এরপর আসে হিপোক্যাম্পাস, ইনসুলা, এবং টেম্পোরাল লোব-এর পরিবর্তনের কথা।
হিপোক্যাম্পাস হলো স্মৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্র। এটি নতুন তথ্যকে সংরক্ষণ করে ও পুরনো স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত করে। ধ্যান বা মন্ত্রজপের ফলে এই অঞ্চলের কার্যক্ষমতা বাড়ে—ফলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি উভয়ই উন্নত হয়।
ইনসুলা (Insula) মস্তিষ্কের সেই অংশ, যা শরীরের ভেতরের অনুভূতি ও আবেগকে চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে—যেমন শ্বাস, হৃদস্পন্দন, বা অভ্যন্তরীণ প্রশান্তির অনুভূতি। এই অংশ সক্রিয় হলে মানুষ নিজের শরীর ও মন সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠে—এটিই আত্ম-সচেতনতা (Self-awareness) বা অন্তঃস্থিতি (Inner Presence)-এর স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ভিত্তি।
পার্শ্বীয় টেম্পোরাল লোব ভাষা, প্রতীকী চিন্তা এবং শ্রবণ-স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত। মন্ত্রজপ বা শাস্ত্রপাঠের ধ্বনি এই অংশকে উদ্দীপিত করে, ফলে শব্দ, অর্থ ও চেতনার মধ্যে এক সূক্ষ্ম সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এই সমন্বিত সক্রিয়তার ফল হলো—চিন্তা, বাক্ এবং শ্বাসের মধ্যে এক স্বয়ংক্রিয় ছন্দ তৈরি হয়, যাকে বলা যায় “entrainment” বা সিঙ্ক্রোনাইজেশন। এই অবস্থায় মন ধীরে ধীরে “একাগ্র” হয়ে পড়ে, আর আবেগ স্থির হয়।
আধ্যাত্মিক ভাষায়, এই অবস্থাকে বলা হয় “শব্দ-বিন্দু-ব্রহ্ম”—যেখানে শব্দ (মন্ত্র), বিন্দু (চেতনার কেন্দ্র) এবং ব্রহ্ম (পরম সত্তা) একীভূত হয়। অর্থাৎ, ধ্বনি আর ভাব, চিন্তা আর চেতনা—উভয়ই একে অপরের প্রতিফলন হয়ে যায়।
এই সমস্ত গবেষণা প্রমাণ করে যে, তান্ত্রিক অনুশীলন মনকে প্রশিক্ষিত করার এক গভীর বিজ্ঞান। এটি শুধু কোনো ধর্মীয় আচার নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য ও সচেতনতার স্নায়ুবিন্যাসকে শক্তিশালী করে। তাই জগদ্ধাত্রীর সাধনা কেবল ভক্তির প্রকাশ নয়, বরং নিউরাল রিস্ট্রাকচারিং—মস্তিষ্কের পুনর্গঠন—যেখানে অহং বা “করীন্দ্রাসুর” ধ্বংস না হয়ে জ্ঞানের আলোয় সংযত শক্তিতে পরিণত হয়।
প্রাচীন তান্ত্রিক জ্ঞান ও আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান—উভয়ই একই সত্য প্রকাশ করে: মানুষের মনের স্থিরতা, আত্মসংযম ও শান্তি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়; এটি এক নিয়মতান্ত্রিক চেতনাপ্রক্রিয়া, যা সাধনার মাধ্যমে অর্জনযোগ্য।
করীন্দ্রাসুর-বধের পৌরাণিক আখ্যান আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় নতুন অর্থ পায়। এটি কেবলই এক মিথ নয়, বরং এক গভীর জৈব-মনস্তাত্ত্বিক প্রতীক—যা দেখায়, কীভাবে কঠোর তান্ত্রিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে মানুষ নিজের অভ্যন্তরীণ স্নায়ুপ্রবাহকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে পারে। জগদ্ধাত্রী তাই শুধু দার্শনিক বা প্রতীকী শক্তি নন; তিনি এক "স্নায়ু-জ্ঞানীয় প্রত্নরূপ" বা "স্নায়ু-জ্ঞানীয় আদিরূপ" (neurocognitive archetype)—যিনি শেখান, শ্বাস, ধ্বনি, মনোযোগ ও আত্মসচেতনতার সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে চেতনা ও মস্তিষ্ক উভয়কেই সাত্ত্বিক স্থিতিতে উন্নীত করা যায়; কেননা মানুষের সহজাত আচরণগত প্যাটার্নগুলি (আর্কিটাইপ) মস্তিষ্কের মধ্যেকার নির্দিষ্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক বা কাঠামোর দ্বারা গঠিত এবং পরিচালিত হয়।
