জগদ্ধাত্রী: ৬



মনোবিজ্ঞানের ভাষায় সত্ত্বগুণ হলো চেতনার স্বচ্ছ অবস্থা—যেখানে মন শান্ত, বোধ জাগ্রত, এবং ইন্দ্রিয়গতি সংযমিত। এই অবস্থায় ব্যক্তি অহং-এর আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে অন্তর্দৃষ্টিতে স্থিত হয়। জগদ্ধাত্রী সেই অন্তর্দৃষ্টির দেবী; তাঁর পূজা মানে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বচ্ছতার সাধনা। তিনি শেখান, প্রকৃত শক্তি বাহ্যিক কর্মে নয়, বরং অন্তর্গত স্থিতিতে—যেখানে মন তার নিজস্ব অশান্ত প্রবৃত্তিকে অতিক্রম করে জ্ঞানের নিস্তব্ধতায় পৌঁছে যায়।

এভাবে শাক্ত ত্রিতত্ত্বে দেখা যায়—দুর্গা রজঃগুণের, অর্থাৎ ক্রিয়াশীলতার; কালী তমোগুণের, অর্থাৎ বিলয় ও অন্তর্জগতের; আর জগদ্ধাত্রী সত্ত্বগুণের, অর্থাৎ ভারসাম্য ও জ্ঞানের প্রতীক। তিনজনই এক পরম শক্তির ভিন্ন ভিন্ন দিক, কিন্তু জগদ্ধাত্রী সেই কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সব গতি থেমে স্থিরতার মধ্যে দীপ্তি জন্ম নেয়। তিনি ধৃতির দেবী—স্থিরতার মহাশক্তি—যিনি অহংকার বিনাশের মাধ্যমে মুক্তির পথ খুলে দেন। তাঁর সত্ত্বগুণী প্রকাশ আমাদের শেখায় যে, আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা অর্জিত হয় তখনই, যখন মন সমতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, জ্ঞান আলোকিত হয়, এবং আত্মা সমস্ত গুণের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের অন্তর্গত ব্রহ্মচেতনার সঙ্গে একীভূত হয়।

মনোবিজ্ঞান, জ্ঞানীয় বিজ্ঞান এবং সাত্ত্বিক সাধনা: জগদ্ধাত্রীর তত্ত্ব ও প্রতিমা কেবল আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় নয়—এটি মানবমনের গভীরতম স্তরকে স্পর্শ-করা এক দার্শনিক ও মনোবৈজ্ঞানিক মডেল। আধুনিক মনোবিজ্ঞান এবং জ্ঞানীয় বিজ্ঞানের আলোকে দেখা যায়, দেবীর প্রতিটি প্রতীক যেন মানবচেতনার অন্তর্গত গতিশীলতারই এক রূপক। তাঁর মধ্যে যেভাবে স্থিতি ও শক্তির সমন্বয় দেখা যায়, তা আজকের ভাষায় বলা যায়—emotional regulation (আবেগনিয়ন্ত্রণ), self-control (আত্মসংযম) এবং neuroplasticity (মস্তিষ্কের পুনর্গঠন ক্ষমতা)-র জীবন্ত প্রতিমূর্তি।

তান্ত্রিক সাধনায় বলা হয়—চেতনার শুদ্ধি ও স্থিরতা আসে ধীরে ধীরে, মনোসংযম (thought restraint), আত্ম-নিরীক্ষণ (self-observation) এবং মনোযোগের পুনর্নির্দেশ (attentional redirection)-এর মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়াগুলি আসলে আজকের স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় “rewiring”—অর্থাৎ মস্তিষ্কে নতুন স্নায়ু-সংযোগ গঠন। যেমন একজন যোগী বা সাধক ধ্যানের মাধ্যমে নিজের মনকে শুদ্ধ করেন, তেমনি আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, ধারাবাহিক মনোনিবেশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ মস্তিষ্কে নতুন নিউরাল পথ তৈরি করে—যা পুরোনো অজ্ঞান ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রবৃত্তিকে মুছে দিয়ে সজাগ ও শান্ত বোধকে প্রতিষ্ঠা করে।

