একটা ‘না’র গল্প

সালটা ২০০৮ হওয়ার কথা। সে সময়, সৌভাগ্যক্রমে, আমাকে কেউ অতোটা চেনে না। আমি তখন ফেসবুকে শুধুই ইংরেজিতে লিখি। লিখতাম এখনকার চাইতে ঢের বেশি। বন্ধুদের কমেন্টের রিপ্লাই করতে পারতাম। রিপ্লাইয়ে বিশাল-বিশাল কমেন্ট লিখতাম। সে সময় আমি আমার বন্ধুতালিকায় দুএকজন ছাড়া আর তেমন কোন বাংলাদেশিকে পাইনি, যারা ভাল ইংরেজিতে লিখতে পারেন, আমার ওয়ালে কমেন্ট করার যোগ্যতা রাখেন। আমার লেখার স্টাইল যে রকমটা ছিল, তার ধারেকাছেও ইংরেজি আমি এখন আর লিখতে পারি না। মজার ব্যাপার হল, সে সময় আমি কবিতা লেখার সময় ইংরেজিতে ভাবতেও পারতাম! এখনও পাঠক হিসেবে পড়লে নিজের লেখা নিজের কাছেই অপরিচিত লাগে। মনে হতে থাকে, এ আমি নই, অন্য কেউ! সেই সময়ের লেখকসত্ত্বাকে আমি আর কোনদিনও খুঁজে পাইনি। এটা আমার অনেক বড় দুঃখ। সে সময় আমি স্বপ্ন দেখতাম অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতী রায়, বিক্রম শেঠ, চেতন ভাগত, সালমান রাশদীদের মতো আমিও ইংরেজিতেই লিখব। শুধু স্বপ্নই দেখতাম না, মনে-মনে প্রচণ্ড বিশ্বাসও করতাম। এই মুহূর্তে আমাকে যদি আমার খুব প্রিয় কিছু একটা দিয়ে দিতে বলে কেউ, তবুও আমি সেই লেখার স্টাইলটা ফিরে পেতে সে বিনিময় করতে রাজি আছি। সেই লেখকের মৃত্যু এখনও আমাকে ব্যথিত করে। তবে মাঝেমাঝে মনে হয়, ব্যাপারটা মৃত্যু না হয়ে জন্মান্তরও হতে পারে।

সে সময়ে আমার সাথে খুব বেশি লোকজন যোগাযোগ রাখত না এবং আমাকেও খুব বেশি মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতে হত না বলে আমি এমন কিছু মানুষকে পেয়েছিলাম, যারা আমার জন্য অনেক দামি ছিলেন এবং আমিও যাদের কাছে মোটামুটি দামি ছিলাম। সবার সাথেই যোগাযোগ রাখতে হবে, আমি বরাবরই এই মতের বিরুদ্ধে। আমি এই পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি ভালোবাসতাম যে দুটো ব্যাপার, সেগুলি হল : বইপড়া এবং ফেসবুকে লেখালেখি। এর বাইরের জগতটাকে চিনেছি, খুব বেশিদিন হয়নি। একটা উদাহরণ দিই। মেয়েদের দিকে তাকানো, ওদের সাথে মেশা আর কথা বলার আর্টটা শিখেছি খুব বেশি হলে সাড়ে চার বছর হবে। এর আগে বরাবরই আমি প্রচণ্ড রকমের shy আর introvert ছিলাম, মেয়েদের ভীষণ ভয় পেতাম। আমাকে কেউই কোনদিনও সে সময় কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে কিংবা হাঁটতে দেখেনি। ফোনেও মোটামুটি দুর্ব্যবহার করতাম। মেয়েদেরকে পাত্তা না দেয়াটাকে মনে হত, পৃথিবীর সবচাইতে বীরোচিত কাজ! দেখাতাম, পাত্তা দিই না; আসলে, ভয় পেতাম।

রোন্ডা ব্যর্নের Like attracts like থিওরিতে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমার মতোই যারা, এমন কিছু মানুষ আমার লেখা দেখেই আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। সেখানে দিল্লি, মাদ্রাজ, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাই-প্রোফাইল শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের এমন সব উঁচু শ্রেণীর মানুষজন ছিলেন, যাদের সাথে আমার সখ্যতার কথা আমি ভাবতেও পারি না। আমি সে সময় উনাদের ওয়ালে গিয়ে অনেক উপরের স্তরের কঠিন-কঠিন সব বিষয় নিয়ে কমেন্ট করতাম আর উনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য অনেক পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়ে সে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতাম, হেরে