জগদ্ধাত্রী: ১৫



জৈন আগম-গ্রন্থ উত্তরাধ্যয়ন সূত্র (২২.৪১) এবং অভিধান রাজেন্দ্র কোশ উভয়েই “ধৃতি দেবী”-র উল্লেখ করেছে—তিনি আত্মসংযম, তিতিক্ষা (সহনশক্তি), এবং করুণার প্রতীক। তাঁকে বলা হয় “ধৃতি-শক্তি”—যিনি “অহিংসা”-র মূর্ত প্রতীক রূপে সমস্ত জীবধারার ভার ধারণ করেন। জগদ্ধাত্রীর মতোই এই ধৃতি দেবীও অহংকার ও প্রবৃত্তির শক্তিকে আত্মনিয়ন্ত্রণে এনে অন্তর্নিহিত স্থিরতা স্থাপন করেন।

জৈন দর্শনে “ধৃতি” এবং “তিতিক্ষা” একত্রে “পরম-বীর্য” (অর্থাৎ সত্যিকারের শক্তি) হিসেবে বিবেচিত—এখানে শক্তির অর্থ আক্রমণ নয়, বরং নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বকে জয় করার সক্ষমতা। এই ধারণাই জগদ্ধাত্রীর “করীন্দ্রাসুর-বধ” প্রতীকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে হাতি বা অসুর অহংকারের প্রতীক, আর দেবী সেই অহং-প্রবণ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনে তাকে জ্ঞানে রূপান্তর করেন।

ধারকশক্তির সংযোগ—বৌদ্ধ-জৈন থেকে শাক্ত: বৌদ্ধ ও জৈন—দুই ধারাতেই “ধারণ”, “স্থিতি” ও “সংযম”—এই তিনটি ধারণাই মানবচেতনার কেন্দ্রীয় স্থিতি নির্ধারণ করে। শাক্ত তন্ত্রে এই নীতিই রূপ নেয় জগদ্ধাত্রীর তত্ত্বে। কাত্যায়নী তন্ত্র, শ্রীতত্ত্বচিন্তামণি ও নিত্যশোড়শারণব তন্ত্র—এই তান্ত্রিক গ্রন্থসমূহে জগদ্ধাত্রীকে বলা হয়েছে “ধারকশক্তি”, “স্থিতিদায়িনী” ও “সত্ত্বগুণ-প্রধানা”—যিনি “চলমান জগৎ”-কে অন্তঃস্থিত ভারসাম্যে ধারণ করেন।

এই দর্শনের মূল ভিত্তি অদ্বৈত বেদান্তের “স্থিতি” ও “চিত্‌”—দুই ধারণার মিলনে। যেমন বেদান্তে বলা হয়, “স্থিতি বিনা যোগঃ নাস্তি”—স্থিতি ছাড়া যোগ নেই; তেমনি তন্ত্রে বলা হয়, “স্থিতি বিনা শক্তিঃ নাস্তি”—স্থিতি ছাড়া শক্তি প্রকাশিত হয় না। এই দুই দিকের সংহত রূপই জগদ্ধাত্রী: চেতনা ও কর্ম, জ্ঞান ও ধৃতি, মন ও প্রাণের একীকরণ।

জগদ্ধাত্রী দেবীর বর্তমান প্রতিমা ও উপাসনাকাঠামো হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি; বরং এটি বহু শতাব্দীর বৌদ্ধ ও শাক্ত প্রতীক-রূপের এক ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। এখানে বৌদ্ধ ধর্মে প্রচলিত “ধারিণী” বা “ধারক-মাতৃশক্তি”-র ভাবধারাই ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছে “জগদ্ধাত্রী” নামের শাক্ত মাতৃরূপে।

বৌদ্ধ “ধারিণী” ছিলেন বিশ্বচেতনার ধারক—যিনি জ্ঞান, করুণা ও ধর্মের শক্তিকে ধারণ করে রাখেন। তাঁর মুখ সর্বদা প্রশান্ত, নিরাভিমন্য, এবং তিনি শুভ্রবর্ণা—এই শুভ্রতা বোঝায় সত্ত্ব-গুণ, অর্থাৎ নির্মল, শান্ত, জ্ঞানময় চেতনা। একইভাবে, জগদ্ধাত্রীর মুখেও দেখা যায় সেই প্রশান্ত দীপ্তি; তাঁর শুভ্রবর্ণ দেহ নির্দেশ করে যে তিনি রজঃ ও তমঃ গুণের ঊর্ধ্বে, সত্ত্বগুণের বিশুদ্ধ প্রতিফলন। তাই তিনি “স্থিতির দেবী”—অর্থাৎ যে-চেতনা অস্থির নয়, নিজের কেন্দ্রেই স্থিত।

