরবতা ভেঙে বললেন, “আরশি, আমি চলে যাচ্ছি। আর কখন দেখা হয়, জানি না। আমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কোরো। জানি, এটা তোমার জন্য অনেক কঠিন আর কষ্টের, কিন্তু প্লিজ চেষ্টা কোরো। আমার কথা মাথায় রাখলে তোমার পড়াশোনা হবে না। আমি তো তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাসটা ধরে রাখার চেষ্টা কোরো। স্বার্থপরের মতোই তোমার কাছ থেকে এটা চাইছি। তোমার কাছ থেকে ওই উপহারটা পেলে আমার চাইতে বেশি খুশি এ দুনিয়াতে আর কেউই হবে না, এতে জেনে রেখো। আর এমনিতেই এভাবে করে রিলেশন কন্টিনিউ করাটা আমাদের দুজনের জন্যই খুব টাফ হবে। এখন থেকে শুধু নিজের কথাই ভাববে, আমাকে ভুলে যেয়ো। আমি আসলেই কখনোই কিছু দিতে পারিনি তোমাকে। তার চেয়ে এ-ই বরং ভাল। আমি দূরে চলে যাচ্ছি, মাঝেমাঝে ইমেইল কোরো। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিয়ো। আর যেকোনো ছেলের সাথেই কথা বল, সমস্যা নেই, কিন্তু আসিফের সাথে কখনোই কথা বোলো না। ও ছেলে হিসেবে খুব একটা সুবিধার না। এই আরকি!” (আসিফ ছিল আরশির ক্লাসমেট। কোনও এক কারণে স্যার আসিফকে পছন্দ করতেন না।) এসব কথা বলার পুরোটা সময়ে আরশি একটি কথাও বলতে পারেনি। মাথা নিচু করে বসেছিল আর বারবার টিস্যুতে চোখ মুছছিল। সেদিন আরশিকে উনার নিজের কিছু বই দিয়ে গিয়েছিলেন; একটি ছিল আন্না কারেনিনা, রাশিয়ার রাদুগা থেকে প্রকাশিত, অরিজিনাল প্রিন্টের। সে বইয়ের প্রথম পাতায় উনি লিখে দিয়েছিলেন, I believe, we will meet again. I don’t know when, I don’t know where, even I don’t know how……..but, the only thing I know, we will definitely meet again someday, somewhere, somehow!
সেদিন আরশি কিছুই বলতে পারেনি। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্যার পেছন থেকে বলেছিলেন, “তোমার কি কিছুই বলার নেই, আরশি?” “আপনি যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন।” এটাই ছিল সাত্যকি স্যারের প্রতি আরশির শেষকথা।
উনি চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আরশি কখনোই এতোটা বুঝতে পারেনি, স্যার ওর জন্য কী ছিলেন। ওর প্রতিদিনের সব স্বপ্নদেখা, বেঁচেথাকা, ভাললাগা, মন্দলাগা সহ সমস্ত ভাবনা আর অনুভূতি জুড়ে উনি ছিলেন। ভীষণ কষ্ট পেত, লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঁদত। কাছের মানুষেরা সবই বুঝতে পারত, কিন্তু কেউই ওকে কিছুই বলত না। প্রতিটি মুহূর্তে ও অনুভব করতে পারত, জীবন থেকে ও কী হারিয়ে ফেলেছে! থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট হয়েছিল যাচ্ছেতাই। উনার সাথে ইমেইলে যোগাযোগ হতো, তাও খুবই কম। ভার্সিটিলাইফে আর কোনোদিনই কোনো ছেলের প্রতি বিন্দুমাত্রও আকর্ষণ অনুভব করেনি। কত ছেলে ভালোবাসার কথা বলত, ও কোনোদিন খেয়ালও করেনি। উনার মোবাইল নাম্বারটাতে প্রতিদিন অসংখ্যবার কল করত। জানত, ওটা বন্ধ, তবুও। নাম্বারটা বারবার আওড়াত। উনার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। উনি যে চেয়ারটিতে বসতেন, সেটির দিকে তাকিয়ে থাকত। যে মামাটি স্যারকে আরশির হয়ে ফক্স