ভক্তের সকল ভার ভগবানই বহন করেন। সত্যিই কি করেন? কেন করেন? কীভাবে করেন? এখানে ভক্তের কর্তব্যকর্ম কী কী? গীতামুখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি। কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি॥ (গীতা, ৯/৩১)
[সঃ (তিনি—সে ব্যক্তি)], ক্ষিপ্রং (শীঘ্র, অচিরেই বা তাড়াতাড়ি), ধর্মাত্মা (ধর্ম-আত্মা: ধার্মিক), ভবতি (হন বা হয়ে যান), শশ্বৎ (নিত্য বা চির), শান্তিং (শান্তি), নিগচ্ছতি (প্রাপ্ত হন বা লাভ করেন), কৌন্তেয় (হে কুন্তীপুত্র), মে (আমার), ভক্তঃ (ভজনশীল, উপাসক, ভক্ত), ন প্রণশ্যতি (বিনষ্ট হন না), [ইতি: এটা] প্রতিজানীহি (নিশ্চিতরূপে জানো, প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারো)
অর্থ: তিনি (এরূপ অসৎ ব্যক্তি) শীঘ্র ধার্মিক হয়ে যান এবং চিরশান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়, তুমি এটা নিশ্চিত হয়ে জেনে রাখো এবং জগতে প্রচার করো যে, আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হন না।
শ্রীধরস্বামীর টীকায় এখানে পাচ্ছি—হে কৌন্তেয়, জয়ডঙ্কা, ঢাক প্রভৃতি দিয়ে উচ্চধ্বনি তুলে বিবদমান (বিবাদ বা কলহ করছে এমন) সভায় গিয়ে বাহু তুলে নিঃশঙ্ক প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারো যে, সুদুরাচার হলেও ভগবানের ভক্তের নাশ নেই।
ঋগ্বেদেও দেখতে পাই—"ন হন্যতে ন জীয়তে ত্বোতো নৈনমংহো অশ্নোত্যন্তিতো ন দূরাৎ।" (৩/৫৯/২), অর্থাৎ তুমি যাকে রক্ষা করো, কেউ তাকে বিনাশ বা পরাভূত করতে পারে না। কোনো পাপ দূর বা নিকট হতে তাকে স্পর্শ করতে পারে না। (ভগবান যে-ভক্তকে রক্ষা করেন, তিনি নিশ্চয়ই পাপমুক্ত হয়ে ভগবদ্ভক্তি অর্জন করেছেন বলেই ভগবানের অমন কৃপার অধিকারী হন, কেননা ভগবান সবসময়ই ন্যায়বিচারক।)
বাহ্যিক গর্হিত আচার, স্বভাব ইত্যাদি ত্যাগ করে যখন আন্তরিক নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি ("সিদ্ধ কে? যার নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি হয়েছে যে, ঈশ্বর আছেন, আর তিনিই সব করছেন; যিনি ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন।"—শ্রীরামকৃষ্ণের 'কথামৃত') পরমার্থ বিষয়ে শান্ত বা স্থির হয়, তখন তিনি আর অসাধু থাকেন না, ধার্মিক হয়ে যান। হে কুন্তীপুত্র, লোকমধ্যে সর্বজনসমক্ষে তুমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারো যে, আমার ভক্ত, অর্থাৎ যাঁর মন-প্রাণ-অন্তরাত্মা আমাতে সমর্পিত, তিনি, কোনো অবস্থাতে বিনষ্ট হন না।