এছাড়া “বজ্রধারিণী” বা “বজ্রযোগিনী”-র প্রতীকের সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর রূপগত মিলও তাৎপর্যপূর্ণ। বজ্রধারিণী বা বজ্রযোগিনী বৌদ্ধ তন্ত্রে প্রতীক অভেদ চেতনার শক্তি—‘বজ্র’ মানে অবিনাশী বোধ বা অচল জ্ঞান, যা বিভাজন বা দ্বৈততার ঊর্ধ্বে। জগদ্ধাত্রীও সিংহবাহিনী—এখানে সিংহ প্রতীক প্রখর চেতনা ও জ্ঞানের শক্তি, যেমন বজ্র প্রতীক অবিনাশী প্রজ্ঞার। অর্থাৎ, “বজ্র” ও “সিংহ” দুই-ই চেতনার অবিচল দীপ্তি ও অভয়তার প্রতীক, আর উভয়েই নারীশক্তির বাহন বা আত্মপ্রকাশ।

ঐতিহাসিকভাবে এই দুই ধারার মিলন ঘটে গুপ্ত যুগের পরবর্তী সময়ে, যখন বৌদ্ধ ও শাক্ত তন্ত্রের পারস্পরিক প্রভাব বেড়ে যায়। বৌদ্ধ বজ্রযান ও হিন্দু শ্রীবিদ্যা তন্ত্রের মধ্যে যে-সংমিশ্রণ দেখা যায়, তাকে বলা হয় “তান্ত্রিক সমন্বয় যুগ”—প্রায় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত। এই সময়ে অষ্টগৌরী, ষোড়শ নিত্যা এবং ত্রিপুরা-তত্ত্ব—এই সব দেবীচক্রে বৌদ্ধ “তারা”, “প্রজ্ঞাপারমিতা”, “বজ্রযোগিনী”-র নানান গুণ যুক্ত হয়। এই মিলন থেকেই পরবর্তীকালে গঠিত হয় “জগদ্ধাত্রী”—যিনি একদিকে প্রজ্ঞা ও স্থিতির প্রতীক, অন্যদিকে করুণা ও শক্তির সমবেত রূপ।

“বৌদ্ধ ধারিণী” ও “বজ্রধারিণী”-র প্রতীকবোধ কেবল মিল নয়; জগদ্ধাত্রীর মূর্ত প্রতিমায় তারই উত্তরাধিকার দৃশ্যমান। তাঁর শান্ত মুখমণ্ডল প্রজ্ঞাপারমিতার, তাঁর শুভ্রবর্ণ সত্ত্বগুণের, তাঁর সিংহবাহন বজ্রচেতনার, আর তাঁর স্থির দৃষ্টি সেই অচল ব্রহ্মচেতনার প্রতীক—যেখানে তন্ত্র, জ্ঞান ও চেতনা এক হয়ে যায়।

ইতিহাসবিদেরা—যেমন ডি. ডি. কোসাম্বি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও নন্দলাল দে—এই সংমিশ্রণ প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করেছেন “শাক্ত-বজ্রযান চেতনার সমন্বিত বিকাশ” (syncretic evolution of Śākta-Vajrāyana consciousness) নামে। তাঁদের মতে, গুপ্তোত্তর ভারতে যখন বৌদ্ধ বজ্রযান ও শাক্ত তন্ত্র পরস্পরের ভাবধারায় মিশে যেতে শুরু করে, তখন “মাতৃতত্ত্ব” বা দেবীর ধারণা কেবল ধর্মীয় প্রতীক হিসেবেই নয়, বরং মানসিক স্থিতি, আত্মসংযম ও সামাজিক সংহতির প্রতীক হিসেবেও গড়ে ওঠে। এই সময়েই দেবীমূর্তি এক অন্তর্দার্শনিক প্রতীক থেকে রূপান্তরিত হয়ে সমাজচেতনার কেন্দ্রীয় চিহ্নে পরিণত হয়—যিনি একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক স্থিরতার ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতিমা।

সমন্বিত ব্যাখ্যা: জগদ্ধাত্রী পূজা কেবল এক আঞ্চলিক শাক্ত আচার নয়; এটি ভারতের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে ধৃতি-তত্ত্বের ধারাবাহিক বিবর্তন। বৌদ্ধধারিণী ধারণ করেন জ্ঞানের শক্তি, জৈন ধৃতি ধারণ করেন সংযমের শক্তি, আর শাক্ত জগদ্ধাত্রী ধারণ করেন চেতনার শক্তি—এই তিন ধারাই মিলিত হয়ে এক অভিন্ন নীতিতে পৌঁছায়: “স্থিতি হি শক্তিঃ”—"স্থিতি (স্থিরতা/অচলতা/ভারসাম্য) হচ্ছে শক্তি"।