এই দৃষ্টিতে জগদ্ধাত্রী কেবল দেবী নন; তিনি চেতনার শৃঙ্খলার দেবী—যিনি অহংকার ও প্রবৃত্তির উত্তাল তরঙ্গকে রূপান্তর করেন সাত্ত্বিক স্থিতিতে। তাঁর সিংহ সেই প্রখর জীবনশক্তি, যা নিয়ন্ত্রণে থাকলে জ্ঞানের বাহন হয়; আর তাঁর শান্ত মুখ সেই স্থির চেতনার প্রতীক, যা সমস্ত গতির মধ্যেও সমবৃত। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে যেমন বলা হয়—“A regulated mind is a liberated mind”—তেমনি জগদ্ধাত্রীর তত্ত্বও বলে, মন যখন সংযত, সজাগ এবং অন্তঃস্থিত, তখনই মুক্তি সম্ভব।

জগদ্ধাত্রী আধুনিক কগনিটিভ সায়েন্স ও তন্ত্র—এই দুই ধারার এক সেতু: তিনি মানবমস্তিষ্কের ও আত্মার উভয় স্তরে সেই শক্তি, যা অস্থিরতাকে রূপান্তরিত করে সচেতন ভারসাম্যে, এবং বিশৃঙ্খল প্রবৃত্তিকে উন্নীত করে শান্ত জ্ঞানে। (কগনিটিভ সায়েন্স হলো মানুষের মনকে একটি "তথ্য প্রক্রিয়াকরণকারী যন্ত্র" হিসেবে অধ্যয়ন করার বিজ্ঞান, যেখানে মস্তিষ্ক কীভাবে চিন্তা করে, শেখে ও অনুভব করে তা বোঝা যায়।)

ক. মনস্তাত্ত্বিক মডেলিং—অহং নিয়ন্ত্রণ এবং আবেগিক ভারসাম্য: জগদ্ধাত্রীর বাহন-দৃশ্য—সিংহ (সত্ত্ব) ও হাতি (অহংকার)-এর সংঘাত—আধুনিক মনস্তত্ত্বে অন্তর্গত দ্বন্দ্বের এক আদর্শ প্রতীক। সিংহ এখানে চেতন নিয়ন্ত্রিত ইচ্ছাশক্তির প্রতীক—সেই সাত্ত্বিক মন, যা সচেতন ও সংযত। অপরদিকে, হাতি (করীন্দ্রাসুর) হলো অহমের অবদমিত, প্রাবল্যশীল ও আত্মমোহে নিমজ্জিত দিক—যে-প্রবৃত্তি মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা, ভয়, প্রতিযোগিতা এবং অস্থিরতার দিকে টেনে নিয়ে যায়। জগদ্ধাত্রীর প্রতিমায় দেখা যায়, তিনি এই দুই শক্তির উপরে অবস্থান করছেন—অর্থাৎ চেতনা সেই স্তরে উন্নীত হয়েছে, যেখানে প্রাণশক্তি ও অহং উভয়ই নিয়ন্ত্রিত ও সমন্বিত।

এই রূপটিই—অর্থাৎ দেবীর শান্ত, সংযত, স্থিত ও দীপ্ত রূপ—আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ভাষায় emotional regulation বা আবেগিক সংযমের প্রতীক। মনোবিজ্ঞান বলে, সুস্থ মানসিক অবস্থার জন্য আবেগকে দমন করা নয়, বরং তাকে রূপান্তরিত করা জরুরি—অন্ধ প্রবৃত্তিকে সচেতনতার আলোয় আনতে পারলেই তা বিকৃত শক্তি না হয়ে সৃষ্টিশীল শক্তিতে পরিণত হয়। অ্যারন টি. বেক ও অ্যালবার্ট এলিস-এর জ্ঞানতাত্ত্বিক মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব (Cognitive Behavioral Theory) বলছে, আবেগের মূল কারণ চিন্তা; এবং চিন্তা যদি আত্মসচেতনতার দ্বারা পরিশোধিত হয়, তবে আবেগেরও রূপান্তর ঘটে। জগদ্ধাত্রীর তত্ত্ব ঠিক এই মনস্তাত্ত্বিক সত্যেরই প্রতীকী রূপ।

