জগদ্ধাত্রী: ১৬



শাক্ত দর্শনের ভাষায় এই ভাবটিই “জগৎ-ধারিণী তত্ত্ব”—অর্থাৎ চেতনার এমন এক রূপ, যা কেবল জগৎকে ধারণই করে না, বরং তা রক্ষা, স্থিতি ও পুনর্গঠনের সক্রিয় শক্তিতে পরিণত হয়। এটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের “স্থিতিশক্তি” ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ—যেখানে পরমচেতনা নিজেকে প্রকাশ করে স্থিতি বা ভারসাম্যের মাধ্যমে। সেই কারণেই জগদ্ধাত্রী শুধু মাতৃশক্তির রূপ নয়; তিনি জ্ঞানের শাসন, করুণার নিয়ন্ত্রণ ও শক্তির সমাহিত দীপ্তি। তাঁর ভঙ্গি, মুখমণ্ডলের প্রশান্তি, ও সিংহবাহিনীর প্রতীক—সবই ইঙ্গিত দেয় যে, এখানে শক্তি আর আক্রমণ নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রিত প্রভা; জয় নয়, বরং ধারণ; আর ধ্বংস নয়, বরং এক চিরন্তন স্থিতির রূপ।

এইভাবেই পালযুগের মিশ্র বৌদ্ধ-শাক্ত দর্শন এক নতুন মানবতাত্মক চেতনা সৃষ্টি করেছিল, যেখানে দেবী আর কেবল এক পৌরাণিক যুদ্ধদেবী নন—তিনি সেই আধ্যাত্মিক মাতা, যিনি নিজের অন্তঃস্থিত দীপ্তিতে জগৎকে ধারণ করেন, রক্ষা করেন, ও চেতনার আলোক দিয়ে পুনর্গঠন করেন। জগদ্ধাত্রী সেই দীপ্তিমান ধারক শক্তিরই প্রতীক—চেতনার সেই স্থিতরূপ, যা সকল গতি ও পরিবর্তনের মাঝেও অক্ষয় থাকে।

মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে “ধারিণী” শব্দটি কেবল আচারিক মন্ত্র বা ধর্মীয় উচ্চারণ নয়, বরং একটি গভীর দার্শনিক ধারণা। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধাতু ‘ধৃ’ (dhṛ) থেকে, যার অর্থ “ধারণ করা” বা “রক্ষা করা”। এই অর্থ থেকেই “ধারিণী” বলতে বোঝায় এমন এক শক্তি বা চেতনা, যিনি জ্ঞান, ধর্ম এবং করুণার প্রবাহকে ধারণ করে রাখেন ও সংরক্ষণ করেন। মহাযান বৌদ্ধতত্ত্বে ধারিণীকে কেবল মন্ত্র হিসেবে দেখা হয় না; তাঁকে দেখা হয় এক অন্তর্গত চেতনার অবস্থান হিসেবে, যেখানে জ্ঞান নিজের স্থিতিতে অটল থাকে, বাহ্যিক বিকিরণ বা পরিবর্তন ঘটলেও তা বিভ্রান্ত হয় না।

অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে (অধ্যায় ২৭) ধারিণীকে বলা হয়েছে “সংরক্ষণশক্তি”—এমন এক শক্তি, যিনি ধর্মের সূক্ষ্ম সত্য, জ্ঞানের স্বচ্ছতা এবং করুণার প্রবাহকে একত্রে ধারণ করে রাখেন। এ সূত্রে বলা হয়, ধারিণী সেই জ্ঞান, যা শূন্যতার মধ্যেও নিজের দীপ্তিতে স্থির থাকে, অর্থাৎ শূন্যতার মধ্যেও পূর্ণতার প্রকাশ ঘটায় (Conze, The Perfection of Wisdom in 8,000 Lines, 1973)। এইভাবে ধারিণী কেবল উচ্চারিত শব্দ নয়; তিনি এমন এক জাগ্রত চেতনা, যা বিভ্রান্ত হয় না, বিলীন হয় না, বরং জ্ঞান ও করুণার ধারাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বহন করে চলে।

