ক. ব্যুৎপত্তিগত ও বেদান্তিক বিশ্লেষণ—ধাত্রীরূপে স্থিতির নীতি: জগদ্ধাত্রী—যার অর্থই ‘জগতের ধারক’—তিনি কেবল এক দেবী নন, বরং বিশ্বচেতনার এক প্রতীকী রূপ, যিনি ধারণ করেন সমস্ত অস্তিত্বের ভারসাম্য ও সাম্য। বাংলার শাক্ত ঐতিহ্যে জগদ্ধাত্রী পূজা যেমন শারদীয় দুর্গোৎসবের পর আত্মসংযমের সাধনায় রূপ নেয়, তেমনি দার্শনিক স্তরে এই দেবী হলেন জ্ঞানের, সত্ত্বের ও চেতনার পরিশুদ্ধ রূপ।
‘জগৎ’ মানে হলো নানারকম রূপ, ভাব, ঘটনা ও পরিবর্তনের সমষ্টি—আমরা যাকে প্রতিদিন দেখি, শুনি, অনুভব করি। এই জগৎ কখনও স্থির নয়, বরং একটানা গতিশীল। আর ‘ধাত্রী’ মানে সেই সত্তা, যিনি এই সমস্ত বৈচিত্র্য, গতি ও পরিবর্তনকে একসাথে ধারণ করেন, যেন এক বিশাল সুরের মধ্যে সব নোট মিলে যায়, কিন্তু আলাদা আলাদা থেকেও কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে।
“জগৎ” হলো এক বিশাল সংগীত—যেখানে জন্ম, মৃত্যু, আনন্দ, বেদনা, প্রেম, ক্রোধ, গতি, স্থিরতা—এই সব শক্তি একসঙ্গে কাজ করছে। প্রতিটি শক্তি একেকটি বাদ্যযন্ত্রের মতো—কেউ ধীর, কেউ তীব্র; কেউ কোমল, কেউ প্রখর। যদি এদের মধ্যে কোনো নিয়ন্ত্রিত ছন্দ না থাকত, তবে পুরো বিশ্বই হতো এক বিশৃঙ্খল শব্দমালা।
কিন্তু জগদ্ধাত্রী সেই মহাসুরকার, যিনি এই সমস্ত শক্তিকে এক তাল, এক সুর ও এক ছন্দে বেঁধে রাখেন। তাঁর উপস্থিতিতে প্রতিটি শক্তি নিজের স্থান জানে, নিজের দায়িত্ব পালন করে এবং মিলেমিশে তৈরি করে এক ঐশ্বরিক সংগীত—যেখানে বহুত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ঐক্যের গভীর সুর।
জগদ্ধাত্রী সেই মহাশক্তি, যিনি জগতের প্রতিটি ভিন্ন সত্তা ও গতিকে এক মহান সংগীতের ছন্দে সংহত করেন। বিশ্বের এই স্থিতি, শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য তাঁরই ধৃতির প্রকাশ—যেখানে অস্থিরতার ভেতর থেকেও জন্ম নেয় সুর, আর অসংখ্য ভিন্নতার মধ্য থেকেও উদ্ভাসিত হয় একতার দীপ্তি।
বেদান্তে এই ধারণ বা সংযমের শক্তিকে বলা হয়েছে সত্ত্বগুণ—যা ব্রহ্মচেতনার অন্যতম প্রকাশ। “ব্রহ্ম” এখানে সেই পরম চেতনা, যিনি অসীম, অব্যয়, আর সকল রূপের অতীত। কিন্তু যখন তিনি নিজেকে এই সীমাবদ্ধ জগতের ভেতর প্রকাশ করেন, তখন এই সীমার মধ্যে থেকেও তিনি তার নিখাদ পবিত্রতা বজায় রাখেন—যেমন আলো রঙে রঙে ভেঙে পড়ে, তবুও নিজের উজ্জ্বলতা হারায় না। এই অবস্থাই সত্ত্বের প্রকাশ, এবং সেই সত্ত্বশক্তিরই জীবন্ত প্রতীক জগদ্ধাত্রী।
