হাঁটুটা টনটন করে উঠল।
অনেক দিনের অভ্যেস। মন যখন খুব অস্থির হয়ে পড়ে, সেই সময় উন্মাদের মতন পায়চারি করতে থাকেন নবদ্বীপবাবু। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের মধ্যে কিংবা বারান্দায় পায়চারি করেন শুধু। তারপর হাঁটুদুটো যখন টনটন করে ওঠে, তখন খানিকক্ষণের জন্য একবার দাঁড়ান। টিফিন ক্যারিয়ারের মতো বিরাট পানের ডিবেটা খুলে দুটো পান মুখে একসাথে পুরে দেন। তারপর চিবোতে চিবোতে ইজি-চেয়ারটায় এলিয়ে দেন তাঁর বিশাল বপুটা। এ অভ্যেস তাঁর অনেক দিনের। পানপ্রীতি এবং বিশাল পানের ডিবে বহন করা এ পরিবারে বংশানুক্রমে চলে আসছে। যেখানেই যান, আর কিছু হোক না হোক, এই নিত্যসহচর পানের ডিবেটা সঙ্গে নিতে তাঁর ভুল হয় না কখনও।
হাসপাতালের বারান্দাতে পায়চারি করতে করতে নবদ্বীপবাবু রেলিংটার ধারে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। চোখের পুরু লেন্সের চশমাটা খুলে কাপড়ের খুঁট দিয়ে ভালো করে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করলেন। কপালের আর মুখের ঘামটা মুছে নিলেন ভালো করে। তারপর চোখের সামনে ধরে চশমার কাঁচটা আর-একবার ভালো করে পরীক্ষা করে সযত্নে নাকের ওপর সেঁটে দিলেন।
সামনের লনটায় দুটো লম্বা পামগাছ গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে। কবে থেকে কে জানে! একটা রঙিন পাখি ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে হলদে ফলগুলো। টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে দু-একটা। ওদের কোনো চিন্তা নেই। বেশ আছে। যত দুশ্চিন্তার বোঝা ভগবান এনে চাপিয়েছেন এই মানুষের ঘাড়ে, নবদ্বীপবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকেন। সংসারের বোঝাটা তাঁর ঘাড়ে এসে চেপেছে সেই কবে। আজও বয়ে চলেছেন তিনি। অনেক দিন আগে সিন্ধুবাদের একটা গল্প পড়েছিলেন। সেই যে বুড়োটা চাপল ঘাড়ে, আর নামতেই চায় না। অনেকেই জানে না, সিন্ধুবাদের সেই ভূতটা অজান্তে সব মানুষই সারাজীবন বয়ে বেড়াচ্ছে। নবদ্বীপবাবু মনে মনে হেসে ওঠেন।
ডিবেটা খুলে দুটো পান মুখে পুরে নবদ্বীপবাবু আবার সেটাকে পকেটে ভরলেন। মনে মনে আর-একবার হিসেব করবার চেষ্টা করলেন এই ভূতটা কবে এসে চেপেছিল তাঁর ঘাড়ে। হিসেব করতে চেষ্টা করলেন পঞ্চকন্যার জননী সুরবালা নতুন বন্ধু হয়ে কবে এসে প্রবেশ করেছিলেন এই বসু পরিবারে। বাইশ বছর? তেইশ বছর। না কি আরও বেশি? এরকমই একটা-কিছু হবে। তেইশ কি চব্বিশ। হ্যাঁ, তা তো হবেই। বড়ো মেয়ের বয়সই তো একুশ।
নবদ্বীপবাবুর কপালটা আবার ঘেমে উঠল। রাস্তাঘাটে এত ছেলে দেখা যায়, অথচ মেয়ে বিয়ে দেবার সময় একটাও পাত্র জোটে না। এর পরে এক, দুই, তিন করে আরও চারটে। কোঁচার খুঁটটা দিয়ে আর-একবার মুখটা মুছে নিলেন তিনি। কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গরম।
ঘড়িতে চেয়ে দেখলেন, চারটে বাজে। সুরবালাকে স্ট্রেচারে করে একটা বিশেষ ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রায় আধঘণ্টার ওপর। প্রত্যেকটি মূহূর্ত যেন এক-একটা ঘণ্টা বলে মনে হতে লাগল। আবার হয়তো ওদের লোক এসে খবর দিয়ে যাবে: খুকি হয়েছে।