এই দর্শনের গভীরে নিহিত আছে এক সর্বজনীন বোধ—শক্তি ধ্বংস করে না, রক্ষা করে; গতি নয়, বরং স্থিতির মধ্য দিয়েই মহাজাগতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই জগদ্ধাত্রী কেবল দেবী নন; তিনি প্রাচীন ভারতের সমন্বিত চেতনার প্রতীক—এক জীবন্ত যোগসূত্র, যেখানে বৌদ্ধ করুণা, জৈন সংযম, ও শাক্ত শক্তি মিলিত হয়ে মানবতার অন্তর্গত শান্তি ও জ্ঞানের সুর রচনা করে।

জগদ্ধাত্রীর উপাসনার শিকড় বাংলার ইতিহাসে গভীরভাবে প্রোথিত। দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাচীনতম পরিচিত মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম হল হুগলি জেলার সোমরার মহাবিদ্যা মন্দির, যা ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত—এই মন্দিরকে জগদ্ধাত্রীর পূজার অন্যতম আদিম কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর নদিয়ার রাঘবেশ্বর মন্দির (১৬৬৫) ও জালেশ্বর মন্দির (১৬৬৯)-এর প্রতিমা ও লিপিতে দেবীর আরাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নদিয়া-হুগলি অঞ্চল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগেই জগদ্ধাত্রীর পূজাকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত ছিল।

ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদের বালিগ্রাম গ্রামের জগদ্ধাত্রী পূজা প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে চলছে, এবং কালনার মীরহাট বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার চার শত বছরেরও বেশি সময় ধরে একই ঐতিহ্য রক্ষা করছেন। এসব প্রমাণ করে যে, দেবী জগদ্ধাত্রী কেবল কোনো আঞ্চলিক দেবী নন—তিনি বাংলার তান্ত্রিক ও শাক্ত সংস্কৃতির প্রাচীন প্রবাহে গভীরভাবে প্রোথিত এক মহাশক্তি।

বাংলায় আধুনিক সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজা মূলত দুটি প্রধান কেন্দ্রকে ঘিরে বিকশিত হয়—নদিয়ার কৃষ্ণনগর ও হুগলির চন্দননগর। তবে এই জনউৎসবের ঐতিহ্য নিজেই অনেক পুরোনো, যার শেকড় তান্ত্রিক ও পারিবারিক আচার থেকে ক্রমে সমাজজীবনের বৃহত্তর পরিসরে বিস্তৃত হয়।

জনপ্রিয় ঐতিহ্য অনুযায়ী, নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৮শ শতকের মাঝামাঝি, আনুমানিক ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে, সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তন করেন। কিংবদন্তি বলে, দুর্গাপূজার সময় নবাব আলিবর্দি খাঁর আদেশে বন্দিত্বের পর মুক্তি লাভ করে মহারাজা দেবীর স্বপ্নদর্শন পান—শুভ্রবর্ণা, সিংহবাহিনী এক দেবী তাঁকে নির্দেশ দেন, “কার্ত্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে আমার পূজা করো।” সেই স্বপ্নাদেশ থেকেই কৃষ্ণনগরে রাজবাড়ির পূজার সূচনা হয়।

তবে ইতিহাসের একাংশ ইঙ্গিত করে যে, দেবী নদিয়া অঞ্চলে এই সময়ের আগেই পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, আনুমানিক ১৬৬৫-১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপুরের চন্দ্রচূর তর্কামণি প্রথম বার দেবীর পূজা প্রচলন করেন। প্রথম দিকে কৃষ্ণনগরে কেবল “ঘটপূজা” অনুষ্ঠিত হতো; পরবর্তীকালে প্রতিমারূপে দেবীর আরাধনা শুরু হয়।