দেবীর শান্ত রূপটি বোঝায়—মন নিজের অন্তর্গত রজোগুণী (উত্তেজনা, ক্রোধ অধৈর্যভাব) ও তমোগুণী (অবসাদ, অজ্ঞতা, নিস্পৃহতা) বিকার অতিক্রম করে সত্ত্বগুণ-এর আলোকময় ভারসাম্যে পৌঁছায়। শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় (১৪.৬) কৃষ্ণ বলেন—“সত্ত্বং নির্মলত্বাৎ প্রকাশকমনাময়ম্‌। সুখসঙ্গেন বদ্ধনাতি জ্ঞানসঙ্গেন চা অনঘ।।” অর্থাৎ, সত্ত্বগুণ স্বচ্ছতার দ্বারা উজ্জ্বল, যা জ্ঞান ও সুখের সঙ্গে যুক্ত করে। কৃষ্ণ এখানে বুঝিয়েছেন যে, সত্ত্বগুণ বা শুদ্ধতার গুণ মানুষের মনে আলো, জ্ঞান ও শান্তি আনে। এটি মেঘমুক্ত আকাশের মতো স্বচ্ছ—যেখানে মন পরিষ্কার থাকে, চিন্তা স্থির হয়, আর অন্তরে এক গভীর আনন্দ অনুভূত হয়।

“নির্মলত্বাৎ প্রকাশকম্‌”—মানে সত্ত্বগুণ মলিন নয়, তাই তা আলো ছড়ায়, সত্যকে প্রকাশ করে। “অনাময়ম্‌”—মানে এতে কোনো মানসিক বা নৈতিক অসুখ নেই; মন শান্ত ও সুস্থ থাকে। “সুখসঙ্গেন বদ্ধনাতি জ্ঞানসঙ্গেন চা”—মানে এই গুণ সুখ ও জ্ঞানের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত রাখে। অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত, তার মন আনন্দময় ও জ্ঞানপূর্ণ হয়, যদিও সেই আনন্দ ও জ্ঞানই তাকে কখনও জগতের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে বেঁধে রাখে—কারণ, সে তখনও “আমি জানি” ও “আমি সুখী”—এই বোধে স্থিত।

অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, সত্ত্বগুণ হলো মুক্তির দ্বার—এটি মনকে এমনভাবে পরিশুদ্ধ করে যে, মানুষ পরিশেষে নিজের সত্য স্বরূপ (আত্মা) উপলব্ধি করতে পারে। অর্থাৎ, সত্ত্বগুণের কাজ হলো অজ্ঞান দূর করা, যেন মন আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং সেখানে প্রতিফলিত হয় পরম সত্য—ব্রহ্মচেতনা।

জগদ্ধাত্রী সেই অবস্থারই রূপক—যেখানে চেতনা অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণে এনে প্রশান্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

জগদ্ধাত্রীর তত্ত্বে “আত্মসচেতনতা” বা Self-awareness-ই সাত্ত্বিক সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। এর মানে, মানুষকে নিজের ভেতরের চিন্তা, অনুভূতি, প্রবণতা ও প্রতিক্রিয়াগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা শিখতে হবে—অর্থাৎ, আমি এখন রাগ করছি, আমি এখন ভয় পাচ্ছি, আমি এখন হিংসা করছি—এই অভ্যন্তরীণ ঘটনাগুলিকে চিনে ফেলা। যখন এই সচেতনতা জন্ম নেয়, তখন মন আর আবেগের দ্বারা চালিত হয় না; বরং চেতনা মনকে চালায়। এটাকেই বলা হয় আত্মসচেতনতা—নিজেকে নিজের সামনে স্পষ্ট দেখা।