জগদ্ধাত্রীর উপাসনা একাধারে মায়ামুক্তির তন্ত্র এবং চেতনার বিজ্ঞান—যেখানে ভক্তি, ধ্যান ও নিউরোবায়োলজি মিলেমিশে প্রকাশ করে মানবচেতনার চূড়ান্ত সম্ভাবনা: অহং-এর সংযম, চেতনার স্থিতি এবং ব্রহ্মচেতনার দীপ্তিতে মনের পুনর্জন্ম।
ক. আচার-অনুষ্ঠান, ইতিহাস এবং সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশ (পূজা): বাংলার ধর্মসংস্কৃতির ইতিহাসে জগদ্ধাত্রী পূজা এক অনন্য সংযোজন, যেখানে আধ্যাত্মিক তত্ত্ব, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক সংহতির স্রোত একত্রে মিলেছে। এটি একদিকে শাক্ত উপাসনার ধারাবাহিকতাকে টিকিয়ে রেখেছে, অন্যদিকে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। আজ নদিয়ার কৃষ্ণনগর ও হুগলির চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পূজার জাঁকজমকের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, তবে ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও আসামের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই উৎসব সমান ভক্তি ও শ্রদ্ধায় পালিত হয়।
ইতিহাসের দিক থেকে দেখা যায়, বাংলায় জগদ্ধাত্রীর উপাসনার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। মুর্শিদাবাদের বালিগ্রামে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এই দেবীর পূজার প্রমাণ পাওয়া যায়, আবার হুগলির সোমরাই অঞ্চলেও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাচীন উপাসনার নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু জনসমক্ষে জগদ্ধাত্রী পূজার বিকাশ এবং তার জনপ্রিয় রূপের কেন্দ্র হয়ে ওঠে নদিয়ার কৃষ্ণনগর, যেখানে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই পূজাকে রাজপৃষ্ঠপোষকতায় সুসংগঠিত রূপ দেন।
জনশ্রুতি অনুসারে, নবাব সিরাজউদ্দৌলার আদেশে কর বকেয়া রাখার অপরাধে কৃষ্ণচন্দ্র রায় বন্দি হন। কয়েক মাস পর মুক্তি পেয়ে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে দেখেন যে, দুর্গাপূজা ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। গভীর অনুতাপে তিনি দেবীর আরাধনায় নিমগ্ন হন, আর সেই রাতে স্বপ্নে তাঁর সামনে আবির্ভূত হন এক কিশোরী দেবী—শুভ্রবর্ণা, সিংহবাহিনী, সোনালী আভায় দীপ্ত মুখে শান্ত হাসি। দেবী তাঁকে আদেশ দেন, “আমার পূজা করো কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে।” এই স্বপ্নদর্শনই বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা বিন্দু হয়ে ওঠে, যা দুর্গাপূজার প্রায় এক মাস পরে অনুষ্ঠিত হয় এবং কালের সঙ্গে সঙ্গে এক স্বতন্ত্র শারদীয় উৎসবে পরিণত হয়।
তবে জগদ্ধাত্রী পূজার তাৎপর্য কেবল রাজপৃষ্ঠপোষকতায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি এক গভীর দার্শনিক প্রতীকেরও মর্যাদা বহন করে। জগদ্ধাত্রী স্তোত্র বা পূজা-পদ্ধতিতে সর্বদা বলা হয়, “জগদ্ধাত্রী জগতধারিণী”—অর্থাৎ যিনি জগৎকে ধারণ করেন, তিনিই জগদ্ধাত্রী। কাত্যায়নী তন্ত্রে তাঁকে বলা হয়েছে “করীন্দ্রাসুর নিসূদিনী”—যিনি অহংকারের প্রতীক হাতি-অসুরকে বধ করেছেন, অর্থাৎ মানুষের অভ্যন্তরীণ অন্ধ শক্তিকে জ্ঞানের আলোয় রূপান্তরিত করেছেন। এই দেবীই ব্রহ্মচেতনার স্থিতিশক্তি, যিনি সৃষ্টির মধ্যেই ভারসাম্য ও স্থায়িত্ব রক্ষা করেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এই দেবীর আরাধনা যেন এক প্রতীকী বার্তা বহন করেছিল—বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্থিতি, ভাঙনের মধ্যে সংহতি, হতাশার মধ্যে আত্মবিশ্বাস। নবাবি শাসনের পতন এবং ইংরেজ শাসনের আগমনের যুগে, জগদ্ধাত্রী হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আত্মনির্ভরতার দেবী—“ধারক শক্তি”, যিনি সমাজকে পুনরায় ঐক্যের চেতনা প্রদান করেন। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে শুরু হয়ে এই পূজা দ্রুত স্থানীয় সমাজে ছড়িয়ে পড়ে; “বুড়িমা”, “ছোটো মা”-এর মতো বারোয়ারি প্রতিমাগুলি এই উৎসবকে জনগণের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করে।
