অবিদ্যা-বিদ্যা: ৩০




এখানে দুই পাখি—জীবাত্মা (ভোগী) ও পরমাত্মা (সাক্ষী)—আসলে এক সত্তার দুই স্তর। জীবাত্মা অবিদ্যার কারণে নিজেকে দেহ মনে করে দুঃখ ভোগ করে। জ্ঞান উদয় হলে সে পরমাত্মার শুদ্ধ স্বরূপ উপলব্ধি করে, তখন দুঃখ ও বন্ধন লুপ্ত হয় এবং আত্মা মুক্ত হয়। শঙ্করাচার্যও একই কথা বলেন: জীবাত্মা যখন পরমাত্মাকে চিনে ফেলে, তখন মুক্তি ঘটে। এই রূপকে দেহ হলো বৃক্ষ, কর্মফল হলো ফল। জীবাত্মা ফল খায়, পরমাত্মা দেখে। জীবাত্মা আসক্তি ত্যাগ করে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নতা জানলেই মোক্ষ লাভ করে।


গীতার এই শ্লোকটি (১৩.২) জ্ঞাতার (ক্ষেত্রজ্ঞ) ও জ্ঞেয়ের (ক্ষেত্র) মধ্যকার সম্পর্ক বোঝার মূলসূত্র। এখানে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন—

“ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে।

এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্বিদঃ।।” (ভগবদ্গীতা ১৩.২)


অর্থাৎ—“হে কৌন্তেয় (অর্জুন), এই শরীরকে ‘ক্ষেত্র’ বলা হয়, এবং যে এই শরীরকে জানে, তাকে ‘ক্ষেত্রজ্ঞ’ বলে জ্ঞানীরা।”


বেদান্তে এই দুটি শব্দের অর্থ গভীর। ‘ক্ষেত্র’ মানে ক্ষেত্র বা ভূমি—যেখানে কর্মফল বপন করা হয়, অভিজ্ঞতার সমস্ত প্রকাশ ঘটে। মানুষের শরীর-মন-ইন্দ্রিয় এই ক্ষেত্র। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জগৎ প্রতীয়মান হয়, মন তার অনুভূতি ধরে রাখে, বুদ্ধি সিদ্ধান্ত নেয়, অহংকার ‘আমি করছি’ বলে কর্তার ভাব সৃষ্টি করে—এই সবই ক্ষেত্রের অন্তর্গত। এটি পরিবর্তনশীল, অনিত্য ও জড়।


অন্যদিকে, যে এই শরীর, মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তাধারাকে জানে, পর্যবেক্ষণ করে, তার পরিবর্তনের সাক্ষী থাকে—তিনি ‘ক্ষেত্রজ্ঞ’। ক্ষেত্রজ্ঞ নিজে কখনও ক্ষেত্রের অংশ নন, বরং তার পটভূমি। শরীর অসুস্থ হয়, মন আনন্দিত বা বিষণ্ণ হয়, বুদ্ধি বিভ্রান্ত হয়—কিন্তু যে জানে—“আমি অসুস্থ”, “আমি আনন্দিত”, “আমি বিভ্রান্ত”—সে তো এসব অবস্থার ঊর্ধ্বে। সেই “আমি”-ই ক্ষেত্রজ্ঞ।


শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যে বলেন, ক্ষেত্র মানে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের সমষ্টি, আর ক্ষেত্রজ্ঞ মানে সেই চৈতন্য, যা এদের আলোকিত করে। যেমন সূর্য জমিনের উপর আলো ফেলে, কিন্তু জমিনের ফল-ফুলের তার সঙ্গে মিশে যায় না, তেমনি আত্মা শরীর-মন-বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত থেকে সব জানে, কিন্তু কখনও তাদের দ্বারা স্পর্শিত হয় না।