আধুনিক জ্ঞানীয় বিজ্ঞান (Cognitive Science) এই প্রক্রিয়াকে বলে Meta-awareness বা সচেতনতার ওপর সচেতনতা—অর্থাৎ আমরা শুধু ভাবছি, তা নয়, ভাবনার প্রক্রিয়াটিকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারছি। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি রাগ করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে, “আমি রেগে যাচ্ছি”—তাহলে সে রাগের দাস নয়, বরং তার নিয়ন্ত্রক। এই স্তরের সচেতনতা মানুষের মস্তিষ্কের সামনের অংশে অবস্থিত prefrontal cortex নামক অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এই প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স-কেই বলা যায় মস্তিষ্কের “নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র”। এখান থেকেই জন্ম নেয় মনোযোগ, সংযম, নৈতিক বিচারবোধ ও সহানুভূতি—যা মানুষের উচ্চতর চেতনার লক্ষণ। যখন কেউ ধ্যান, নামজপ, বা তান্ত্রিক মনোসংযম অনুশীলন করে, তখন এই অঞ্চলটি আরও সক্রিয় হয়।

রিচার্ড ডেভিডসন (University of Wisconsin) এবং অ্যান্ড্রু নিউবার্গ (University of Pennsylvania)-এর neurotheology বিষয়ক গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, নিয়মিত ধ্যান বা মন্ত্রজপ মস্তিষ্কে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মন আরও স্থিতিশীল, সংযত ও সহানুভূতিশীল হয়। এটি ঠিক সেই অবস্থাই, যা সাত্ত্বিক চেতনা হিসেবে শাস্ত্রে বর্ণিত—মন তখন নির্মল, জ্ঞানময় ও শান্ত। (নিউরোথিওলজি (Neurotheology) বা স্নায়ু-ঈশ্বরতত্ত্ব হলো একটি আন্তঃশাস্ত্রীয় গবেষণা ক্ষেত্র, যা স্নায়ুবিজ্ঞান (Neuroscience) এবং ঈশ্বরতত্ত্ব (Theology) বা ধর্মীয় অভিজ্ঞতা-র মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে।)

জগদ্ধাত্রীর উপাসনা কেবল বাহ্যিক আচার নয়—এটি এক প্রাচীন চেতনা-প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া, যা আজকের স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় "সচেতনতার দ্বারা স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ" বা “neural regulation through awareness”। তাঁর সাধনা আমাদের শেখায়—মনকে দমন নয়, বুঝে গ্রহণ করতে হয়; আর বোঝার মধ্য দিয়েই অন্ধ আবেগ আলোকিত জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে দেবীর “স্থিতি” তত্ত্ব আধুনিক মস্তিষ্কবিজ্ঞানের “স্থিতিশীল চেতনা”-র সঙ্গেও একাত্ম হয়।

জগদ্ধাত্রী তাই কেবল এক পৌরাণিক দেবী নন, বরং এক জ্ঞানীয় ভারসাম্যের প্রতীক—যিনি আবেগকে দমন নয়, চেতনার আলোয় সঞ্জীবিত করেন। তাঁর স্থির মুখমণ্ডল, কোমল দৃষ্টি ও সিংহবাহিনী রূপ বোঝায় সেই অবস্থাকে, যেখানে জীবনশক্তি (instinctual drive) সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত অথচ জীবন্ত, শান্ত অথচ সক্রিয়।