তন্ত্রশাস্ত্র এই নীতিকে আরও অন্তর্গতভাবে ব্যাখ্যা করে। সেখানে জগদ্ধাত্রীকে বলা হয় যোগমায়া—অর্থাৎ সেই দেবী, যিনি চেতনার সঙ্গে শক্তির যোগ ঘটান। তিনি প্রাণশক্তিকে (যাকে কুণ্ডলিনী বলা হয়) সংযত ও পরিচালিত রাখেন, যাতে সেই শক্তি আমাদের অন্তরের অন্ধকারকে জ্বেলে আলো করে তোলে। প্রাণশক্তি যখন অসংযত থাকে, তখন তা অস্থিরতা, কামনা ও বিভ্রমে রূপ নেয়; কিন্তু যখন জগদ্ধাত্রীর আশ্রয়ে আসে, তখন সেই একই শক্তি জ্ঞানে, ধ্যানে ও শান্ত দীপ্তিতে রূপান্তরিত হয়।
এই কারণেই জগদ্ধাত্রী কেবল কর্মশক্তির প্রতীক নন—তিনি শক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। তিনি কুণ্ডলিনীর প্রখর শক্তিকে শান্ত জ্ঞানের দীপ্তিতে রূপান্তরিত করেন। তাঁর শক্তি ঝড় নয়, বরং ভারসাম্যপূর্ণ হাওয়া; তাঁর দীপ্তি অগ্নিশিখা নয়, বরং সূর্যালোকের মতো স্থির, উষ্ণ ও শান্ত।
জগদ্ধাত্রী আমাদের শেখান—জীবনের বৈচিত্র্য বা অস্থিরতাকে দমন করার নয়, বরং তা সচেতনভাবে ধারণ করার নামই শক্তি। প্রকৃত বল নিহিত থাকে স্থিরতায়, নিয়ন্ত্রণে, আর আত্মজ্ঞানের সেই শান্ত দীপ্তিতেই, যা সমস্ত অস্থিরতার মধ্যেও নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে জানে।
প্রতিমা-শিল্পে জগদ্ধাত্রীকে দেখা যায় সিংহবাহিনী, হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ। এই চারটি অস্ত্র আসলে চেতনার চারটি শক্তির প্রতীক—শঙ্খ শব্দের, চক্র চেতনার গতি বা কালের, ধনুক ইচ্ছাশক্তির, আর বাণ জ্ঞানের সূক্ষ্ম তীক্ষ্ণতার প্রতিরূপ। তাঁর নিচে অসুররূপে যে মূর্খত্ব বা তামসিক প্রবৃত্তি পদদলিত, তা বোঝায়—অহং ও অবিদ্যার উপর জ্ঞান-সংযমের বিজয়।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও জগদ্ধাত্রী এক বিশেষ প্রতীক—তিনি সেই মানসিক অবস্থার প্রতিরূপ, যেখানে আবেগ ও যুক্তি, কর্ম ও ধ্যান, বহির্মুখতা ও অন্তর্মুখতা এক ভারসাম্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি আমাদের শেখান, আত্মসংযম কোনো দমন নয়, বরং আত্মজ্ঞান-নির্ভর স্থিতি। এ অবস্থায় মন আর বাইরের টানাপোড়েনে নয়, বরং অন্তর্নিহিত সত্যের আলোয় নিয়ন্ত্রিত হয়।
জগদ্ধাত্রী পূজা কেবল আচার নয়—এ এক দর্শন, যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণ, জ্ঞান ও সাম্যের সাধনা মিলিত হয়ে পরম সত্যের স্বীকৃতিতে পৌঁছে। এই দেবী তাই ব্রহ্মের প্রতিফলন—যিনি বিশ্বরূপে প্রকাশিত, তবু অন্তরে অবিচল; যিনি বহির্ভাবে শক্তি, অথচ অন্তরে নিস্তব্ধ চৈতন্য। তাঁর উপাসনা আমাদের শেখায়, সত্যিকার জগদ্ধাত্রী সেই আত্মা, যে নিজেই জগৎকে ধারণ করে, আবার তার ঊর্ধ্বে থেকেও জগৎকে আলোকিত করে।
‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি সংস্কৃত উপাদান থেকে—“জগৎ” এবং “ধাত্রী”। “জগৎ” শব্দের মূল গম্ ধাতু, যার অর্থ ‘গমন’ বা ‘চলন’; অর্থাৎ, যা সর্বদা গতিশীল, পরিবর্তনশীল—তা-ই জগৎ। অন্যদিকে “ধাত্রী” এসেছে ধা ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘ধারণ করা’, ‘রক্ষা করা’ বা ‘সমর্থন করা’। এই দুটি মিলে “জগদ্ধাত্রী” অর্থ দাঁড়ায়—“যিনি এই চলমান জগৎকে ধারণ করেন, স্থিরতা প্রদান করেন, এবং তার অন্তর্গত শৃঙ্খলাকে রক্ষা করেন।”
বেদান্তীয় দৃষ্টিতে, এই “ধারণ” কেবল ভৌত বা শারীরিক অর্থে নয়; এটি চেতনার স্তরে এক গভীর নীতি—স্থিতির নীতি। “ধাত্রী” হলেন সেই চেতনার শক্তি, যিনি পরিবর্তনের ভেতরেও স্থায়িত্ব সৃষ্টি করেন; যিনি অস্থির গতির মধ্যে সমতা, বিশৃঙ্খলার মধ্যে সুষমা প্রতিষ্ঠা করেন। গীতায় এই নীতিই প্রকাশিত—“স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা” (২/৫৪)—অর্থাৎ, "স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির কী ভাষা বা লক্ষণ?" এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৫৫ থেকে ৭২তম শ্লোক পর্যন্ত এক দীর্ঘ উত্তর দিয়েছেন, যা গীতায় 'স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণ' নামে সুপরিচিত। এই লক্ষণগুলিই কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের মাধ্যমে মুক্তি লাভের আদর্শ অবস্থা বর্ণনা করে। স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণগুলিই গীতার প্রধান দার্শনিক ভিত্তি। সেখানে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিকে বলা হয়েছে সেইজন, যিনি জগতের পরিবর্তনের মধ্যেও অবিচল। এই স্থিতিই “ধাত্রী”-র চেতনা।
জগদ্ধাত্রী সেই দেবী, যিনি সমস্ত অস্তিত্বের ভিতের মতো কাজ করেন, আর তাঁর শক্তিই বিশ্বচেতনার ভারসাম্য ও স্থিতি বজায় রাখে।
“আধারভূতঃ” মানে “সব কিছুর আধার” বা “ভিত্তি”—যার ওপর সমগ্র জগৎ টিকে আছে। পৃথিবী, প্রাণ, চিন্তা, গতি—সব কিছু তাঁর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত; তিনি না থাকলে কোনো কিছুই টিকে থাকতে পারত না। “ধৃতিরূপঃ” মানে “দৃঢ়তা বা স্থিরতার রূপ”—অর্থাৎ তিনি সেই শক্তি, যিনি জগতের ভেতরের শৃঙ্খলা, ভারসাম্য ও স্থিতিকে ধরে রাখেন।
ব্রহ্ম, যিনি চিরন্তন ও নিরাকার, তাঁর মধ্যে কোনো গতি বা পরিবর্তন নেই—তিনি নিঃসীম শান্তি ও চেতনা। কিন্তু যখন সেই ব্রহ্ম মায়ার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন, তখন রূপ, নাম, গতি, সৃষ্টি—এই সব উদ্ভূত হয়। এই গতি যদি সম্পূর্ণ মুক্ত থাকত, তবে বিশ্ব অস্থির হয়ে পড়ত। তাই এই প্রকাশ যেন নিয়ন্ত্রিত হয়, সুশৃঙ্খল থাকে—সেই নিয়ন্ত্রণের শক্তিই জগদ্ধাত্রী।