অনর্থক অতি দ্রুত পায়চারি শুরু করলেন নবদ্বীপ বোস। তৃতীয় কন্যার পর থেকেই সুরবালার দেহে তাবিজ আর মাদুলি বাড়তে শুরু করেছে। ফল হয়নি। বিষণ্ণ তিনি হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে ভেঙে পড়েননি।
নবদ্বীপবাবু তাকিয়ে দেখলেন, হাসপাতালের গেইটটার কাছে কতগুলো ছেঁড়া কাগজ আর ধুলো নিয়ে খানিকটা হাওয়া ঘুরতে ঘুরতে বাইরে বেরিয়ে গেল। একটা বাচ্চাছেলে একটা ডাবের খোলায় লাথি মারতে মারতে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে। চারিদিকে একবার তাকিয়ে আবার উঠে পড়ল ধুলো ঝেড়ে। হাসপাতালের জমাদার হাতে একটা লম্বা বুরুশ দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করতে করতে কাকে যেন অশ্লীল গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে সমানে। আশ্চর্য! কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। যার যার কাজ নিয়ে সে সে ব্যস্ত।
অফিসের ক্যাশিয়ার মনীশবাবুই লক্ষ করেছিলেন ব্যাপারটা, কয়েক দিন ধরেই নবদ্বীপবাবুর মনটা কেমন যেন চঞ্চল। সব শুনে বেহালার গোলক ঠাকুরের কথা বলছিলেন তাকে। মনীশবাবুর বড়ো মেয়ের পর পর তিনটে পুত্রসন্তানের পর গোলক ঠাকুরের তাবিজের গুণে চতুর্থটি দিব্যি ফুটফুটে একটি মেয়ে হয়েছিল। এর কথা শুনে নবদ্বীপবাবু মনে মনে হেসেছিলেন। কারণ মনীশবাবু জানতেন, সুরবালার সর্বশেষ তাবিজ গোলক ঠাকুরেরই দেওয়া। ঠাকুর-দেবতার ওপর খুব একটা বিশ্বাস তাঁর ছিল, তা নয়। তবে চতুর্থ বারও যখন মেয়ে হলো, তখন থেকেই এ মন্দির সে মন্দির করে বেড়াচ্ছেন তিনি।
প্রতি বারই সুরবালা বিষণ্ন মনে কন্যাকোলে ফিরেছেন হাসপাতাল থেকে। আবার এসে নিঃশব্দে রান্নাঘরে ঢুকেছেন। নির্বিকার চিত্তে নবদ্বীপবাবু জোড়াপান মুখে পুরে দরজার ওপর কাঠের তাকে বসানো সিদ্ধিদাতা গণেশের উদ্দেশে ভক্তিভরে নমস্কার করে অফিসের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সংসারের কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। হায়েত খাঁ লেনের একটা ঝরঝরে চুনখসা বাড়ির সংসারে অনেক দিনের মুখস্থ-করা যেন একটা ফরমুলা চলছে—না বুঝেই মুখস্থ করা। কী যে এর মানে, কে জানে ছাই! মানে খুঁজতেও কোনোদিন যাননি তিনি। অঙ্ক তো মিলেই যাচ্ছে। বৈচিত্র্য তো কিছু নেই। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কিন্তু ওটাকে তিনি দুর্বলতা বলে মনে করেন না।
এবারে অবশ্য কত্তা গিন্নি দু-জনের মনেই একটা আশা দানা বেঁধে উঠেছিল প্রথম থেকেই। তাঁর হাতে নাকি লেখা আছে পঞ্চকন্যার পর পুত্রলাভ। দক্ষিণেশ্বরের কোন এক নামকরা সাধুকে মোটা টাকা প্রণামি দিয়ে হাত দেখিয়েছিলেন নবদ্বীপবাবু। তাঁর সব কথা শুনে সাধু আশ্বাস দিয়েছিলেন। ছোটোখাটো একটা যজ্ঞ করার বিধিও দিয়েছিলেন সাথে সাথে। গ্রহই নাকি সব করাচ্ছে। গ্রহশান্তির প্রয়োজন। জনাতিনেক ব্রাহ্মণভোজন করালে ফলটা আরও জোরালো হবার সম্ভাবনা।