পরবর্তী সময়ে, বিশেষত বজ্রযান তন্ত্রে, ধারিণী ধারণাটি আরও গভীর প্রতীকী অর্থে রূপান্তরিত হয়। এখানে ধারিণী এক দেবী বা মাতৃশক্তি হিসেবে প্রতিভাত হন, যিনি ধর্মরক্ষার ভার নিজের উপর বহন করেন। উষ্ণীষবিজয়া ধারিণী সূত্র, ধারণীসংগ্রহ, এবং সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্রে ধারিণীকে ধর্মরক্ষাকারিণী দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে (Lokesh Chandra, Buddhist Dhāraṇīs, 1981)। তিনি কেবল বুদ্ধের শিক্ষাকে রক্ষা করেন না, জীবজগতের আধ্যাত্মিক সুরক্ষাও প্রদান করেন। এই মাতৃরূপে ধারিণী স্মৃতির, স্থিতির ও করুণার কেন্দ্রবিন্দু; তাঁর দ্বারা ধর্ম টিকে থাকে, বুদ্ধচেতনা ধারণ ও সংরক্ষণ হয়, এবং করুণার প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন থাকে (Davidson, Indian Esoteric Buddhism, 2002)।

ধারিণী মহাযান ও বজ্রযান উভয় ধারায় এমন এক শক্তির প্রতীক, যিনি জ্ঞান, করুণা ও ধর্মের ঐক্যকে ধারণ করে রাখেন। তিনি একাধারে মন্ত্র, চেতনা ও দেবী—যাঁর মাধ্যমে ধর্ম সংরক্ষিত থাকে এবং বুদ্ধচেতনার আলোক কখনও নিভে যায় না।

তিব্বতি ও নেপালি বজ্রযান তন্ত্রে “ধারিণী”-ভাবের যে-বিকাশ “বজ্রধারিণী”-র রূপে পরিণত হয়েছে, তা কেবল নামের পরিবর্তন নয়—এটি এক গভীর দার্শনিক রূপান্তরের নিদর্শন। “বজ্র” শব্দটি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে চেতনার এমন এক অবস্থা নির্দেশ করে, যা অনাদি, অবিনশ্বর, অপরিবর্তনীয়—যা কোনো কালিক পরিবর্তন বা মনস্তাত্ত্বিক ওঠানামায় ব্যাহত হয় না। বজ্রসত্ত্ব, বজ্রযোগিনী বা বজ্রধারা প্রভৃতি নামের মধ্যে “বজ্র” মানে সেই অখণ্ড ও অবিচল চেতনা (বজ্রচিত্ত), যা শূন্যতার মধ্যেই স্থিত থাকে। অপরদিকে “ধারিণী” শব্দটি এসেছে ‘ধৃ’ (ধারণ করা) ধাতু থেকে—অর্থাৎ যিনি ধারণ, রক্ষা ও সংরক্ষণ করেন। এই দুই ভাব—“বজ্র” ও “ধারিণী”—যখন একীভূত হয়, তখন জন্ম নেয় “বজ্রধারিণী”: সেই দেবী, যিনি চেতনার অপরিবর্তনীয় স্বরূপ ও তার ধারণক্ষম শক্তি উভয়ই।

প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে, বিশেষত অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা-র ২৭তম অধ্যায়ে, “ধারিণী” শব্দটির দার্শনিক অর্থ কেবল কোনো মন্ত্র বা শব্দরূপ নয়, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক শক্তি। এখানে “ধারিণী” মানে সেই ধর্মধারণশক্তি—অর্থাৎ এমন এক অন্তর্গত শক্তি, যিনি বোধিসত্ত্বর জ্ঞান (প্রজ্ঞা), করুণা (কারুণ্য) এবং বোধিচিত্ত (জাগ্রত চেতনা)-কে স্থিত, সংরক্ষিত ও অবিচল রাখেন। এভাবে, ধারিণী হচ্ছে চেতনার স্থিতি-শক্তি, যা জ্ঞানের প্রবাহকে বিকৃত বা ক্ষয় হতে দেয় না।

