অস্পষ্ট জার্নাল: ২

আট। ভালোবাসাহীন জীবন অমিত সম্ভাবনার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। আত্মিক ভালোবাসা, বস্তুগত ভালোবাসা, কিংবা শারীরিক ভালোবাসা—ভালোবাসার এমন ভেদাভেদ ভালোবাসা সম্পর্কে আমাদের বিচার-বিবেচনাকে বৈষম্যের দিকে নিয়ে যায়। ভালোবাসার কোনো নাম হয় না, ভালোবাসা কোনো বিশেষ শ্রেণীতে পড়ে না, ভালোবাসাকে কোনো সর্বজন অনুমোদিত উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ভালোবাসা কোনো নির্দিষ্ট পৃথিবীর অংশ নয়, ভালোবাসা নিজেই একটা পৃথিবী। হয় আমরা এর মধ্যে বাস করছি, নতুবা এর বাইরে আছি। এর মাঝামাঝি আর কিছু নেই। ভালোবাসা যখন হৃদয়কে আলোড়িত করে, আমাদের কথা ও কাজ স্রষ্টার নির্দেশিত পথ ধরে চলে, তখন সকল অহেতুক যুক্তি, জিত আর তর্কের অবসান ঘটে। নিশ্চয়ই বিস্রস্ত বচনের চাইতে সংযত নৈঃশব্দ্য অধিক শক্তি ধারণ করে। নীরবতা ও ধৈর্যের মধ্য দিয়ে সেবা ও শান্তির অমর সংগীত রচিত হয়। ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় না, ভালোবাসা আপনিই প্রকাশ পায়। ভালোবাসার যে আরাধ্য ধন, তাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্নে মানুষ জীবনবাজি রেখে হাসিমুখে লড়তে পারে। যার হৃদয়ে ভালোবাসার শক্তি আছে, সে সকল কষ্ট ও পরীক্ষা হাসিমুখে উৎরে যেতে পারে। জীবনের সকল কষ্ট, সকল দুঃখ, সকল গ্লানি, সকল যন্ত্রণা, সকল ব্যথা, সকল বেদনার চাইতেও…জীবন বড়ো। জীবনে নৈরাশ্য ও হতাশা আসবেই, তবে তা যেন আমাদের চলার পথকে রুদ্ধ করে না দেয়, আমাদের স্বপ্নকে আড়াল না করে রাখে। যে স্রষ্টা আমাদের জীবনের এতোগুলি বছর আমাদের যত্নে রেখেছেন, ভাল রেখেছেন, তিনি সাময়িক কিছু সময়ের জন্য আমাদের কষ্টে রাখতেই পারেন। তার জন্য আমরা তাঁকে অভিযুক্ত করতে পারি না, তাঁর প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারি না। বরং ওই কঠিন সময়ে তাঁর ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাস আরো দৃঢ় করতে হবে। এর অন্যথায় মাত্রই পাপ। নিশ্চয়ই আমরা এখন যে পথে আছি, সে পথ আমাদের জন্য অকল্যাণকর বলেই স্রষ্টা আমাদের সে পথের অসীম কষ্ট বোঝানোর মাধ্যমেই সে পথ থেকে আমাদের সরিয়ে আনতে চাইছেন। স্রষ্টার প্রত্যেক কাজের মধ্যেই বর্তমান ও ভবিষ্যতের মঙ্গল নিহিত আছে। আমাদের যাকিছু আছে, তার জন্য আমরা স্রষ্টাকে যতোটা ধন্যবাদ দিই, আমাদের যাকিছু দেয়া হয়নি, তার জন্যও স্রষ্টাকে সমানভাবে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। তিনি আমাদের প্রার্থনায় ইতিবাচক সাড়া দেননি কারণ, নিশ্চয়ই আমাদের প্রার্থনার মধ্যে কোনো এক অমঙ্গল লুকিয়ে ছিল। আমাদের বর্তমান কষ্টকে কমিয়ে দিলে আমরা খুশিই হতাম, কিন্তু কে বলতে পারে, হয়তো বর্তমান কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমেই কষ্টটা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব! বুলেটবিদ্ধ স্থান হতে বুলেটটি অপসারণ করার যে পথ, তা ওই সময়ের যন্ত্রণাকে সাময়িকভাবে আরো বাড়িয়ে দেয়। হয়তো সে স্থানে মলম লাগালে যন্ত্রণা কমতো, কিন্তু যন্ত্রণার অবসান তো হতো না। তাই, দাঁতে দাঁত চেপে অসীম কষ্ট সহ্য করে যেতে হয়। স্রষ্টাপ্রদত্ত যে আপাতঅনন্ত যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণাপর্বের পরিসমাপ্তি হয় নিরবধি সুখপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। তাই, আমাদের সকল দুঃখ আর বিষাদের সর্বোত্তম প্রত্যুত্তর হলো নীরবতা। কঠিন সময় আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি বাড়ায় এবং আমাদের হৃদয় ক্ষত সারাতে শেখায়। আমরা আমাদের কল্পনার চাইতেও বেশি দৃঢ়তা নিয়ে বাঁচতে শিখি, আমাদের ব্যক্তিত্বের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয় যা আমাদের সহিষ্ণু করে, সংযমী করে, বিনীত হতে শেখায়। আমরা আমাদের ও আমাদের চারপাশের জগতটাকে নতুনভাবে চিনতে শিখি। বাজে অবস্থায় পড়লে মানুষ জীবনকে সবচাইতে কাছ থেকে চিনতে পারে। ভর্তি মানিব্যাগ, সৌভাগ্য কিংবা সুস্বাস্থ্য—এর কোনোটাই জীবনকে চিনতে শেখায় না। জীবনের অর্থ বোঝার প্রথম ধাপ হলো, নিজের ভেতর থেকে ইগোকে পুরোপুরিই বের করে দিতে হবে। এটা করতে পারলে নিজেকে নির্ভার মনে হবে, নিজের অন্তরের আলোয় বিকশিত হয়ে নিজের ভেতরের ও বাইরের পৃথিবীর মধ্যে একধরনের আশ্চর্য সংযোগ সৃষ্টি হবে। এতে করে আমরা ক্ষমতার নিকটবর্তী হতে থাকি, আমাদের হৃদয়ের যে স্থানে স্রষ্টার