তুরীয়তে এই বীজনিদ্রা বা কারণ শরীর সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত থাকে। তুরীয় হলো সেই শুদ্ধ চৈতন্য, যা অবিদ্যার বীজ থেকেও মুক্ত। এই মুক্ত অবস্থাই প্রমাণ করে যে, তুরীয় কোনো অভিজ্ঞতার অবস্থা নয়, বরং সেই আত্মার স্বরূপ, যা তিন অবস্থার সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান এবং তাদের অতিক্রম করে।
তুরীয়ের স্বরূপ—শান্ত, শিব, অদ্বৈত: নেতিবাচক সংজ্ঞার পাশাপাশি, মাণ্ডূক্য উপনিষদ তুরীয়কে তার চিদঘন স্বরূপ দ্বারা চিহ্নিত করে:
একাত্মপ্রত্যয়সারম: এটি কেবল আত্মার উপলব্ধির সার।
প্রপঞ্চোপশমম: এটি হলো সমস্ত প্রপঞ্চ বা দৃশ্যমান জগতের (যা জাগ্রৎ ও স্বপ্নে দেখা যায়) বিলুপ্তি বা বিরামস্বরূপ।
শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম: তুরীয় হলো শান্ত, মঙ্গলময়, এবং অদ্বিতীয়।
এই অবস্থাটি হলো শুদ্ধ অদ্বৈত ব্রহ্ম। তুরীয়ের উপলব্ধি হলে জীব তার ব্রহ্মস্বরূপতা উপলব্ধি করে এবং বুঝতে পারে যে, সে কখনও তার স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হয়নি, কেবল অবিদ্যার প্রভাবে নিজেকে জ্ঞাতা-কর্তা-ভোক্তা হিসেবে মনে করেছে।
জ্ঞানীর অবস্থা—জাগ্রৎ-সুষুপ্তি (Jāgrat-Suṣupti): যে-ব্যক্তি তুরীয়ের জ্ঞান লাভ করেন, তার জাগরণকে জাগ্রৎ-সুষুপ্তি বলা হয়। এই অবস্থাটি নির্বিকল্প সমাধির সমতুল্য এবং এটি তুরীয় চেতনারই সক্রিয় প্রকাশ। এই অবস্থায় সাধক জাগ্রত অবস্থাতেই সুষুপ্তির নীরবতা এবং স্থিরতা অনুভব করেন। এই অবস্থাকে শ্রী রমণ মহর্ষি জাতিজাগ্রৎ (অতি-জাগ্রৎ) বা জাতিসুষুপ্তি (অতি-সুষুপ্তি) বলে বর্ণনা করেছেন। তুরীয় হলো সেই চূড়ান্ত উপলব্ধি, যা সকল উপাধি মুক্ত এবং যেখানে জীব তার নিজেরই আত্মার সঙ্গে অভিন্ন হয়।
মাণ্ডূক্য উপনিষদ ও গৌড়পাদ কারিকার এই বিশদ বিশ্লেষণ চেতনার তিনটি পরিচিত অবস্থা এবং তাদের অন্তর্নিহিত সত্য ব্রহ্মকে প্রকাশ করে। জাগ্রৎ (বৈশ্বানর) এবং স্বপ্ন (তৈজস) অবস্থার মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলি মূলত উপাধি এবং ভোগের ভিন্নতার কারণে সৃষ্ট—বৈশ্বানর স্থূল শরীরের মাধ্যমে বাহ্যিক স্থূল বস্তু ভোগ করে (ব্যাবহারিক সত্য), আর তৈজস সূক্ষ্ম শরীরের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাসনা ভোগ করে (প্রাতিভাসিক সত্য)। জাগ্রৎ অবস্থাকে আপেক্ষিকভাবে স্বপ্নের চেয়ে বেশি বাস্তব মনে হলেও, এই দুটি স্তরই মায়া বা অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট এবং এদের শুরু ও শেষ আছে।
গৌড়পাদ তাঁর ‘বৈতথ্য প্রকরণ’-এ দৃঢ় যুক্তি সহকারে প্রমাণ করেন যে, যেহেতু জাগ্রৎ জগৎও আদি ও অন্তযুক্ত এবং এক অভিজ্ঞতা অন্য অভিজ্ঞতা দ্বারা বাধিত হয়, তাই চূড়ান্ত পারমার্থিক সত্যের মানদণ্ডে জাগ্রৎ এবং স্বপ্ন উভয়ই মিথ্যা বা অনির্বচনীয় মায়া। এই দুই অবস্থার মিথ্যাত্ব জ্ঞান সাধককে তৃতীয় অবস্থা, সুষুপ্তি, অতিক্রম করে তুরীয়ের দিকে চালিত করে।