পরবর্তী বজ্রযান সূত্রসমূহে, যেমন উষ্ণীষবিজয়া ধারিণী সূত্র ও ধারিণীসংগ্রহ, এই “ধারিণী”-ভাব কেবল বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং এক মূর্ত দেবী রূপে প্রতিফলিত হয়। সেখানে তিনি এমন এক দেবী, যিনি জ্ঞানের আকারে স্থিরতা এবং করুণার আকারে গতিশীলতা—এই দুই দিককেই ধারণ করেন। তাঁর মধ্যে শূন্যতা (śūnyatā)—অর্থাৎ রূপহীন, নির্ভাবনা, অনন্ত সম্ভাবনা—ও করুণা (karuṇā)—অর্থাৎ জীবের প্রতি অন্তহীন সহানুভূতি—একে অপরের পরিপূরক ও অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ, ধারিণী সেই চেতনার অবস্থার প্রতীক, যেখানে শূন্যতা করুণাকে জন্ম দেয়, আর করুণা শূন্যতাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।

তিব্বতি ভাষ্যকারগণ, যেমন শতসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা টীকা ও গুহ্যসমাজ তন্ত্র (অধ্যায় ৫)-এর ব্যাখ্যায় বলেন—“চিত্তং ধারয়তি যা, সা বজ্রধারিণী” অর্থাৎ “যিনি চিত্তকে ধারণ করেন, তিনিই বজ্রধারিণী।” এই ব্যাখ্যায় বোঝানো হয়েছে যে, বজ্রধারিণী কোনো বহিরাগত দেবতা বা দেবী নন—তিনি সেই অন্তর্মুখী বা আধ্যাত্মিক শক্তি, যা আমাদের চেতনার মধ্যে নিজস্ব ভারসাম্য রক্ষা করে।

অর্থাৎ, তিনি এমন এক নীরব কেন্দ্র, যেখানে চিন্তা, অনুভূতি, ক্রিয়া—সব এক সুরে মিশে যায়। চেতনার প্রবল উচ্ছ্বাস যখন বিচ্যুতির দিকে যায়, তখন তিনি তাকে সংহত করেন; আর চেতনা যখন নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হয়, তখন তিনি সেই নীরবতাকে জীবন্ত রাখেন। এইভাবেই বজ্রধারিণী—যিনি চিত্তের রক্ষিকা—তিনি শূন্যতার গভীরতা ও করুণার স্পন্দনের মিলিত রূপ; স্থিরতা ও গতির, ধ্যান ও প্রকাশের মধ্যবর্তী সেই চেতনার সুষমা, যা শেষ পর্যন্ত বুদ্ধত্ব বা পরিপূর্ণ জ্ঞানের প্রতীক হয়ে ওঠে।

এই স্থিতি ও করুণার মিলনই বজ্রযান তত্ত্বে “বুদ্ধত্ব” (বুদ্ধত্ব) বা পরিপূর্ণ চেতনার প্রতীক। বজ্রধারিণী এখানে সেই তত্ত্বের জীবন্ত রূপ—তিনি জ্ঞানের স্থিরতা (প্রজ্ঞা) ও করুণার প্রবাহ (করুণা) একত্রে ধারণ করেন; তাই তিনি শূন্যতার মধ্যে দৃঢ়, আর দৃঢ়তার মধ্যে শূন্য। বজ্রধার-নামা ধারিণী সূত্রে বলা হয়েছে—এই ঐক্যই বজ্রযান সাধকের অন্তর্জাগতিক সিদ্ধির মূল: স্থিতি ও শূন্যতার যোগই মুক্তির পথ।

