একটা পাখিকে মাঝে মাঝে উড়ে যেতে দেখি। কখনোবা রাতদুপুরে অত্যন্ত বিষণ্ণ সুরে গান গায় সে। দূর থেকে দূরে মহাসাগরের উপর দিয়ে তার সরু ডানা ঝাপটে উড়ে যায় কুয়াশার মাঝে। একটা মুখ খুব চেনা চেনা মনে হয়। ফিসফিসিয়ে কথা বলে অথবা দমকা বাতাসের মতো হেসে গায়ের উপর এলিয়ে পড়ে। আমি দু-হাতে জড়িয়ে ধরি। ওর মুখটা তুলে ধরি, ও বলে…অসভ্য! আমি বলি, স্বপ্না, তুই রাগ করিসনে। তুই যাসনে। তবু ও চলে যায়। আলেয়ার মতো মিলিয়ে যায়। ধড়ফড় করে জেগে উঠি। দেখি ব্যস্ত নগরী, যানবাহনের কোলাহল; আর কাকের কর্কশ ডাক শুনি।
তবুও যদি কখনও স্মৃতির পুরোনো আয়নাটার ধুলো ঝেড়ে ওটার দিকে তাকাই, তবে প্রথমেই ভেসে ওঠে একটা নদী—ইছামতী। নদীর ধারে একটা গ্রাম। আম, কাঁঠাল, জাম আর বাঁশবনের মাঝে মাঝে ছড়ানো-ছিটানো ছোটো-বড়ো ঘরবাড়ি। নদীর ধারে একটা পুরোনো স্কুলঘর। আমার স্কুলজীবনের মধুময় দশটি বছর সেখানেই কেটেছে। স্কুলে ছেলে-মেয়ে সবাই একসঙ্গে পড়তাম। আর সেজন্যই ছেলে ও মেয়েদের মাঝে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলত একে অন্যকে নানাভাবে হারিয়ে দেবার।
স্বপ্না ছিল মেয়েদের দলনেত্রী। শ্যামলা সুশ্রী মুখে অল্প একটু হাসি আর তার চেয়ে একটু বেশি অহংকার ওকে বেশ আকর্ষণীয় করে রাখত। ছেলেদের দলনেতা দুর্বল-লম্বা-লিকলিকে ও মোটামুটি ভীরু বলে পরিচিত আমিই ছিলাম। ক্লাসরুমটা আমার জন্য ছিল একটা যুদ্ধক্ষেত্র এবং বার বার সে যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেকে বেশ একটা প্রত্যয়ী বীরপুরুষ ভাবতাম।
অঙ্কের ক্লাসে ভূপেন স্যার যে মাত্রই বলতেন, “একটা দুর্গে এক-শো জন…” আমি খুব তাড়াতাড়ি অঙ্ক করে স্যারের টেবিলে গিয়ে হাজির হতাম। আমার বন্ধুরা দাঁত বের করে ফিকফিক হাসত। মেয়েরা পেনসিল দিয়ে স্বপ্নার পিঠে খোঁচা মারত। আমি অত্যন্ত নির্বিকারভাবে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম, স্বপ্না খাতা কাটাকুটি করে ভরে ফেলছে, তবু অঙ্ক মিলছে না। কিন্তু ইতিহাসের দিন এলেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। প্রবীণতম শিক্ষক পরেশ বাবু ক্লাসে এসেই হয়তো আমাকে জিজ্ঞেস করে বসতেন, তোঘলক খাঁ কোন খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন? অধিকাংশ দিনই ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ থাকত না। ক্লাসের ছেলেগুলো নিশ্চুপ পাথরের মতো হয়ে যেত, কিন্তু মেয়েগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ত।
স্যার একগাল হেসে ভরাট গলায় বলতেন, “স্বপ্না…মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস?” স্বপ্না পানিপথের যুদ্ধ করে, আকবরকে আট-দশখান বিয়ে দিয়ে তাজমহল বানিয়ে মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকত। ডাইনে কাত হয়ে অথবা বামে হেলে চোখদুটো আমার মুখের উপর নিক্ষেপ করে অথবা বন্ধ করে রাজনীতিবিদদের মতো হাত ঝেড়ে নুরজাহান হয়ে মোঘল সাম্রাজ্য চালাতে থাকত। স্যার তখন বিজয়ীর হাসি হেসে বলত, “নুরজাহান, তুমি থামো!”...এহহ্! নুরজাহান! আমার সারাশরীর জ্বলে যেত।
