এক।
একসময় মনে হতো, আমার জামায় অনেক পকেট থাকুক, তাহলে অনেক নুড়িপাথর জমাতে পারব। এখন মনে হয়, আহা, অনেক বড়োসড়ো একটা জামা আমার থাকলে সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারতাম!
দুই।
: তোমার ঘর কোথায়? : সেখানে, যেখানে রক্ত ও অশ্রু পাশাপাশি ঘুমোয়।
তিন।
কবিকে নিলামে তুলো না। বেচতে হয়তো পারবে, তবে বিক্রি হয়ে যাবে নিজেই।
চার।
মশারি—মাত্র চারটা পেরেকের উপর ভর করে যেখানে বিশ্বসংসার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে।
পাঁচ।
মানুষ নানান রঙের বলেই রংহীনতার এত জয়জয়কার।
ছয়।
ছুরির ধারেই যত রক্তপাত, বিচারের রায়ে তবু ফাঁসি হয় অস্তগামী সূর্যের!
সাত।
: এত পাথর জমিয়েছ কেন? : প্রাক্তনের দিকে ছুড়ব বলে! : পাথর তো পাথরের দোসর, ছুড়ে কী হবে? : তবে? : পাথর ফেলে বরং ঘুমোও।
আট।
একা তো সবাই-ই! যদি তা না হতো, তবে কি আর যে যার মতো কাঁদত, বলো?
নয়।
তোমাকে তো দেখি হাজার বছর ধরে! তুমি একদিন আমায় দেখলে আর অমনিই ভয়ে পালিয়ে গেলাম, পাছে তুমি আমার অশ্রুর সাক্ষী হয়ে যাও!
দশ।
শিশুর জন্ম ওর জন্মের আগেই—বাবা-মা’য়ের স্বপ্নে। বাবা-মা’য়ের পুনর্জন্ম শিশুর চোখে—বাবা-মা’য়ের যত্নে।
এগারো।
নগ্ন এসেছিলাম। সেই নগ্নতায় আমার কোনো হাত ছিল না। নগ্ন বেঁচে আছি। এই নগ্নতায় ঈশ্বরের কোনো হাত নেই।
বারো।
লাম্পট্য ও ব্যভিচার ঈশ্বর পছন্দ করেন না। তাই লম্পট ও ব্যভিচারী লোকেরা ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত; তবে ভদ্রলোকেদের বেলাতে ব্যাপারটা আলাদা।
তেরো।
সবাই বোবা নয়, বেশিরভাগই নির্বাক। মানুষ যখন তার নিজের খুনির নামটা জানে, তখন সে ঈশ্বরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে আর নিরাপদ নয়।
চৌদ্দ।
হাতে যখন সময়ের চেয়ে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন টাকা গোনার সময় সূর্য ও চাঁদ দুই-ই মাথার কাছে নেমে এসে শুধোয়: আলোটা একটু বাড়িয়ে দিই, স্যার?
পনেরো।
কাচের ঘরে থেকে পাথরকে খেপিয়ে কী লাভ!
ষোলো।
তোমায় ভালোবাসি, তাই বলে সময় চাই না। আমায় ভালোবাসো, তাই বলে সময় চেয়ো না।
সতেরো।
বন্ধুত্বের ভান করে যারা, তাদের সাথে মেশার আগে, কৌরবদের বন্ধু শকুনি মামার কথা ভেবো।
আঠারো।
কারও উপর আমার কোনো রাগ নেই। রাগ করে কী হবে, সকলেই তো ঈশ্বরের সন্তান! সন্তান পিতার মতন হবে না তো কার মতন হবে?
উনিশ।
ঈশ্বর গাধাকে আকাশ না চিনিয়ে চিনিয়েছেন ঘাস আর কাঁটাগাছ। তা সত্ত্বেও মা শীতলাকে রাস্তায় ফেলে না দিয়ে যে বহন করে চলেছে, তা কি সে গাধা বলেই? না কি এ কেবলই ঈশ্বরের প্রতারণার ফল?