শ্রুতিশাস্ত্র বলছেন—দুরাচার ব্যক্তি ভক্ত হতে পারেন না, অর্থাৎ ভগবানের প্রতি তাঁর মনই হয় না। আবার গীতামুখে ভগবান বললেন, দুরাচার ব্যক্তির মনে আমার প্রতি যদি সামান্য অনুরক্তি আসে, তাহলে অচিরেই তাঁর দুর্বৃত্তভাব চলে যায় এবং তখন তিনি সদাচারসম্পন্ন এবং নিষ্ঠচিত্ত হন। বারবার তনুতপ্ত হওয়ায় তাঁর ভেতর থেকে ভগবদ্বিরুদ্ধ সমস্ত ভাব অন্তর্হিত হয় এবং তাঁর চিত্ত শান্তপ্রকৃতি ধারণ করে। শ্রুতি ও স্মৃতিতে বর্ণিত প্রায়শ্চিত্তসমূহ সাধন না করলেও ভগবানের ভক্ত ভ্রষ্ট হয়ে কখনও দুর্গতিপ্রাপ্ত হন না। অর্জুন প্রমুখ ভক্তরা ভক্তিবিরহিত ব্যক্তিগণকেও সগর্বে বলতে পারেন যে, ভগবানের ভক্তের কখনও বিনাশ নেই।
দুরাচার ব্যক্তিরা অধর্মাচরণের পরই যদি ভগবানের ভজনমার্গের অনুসরণ করেন, তাহলে তাঁদের মনে অনুতাপ জাগে, আর নিজেকে মানুষের সমাজে কলঙ্কস্বরূপ মনে করে নির্বেদ বা আত্মগ্লানি প্রাপ্ত হন, এভাবে তিনি অচিরেই কাম-ক্রোধাদির বেগ থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং ধর্মাত্মা হন। ভক্তকে রক্ষা ভগবানই করেন।
চিরকালের দুরাত্মাও যদি একবার একমনে একধ্যানে ভগবানের শরণ নেয়, তাহলে সেই উপাসনার ফলে শীঘ্রই সে ধার্মিক হয়ে যায়। উপাসনার এমনই মহিমা যে, এতে তার সমস্ত দুর্বৃত্ততা ঘুচে যায় এবং নির্বেদ উপস্থিত হওয়ায় সে ধার্মিকে পরিণত হয়। ভগবানের প্রতি ভক্তির এমনই মহিমা যে, তাঁর ভক্তগণ বিরুদ্ধবাদীদের সামনে গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন, যত দুরাচারীই হোক না কেন, বাসুদেবভক্ত হলে তার আর বিনাশ হয় না। ভগবান তাকে রক্ষা করেন।
ভগবদ্বিশ্বাসী ব্যক্তি দুরাচার হলেও নিশ্চয়ই তিনি সমস্ত প্রকারের দুর্বৃত্তপরায়ণতা ত্যাগ করে অচিরেই ধার্মিকতার লক্ষণযুক্ত হন এবং পরিশেষে চিরশান্তি লাভ করেন। পরম কৃপাময় ভগবান বাৎসল্য, ক্ষমা ও অনুকম্পাবশত ভক্তকে বিনাশ থেকে রক্ষা করেন।
নিজে ধর্মে স্থির হয়ে লোকের মধ্যে ভক্তিযোগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই কর্তব্যকর্ম। অতি পাপাত্মাও ভগবদ্নামে ধর্মাত্মা হয় ও নিরন্তর শান্তি পায়—তুমি নিশ্চিত হয়ে জেনে রাখো, ভগবানের ভক্তের কখনও বিনাশ হয় না।
ভগবানের পায়ে আত্মসমর্পণে আত্মার সকল দ্বার উন্মুক্ত হয়, নীচ সাধারণ প্রকৃতি দ্রুত অধ্যাত্ম প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হয় ও দিব্যজীবনের ধর্ম গড়ে ওঠে। এর ফলে ভগবান তাঁর মায়ার আবরণ অপসৃত করেন, সকল ভ্রান্তি নাশ করেন ও বাধা ধ্বংস করেন। প্রকৃত ঈশ্বরভক্ত কখনও অধোগতিপ্রাপ্ত হন না।
ভগবানকে ডাকার এমনই আশ্চর্য মহিমা যে, মহাপাপীও শীঘ্র ধর্মাত্মা হন। সমস্ত কর্মীরই ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, কিন্তু ভক্তিরাজ্যে ঐকান্তিকতা থাকলে ভগবান বশীভূত হন, এমনকি অজ্ঞানাচ্ছন্ন অবস্থাতে ভক্তের মৃত্যু হলেও, ভগবান ভক্তের হৃদয়ে বিরাজিত থেকে তাকে পতন বা বিনাশ থেকে রক্ষা করেন।
এখানে 'প্রতিজানীহি' কথাটা—যার অর্থ—'প্রতিজ্ঞা করে বলছি' বা 'সত্য করে বলছি'—ভগবান কেন বললেন?