তাঁর সাধনা এই কারণে কেবল ভক্তির প্রকাশ নয়; এটি এক মনোপ্রশিক্ষণ—যেখানে মানুষ নিজের মধ্যে লুকানো অন্ধকারকে চিনে তা আলোকিত করে। অহং, লোভ, ঈর্ষা, ভয়—এসব আবেগ এখানে “শত্রু” নয়, বরং “উপকরণ”—যেগুলিকে চেতনার মাধ্যমে শুদ্ধ ও রূপান্তরিত করতে হয়। এই পথেই অর্জিত হয় সত্যিকারের মুক্তি, যা আধুনিক ভাষায় "আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে আবেগ নিয়ন্ত্রণ", আর বেদান্তের ভাষায়—অহংকার-ক্ষয় ও আত্মপ্রকাশের একীভবন। জগদ্ধাত্রী সেই দেবী, যিনি মন ও মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বকে ঐক্যে রূপ দেন—যেখানে আবেগ, বুদ্ধি ও আত্মা মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে জ্ঞানের প্রশান্ত দীপ্তি; আর সেই দীপ্তিই মুক্তির প্রথম আভা।

জগদ্ধাত্রী আখ্যানের একটি সূক্ষ্ম দার্শনিক দিক হলো—দেবী হাতিকে হত্যা করেন না, বরং সিংহের দ্বারা তাকে নিয়ন্ত্রিত করেন। এই প্রতীকের মানে, মানবমনকে পরিশুদ্ধ করতে প্রবৃত্তি বা জীবনশক্তিকে ধ্বংস করা নয়, বরং চেতনার নিয়ন্ত্রণে এনে একীভূত করা প্রয়োজন। হাতি (অহং) বিলীন নয়—সে নিয়ন্ত্রিত, সংযত, একত্রীভূত; ঠিক যেমন ধ্যানের মধ্যে শক্তি ও শান্তি পরস্পরবিরোধী নয়, বরং ঐক্যবদ্ধ।

এইভাবে জগদ্ধাত্রী আধুনিক মনোবিজ্ঞানে আত্মিক সংহতি বা মনো-সামাজিক সংহতি (psychic integration)-র এক আদি প্রতীক—যিনি দেখান, কীভাবে গভীর অন্তর্দৃষ্টির স্থিরতা বজায় রেখে মানুষ নিজের মধ্যকার বিপুল, প্রবল, অবাধ শক্তিকেও ধারণ করতে পারে। তাঁর রূপ শেখায়, ভারসাম্য মানে স্থবিরতা নয়—এটি এক জীবন্ত সত্ত্ব, যেখানে শক্তি ও শান্তি, কর্ম ও ধ্যান, প্রেরণা ও সংযম একে অপরের পরিপূরক।

জগদ্ধাত্রী সেই অন্তর্গত সাম্যচেতনার প্রতিমূর্তি—যিনি মানবমনকে শেখান, কীভাবে চেতনার আলোর নিয়ন্ত্রণে অহংকারের ভারাক্রান্ত হাতিকে সংযত করে, জীবনের প্রবল শক্তিকে জ্ঞানের মহাসমুদ্রে পরিণত করা যায়।

আত্মিক সংহতি বা মনো-সামাজিক সংহতি (Psychic Integration) বলতে বোঝায়—মানবচেতনার বিভিন্ন স্তর, যেমন—শরীর, মন, আবেগ, চিন্তা, ইচ্ছা ও আত্মা—এই সমস্ত বিচ্ছিন্ন দিকগুলিকে এক ঐক্যবদ্ধ ভারসাম্যে স্থাপন করা। সাধারণত মানুষ তার নিজের ভেতরে এক নয়: চিন্তা একদিকে, আবেগ অন্যদিকে, ইচ্ছা আরেকদিকে ছুটে চলে। এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই জন্ম নেয় মানসিক দ্বন্দ্ব, উদ্‌বেগ, অনিশ্চয়তা ও আত্ম-সংঘাত। আত্মিক সংহতি হলো সেই অবস্থা, যখন এই সমস্ত বিভাজন মিলেমিশে এক হয়—যখন ব্যক্তি নিজের ভেতরের শক্তি, বোধ ও আবেগকে এক কেন্দ্রে সমন্বিত করতে পারে।