বিশ।
গলা কেটে ফেলার পরও যদি, মুণ্ডু দূরে থাক, এক ফোঁটাও রক্ত মাটিতে না পড়ে, তবে বুঝে নিয়ো, ওখানে রাজনীতির মহড়া চলছে।
একুশ।
ভিক্টিম নিজের মা-বোন না হলে যৌনতার সব ধরনের চর্চাকেই লীলা মনে হয়।
বাইশ।
দুঃখীদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব ঈশ্বরের কিংবা রাষ্ট্রের। বিশ্বাস না হলে বস্তিগুলোর দিকে তাকান, সব বুঝে যাবেন।
তেইশ।
মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু কুকুর, কেননা ওদের কামড়ানোর দৌড় হাঁটু পর্যন্তই।
চব্বিশ।
ভেজা কাঠে ভাত রান্না হচ্ছে। রাঁধুনি ক্রমাগত ফুঁ দিয়ে চলেছেন কাঠে লাল আগুন ধরানোর জন্য। ফুঁ দিতে দিতে ব্যথায় চোয়াল নীল হয়ে গেছে। তবু তার সাহস নেই—কাঠ যদি দিলই, তবে তা ভেজা দিল কেন—এই প্রশ্ন তোলার! তার কাজ রান্না করা, রান্নার কাঠ নিয়ে প্রশ্ন করা নয়।
পঁচিশ।
বহুদিনের পুরোনো একটা ভোঁতা ছুরি ড্রয়ারে পড়ে আছে। আমার বিশ্বস্ত প্রেমিকার একটা ব্রায়ের দাম পেলেই ছুরিটা বেচে দেবো। কেনার পর ক্রেতা ওটা দিয়ে আপেল কাটল কি তার প্রেমিকার গলা কাটল, তা আমার দেখার বিষয় নয়।
ছাব্বিশ।
আমি কবিই হতে চাই, কেননা একজন কবি হিসেবে আপনাকে গালাগাল করলেও আপনি সেখানে নান্দনিকতা খুঁজে পাবেন।
সাতাশ।
ব্যাঙের ভূগোল তার কুয়োটুকুই, যেমনি প্রতারকের ভূগোল তার পবিত্র গ্রন্থটুকুই।
আটাশ।
লোকে হিটলারকেই ভালোবাসে, কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে তার মতো আর কেউই শ্মশানের আনুষ্ঠানিকতার খরচা বাঁচিয়ে দেয়নি।
উনত্রিশ।
শৃঙ্খলা চাও তো ভেড়া পালো। লক্ষ ভেড়ার একটা পালও মাথা নিচু করে খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে চলে। যে কোনোদিনই শৃঙ্খলা ভাঙেনি, সে আবার মানুষ হয় কী করে?
ত্রিশ।
ফুলের বাগান করার চাইতে যে শুয়োরের খামার করাটা অধিক লাভজনক, তা জানার জন্য শুয়োর হতে হয় না, মানুষ হলেও চলে।
একত্রিশ।
শুয়োরদের হাতে কাঁটা চামচ ধরিয়ে দিলেও ওরা তা দিয়ে বিষ্ঠাই খাবে।
বত্রিশ।
হিসেব করে দেখলাম, একজন কবির চাইতে খুবই সাধারণ মানের একটা বেশ্যার দামও বেশি। আপনিই বলুন, নেহায়েতই গরিব না হলে কেই-বা কবিতা পড়বে?
তেত্রিশ।
মোরগটাকে কুকুরের সঙ্গেই পালতাম। ওদের মধ্যে কখনও কোনো ঝগড়াঝাঁটি দেখিনি। অথচ মোরগটাকে জবাই করার সময় আমি কুকুরের চোখেমুখে খুশি দেখেছি। শালা, বেঁচে থাকলে বিনে পয়সায় কত নাটক দেখা যায়!
চৌত্রিশ।
কবিদের বেদনার কথা বিনে পয়সায় ছেপে দেয় যে-শালা, খোঁজ নিয়ে দেখো, বেচারা খুব চেষ্টা করেও তার বেদনার কথাগুলি লিখতে একসময় ব্যর্থ হয়েছিল!
পঁয়ত্রিশ।
তৃষ্ণার জল চাইলেই একদিন যাকে সমুদ্র দেখিয়ে বলতাম, “যা! গোটা সাগরটাই তোর নামে লিখে দিলাম!”, আজ বিকেলের ডাকে তার চিঠি পেলাম। সেখানে লেখা, “তোমার অশ্রুভেজা রাত্রিগুলির ঠিকানা আমার কাছে জমা আছে; লাগলে বোলো, পাঠিয়ে দেবো।”
ছত্রিশ।
আমাকে যারা হত্যা করেছিল কিছু কবিতার ভ্রূণ আমার গর্ভে থাকার সন্দেহে, আমার মৃত্যুর পর ওরাই এসেছিল আমার কবরের কাছে...কবিতাগুলি খুঁজতে।
সাইত্রিশ।
কবিদের চাকরি দিয়ো না, ওরা শুধুই কবিতা লিখতে পারে। বরং চাকরি দাও ওদেরকেই, যারা কবিতা লিখতে পারে না; ওরা প্রয়োজনে মানুষও খুন করতে পারে।
আটত্রিশ।
যাকে যা দেখতে পাওয়াটা ছিল সংগত, তাকে তার উলটোটা দেখতে দেখতে আমরা এখন উলটোটাকেই সোজা হিসেবে ধরে নিয়েছি। ঈশ্বরকে বানিয়েছি শয়তান, আর শয়তানকে ঈশ্বর। সাহিত্যিককে বানিয়েছি সাংবাদিক, সাংবাদিককে সাহিত্যিক।
উনচল্লিশ।
সমস্ত খেলাই নিজ নিজ নিয়মে এখানে-ওখানে চলছে, যদিও সবাই তার নিজ নিজ পছন্দের খেলাটিকেই চলমান হিসেবে ধরে নিয়ে অন্য সমস্ত খেলাকেই নাকচ করে দিতে চাইছে।
চল্লিশ।
“শালা, শুয়োরের বাচ্চা!” বলে থুতু ছুড়ে গালি দিতে মন চায় যাদেরকে, অবাক হয়ে দেখি, ওদের প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো দিক দিয়ে আমারই জ্ঞাতিভাই!