এমন কথা মানুষ যখন বলে, তখন বুঝতে হবে, তার বিশ্বাসে দৃঢ়তার কিছু অভাব বা সংশয় আছে, কেননা মানুষ যখন পুরো বিশ্বাস নিয়ে সত্য কথা বলে, তখন এ ধরনের কথা বলে না; যেমন খাওয়ার পর "আমি খেয়েছি।", কেবল এটুকুই বলে—"নিশ্চিত করে বলছি, আমি খেয়েছি।"—এভাবে কিন্তু বলে না, বরং অসম্ভব কিছু বা বিশ্বাসের কিছুটা অভাব নিয়েই বলে—সত্যি করে বলছি…নিশ্চিত করে বলছি… ইত্যাদি। তাহলে ভগবান এ ধরনের কথা কেন বললেন?
এর একটা দিক লক্ষ করতে হবে যে, ভগবান এখানে নিজে প্রতিজ্ঞা করে বলছেন না—তাঁর তো বিশ্বাসের অভাব নেই—তিনি নন, বরং "ভক্ত বলতে পারবে প্রতিজ্ঞা করে যে, ভক্তের বিনাশ হয় না।"—এখানেই আমাদের মনে বিশ্বাসের কিছুটা ঘাটতির সম্ভাবনা রয়ে গেল— বাস্তবিক ক্ষেত্রে আমরা দেখি, গূঢ় ভগবদ্তত্ত্ব সম্বন্ধে মানুষ পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারে না, আবার নির্দ্বিধায় বিশ্বাসও করতে পারে না; সেজন্য এখানে প্রতিজ্ঞা করার সুযোগ রয়েই গেল।
আর 'বিনাশ' অর্থ এখানে 'আত্মিক বিনাশ' বা 'ধর্মরাজ্যে উন্নতির বিনাশ' বোঝানো হয়েছে। গীতামুখে ভগবান ষোড়শ অধ্যায়ে হিংসাপরায়ণ, লোভী, অপরের অনিষ্টকারী, দাম্ভিক ভোগীদের উদ্দেশে বলেছেন—
অনেকচিত্তবিভ্রান্তা মোহজালসমাবৃতাঃ। প্রসক্তাঃ কামভোগেষু পতন্তি নরকেহশুচৌ॥ (১৬)
তানহং দ্বিষতঃ ক্রূরান্ সংসারেষু নরাধমান্। ক্ষিপাম্যজস্রমশুভানাসুরীষ্বেব যোনিষু॥ (১৯)
আসুরীং যোনিমাপন্না মুঢ়া জন্মনি জন্মনি। মামপ্রাপ্যৈব কৌন্তেয় ততো যান্ত্যধমাং গতিম্॥ (২০)
কাম, ক্রোধ, লোভের ফলে আসুর স্বভাবের লোকের মধ্যে দম্ভ, দর্প, হিংসা, দ্বেষ এত বৃদ্ধিলাভ করে যে, অপরের ক্ষতি করে ক্রমাগত ভোগৈশর্য বৃদ্ধির চেষ্টায় মত্ত হয়—অশ্রদ্ধাশীল হয়, তাদের জঘন্য বৃত্তির প্রকাশ দেখে গীতামুখে ভগবান বললেন, তিনি তাদের ব্যাঘ্র-সর্পাদি যোনিতে নিক্ষেপ করেন, আবার সেখান থেকেও আরও নীচজন্ম কৃমি-কীটাদিরূপে তাদের জন্ম হয়—এখন এই যে বিশেষ বিনাশ, এটা ভক্তের কখনও হয় না। আসুর প্রবৃত্তির লোক ভগবদ্ভক্তিরসে জারিত হলে তিনি সেই পরিণতি থেকে মুক্ত হতে পারেন।—তাছাড়া ভক্তেরা অনেকসময় দুঃখ-দারিদ্র্য ভোগ করলেও জাগতিকভাবে ভগবান তাদের সবসময় রক্ষা করেন। এমনটা ঘটতে আমরা নিত্যই দেখছি।
অন্য শাস্ত্রেও পাই—
মহাপাতকযুক্তোহপি কীর্তয়ন্ননিশং হরিম্। শুদ্ধান্তঃকরণো ভূত্বা জায়তে পংক্তিপাবনঃ।। (ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ)
অনুবাদ: মহাপাপিষ্ঠও যদি নিরন্তর হরিকীর্তন করেন, তাহলে তাঁর অন্তঃকরণ শুদ্ধ হয়ে যায় ও তিনি পঙ্ক্তিপাবন হন (অর্থাৎ দ্বিজশ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন)।
