আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সৃষ্টির যে-ধারা, সেটি সূক্ষ্ম থেকে স্থূলের দিকে যাত্রা—অর্থাৎ, চেতনার বহির্মুখ বিকাশ। আর আত্মজ্ঞান তার ঠিক বিপরীত পথ—স্থূল থেকে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্ম থেকে চেতনায়, আর চেতনা থেকে নিজের স্বরূপে ফিরে যাওয়া। এই দুই প্রবাহ—সৃষ্টি ও প্রত্যাবর্তন—বেদান্তের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। কর্মযোগ সেই প্রত্যাবর্তনের সূচনাবিন্দু, কিন্তু আত্মজ্ঞান তার পরিণতি।
তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২.১.১) বলা হয়েছে—“আকাশাদ্ বায়ুঃ, বায়োরগ্নিঃ, অগ্নেরাপঃ, অধ্যঃ পৃথিবী”—অর্থাৎ প্রথমে আকাশ, তারপর বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবীর সৃষ্টি। এই ক্রমে এক চৈতন্যময় সম্ভাবনা ধীরে ধীরে ঘন হয়ে স্থূল রূপে প্রকাশিত হয়। আকাশ ধারণক্ষম, বায়ু চলনক্ষম, অগ্নি রূপান্তরমূলক, জল সংযোজক, আর পৃথিবী স্থিতির প্রতীক। এই প্রক্রিয়াই হলো বহির্মুখ সৃষ্টি—যেখানে ব্রহ্ম বা চেতনা নাম-রূপে বিকশিত হয়ে জগৎ হয়ে ওঠে।
কিন্তু মুক্তির পথে এই প্রবাহ উলটো দিকে চলে। কঠ উপনিষদে (২.৩.১০) বলা হয়েছে—“ইন্দ্রিয়েব্যঃ পরা হ্যর্থা, অর্থেব্যশ্চ পরং মনঃ, মনসস্তু পরা বুদ্ধিঃ, বুদ্ধের্ আত্মা মহাঁ পরঃ”—অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে বিষয়, বিষয়ের ঊর্ধ্বে মন, মনের ঊর্ধ্বে বুদ্ধি, আর বুদ্ধির ঊর্ধ্বে আত্মা। এই পথেই সাধক স্থূল দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সীমা পেরিয়ে সূক্ষ্ম মন, বুদ্ধি ও চেতনার স্তরে উত্তীর্ণ হয়। এটি স্থূল থেকে সূক্ষ্মের যাত্রা—সাধকের অন্তর্মুখ প্রত্যাবর্তন।
এই প্রত্যাবর্তনের সূচনা ঘটে কর্মযোগ দিয়ে। কর্মযোগ হলো বাহ্য-জগতের মধ্যেই অন্তরের শুদ্ধি। গীতা (৩.১৯) বলে—“তস্মাদসক্তঃ সদা কর্মং কর্ম করোতি যঃ, লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিভাম্ভসা”—যিনি আসক্তিহীনভাবে কর্ম করেন, তিনি জগতে থেকেও কলুষিত হন না। কর্মযোগের মাধ্যমে মানুষ প্রথমে নিজের কর্মকে শুদ্ধ করে, তার ফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে, এবং কর্মকে ঈশ্বরার্পণ হিসেবে দেখতে শেখে। এতে মন ক্রমশ নির্মল হয়, অহং প্রশমিত হয়, এবং চেতনা অন্তর্মুখ হয়।
যখন মন নির্মল হয়, তখন জ্ঞানযোগের দ্বার খুলে যায়। গীতা (৪.৩৮) বলে—“ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে”—জ্ঞানই সর্বোচ্চ পবিত্রতা। কর্মযোগ যেখানে মনকে প্রস্তুত করে, জ্ঞানযোগ সেখানে সেই মনকে আত্মার দিকে পরিচালিত করে। এই দুই একে অপরের পরিপূরক—কর্ম শুদ্ধি আনে, জ্ঞান মুক্তি দেয়।
আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সৃষ্টির ধারা চেতনার নিম্নগমন—ব্রহ্মের বহুরূপ প্রকাশ; আর আত্মজ্ঞান সেই ধারার উলটো গতি—চেতনার নিজ স্বরূপে প্রত্যাবর্তন। কর্মযোগ এই প্রত্যাবর্তনের প্রথম ধাপ, যেখানে মানুষ বাহ্য-কর্ম থেকে অন্তর-চিন্তায় প্রবেশ করে। ধ্যান ও জ্ঞানযোগ তার পরবর্তী স্তর, যেখানে সূক্ষ্ম মন চেতনার সাগরে বিলীন হয়। আর চূড়ান্ত উপলব্ধি—যেখানে কর্তা, কর্ম ও ফল মিলিয়ে যায়—সেটিই ব্রহ্মনিষ্ঠা, চূড়ান্ত আত্মজ্ঞান।
এইভাবে—সৃষ্টি হলো চেতনার বহির্মুখ প্রবাহ, কর্মযোগ সেই প্রবাহকে অন্তর্মুখ করে, আর আত্মজ্ঞান সেই প্রবাহের অন্তিম বিশ্রাম—নিজের চিরন্তন স্বরূপে প্রতিষ্ঠা।
প্রাণ, আপান, উদান, সমান ও ব্যান—এই পাঁচটি জীবনশক্তিকে একত্রে বলা হয় পঞ্চপ্রাণ। বেদান্ত ও উপনিষদে এগুলি জীবনের সূক্ষ্ম প্রবাহ বা শক্তির রূপে বিবেচিত, যা সূক্ষ্ম শরীরের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই শক্তিগুলি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিটি শ্বাস, হৃৎস্পন্দন, পাচন, চিন্তা ও জীবনীশক্তির প্রকাশে এদের কার্য স্পষ্ট। উপনিষদ বলে—“প্রাণ এষ যঃ সর্বান্ ভূতান্যধিতিষ্ঠতি”—প্রাণই সব জীবকে ধারণ করে (প্রশ্ন উপনিষদ, ২.৫)। এই পঞ্চপ্রাণের ভারসাম্য রক্ষা করাই জীবনের স্থিতি ও স্বাস্থ্যের মূল।
বেদান্ত ও যোগদর্শনের আলোকে শ্বাস, হৃদস্পন্দন, পাচন, চিন্তা ও জীবনীশক্তি—এগুলো আসলে একটিই নীতির বিভিন্ন প্রকাশ। এরা সবই প্রাণ বা প্রাণশক্তির নানা রূপ। যেমন আকাশে একই বাতাস কোথাও ঘূর্ণি, কোথাও মৃদু হাওয়া, কোথাও ঝড় হয়ে ওঠে—তেমনি চেতনার একটিই শক্তি দেহে নানা ক্রিয়ায় প্রকাশ পায়।
শ্বাস হলো প্রাণবায়ুর স্থূল স্তর। এটি বায়ুর নিয়মিত গতি, যা দেহে অক্সিজেন এনে জীবন বজায় রাখে। উপনিষদে বলা হয়েছে—“প্রাণ এষ যঃ সর্বান্ ভূতান্যধিতিষ্ঠতি” (প্রশ্ন উপনিষদ, ২.৫)—প্রাণই সমস্ত জীবের ভিতরে অধিষ্ঠিত থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখে।
হৃৎস্পন্দন সেই প্রাণশক্তির আরেক প্রকাশ—যেখানে বায়ু হৃদয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে ছন্দ সৃষ্টি করে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, প্রাণ হৃদয় থেকে সঞ্চারিত হয়ে সমস্ত নাড়িতে প্রবাহিত হয়। তাই হৃদয়কে (হৃৎপিণ্ড) বলা হয় “প্রাণস্থল”—প্রাণের আসন।