যাব জেনেও তর্ক করতাম। বড় মানুষের সাথে লড়াই করে হেরে যাওয়াতেও আনন্দ, ওতে অনেক কিছুই শেখা যায়। উনারা যে পর্যায়ের মানুষ ছিলেন, সে পর্যায় থেকে উনারা আমার কমেন্ট খেয়ালও করে দেখবেন না, এটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ সত্যিই আমাকে কখনওই তেমন কোন অবহেলা সহ্য করতে হয়নি, কিংবা আমি নিজেকে কোন অবহেলা সহ্য করতে দিইনি। কিন্তু এমনও হত, প্রথম-প্রথম কমেন্ট লেখার সময় আমার হাত কাঁপত। ভদ্রলোকের নামটা বলছি না, সেই সময়কার ইন্ডিয়ান পুলিশের চিফ যদি আমার ওয়ালে লিখতেন এবং উনার সাথে রিলিজিয়ন নিয়ে আরও কিছু সম পর্যায়ের মানুষ সহ মিলে তর্কে উনি আমার যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করতেন, আমার জন্য সেটা ছিল অনেকটা, সিংহ-সিংহ যুদ্ধ করছে, সেখানে গিয়ে ইঁদুরের সিংহের কেশর ধরে ঝুলে পড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়ার মতো। মজার ব্যাপার হল, আমার লেখা আর চিন্তার ধরন দেখে উনাদের অনেকেই আমাকে খুব বয়স্ক কেউ ভাবতেন। আমি যে একজন নগণ্য যুবক ছিলাম, সে কথা কারও মাথাতেও আসত না। আমিও সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ওদের ওয়ালে গিয়ে পাকামো করতাম। উনারাও নিয়মিত আমার ওয়ালে আসতেন কমেন্ট করতে। আমি সে সময়েও খুব সরাসরি অকপটভাবে কথা বলতে পারতাম। ইন্ডিয়ান আর্মির চিফ সিভিল সার্জন আমার লেখা একটা কবিতা উনার নিজের ব্লগে নিজের নামে পাবলিশ করায় উনাকে চরম অপমান করেছিলাম। কাউকেও তেলিয়ে কোনও কথা কখনওই বলেছি বলে মনে পড়ে না। তাই উনাদের সবার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিখ্যাত প্রফেসর আমাকে ডাকতেন Mr Angry Youngman বলে। উনার লেখা অনেক বই দেশ-বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। এসব দেখেটেখে খুব মজা পেতাম। তবে খুব বিনীতভাবেই বলছি, লেখালেখি বলতে যা বোঝায়, সেই দিক বিবেচনায় আমার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো লোক উনাদের মধ্যে খুব বেশি ছিল বলে মনে পড়ছে না। হ্যাঁ, কিছু অবাঙালি ভারতীয় লেখক এবং সাহিত্যের অধ্যাপকের সাথে গল্প হত। উনারা বেশ ভাল লিখতেন।

আমি কিন্তু সেই নোবডি থাকার সময়ও খুব আনফ্রেন্ড করে দিতাম। (ওইসময়ে ব্লক করা যেত কি না, মনে নেই।) ভারতের কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, এমন একজন লেখককে আমার লিস্ট থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম উনি আমাকে ছোট করে একটা কমেন্ট করেছিলেন বলে। আইআইএম’এর একজন প্রফেসর একবার কী একটা কারণে রাগ করে আমাকে বলেছিলেন, “তোমার শিক্ষকদের শিক্ষকরাও আমার আন্ডারে পিএইচডি করে। তুমি আমার কাছে এস, তোমার অনেক কিছু শেখার আছে এখনও।” আমি বলেছিলাম, “স্যার, সেটা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমাকে পিএইচডি করানোর পারমিশন তো আমি আপনাকে দিইনি।” সেকথায় উনি আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর স্ত্রী এক বিখ্যাত বাঙালি লেখিকা আমাকে বলেছিলেন, “তুমি চাইলে আমার লেখার অনুবাদ করার কাজটা নিতে পার। আমি ভাল সম্মানী দিতে রাজি আছি।” আমি বলেছিলাম, “অনুবাদ যদি করিই, আরও ভাল লেখা বিনে পয়সায় অনুবাদ করব।” হিন্দুস্তান ইউনিলিভার কোম্পানির তৎকালীন সিইও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী বল! তুমি আমাকে চিনই না? পুরো ভারত আমাকে চেনে!” আমি বলেছিলাম, “স্যার, আপনাকে চিনতেই হবে কেন? আমি তো এখনও আমার নিজের দেশের ৫% বড় ব্যবসায়ীকেও চিনি না। এতে তো আমার কোন সমস্যা হয়নি এখনও!” দুবাই টেলিকমের মেকানিক্যাল সাইডের তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমাকে বলেছিলেন, “সুশান্ত, আমি চাইলেই তোমার জন্য আমার কোম্পানিতে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।” আমি বিনীতভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, “না স্যার, পারেন না। কারণ, সাথে আমাকেও তো চাইতে হবে।” আমার হিসেব ছিল সহজ। আমি যা পারি, তা ভালভাবেই পারি। ওটাই আমার অ্যাসেট। ওটা দিয়েই আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করব। যার কাছ থেকে আমার কোনও কিছুই চাওয়াপাওয়ার নেই, তার অনর্থক অহমিকা সহ্য করব কেন? হতে পারে, উনি অনেক বড় মানুষ। এতে আমার কী? আমি কিছুতেই অন্য কাউকে আমাকে অসম্মান করতে দেবো না। নিজেকে সম্মান করতে জানাটাই সবচাইতে বড় কথা। উনি উনার জায়গায় বড়, আমি আমার জায়গায় বড়। হোক আমার জায়গাটা ছোট, তবুও সেই ছোট জায়গাটাতে তো আমিই বড়! আমার ছোট জায়গা আমার কাছে অনেক বড়! সে জায়গাটাকে যে সম্মান করতে জানবে না, আমার জীবনে তাকে আমার দরকারও নাই। আমি তো আর কারও কাছে হাত পাততে যাইনি, তবে কেন কারও বড় কথা সহ্য করব? আমি কারও খাইও না, পরিও না। অতএব, আমি কাউকেই আমাকে অপমান করার অনুমতি দেবো না। এরকম করে ভাবতাম।

আমি বন্ধু হারানোর বিরল প্রতিভাসম্পন্ন একজন মানুষ। আমি সাধারণত কারও সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে পারি না। সত্যিই ভুলে যাই। কাউকে নিজ থেকে অতো ফোনটোন দিই না। কেউ হারিয়ে গেলেও মনে থাকে কম। কেউ বড় অবস্থানের মানুষ বলেই তার সাথে ভাল যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে, আমার মধ্যে এরকম কিছু নেই। এটা আমার খুব খুব বাজে দিকগুলির একটা। যারা আমার সাথে থাকেন, থেকে যান, তারা সাধারণত নিজগুণেই থাকেন, থেকে যান। তাদের এই মহানুভবতার জন্য আমি তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। তবে কিছু-কিছু মানুষকে ভুলতে পারিনি, পারবও না। ওরা যদি অনেক দুঃখও দেয় আমাকে, প্রচণ্ড অবহেলাও করে, তবুও ওদেরকে আজীবন নতমস্তকে সম্মান করে যাব, ওদের জন্য প্রার্থনা করে যাব। ওদের জন্যই আমার আজকের সব কিছু। এমন একজন মানুষের কথা বলছি।

সে সময় হাতেগোনা দুএকজন মানুষের সাথে ইনবক্সে নিয়মিত চ্যাটিং করতাম। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সুদেষ্ণা দিদি। উনি ছিলেন শিখ সম্প্রদায়ের। উনার বাবার মৃত্যুর পর উনারা পারিবারিক কারণে আমেরিকায় পাড়ি জমান। যার সাথে উনার প্রেম ছিল, দেশান্তরী হওয়ার কারণে তার সাথে উনার বিয়ে হয়নি। আমেরিকা থেকে উনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাস করেন এবং দুইবার চাকরি বদলানোর পর ডিজনিতে চাকরি নেন। সে চাকরিতে ২০০৪ সালে উনার বাৎসরিক বেতন ছিল বাংলাদেশি টাকায় ২ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা। উনার বিয়ে হয়েছিল আমেরিকা প্রবাসী একজন ইন্ডিয়ান সফটওয়্যার ব্যবসায়ীর সাথে। সে ভদ্রলোকের কোম্পানির নামটা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে এটা মনে আছে, উনার কোম্পানিটা ছিল আমেরিকার শীর্ষ ১০টি সফটওয়্যার কোম্পানির একটি। সে সময় আমি নিজের অসহায়ত্ব এবং বাজে অবস্থার কথা একেবারে মন খুলে বলেছিলাম যে ৩ জন অপরিচিতকে, উনি তাদের একজন। আমি উনাকে কখনওই দেখিনি, তবে উনার সাথে সবসময়ই ইনবক্সে আলাপ হত, কখনও-কখনও উনি ফোন করতেন, কিন্তু খুব দ্রুত ইংরেজিতে কথা বলার কারণে উনার কথা খুব বেশি বুঝতে পারতাম না। বাবা, মা আর আমার ছোটভাইয়ের বাইরে শুধু এই একজন মানুষকেই মনের সব কথা বলে অনেক শান্তি পেতাম। উনি আমাকে সবসময়ই বলতেন, “বাপ্পি, তুমি নিজেকে যতটুকু ভাব, তুমি তার চাইতেও বেশি কিছু করতে পারবে, যদি তুমি তোমার ভাবনার বলয়টাকে একটু বাড়াতে পার। আমি অনেক মানুষের সাথে মিশেছি, অনেক দেশে ঘুরেছি। আমি অন্তত তোমার চাইতে একটু হলেও বেশি পৃথিবীটাকে দেখার কারণে, এটা বুঝতে পারছি, তোমার সামনের দিনগুলি তুমি যতটা ভাবছ, তার চাইতেও অনেক সুন্দর হবে। তুমি কোথায় যাবে, এর কিছুই তুমি এখনও জানো না।” সুদেষ্ণা দিদির প্রত্যেকটা কথাকেই আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। উনি যদি বলতেন, আগুনে ঝাঁপ দাও, আমি হয়তো তা-ই করতাম, কারণ আমি বিশ্বাস করে নিতাম, নিশ্চয়ই ওতে ভাল কিছুই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে উনার মতো ভালমানুষ খুব বেশি দেখিনি। উনার জীবনদর্শন আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমি সারাদিনই উনার কথা ভাবতাম; শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে, ভালোবাসায়। উনার লাইফস্টাইল ছিল আমার দেখা সবচাইতে গর্জিয়াস লাইফস্টাইলগুলির অন্যতম। উনি আমাকে দ্য সিক্রেট বইটা পড়তে বলেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশে আমি বইটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন উনি আমাকে বললেন, আমেরিকা থেকে বইটা আমার জন্য পার্সেলে পাঠিয়ে দেবেন। আমি গিফট নিতে পছন্দ করতাম না। পাছে উনি সত্যি সত্যিই পাঠিয়ে দেন, সে ভয়ে ঢাকার নিউমার্কেটের বুক ওয়েবের মাধ্যমে বইটা বাইরে থেকে আনিয়ে নিই এবং উনাকে জানাই, “দিদি, পেয়ে গেছি। আর লাগবে না।” উনার সাথে ইনবক্সে আমার যে কথাগুলি হত, সেখানে দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য, ভ্রমণ, সভ্যতা, সংস্কৃতি সহ বিচিত্র সব বিষয় ছিল। সেসব কনভারসেশনের তেমন কিছুই ফেসবুক চ্যাটহিস্ট্রিতে আমি পরবর্তীতে খুঁজে পাইনি। খুবই সামান্য কিছু পেয়েছি, সেগুলিকে আমি Conversations with My Idol নামে নোট আকারে রেখে দিয়েছি। তবে আমাদের প্রথম দিককার কথোপকথনগুলিই ছিল সেরা। সেগুলি পেলে নিজেকে আরও একবার আলোকিত করে নিতে পারতাম।

আমাকে সবচাইতে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে উনার সাজেস্ট-করা বেশ কিছু বই আর উনার নিজের জীবনদর্শন। দিদিকে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, উনার টিচিংস নিয়ে ভাবতাম, আর উনি যা যা করতে বলতেন, তা-ই তা-ই করতাম। উনার সাথে যতক্ষণই কথা বলতাম, ততক্ষণই নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে হত। এটা বিশ্বাস করতাম, আমি চেষ্টা করলে পৃথিবীতে আমার পক্ষে যতদূর পাড়ি দেয়া সম্ভব, ততদূরই পাড়ি দিতে পারব। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর জিনিসগুলি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যেহেতু সেগুলির দেখা আমি কোনদিনই এখনও পর্যন্ত পাইনি, সেহেতু সেগুলির দেখা পেতে চাইলে আমাকে আমার অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সরে আসতে হবে। আমি এতদিন ধরে যা করে এসেছি, তা-ই করে গেলে, আমি এতদিন যেমন ছিলাম, তেমনই থেকে যাব, এটা মনে হয়েছিল। আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গির ধরন বদলানোর জন্য যে কয়েকজন মানুষের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব, উনি তাদের একজন।

