জগদ্ধাত্রী: ৩



জগদ্ধাত্রী যোগদর্শনের দৃষ্টিতে “ধৃতি” বা স্থিতিশক্তির দেবী, অর্থাৎ সেই শক্তির প্রতীক, যিনি প্রাণশক্তিকে ভারসাম্যে রাখেন এবং চেতনার গভীরে স্থিত হন।

যোগ দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—“স্থিতি বিনা যোগঃ নাস্তি” অর্থাৎ, "স্থিতি বা স্থিরতা ছাড়া যোগ সম্ভব নয়।" এখানে “যোগ” মানে কেবল আসন বা ধ্যান নয়; যোগ মানে চেতনা ও প্রাণের ঐক্য, মন ও আত্মার সমন্বয়। যোগ বা চেতনার ঐক্য তখনই সম্ভব, যখন মন সম্পূর্ণভাবে শান্ত, স্থির ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছে যায়।

মানুষের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা সাধারণত বিচ্ছিন্ন, অস্থির এবং অবিরাম চিন্তাপ্রবাহে আচ্ছন্ন। মন ক্রমাগত এক চিন্তা থেকে অন্য চিন্তায় দৌড়ায়, ইন্দ্রিয়েরা বাইরের জগতে আকৃষ্ট হয়, ফলে অভ্যন্তরীণ সমন্বয় বা ঐক্য নষ্ট হয়। যোগদর্শনের মতে, এই অস্থিরতার কারণই হলো মন ও প্রাণের (শ্বাসের) অসামঞ্জস্য।

যখন গতি নিয়ন্ত্রিত হয়, অর্থাৎ শরীর ও ইন্দ্রিয়ের চলন সংযত হয়; যখন শ্বাস সমবায়ী হয়, অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর, সুষম ও গভীর হয় (যাকে বলে প্রাণায়াম), আর যখন চিন্তা প্রশমিত হয়, অর্থাৎ মনের ভিতরকার তরঙ্গ শান্ত হয়—তখনই মন নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, যাকে যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে “চিত্তবৃত্তিনিরোধ” (পতঞ্জলি যোগসূত্র, ১.২)।

এই অবস্থাই হলো “স্থিতি” বা অন্তর্নিহিত প্রশান্তি—এক এমন মানসিক অবস্থা, যেখানে মন না জড় ও নিস্তেজ, না অস্থির ও আলোড়িত; বরং সে স্বচ্ছ, স্থির এবং সম্পূর্ণ সচেতন। এই স্থিত ও শান্ত মনেই যোগ সম্পন্ন হয়—চেতনা তখন নিজের উৎসে ফিরে যায়, আত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয়।

যোগের প্রাথমিক শর্ত হলো এই অভ্যন্তরীণ স্থিরতা; কারণ মন যতক্ষণ আলোড়িত, ততক্ষণ সে নিজের সত্য রূপ দেখতে পারে না। স্থিত মনই চেতনার আয়না—যেখানে সত্য প্রতিফলিত হয়।

জগদ্ধাত্রী সেই স্থিতিশক্তিরই রূপ। তাঁর কাজ হলো কুণ্ডলিনী—অর্থাৎ প্রাণ বা জীবনীশক্তির প্রবাহ—যা নিচ থেকে উপরে উঠে চেতনার উচ্চস্তরে মিলিত হয়, সেই উত্থানকে নিয়ন্ত্রিত রাখা। যদি এই শক্তি সংযত না হয়, তবে তা অস্থিরতা, উত্তেজনা বা বিকৃতি ঘটাতে পারে; কিন্তু জগদ্ধাত্রীর করুণায় সেই শক্তি জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়। তাই তিনি শক্তির জাগরণ ঘটান, কিন্তু সেটিকে চেতনায় স্থিত করে দেন—এটাই তাঁর যোগিক মাহাত্ম্য।