পাচন হলো সেই অগ্নিতত্ত্বের কার্য, যা সমান বায়ুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রশ্ন উপনিষদে (৩.৫) বলা আছে—“সমানো’গ্নিমধ্যস্থঃ পচতি অন্নং”—সমান বায়ু অগ্নির মধ্যে অবস্থান করে খাদ্য পরিপাক করে। অর্থাৎ, শরীরের পাচন প্রক্রিয়া কোনো যান্ত্রিক ক্রিয়া নয়, বরং প্রাণশক্তির এক বিশেষ সমবণ্টন। এর অর্থ বোঝার জন্য একটু পটভূমি জানা দরকার।
উপনিষদে বলা হয়েছে, জীবদেহে একটিই প্রাণশক্তি নানা কার্যরূপে প্রকাশিত—শ্বাস নেওয়া (প্রাণ), নিঃসরণ (আপান), ঊর্ধ্বগতি (উদান), সমবণ্টন (সমান), ও সংযোগ (ব্যান)। এর মধ্যে সমান বায়ু দেহের নাভি অঞ্চলে অবস্থিত, এবং এর কাজ হলো দেহের ভেতরের অগ্নিশক্তিকে—যাকে জঠরাগ্নি বা হজমশক্তি বলা হয়—সমভাবে কার্যকর রাখা।
“অগ্নির মধ্যে অবস্থান” বলতে বোঝানো হয়েছে, এই বায়ু দেহের তাপ বা অগ্নিশক্তির সহায়ক। যেমন আগুনকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য বাতাস প্রয়োজন, তেমনি পাচনাগ্নিকে সক্রিয় রাখার জন্য সমান বায়ু প্রয়োজন। এই দুইয়ের মিলিত কার্যেই খাদ্য হজম হয়, খাদ্যরস সারাদেহে সমভাবে বিতরণ হয়, আর দেহে শক্তি উৎপন্ন হয়।
এখানে “অগ্নি” কোনো রূপক নয়, বরং জীবের ভিতরের রূপান্তরশক্তি—যা খাদ্যকে পুষ্টিতে, পুষ্টিকে শক্তিতে এবং শক্তিকে প্রাণে পরিণত করে। আর “সমান বায়ু” সেই অগ্নিশক্তির নিয়ন্ত্রক বাতাস—যা তাপকে ভারসাম্যে রাখে, অতিরিক্ত উত্তাপ বা শৈত্যকে প্রতিহত করে, এবং দেহের সব প্রক্রিয়াকে সমভাবে চালায়।
মানবদেহে থাকা সমান বায়ু নামক প্রাণশক্তি নাভিস্থ অগ্নির মধ্যে থেকে খাদ্য হজম করায় ও পুষ্টির সমবণ্টন ঘটায়। দার্শনিক অর্থে এটি দ্বারা বোঝায় যে, জীবনশক্তি কেবল শ্বাসে নয়, প্রতিটি কোষে ক্রিয়াশীল; চেতনা ও দেহের মধ্যে যে সমন্বয় ঘটে, তারই প্রতীক এই সমান বায়ু।
চিন্তা হলো প্রাণের সেই সূক্ষ্মতম স্তর, যা মন ও বুদ্ধির স্তরে গতি সৃষ্টি করে। যখন প্রাণ মস্তিষ্কে ও ইন্দ্রিয়পথে প্রবাহিত হয়, তখন চিন্তা, অনুভব, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি মানসিক ক্রিয়া ঘটে। তাই উপনিষদ বলে—“প্রাণবৃদ্ধি মনোবল বৃদ্ধি”—মন প্রাণের উপর নির্ভরশীল।
জীবনীশক্তি এইসবের মূল একত্ব—যা সব দিকেই প্রকাশ পায়। এটি বায়ুর মতো দেহে ছড়িয়ে থাকে, কিন্তু তার উৎস চৈতন্য। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“প্রাণঃ শরীরেষু কৌন্তেয়” (গীতা, ৭.৯)—আমি সকল জীবের প্রাণরূপে বিরাজমান।
শ্বাস দেহের স্তরে, হৃৎস্পন্দন রক্তের স্তরে, পাচন অগ্নির স্তরে, চিন্তা মনের স্তরে, আর জীবনীশক্তি আত্মার স্তরে প্রকাশ পায়। এই পাঁচ স্তর একে অপরের প্রতিফলন—সব কিছুর মূলে এক প্রাণ, এক চেতনা, যা দেহে ক্রিয়ারূপে প্রকাশিত হয়ে জীবনের ছন্দ সৃষ্টি করে।