ক্লাস শেষ হলে স্বপ্না আমার মুখের সামনে মুখ এনে বলত, কেমন হেরে গেলি! ইতিহাস পারিস না, আমার সঙ্গে লড়তে আসিস! আমি বলতাম, আমার ইতিহাসের দরকার নেই। তুই পড়ে পড়ে ইতিহাস হয়ে যা-গে! স্বপ্না বাধা দিয়ে বলত, অবশ্য তুই যখন অঙ্ক করে দ্রুত স্যারের টেবিলে যাস, তখন তোকে ঠিক আলেকজান্ডারের মতো লাগে। যেন মেসিডোনিয়া থেকে জয় করতে করতে পুরুর রাজত্বে পৌঁছে গেছিস! আমিও ওকে তাচ্ছিল্য করে বলতাম, আলেকজান্ডার আর তুই তো একই ক্লাসে পড়তিস, অঙ্ক করে করেই তো সে বীরপুরুষ হয়েছিল। স্বপ্না বেশ রাগের সঙ্গে বলত, তুই ফার্স্ট হলে কী হবে? তোর মাথায় কিচ্ছু নেই! আলেকজান্ডার আমাদের বাড়িতেই আছে বাবার বুকশেলফের সবচেয়ে উপরের তাকে।
স্কুলে গেলেই স্বপ্নার সঙ্গে আমার প্রায়ই ঝগড়া বাধত, কিন্তু বাড়িতে এলেই সব ভুলে যেতাম। আমি প্রতিদিন যেতাম ওদের পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে। স্বপ্না আসত প্রতিদিন আমাদের গাছের টক-কুল অথবা পেয়ারা খেতে।
একদিন মিছেমিছি এক ঝগড়া বাধিয়ে স্বপ্নার সঙ্গে দুই দিন কথা বললাম না। ছুটির দিন সকালে বাড়িতে ছিলাম। মা খাবার দিচ্ছিলেন আমাকে। স্বপ্না লাফাতে লাফাতে এসে বলল, খালাম্মা, লুকু আমার উপর রাগ করেছে। তারপর মাদুরের ওপর বসে আমাকে বলল, রাগ করেছিস? তোর রাগ করাও যেন কেমন! আমার ভালো লাগে না। রাগ করলে চেঁচামেচি করবি, চোখ রাঙাবি, পারলে ঠাস করে একটা লাগিয়ে দিবি। …শুনে আমি সশব্দে হেসে উঠেছিলাম।
তারপর হঠাৎ কী যে হয়ে গেল! একাত্তরের মার্চ মাসে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। দলে দলে লোক শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসতে লাগল। সবার চোখে-মুখে কেমন ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। স্বপ্নার বড়ো বোন শেফালি আপা আশি মাইল পথ পায়ে হেঁটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি চলে এল। গ্রামের অনেক ছেলের মুখে সহসা খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মাথায় লম্বা রুক্ষ চুল গজিয়ে অচেনা করে দিতে লাগল। স্বপ্না একদিন আমাকে চুপিচুপি বলল, আপার ব্যাগের মধ্যে না একটা বোমা আছে। আমার ভয়ে গা শিউরে উঠেছিল।
এপ্রিলের এগারো তারিখ রাতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে জেগে উঠলাম। মেশিনগানের এলোপাথাড়ি গুলি ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের মাথার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কী যেন বলছিলেন, বুঝতে পারছিলাম না। আব্বা আমাকে মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুই তাড়াতাড়ি পালিয়ে যা। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়াবি, গুলির শব্দ শুনলে শুয়ে পড়বি। স্বপ্নাদের বাড়ির পেছনের দিকে নদীতে পানি কম আছে, সাঁতরে পেরিয়ে যাবি। নদীর ওপারে বোধ হয় মিলিটারিরা নেই। আমি আর তোর মা আসছি; যা তুই!
