জগদ্ধাত্রী: ৫



কর্ম ও ফল: এই গুণগুলিই কর্মের ফল সৃষ্টি করে এবং আত্মাকে সেই ফল ভোগের জন্য বার বার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে টেনে আনে। সত্ত্ব (জ্ঞান), রজ (কর্ম) এবং তম (আলস্য)—এই তিনটি গুণ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আত্মাকে এই জগতে লিপ্ত করে।

এই ত্রিগুণের মধ্যে সত্ত্ব হলো স্বচ্ছতা, জ্ঞান ও স্থিরতার গুণ; রজঃ হলো গতি, কর্ম, বাসনা ও উচ্ছ্বাসের প্রতীক; আর তমঃ হলো অন্ধতা, জড়তা, অলসতা ও মোহ। এখন, এখানে সিংহ প্রতীক সেই রজঃ-শক্তির নিয়ন্ত্রিত রূপ, আর হাতি বা করীন্দ্রাসুর অহংকার ও তমোগুণের অন্ধ প্রাবল্যের প্রতীক।

তন্ত্রশাস্ত্র বলে, সমস্ত আধ্যাত্মিক সাধনার মূল হলো অহংকারের নিবৃত্তি—কারণ অহং-ই সেই কেন্দ্র, যেখানে চেতনা নিজেকে সীমিত করে “আমি” বলে চিহ্নিত করে। কাত্যায়নী তন্ত্রে দেবীকে বলা হয়েছে—“করীন্দ্রাসুর নিসূদিনী”, অর্থাৎ যিনি হাতি-রূপী অসুরকে বধ করেছেন। হাতি এখানে গর্ব, মদ ও অহংকারের প্রতীক—যা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কেন উপনিষদ (১.১)-এর মৌলিক প্রশ্ন—“কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ?”—“কে এই মনকে চালায়?”—এই প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত আছে সেই অজ্ঞতার উৎস, যা মনে করে যে “আমি-ই কর্তা”, “আমি-ই চালক”। কিন্তু উপনিষদ উত্তর দেয়—মন বা প্রাণ নিজের শক্তিতে কিছুই করে না; সবই এক পরম চেতনার প্রেরণায় চলে।

হাতি বা করীন্দ্রাসুর সেই বিভ্রমের প্রতীক, যা বলে “আমি পৃথক”, “আমি স্বয়ং শক্তিমান”। আর দেবী যখন সিংহে আরোহিণী, তখন বোঝায়, চেতনা যখন রজঃকে (গতি) জ্ঞানের দ্বারা সংযত করে, তখন সেই শক্তি আর অহং-এর অধীন থাকে না—বরং পরিণত হয় ব্রহ্মচেতনার বাহনে। সিংহের চঞ্চল শক্তি তখন নিয়ন্ত্রিত, আর হাতির অন্ধ শক্তি নত। এটি মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক, কিন্তু বেদান্তের ভাষায় এটি “অহংকার-ক্ষয়”—যেখানে কর্তার ধারণা বিলুপ্ত হয়ে চেতনা নিজের মূল সত্তায় স্থিত হয়।

এই রূপকটির আরও একটি সূক্ষ্ম অর্থ আছে। কেন উপনিষদ-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে—যখন দেবতারা নিজেদের শক্তিকে নিজেদের বলে মনে করেছিল, তখন দেবী উমা হৈমবতী রূপে এসে তাঁদের শিক্ষা দিলেন—“তোমাদের শক্তি কোনো স্বতন্ত্র দেবশক্তি নয়; বরং ব্রহ্মেরই প্রকাশ।” ঠিক তেমনি, করীন্দ্রাসুরের দমন বোঝায়, অহং-এর মধ্য দিয়ে যে-বিভ্রম জন্ম নেয়—“আমি স্বতন্ত্র”—সেই বিভ্রমের বিনাশই মুক্তি।

বেদান্ত ও যোগ দর্শনে বলা হয়—“অহংকারো মূলম্‌ বান্ধস্য”, অর্থাৎ "অহংকারই হলো বন্ধন বা আবদ্ধতার মূল কারণ।" জাগতিক দুঃখ-কষ্ট এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ থাকার (বন্ধন) একমাত্র বা প্রধান কারণ হলো অহংকার। বন্ধন দেহের নয়, মনের; এবং মনের সেই বন্ধনের মূল কারণ হলো মিথ্যা অহংকার।

আধ্যাত্মিক পরিভাষায় অহংকার বলতে 'মিথ্যা আমি-বোধ' বা 'কর্তৃত্বাভিমান' বোঝানো হয়। অর্থাৎ, শুদ্ধ আত্মা (দ্রষ্টা) যখন ভুল করে নিজেকে দেহ, মন, বুদ্ধি বা কর্মের কর্তা ও ভোক্তা মনে করে, তখন সেই ভুল ধারণাই হলো অহংকার। যখন কেউ মনে করে, "আমি কাজ করছি" (কর্তা) এবং "আমি ফল ভোগ করছি" (ভোক্তা), তখন সে কর্মের ফল (পাপ-পুণ্য) দ্বারা আবদ্ধ হয়ে যায়। এই কর্মফলের ভোগের জন্যই তাকে বার বার পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয়। এই অহংকারই হলো আসক্তি, রাগ-দ্বেষ এবং দ্বৈতভাবের জন্ম দেয়। মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করতে হলে এই কর্তৃত্বের মিথ্যা অহংকার ত্যাগ করতে হয়। যখন মানুষ উপলব্ধি করে, আমি কর্তা নই, ভোক্তাও নই; আমিই ব্রহ্ম—অর্থাৎ সে কেবল ঈশ্বরের যন্ত্র মাত্র—তখনই সে বন্ধনমুক্ত হয়।

এই অহংকারই হাতির মতো স্থূল, দৃঢ় ও আত্মম্ভরিত; আর দেবী, যিনি চেতনার প্রতীক, সেই অহংকারকে জ্ঞানরূপ সিংহ দ্বারা দমন করেন। তখন সৃষ্টির তমোগুণ-প্রবণ শক্তি আর ধ্বংসাত্মক থাকে না; তা রূপান্তরিত হয় সাত্ত্বিক দীপ্তিতে—যেখানে রজঃ ও তমঃ আর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সত্ত্বের আলোয় সুষমা লাভ করে।

জগদ্ধাত্রীর এই চিত্র কেবল পৌরাণিক যুদ্ধ নয়; এটি আত্মার অন্তর্গত আত্ম-সংগ্রাম—যেখানে চেতনা নিজের নিম্নতর প্রকৃতিকে জয় করে নিজের পরম স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় (৬.৫) কৃষ্ণ বলেন, “উদ্ধরেদ্‌ আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত্‌। আত্মৈব হ্যত্মনো বন্দুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ।।” এই শ্লোকটি গীতার অন্যতম গভীর মনোবৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক উক্তি, যেখানে কৃষ্ণ আত্মাকে দুটি স্তরে ব্যাখ্যা করেছেন—একটি হলো নিম্ন আত্মা (অহং, মন, ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিচালিত ব্যক্তিত্ব), আর অন্যটি হলো উচ্চ আত্মা (শুদ্ধ চেতনা বা আত্মস্বরূপ)। শ্লোকটির আক্ষরিক অর্থ—মানুষকে নিজের আত্মার দ্বারা নিজেকেই উন্নীত করতে হবে; নিজেকেই পতিত করা অনুচিত। কারণ, আত্মাই নিজের বন্ধু, আত্মাই নিজের শত্রু। অর্থাৎ, মানুষ নিজের দ্বারা নিজেকে উদ্ধার করবে; নিজেকে নিরাশ বা অধঃপতিত করবে না। কারণ, নিজেই নিজের বন্ধু (বা সখা) এবং নিজেই নিজের শত্রু।