তুরীয় হলো সেই চতুর্থ পাদ, যা কোনো অভিজ্ঞতা বা অবস্থা নয়, বরং চেতনার অখণ্ড, অদ্বিতীয়, এবং স্ব-অস্তিত্বশীল স্বরূপ। তুরীয় সুষুপ্তির বীজনিদ্রা (অজ্ঞানের বীজ বা কারণ শরীর) থেকেও মুক্ত, যার ফলে এখানে বহুত্বের পুনরাবির্ভাবের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এই তুরীয়ই হলো প্রপঞ্চোপশমম, শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম—সমস্ত দ্বৈততা থেকে মুক্ত, আত্মার চূড়ান্ত স্বরূপ, যা উপলব্ধির মাধ্যমে জীব মোক্ষলাভ করে। এই বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, মুক্তিলাভের জন্য প্রথম তিনটি উপাধিযুক্ত অবস্থাকে মায়া বা বিভ্রম হিসেবে চিহ্নিত করা এবং তুরীয় অদ্বৈত ব্রহ্মের সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা উপলব্ধি করাই অদ্বৈত সিদ্ধান্তের মূল নির্যাস।
প্রথম তিনটি শরীর আত্মাকে আচ্ছন্ন করে, যেন সূর্যের উপরে তিন স্তরের মেঘ। আত্মা নিজে কোনো শরীর নয়, কেবল এদের আলোকিত করে। তবু অবিদ্যার কারণে জীব নিজেকে এই শরীরগুলির সঙ্গে এক করে ফেলে—“আমি দেহ,” “আমি মন,” “আমি স্বপ্ন দেখি,” “আমি ঘুমাই”—এই সমস্ত পরিচয় অবিদ্যারই ফল। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “ক্ষেত্রজ্ঞং চাপি মাম্ বিদ্ধি সর্বক্ষেত্রেষু ভারত” (১৩.৩)—প্রত্যেক দেহে যে চেতনা বা ক্ষেত্রজ্ঞ উপস্থিত, সেটি আমিই; অর্থাৎ আত্মা সর্বদেহে একই, কিন্তু দেহভেদে ভিন্ন বলে মনে হয় অবিদ্যার কারণে।
এই তিন দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঁচটি আবরণ বা কোষ—অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময়। অন্নময় দেহ খাদ্যনির্ভর স্থূল স্তর, প্রাণময় জীবনশক্তি, মনোময় চিন্তা-ইচ্ছার আসন, বিজ্ঞানময় বুদ্ধির প্রতিফলন, আর আনন্দময় সুপ্ত সুখের অভিজ্ঞতা। প্রতিটি কোষ অবিদ্যার এক একটি স্তর—যত গভীরে নামা যায়, চেতনা তত আচ্ছন্ন হয়; যত উপরে ওঠা যায়, তত আত্মার আলোক উদ্ভাসিত হয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.১-২.৫) এই ক্রমধারায় আত্মার আবরণ খুলে দেখিয়েছে, যতক্ষণ না চূড়ান্ত উপলব্ধি আসে—“আনন্দো ব্রহ্মেত্যবিজানাত”—আনন্দই ব্রহ্ম।
স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর আসলে অবিদ্যার তিন পর্যায়—যেখানে আত্মা নিজেকে দেহে, মনের চিন্তায় ও অজ্ঞানতার গভীরে ভুলে থাকে। জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই তিন স্তরের পর্দা অপসারিত হয়, আত্মা তখন নিজের প্রকৃত স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়—চিরসচেতন, নির্লিপ্ত, পরম।
এইভাবে অবিদ্যা অসীম চেতনাকে এক সসীম ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করে—যেন অনন্ত আকাশ একটি পাত্রে বন্দি হয়ে গেছে। জীব তখন নিজেকে পথচারীর মতো ভাবে, যার দেহ জড় উপাদানে গঠিত, মন পরিবর্তনশীল, আর অন্তরে বাসনা ও সংস্কারের ঘন পর্দা জমে আছে। অথচ বাস্তবে সে সেই আলোক, যা এই সমস্ত স্তরের আড়াল পেরিয়ে অবিকৃতভাবে দীপ্ত।
এবার দেখা যাক, এই অবিদ্যা থেকে কীভাবে জগতের উত্থান ঘটে। অদ্বৈত মতে, জগৎ কোনো “পরিণাম” নয়, অর্থাৎ ব্রহ্মের প্রকৃত পরিবর্তন নয়, বরং “বিবর্ত” (Vivarta)—একটি আপাত রূপান্তর। যেমন জবা ফুলের পাশে রাখলে স্বচ্ছ স্ফটিককে লাল মনে হয়, অথচ স্ফটিক নিজে অপরিবর্তিত থাকে, তেমনি ব্রহ্মও অপরিবর্তিত থেকে নাম-রূপের মাধ্যমে জগতরূপে প্রকাশিত বলে মনে হয়। এটি সেই বিবর্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে জগত কেবল চৈতন্যের প্রতিফলন, তার প্রকৃত পরিবর্তন নয়।