শুকনো বাঁশপাতা পায়ের নিচে মচমচ করে ভেঙে পড়ছিল। চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আগুনের শিখার মতো গুলি এদিকে-সেদিকে চলে যাচ্ছে। কয়েক বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। দৌড়োতে দৌড়োতে স্বপ্নাদের বাড়ি পৌঁছে ওদের উঠোনে গিয়ে দেখলাম, শেফালি আপা আর কয়েকটা ছেলে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলোর কাঁধে বন্দুক আর শেফালি আপার কাছে সেই ব্যাগ। স্বপ্নার বাবা হারিকেন বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, তোরা দু-জন পশ্চিমে এই জঙ্গল দিয়ে যতদূর পারিস পালিয়ে যা। ইছামতী পেরুতে পারলেই আর কোনো ভয় নেই। আমি বুড়ো মানুষ, চোখে কিছু দেখতে পাই না। বোধ হয় বেশি দূর যেতে পারব না। তোরা যা!
মুহূর্তের মধ্যে আমরা বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে তেঁতুল গাছের নিচ দিয়ে, বটগাছের কাছে জঙ্গল যেখানে গভীর হয়েছে, সেখানে পৌঁছে গেলাম। দৌড়োতে গিয়ে স্বপ্না কয়েক বার আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। আমার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা উলটে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথা করছিল। লতা-পাতার ভেতর দিয়ে একটা অজানা জন্তু, সড়সড় করে চলে গেল। স্বপ্না বলল, শেয়াল না? আমি উত্তর না দিয়ে ওর ডান হাতটি নিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম।
গত বছর আমি একটা প্রকাণ্ড দাঁড়াশ সাপকে বটগাছের শিকড়ে জড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল, ওই হলুদ ডোরাকাটা সাপটা আমাদের দু-জনকে গ্রাস করতে ফণা ধরে এগিয়ে আসছে। স্বপ্না আর দৌড়োতে পারছিল না। আমি ওকে জোর করে তুলে বললাম, জঙ্গল পেরুলেই নদী আর নদী পেরুলেই আমরা বেঁচে যাব।
সমস্ত গ্রামটা আগুনের লেলিহান শিখায় ডুবে গেল। আগুনে পুড়ে বাঁশগুলো কেমন বিকট শব্দ করে করে ফেটে যাচ্ছিল। দখিনা বাতাসে পোড়া গন্ধ আর ছাই উড়ে আসছিল। উত্তরপাড়া থেকে মানুষের আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে। স্বপ্না বলল, বাবা কোথায়? লাটাগাছের কাঁটায় আমাদের জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। নদীতে ঝাঁপ দেবার আগে সব জামাকাপড় খুলে ফেলবি, নইলে ভেসে যেতে পারিস।—আমি বললাম। মেশিনগানের গুলি বোধ হয় বেশ কাছ থেকে আসছিল। হঠাৎ স্বপ্না আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে বলল, বাবা গো…! আমি ওকে তুলে ধরার চেষ্টা করেও পারলাম না। বুকে হাত দিয়ে বুঝলাম, রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে। ওর ঘাড়ের পাশটা উঁচু করে ধরলাম, তবে গাঢ় অন্ধকারে ওর মুখ আমি দেখতে পেলাম না।
স্বপ্নার গলার স্বরটা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছিল। ও ধরাগলায় কাতরভাবে বলল, শে-ফা-লি আ-পা, বা-বা-গো…। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বলল, লু-কু, পা-নি, পা-নি…। ইছামতীর কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম, স্বপ্নাদের বাড়িতে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। স্বপ্নাকে আমি দু-হাতে প্রবলভাবে বুকের সঙ্গে লেপটে ধরলাম। স্বপ্না বলল, আমি কি মরে যাচ্ছি? আমি কিছু বললাম না।
রাত শেষ হয়ে আসছিল। পুব আকাশে আলোর ছটায় দেখতে পেলাম, স্বপ্নার গভীর কালো ডাগর চোখদুটো চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল।