আলোয় আলো পথ

১। যিনি খুব সুন্দর নাচতে জানেন, তাঁর নিজের জীবনটাও বুঝি হুবহু নাচের মুদ্রার মতন, এটা অনেকেরই ধারণা, যা পুরোপুরিই একটা ভুল ধারণা।


যে মানুষটা লেখালেখি করেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটাও তাঁর লেখার মতনই, এটা আরও বড়ো একটা ভুল ধারণা। লেখক আর লেখা, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি সত্তা। অথচ কারও লেখা দিয়ে আমাদের সমাজে তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে জাজ করা হয়, আর তাঁর সৃষ্ট গল্পের চরিত্র দিয়ে তিনি নিজে কেমন, তা জাজ করা হয়। তাঁর গল্পের চরিত্র খারাপ মানেই তিনিও খারাপ, ভালো মানেই তিনিও ভালো, এমন কিছু শিশুতোষ ভাবনা নিয়ে অনেক পাঠকই বসে থাকেন। পাঠকের এমন অপরিপক্বতার চাইতে হাস্যকর আর কিছু নেই।


আমাদের দেশে এখনও প্রজননযন্ত্রের একমুখিতাকেই উন্নত চরিত্রের একমাত্র নির্ধারক হিসেবে ধরা হয়। স্বামীর ঘুষের টাকায় সংসার চলে, এ নিয়ে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু স্বামী মেসেঞ্জারে কোনও মেয়ের সাথে কথা বললেও স্বামীর চরিত্র খারাপ,---আমাদের দেশে বেশিরভাগ স্ত্রীই এখনও এরকম করেই ভাবেন। এমন একটা দেশের দুর্নীতিমুক্ত হতে একটু সময় তো লাগবেই! আমরা কিছু স্টেরিওটিপিক্যাল ব্যাপার থেকে বেরোতেই পারি না। কেউ অভিনয় করে মানেই সে খারাপ, কেউ বিপরীত লিঙ্গের কারও সাথে মেশে মানেই সে খারাপ, কেউ রাত করে বাড়ি ফেরে মানেই সে খারাপ, কেউ একটু ফ্যাশন-সচেতন মানেই সে খারাপ, কেউ ধর্মাচরণ করে না মানেই সে খারাপ, কেউ ভণ্ডামি না-করে সরাসরি কথা বলে মানেই সে খারাপ, আরও কত কী! এসব ভুল ধারণা পরিবেষ্টিত হয়েই আমরা বেঁচে আছি। তবে ঠিকটা কী? ঠিকটা হচ্ছে, কেউ একজন এটা, সেটা, ওটা, যেটা, অমুক, তমুক, এরকম, ওরকম ইত্যাদি কিছু হবার মানেই এই না যে সে ভালো কিংবা সে খারাপ। ভালোত্ব বা মন্দত্ব মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।


আবার আরেকটা জিনিস খেয়াল করা যায়, কেউ তাঁর কাজে ভীষণ ভালো হতে পারেন, কিন্তু তিনি মানুষ হিসেবে ভালো না-ও হতে পারেন। ঘরের বাইরে যে মানুষটি সেরা, সেই একই মানুষ ঘরের ভেতরে নিকৃষ্টও হতে পারেন। এক অ্যাওয়ার্ড-শো’তে আমার প্রিয় শাহরুখ খানের সামনে দীপিকা পাড়ুকোনকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘শাহরুখ একজন মানুষ হিসেবে বেশি ভালো, না কি অভিনেতা হিসেবে? দীপিকা মুচকি হেসে ডিপ্লোম্যাটিক্যালি উত্তরটা দেন এভাবে: ‘উনি ভালো মানুষ হবার অভিনয় করেন।’ প্রিয় পাঠক, কী বুঝলেন?