সে সময় উনার কোলে আসে উনার প্রথম সন্তান : নীল। সন্তানের জন্মের কিছুদিন পরেই সন্তান মানুষ করার জন্য উনি উনার চাকরিটা ছেড়ে দেন। আমি সত্যিই খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম উনার সিদ্ধান্তে। ওরকম একটা চাকরিও যে কেউ ছাড়ার কথা ভাবতেও পারে, সেটাই আমার মাথায় কোনও দিন আসেনি। উনি আমাকে আমার লেখা আর চিন্তার জন্য খুব সম্মান করতেন, গুরুত্ব দিতেন। চাকরিটা ছাড়ার আগে উনি আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। আমি উনাকে চাকরি ছাড়তে নিষেধ করলে উনি আমাকে বলেছিলেন, “জীবনে বড় কিছু পাওয়ার জন্য ছোট কিছুর মায়া ছাড়তে হয়।” এই কথাটিই আমার মা আমাকে প্রায় বলতেন। তখন বুঝেছিলাম, পৃথিবীর দুইটি ভিন্ন প্রান্তে বাস করলেও মানসিকতায় মিল থাকলে দুইটি মানুষের অনেক কথাও মিলে যায়। জীবনদর্শনের দীক্ষার গভীরতায় প্রবেশ করতে কেতাবি শিক্ষার অতো গভীরতা না থাকলেও চলে। আমি সে সময় বুঝেছিলাম, পৃথিবীর সবচাইতে সেরা উপহারগুলি পেতে চাইলে সবার আগে অর্থের লোভ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনতে হবে। যার মধ্যে অর্থের লোভ যত কম, সে তত বেশি নিঃশঙ্ক আর ধনী। টাকার মোহ থেকে একবার নিজেকে মুক্ত করে ফেলতে পারলে, আর কারও কাছেই তেমন একটা মাথা নত করে চলতে হয় না। দিদি আমাকে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উনার অনেক ফ্রেন্ড পড়াতেন। উনার পক্ষে আমাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ ম্যানেজ করে দেয়াটা কঠিন ছিল না। উনি সে চেষ্টাও করে যাচ্ছিলেন আর আমাকে দ্রুত অনার্স কমপ্লিট করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। উনি আমাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানের ছবি ফেসবুকে আপলোড করার পর আমি সেখানে কমেন্ট করলে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতেন এই বলে, “এ আমার আদরের ছোটভাই বাপ্পি।” উনার অনেক ফ্রেন্ডের সাথেও আমার নিয়মিত ফেসবুকে যোগাযোগ হত। সেখানে মুম্বাইয়ের নামকরা এক ফিল্ম প্রডিউসার ছিলেন (উনি সুদেষ্ণা দিদির এক্স-বয়ফ্রেন্ডের বড় ভাই) যিনি আমাকে একাধিকবার ইন্ডিয়ান ফিল্মে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার সকল দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। আমি বারবারই সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা নিয়ে দিদি আর দিদির বান্ধবীরা খুব হাসাহাসি করতেন। ওরা বলতেন, “বেচারা ভাবছে, রূপের ঠ্যালায় গুণ পালিয়ে যাবে! নায়িকারা যদি আমার আমাদের হিরোকে গুমটুম করে ফেলে! আর তাছাড়া নায়কের মাথায় অতো বুদ্ধি থাকলে নায়িকাকে চুমু খাবে কীভাবে? হাহাহাহা………” আমি ভাবতাম, ফিল্মে গেলে আমি যা চাইছি, তা হবে না। তার চাইতেও বড় কথা, আমি আমার নিজের চেষ্টায় বড় হবো। কিছুতেই কারও হাত ধরে আমি উঠবো না। আমি বড় হতে চাই, কিন্তু সেটা কারও করুণা নিয়ে নয়। প্রয়োজনে এখন যে ব্যবসাগুলি করছি, সেগুলি নিয়েই থাকব।