এই শ্লোকটি এক আত্ম-মনস্তাত্ত্বিক যাত্রার সারসংক্ষেপ। বেদান্ত বলে, মানুষের মধ্যে দুটি প্রবণতা চিরকাল সক্রিয় থাকে—একটি উর্ধ্বগামী (বোধ, সচেতনতা, জ্ঞান, সত্ত্ব) এবং অন্যটি অধোগামী (অবচেতনা, আকাঙ্ক্ষা, মোহ, রজঃ ও তমঃ)। “আত্মা” এখানে সেই চেতনার নাম, যা উর্ধ্বগামী হতে চায়, নিজের উৎসে ফিরে যেতে চায়—অর্থাৎ পরম আত্মা-র সঙ্গে মিলিত হতে চায়। আর “অন্য আত্মা” বোঝায় সেই সীমাবদ্ধ সত্তা—অহং, যাকে অদ্বৈত বেদান্ত অবিদ্যা-প্রসূত আত্মবোধ বলে।

যখন মানুষ অজ্ঞানের বশে ইন্দ্রিয়-আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, ঈর্ষা বা ভয়ের দ্বারা চালিত হয়, তখন নিম্ন আত্মা উচ্চ আত্মার শত্রু হয়ে ওঠে। তখন চেতনা নিজেই নিজের পতনের কারণ হয়। কঠোপনিষদ (১.৩.৬)-এ এই অবস্থারই প্রতীক দেখা যায়—“যেন রথের অশ্বা”—অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলি যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে তারা রথটিকে (মানবজীবনকে) ভুল পথে টেনে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে, যখন মন নিয়ন্ত্রিত, ইচ্ছাশক্তি সংযত, আর চিন্তা চেতনার কেন্দ্রে স্থির হয়—তখন নিম্ন আত্মা উচ্চ আত্মার বন্ধু হয়ে ওঠে। তখন মন আর শত্রু নয়; বরং মুক্তির উপকরণ। সেই অবস্থায় মানুষ নিজেরই চেতনার শক্তিতে অজ্ঞানকে দমন করে, এবং নিজের মধ্যেই মুক্তি লাভ করে।

ঈশোপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও বেদান্ত সিদ্ধান্ত এই—“অবিদ্যায়া বদ্ধঃ, বিদ্যয়ামুক্তঃ”—অর্থাৎ "অবিদ্যার দ্বারা (জীব) আবদ্ধ হয়, এবং বিদ্যার দ্বারা মুক্ত হয়।" অজ্ঞানেই বন্ধন, আর জ্ঞানেই মুক্তি। এই জ্ঞান কোনো তথ্য নয়, বরং আত্মবোধ—যে-উপলব্ধিতে জানা যায়, “আমি দেহ নই, মন নই, আমি সেই চৈতন্য, যে সব কিছুর সাক্ষী।” এই উপলব্ধি হলেই মানুষ নিজের শত্রু-স্বরূপ মনকে বন্ধুতে রূপান্তরিত করে।

এই কারণেই কৃষ্ণ বলেছেন—“উদ্ধরেদ্‌ আত্মনাত্মানং”—অর্থাৎ নিজেকে বাইরে নয়, নিজের মধ্যেই উদ্ধার করো। দেবী জগদ্ধাত্রীর প্রতীকী সংগ্রামও এই তত্ত্বের প্রকাশ—তিনি অহং (করীন্দ্রাসুর)-এর অন্ধ শক্তিকে নিজের জ্ঞানের আলোয় পরাজিত করেন। সিংহ তাঁর নিয়ন্ত্রিত প্রাণশক্তি, আর তিনি নিজে সেই পরম চেতনা, যিনি মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়—সব কিছুকে ভারসাম্যে ধরে রাখেন।