একই সময়ে চন্দননগর, যা ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রভাবে একটি সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠছিল, সেখানে জগদ্ধাত্রী পূজা এক অনন্য রূপ লাভ করে। ফরাসি আলোকসজ্জা ও ইউরোপীয় শিল্পরীতি বাংলার মৃৎশিল্প ও শাক্ত ভক্তির সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে তোলে এক অসামান্য উৎসব-সংস্কৃতি। সেখানে জগদ্ধাত্রী আর কেবল ধর্মীয় দেবী নন, তিনি হয়ে ওঠেন শিল্প, সংগীত, আলোক ও নান্দনিকতার এক সাংস্কৃতিক চেতনা—বাঙালি সমাজের সমন্বয়বোধের জীবন্ত প্রতীক।
জগদ্ধাত্রী পূজা একাধারে ধর্মীয়, দার্শনিক ও সামাজিক ঐক্যের প্রতিফলন। তিনি কেবল শাক্ত তন্ত্রের দেবী নন, বরং বেদান্তের দৃষ্টিতে “স্থিতি”-র প্রতীক—যিনি ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত চেতনাশক্তিকে ধারণ করেন। তাঁর সিংহবাহিনী রূপ চেতনার নিয়ন্ত্রিত তেজের প্রতীক, আর করীন্দ্রাসুর নিধন অহংকারের রূপান্তরের প্রতীক। বাংলার ইতিহাসে এই পূজা সেই চিরন্তন বার্তাই বহন করে চলেছে—শক্তি ধ্বংস করে না, বরং ধরে রাখে; জাগরণ আবেগে নয়, স্থিতিতে; আর দেবী শৃঙ্খলাকে কেবল ধর্মে নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীরতম স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেন—তিনি হলেন জগদ্ধাত্রী, বিশ্বাধার ও চেতনার রক্ষিকা।
অষ্টাদশ শতকের সেই সময়ে বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ছিল অস্থির। নবাবী শাসনের পতন, ইংরেজ শাসনের ক্রমবিকাশ এবং সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ‘ধাত্রী’—যিনি শৃঙ্খলার ধারক ও স্থিতির প্রতীক—তাঁর পূজা শুরু করা ছিল এক অর্থে রাজনৈতিক প্রতীকবাদ। কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের জন্য এটি ছিল শুধু ব্যক্তিগত ভক্তি নয়, বরং রাজ্য ও সমাজে এক ঐশ্বরিক স্থিতির আহ্বান—এই একটি বার্তা যে, বিশৃঙ্খলার মাঝেও দেবী জগদ্ধাত্রী চেতনার স্থিতি ও ঐক্যের রক্ষিকা।
এই পূজার প্রবর্তন তাই একাধিক স্তরে তাৎপর্যপূর্ণ—ধর্মীয়ভাবে এটি ছিল অহং-দমন ও ধৃতির সাধনা, সমাজতাত্ত্বিকভাবে সংহতি ও সংস্কৃতির পুনঃস্থাপন, আর রাজনৈতিকভাবে রাজশক্তির বৈধতার পুনঃনির্মাণ। দেবী এখানে শুধু জগতের ধারক নন—তিনি রাজ্যের রক্ষাকর্ত্রীও। কৃষ্ণচন্দ্র এই ধারণাকে কেন্দ্র করে রাজকীয় পূজাকে জনউৎসবে রূপ দেন, যা ধীরে ধীরে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে নাগরিক সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
১৭৭২ সালে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় “বুড়িমা” নামে পরিচিত প্রাচীনতম বারোয়ারি প্রতিমার প্রতিষ্ঠা সেই ঐতিহ্যেরই চিহ্ন, যা মহারাজার ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষণ থেকে জনজাগরণের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়। বুড়িমার পূজা আজও নদিয়ার মানুষের কাছে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সংযোগস্থল—যেখানে ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি এক সুতায় গাঁথা।