বলা বাহুল্য, নবদ্বীপবাবু গ্রহশান্তির জন্য আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেননি। কী-একটা প্রবল আকর্ষণে আবার গিয়ে হাজির হয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে, কিন্তু সেই সাধুর দেখা আর পাননি তিনি। কোনো তীর্থে হয়তো গিয়ে থাকবেন। মনের কোণে থাকা একটা সন্দেহের হাত থেকে তিনি বার বার মুক্ত হতে চেয়েছিলেন সেদিন।
মনে মনে অঙ্কটা সেদিন যেন জোর করে মিলিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এতটা মাথা ঘামানো ঠিক নয়। লজ্জিত বোধ করেন নবদ্বীপ বোস।
নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই পৃথিবী কতটুকু! সেই পৃথিবীর ছোট্ট একটা অংশ হায়েত খাঁ লেইন। তারই একটি ঘরের বাসিন্দা তিনি! ধরতে গেলে কিছুই নয়। মহাকাশে কোটি কোটি আলোকবর্ষব্যাপী ছড়িয়ে আছে কত-শত সৌরমণ্ডল। কোটি কোটি সূর্যের সমান সব বিরাট বিরাট নক্ষত্র। আর কোথায় নবদ্বীপ বোস! হাসি পায় তাঁর।
ছ-জন নার্স হনহন করে তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল। ওরা বোধ হয় বিশাল সৌরজগতের কোনো খবর রাখে না। সবাই কী ভীষণ ব্যস্ত! ওরা জানে না, ওদের কামনা-বাসনা কত ক্ষুদ্র। এদের জন্য মায়া হয় তাঁর। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বিরাট পানের ডিবেটা খুলে আবার দুটো পান মুখে দিলেন তিনি।
এখন ভিজিটিং-আওয়ার। সবাই ফলমূল নিয়ে যাচ্ছে আপনজনের কাছে। মনে মনে এদের মিলন দৃশ্যগুলো আঁকতে চেষ্টা করেন নবদ্বীপবাবু। এসব দৃশ্য তাঁর চেনা। অনেক বার এসেছেন এখানে। এখানেও সেই একটি নির্দিষ্ট ফরমুলা। একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক। এদের জন্য মায়া হয় তাঁর। বিশ্বসংসারের সকলের জন্যই আজ ভীষণ মায়া হচ্ছে তাঁর। সবাই কত ক্ষুদ্র।
সলজ্জ এক বধূ ফুটফুটে একটি বাচ্চা কোলে নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে। পাশে তার তরুণ স্বামী। প্রথম সন্তান বোধ হয়। অনেক আগের ঠিক এরকম একটা ছবিই তাঁর মনে পড়ে গেল। সুরবালার সেই সলজ্জ হাসিটি আজও যেন তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ে। এরপর আরও তো কত বার এলেন। কিন্তু সেই প্রথম বারের অনুভূতিটা আর পেলেন না। তবে এবার যেন কেমন একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছেন। ছেলে এবার হতেই হবে। সবাই তো বলছে তা-ই। হাতের রেখায় তো স্পষ্ট লেখা আছে। নাটাগড়ের সেই সাধুর মাদুলি তো একেবারে অব্যর্থ।
বুড়ি পিসির কথা ধরতে নেই। ফস করে বলে দিলেই হলো…এবারও তোর খুকুই হবে, নবু! নবদ্বীপবাবু বিরক্তবোধ করেননি। অশিক্ষিত সেকেলে মানুষ। ওদের কথা ধরতে নেই। কিন্তু অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকেন নবদ্বীপবাবু। এবার তিনি পায়চারি বন্ধ করলেন। সুরবালা বোধ হয় এতক্ষণে তাঁর পুত্রের দিকেই তাকিয়ে আছে। তার সমস্ত ব্যথাবেদনা বোধ হয় ভুলে গেছে। তাঁদের প্রথম পুত্রসন্তান। কতদিনের কত আশাআকাঙ্ক্ষার ধন! ছেলের জন্য একটা ইনশিওরেন্স করানো দরকার। অফিসের সুবোধবাবুকে দিয়েই করাবেন। তিনি অনেক দিন থেকে কাজটা করছেন।