অগ্ৰ্যাঃ সর্বেষু বেদেষু সর্বপ্রবচনেষু চ। শ্রোত্রিয়ান্বয়জাশ্চৈব বিজ্ঞেয়াঃ পঙ্ক্তিপাবনাঃ॥ (মনুসংহিতা, ৩/১৮৪)
অর্থ: সকল বেদে, সকল বেদাঙ্গে যাঁরা শীর্ষস্থানীয় এবং বেদত্ত ব্রাহ্মণকুলে জাত, তাঁরা পঙ্ক্তিপাবন বলে জ্ঞেয়।
স্বামী বিবেকানন্দ সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন, "ইঁহারা ব্যতীত আর এক শ্রেণীর গুরু আছেন—এই পৃথিবীর খ্রীষ্টতুল্য ব্যক্তিগণ। তাঁহারা গুরুরও গুরু—স্বয়ং ঈশ্বর মানবরূপে অবতীর্ণ। তাঁহারা পূর্বোক্ত গুরুগণ অপেক্ষা অনেক উচ্চে। তাঁহারা স্পর্শ দ্বারা, এমনকি শুধু ইচ্ছামাত্র অপরের ভিতর ধর্মশক্তি সঞ্চারিত করিতে পারেন। তাঁহাদের শক্তিতে হীনতম অধম ব্যক্তিগণও মুহূর্তের মধ্যে সাধুতে পরিণত হয়। তাঁহারা কীরূপে ইহা করিতেন, তাহা কি তোমরা পড়ো নাই? আমি যে-সকল গুরুর কথা বলিতেছিলাম, এই গুরুগণ তাঁহাদের মতো নন, ইঁহারা ঐ-সকল গুরুরও গুরু—মানুষের নিকট ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। তাঁহাদের মধ্য দিয়া ব্যতীত অন্য কোনোরূপে আমরা ঈশ্বরের দেখা পাইতে পারি না। তাঁহাদিগকে পূজা না করিয়া আমরা থাকিতে পারি না, একমাত্র তাঁহাদিগকেই আমরা পূজা করিতে বাধ্য।" (ভক্তির আচার্য—সিদ্ধগুরু ও অবতারগণ)
মহাপ্রভুর স্পর্শে অতি দুরাচার জগাই-মাধাই নিমেষে পবিত্র হয়ে যাওয়ার কথা আমরা পদকর্তা নরোত্তম দাস ঠাকুরের পদে পাই—
ব্রজেন্দ্রনন্দন যেই শচীসুত হৈল সেই বলরাম হইল নিতাই। দীনহীন যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল তার সাক্ষী জগাই মাধাই॥
'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের মধ্যখণ্ডে আছে—
এক নামাভাসে তোমার পাপ-দোষ যাবে। আর নাম লইতে কৃষ্ণচরণ পাইবে।
ভগবদ্স্মরণে পাপ দূর হয়ে যায়, এ সম্বন্ধে কথামৃত-মুখে শুনছি—
"ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই — কী! আমি তাঁর নাম করেছি, আমার এখনও পাপ থাকবে? আমার আবার বন্ধন কী, পাপ কী?...ভগবানের নাম করলে মানুষের দেহ-মন সব শুদ্ধ হয়ে যায়।"
ভগবান গীতামুখে এই মন্ত্রে যে-কথাটা বললেন, সেটা কৃপার কথা—কৃপায় কী না হয়—এ সম্বন্ধে কথামৃত-মুখে বড়ো আশ্বাসভরা এই বাণী পাই—
"অষ্টবন্ধন নয়, অষ্টপাশ। তা থাকলেই-বা! তাঁর কৃপা হলে এক মুহূর্তে অষ্টপাশ চলে যেতে পারে। কীরকম জানো, যেমন হাজার বৎসরের অন্ধকার ঘর, আলো লয়ে এলে একক্ষণে অন্ধকার পালিয়ে যায়! একটু একটু করে যায় না! ভেলকিবাজি করে, দেখেছ? অনেক গেরো দেওয়া দড়ি একধার একটা জায়গায় বাঁধে, আর-একধার নিজের হাতে ধরে; ধরে দড়িটাকে দুই-একবার নাড়া দেয়। নাড়াও দেওয়া, আর সব গেরো খুলেও যাওয়া। কিন্তু অন্য লোকে সেই গেরো প্রাণপণ চেষ্টা করেও খুলতে পারে না। গুরুর কৃপা হলে সব গেরো একমুহূর্তে খুলে যায়।"
গীতামুখেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরেক জায়গায় একথা বলছেন—
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে৷ ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি॥ (৬/৪০)
অর্থ: হে পার্থ, বৈদিক কর্মত্যাগ করা সত্ত্বেও যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি ইহলোকে পতিত বা নিন্দিত হন না, পরলোকেও নিকৃষ্ট শরীর প্রাপ্ত হন না। হে বৎস, এর কারণ, কল্যাণকারীর কখনও অধোগতি হয় না।
উপনিষদও বলছেন:
ইহ চেদশকদ্বোদ্ধুং প্রাক্ শরীরস্য বিস্রসঃ। ততঃ সর্গেষু লোকেষু শরীরত্বায় কল্পতে।। (কঠোপনিষদ, ২/৩/৪)
অর্থ: এই সংসারে শরীরত্যাগের পূর্বেই জ্ঞানলাভ করতে পারলে তবেই মঙ্গল, অন্যথায় অজ্ঞানবশত সৃষ্টির নানাবিধ লোকে (স্থানে) শরীরধারণ হয়ে থাকে।
যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি যজ্ঞাদিরহিত হলেও পঞ্চাগ্নিবিদের গতি প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ ব্রহ্মলোকে যান। মনুসংহিতা বলছেন, যাঁর ঘরে পঞ্চ অগ্নি আছে, তাঁকে পঞ্চাগ্নিবিদ বলে। ("ত্রিণাচিকেতঃ পঞ্চাগ্নিস্ত্রিসুপর্ণঃ ষড়ঙ্গবিৎ।" মনুসংহিতা, ৩/১৮৫) ছান্দোগ্যোপনিষদের মতে, স্বর্গ-পৃথিবী, পর্জন্য (গর্জনকারী ও জলবর্ষী মেঘ), "ধান, পুরুষ ও নারীকে যজ্ঞাগ্নি কল্পনা করে উপাসনা অথবা পঞ্চযজ্ঞ-ভাবনা হলো পঞ্চাগ্নিবিদ্যা এবং যিনি এটা করেন, তিনিই পঞ্চাগ্নিবিদ।" শ্রুতি বলছেন, "পঞ্চাগ্নয়ো যে চ ত্রিণাচিকেতাঃ।", অর্থাৎ চারিদিকে এবং ঊর্দ্ধদিকে স্থিত পঞ্চতেজস্বী বা পঞ্চাগ্নি বিদ্যাধ্যায়ীই হচ্ছেন পঞ্চাগ্নিবিদ। পঞ্চ অগ্নির সমাহার হচ্ছে— চারিদিকে প্রজ্জ্বলিত চারটি অগ্নি ও মাঝখানে সূর্যাগ্নি—পঞ্চতপ। এখানে প্রতীকী অগ্নি হলো ধ্যানের বস্তু এবং এই বিদ্যা মূলত আত্মার স্থানান্তরের মতবাদ।
রোগীর যেমন ডাক্তারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তেমনই মানুষ নিজের অসহায় অবস্থা জেনে যখন ভগবানের সামর্থ্যের ওপর আস্থাবান হয়, তখন তার সাথে ভগবানের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অর্থাৎ মানুষ যখন জাগতিক দুঃখে হতচকিত হয়ে সেই দুঃখ দূর করতে নিজের অসমর্থতা অনুভব করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে বিশ্বাস করে যে, ভগবানের কৃপায় তার সেই দুর্বলতা দূর হতে পারে, জাগতিক দুঃখ থেকে সে বেঁচে যেতে পারে, তখন সে শীঘ্রই ‘ভক্ত’ হয়ে ওঠে—"ক্ষিপ্ৰং ভবতি ধর্মাত্মা"। ক্ষুধার্ত মানুষ অন্ন পেলে কি আর খেতে দেরি করে?