সুদেষ্ণা দিদির সাথে নানান বিষয় নিয়ে কথা চলতে লাগল। উনি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন, আমার প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনতেন। আমি আমার জীবনের অদ্ভুত সব মোড়বদলের গল্প করতাম উনার সাথে। জীবন নিয়ে আমার ছেলেমানুষি ভাবনাগুলি শেয়ার করতাম। উনার জীবনের এমনকিছু ছিল না, যেটা আমি জানতাম না। আমি নিজেকে নিয়ে কী ভাবতাম, চারপাশের পৃথিবীটাকে কীভাবে দেখতাম, তার সবকিছুই উনি জানতেন। এমন কথাও উনার সাথে শেয়ার করতাম, যে কথাগুলির মুখোমুখি দাঁড়াতে আমি নিজেই সাহস পেতাম না। এর কিছুদিন পর একদিন সুদেষ্ণা দিদি বললেন, “আচ্ছা, তুই তো আমেরিকায় এমনিতেই আসবি হাইয়ার স্টাডিজের জন্য, নাকি?” “হ্যাঁ, দিদি।” “আচ্ছা, একটা কাজ কর না! তোর দাদাবাবু আজকে সকালে বলছিল, ওর নিউইয়র্কের যে অফিসটা আছে, সেটাতে একজন ইঞ্জিনিয়ার নেবে। তুই তো আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পছন্দ করিস না। তুই এক কাজ কর। এখানে চলে আয়, আমার বাসাতেই থাকবি, আর আমাদের নিউইয়র্কের অফিসটা দেখাশোনা করবি। তোকে ওর কাজিন হেল্প করবে। এর পাশাপাশি তুই এমবিএটা করে ফেলবি। এমবিএ শেষ হলে তোকে আমাদের একটা স্টেট অফিসের ইনচার্জ করে দেবো। আমি ওকে বলেছি। ও তো শুনেই অনেক এক্সাইটেড! বলেছে, শালাবাবু আমার সাথে ব্যবসা করলে তো আমার আর কোনও চিন্তাই নেই!” দিদির কথায় জীবনে প্রথমবারের মতো প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম, কেন জানি না, মনে খুব আঘাত পেলাম। দিদিকে খুব ভালোবাসতাম বলেই হয়তো দিদির অমন কথায় ভীষণ অভিমান হল। আমি জীবনে সফল হতে চাই, জীবনটাকে গোছাতে চাই, ভাল কথা। কিন্তু কারও হাত ধরে উঠব না, এটাই ছিল আমার নিজের কাছে নিজের শপথ। প্রয়োজনে হারিয়েই যাব, তবুও কারও কাছেই পথের খোঁজ ভিক্ষা করব না। একটা পয়সাও কারও কাছ থেকে না নিয়ে, পৃথিবীর কারও আনুকূল্য না নিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নিজে চেষ্টা করে যাব। আমি কি তাহলে নিজের অজান্তেই এমনকিছু দিদিকে বলেছি যে কথায় দিদির মনে হয়েছে আমি উনার কাছ থেকে কোনও ফেভার চাই? ছিঃ! নিজের আত্মসম্মানবোধ ভেতর থেকে চিৎকার করে বলে উঠল, “কিছুতেই না! না খেয়ে মরে গেলেও না! আমি কোথাও যাব না। যেতে হয় তো নিজ যোগ্যতায় যাব।” বাঙালি মধ্যবিত্তের একটাই সম্পদ : আত্মসম্মানবোধ! সেটাও বিকিয়ে দিলে আর কী-ই বা থাকে! সেদিন প্রচণ্ড রিঅ্যাক্ট করেছিলাম। সুদেষ্ণাকে দিদিকেও যে বড় বড় কথা শুনিয়ে দেয়া যায়, সেটা দেখলাম। পরম বিস্ময়ে নিজেকে প্রচণ্ড আত্মঅহমিকাপূর্ণ কথাবার্তা চ্যাটিংয়ে লিখতে দেখলাম। দিদির কথাগুলি পড়ে মনে হচ্ছিল, দিদি কাঁদছেন। তবুও একটুও দয়ামায়া হল না। ক্রোধান্ধ মস্তিষ্কে যা এল, তা-ই লিখে যেতে লাগলাম। “দিদি, তুমি ভাবলে কী করে যে তোমার কাছ থেকে দয়াদাক্ষিণ্য নিয়ে আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হব? আমি আমেরিকায় আসবই না। লাগবে না আমার ডিগ্রিফিগ্রি! যেদিন নিজের চেষ্টায় আসতে পারব, সেদিন আসব। তুমি, দাদাবাবু আর আমার ভাগ্নেকে নিয়ে সেদিন অনেক মজা করব। যদি এমন কথা আর কোনদিনও ভাবোও, আমার সাথে কথা বলার দরকার নেই। আমার বিত্ত চাই না। আমি গরীব হয়েই বেশ ভাল আছি!”