এই শ্লোকের মূল বোধ হলো—মুক্তি কোনো বাহ্যিক অনুগ্রহ নয়; এটি আত্মার নিজেরই উত্তরণ। মানুষ যতক্ষণ নিজের ভেতরের শত্রু—অহংকার, মোহ, অজ্ঞতাকে চেনে না, ততক্ষণ সে দাস। আর যখন সেই অজ্ঞতা বিলীন হয়, তখন সে মুক্ত, কারণ তখন চেতনা নিজেকে চিনেছে—“অহম্‌ ব্রহ্মাস্মি।”

জগদ্ধাত্রী তাই এই অন্তরযুদ্ধের বিজয়রূপা দেবী—যিনি রজঃকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন, তমঃকে জ্ঞানে রূপান্তর করেন, আর সত্ত্বের শান্ত আলোককে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সিংহ আর হাতি—এই দুই প্রতীকই শেষপর্যন্ত মিলিত হয় এক আধ্যাত্মিক ঐক্যে, যেখানে শক্তি ও চেতনা, গতি ও স্থিরতা—সব এক অদ্বৈত সত্যে পরিণত হয়।

দেবীর প্রতীকের দার্শনিক তাৎপর্য সরাসরি কেনোপনিষদের কিংবদন্তির সঙ্গে যুক্ত। কেনোপনিষদে দেবতারা নিজেদের বিজয়ে উল্লসিত হয়ে যখন অহংকারে আচ্ছন্ন হন, তখন দেবী উমা তাঁদের সামনে এক অতিসাধারণ ঘাসের ডগা রাখেন, যা তাঁরা নাড়াতে পর্যন্ত পারেন না। দেবী সেই বিভ্রম ভেঙে তাঁদের উপলব্ধি করান যে, শক্তি তাঁদের নয়—সেই পরম চেতনার, যিনি তাঁদের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল। এখানেই অহংকারের শিক্ষা নিহিত। জগদ্ধাত্রী সেই একই চেতনার প্রতীক—তিনি শক্তির আসন থেকে অহংকারের প্রতিমাকে দমন করেন, যেন স্মরণ করিয়ে দেন: শক্তি যদি চেতনার নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তবে তা ধ্বংসাত্মক; আর চেতনা যদি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে তা নিষ্প্রভ।

হাতি এখানে “অহং”-এর প্রতীক—অন্ধ, ভারী, আত্মকেন্দ্রিক, গর্বিত। সিংহ নির্দেশ করে “নিয়ন্ত্রিত চেতনা”—সচেতন শক্তি, যা নিজের স্বরূপ জানে এবং সেই জ্ঞানে অপ্রতিরোধ্য। সিংহ হাতিকে পদানত করছে মানে, চেতনা তার নিজের অহং-প্রবণ প্রকৃতিকে জ্ঞানের আলোয় শাসন করছে। আর সেই পুরো দৃশ্যের উপরে আসীন জগদ্ধাত্রী, যিনি এই দ্বন্দ্বের মধ্যস্থ দেবী—তিনি শাসন করেন উভয়কে, চেতনার তেজ ও অহং-এর অবদমন উভয়ই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।

এই মিথের গভীরতা এখানেই যে, দুর্গার মহিষাসুরবধ বহিরাগত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে চিহ্নিত করে, কিন্তু জগদ্ধাত্রীর করীন্দ্রাসুরবধ নির্দেশ করে আত্মিক রণক্ষেত্রের ভেতরের যুদ্ধ—মানবমনের গভীরে অহং, আসক্তি ও আত্মমোহের বিরুদ্ধে সাধকের সংগ্রাম। এটি এক মনস্তাত্ত্বিক সাধনা, যেখানে জগদ্ধাত্রী সেই অন্তর্গত শৃঙ্খলার দেবী—যিনি অহংকারকে রূপান্তরিত করে আত্মসচেতনার দিকে নিয়ে যান।