অবস্থান, আমরা সে স্থানের সন্ধান পেয়ে যাই। এলোমেলো বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা যে সিদ্ধান্তে আমাদের পৌঁছে দিতে চায়, আমরা যদি তাতে বিচলিত না হয়ে আমাদের হৃদয়ের ইশারায় চলি, তবে যাকিছু আমাদের জন্য মঙ্গলজনক, তাকিছুই আমাদের জীবনে আসে। আমরা যখন প্রার্থনা করি, তখন কী ঘটে? আমাদের হৃদকম্পন, আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস, আমাদের সমস্ত অনুভূতি একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে স্রষ্টার কাছে নিজেকে অভিন্ন সত্তায় সমর্পণ করে। প্রার্থনার অচিন্ত্য শক্তি মানুষের নিয়তিকেও বদলে দিতে পারে। প্রার্থনা হলো নিজের বিশ্বাস ও আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তোলার যাদু।

নয়। স্রষ্টার ধারণা আমাদের মধ্যে কখন এল? কীভাবে এল? কেন এল? স্রষ্টা কোথায় থাকেন? স্রষ্টাকে আমরা আমাদের প্রার্থনায় খুঁজি, প্রণতিতে কল্পনা করি। আমাদের ভালোবাসায় স্রষ্টা বাস করেন, আমাদের সকল সৎ কাজে স্রষ্টাকে স্মরণ করি, একান্ত আনুগত্যের ভেতর দিয়ে যেন তাঁর কাছে পৌঁছে যাই, স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় স্বর্গে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জীবন কাটাই। এরপর যখন আমাদের চারপাশের পৃথিবীর দিকে তাকাই, তখন দেখি সহিংসতা আর ঘৃণার রাজত্ব, কপটতা আর বিশ্বাসঘাতকতার জয়জয়কার। অবিচার আর নিষ্ঠুরতা আমাদের বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়, ধর্ম নিয়ে মানুষের বর্বরতা বিশ্বাসীদের প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়, বর্ণবাদ আর বৈষম্য প্রতারকদের ওপরের তলায় ওঠায়, মানুষ জীবিত অবস্থাতেই কবরের অন্ধকারে বাস করে আর সেখানে সুখ খোঁজে, কাম আর কামনার আগুনে প্রতিনিয়তই স্বেচ্ছাদহনে দগ্ধ হতে থাকে। মিথ্যেবাদীদের পৃথিবী বুদ্ধিমান বলে ডাকে, নিষ্পাপদের বলে নির্বোধ, যারা কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই, তাদের পৃথিবী ডাকে সুবিধাবাদী বলে। স্রষ্টা প্রার্থনাকক্ষে বাস করেন না, প্রার্থনাকারীদের হৃদয়ে বাস করেন। দূরের কোনো নির্জন পাহাড়ে, দ্বীপে, উপত্যকায় বা তীর্থক্ষেত্রে গেলে স্রষ্টার খোঁজ পাওয়া যাবে না, নিজের হৃদয়ের গোপন মণিকোঠায় স্রষ্টার সৃষ্টিপ্রাচীন অধিষ্ঠান। অপার্থিব পরম শান্তির খোঁজ আমাদের হৃদয়ের ভেতরেই, আমাদের ক্ষমতার পরিমাণ আর পরিধি আমাদের সকল কল্পনার চাইতেও বেশি, আমরাই আলো, আমরাই আঁধার, যে আঁধারের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করে চলেছি, সে আঁধার আমাদের হৃদয়ের ভেতরেই, যে আলোর খোঁজে আমরা জীবন কাটাই, সে আলোটাও হৃদয় থেকেই আসে। আমাদের মহত্তম সৃষ্টি কিংবা ভয়ঙ্করতম প্রলয় দুইই আসে আমাদের মধ্য থেকেই। স্রষ্টা আর আমরা—এর মাঝে আর কিছু নেই, আমরা ভুল করে কিছু একটাকে নিয়ে এসে বিপত্তি বাড়াই। কোনো ধর্মগুরু, কোনো ধর্মালয়, কোনো প্রার্থনাপুস্তক, কোনো ধর্মীয় সংস্কার, কোনোকিছুই আমাদের স্রষ্টার কাছে নিয়ে যেতে পারবে না যদি আমরা আমাদের মনকে স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভের জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে না পারি। আমাদের হৃদয়ের যতো কাছাকাছি আমরা যেতে পারবো, স্রষ্টার ততো কাছে আমরা থাকতে পারবো। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের রীতি, আমাদের প্রথা, আমাদের আচার সবকিছুই আমাদের জীবনদর্শনের সাথে মিল রেখে গড়ে ওঠে। কোনো ধর্মদর্শনই শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট নয়। প্রত্যেক ধর্মেই অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আর সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারী, তার কাছে তার ধর্ম যথেষ্ট। এই সত্যটা মানতে আমরা যতো কুণ্ঠিত হবো, ততো অনর্থক সংঘাতের উদ্ভব হবে। এরূপ সংঘাত বা দ্বন্দ্ব যেকোনো ধর্মেরই মূল দর্শনের পরিপন্থী। অন্যের দর্শনকে আহত করে কিংবা ছোট করে আমরা যতো নিখুঁতভাবেই প্রার্থনা করি না কেন, স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব নয়। আমাদের হৃদয় আমাদের প্রার্থনাঘর। সে ঘরে শান্ত সমাহিত হয়ে নিজেকে চারপাশের জগত ও অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের সামনে তুলে ধরতে হয়। এই হৃদয়ের শুদ্ধতাই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রকাশ করে। আমরা যখন বলি, আমরা স্রষ্টাকে