অর্থাৎ, তিনি সেই দেবী, যিনি অসীম ব্রহ্মের প্রকাশকে ভারসাম্যপূর্ণ করে রাখেন—শক্তি যেন উচ্ছৃঙ্খল না হয়, সৃষ্টি যেন বিশৃঙ্খল না হয়। তাঁর উপস্থিতিতেই মায়া নিয়ন্ত্রিত, গতি সুশৃঙ্খল, আর বিশ্বচেতনা স্থিত থাকে। তাই তাঁকে বলা হয়—তিনি অস্তিত্বের আধার, এবং স্থিতির জীবন্ত রূপ—যাঁর মধ্যে সব গতি, পরিবর্তন ও রূপ এক নির্ভরযোগ্য নীরব কেন্দ্রে স্থিতি খুঁজে পায়।
জগদ্ধাত্রীর রূপের ভেতর দিয়ে তিনটি মৌলিক নীতি প্রকাশ পায়, যা সমগ্র বিশ্বচেতনার ভারসাম্য রক্ষা করে।
প্রথমত, চলন (জগৎ) মানে গতি, পরিবর্তন, ক্রমাগত সৃষ্টি ও বিনাশের প্রবাহ। জগৎ সবসময় পরিবর্তনশীল—কিছু-না-কিছু ঘটছে, জন্ম হচ্ছে, বিলয় হচ্ছে, আবার নতুন কিছু তৈরি হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ধারণ (ধৃতি) মানে সেই শক্তি, যা এই ক্রমাগত পরিবর্তনকে ভেঙে পড়তে দেয় না; বরং তাকে এক নিয়মে, এক ভারসাম্যে ধরে রাখে। যেমন পৃথিবী ঘুরছে, নদী বইছে, গাছ বড়ো হচ্ছে—সবই পরিবর্তন, কিন্তু এক নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার ভেতরে। এই শৃঙ্খলার শক্তিই ধৃতি, আর জগদ্ধাত্রী সেই শক্তিরই প্রতীক।
তৃতীয়ত, সমতা (স্থিতি) মানে সেই গভীর শান্তি, যেখানে সমস্ত গতি ও পরিবর্তনের মাঝেও এক অপরিবর্তনীয় স্থিরতা অনুভূত হয়। জগদ্ধাত্রী এই স্থিতিরই দেবী—তিনি গতি বন্ধ করেন না, বরং সেই গতির মধ্যেই এক নীরব, ধ্রুব শান্তিকে ধরে রাখেন।
তাঁর মধ্যে প্রকাশ পায় এমন এক নীতি, যেখানে জগৎ ক্রমাগত পরিবর্তনশীল, কিন্তু সেই পরিবর্তনের ভেতরেও এক অদৃশ্য, চিরন্তন স্থিরতা কাজ করছে। তিনি সেই চেতনার স্থাপত্যের ভিত্তি, যিনি সব কিছুকে চলমান রাখেন, তবুও নিজে কোনো আন্দোলনে আবদ্ধ নন। তাঁর শক্তি একাধারে গতিশীল এবং স্থিতিশীল—তিনি বিশ্বকে চালান, কিন্তু নিজে চিরশান্ত ব্রহ্মসত্তায় প্রতিষ্ঠিত।
অদ্বৈত বেদান্তে “জগৎ” কেবল দৃশ্যমান বাস্তবতার ধারণা নয়—এটি সেই সূক্ষ্ম উপলব্ধি, যেখানে পরম চেতনা যেন নিজেকে নানারূপে প্রকাশ করে। এই দর্শন ঘোষণা করে—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, অপর যা কিছু প্রতীয়মান, তা মায়ার ছায়া মাত্র। কিন্তু এই “মায়া” কোনো মিথ্যা বিভ্রম নয়; এটি ব্রহ্মেরই সক্রিয় শক্তি, যার মাধ্যমে এক অদ্বিতীয় সত্তা আপাত বহুত্বের নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। তাই প্রপঞ্চ বা জগৎ, যদিও পরম অর্থে অনিত্য, তবুও তা পরম চেতনারই খেলা—যেন নিস্তব্ধ সাগর নিজেরই ঢেউয়ে প্রতিফলিত।