২। ‘ক্ষমা একটি মহৎ গুণ।’ হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে! তবে এই অমূল্য একটি বাণীতে লাভ হয়েছে কাদের, জানেন? তাঁদের, যাঁরা ক্ষমাটা পেয়ে যাচ্ছেন সবসময়, প্রত্যেকটা বার। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটা হয়, বেশিরভাগ সময়ই, যে মানুষ ক্ষমাটা করছেন, তিনি ক্ষমা করতেই থাকেন, আর অপরপাশের মানুষটা এর সুযোগ নিতেই থাকেন। ক্ষমা পেয়ে সেটার মর্যাদা আমৃত্যু ধরে রাখেন, কেবল এরকম মানুষই ক্ষমা পাবার যোগ্য, বাকিরা নয়।


৩। কারও ‘কেমন আছ?’র উত্তরে একদিন সুন্দর করে হেসে, ‘খুব ভালো আছি!’ বলেই দেখুন না কী হয়! কী কী হতে পারে? অনেকেই কপাল কুঁচকে আপনার দিকে এমনভাবে তাকাবে যেন এটা কোনও খারাপ একটা খবর। অনেকেই মনে মনে ভাববে, ‘কেন? খুব ভালো কেন থাকবে? আমি তো ‘ভালো আছি।’টুকুই বলার অবস্থায় নেই, আর উনি কিনা বলছেন ‘খুব ভালো’? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!’ আবার কেউ কেউ নিজের মনে রাখতে না পেরে মুখ ফুটে বলেই বসবেন, ‘কেন, আপু? অফিসে কাজটাজ নাই নাকি আজকাল?’ ‘ভাই, নিশ্চয়ই লটারি জিতেছেন, তাই না? না কি প্রাইজবন্ড?’ এই ‘খুব ভালো’টা বলার প্র্যাকটিসটা করে দেখবেন নাকি এই দুঃসময়ে? ‘খুব’ শব্দটির ‘খুবিয়া (গুণ)’ নিজেই বুঝতে পারবেন। মানুষ অন্যকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন?’, আর উত্তর পেতে চায়, ‘খারাপ আছি।’ কিংবা ‘এই তো আছি একরকম।’ কিংবা ‘ভালো কি আর থাকা যায়!’ মানুষকে রাগিয়ে দেবার সহজ বুদ্ধি হলো, উত্তরে ‘খুবই ভালো আছি।’ জাতীয় কিছু একটা বলা।


৪। এই দুনিয়ায় অনেক লোক আছেন, যাঁদের শেষনিঃশ্বাসটার খবর রাখবারই কেউ নাই, অথচ আপনার অকারণেই মন খারাপ হবার খবর রাখবার অন্তত একজন মানুষ হলেও আছেন। তার পরেও আপনি বলেন, আপনি নাকি দুঃখী মানুষ! সত্যিই কি তা-ই? তা যদি হয়, তবে সেই বেচারা কেমন মানুষ, যাঁর বেঁচে থাকা না থাকায় পৃথিবীর কারও কিছুই এসে যায় না?


৫। আমাদের অনেক ভালো সম্ভাব্যপ্রাপ্তি আর ভালো কাজ হারিয়ে যায়---‘করলেই করতে পারি, কিন্তু করতে আলসেমি লাগে।’ কিংবা ‘পরে করলেই চলবে, আর তা ছাড়া, সময় তো আছেই!’ এই দুটো ভাবনার নিচে চাপা পড়ে। কেউ-না-কেউ এমন ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে সময়মতো কৃতিত্বটা নিয়ে ফেলবেই ফেলবে! আলস্য কিংবা কাজ ফেলে রাখার অভ্যাস কেবল তখনই আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, যদি আপনি পৃথিবীর সবাইকেই আপনার মতো বানিয়ে ফেলতে পারেন, যা কখনওই সম্ভব নয়। তাই এই পৃথিবীতে দুটো দল আছে। প্রথম দল কাজটা করে দেখায়, দ্বিতীয় দল কাজটা করতে না পারার পেছনে অজুহাত দেখায়।