নাম (Nāma) আমাদের ধারণাগত পরিচয় দেয়—“এটি গাছ”, “এটি জল”, “এটি আমি”—এইসব চিন্তাগত আকারে; রূপ (Rūpa) দেয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার ও সীমা। এই নাম ও রূপের বুননেই প্রপঞ্চ (Phenomenon) তৈরি হয়—যা অভিজ্ঞতাগত বা ব্যাবহারিক বাস্তবতা (Vyāvahārika Sattā) হিসেবে অনুভূত। কিন্তু এর আশ্রয় বা ভিত্তি থাকে পারমার্থিক সত্তা (Pāramārthika Sattā)—ব্রহ্ম নিজে, যিনি অপরিবর্তিত। জ্ঞান উদিত হলে এই প্রপঞ্চ ধ্বংস হয় না, কেবল তার বিভ্রম হিসেবে ধরা পড়ে—যেমন তরঙ্গ সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্তু সমুদ্র কখনও হারায় না। তরঙ্গ কেবল নাম ও আকার; সমুদ্রই বাস্তব।
অবিদ্যার অবস্থান নিয়ে যে সূক্ষ্ম এবং গভীর প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়, তা "আশ্রয়-অনুপপত্তি" নামে পরিচিত। এই প্রশ্নটি কেবল একটি তাত্ত্বিক বিতর্ক নয়, বরং এটি অদ্বৈত বেদান্তের মূল ভিত্তি—ব্রহ্মের নির্গুণত্ব ও জীবাত্মার একত্ব—সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। অবিদ্যা বা অজ্ঞতা, যা জাগতিক মায়া ও বন্ধনের কারণ, তা কোথায় আশ্রয় করে থাকে, এই প্রশ্নটি নিয়ে বিভিন্ন আচার্য ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন মতবাদ বিদ্যমান।
একদল দার্শনিক মনে করেন যে, অবিদ্যা ব্রহ্মেই অবস্থিত। তাঁদের যুক্তিটি অত্যন্ত সরল কিন্তু গভীর। তাঁরা বলেন, কেবল একটি বাস্তব সত্তাই বিভ্রমের আশ্রয় হতে পারে। যেমন, একটি দড়ি ছাড়া সাপের ভ্রম কল্পনা করা অসম্ভব। দড়িটি একটি বাস্তব সত্তা, আর তার উপরেই সাপের অবাস্তব ভ্রম আরোপিত হয়। এই যুক্তির ভিত্তিতে, যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র বাস্তব সত্তা, তাই অবিদ্যার আশ্রয়ও ব্রহ্মই হওয়া উচিত।
প্রকাশাত্মন সম্প্রদায় এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা। তাঁদের মতে, চৈতন্যই একমাত্র বাস্তব ভিত্তি, এবং এই চৈতন্যই ব্রহ্ম। যদি অবিদ্যা জীবের মধ্যে থাকত, তাহলে অবিদ্যাকে সসীম হতে হত এবং এর বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে জীবও মুক্ত হয়ে যেত। কিন্তু অবিদ্যা সর্বজনীন এবং অনাদি (অনন্তকাল ধরে বিদ্যমান), তাই এর আশ্রয়ও অসীম ও অনন্ত হতে হবে, যা কেবল ব্রহ্মই হতে পারেন। তাঁদের মতে, ব্রহ্ম তাঁর স্বরূপে অজ্ঞ নন, বরং তাঁর শক্তি হিসেবেই অবিদ্যা অবস্থান করে, যা জগৎরূপে প্রকাশিত হয়।
যেমন একজন জাদুকর নিজের শক্তিতে বিভ্রম সৃষ্টি করলেও নিজে বিভ্রমের অধীন হন না, তেমনি ব্রহ্মও অবিদ্যার আশ্রয় হয়েও তার দ্বারা প্রভাবিত হন না। এই মতবাদটি ব্রহ্মকে অবিদ্যার 'আশ্রয়' এবং 'বিষয়' উভয় রূপেই দেখে—ব্রহ্মে অবিদ্যা থাকে (আশ্রয়), এবং ব্রহ্মকেই অবিদ্যা আবৃত করে রাখে (বিষয়), যদিও ব্রহ্ম স্বতঃপ্রকাশিত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে আবৃত হন না, কেবল জীবের কাছে আবৃত বলে মনে হয়।
অন্যদিকে, ভামতী সম্প্রদায়, যার প্রধান প্রবক্তা বাচস্পতি মিশ্র, ভিন্ন একটি মতবাদ পোষণ করেন। তাঁদের মূল যুক্তি হলো, ব্রহ্ম শুদ্ধ চেতনা এবং নির্গুণ; তিনি অজ্ঞতার দ্বারা আবৃত হতে পারেন না। যদি ব্রহ্ম অজ্ঞতার দ্বারা আবৃত হন, তাহলে ব্রহ্মের পূর্ণত্ব, নির্গুণত্ব এবং স্বতঃপ্রকাশিতত্বের ধারণার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। ব্রহ্ম নিত্যশুদ্ধ, নিত্যবুদ্ধ, নিত্যমুক্ত—এমন একটি সত্তা অজ্ঞতার আশ্রয় হতে পারেন না।