তাঁর গায়ত্রী মন্ত্র এই তত্ত্বেরই জীবন্ত প্রতীক—“ওঁ মহাদেব্যৈ বিদ্মহে, সিংহবাহিন্যৈ ধীমহি, তন্নো দেবী প্রচোদয়াত্‌॥” অর্থাৎ, “ওঁ, আমরা মহাদেবীকে জানতে চাই (অর্থাৎ তাঁকে উপলব্ধি করি); যিনি সিংহবাহিনী, তাঁর ধ্যান করি; সেই দেবী আমাদের সৎকর্মে প্রেরণা দিন।”

এই মন্ত্রের প্রতিটি অংশেই এক গভীর দার্শনিক তাৎপর্য নিহিত। “মহাদেব্যৈ বিদ্মহে”—এই অংশে দেবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত জ্ঞান ও শক্তির উৎস হিসেবে। তিনি সেই পরাশক্তি, যাঁর মধ্য থেকেই সমস্ত দেবতাশক্তির উদ্ভব, এবং যিনি নিজেই ব্রহ্মচেতনার প্রকাশ। সাধক এখানে স্বীকার করে নেয়—জ্ঞান, শক্তি ও প্রেরণা কোনো মানুষের নয়; সবই দেবীরই দান, তাঁরই প্রকাশ।

“সিংহবাহিন্যৈ ধীমহি”—এই অংশে দেবীর যোগিক ও তান্ত্রিক রূপ ফুটে ওঠে। সিংহ এখানে প্রতীক প্রবল প্রাণশক্তির, প্রবৃত্তির ও ইন্দ্রিয়গত আকর্ষণের। এই শক্তি যদি সংযত না হয়, তবে তা ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়; কিন্তু দেবী সেই সিংহের উপর আরোহিণী—অর্থাৎ তিনি প্রবল শক্তিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন, এবং সেই শক্তিকেই জ্ঞানের পথে রূপান্তর করেন। সিংহবাহিনী রূপ তাই বোঝায়—দেবী শক্তির দ্বারা নয়, শক্তি দেবীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; শক্তি যখন জ্ঞানের অধীনে আসে, তখনই সে সৃষ্টির উপকারী শক্তি হয়ে ওঠে।

শেষ অংশ—“তন্নো দেবী প্রচোদয়াত্‌”—মানে, “সেই দেবী আমাদের অন্তর্গত প্রেরণা দিন।” এখানে “প্রচোদনা” কোনো বাহ্যিক উদ্দীপনা নয়; এটি এক অন্তর্গত জাগরণ। এই জাগরণে মন শান্ত, কিন্তু সম্পূর্ণ সজাগ; স্থির, কিন্তু গভীরভাবে কর্মক্ষম। এই অবস্থায় মন অলসও নয়, অস্থিরও নয়—বরং পরিমিত ও নিবিষ্ট। এই প্রেরণাই যোগের প্রাণ, কারণ এটি চিন্তা ও ধ্যান, জ্ঞান ও কর্ম—সব কিছুকে একত্রে ভারসাম্যে রাখে। স্থিরতা এখানে জড়তা নয়, বরং এক জীবন্ত নীরবতা—যেখানে মন স্থির থেকেও জাগ্রত, আর ক্রিয়া স্থিরতার মধ্যেই পরিণত।

এই মন্ত্রে দেবীকে আহ্বান করা হয়েছে “মহাদেব্যৈ”—অর্থাৎ সর্বোচ্চ দেবী, যিনি সমস্ত দেবশক্তির মূল ও মিলনস্থল। “সিংহবাহিন্যৈ” নির্দেশ করে তাঁর সেই অদম্য শক্তিকে, যা ইন্দ্রিয় ও প্রবৃত্তিকে বশে রাখে; সিংহ এখানে প্রতীক প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও জীবনীশক্তির, আর তাঁদের উপর আরোহণ করে দেবী প্রকাশ করেন চেতনার সাম্য, সংযম ও ধৃতির নীতি। “প্রচোদয়াত্‌” শব্দটি তাঁর অন্তঃপ্রেরণার শক্তিকে জাগিয়ে তোলে—তিনি সেই দেবী, যিনি মানুষের চিন্তাকে জাগ্রত করেন, কর্মকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন, এবং জ্ঞানকে নির্মল করেন।