ভালোবাসি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসাই প্রকাশ করি। স্রষ্টাকে ভালোবাসার অর্থই হল, স্রষ্টা নির্দেশিত মহৎ গুণগুলি নিজের হৃদয়ে অনুভব করা। এমন ভালোবাসা নিজেকে শুদ্ধ করে। আমরা যদি আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করি, তবে আমাদের কাজগুলি আমাদের প্রার্থনার মতো পবিত্র ও আন্তরিক হয়ে ওঠে, আমাদের ভাবনাগুলি আমাদের হৃদয়ের সবচাইতে মহৎ বৃত্তিগুলিকে তুলে ধরে। যে উপায়ে আমরা আমাদের নিজেদের সবচাইতে সুন্দর রাখতে পারি, সে উপায়টি অনুসরণ করতে যা যা করা প্রয়োজন, তার সবকিছুই আমরা করি। স্রষ্টার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাদের সুন্দর করে ভাবতে শেখায়, এতে আমাদের নিয়তগুলি নিখাদ, নিষ্কলুষ ও দৃঢ় হয়, আমাদের শরীরে ও মনে এক আশ্চর্য শক্তি সঞ্চারিত হয়, আমাদের যাপিত জীবনকে আমরা সুন্দর ও সত্য পথে পরিচালিত করি। এসবকিছু আমাদের শান্তি দেয়, আমাদের মনে স্বস্তি বাড়ায়। আমাদের মানসিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের ও পৃথিবীর কল্যাণ করতে পারি। এই ভালথাকা ও ভালরাখাই সবচাইতে উত্তম প্রার্থনা। নিজে সুন্দরভাবে বেঁচে অন্যকে সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করাই সকল ধর্ম, মত ও পথের সারকথা। তাই, স্রষ্টাকে ভালোবাসা মানে নিজেকেই ভালোবাসা। এই ভালোবাসার মধ্য দিয়েই প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান মেলে। পৃথিবীর সব বইয়ের সবকটা অক্ষর মিলেও এর সিকিভাগ জ্ঞানের খোঁজও দিতে পারবে না। আমরা যখন আমাদের অহং নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তখন আমরা নিজেদের সুন্দরতম সত্তাটার খোঁজ কিছুতেই পাই না। সেসময় অন্ধকারের পুরু অস্পষ্ট পর্দা এসে আমাদের সামনের আলোর পথকে আড়াল করে রাখে। অদ্ভুত এক আঁধারে আমাদের ভেতরবাহির আচ্ছন্ন হয়ে যায়। যখন সে ঘন আঁধার সরে যায়, তখন ঐশী আলোর ঝর্ণাধারা হৃদয়ের সবকটা দীপ একে-একে জ্বালিয়ে দেয়। উপাসনালয়ের সবকটা বাতি জ্বালিয়ে যেমনি করে পবিত্র মনে একাগ্রচিত্তে স্রষ্টাকে ডাকা যায়, তেমনি হৃদয়ের সবকটা প্রকোষ্ঠে আলো জ্বালিয়ে প্রাণের ঐকান্তিক সাধনায় সিদ্ধিলাভের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। স্রষ্টা কোনো ধর্ম চেনেন না, কোনো প্রার্থনাগৃহের কাঠামোর নির্দিষ্টতা তাঁকে বাঁধতে পারে না। স্রষ্টা শুধু হৃদয়ের নৈবিদ্যে তুষ্ট হন। স্রষ্টার সে প্রসাদেই মানুষ পরম সুখের সন্ধান পায়।

দশ। পুরো পৃথিবী জুড়ে নানান বিশ্বাস ও মতের উপর ভিত্তি করে স্রস্টার বিভাজন ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে, সে দ্বন্দ্ব মানুষকে স্রষ্টার প্রকৃত ধারণা ও অনুগ্রহ থেকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কাছেই জীবন রহস্যের একেকরকম ব্যাখ্যা আছে। এসব ব্যাখ্যার কোনোটাকেই উদ্ভ্রান্ত উদ্ভট বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না, কারণ এগুলিকে ধারণ এবং অনুসরণ করেই এসব গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের মতো করে ভালভাবে জীবনযাপন করে আসছে পুরুষানুক্রমে। জীবনের অর্থ সময়ের সাথে-সাথে জীবনের অভিজ্ঞতা আর প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত হয়। একইভাবে সত্য কী আর মিথ্যা কী, এর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। মানুষ যখন সুন্দর মন নিয়ে প্রার্থনাগৃহে যায়, তখন মানুষ প্রকৃতপক্ষে আন্তরিকতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস এবং মানবিক গুণাবলিকে সাথে নিয়ে সেখানে যায়, যেমনি করে মানুষ তার পরম বিশ্বস্ত বন্ধুকে তার সাথে রাখতে ভালোবাসে ও নিরাপদবোধ করে। এরপর যখন মানুষের সাথে স্রষ্টার একটা যোগাযোগ তৈরি হয়, তখন তার কৃতিত্ব পুরোটাই মানুষের হৃদয়ের, যা সেই প্রার্থনাগৃহে মানুষকে পরম মমতায় সঙ্গ দিয়েছে। আমরা যতোই স্রষ্টার কাছাকাছি চলে যাই বলে ভাবি, প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের নিজেদের হৃদয়ের অসীম শক্তির ততোই কাছে যেতে থাকি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে একেকজন একেকরকম করে ভাবে। এই যেমন, ঈশ্বর সবজায়গায় আছেন, ঈশ্বর সবার হৃদয়ে আছেন, ঈশ্বরের সাথে একাত্ব হয়ে মিশে যাওয়া যায়, ঈশ্বর আমাদের বন্ধু, মনেপ্রাণে ডাকলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়, ঈশ্বরের অনেক রূপ আছে, ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন, এরকম আরো অনেক অনেককিছু। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন কোনো অসহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাসী মানুষ অন্যমত এবং অন্যপথের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে, নিজের ধর্মমতকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, ধর্মকে উপজীব্য করে ব্যবসা করে, যুদ্ধ করে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই এমন সংঘাতময় পরিস্থিতি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজকে বারবার সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জীবন ও ধর্মদর্শন সম্পর্কে ভিন্ন চিন্তা বা উপলব্ধি থাকতেই পারে, যে পথে চললে নিজের মতো করে ভাল থাকা যায়, সে পথে যেকেউই চলতে পারে, তবে সেটা কারো শান্তি নষ্ট করে নয়, জীবন সম্পর্কে কারো অনুভূতি আর বিশ্বাসকে আহত করে নয়। থাকুক না যে যার মতো করে ভাল! চলুক না যে যার স্বচ্ছন্দ বিশ্বস্ত অভ্যস্ত পথে! যদি আমরা অন্যদের ভিন্নতা মেনে না নিই, তবে আমরা কীভাবে আশা করি যে অন্যরা আমাদের ভিন্নতা সহজে মেনে নেবে? অন্য মত আর পথের প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষ বড় হয়, নিজের ধর্মকে অধিকতর আদৃত করে। স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভের পথ শান্তি, বিনয় আর সহিষ্ণুতায় গড়া। সেখানে ঔদ্ধত্য, অহংকার কিংবা গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। ধর্ম, মত বা পথ যা-ই হোক না, প্রত্যেক পন্থাই মূলত এমন এক যাত্রাপথের সন্ধান দেয়, যে যাত্রা নিজের ভেতরের সত্তাটাকে জাগ্রত করার যাত্রা। স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করার মানেই হল, নিজের ভেতরে এক পবিত্র শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করা, যে শক্তি মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, মানুষের কল্যাণ করতে শেখায়, আত্মার অসীম সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে, জীবনকে শান্তি আর স্বস্তির আশ্রয় দেয়। মানুষ পুরো পৃথিবী জুড়ে স্রষ্টার খোঁজ করতে-করতে ব্যর্থ ক্লান্ত হয়ে শেষে নিজের মধ্যেই তাঁকে অনুভব করে। এ এক অদৃশ্য শক্তি, যেটার উপস্থিতি একমাত্র সেই টের পায়, যার মধ্যে এ শক্তি অবস্থান করে। কোন ব্যক্তির ভেতরে কোন শক্তির রাজত্ব, তা ওই ব্যক্তি বাদে আর কেউ সঠিকভাবে জানতে পারে না। আপনি আসলে কী, সেটা এক আপনি ছাড়া আর কেউই কোনোদিন জানবে না। কারো শক্তি এবং দুর্বলতার জায়গাগুলি ঠিক কোথায়, সে খোঁজ ওই ব্যক্তি ছাড়া আর কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি যে সুখ আর শান্তি ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দেয়, তা ব্যক্তির জীবনচর্যা, দর্শন আর বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। কেউ যখন মুখে মানবতার কথা বলে, ভালমানুষ হওয়ার কথা ভাবে, কিন্তু সেসবের প্রতি তার প্রকৃত আন্তরিকতা থাকে না, তখন তার কথা আর ভাবনাগুলি প্রার্থনালয়ের ঘণ্টাধ্বনির মতোই শোনায়, যার কাজ শুধুই ধ্বনিত হওয়া—অর্থহীনভাবেই। যে ধ্বনি ঘণ্টা নিজেই ধরে রাখতে পারে না, হাওয়ায় মিলিয়ে যায় দূরদূরান্তে, কতটুকুই বা তার ক্ষমতা? যদি এমনও হয়, পৃথিবীর সব জ্ঞান আর বিদ্যা কেউ নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলতে পারে, তার নিজের ক্ষমতার উপর এমনই অটল বিশ্বাস থাকে, যে বিশ্বাসে পর্বত পর্যন্ত নড়ে যায়, অথচ হৃদয়ে ভালোবাসাটাই রাখতে না পারে, তবে তার সকল ঐশ্বর্য মিলেও তাকে কিছুই দিতে পারে না। আমাদের যাকিছু আছে, তার সবটুকুই যদি যাদের কিছুই নেই, তাদের মধ্যে বিলিয়েও দিই, নিজেদের সেই কষ্টে রাখি যে কষ্ট ইবাদতের সমান, তাও আমরা বেশিদূর এগোতে পারবো না, যদি আমার মনে ভালোবাসার ঝর্ণা না থাকে, কিংবা সে ঝর্ণা শুকিয়ে যায়। ভালোবাসার কোনো ধর্ম নেই, অথচ সব ধর্মের মূলভিত্তিই হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা দয়া আর সহমর্মিতার দীক্ষা দেয়, ধৈর্য ধরে বাঁচতে শেখায়, সকল ঈর্ষা আর দম্ভ থেকে আমাদের দূরে রাখে, নিজের ভেতরের সুন্দরটাকে চোখের সামনে নিয়ে আসে, অন্যের প্রতি সম্মান আর সহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে। ভালোবাসা পাপকে দূরে ঠেলতে শেখায়, সত্যকে আলিঙ্গন করতে শেখায়। ভালোবাসা আশ্রয় দেয়, বিশ্বাস জন্মায়, আশা জাগায়, ধৈর্য বাড়ায়। এ এক রহস্যময় শক্তি, যা আমাদের পরিচালিত করে। আমরা শ্বাস নিই, আমাদের শরীরে রক্ত চলাচল করে, আমাদের স্নায়ুগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের সাড়া দেয়, এই সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এক অসীম শক্তির প্রভাবে। সে শক্তিকে ভালোবাসলে, নিজের মধ্যে সে শক্তির উপস্থিতি অনুভব করলে, আর নিজেকে সে শক্তিতে জাগিয়ে তুললে সুন্দর শান্তিময় স্বস্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা সহজ।