৬। কেউ আমার না, এই দুনিয়াতে কেউ আমাকে কেয়ার করে না, আমার এটা নাই সেটা নাই, আমি বিদেশে ঘুরতে যেতে পারি নাই, আমার এখনও একটা আইফোন নাই, আমার চাঁদে একটুকরো জমি নাই!---এমন কষ্টের ফিরিস্তি কার কার আছে? ‘এই দুনিয়ায় আমার কষ্টই সবচাইতে বেশি!’ প্রায়ই এরকম মনে হয়? আচ্ছা। আমি আপনার পাশেই আছি। তিনদিনের একটা চ্যালেঞ্জ নিন। টোটাল বাহাত্তর ঘণ্টা কিছুই খাবেন না এক পানি ছাড়া। যত কষ্টই হোক, খাবেন না। তিনদিন শুধু পানি খেয়ে থাকলে আপনি কোনওভাবেই মারা যাবেন না। এভাবে তিনদিন কাটানোর পর, সামনে একথাল ভাত নিয়ে বসেন। ওই মুহূর্তে আপনার অনুভূতিটা কেমন, তা জানতে চাইছি। (যদিও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।) এবার বলুন, আপনি কী কী যেন বলছিলেন? কী কী যেন অভিযোগ ছিল আপনার? ওগুলো আছে এখনও? মনে করতে পারছেন ওসবের কিছুই? কেমন লাগছে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আপনার যা মনে হচ্ছে, তা সঠিক। একথাল ভাত ছাড়া বাকি যা-কিছু আমাদের আছে কিংবা নেই, তার সবই অপ্রয়োজনীয়। ওসব কিছুরই বিকল্প আছে, কিন্তু ভাতের বিকল্প শুধু ভাতই। (এখানে আমি ‘ভাত’ শব্দটিকে রূপকার্থে ব্যবহার করেছি। আর ভালো কথা, এই পৃথিবীতে অনেক মানুষই আছেন, যাঁরা সত্যি সত্যিই অতটা ক্ষুধার কষ্টে দিন কাটাতে বাধ্য হন।) আমার প্রিয় ‘বাইশে শ্রাবণ’ মুভির একটা ডায়লগ মনে পড়ছে। ‘ভাত-ডাল আর বিরিয়ানির মধ্যে তফাতটা জানো? প্রথমটা নেসেসিটি, পরেরটা লাক্সারি।’


৭। একটা মজার তথ্য দিই। আপনি যদি কোনও গার্লস-গ্রুপের কয়েকটা পোস্ট আর সেগুলির কমেন্ট দেখতে পান, আর ইনবক্সে মেয়েদের একজনের সাথে অন্যজনের কথাবলার টপিক জানতে পারেন, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন, শুধু এলিয়েনরাই এলিয়েন না, অনেক মেয়েও এলিয়েন। জগতে এমন একটা বিষয়ও নেই, যা নিয়ে মেয়েরা কথা বলতে পারে না। জগতে এমন একটা বিষয়ও নেই, যা নিয়ে মেয়েরাও ঝামেলা বাধাতে পারে না। জগতে এমন একটা বিষয়ও নেই, যা মেয়েরা না-পেঁচিয়ে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। মেয়েরা পৃথিবীর জটিলতম মস্তিষ্কের অধিকারিণী। একটা মেয়ে যে কী কী তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস নিয়েও মাইন্ড করে বসতে পারে, একমাত্র ভুক্তভোগী বাদে আর কেউ তা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। সেদিন আমার বন্ধু তার গার্লফ্রেন্ডকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এমন একটা ভিডিও পাঠাল, যেখানে দেখানো হয়েছে কী করে একজন মানুষ মাত্র একশো টাকা পকেটে নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, বুদ্ধিতে, অসীম পরিশ্রমে শতাধিক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ভিডিওটি দেখে মেয়েটি প্রচণ্ড রকমের রিঅ্যাক্ট করে আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তোমার কি ধারণা আমি টাকার জন্য লালায়িত? তোমার টাকার প্রতি আমার লোভ আছে, তুমি আমাকে এটাই মনে করো? ছিঃ! আজকের পর তুমি আমার সাথে আর কখনও কথা বলবে না।’ তখন আমার বন্ধুটির ‘মাননীয় স্পিকার’ হৃদয়ে হয়তো বেজে চলেছিল…আকাশেতে লক্ষ তারা, চাঁদ কিন্তু একটা রে…ইইইইয়া ইইইইয়া!