এই বজ্রধারিণী ভাবটি পরে হিন্দু তন্ত্রে “ধৃতি” বা “স্থিতিশক্তি”-র রূপে প্রতিফলিত হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর দেবী-মহাত্ম্য অংশে এবং দুর্গাসপ্তশতী-র ধ্যানশ্লোকে দেবীকে বলা হয়েছে—“ধৃতিধারিণীং”, অর্থাৎ যিনি সমগ্র সৃষ্টিকে স্থিতি দেন। তান্ত্রিক শাস্ত্রসমূহে (যেমন রুদ্রযামল তন্ত্র, কালিতান্ত্র ও নিগমতন্ত্র) “ধৃতি”র এই ধারণা বজ্রধারিণীরই সমার্থক—এটি সেই শক্তি, যা পরিবর্তনের মধ্যেও সমতা ও স্থিতি বজায় রাখে। এই “ধৃতি”-ই তান্ত্রিক পরম্পরায় জগদ্ধাত্রী রূপে মূর্ত হয়ে ওঠেন—যিনি “জগৎ ধারণ করেন”, অর্থাৎ জগৎ ও চেতনার গতি-স্থিতির ভারসাম্য রক্ষা করেন।

এভাবে ধারিণী থেকে বজ্রধারিণী, এবং বজ্রধারিণী থেকে জগদ্ধাত্রী—এ এক অবিচ্ছিন্ন দার্শনিক বিবর্তনরেখা, যেখানে “ধারণা” আর কেবল সংরক্ষণ নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত ভারসাম্যের প্রতীক। জগদ্ধাত্রী সেই ধৃতিশক্তি, যিনি বজ্রধারিণীর তত্ত্বে নিহিত স্থিতি ও শূন্যতার দ্বন্দ্বকে মানবিক, নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক রূপে প্রকাশ করেছেন। তাঁর শুভ্রবর্ণ জ্ঞানের স্থিরতার প্রতীক, তাঁর করুণাময় দৃষ্টি করুণার গভীরতার প্রতীক, আর তাঁর সিংহবাহিনী রূপে প্রকাশ পেয়েছে সেই অপরিবর্তনীয় শক্তি—যা বজ্রের মতো অবিনশ্বর, আর শূন্যতার মতো অসীম।

প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পেও এই নীতির চিত্রায়ণ স্পষ্ট। গান্ধার ও নালন্দা বিদ্যালয়ে পাওয়া ধারিণী-মুদ্রা-ধারী ত্রাণদেবীদের মূর্তিতে দেখা যায়—তাঁরা অঞ্জলি বা চিত্ত-সংযমের ভঙ্গিতে বিশ্বকে ধারণ করছেন। পরবর্তী কালে এই “ধারক মাতৃরূপ” ধীরে ধীরে তান্ত্রিক শাক্ত প্রেক্ষিতে আত্মীকৃত হয়, যেখানে “ধারিণী”-র স্থলে আসে “ধাত্রী”—একই শব্দমূলের (ধৃ, ধারণ করা) দুটি ভিন্ন ভাষাগত অভিযোজন।

জৈন দর্শনে “ধৃতি” ও “স্থিতি”-র ধারণা আসলে আত্মানুশাসনের এক গভীর তত্ত্ব, যা কেবল নৈতিক শৃঙ্খলা নয়, বরং চেতনার ভারসাম্য রক্ষার এক আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। জৈন ধর্মের মূলবাক্য—“সংযমই মুক্তির পথ”—এই ভাবনাকেই কেন্দ্র করে গঠিত। এখানে সংযম মানে ইচ্ছাশক্তিকে দমন নয়, বরং ইচ্ছার উৎসকে জ্ঞানে রূপান্তর করা। যে-ব্যক্তি বাহ্যিক সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, প্রশংসা-নিন্দার মতো দ্বন্দ্বের মধ্যেও অন্তরে স্থির থাকে, তিনিই প্রকৃত অর্থে “ধৃতি” লাভ করেছেন। তত্ত্বার্থসূত্র (৯.৬)-এ এই ধৃতিকে বর্ণনা করা হয়েছে এক মানসিক ও নৈতিক দৃঢ়তা হিসেবে—যা কেবল মনকে স্থির রাখে না, তাকে তার স্বরূপে স্থাপন করে। এই স্বরূপ-স্থিতিই মুক্তির আরম্ভ, কারণ যে-চেতনা নিজের মধ্যেই স্থিত, সে আর কোনো বাহ্যিক আকর্ষণে টলে না।