এগারো। কখনো-কখনো নিজের ভেতরের আমি’টার কথা শুনতে হয়। যখন কোনোভাবেই একটা সমস্যার কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না, যখন সমাধানের সব পথই বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়, তখন নীরবে নিভৃতে চুপচাপ নিজের মন কী বলে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হয়। সেসময় কিছু না বলাটাই সবচাইতে সুন্দর কথাটির চাইতেও ভাল কোনো উপায় বলে দিতে পারে। যখন হৃদয় একেবারে ভেঙ্গেচুরে যায়, যখন সব আলো একে-একে নিভে যায়, যখন মনের সাথে যুদ্ধ করে শরীরও আর পেরে ওঠে না, তখন হৃদয়কে তার নিজের পথেই চলতে দিতে হয়। আমাদের ইগো, আমাদের অহমিকা, আমাদের অর্জন, আমাদের প্রজ্ঞার আস্ফালন, আমাদের জাত্যাভিমান, আমাদের অবস্থান—এই সবকিছুকে দূরে সরিয়ে রেখে শূন্য মনে রিক্ত হাতে স্রষ্টাকে খুঁজতে হয়। স্রষ্টার পথে যাত্রা শুরু করতে হয় শূন্য থেকে। ভারাক্রান্ত হৃদয় আলোর বোঝাটাও যেন সহ্য করতে পারে না। নিজের ভেতর থেকে নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে রেখে ভেতরটা স্রষ্টার অস্তিত্বের অনুভূতি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিতে হয়। হৃদয়ের চাইতে বড় উপাসনালয় আর নেই। স্রষ্টার অনুগ্রহের সন্ধানে এক হৃদয় সঁপে দিলে লক্ষ হৃদয়পদ্ম প্রস্ফুটিত হতে থাকে। সুন্দরের খোঁজে যে মানুষ সারা পৃথিবী ঘুরে মরল, অথচ এক মুহূর্তের জন্যও নিজের হৃদয়ের দিকে তাকানোর সময়টুকু পেলো না, সে বড় দুর্ভাগা। জীবনের সবচাইতে গুরুত্ববহ প্রশ্নগুলির উত্তর একমাত্র নিজের হৃদয়ের কাছেই পাওয়া যায়। এই হৃদয়মন্দিরই সত্য ধ্রুব, এখানেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। সব হৃদয়ে স্রষ্টা আসন পাতেন না, যে হৃদয় সকল অহংকার আর দম্ভ ভুলে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করতে জানে, স্রষ্টার প্রিয় স্থান সেটিই। স্রষ্টা বাস করেন মানুষের চেতনা, সুবুদ্ধি আর বিবেকের মধ্যে। আমাদের সকল কাজ ও ভাবনার আগে বা পরে, আমাদের চারপাশে, আমাদের ঘুম কিংবা জাগরণে, আমাদের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীদের হৃদয়ে, আমাদের চোখে কিংবা আমাদের বন্ধুদের দয়ার্দ্র চোখে, আমাদের সকল ভাল উদ্দেশ্য ও ভাল কাজে স্রষ্টার আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের ছাপ সুস্পষ্ট। যখন আমরা স্রষ্টার প্রশস্তি গাই, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের হৃদয় পরিশুদ্ধ করি, আমাদের চিন্তাভাবনা সুন্দর হয়, আমাদের মনে আনন্দ খেলা করে, নিজেদের এবং চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একটা দারুণ অনুভূতি জন্মে, সুন্দর ভাবনা ও সুন্দর উদ্দেশ্য আমাদের কাজকে সুন্দর করে, আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেটা ভাল ও সুন্দর। যাকিছু সুন্দর, তাকিছু শান্তি দেয়ই, এমনটা নাও হতে পারে; তবে যাকিছু শান্তি দেয়, তাকিছু নিশ্চয়ই সুন্দর। সুন্দর আলোর নাচনে আঁধারের রাজ্য লুপ্ত হয়ে যায়। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা নিজের ভেতরের সুন্দর সত্তাটির জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যদি বিবেকের এমন উদ্বোধন দূরের পাহাড়ে সাগরে গুহায় প্রার্থনাগৃহে কিংবা কোনো নির্জন নিভৃত স্থানে হয়, তবে আমরা সে স্থানকে পবিত্র বলি, হৃদয়ের টানে সে স্থানে ছুটে যাই। যেখানে গেলে হৃদয়ের সুপ্তাবস্থার অবসান হয়, সে স্থানকেই আমরা বলি তীর্থ। মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডা কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মালয় আমাদের ততক্ষণ পর্যন্ত স্রষ্টার সান্নিধ্য দিতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের হৃদয়কে জাগাতে না পারছি। বিভিন্ন মায়া আর অজ্ঞতার কারণে আমরা আমাদের বাহ্যিক পৃথিবীতে শান্তি, ভালোবাসা, সুখ আর স্বস্তি খুঁজে বেড়াই। এতে