প্রাণ (Prāṇa) শব্দের মূল অর্থ ‘জীবনশক্তি’ বা ‘শ্বাস’। এটি দেহে উপরের দিকের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষত শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎযন্ত্রের গতি। প্রাণ হৃদয় থেকে মুখ পর্যন্ত ক্রিয়াশীল, শ্বাস-প্রশ্বাস ও জীবনের স্থিতির কেন্দ্র। প্রশ্ন উপনিষদ (৩.৩) বলে—“প্রাণ এষ যঃ সর্বান্ ভূতান্যধিতিষ্ঠতি”—এই প্রাণই জীবকে জীবিত রাখে। শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন, এই প্রাণই অন্য সব উপপ্রাণকে শক্তি জোগায়; তাই একে প্রধান বলা হয়।
বেদান্ত ও যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে—প্রাণ একটাই, কিন্তু তার প্রকাশ বহু রকম। দেহে সেই একক প্রাণশক্তি যখন নানা স্থানে, নানা কাজের জন্য বিভিন্নভাবে কার্যকর হয়, তখনই তাকে বলা হয় উপপ্রাণ। অর্থাৎ, উপপ্রাণ মানে “প্রাণের উপশাখা” বা “প্রাণের আঞ্চলিক কার্যরূপ”। এগুলি পাঁচটি—নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধানঞ্জয়। এদের কাজ খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু দেহের স্বাভাবিক ভারসাম্য ও জীবনীপ্রবাহ বজায় রাখতে অপরিহার্য।
প্রশ্ন উপনিষদে (৩.৫-৭) এই উপপ্রাণগুলির উল্লেখ আছে, এবং তত্ত্ববোধ, শ্রীশঙ্করভাষ্য, ও ‘হঠযোগ প্রদীপিকা’-তেও এদের ক্রিয়া বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
নাগ উপপ্রাণ হলো সেই শক্তি, যা ঢেঁকুর, হেঁচকি ও বায়ু নির্গমনের সঙ্গে যুক্ত। এটি মূলত বক্ষদেশে কার্যকর, খাদ্য ও বাতাসকে উপরের দিকে তোলার জন্য। তাই যখন পেটে বায়ু জমে, নাগ বায়ুর প্রবলতা ঢেঁকুর বা হেঁচকির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করে।
কূর্ম উপপ্রাণ চোখ ও ইন্দ্রিয়ের রক্ষাকর্তা। এর কাজ হলো চোখের পলক ফেলা ও দৃষ্টিশক্তি সুরক্ষিত রাখা। যেমন চোখে ধুলো পড়লে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চোখ বন্ধ হয়—এটি কূর্ম বায়ুর কাজ। এই বায়ুই চোখের অশ্রুপ্রবাহ ও দৃষ্টিসংবেদন নিয়ন্ত্রণ করে।
দৃষ্টিসংবেদন মানে “দেখার অনুভূতি” বা “চক্ষুর মাধ্যমে জ্ঞানের উদ্ভব”—কিন্তু বেদান্তীয় ভাষায় এটি কেবল শারীরিক দৃষ্টিশক্তি নয়, বরং চেতনার এক সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দ্রষ্টা (দেখনেওয়ালা আত্মা), দর্শনযন্ত্র (চোখ ও মন), এবং দৃশ্য (বাহ্য বস্তু)—এই তিনের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।