নিজের চাকরি আছে আরও প্রায় দশ বছর। এর মধ্যেই ব্যবস্থা কিছু-একটা করে ফেলতে হবে। আশেপাশের এসব আজেবাজে স্কুলে ছেলেকে দিয়ে লাভ নেই। ছেলে তো আর পরের হাতে তুলে দেবার নয় যে, কোনোরকমে ম্যাট্রিকটা পাশ করলেই হলো। ভালো শিক্ষক ভালো পরিবেশ না পেলে সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ে উঠতে পারে না। যা কমপিটিশনের বাজার! ভালো একটা কোয়ালিফিকেশন না থাকলে কোথাও দাঁড়ানো যায় না আজকাল।
হঠাৎ দুটো কাক ঝগড়া করতে করতে নবদ্বীপবাবুর কাছেই উঠোনে এসে জড়াজড়ি করে ধপাস করে পড়ল। অত্যন্ত বিরক্তবোধ করলেন তিনি। নিশ্চিন্ত মনে একটা সৎচিন্তাও করা যাবে না। কিন্তু বুড়ি পিসিই-বা ও কথা বললেন কেন হঠাৎ? তাঁর মনটা ক্রমেই বিষাদে ভরে গেল। সব মিথ্যে? সবাই তাকে প্রতারণা করছে? সুরবালাও? কিন্তু তা কী করে হয়! কেমন একটা অবিশ্বাসের ভূত যেন তাঁর গলা চেপে ধরেছে দু-হাত দিয়ে। আশ্চর্য! এত নিচু এরা! এত নিচু এদের মন! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর বোধ হয় এরা কেউই রাখে না।
আবার তাঁর মনে পড়ল, দেয়াল থেকে চুন খসে খসে পড়ছে। কার্বন পেপারের মতো কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি। হায়েত খাঁ লেনের আট-বাই-দশ ছোট্ট একখানা ঘর। দুটো ইট দিয়ে উঁচু-করা এটা বহু পুরোনো তক্তপোশ। ওটার নিচে সংসারের যাবতীয় সম্পত্তি ঠেসে ঠেসে ঢোকানো। ঘরটার কোণে কোণে ঝুল পড়েছে। দখিনের জানালা খুললেই বিশাল একটা দেয়ালে চোখ আটকে যায়, যার নিচে পচা ডিমের আড়ত। এগুলোও নাকি সস্তাদরে বিক্রি হয় হোটেলের জন্য। ডিমের পচা গন্ধটা এখন সকলেরই নাকে সহ্য হয়ে গেছে। বারান্দার একটা ধারে উনোন জ্বলে। হায়েত খাঁ লেনের আনাচে কানাচে উনোনের কুণ্ডলি-পাকানো ধোঁয়াগুলো খেলে বেড়ায়।
এখন আবার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কথা মনে হলো নবদ্বীপ বোসের। তিনি যেন দিব্যচোখে দেখে নিলেন, সুরবালা আরও একটা কন্যাসন্তান পাশে নিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। লালপেড়ে সস্তা শাড়িটা হাঁটুর ওপরে উঠে আছে। মুখটা হাঁ হয়ে আছে, আর নাক দিয়ে একটা বিচ্ছিরি আওয়াজ বেরোচ্ছে। নিচে কলতলায় ঝি বাসন মাজছে আর বকবক করে চলেছে সমানে। পাশের বাড়ির ছেলেটা গলা ফাটিয়ে পড়তে শুরু করেছে। নবদ্বীপবাবুর শরীরটা কেমন গুলিয়ে উঠল।
আর ভাবতে ভালো লাগল না। সেই পুরোনো একটা অঙ্ক। বছরের পর বছর ফেইল করে একই পড়া মুখস্থ করে যাওয়া, একবর্ণও না বুঝে।
একমুখ পানের পিক ফেলে আবার এসে দাঁড়ালেন তিনি বারান্দার রেলিংটার ধারে। নাঃ! আর অপেক্ষা করা যায় না। অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। কেমন একটা অজানা আশঙ্কায় তাঁর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সুরবালার কিছু হলো না তো আবার? একটা আয়া আসছে এদিকটায়। তাকেই জিজ্ঞেস করা যাক।
- ষোলো নম্বর বেডের কী খবর?
- ও তো ভালোই আছে। বেডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
- কী হয়েছে? খোকা, না খুকি?
- তা তো বলতে পারব না।
- আমায় একটা খবর এনে দাও না!