ভামতী সম্প্রদায়ের মতে, অবিদ্যা জীবের অন্তঃকরণে থাকে। অজ্ঞতা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রকাশিত হয়। আমরা বলি, "আমি জানি না," "আমি অজ্ঞ," ইত্যাদি। এই অজ্ঞতা কেবল একজন জীবের মধ্যেই অনুভূত হয়, সর্বজনীনভাবে ব্রহ্মের মধ্যে নয়। তাই, অবিদ্যা জীবাত্মার সাথে সম্পর্কিত এবং জীবের অন্তঃকরণেই এর অবস্থান।
এই মতবাদ অনুযায়ী, অবিদ্যা জীবের মধ্যে থাকে এবং জীবকেই আবৃত করে রাখে। যখন একজন জীব সাধন-ভজনের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভ করে, তখন তার মধ্যকার অবিদ্যা দূর হয় এবং সে মুক্তি লাভ করে। অন্যান্য জীবের মধ্যে অবিদ্যা বিদ্যমান থাকে, যতক্ষণ না তারা নিজেরা জ্ঞান লাভ করে। এই মতবাদটি ব্যাখ্যা করে যে, কীভাবে একই ব্রহ্ম বিভিন্ন জীবের কাছে ভিন্নভাবে প্রতীয়মান হয়, কারণ প্রতিটি জীব তাদের নিজস্ব অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত।
এই দুটি প্রধান মতবাদ "আশ্রয়-অনুপপত্তি" বিতর্কের মূল ভিত্তি। পরবর্তীকালে, অদ্বৈত বেদান্তের অন্যান্য আচার্যগণ এই দুটি মতবাদের সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন বা নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, অবিদ্যার অবস্থানকে লৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত নয়, কারণ অবিদ্যা নিজেই অবাস্তব বা অনির্বচনীয়। এর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই যুক্তিযুক্ত নয়।
“আশ্রয়-অনুপপত্তি” প্রশ্নটি অদ্বৈত বেদান্তের জটিলতা এবং সূক্ষ্মতাকে তুলে ধরে। এটি ব্রহ্মের স্বরূপ, জীবের বন্ধন ও মুক্তির প্রক্রিয়া এবং অবিদ্যার কার্যকারিতা সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের পথ খুলে দেয়। প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব যুক্তি এবং ব্যাখ্যা অদ্বৈত দর্শনের সমৃদ্ধি ও গভীরতাকে প্রমাণ করে, যেখানে ব্রহ্ম ও অবিদ্যার সম্পর্ক নিয়ে নিরন্তর মনন ও বিশ্লেষণ চলেছে। এই বিতর্ক কেবল দার্শনিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে, কারণ অবিদ্যার প্রকৃত অবস্থান ও স্বরূপ নির্ধারণ মুক্তি লাভের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
অদ্বৈত-বেদান্তের অন্যতম জটিল এবং কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো অবিদ্যা বা মায়ার ধারণা, যা ব্রহ্ম এবং জীবের মধ্যকার সম্পর্ককে এক সূক্ষ্ম অথচ দ্বান্দ্বিক জালে আবদ্ধ করে রাখে। মজার ব্যাপার হলো, এই দ্বন্দ্ব অদ্বৈত-তত্ত্বে ইচ্ছাকৃতভাবে অমীমাংসিত রাখা হয়েছে, কারণ এর একটি সরল সমাধান ব্রহ্মের অসীমতা এবং জীবের স্বরূপ সম্পর্কে গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে।
যদি বলা হয় যে, ব্রহ্ম অবিদ্যার দ্বারা আবৃত, তবে ব্রহ্মের অসীম, নিরাকার এবং নির্গুণ সত্তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যা অদ্বৈতবাদের মূল ভিত্তির পরিপন্থী। ব্রহ্ম যদি আবৃত হন, তবে তাঁর সর্বব্যাপকতা এবং অদ্বিতীয়ত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। ব্রহ্মের স্বরূপই হলো জ্ঞান এবং প্রকাশ, সেখানে আবরণের ধারণাটি স্ব-বিরোধী।