চকোলেট দিয়ে আসতেন, উনাকে বলে উনার রুমের সামনের নেমপ্লেটটা সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। এছাড়াও উনি চলে যাওয়ার পর উনার রুমটা পরিষ্কার করার সময়ে উনার ব্যবহৃত কলম, মার্কার, হাইলাইটার, রাইটিং প্যাড, পানি খাওয়ার মগ, আরও কী কী যেন আরশির অনুরোধে ফেলে না দিয়ে মামা যখন আরশিকে দিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন উনি বাচ্চাদের মতো কেঁদে-কেঁদে বলছিলেন, “আপা, স্যাররে যাইতে দিলেন ক্যান? আটকায়ে রাখতে পারলেন না?” রুমের দরোজা বন্ধ করে প্রতিদিন স্যারের ব্যবহৃত জিনিসগুলি নিজের ওড়না দিয়ে মুছতে-মুছতে আরশি মামার ওই সহজ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজত। অশ্রুতে সব উত্তর এসে থেমে যেত প্রতিদিনই।
এসবের কিছুই কখনও আরশি উনাকে মেইলে জানাত না। খুব সংক্ষিপ্ত কথায় উনার মেইলের উত্তর দিত আরশি, প্রায়ই একটা শব্দেই মেইল শেষ করতো: Yes. Thanks. Hmm….ভালোই। আচ্ছা। চলছে……… এরকম। একটা সময়ে উনিও ধরে নিয়েছিলেন, মেয়েটা বোধহয় আমাকে দ্রুত ভুলে গেছে। ভাল। ও যেভাবে ভাল থাকে। এরপর আস্তেআস্তে ইমেইলে যোগাযোগও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
২০১১তে উনি দেশে ফেরেন, ফ্যামিলির পছন্দে বিয়েও করেন। আরশিকে মেইল করেছিলেন, “কেমন আছ, কোথায় আছ, কীভাবে আছ, জানি না। বিয়ে করছি। জুনের ২৮ তারিখ বিয়ে, কিং অব চিটাগাংয়ে। এসো। জানি না, আমাকে আর মনে রেখেছো কি না। যদি বিরক্ত করে থাকি, ক্ষমা করে দিয়ো।” ভদ্রলোক সারাজীবন ইকোনমিক্স নিয়েই কাটিয়ে দিলেন। উনি কীভাবে জানবেন, মেয়েরা যাকে একবার ভালোবাসে, সারাজীবনেও তাকে আর ভুলতে পারে না।
৫টা বছর কেটে যাচ্ছে। উনার ছেলের বয়স ৩ চলছে। নিভৃতে উনার সব খবরই আরশি রাখে। হয়তো উনার কথা এখন আর অতোটা মনে পড়ে না আগের মতো, তারপরেও এখনও যদি হঠাৎ-হঠাৎ কাউকে ভাল লেগে যায়, আরশির অবচেতন মন তার মধ্যে উনার ছায়া খুঁজে ফেরে, মাথায় উনিই ভর করে থাকেন; এতদিন পরেও!
ওই ভাললাগা পর্যন্তই। উনার জায়গায় কিছুতেই আরশি আর অন্য কাউকেই কল্পনাও করতে পারে না। আরশি ভাবে, ছোট্ট একটা জীবন! উনার কথা ভেবেই তো দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়!
তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!
নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু-পায়ে
হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —
একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।
আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —
কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি
রয়েছি দাঁড়ায়ে!
নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে
হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!
একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!
আরশি বিশ্বাস করে, জীবনটা এমনই! জীবনানন্দের এই লাইনগুলির মতন।
পুনশ্চ। সাত্যকি সাহেবের সাথে যদি আরশির বিয়েটা হতও, এতদিনে যদি আরশি এক ডজন বাচ্চাকাচ্চার মাও হয়ে যেত, তারপরও সে উনাকে সারাজীবনই ‘আপনি’ই বলত!