গীতা এভাবেই ‘ক্ষেত্র’ ও ‘ক্ষেত্রজ্ঞ’-এর মাধ্যমে জড় ও চেতনার বিভাজন স্পষ্ট করে। জড় পরিবর্তনশীল, সীমাবদ্ধ; চেতনা অপরিবর্তনীয়, অসীম। কিন্তু সংসারে এই দুই একত্রিত—চেতনা জড়কে প্রাণ দেয়, জড় চেতনাকে প্রকাশের উপকরণ দেয়। অদ্বৈত বেদান্ত এই দুইয়ের ঐক্যেই ব্রহ্মতত্ত্ব খুঁজে পায়—যেখানে ক্ষেত্রজ্ঞই আসলে পরম চেতনা, আর ক্ষেত্র তারই প্রতিফলিত রূপ।


গীতার এই এক শ্লোকেই সমগ্র জীব-ব্রহ্ম-সম্পর্কের সার নিহিত আছে—শরীর হলো অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র, আর আত্মা সেই ক্ষেত্রের জ্ঞাতা; শরীর নিত্য পরিবর্তনশীল, কিন্তু আত্মা চিরসাক্ষী, চিরনির্বিকার।


এভাবে বোঝা যায়—দেহ, মন, জগৎ সবই দৃশ্য; আত্মা একমাত্র দ্রষ্টা। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিবিম্ব দেখা যায়—প্রতিবিম্ব বদলায়, কিন্তু আয়না অচল। দেখা-জানার অভিজ্ঞতা চেতনার; তাই আয়না ও প্রতিবিম্বের মতো, দেহ ও মনও আত্মার সামনে দৃশ্যমাত্র।


দৃশ্য পরিবর্তনশীল, দ্রষ্টা স্থায়ী। আত্মা কর্ম করে না, ভোগও করে না; সে কেবল সাক্ষী। এই বোঝাই মুক্তির সূচনা—যখন জানা যায়, “আমি দ্রষ্টা, দৃশ্য নই।”


যা দেখা যায়, তা মিথ্যা; যে দেখে, সে সত্য। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, জগৎ—সবই পরিবর্তনশীল দৃশ্য; আত্মা সেই অপরিবর্তনীয় চেতনা, চিরসাক্ষী, চিরশান্ত, চিরঅদ্বিতীয়। “দৃশ্য মায়া, দ্রষ্টা ব্রহ্ম”—এই উপলব্ধিই বেদান্তের চরম সিদ্ধান্ত।


মায়ার কার্যপদ্ধতিকে বুঝতে গেলে প্রতিফলনের দার্শনিক উপমাগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।


দর্পণ-প্রতিবিম্ব-ন্যায় বেদান্তে আত্মা, জীব ও ব্রহ্মের সম্পর্ক বোঝানোর এক অতিসূক্ষ্ম দার্শনিক উপমা। যেমন আয়নায় মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, কিন্তু মুখ ও প্রতিবিম্ব এক নয়—তেমনি চৈতন্য বা পরমাত্মা অন্তঃকরণের আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে জীবাত্মা রূপে প্রকাশ পায়। মুখ বাস্তব, আয়না প্রতিফলনের মাধ্যম, আর প্রতিবিম্ব সেই মুখেরই ছায়া। মুখ না থাকলে প্রতিফলন থাকে না, কিন্তু প্রতিফলন নিজে মুখ নয়।


বেদান্ত বলে—এই উপমায় তিনটি স্তর আছে। প্রথমত, মুখ বা বিম্ব—যা পরব্রহ্ম, বিশুদ্ধ চৈতন্য, অপরিবর্তনীয় ও স্বপ্রকাশ। দ্বিতীয়ত, আয়না বা প্রতিফলন-মাধ্যম—যা মায়া বা অবিদ্যা, চৈতন্যকে সীমাবদ্ধভাবে প্রকাশ করে। তৃতীয়ত, প্রতিবিম্ব—যা জীবাত্মা, যে নিজেকে দেহ ও মন হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করে। সূর্যের প্রতিফলনের মতো, চৈতন্য এক হলেও অন্তঃকরণের বৈচিত্র্যে বহু-জীব বলে প্রতীয়মান হয়।