জগদ্ধাত্রী সেই শক্তি, যিনি পরম চেতনার সক্রিয় দিক হিসেবে প্রকাশিত হন। ব্রহ্ম স্বভাবতই স্থির, নিরাকার ও অসীম; কিন্তু তাঁর মধ্যে যে-শক্তি আছে, যা সেই অসীম স্থিরতার মধ্যেও গতি, সৃষ্টি ও প্রকাশ ঘটায়—সেই শক্তিই জগদ্ধাত্রীর রূপে উদ্ভাসিত হয়।
তিনি জগতের ধারক ও রক্ষিকা—অর্থাৎ বিশ্বজগতের সমস্ত গতি, রূপ ও পরিবর্তন যেন টিকে থাকে, ভেঙে না পড়ে, সে দায়িত্ব তাঁর। অসীম ব্রহ্মের মায়াশক্তি বা সৃষ্টিশক্তি যেন বিশৃঙ্খলায় ছড়িয়ে না পড়ে, বরং এক সুশৃঙ্খল রূপে প্রকাশিত হয়—সে লক্ষ্যে জগদ্ধাত্রী সেই বিশৃঙ্খল প্রবাহকে রূপ, সীমা ও ভারসাম্য দেন। তাঁর মাধ্যমে অসীম সম্ভাবনা পায় এক নির্দিষ্ট প্রকাশ, চেতনার অন্তহীন আলো পায় এক নিয়ন্ত্রিত দীপ্তি।
ব্রহ্ম, যিনি তুরীয়—অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুপ্ত—এই তিন চেতনা-অবস্থারও অতীত, নিস্পৃহ ও নিরাকার; তিনি যখন জগতে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তখন তাঁর এই স্থির চেতনা জগদ্ধাত্রীর মাধ্যমেই গতিশীল রূপ পায়। জগদ্ধাত্রী সেই মাধ্যম, যার দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন—চলমান জীবন, প্রকৃতি ও সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে।
এজন্য তাঁকে বলা হয় এক সেতু—তিনি সেই সংযোগরেখা, যা অদৃশ্য, নীরব ব্রহ্মচেতনা ও দৃশ্যমান, কর্মময় জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। তাঁর মধ্য দিয়েই ব্রহ্ম বাস্তব জগতে প্রতিফলিত হন, আর জগৎ তাঁর মাধ্যমে নিজের উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
জগদ্ধাত্রী সেই মধ্যস্থ চেতনা, যিনি স্থিতি ও গতি, নিরাকার ও রূপ, নীরবতা ও প্রকাশ—এই দুই বিপরীত দিককে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যে ধারণ করেন। তিনি ব্রহ্মচেতনার শান্ত গভীরতা আর জীবনের চলমান প্রবাহের মধ্যে এক ঐশ্বরিক সেতুবন্ধন—যেখানে সৃষ্টি ও স্থিতি, ধ্যান ও কর্ম, নিস্তব্ধতা ও প্রকাশ একই সত্যে মিলেমিশে যায়।
তাঁর যোগশক্তি মহাবিশ্বের ধ্বনি ও গতি, সৃষ্টির অন্তর্লীন শৃঙ্খলা ও স্থিতির ভিত্তি। এই “ধৃতি”—অর্থাৎ দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব—তাঁর স্বরূপ। তিনিই মহাজাগতিক স্থিতিশক্তি, যিনি গতি ও পরিবর্তনের মাঝে স্থায়ী সমতা স্থাপন করেন। ব্রহ্ম যদি নিস্তব্ধ চৈতন্য হয়, তবে জগদ্ধাত্রী সেই নিস্তব্ধতার স্থপতি শক্তি, যিনি বহির্বিশ্বকে সংহত ও স্থির রাখেন, যাতে অস্তিত্ব নিজেই নিজেকে ধারণ করতে পারে।