জগদ্ধাত্রী পূজা বাংলায় কেবল দেবী উপাসনার ধারাবাহিকতা নয়; এটি এক সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুনর্গঠন আন্দোলনের প্রতীক। তাঁর পূজা শুরু হয়েছিল ভক্তির তাগিদে, কিন্তু বিকশিত হয়েছে চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঐতিহ্যে—যেখানে মহারাজার রাজনীতি, জনমানুষের ভক্তি, এবং দেবীর দার্শনিক নীতি মিলেমিশে রচনা করেছে বাংলার এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
বুড়িমা পুজোর কথকতা: কৃষ্ণনগরের “বুড়িমা” জগদ্ধাত্রী পূজা বাংলার শাক্ত ঐতিহ্যের ইতিহাসে এক বিরল অধ্যায়—যেখানে আধ্যাত্মিকতা, সামাজিক ঐক্য, শিল্প ও আবেগ মিশে গড়ে উঠেছে এক প্রাণস্পন্দিত জনউৎসব, যা আজও ২৫৩ বছর পরে একই উজ্জ্বলতায় দীপ্ত। এই পূজা শুধু এক দেবীমূর্তির উপাসনা নয়; এটি বাংলার সমাজজীবনের এক গভীর সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশ, যেখানে ঐতিহ্য, ভক্তি এবং নাগরিক চেতনা এক মহাসংগীতে মিলেমিশে যায়।
এই পূজার সূচনা হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে, আনুমানিক ১৭৭২ সালে, নদিয়ার কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়া অঞ্চলে। ইতিহাস বলে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রীর পূজা শুরু হয়েছিল প্রথমে রাজসভা-কেন্দ্রিক আচার হিসেবে—এক রাজপৃষ্ঠপোষক তান্ত্রিক উপাসনা, যা পরবর্তীতে নাগরিক সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। জনশ্রুতি অনুসারে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিজে স্বপ্নে দেবীদর্শন লাভ করেন—শুভ্রবর্ণা, সিংহবাহিনী, শান্তমুখী এক কিশোরীরূপা দেবী তাঁকে নির্দেশ দেন কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে তাঁর পূজা আয়োজন করতে। রাজা সেই নির্দেশ পালন করেন, এবং কয়েক বছরের মধ্যেই শহরের সাধারণ মানুষ, বিশেষত চাষাপাড়ার লেঠেল ও কর্মজীবী সমাজ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের উদ্যোগে একটি বারোয়ারি পূজার সূচনা করে। সেই জনউদ্যোগই ধীরে ধীরে কৃষ্ণনগরের “বুড়িমা” পূজা নামে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে।
“বুড়িমা” নামটি অবশ্য পূজার আদিকালে প্রচলিত ছিল না। প্রবীণদের মতে, প্রায় সত্তর থেকে পঁচাত্তর বছর আগে স্থানীয় ভক্তরা স্নেহের সুরে তাঁদের আরাধ্যা দেবীকে “বুড়িমা”—অর্থাৎ “প্রাচীন, অভিভাবিকা, মাতৃসুলভ আশ্রয়দাত্রী মা”—বলে ডাকতে শুরু করেন। সময়ের সঙ্গে সেই সম্বোধনই হয়ে ওঠে কৃষ্ণনগরের ধর্মীয় ও আবেগিক পরিচয়ের প্রতীক। আজ এই নামে উচ্চারিত হয় এক মাতৃসত্তার চিহ্ন, যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শহরটিকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন।
কৃষ্ণনগরে দুর্গাপূজা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু স্থানীয়দের কাছে প্রকৃত শারদোৎসব হলো জগদ্ধাত্রী পূজা—আর তার প্রাণকেন্দ্র বুড়িমা। দুর্গাপূজার রাজকীয় ঐশ্বর্যের বিপরীতে বুড়িমার পূজায় আছে এক অন্য রকমের আবেগ—এখানে নেই থিমের প্রতিযোগিতা বা বাণিজ্যিক প্রদর্শনী; এখানে আছে এক অপরিবর্তনীয় ভক্তি, এক ঘনিষ্ঠ সামাজিক সংহতি। এই পূজার মণ্ডপে প্রবেশ করলেই মনে হয় যেন শহরজুড়ে এক মাতৃস্পর্শ ছড়িয়ে আছে—মাটির গন্ধে, শঙ্খের ধ্বনিতে, দীপশিখার নরম আলোয়।
অর্থনৈতিক কাঠামোতেও এই পূজার এক আলাদা তাৎপর্য আছে। কোনো রকম চাঁদা তোলা হয় না; মানুষ নিজের ইচ্ছায়, ভক্তির টানে সারিবদ্ধভাবে এসে দান করেন। কেউ কয়েন ফেলে যান, কেউ সোনার গয়না, কেউ আবার পরিবারের নামে অর্ঘ্য প্রদান করেন।