জগদ্ধাত্রীর বাহন-রূপ কেবল এক পৌরাণিক প্রতীক নয়; এটি মুক্তির রূপরেখা। তিনি শেখান, আধ্যাত্মিক উন্নতি বাহ্যিক অসুরবিনাশে নয়, বরং অন্তরের অহং-বিনাশে নিহিত। সিংহ যদি চেতনার সত্ত্বশক্তির প্রতীক হয়, তবে হাতি সেই তমসিক অহং, যা ভারাক্রান্ত ও অচল। জগদ্ধাত্রী তাঁদের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে ঘোষণা করেন—যে-মন নিজেকে জয় করতে পারে, সে-ই প্রকৃত বিশ্বধারক, সে-ই জগদ্ধাত্রী।

গ. জগদ্ধাত্রী এবং ত্রিগুণ কাঠামো: হিন্দু দর্শনের মৌলিক দার্শনিক কাঠামোয় বলা হয়েছে—প্রকৃতি বা প্রকাশিত মহাবিশ্ব তিনটি গুণের (গুণত্রয়) পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত। এই গুণত্রয় হলো—সত্ত্ব, যা আলোক, পবিত্রতা ও ভারসাম্যের প্রতীক; রজঃ, যা ক্রিয়া, গতি ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ; এবং তমঃ, যা অন্ধকার, জড়তা ও বিভ্রমের রূপ। এই তিন গুণ পরস্পরবিরোধী নয়—বরং এক অপরকে পরিপূরক করে; এবং সৃষ্টির, সংরক্ষণের ও বিলয়ের গতিশীল সমতা এই ত্রিগুণের ভারসাম্যের মাধ্যমেই রক্ষিত হয়।

এই ত্রিগুণ কাঠামোর মধ্যেই জগদ্ধাত্রী দেবী এক বিশেষ অবস্থান অধিকার করেন—তিনি সত্ত্বগুণের প্রতিমূর্তি, সেই স্থিত, বিশুদ্ধ ও আলোকিত শক্তি, যা চেতনার ভারসাম্য ও স্থিরতাকে রক্ষা করে। যেখানে রজঃ গতি ও পরিবর্তনের প্রতীক, এবং তমঃ বিশ্রাম ও বিলয়ের, সেখানে সত্ত্ব হলো তাদের মধ্যে মধ্যস্থ আলোক—যা উভয়কে সমন্বিত করে চেতনার শুদ্ধ প্রকাশ ঘটায়। জগদ্ধাত্রী সেই আলোকের মূর্তরূপ, যিনি বহুত্বের অন্তর্নিহিত বিশৃঙ্খলার মাঝেও ধৃতির স্থায়ী ছন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। (ধৃতি হলো সেই মানসিক দৃঢ়তা, যা জীবকে কোনো পরিস্থিতি বা সিদ্ধান্ত থেকে টলে যেতে দেয় না।)

তাঁর প্রতিমার শান্ত, উপবিষ্ট ভঙ্গি এবং মুখের অবিচল প্রশান্তি এই সত্ত্বগুণের দৃশ্যরূপ। দুর্গার উগ্র যুদ্ধ-ভঙ্গি যেখানে রজোগুণের গতিশীল প্রকাশ, আর কালী দেবীর অগ্নিময় তেজ ও বিলয়মুখী ভয়াল রূপ যেখানে তমোগুণের গভীর প্রতিফলন, সেখানে জগদ্ধাত্রীর রূপ সেই ত্রিগুণের অন্তর্নিহিত ভারসাম্যের প্রতীক—এক নীরব দীপ্তি, যেখানে কর্মের তেজ, ধ্বংসের শক্তি এবং স্থিতির আলো একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। তাঁর সিংহবাহিনী রূপ নির্দেশ করে আত্মবিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রিত শক্তিকে, আর করীন্দ্রাসুরবধ অহংবিনাশের প্রতীক, যা সত্ত্বগুণের প্রাধান্যে মনস্তাত্ত্বিক পরিশুদ্ধির পথ রচনা করে।