এই মন্ত্র, তন্ত্র ও প্রতীকের সম্মিলনে জগদ্ধাত্রী হয়ে ওঠেন মহা-মহাদেবী—যিনি চেতনার অন্তর্গত স্থিতি ও বিশ্বশক্তির গতিশীলতা—দুইয়েরই পরম প্রতীক। তাঁর সিংহবাহিনী রূপ দেখায় যে, তিনি শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের প্রতিমূর্তি; আর তাঁর গায়ত্রী মন্ত্রের আহ্বান জাগিয়ে তোলে সেই অন্তর্দীপকে—যেখানে মানবচেতনা ধীরে ধীরে আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার থেকে জ্ঞানের ও ব্রহ্মচেতনার দীপ্তির দিকে উত্তীর্ণ হয়।

জগদ্ধাত্রী সেই দেবী, যিনি দেখান—সত্যিকারের যোগ মানে গতি নয়, স্থিরতার মধ্যেই গভীর গতি; আর শক্তি মানে বিস্ফোরণ নয়, বরং জ্ঞানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক অন্তর্যাত্রা। তাঁর সিংহবাহিনী রূপ যেন চেতনার জয়গাথা—যেখানে বন্য শক্তি বশে আসে, মন প্রশমিত হয়, আর প্রাণ নিজের উৎসে ফিরে গিয়ে পরিণত হয় বিশুদ্ধ বোধে।

পুরাণসমূহেও তাঁর এই দার্শনিক রূপ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে—“সা জগদ্ধাত্রী দেবী সিদ্ধিদাত্রী চ সংস্মৃতাঃ”—অর্থাৎ, জগদ্ধাত্রীই সিদ্ধিদাত্রী, যিনি আত্মাকে আধ্যাত্মিক সিদ্ধি ও মুক্তির পথে পরিচালিত করেন। আবার শ্রীভুবনেশ্বরী তন্ত্রে বলা হয়েছে, জগদ্ধাত্রী হলেন ভুবনেশ্বরী (ধারণশক্তি) ও দুর্গা (অজ্ঞান-নাশিনী)-র সম্মিলিত প্রকাশ। ভুবনেশ্বরী বিশ্বরূপে প্রকাশিতা সেই দেবী, যিনি চেতনার সম্প্রসারণ ঘটান, আর দুর্গা সেই চেতনার রক্ষক, যিনি অজ্ঞান ও বিভ্রম নাশ করেন। এই দুই নীতির ঐক্যরূপেই জগদ্ধাত্রী: ধারণ ও ধ্বংস, স্থিতি ও জাগরণ, জ্ঞান ও শক্তি—সব একসাথে মিলেমিশে যায় তাঁর মধ্যে।

জগদ্ধাত্রী তাই তন্ত্রের শক্তি, বেদান্তের চেতনা, আর যোগের স্থিতি—এই তিন প্রবাহের মিলনবিন্দু। তিনি স্থিতি ও সচেতনতার একাত্মতা—যেখানে গতি আছে, কিন্তু সেই গতি নিয়ন্ত্রিত; যেখানে শক্তি আছে, কিন্তু সেই শক্তি জ্ঞানের দীপ্তিতে আলোকিত। তাঁর উপাসনা বাহ্যিক যুদ্ধ নয়, বরং অন্তরের ভারসাম্য ও আত্মবোধের সাধনা—যেখানে শক্তি জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়, আর কর্ম পরিণত হয় চেতনার নীরব দীপ্তিতে।