যখন আমরা বলি, “আমি দেখছি”, তখন আসলে তিনটি স্তরে একযোগে ক্রিয়া ঘটে—(১) চোখে আলোর প্রতিফলন, (২) মনের সেই চিত্র গ্রহণ, (৩) চেতনার সেই গ্রহণকে সচেতনভাবে জানা। এই শেষ স্তরটাই “দৃষ্টিসংবেদন” বা দৃষ্টিজ্ঞান—যেখানে দেখা শুধু শারীরিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং সচেতন অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।
বেদান্ত বলে—চোখ নিজে দেখে না, চোখ কেবল বাহ্যিক আলো গ্রহণের মাধ্যম। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪.৩.৭) বলা হয়েছে—“ন চক্ষুষা পশ্যতি, তস্য চক্ষুষঃ পশ্যতি”—চোখ দিয়ে আত্মা দেখে না, বরং আত্মাই চোখকে দেখার শক্তি দেয়। অর্থাৎ, দেখা মানে চোখের কাজ নয়, চেতনার প্রতিফলন। চোখ কেবল উপকরণ (যন্ত্র), মন হল মাধ্যম (অন্তঃকরণ), আর আত্মা হল আলোকদাতা (সাক্ষী)।
জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আসলে তিন স্তরে ঘটে: যন্ত্র, মাধ্যম, এবং সাক্ষী।
চোখ কেবল যন্ত্র—এটি একটি উপকরণ, যেমন লেন্স বা ক্যামেরা। এর কাজ শুধু বাহ্যিক আলো বা রূপ গ্রহণ করা। চোখ নিজে জানে না, বোঝে না; সে শুধু দৃশ্যের প্রতিফলন বহন করে। যেমন ক্যামেরা ছবি তোলে, কিন্তু ছবির অর্থ বোঝে না—তেমনি চোখ দেখা ঘটায়, কিন্তু “আমি দেখছি” এই সচেতনতা তার নেই।
মন হলো মাধ্যম—অন্তঃকরণ, যা চোখ থেকে আসা সেই দৃশ্যচিত্রকে গ্রহণ করে, বিশ্লেষণ করে, নাম দেয়, অর্থ নির্ধারণ করে। যখন চোখ দেখে একটি রূপ, মন বলে—“এটি গাছ”, “এটি মানুষ”, “এটি আগুন”—এই অর্থবোধ মনের কাজ। কিন্তু মনও স্বয়ংচেতনা নয়; সে শুধু ভাব ও সংবেদনের সঞ্চালক।
আত্মা হলো সাক্ষী—অর্থাৎ আলোকদাতা, যিনি দেখা, ভাবা, বোঝা—সব কিছুর মধ্যেই অবিচলভাবে উপস্থিত। চোখ ও মন কাজ করছে বলে আমরা জানি—এই জানাটিই আত্মার আলোকপ্রদীপ। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৪.৩.৭) বলা হয়েছে—“ন চক্ষুষা পশ্যতি, তস্য চক্ষুষঃ পশ্যতি”—চোখ দিয়ে আত্মা দেখে না, বরং আত্মাই চোখকে দেখার শক্তি দেয়।
অর্থাৎ, চোখ হলো বহিরঙ্গিক যন্ত্র, মন হলো সেই যন্ত্রের অপারেটর, আর আত্মা হলো সেই আলোকিত চৈতন্য, যার কারণে যন্ত্র ও অপারেটর উভয়ই সচল। আত্মা যেমন সূর্যের মতো—সে নিজে কিছু করে না, কিন্তু তার আলোকেই চোখ দেখে, মন ভাবে, ও জগৎ প্রকাশ পায়।
এভাবে দেখা যায়—দেখা, শোনা, জানা, অনুভব করা—সবই এক আত্মচৈতন্যের প্রতিফলন। চোখ ও মন তার উপকরণমাত্র; আত্মাই আসল দ্রষ্টা, যিনি কখনো পরিবর্তিত হন না, কেবল সমস্ত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে থাকেন।