আচ্ছা, আবার শুরু করো। স্যার, এ ৪ শব্দের কথাটা পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী কথা, যেটা কেউ বলে না, কেউই না। আপনাকে ভালোবাসি, কারণ আপনি এটা সবাইকে বলেন।
সবাই তো বোঝে, ভাল কাজের ফল কিংবা খারাপ কাজের ফল সে পাবেই পাবে। আমিও একসময় ভাল স্টুডেন্ট ছিলাম, স্যার। ক্লাস এইটে সুনামগঞ্জ থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় থার্ড হই। গ্রামের স্কুল-কলেজ থেকে ম্যাট্রিক-ইন্টারমেডিয়েট পাস করে এমসি কলেজে কেমিস্ট্রিতে যখন ভর্তি হলাম, তখন সবাই বলেছিল, কেমিস্ট্রি অনেক কঠিন সাবজেক্ট, তুমি পারবে না। আজ ওদের কথাই তো সত্যি হল। আমি অনার্সে রেজাল্ট খারাপ করলাম। কেউ কি ইচ্ছে করে রেজাল্ট খারাপ করে, স্যার? আমি ইন্টার পর্যন্ত কড়া শাসনে বড় হয়েছি। এরপর অনার্সে এসে লাগামছাড়া হয়ে পড়লাম। বাবা-মা তো আর সাথে থাকত না। আমাকে কে পায়? আমি যা মন চায়, তা-ই করতে পারি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পড়াশোনা করতাম না, শুধু ঘুরে বেড়াতাম। এমনকি পরীক্ষার আগেও কোন কোর্সের পরীক্ষা সেটা জানতাম না। কী লজ্জার কথা! এর জন্য আমি কাকে দোষ দেবো? বাবা-মা আর ছোট বোন তো ভাবত আমি পড়াশোনা করছি। আর আমি কিনা . . . . . . ছিঃ! এখন সবাই দূর-দূর ছাই-ছাই করে। আমি জবের কোনও ক্লাস বুঝি না, আমার স্রেফ একটা চাকরি চাই, চাকরি। হোক থার্ড ক্লাস ফোর্থ ক্লাস, চাকরি তো! আপনি বলেন না, ছোটবেলায় ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে পরিচিত হয়ে যাওয়াটা একটা বিশ্রী ব্যাপার? খুব সত্যি কথা, স্যার। সবাই শুধু লাথি দেয়। একটু ভাল কথা কারও মুখে কোনও দিনও শুনলাম না। আমার আর কোনও আত্মসম্মান নেই, জেদ নেই, পড়াশোনার প্রতি মনযোগ নেই, কারও প্রতিই কোন ধরনের অভিযোগ নেই। গ্রামে যেতে পারি না, সবাই শুধু কথা শোনায়। ভুল করেছি, ভাল কথা। আমাকে শোধরাবার অন্তত একটা সুযোগ দাও। না হয় মেরে ফেল, তবুও ওরকম আঘাত কোরো না। মানুষ সুইসাইড করে শুনলে একসময় হাসতাম। এখন বুঝি, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা কত বেশি হলে মানুষ আর বাঁচতে চায় না। কিন্তু আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে থেকে আপনার লেখাগুলো পড়ি। আমি বোঝাতে পারব না স্যার, আপনার প্রতি আমার কত ঋণ। আমি জানি, আপনাকে এ কথাগুলো অনেকেই বলে। আমি কোনও দিনই কল্পনাও করতে পারিনি যে আপনাকে আমি সামনাসামনি দেখব। ঈশ্বরের অশেষ দয়া, আজকে আপনার সাথে দেখা করে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারছি।
চাকরির প্রয়োজনে একবার ২ মাস সিলেটে থাকতে হয়েছিল। একদিন মদিনা মার্কেটের ওদিকে চাচার টংয়ে সাস্টের ছোটভাইদের সাথে আড্ডা দিয়ে ছোটভাই গিয়াস সহ সিপি’তে চিকেন-থাই আর পেপসি’র অর্ডার দিয়ে ওয়েট করছিলাম। এমন সময় দেখলাম, সুদর্শন চেহারার লম্বা এক ছেলে খুব ইতস্তত ভঙ্গিতে ঢুকে আমার দিকে অনেক সংকোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি সুশান্ত স্যার না? এরপর ওর কথাগুলো শুনতে লাগলাম। ওকে উদভ্রান্ত পরাজিত সৈনিকের মত দেখাচ্ছিল। কথা প্রায়ই আটকে যাচ্ছিল। এক ফাঁকে আমার সাথে অনেক কুণ্ঠা নিয়ে একটা ছবি তুলল। এই মুহূর্তে যা নিয়ে সে বেঁচে আছে, তা হল নিজের ক্ষমতার প্রতি প্রচণ্ড অবিশ্বাস। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে, রুমে ফিরতে আরও দেরি হয়ে যাবে জেনেও ওর সব কথা শুনলাম, ওর সাথে কথা বললাম, ওর শক্তির জায়গাগুলো চিনিয়ে দিলাম, সবাই আসলে কী বলে কেন বলে, এর কতটা শুনতে হবে, কতটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে, সেটা বোঝালাম। ও শুনল, ভাবল, ওকেও ভাল কিছু একটা করতে হবে। ও মন থেকে চাইলেই পারবে। ওর কাজের মধ্য দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে, ও কিছুতেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার মত কেউ নয়। ও কিছুতেই হারিয়ে যাবে না। একটু পর দেখলাম, ও চোখ মুছছে। একটা সিএনজি নিয়ে ওখান থেকে দ্রুত চলে এলাম, দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে নয়, আমি এই জাতীয় দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না বলে।