অন্তঃকরণ স্বচ্ছ হলে প্রতিবিম্ব পরিষ্কার হয়, কিন্তু অস্থির হলে তা বিকৃত হয়। যেমন জলে সূর্যের প্রতিচ্ছবি তরঙ্গে কাঁপে, অথচ আসল সূর্য অচঞ্চল থাকে, তেমনি চৈতন্য সর্বদা স্থির—মন-বুদ্ধির অস্থিরতায় জীবের অভিজ্ঞতা দুলতে থাকে। চৈতন্য কখনও দুঃখভোগ করে না; কিন্তু জীব দুঃখী হয়, কারণ সে ভাবে—“আমি দেহ, আমি মন, আমি এই প্রতিবিম্ব।”


শঙ্করাচার্য ও বিদ্যারণ্য এই ন্যায়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পঞ্চদশী-তে বিদ্যারণ্য স্বামী বলেন—যেমন আয়নায় মুখ দেখা যায়, তেমনি বুদ্ধিতে চৈতন্য প্রতিফলিত হয়ে জীবরূপে প্রকাশিত হয়। মুখের প্রতিচ্ছবি বাস্তব নয়, আবার পুরো মিথ্যাও নয়; তেমনি জীবও অনির্বচনীয়—না সত্য, না অসত্য। ব্রহ্ম সূর্যের মতো, জীব তার প্রতিফলিত আলো তথা প্রতিবিম্ব।


যেমন এক সূর্য বহু জলাশয়ে প্রতিফলিত হয়—কোথাও শান্ত, কোথাও ঘোলা—তেমনি এক আত্মা অসংখ্য দেহে প্রতিফলিত হয়ে বহু-জীব বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে চৈতন্য এক, জীবের বহুতা কেবল প্রতিফলনের বিভ্রম। মায়া সেই দর্পণ, যা ব্রহ্মের অচঞ্চল আলো প্রতিফলিত করে জীবরূপে বিভক্ত করে দেখায়।


প্রতিবিম্ব কখনও মুখকে পরিবর্তন করে না, কিন্তু আয়নার বিকৃতি প্রতিফলনকে বিকৃত করে। তেমনি আত্মা নিঃকলঙ্ক, কিন্তু অবিদ্যার বিকৃতি জীবকে সীমাবদ্ধ, দুঃখী ও বদ্ধ বলে প্রতীয়মান করে। অথচ ব্রহ্ম চিরনির্বিকার, ভোগী বা কর্তা নন।


মুক্তির অর্থ এখানে প্রতিবিম্বকে নয়, মুখকে জানা। যেমন আয়নায় নিজের মুখ চিনে নিলে ভ্রম মুছে যায়, তেমনি আত্মজ্ঞান মানে জানা—“আমি চৈতন্য, আমি প্রতিবিম্ব নই।” যতদিন জীব ভাবে—“আমি দেহ, আমি মন”—ততদিন সে প্রতিবিম্বে আবদ্ধ থাকে; কিন্তু যখন সে জানে—“আমি মুখ, আমি ব্রহ্ম”—তখনই মুক্তি ঘটে।


এই ন্যায়ের মূল তত্ত্ব শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে (২.৩.৫০) ব্যাখ্যা করেছেন—জীব ব্রহ্মের অংশ নয়, তার প্রতিফলনমাত্র, যেমন সূর্যের প্রতিফলন সূর্য থেকে আলাদা নয়। তাই ব্রহ্ম অপরিবর্তনীয় থেকেও জীবাত্মার রূপে প্রতীয়মান।


দর্পণ-প্রতিবিম্ব-ন্যায় শেখায়—ব্রহ্ম একমাত্র সত্য, জগৎ তার প্রতিফলন, আর জীব সেই প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মকেই সীমাবদ্ধভাবে অভিজ্ঞতা করছে। জ্ঞান মানে সেই সীমাবদ্ধ প্রতিফলন অতিক্রম করে মূল চৈতন্যকে চেনা—যেখানে আর আয়না বা প্রতিবিম্বের প্রয়োজন নেই, থাকে কেবল সেই এক, স্বপ্রকাশ, চিরনির্বিকার ব্রহ্ম—সব আলোরও আলো।


বিম্ব-প্রতিবিম্ব-বাদ অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম সূক্ষ্ম ও গভীর তত্ত্ব, যা ব্রহ্ম (পরমাত্মা), জীব (ব্যক্তিগত আত্মা) এবং চেতনার প্রতিফলনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এটি মূলত দর্পণ-প্রতিবিম্ব-ন্যায় বা Mirror-Reflection Analogy-এর উপর প্রতিষ্ঠিত, এবং শঙ্করাচার্য ও তাঁর শিষ্য-পরম্পরা, বিশেষত বিদ্যারণ্য স্বামী (পঞ্চদশী-তে) এটি ব্যবহার করেছেন জীব-ব্রহ্ম-অভেদ বোঝাতে।


যেমন মুখ আয়নায় প্রতিফলিত হলে মুখ ও প্রতিফলন আলাদা মনে হয়, কিন্তু মুখ ছাড়া প্রতিফলনের অস্তিত্বই নেই, তেমনি ব্রহ্মই সেই “বিম্ব” বা আসল চৈতন্য, এবং জীব তারই “প্রতিবিম্ব” বা চিদাভাস—চৈতন্যের সীমাবদ্ধ প্রতিফলন। আয়না বা প্রতিফলন-মাধ্যম হলো মায়া বা অবিদ্যা, যা স্বচ্ছ না হলে প্রতিফলন বিকৃত হয়।


বিম্ব বা ব্রহ্ম এক, অদ্বিতীয়, অপরিবর্তনীয় ও স্বপ্রকাশ। তিনি সূর্যের মতো—সর্বত্র আলোকদাতা, কিন্তু কারও দ্বারা স্পৃষ্ট নন। অন্তঃকরণ বা মন-বুদ্ধি হলো সেই আয়না, যেখানে ব্রহ্মচেতনার প্রতিফলন ঘটে। এই প্রতিফলনই জীবাত্মা—যে ভাবে, “আমি দেহ, আমি সুখী, আমি দুঃখী।” অথচ আত্মা নিজে এসব কিছু নয়; সে কেবল সাক্ষী, শুদ্ধ, মুক্ত ও নির্লিপ্ত।


যেমন সূর্যের আলো স্বচ্ছ জলে পড়লে সূর্যের প্রতিফলন দেখা যায়, তেমনি আত্মার আলো যখন মনের স্বচ্ছতায় প্রতিফলিত হয়, তখন “আমি”-বোধ উদ্ভূত হয়। সূর্য কখনও জলে প্রবেশ করে না, কিন্তু জলের উপর তার আলোর ছায়া পড়ে। সেই ছায়া সূর্যের মতোই আলো দেয়, কিন্তু আসল সূর্য নয়। তেমনি আত্মা কখনও মনের মধ্যে প্রবেশ করে না, কিন্তু মনে তার প্রতিফলন দেখা যায়—এই প্রতিফলনই চিদাভাস।


এখানে আত্মা বা চৈতন্য হলো বিম্ব, মন হলো প্রতিফলন-মাধ্যম, আর জীব বা অহংকার হলো সেই প্রতিবিম্ব। আত্মা অপরিবর্তনীয় সূর্য, মন পরিবর্তনশীল জল, আর চিদাভাস সেই তরঙ্গায়িত প্রতিবিম্ব। মন যত স্বচ্ছ, আত্মার প্রতিফলন তত নির্মল; মন যত অস্থির, প্রতিফলন তত বিকৃত। এই বিকৃতি বা মলিনতাই অবিদ্যা, যা জীবকে সীমাবদ্ধতা ও বন্ধনে আবদ্ধ করে।


এই তত্ত্ব অনুসারে, জীব ও ঈশ্বর উভয়ই ব্রহ্মের প্রতিফলন, কিন্তু ভিন্ন উপাধিতে। যখন ব্রহ্মচেতনা সমষ্টিগত মায়া (মহামায়া)-তে প্রতিফলিত হয়, তখন ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়—যিনি সর্বজ্ঞান ও সর্বশক্তির অধিকারী। আর যখন একই চেতনা ব্যক্তিগত মায়া (অবিদ্যা)-তে প্রতিফলিত হয়, তখন জীবের সৃষ্টি হয়—যিনি সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও কর্মফলে আবদ্ধ। কিন্তু উভয়েরই মূল এক—ব্রহ্ম।


শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে (২.৩.৫০) বলেন, “যথা একঃ সূর্যঃ বহুশু জলাধিষু প্রতিফলিতঃ”—এক সূর্য বহু জলে প্রতিফলিত হলেও সূর্যের কোনো ভেদ হয় না; তেমনি এক ব্রহ্ম বহু জীববুদ্ধিতে প্রতিফলিত হলেও ব্রহ্মে কোনো পরিবর্তন ঘটে না।


জীবের দুঃখ বা বন্ধনের মূল কারণ তার ভুল আত্মপরিচয়। সে প্রতিবিম্বকে আসল মনে করে বলে দুঃখভোগ করে। যেমন মেঘে সূর্য ঢেকে গেলে পৃথিবী অন্ধকার মনে হয়, কিন্তু সূর্য আসলে অন্ধকারে যায়নি; তেমনি অবিদ্যার আচ্ছাদনে আত্মা আড়াল হয়ে পড়ে, অথচ আত্মা কখনও আচ্ছন্ন হয় না।


মুক্তি বা জীবন্মুক্তি তখনই ঘটে, যখন জীব এই প্রতিবিম্ব-ভ্রান্তি ভেঙে বুঝতে পারে—সে মুখ নয়, সে সূর্য নয়, বরং সূর্যেরই প্রতিবিম্ব নয়, আসল সূর্য-চেতনা নিজে। তখন “আমি দেহ”, “আমি মন”-এর ভ্রান্তি লুপ্ত হয়, এবং থাকে কেবল সেই এক চিরচেতনা—অচঞ্চল, অবিনাশী ব্রহ্ম।


এই উপলব্ধিই বিম্ব-প্রতিবিম্ব-বাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য—প্রতিফলনের অস্থির জলে নয়, বরং আত্মার নির্মল সূর্যে ফিরে যাওয়া। যখন জীব জানে—“আমি কোনো সীমিত প্রতিচ্ছবি নই, আমি সেই এক অনন্ত আলোক”—তখনই সে ব্রহ্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং অভিজ্ঞতায় প্রকাশ পায় সেই চিরসত্য বাণী—“ব্রহ্ম সত্যং, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।”


ঘট-আকাশ-মহাকাশ-ন্যায় (Ghaṭa-Ākāśa-Mahākāśa Nyāya) অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের এক অতি গভীর ও মৌলিক উপমা, যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয় ব্রহ্ম (পরমাত্মা) ও জীবাত্মা (ব্যক্তিগত আত্মা)-র প্রকৃত সম্পর্ক—তাদের আপাত পার্থক্য ও পরম অভিন্নতা।


একটি ঘট বা কলসির ভেতরে থাকা আকাশকে (শূন্যস্থানকে) আমরা আলাদা বলে মনে করি—ভাবি, এটি ঘটাকাশ; আর পাত্রের বাইরে যে অসীম আকাশ আছে, সেটি মহাকাশ। কিন্তু বাস্তবে কোনো আকাশই আলাদা নয়; পাত্রের দেয়াল কেবল আপাত সীমারেখা তৈরি করে, যার ফলে এক অবিভক্ত আকাশ সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়। যখন পাত্রটি ভেঙে যায়, তখন দেখা যায়—আকাশ কখনও বিভক্ত ছিল না, সে সর্বদা এক ও অবিভক্ত।


এই দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বেদান্ত বলে—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, আর জীবাত্মা সেই ব্রহ্মেরই প্রতিফলন, যাকে দেহ ও মনের উপাধি সীমাবদ্ধ বলে প্রতীয়মান করে। এখানে তিনটি দার্শনিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে—


প্রথমত, মহাকাশ—যা অসীম, অপরিচ্ছিন্ন ও সর্বব্যাপী, ব্রহ্মের প্রতীক। যেমন মহাকাশ কখনও বিভক্ত হয় না, তেমনি ব্রহ্ম সর্বদা এক ও অভেদ।


দ্বিতীয়ত, ঘট বা উপাধি—যা মাটির পাত্রের মতো সীমাবদ্ধ বস্তু। এটি দেহ, মন, ইন্দ্রিয় বা অহংকারের প্রতীক, যা আত্মাকে ঘিরে রাখে এবং আপাত-সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।