তাঁর পূজা ও সাধনা মূলত তান্ত্রিক ঐতিহ্যের শৃঙ্খলাপূর্ণ ধারার অন্তর্গত, যেখানে মুক্তির লক্ষ্য কোনো নৈর্ব্যক্তিক নির্বাণ নয়, বরং চেতনার শুদ্ধ বিকাশের মাধ্যমে আত্মা ও বিশ্বচেতনার ঐক্য উপলব্ধি। তন্ত্রের ভাষায় এই সাধনা হলো অহংকার ও ইচ্ছার রূপান্তর—যেখানে কামনা দমিত নয়, বরং রূপান্তরের মাধ্যমে জ্ঞানে পরিণত হয়। জগদ্ধাত্রী এই শুদ্ধিকরণের প্রতীক—তিনি সেই অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার দেবী, যিনি ইন্দ্রিয়, মন ও প্রাণকে সমন্বিত করে পরম চৈতন্যে স্থিত করেন।

তাই জগদ্ধাত্রীর তান্ত্রিক অবস্থান কেবল কোনো আচারিক বা পূজানুষ্ঠানের সীমায় আবদ্ধ নয়; এটি মহাজাগতিকও বটে। তিনি শক্তির অন্তর্নিহিত স্থপতি—চেতনার সেই সূক্ষ্ম নকশাকারিণী, যিনি সমস্ত সত্তার অন্তরে ধৃতি (সংকল্পের দৃঢ়তা) ও স্থিতি (স্থিরতা)-র বীজ রোপণ করেন। তাঁর পূজা মানে বাহ্যিক আচার নয়, বরং নিজের অন্তরাত্মায় সেই ব্রহ্মশক্তির ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা—যেখানে জ্ঞান ও কর্ম, প্রেম ও সংযম, রূপ ও নিরাকার, সব মিলেমিশে এক দীপ্ত ঐক্যে পরিণত হয়। সেই আলোকিত ঐক্যেরই নাম—জগদ্ধাত্রী।

প্রতিমা-শিল্প, প্রতীকবাদ এবং গুণের সংশ্লেষণ: জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা কোনো অলঙ্কারিক নকশা নয়; এটি এক গভীর দার্শনিক ভাষা, যেখানে প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, রং, অলংকার ও অস্ত্র একটি অন্তর্নিহিত তত্ত্বকে প্রকাশ করে। তাঁর রূপ আসলে চেতনার স্থাপত্য—যেখানে ত্রিগুণের (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) সুষমা, শক্তি ও জ্ঞানের সমন্বয় একত্রিত হয়েছে। তাঁর স্থিত, প্রশান্ত, অথচ দীপ্ত রূপে একদিকে মাতৃস্নেহের স্নিগ্ধতা, অন্যদিকে ব্রহ্মচেতনার স্থিতশক্তির প্রতাপ প্রকাশ পেয়েছে।

ক. চতুর্ভুজ রূপ এবং সমন্বিত প্রতীকবাদ: জগদ্ধাত্রীর চতুর্ভুজ রূপ কোনো সাধারণ অলংকার বা পৌরাণিক কল্পনা নয়; এটি গভীর দার্শনিক প্রতীকবাদের ধারক। তাঁর চারটি হাত চেতনার চারটি স্তরের প্রতীক—মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহং।

মন হলো অনুভবের কেন্দ্র—যেখানে চিন্তা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ জন্ম নেয়। বুদ্ধি সেই মনকে দিকনির্দেশ দেয়, বিচার করে, সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করে। চিত্ত হচ্ছে স্মৃতির ভাণ্ডার, যেখানে সব অভিজ্ঞতা সঞ্চিত থাকে, যা আমাদের প্রতিক্রিয়াকে গঠন করে। আর অহং হলো “আমি”-বোধ—যা নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা দেয়, কিন্তু একই সঙ্গে বিভ্রমও সৃষ্টি করে।