কৃষ্ণনগরের প্রতিমা-শিল্পে জগদ্ধাত্রী সাধারণত এক কুমারী রূপে চিত্রিত—১৩ বছরের বেশি বয়স নয়, এমন এক কিশোরী দেবী, শুভ্রবর্ণা, প্রশান্ত মুখমণ্ডল, চারভুজা, সিংহবাহিনী। দেবীর উচ্চতা ঐতিহ্যগতভাবে চার ফুটের নিচে রাখা হয়—যাতে মাতৃসুলভ কোমলতা ও আধ্যাত্মিক স্থিতি বজায় থাকে। অনেক সময় সিংহবাহনটিকে ঘোড়ার মতো গঠিত করা হয়, যা গতিময়তার প্রতীক। রাজবাড়ির দেবীকে বলা হয় “রাজরাজেশ্বরী”, যিনি রাজকীয় ধৃতি ও শাসনশক্তির প্রতিরূপ।

কৃষ্ণনগরের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উদ্‌যাপন হলো চাষাপাড়ার “বুড়িমা জগদ্ধাত্রী পূজা”, যার সূচনা হয় ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে—রাজবাড়ির পূজার কিছু বছরের মধ্যেই। এটি বাংলার প্রথম দিকের বারোয়ারি পূজা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। “বুড়িমা” প্রতিমা তাঁর বিস্তৃত সোনা ও রুপার অলঙ্কারের কারণে—প্রায় ১৫০ কেজি সোনা ও রুপা-মণ্ডিত বিধায় বিখ্যাত, যা তাঁকে কেবল ধর্মীয় নয়, নন্দনতাত্ত্বিক প্রতীকেও পরিণত করেছে।

এই পূজায় কোনো বাণিজ্যিক থিম বা প্রতিযোগিতা নেই—এখানে মূল আকর্ষণ ভক্তির আবেগ। চাঁদা তোলার প্রয়োজন হয় না; মানুষ নিজে থেকে দাঁড়িয়ে দান করেন, যেমন করতেন আঠারো শতকেও। বিসর্জনের দিন দেবীকে ভক্তদের কাঁধে বহন করে রাজবাড়ি প্রদক্ষিণ করানো হয় এবং তারপর জলঙ্গীর ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়—এই রীতি আজও অক্ষুণ্ণ।

সব মিলিয়ে, জগদ্ধাত্রীর পূজা কেবল এক দেবী-উপাসনার ইতিহাস নয়; এটি বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের দলিল। সোমরা থেকে কৃষ্ণনগর, বালিগ্রাম থেকে কালনা—সব স্থানে এই পূজা একই আধ্যাত্মিক সূত্রে বাঁধা: “ধারকশক্তি”, সেই দেবী যিনি বিশ্বে স্থিতি দেন, সমাজে সংহতি আনেন, এবং মানুষের অন্তরে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করেন।

চন্দননগর (হুগলী) অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা নিয়ে ইতিহাসে দুটি প্রচলিত মত রয়েছে। এক মতে, এই উৎসবের প্রবর্তক ছিলেন ফরাসি শাসিত চন্দননগরের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, যিনি কৃষ্ণনগরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে পূজা দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ শহরে এই পূজা শুরু করেন। অন্য মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আরেক দেওয়ান দাতারাম সুর ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে চন্দননগরে এই উৎসবের প্রবর্তন করেন। যে-ই হোন প্রতিষ্ঠাতা, পরবর্তীকালে এই পূজা চন্দননগরের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনের অন্যতম পরিচয় হয়ে ওঠে।

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নিজস্ব শৈলীর জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। বিশাল আকারের এই প্রতিমাগুলি কখনো কখনো ৭৫ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছেছে। প্রতিমার মুখ সাধারণত দীর্ঘ, চোখ বড়ো ও গভীরভাবে বসানো, এবং দেবীর গলায় সাপ পৈতে হিসেবে ব্যবহৃত হয়—যা এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। দেবীর বাহন সিংহ প্রায়ই সাদা বর্ণের হয়, আর তার বিপরীতে প্রতীকীভাবে এক হাতির মূর্তি স্থাপন করা হয়। এই রূপশৈলী একদিকে যেমন সনাতন রীতি অনুসরণ করে, তেমনই স্থানীয় শিল্পরুচিরও প্রকাশ ঘটায়।

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার চমকপ্রদ আলোকসজ্জা ও বিশাল শোভাযাত্রা। ১৯শ শতাব্দীতে এই দিকটির বিকাশে ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ফরাসি কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা ও অবকাঠামোগত সহায়তার ফলে চন্দননগরে এক অনন্য আলোকশিল্পের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে—যা আজও বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছে। দেবীযাত্রার পূর্বে শহরজুড়ে আলোকসজ্জিত প্রদর্শনী, আলোর চলমান দৃশ্য ও বিষয়ভিত্তিক আলোকনকশা এই উৎসবকে রূপ দেয় এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টিনন্দন ও সাংস্কৃতিক মহোৎসবে।