এই ধৃতির দেবী-রূপও জৈন আগম ও অভিধানে বিদ্যমান—উত্তরাধ্যয়ন সূত্র (২২.৪১) এবং রাজেন্দ্র কোশ-এ উল্লিখিত “ধৃতি দেবী” সেই প্রতীক, যিনি আত্মসংযম, তিতিক্ষা (সহিষ্ণুতা), ও করুণার মূর্ত রূপ। তিনি “ধৃতি-শক্তি”—অহিংসার সেই অন্তর্লীন বল, যা সমস্ত জীবের প্রতি সমান সহানুভূতিতে জগৎকে ধারণ করে। এখানে ধৃতি কেবল মানসিক সংযম নয়, বরং এক ধ্রুব চেতনা, যা সমস্ত সত্তাকে অহংকারের প্রাবল্য থেকে রক্ষা করে। জগদ্ধাত্রী-চেতনার সঙ্গে এর গভীর সাদৃশ্য দেখা যায়—উভয়ই “ধারণকারী শক্তি”, উভয়ই অহং-প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে জ্ঞান ও করুণার স্থিতি স্থাপন করে।

জৈন দর্শনে “ধৃতি” ও “তিতিক্ষা”—এই দুই গুণকে একত্রে বলা হয়েছে “পরম-বীর্য”, অর্থাৎ সত্যিকারের শক্তি। এই শক্তি কোনো যুদ্ধজয়ের ক্ষমতা নয়, বরং নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব জয়ের সামর্থ্য। যে-ব্যক্তি ক্রোধ, ভয়, লোভ, কিংবা অহংকারের প্ররোচনাকে নিজ অন্তরেই শান্ত করতে পারে, সেই প্রকৃত বীর। এই ভাবনা প্রতীকীভাবে প্রকাশ পেয়েছে “জগদ্ধাত্রী দেবীর করীন্দ্রাসুর-বধ” চিত্রে, যেখানে অসুর বা হাতি অহংকারের প্রতীক, আর দেবী সেই অহংকারকে নিঃশব্দে বশ করে তাকে জ্ঞানে রূপান্তর করেন। জৈন ভাবধারায়ও মুক্তি মানে এই—অহিংস, স্থিত, ও স্বনিয়ন্ত্রিত চেতনার সম্পূর্ণ উদ্‌ভাসন; যেখানে বাহিরের সংগ্রাম আর প্রয়োজন হয় না, কারণ অন্তরের সকল দ্বন্দ্ব ইতিমধ্যে ধৃতির অদম্য স্থিতিতে বিলীন হয়ে গেছে।

বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে “ধারণ”, “স্থিতি” ও “সংযম”—এই তিনটি শব্দ আসলে মানুষের চেতনা কেমনভাবে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে, তার এক গভীর মানসিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা। বৌদ্ধ চিন্তায় “ধারিণী” হলো সেই চেতনার রূপ, যা জ্ঞান, করুণা ও ধর্মকে ধারণ করে রাখে—যেন বিশ্বজগতের সমস্ত বিকার ও পরিবর্তনের মধ্যেও এক অন্তর্নিহিত স্থিতি বজায় থাকে। জৈন ধর্মে এই একই ভাব “ধৃতি” ও “তিতিক্ষা”-র মাধ্যমে প্রকাশিত—যেখানে আত্মা নিজের দ্বন্দ্ব, লোভ, ক্রোধ বা অহংকারকে সংযমের দ্বারা অতিক্রম করে স্থির চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুই ধারার মধ্যেই আমরা পাই “ধারকশক্তি”-র প্রথম তাত্ত্বিক রূপরেখা—যে-শক্তি সমস্ত গতি, পরিবর্তন ও প্রবৃত্তির মধ্যেও চেতনার মূল ভারসাম্য বজায় রাখে।