মানুষ যতক্ষণ নিজের মধ্যে কোনো বল, যোগ্যতা, বিশিষ্টতা দেখতে পায়, ততক্ষণ সে ‘অনন্যভাক্’ অর্থাৎ 'আমি শুধু ভগবানের এবং ভগবান শুধু আমারই', এমন ভাববিশিষ্ট হয় না। সে তখনই ‘অনন্যভাক্’ হয়, যখন সে দেখে, অন্য কেউই তার দুঃখ দূর করতে সক্ষম নয়। ‘অনন্যভাক্’ হলেই সে ধর্মাত্মা অর্থাৎ ভগবানের ভক্ত হয়ে যায়।
ভক্তের কখনও পতন হয় না, কারণ সে ভগবদ্নিষ্ঠ হয়, অর্থাৎ তার সাধন ও সাধ্য ভগবানই হয়ে থাকেন, তার নিজের কোনো শক্তি থাকে না, ভগবানের বলই তার শক্তি হয়। এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, ভক্তের যদি পতন না হয়, তাহলে ভগবান অষ্টাদশ অধ্যায়ে অর্জুনকে ‘অথ চেৎ ত্বমহঙ্কারান্ ন শ্রোষ্যসি বিনঙ্ক্ষাসি' (১৮/৫৮) ‘তুমি যদি অহংকারবশত আমার কথা না শোনো, তাহলে তোমার পতন হবে'—একথা কেন বলছেন? কেননা ভগবান অর্জুনকে তাঁর ভক্ত বলে স্বীকার করেছেন—‘ভক্তোহসি মে সখা চেতি' (গীতা, ৪/৩)। ভক্তের পতন তখনই হওয়া সম্ভব, যখন সে ভগবানে শরণাগতি ত্যাগ করে অহংকারের আশ্রয় গ্রহণ করে—'অহঙ্কারান্ ন শ্রোষ্যসি”। ভগবানের আশ্রয়ে থাকলে তার কখনও পতন হয় না।
ভক্ত ভগবানের কাছে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর মতো, আর জ্ঞানী হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক বালকের মতো। মায়ের কাছে ছোটো-বড়ো সকল সন্তান সমান হলেও, মাকে ছোটো সন্তানকে যত দেখাশোনা করতে হয়, বড়োকে তত হয় না। ঠিক তেমনি ভগবান তাঁর আশ্রিত ভক্তকে সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করেন এবং নিজেই তার যোগক্ষেম (অলব্ধ বস্তুর লাভ ও লব্ধ বস্তুর রক্ষা) বহন করেন (গীতা, ৯/২২)। কিন্তু জ্ঞানীর যোগক্ষেম কে বহন করবে? তাই জ্ঞানের সাধক যোগভ্রষ্ট হলেও ভক্ত কখনও যোগভ্রষ্ট হন না। ব্রহ্মা এবং অন্যান্য দেবতা ভগবানকে বলেছেন:
যেহনোহরবিন্দাক্ষ বিমুক্তমানিনস্ত্বয্যস্তভাবাদবিশুদ্ধবুদ্ধয়ঃ। আরুহ্য কৃচ্ছ্রেণ পরং পদং ততঃ পতন্ত্যধোহনাদৃতযুষ্মদধ্ৰয়ঃ।। (শ্রীমদ্ভাগবত, ১০/২/৩২)
অর্থ: হে কমলনয়ন! যারা আপনার শ্রীচরণে আশ্রয় গ্রহণ করে না এবং আপনার ভক্তিবর্জিত হওয়ার কারণে যাদের বুদ্ধিও শুদ্ধ নয়, তারা নিজেদের যতই মুক্ত মনে করুক, আসলে তারা বদ্ধই হয়ে থাকে।
তথা ন তে মাধব তারকাঃ ক্বচিদ্ ভ্রশান্তি মার্গাত্ত্বয়ি বদ্ধসৌহৃদাঃ। ত্বয়াভিগুপ্তা বিচরন্তি নির্ভয়া বিনায়কানীকপমূর্ধসু প্রভো।। (শ্রীমদ্ভাগবত, ১০/২/৩৩)