জগদ্ধাত্রী এই চার স্তরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন। তাই তাঁর চার হাত আসলে চেতনার এই চার দিকের সামঞ্জস্য ও সংহতির প্রতীক—যেখানে মন প্রশমিত, বুদ্ধি স্বচ্ছ, চিত্ত নির্মল, আর অহং সংযত। তাঁর রূপ আমাদের শেখায়—অন্তর্গত ভারসাম্য ছাড়া বাহ্যিক স্থিতি সম্ভব নয়।

তিনি সিংহবাহিনী, অর্থাৎ প্রবল প্রাণশক্তির উপর আরোহিণী। সিংহ এখানে কেবল এক বাহন নয়, বরং এক শক্তিশালী প্রতীক—অদম্য ইচ্ছাশক্তি, তেজ, কামনা ও ক্রোধের প্রতিনিধি। জগদ্ধাত্রী সেই সিংহের উপর উপবিষ্ট, শান্ত ও অচঞ্চল—এ যেন জীবনের প্রবল শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিমূর্তি। তাঁর স্থির ভঙ্গি বোঝায় যে, প্রকৃত শক্তি কখনও বিক্ষিপ্ত নয়; তা শাসিত হয় জ্ঞানের দ্বারা, পরিচালিত হয় চেতনার স্থিরতার মধ্য দিয়ে।

তাঁর মুখে যে শান্ত তেজ, তা এক বিরল দ্বৈততা বহন করে—স্নিগ্ধ করুণা ও দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ, মৃদু হাসি ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। এই মুখাবয়ব মহাবিশ্বের সেই অন্তর্নিহিত সাম্যের প্রতীক, যা অবিরাম গতির মধ্যেও স্থিত থাকে। যেমন পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরতে ঘুরতে স্থির ভারসাম্য রক্ষা করে, তেমনি জগদ্ধাত্রীর মুখে প্রতিফলিত হয় সেই মহাজাগতিক স্থিতি।

জগদ্ধাত্রীর চতুর্ভুজ রূপ কেবল এক দেবীমূর্তির বর্ণনা নয়; এটি এক পূর্ণ দর্শন—যেখানে চেতনার চার স্তর, শক্তির নিয়ন্ত্রণ, ও মহাজাগতিক সাম্য একাকার হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সেই দেবী, যিনি বিশ্বচেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত হয়ে সমস্ত বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ গতি সামঞ্জস্যে ধারণ করেন—তাই তিনি প্রকৃত অর্থেই “জগদ্ধাত্রী”—বিশ্বের ধারক, রক্ষিকা ও চিরন্তন ভারসাম্যের প্রতিমা।

জগদ্ধাত্রীর চার হাতে যে-অস্ত্রগুলি দেখা যায়, সেগুলি কেবল যুদ্ধ বা শক্তির বাহ্যিক প্রতীক নয়; বরং সেগুলির প্রতিটি মহাজাগতিক অর্থ বহন করে। এই অস্ত্রগুলি আসলে বিশ্বচেতনার তিন প্রধান শক্তি—সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও লয়—যা হিন্দুদর্শনে ত্রিমূর্তি (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব)-এর মাধ্যমে প্রকাশিত, তাদের একত্রিত রূপকে বোঝায়।

অর্থাৎ, জগদ্ধাত্রীর হাতে থাকা অস্ত্রগুলি বোঝায় যে, তিনি শুধু কোনো এক বিশেষ দেবতার শক্তি নন; বরং তিন দেবতার (ত্রিমূর্তির) ক্রিয়াশক্তি তাঁর মধ্যেই এক হয়ে গেছে।

জগদ্ধাত্রী একাই সেই সর্বজনীন শক্তি, যিনি ত্রিমূর্তির (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব) তিনটি প্রধান কার্যধারাকে নিজের মধ্যে একত্রিত করে রাখেন। এখানে প্রতিটি অংশের অর্থ ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা যায়—