৮। একটা সিক্রেট পাওয়ারের কথা শেয়ার করি। সেটা হচ্ছে ‘ইগনোর করতে জানা’। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, আপনার আশেপাশের বেশিরভাগ জিনিস আর বেশিরভাগ মানুষকে ইগনোর করে চললে আপনার কোনও ক্ষতি তো হবেই না, বরং লাভই হবে। আরও বড়ো কথা হলো, আশেপাশে প্রতিনিয়ত ঘটতে-থাকা বেশিরভাগ জিনিস আর বেশিরভাগ মানুষ আপনার এই ইগনোর করার কাজটাই ডিজার্ভ করে। চারিদিকের চলমান ঘটনাকে এবং মানুষকে আপনি যত বেশি আমলে নেবেন, তত বেশি পরিমাণে কষ্ট আর ঝামেলা পোহাতে হবে আপনাকে। এই জগতে ভালোথাকার মূলমন্ত্র একটিই---সিটিএন। (উল্লেখ্য, এর ইলাবোরেশন ‘ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক’ নয়!)


৯। যে মানুষ নিজের ভুলত্রুটি নিজেই ধরতে জানে, তার ভুল আর কেউ ধরতে পারবে না। এটা ক্রমাগত করে যেতে পারে যে, তার জীবনে কী হয়, জানেন? সত্যটাই বলি! ভুল তো তুচ্ছ জিনিস, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে গিয়ে তাকেই তো আর কেউ ধরতে পারবে না! সে ধরাছোঁয়ার মধ্যেই আর থাকবে না, অনেকদূর এগিয়ে চলে যাবে, ততটাই দূরে যে, তাকে কেবল চোখেই দেখা যাবে, ছোঁয়া আর যাবে না। আর বাকিরা পড়ে থাকবে আগের জায়গাতেই, আর দশটা সাধারণ নগণ্য মানুষের মতো নিজেকে মহাআত্মতৃপ্তিতে ক্ষমা করে দিয়ে দিয়ে।


১০।
- ধরো, কারুর ভুলে তার কাছ থেকে পাঁচশো, একহাজার, দশহাজার টাকা তোমার সামনে পড়ে গেল। তখন তুমি কী করবে?
- আশ্চর্য! কী করব, মানে? ফিরিয়ে দেবো। আমার কি নৈতিকতা নেই নাকি? আমাকে আমার পরিবার থেকে দেওয়া শিক্ষা ওরকম মনে হয় তোমার? আমার টাকা কম থাকতেই পারে, তাই বলে আমাকে এরকম প্রশ্ন করছ তুমি! ছিঃ! আর ওই কয়টা টাকা দিয়ে আমি করবটাই-বা কী?
- যদি টাকার অ্যামাউন্টটা বাড়ে? ধরো, যদি তা সিক্স-ডিজিট কিংবা সেভেন…কিংবা এইট…এ গিয়ে দাঁড়ায়, তখন…? সত্যিটা বলবে কিন্তু!
- ………………………………………………………
- কী হলো? কথা বলো…!
- ইয়ে…মানে…ইয়ে…!


(তবে হ্যাঁ, পৃথিবীতে এমন মানুষও আছেন, যিনি ওই সিক্স-সেভেন-এইট কিংবা যা-ই ডিজিটের টাকা হোক না, তা-ও নেবেন না। ওঁদের কাছে, অন্যের টাকা মানেই তা অন্যের টাকাই, নিজের কিছুতেই নয়। ওঁরা কারা? ওঁরা পৃথিবীর সেই গুটিকয়েক মানুষ, মানে লিমিটেড ভার্সনের অতিদামি মানুষ, যাঁরা বিত্তের দিক থেকে হয়তো নগণ্য, তবে চিত্তের দিক থেকে বিবেচনা করলে পুরো পৃথিবীই এসে শ্রদ্ধায় সম্ভ্রমে পরাজিত সৈনিকের মতো নতমস্তকে তাঁদের পায়ে লুটিয়ে পড়ে!)
Content Protection by DMCA.com