একচল্লিশ।
চুল ছেঁড়াছিঁড়ি আগে শেষ হতে দাও। এরপর তামাশা দেখো। দেখবে, হারানো চুলের শোকে বোকারা কাঁদে কীভাবে! এখানে কর্তৃপক্ষ বড্ড মায়াবী—মায়ায় পড়ে বাধাও দিতে পারে না, চুল ফেরত দিতেও পারে না।
বিয়াল্লিশ।
হে ঈশ্বর! এত শীত পাঠালেই যদি, পুরোনো একটা সোয়েটারও কেন সঙ্গে পাঠালে না? না কি কেবল সোয়েটার পাঠানোর বেলাতেই তুমি সর্বনিয়ন্তা নও?
তেতাল্লিশ।
আমার জামায় একটা ফুটো, এর নাম দারিদ্র। তোমার জামায় হাজার ফুটো, তার নাম ডিজাইন। ...কিন্তু এমন কেন?
চুয়াল্লিশ।
ভদ্র হতে হলে মৃতদের মতো ভদ্র হও। অভদ্র হতে হলে অসুস্থদের মতো অভদ্র হও। নিরুপায় হয়ে...হয় কাউকেই বিরক্ত কোরো না, নয় সবাইকেই বিরক্ত করো।
পঁয়তাল্লিশ।
ওরা সবার উপরেই আস্থা রাখতে চায়, কেননা ওরা কারও সাথেই দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না। ওরা বলে, মানুষকে শৃঙ্খলা মানতে হয়। শৃঙ্খলা আর কাপুরুষতা যে এক নয়, তা ওদের মাথায়ই নেই! ওরা এক মুখে প্রতারিত হতে চায় না, আরেক মুখে প্রতারণাকে প্রশ্রয় দেয়।
ছেচল্লিশ।
সেন্সর-বোর্ড খুব কড়া! এক নিজেদেরকে বাদে আর কাউকেই ওরা কোনো নোংরামি করতে দেবে না। এখানে সব কিছুই সেন্সরড!
সাতচল্লিশ।
সামাজিক নিঃস্পৃহতার কালচারে পাখিদের গানই সেইসব সামাজিক মানুষের ঘুম ভাঙানোর একমাত্র উপায়, যারা রাত্রি গভীরে ঢোকার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।
আটচল্লিশ।
মৃত্যুর সময়, যারা বীজ বোনে, তাদের নামে আমার অর্ধেক আকাশ উইল করে যাব; আর বাকিটা করব আমার মায়ের নামে, যার রক্তপাতেই আমি আমার আকাশটা পেয়েছিলাম।
উনপঞ্চাশ।
মূলত সমস্ত আয়োজনই অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে; আমরা কেবল সময়ে সময়ে সাড়াটুকু দিই, আর সেসবের নাম দিই—প্রয়োজন।
পঞ্চাশ।
জীবনের খুব কাছাকাছি ও পাশাপাশি থেকেও যেমন করে মানুষ একসময় জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি প্রিয় কাউকে খুব স্পষ্ট করে অনুভব করতে করতেই মানুষ একসময় তার প্রতি অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। জীবন কূলে কূলে জীবনের ছদ্মবেশে মৃত্যুর ঢেউ আছড়ে পড়ে!
একান্ন।
যার ভেতরে আগুন নেই, সে বরং আগুন চুরি না করুক। তার মাথায় থাকুক, অসতর্কতায় গায়ে কোনোভাবে আগুন লেগে গেলে বাঁচাতে কেউই এগিয়ে আসবে না। স্পর্ধা যার রক্তে নেই, তার চামড়ায় স্পর্ধা ফোসকা ফেলে দেয়।