নবদ্বীপবাবুর কণ্ঠে কাতরতা ফুটে ওঠে।
- আমার আবার এদিকে কাজ রয়েছে যে!
নবদ্বীপবাবু আয়ার হাতে এক-শো টাকা গুঁজে দেন। খুশিমনেই সে প্যাসেজটা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নবদ্বীপবাবুর বুকের স্পন্দনটা যেন হঠাৎ থেমে গিয়ে দ্বিগুণ গতিতে চলতে শুরু করল।
ভিজিটররা এখনও সব ভিড় করে রয়েছে এদিক-ওদিক। ঘর্ঘর করে ভাঙাচোরা ট্রাক গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। উঃ! কী বিচ্ছিরি শব্দ। আয়াটা আসছে না কেন এখনও! সেই কখন গেছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন, নাঃ! মাত্র মিনিটখানেক হলো গেছে। সময়টা যেন গোঁয়ার বলদের মতো মুখ বেঁকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না এক পা-ও। একটু এগিয়ে দেখবেন নাকি? থাক। কেমন যেন একটা সঙ্কোচবোধ হচ্ছে।
হাসপাতালের সমস্ত লোক যেন হাঁ করে আছে তাঁর দিকে। আশ্চর্য! এমন অসভ্যের মতো তাকিয়ে থাকবার কী হয়েছে? কী জানি তাঁর আচরণে কোনোরকম অসংগতি প্রকাশ পাচ্ছে না তো! নিজেকে আর-একটু সংযত করলেন নবদ্বীপ বোস। কিন্তু আয়াটার হলো কী?
একজন হাউস সার্জনের সাথে একটি নার্স হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। সমস্ত শরীর যেন একেবারে জ্বলে উঠল। অসহ্য! তাঁকেই যেন সবাই ঠাট্টা করছে। ওই তো সেই আয়াটা না? নাঃ! অন্যকেউ। না, না, সে-ই তো! কী খবর নিয়ে আসছে কে জানে! উত্তেজনায় তাঁর পা-টা যেন কাঁপছে। তাঁর মনে হচ্ছে এক্ষুনি তাঁর বিচারক রায় দেবেন। হয় শাস্তি, নয় মুক্তি। পরীক্ষার রেজাল্ট জানানো হবে এক্ষুনি। হয় পাশ, নয় ফেইল। কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। তাঁর সমস্ত চিন্তা কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
ভিজিটররা সব নিশ্চিন্ত মনে ঘোরাফেরা করছে। কারও মনেই কোনো অশান্তি নেই। শুধু হায়েত খাঁ লেনের কোনো এক নবদ্বীপ বোসের মনের রাজ্যে বিরাট অরাজকতা চলছে। মুখস্থ-করা অঙ্কটা অসংবদ্ধ প্রলাপের মতো ভীষণ জট পাকিয়ে গেছে। আয়াটা যেন বহুযোজন দূর থেকে আসছে দুলকি চালে। সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হবে। সিনেমার স্লো-মোশনের মতো পক্ষীরাজ ঘোড়া যেন হালকা মেঘের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে। পিঠে তার কার্ত্তিকের মতো এক রাজপুত্র। সূর্যের রশ্মি এসে ঠিকরে পড়ছে রাজপুত্রের মুকুটচূড়ায়। আর তা থেকে সাতটি রং বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছে দিগ্দিগন্তে। ঘোড়া-সমেত সেই রাজপুত্র এসে বিরাট আকার ধারণ করে এগিয়ে আসছে হায়েত খাঁ লেনের ঘুণে-ধরা ছোট্ট অন্ধকার ঘরটায়। কিন্তু ওতে তো ধরবে না এত বড়ো একটা বিশাল চলন্ত মূর্তি।
চুনখসা, লোনা-ধরা দেয়াল ঝপ ঝপ করে ধ্বসে পড়ছে। ঘরের কড়ি বরগা বিরাট বিরাট চাঙড় নিয়ে খসে পড়ল মেঝেতে। নবদ্বীপবাবুর সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে উঠল। কপালের পাশের শিরাদুটো দপ দপ করতে থাকে। চারদিক হঠাৎ কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। নবদ্বীপবাবু কাঁপতে কাঁপতে অবসন্ন হয়ে বসে পড়লেন হাসপাতালের বারান্দায়।