আমাদের মধ্যে হতাশা, বিষণ্ণতা, বৈষম্য, মিথ্যে আত্মপ্রসাদ আর বিমর্ষতার বীজ রোপিত হয়, কারণ আমরা আমাদের ভেতরের ভালোবাসা আর মঙ্গলবার্তার যে অফুরান স্রোতধারা, সে ধারার আবর্তে এক চির আগন্তুক হয়েই জীবন কাটিয়ে দিই। যতো বেশি বাইরের পৃথিবীর ঐশ্বর্যে আমরা শান্তি খুঁজি, স্রষ্টা আর আমাদের মাঝের দেয়ালটা ততো বেশি মজবুত হয়। ক্রমশই সে দেয়াল স্রষ্টা, তথা আমাদের হৃদয় থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। হৃদয়ের চোখ যখন খুলে যায়, তখন আমরা উপলব্ধি করতে পারি, যে অবারিত শান্তির মহাসমুদ্র আমাদের মধ্যে নিরবধি বয়ে চলেছে, হয়তো তার বিন্দুমাত্রের খোঁজে আমি এতদিন ধরে হাতড়ে মরছি। আমাদের হয়তো একটা ভাল বাড়ি নেই, একটা ভাল গাড়িতে আমরা কখনোই চড়তে পারবো না, দামি খাবার খাওয়ার সামর্থ্য হয়তো আমাদের এ জন্মে আর হবেই না, পৃথিবীর চমৎকার সব জায়গা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য আমাদের কোনোদিনই হবে না, বহুমূল্য কাপড় বা অলংকার আমাদের শোভাবর্ধন করবে না কোনোদিনই; ধরেই নিচ্ছি, যেসব বাহ্যিকতা থেকে লোকে শান্তি খুঁজে বেড়ায়, তার কোনোকিছুই আমাদের নেই; তবে আমাদের মধ্যে হৃদয়ের আলো আছে, আমাদের সুন্দর গুণগুলি আমাদের হয়েই চিরকাল থেকে যাবে, আমরা আমাদের স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে বাহ্যিক জাগতিক মোহের শেকল থেকে মুক্ত করতে পারি। প্রকৃতি আমাদের সুন্দর পাহাড় আর উপত্যকা উপহার দিয়েছে, রাতের আকাশে তারার আলো আমাদের মোহিত করে রাখে, সূর্য আর চাঁদের কিরণ আমাদের গা ধুয়ে দেয়, নানান ঋতুতে দিনরাত্রির বৈচিত্র্য আমাদের স্রষ্টার অসীম রহস্যময়তা নিয়ে ভাবায়, আগ্নেয়গিরির উদ্গিরন কিংবা এক পশলা বৃষ্টির পরের রংধনুটা, মেঘ আর হাওয়ার মিতালি, সুন্দর ফসলের মাঠ, কলকল ধারায় বয়েচলা নদী, আকাশে পাখির রঙিন ওড়াওড়ি, সাগরের বুকে পালতোলা নৌকার ভেসে চলা, শিশুর আশ্চর্য জন্ম, এই সবকিছুই কোনো এক অদৃশ্য দুর্জ্ঞেয় প্রচ্ছন্ন শক্তির প্রতি আমাদের অনুগত করে দেয়। আমরা সে শক্তির আরাধনা করি, সে শক্তির সান্নিধ্য পাওয়ার সাধনায় নিজেকে নিবেদন করি। যখন আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে ঐশ্বর্যের যে অতল সাগর, সেখানে ডুব দিই, তখন আমাদের মধ্যে এই গাঢ় অনুভূতি আর প্রতীতি জন্মে যে, আমরাই সেই আরাধ্য শক্তির আদিমতম প্রমাণসিদ্ধ আধার। এক অন্তর্জাত অপার্থিব আনন্দের স্রোত আমাদের নিরত করে দেয়, জ্ঞানের স্বর্ণপথে নত মস্তকে নীরবে চলতে শেখায়।

বারো। পৃথিবীকে বদলে দিতে হলে প্রথমেই আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে, এতে আমাদের চারপাশের সবাই বদলাবে—পরিবার বদলাবে, সমাজ বদলাবে, দেশ বদলাবে, একসময় পৃথিবীও বদলাবে। চেতনাপ্রবাহের শুরুটা হতে হবে নিজেকে দিয়ে। নিজে জাগলে নিজের পৃথিবীটাও জাগবে। প্রত্যেক ধর্মই মূলত এই জাগানোর কাজটা করে দেয়। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার বা নিজের হৃদয়ের সাথে আমাদের বাহ্যিক সত্তার একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়। চিন্তাভাবনা ও কাজের পরিধি ধীরে-ধীরে বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে সুস্থির রৈখিক ছন্দে এসে যায়। ধর্ম আমাদের সুন্দর ভাবনা ও ভাল কাজের মধ্য দিয়ে অপার আনন্দের সন্ধান দেয়। ধর্মদর্শন এই দুর্বোধ্য দুর্জ্ঞেয় রহস্যাবৃত আনন্দলোকে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে। যে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিজের হৃদয়ে অনুভব করে না, সে পৃথিবীর সকল পবিত্র স্থান ঘুরেও স্রষ্টার অনুগ্রহের সামান্যতমের সন্ধানটুকুও পায় না। আমাদের সকল প্রার্থনাই তাই নিজেকে জাগিয়ে তোলার পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যে খোলসে নিজেদের লুকিয়ে রাখি, যে বাহ্যিক প্রবৃত্তিসমূহ আমাদের হৃদয়কে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে, সে মেকি খোলস ছেড়ে বাইরে আসার নাম জাগতিক অনুভূতির মৃত্যু। এমন মৃত্যু আমাদের আলোর পথে জাগিয়ে তোলে, শান্তি ও সুখের জন্য যে পথে চলা প্রয়োজন, পার্থিব অনুষঙ্গের ভারমুক্ত হয়ে আমরা সে পথে চলার মতো করে নিজেদের প্রস্তুত করি। অযাচিত অর্থহীন জীবন ছেড়ে নতুন জীবনে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য এমন পুনরুত্থানের স্বার্থে বর্তমানের সকল স্বয়ংবিরুদ্ধ অবস্থার মৃত্যু ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। কাঙ্ক্ষিত পুনরুত্থান বা নবজন্মের স্বার্থে বর্তমান সত্তাটির মৃত্যু জরুরি। আমাদের চারপাশের সবকিছুকে এখন যেমন আছে, তেমনই রেখে দিয়ে, এখন আমরা যা যা করছি, যেভাবে করছি, সেগুলি সেভাবেই করে নিজেকে নতুন রূপে দেখার দিবাস্বপ্ন দেখি। এটা কখনোই হয় না। বর্তমানের আরামপ্রদ জীবনযাপনের মৃত্যুর মাঝেই নতুন জন্মের সূচনা ঘটে। এই মৃত্যু হলো পুরনো অভ্যস্ততা থেকে বেরিয়ে আসা, সুখকর অভিজ্ঞতার বলয়ের বাইরে অসীম দুঃসাহসে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়া, অভিনব পথে হাঁটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, যা কখনোই আমার ছিল না, এখনো আমার নেই, কিন্তু আমার মধ্যে যার উপস্থিতি আমার একান্ত প্রয়োজন, তাকে আলিঙ্গনের স্পর্ধা দেখানো, ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে নিজেকে উন্নীত করা, ক্ষণিকের সুখ ও আনন্দকে বিসর্জন দিয়ে অবারিত শান্তির পথে যাত্রা করা, মোহনীয় অকল্যাণ ও অমঙ্গলের অথৈ সমুদ্র থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে কণ্টকাকীর্ণ সত্যের পথে হাঁটার কঠোরতম পরীক্ষা দেয়া। আমরা যখন প্রার্থনা করি, তখন আমরা মূলত আমাদের সাথে স্রষ্টার একত্ব কল্পনা করি এবং নিজেদের স্রষ্টার অনুগ্রহলাভের জন্য প্রস্তুত করি। এ প্রস্তুতি হলো নিজেদের মন ও হৃদয়কে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি। এ প্রস্তুতির প্রথম ধাপই হলো বর্তমান ভুল সত্তার মহিমান্বিত ইচ্ছামৃত্যু।

তেরো। স্তব্ধতার যাদু বিস্ময়কর। যেখানে নৈঃশব্দ্য নেই, যেখানে শব্দের মিছিল এগোয় অবিরাম, সেখানে সবচাইতে অপূর্ব শব্দমালাও নিরর্থক। শোনার মতো শুনতে না জানলে, কিংবা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে না জানলে পৃথিবীর সুন্দরতম কথাও কারো মনের ক্ষত সারাতে পারে না। কখনো-কখনো দূরত্বের অনুপস্থিতি নিরন্তর নৈকট্যকে অর্থহীন করে দেয়। হৃদয়ের বোঝা কমিয়ে নিজেকে হালকা করে স্রষ্টার অনুগ্রহলাভের জন্য প্রস্তুত করতে স্তব্ধতার কাছেই বারবার ফিরতে হয়। স্রষ্টার কাঁধে নিজের সকল বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজ করে যাওয়াই প্রার্থনা। তখন একই দেহে দুটো ভিন্ন সত্তা কাজ করে। একটা সত্তা স্রষ্টার হয়ে বোঝা বহন করে, আরেকটা সত্তা হালকা কায়ায় নিরলস কাজ করে যায়। আমরা যখন জাগি, তখন এক আলোকিত উজ্জ্বল মশাল পৃথিবীতে আলো ছড়াতে থাকে। সে আলোর প্রচণ্ড ছটায় আমাদের আত্মার শুদ্ধি আসে। আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তার পরিকল্পনা আমাদেরকেই করতে হয়। যদি আমাদের জীবনের ছকটা আমরা নিজেরা না সাজাই, তবে অন্য কেউ সে ছকটা তার নিজের সুযোগসুবিধে মতো সাজিয়ে নেবে। আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকি, না জাগি, তবে আমরা একসময় অন্য কারো ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস হিসেবে নিজেদের দেখতে পাবো। সময় থাকতে নিজের ভাগ্যের প্রভুত্ব নিজের হাতে সমর্পণ না করলে একসময় অন্যের ভাগ্যের ভৃত্যত্ব বরণ করে নিতে হয়। স্রষ্টার নির্দেশ প্রকৃতপক্ষে নিজের বিবেকের সুপ্ত স্বর্গীয় অনুজ্ঞা। নীরব চিত্তে শান্ত হৃদয়ে ভালোবাসা আর মানবপ্রেমকে উপজীব্য করে বিবেকের অনুশাসন শুনতে হয়। মনের ঐশ্বর্যের উদ্বোধনের মাধ্যমেই অভীষ্টের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। অবিচারের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে শক্ত করে, আপাত সুখকে বিসর্জন দিয়ে, দয়া আর দরদকে সাথী করে স্রষ্টার কৃপা গ্রহণ করতে হয়। নিরাশার নিরালোক রাত সরিয়ে জীবনে আশার আলো খেলে, ভোরের মাহেন্দ্রক্ষণে ক্ষয়িষ্ণু হৃদয় সতেজ হয়ে ওঠে, স্রষ্টার সৌন্দর্য আর উৎকর্ষের ছোঁয়ায় নীরবিন্দুও সাগরের বিশালতা লাভ করে, ঐশী আলোর স্পর্শে জোনাকির ক্ষীণ আলোককণাও তেজোদীপ্ত তারকার চাইতেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে। এমন সব ইন্দ্রজালে নিজেকে বাঁধতে হয় হৃদয়ের ঐকান্তিক বিশ্বাস আর ভালোবাসার অমিয়ধারায় সিক্ত হয়ে। যে মানুষ নিজের শক্তি সম্পর্কে উদাসীন, কিংবা নিজের শক্তিকে অব্যবহৃতই রেখে দেয়, তার সাথে শক্তিহীনের পার্থক্য অতি সামান্যই। চিরন্তন সত্যের পথে মুসাফির হয়ে চলতে নিজের ভ্রান্ত সত্তার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার অসীম সাহস আর ধৈর্য লাগে। এমন আত্মিক মৃত্যু নতুন জন্মের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার প্রাথমিক ধাপ। এ মৃত্যুর মধ্য দিয়েই নতুন জীবনের সূচনা ঘটে। সদ্যগত অতীত যেমনি করে সবসময়ই বর্তমানের পায়ে শেকল পরিয়ে দিতে চায়, তেমনি করে সে মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের মুহূর্তেও মৃত্যুর নিশ্চিন্ত দুর্নিবার আকর্ষণ পিছু ডাকতে থাকে। সে আকর্ষণকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা যার যতো বেশি, সে ততো বেশি আত্মশক্তিতে পরিপূর্ণ।