দিদি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। ছোটভাইয়ের ওরকম রিঅ্যাকশনের পরেও উনি ভাইকে দূরে ঠেলে দেননি। অনেকবার ক্ষমা চেয়েছেন অকারণেই! বলেছেন, “আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি। আমি সত্যিই অতকিছু ভেবে বলিনি কথাটি। বাপ্পি, তোকে আমি বড় ভালোবাসি। প্রতিদিন প্রার্থনা করার সময়ে তোর জন্য প্রার্থনা করি। আমি বিশ্বাস করি, তুই অনেক বড় হবি। তোর কথা শুনে তোর দাদা বলেছে, “সুদেষ্ণা, তুমি দেখো, এই ছেলেটা অনেক দূর যাবে!” তুই রাগ করিস না রে ভাই, আমার লক্ষ্মীসোনা ভাই। প্রমিজ করছি, আর কোনদিনও তোকে অমনকিছু আর বলব না। বোকা দিদিটাকে ক্ষমা করে দিস, ভাই।” ……. এসব শুনে আমি নিজেও চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। কাঁদতে-কাঁদতে দিদির কাছে শপথ করলাম, “দিদি, আমার জন্য তুমি আজকে যে কষ্টটা পেলে, এই কষ্টের মর্যাদা আমি জীবন দিয়ে হলেও রাখব। তুমি শুধু পাশে থেকো, তাহলেই হবে।”

আমার দিদি আমার পাশে ছিল, তাই আমি আজকে আছি। যাকে কখনওই দেখিওনি, সেই মানুষটির জন্যই আমি হারিয়ে যাইনি। একটা ভার্চুয়াল সম্পর্ক আমার জীবনটাকে গুছিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা-মা’র পর দিদিই আমার কাছে এ পৃথিবীর ঈশ্বর। বছরখানেক আগে ক্যান্সারের কারণে দিদির ব্রেস্ট আর ইউটেরাস কেটে বাদ দিতে হয়েছে। দিদি প্রায়ই বলে, “শোন, মানুষ যে কতটা বাঁচতে পারে, আমার নিজেকে না দেখলে আমি কখনওই তা জানতেই পারতাম না। আমি যে এখনও বেঁচে আছি, সেটা শুধু আমার জীবনীশক্তির জন্য, আর কিছুই না। কেমোথেরাপির কষ্ট আর ক্যান্সারের ওরকম বিদঘুটে ট্রিটমেন্ট নামক যন্ত্রণার পরও যে কেউ বাঁচে, আমাকে কেউ এসে বললে তো বিশ্বাসই করতাম না। বেঁচে যে আছি, এটাই আনন্দের, এটাই বিস্ময়ের!” দিদি এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মানসিকভাবে শক্তি দেয়ার জন্য একটা ফ্রি কাউন্সেলিং স্কুল খুলেছেন। উনার ইচ্ছা, বাকি জীবনটা নীলকে মানুষ করে, পৃথিবীটা ঘুরে, নিজের এবং অন্যের জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়ে, আর মানুষের সেবা করেই কাটিয়ে দেবেন। দিদির কাছ থেকে আমি শিখেছি, how to celebrate life to the fullest even in the worst conditions! পৃথিবীতে সবচাইতে বড় সাফল্য : মৃত্যুর আগেই নিজের মতো করে বেঁচে নেয়া!

Content Protection by DMCA.com