অর্থ: কিন্তু ভগবান! যাঁরা আপনার ভক্ত, যাঁরা আপনার শ্রীচরণে সত্যিকারের প্রীতি উজাড় করে দিয়েছেন, তাঁরা কখনও জ্ঞানাভিমানীদের মতো নিজ সাধন থেকে বিচ্যুত হন না। আপনি এঁদের সুরক্ষা দেওয়ায় এঁরা বড়ো বড়ো বিঘ্ন প্রদানকারী সৈনিকদের সর্দারের মাথায় পা দিয়ে নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারেন, কোনো বিঘ্নই তাঁদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
ভগবানের স্তুতি করে শ্রীরামচরিতমানস জানাচ্ছেন—
জে জ্ঞান মান বিমত্ত তব ভব হরনি ভক্তি ন আদরী। তে পাই সুর দুর্লভ পদাদপি পরত হম দেখত হরী।। বিশ্বাস করি সব আস পরিহরি দাস তব জে হোই রহে। জপি নাম তব বিনু শ্রম তরহি ভব নাথ সো সমরামহে।। (উত্তরকাণ্ড, ১৩/৩)
অর্থ: জ্ঞানযোগের সাধকদের মধ্যে কিছু ন্যূনতা থাকলে তাদের পতন হতে পারে, কিন্তু ভক্তিযোগের সাধকদের মধ্যে কোনো কিছুর ন্যূনতা থাকলেও তাঁদের পতন হয় না।
তাই ভগবান বলেছেন—
বাধ্যমানোহপি মদ্ভক্তো বিষয়েরজিতেন্দ্রিয়ঃ। প্রায়ঃ প্রগল্ভয়া ভক্ত্যা বিষয়ৈর্নাভিভূয়তে।। (শ্রীমদ্ভাগবত, ১১/১৪/১৮)
অর্থ: হে উদ্ধব! আমার যে-সব ভক্ত এখনও জিতেন্দ্রিয় হতে পারেনি, ফলে সাংসারিক বিষয়ে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সেদিকেই আকৃষ্ট হয়, তা সত্ত্বেও তারা আমার প্রতি প্রতিমুহূর্তে বর্ধনশীল ভক্তির প্রভাবে প্রায়শই বিষয়াদির কাছে পরাজিত হয় না।
“ন বাসুদেবভক্তানামশুভং বিদ্যতে ক্বচিৎ।" (মহাভারত, অনুশাসনপর্ব, ১৪৯/১৩১), অর্থাৎ "ভগবদ্ভক্তের কোথাও কখনও অশুভ হতে পারে না।"
"সীম কি চাপি সকই কোউ তাসূ। বড় রখবার রমাপতি জাসূ।” (শ্রীরামচরিতমানস, বালকাণ্ড ১২৫/৪), অর্থাৎ "...কামদেবের সকল ছলাকলা দেবর্ষি নারদের উপর প্রভাব ফেলতে বিফল হল। এইবার পাপী কামদেবের মনে নিজ পাপাচারের জন্য ভীতি উৎপন্ন এল। রমাপতি শ্রীভগবানের শরণাগতকে স্পর্শ করা যে আদৌ সম্ভব হয় না!"
‘কৌন্তেয় প্রতিজানীহি’—ভগবান অর্জুনকে প্রতিজ্ঞা করতে বলছেন, কারণ ভক্তের প্রতিজ্ঞা ভগবানও এড়াতে পারেন না। ভক্তি হলো ভগবানের দুর্বলতা। তাই ভগবান দুর্বাসাকে বলেছেন—
অহং ভক্তপরাধীনো হাস্বতন্ত্র ইব দ্বিজ। সাধুভিগ্রস্তহৃদয়ো ভক্তের্ভক্তজনপ্ৰিয়ঃ।। (শ্রীমদ্ভাগবত, ৯/৪/৬৩)
অর্থ: হে দ্বিজ! আমি সর্বতোভাবে ভক্তের অধীন, স্বাধীন নই। ভক্তগণ আমার অত্যন্ত প্রিয়। আমার হৃদয়ের ওপর ওদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
‘কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি' —এই পদে উদ্ধৃত কথায় সাধকদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা উচিত যে, তাঁদের কখনও পতন হতে পারে না, কারণ তাঁরা ভগবানেরই। যে-হৃদয় স্বয়ং ভগবানের ঘর, তা আবার ভাঙে কী করে!