চৌদ্দ। কোনটা সুন্দর, কোনটা অসুন্দর, এটা চটজলদি বলে ফেলাটা সম্ভব নয়। কারো চোখে যা সুন্দর, অন্যকারো কাছে সেটাকে অসুন্দর মনে হতে পারে। কোনোকিছুকে দেখেই, সুন্দর নয়—এমন রায় দিয়ে দেয়াটা একধরনের মূর্খতা আর ঔদ্ধত্য। প্রত্যেক ভালকিছুর মধ্যেই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তার যতটুকু চোখে দেখা যায়, ততটুকু হয়তো আপাতদৃষ্টে অসুন্দর, অতটুকু দেখেই দ্রুত সেটাকে বাতিল করে দেয়ার মীমাংসা নিম্ন ব্যক্তিত্ব্যের পরিচয় দেয়। যে হৃদয় সুন্দর, সে হৃদয় অকপট, দারুণ, স্বচ্ছ। অমন হৃদয় যার, সে নিজের প্রতিই শুধু নয়, পুরো মানবতার প্রতি দয়ালু ও সুবিচারক। হয়তো তার পকেটে টাকা নেই, কিংবা অল্প সঙ্গতি নিয়েই তাকে কায়ক্লেশে বাঁচতে হয়, তবু তার হৃদয়ের ঐশ্বর্য সবাইকে স্পর্শ করে। সুন্দর চেহারার মানুষ যেসময়ে তার সৌন্দর্যের অহংবোধে নিজেই নিজের ভেতরে-ভেতরে পুড়তে থাকে, একই সময়ে সুন্দর হৃদয়ের মানুষ তার ঔজ্জ্বল্য চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। শরীরের পবিত্রতা থেকে হৃদয়ের পবিত্রতা অনেক বেশি জরুরি। আমরা শরীরকে পবিত্র রাখতে, সুন্দর রাখতে কতকিছু করি, অথচ হৃদয়ের পরিচর্যা করি কয়জন? মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডা ঝকঝকে তকতকে করে রাখি আর নোংরা হৃদয়ে সেখানে গিয়ে পরিষ্কার জায়গায় বসে প্রার্থনা করি। এতে কি স্রষ্টার অনুগ্রহ পাওয়া যায়? উপাসনালয়ের পরিচ্ছন্নতা আর হৃদয়ের পবিত্রতা—এই দুইয়ের সহাবস্থানে প্রার্থনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। স্রষ্টা বাস করেন আমাদের হৃদয়ে, প্রার্থনাঘরে নয়—সে জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখতে হয়, পবিত্র রাখতে হয়। যখন আমরা কাউকে আঘাত করি, কারো মনে কষ্ট দিই, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে তার ভেতরের স্রষ্টাকেই আঘাত করি। আহত মানুষের হৃদয়ক্ষরণ স্রষ্টার অনুগ্রহ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়, সেসময় ক্ষমা চাইতে হয়। আমরা যখন কারো কাছে ক্ষমা চাই, তখন আমরা আসলে তার হৃদয়ে যে স্রষ্টার অধিষ্ঠান, সে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাই। আমরা ক্ষমা পাই হৃদয়স্থিত স্রষ্টার কাছ থেকে, ব্যক্তির কাছ থেকে নয়। যার হৃদয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব যতো ক্ষীণ, তার ক্ষমা করার ক্ষমতা ততো কম। যে ক্ষমা করতে পারে, সে তার ক্ষোভ আর জেদের গনগনে আগুন থেকে মুক্ত হয়ে যায়, এবং নিজেকে পালকের মতো হালকা করে স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভের দিকে এগিয়ে যায়। ক্রোধ ক্রুদ্ধ ব্যক্তিকেই পুড়িয়ে মারে। অন্যকে ক্ষমা করে দেয়ার মধ্য দিয়ে অন্যের প্রতি রাগ আর বিদ্বেষের দুর্বহ ভার থেকে আমাদের হৃদয় মুক্তি পায়। সেসময় নিজের জীবনের প্রতিটি সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের রাস্তায় রিক্ত হাতে খোলা মন নিয়ে হেঁটে বেড়ানো যায়। যাকিছু আমার প্রিয়, যাকিছু পেলে আমার জীবনে শান্তি ও স্বস্তি আসবে, তাকিছু আমার চোখের সামনে থাক না থাক, হৃদয়ে ধারণ করে পথ চলতে পারি। স্বপ্ন থেকে আমার বাস্তবতার যে দূরত্ব, সেটা ঘোচাতে যা যা করা প্রয়োজন, আমাদের হৃদয় তার সবকিছুই করতে প্রস্তুত হতে পারে, কারণ তখন আমি শুধু আমাকে নিয়েই পথ চলতে পারি। নিজের হৃদয়ে কারো প্রতি ঘৃণা আর রাগ ধারণ করার অর্থই হল, সেই ব্যক্তির পাপের বোঝা নিজের মাথায় বহন করে পথচলা। এরূপ অহেতুক ক্রোধ অনর্থক কষ্টের স্তূপ তৈরি করে। যাকে সহ্যই করতে পারি না, তার ভাবনায় নিজের স্বস্তি নষ্ট করার কী মানে? অন্যকে মুক্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে নিজের আত্মাকে মুক্তি দেয়া যায়। অন্যের প্রতি রাগ আর বিদ্বেষ পুষে জেতার চাইতে নিজের জন্য ভালোবাসা আর প্রার্থনা নিয়ে হারাও অনেকবেশি শান্তির।