অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৫



গীতার ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বলেছেন—এই জ্ঞান সঞ্চিত (সংচিত) ও আগামী কর্ম দগ্ধ করে, কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম শরীর থাকা পর্যন্ত থাকে। কারণ প্রারব্ধ কর্মই দেহের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে, যেমন ছোড়া তীর লক্ষ্যভেদ না করা পর্যন্ত থামে না। কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি সেই কর্মের দ্বারা আর বদ্ধ হন না; তিনি জানেন, কর্ম ঘটছে, কিন্তু “আমি করছি” না।

এই দৃষ্টিভঙ্গি বেদান্তের মূল শিক্ষা—যে-ব্যক্তি অজ্ঞ অবস্থায় কাজ করে, সে ফল চায়, তাই বন্ধন জন্মায়। যে-ব্যক্তি জ্ঞানী অবস্থায় কাজ করে, তার কাজ লীলা হয়ে যায়—কর্ম থাকে, কিন্তু ফলের মালিকানা থাকে না।

“জ্ঞানের অগ্নি সমস্ত কর্মকে দগ্ধ করে ফেলে”, এই কথার অর্থ এই—যখন আত্মা নিজের স্বরূপকে জানে, তখন কর্মের বীজ আর কার্যক্ষম থাকে না। তখন কাজ হয়, কিন্তু কোনো বাঁধন তৈরি হয় না; ফল আসে, কিন্তু তার মালিক আর কেউ নয়। জীবনের প্রবাহ তখন মুক্ত ও নিঃস্বার্থ হয়ে যায়, যেখানে কাজ নিজেই জ্ঞানের প্রকাশ—ফল নয়, শুধু লীলা।

বেদান্তে কর্মের ধারণা একটি গভীর ও সুদূরপ্রসারী দার্শনিক তত্ত্ব, যা মানুষের বর্তমান জীবন এবং ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে। কর্মকে মূলত তিন প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে, যা ব্যক্তির আত্মিক ও জাগতিক যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়কে নির্দেশ করে:

১. সংচিত কর্ম (সঞ্চিত): এটি হলো অসংখ্য পূর্বজন্মের সঞ্চিত কর্মফল, যা এখনও ফলপ্রসূ হয়নি বা প্রকাশিত হয়নি। এটিকে একটি বিশাল কর্মের ভাণ্ডার বা 'কর্মের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট' হিসাবে কল্পনা করা যেতে পারে। এই সঞ্চিত কর্মের মধ্যে ভালো ও মন্দ উভয় প্রকারের কর্মফল অন্তর্ভুক্ত থাকে। মানুষ তার ইচ্ছানুযায়ী বা ঈশ্বরীয় বিধান অনুসারে এই ভাণ্ডার থেকে নির্দিষ্ট কিছু কর্মফলকে বর্তমান জীবনে 'প্রারব্ধ' হিসাবে গ্রহণ করে। সংচিত কর্ম হলো সেই সুপ্ত শক্তি, যা সঠিক সময় ও পরিস্থিতিতে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে কিছু সংচিত কর্মকে দগ্ধ করা সম্ভব বলে বেদান্তে উল্লেখ আছে, যা জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তির পথকে সুগম করে।

২. প্রারব্ধ কর্ম: এটি সেই কর্মফল, যা সংচিত কর্মের ভাণ্ডার থেকে বর্তমান জীবনের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। 'প্রারব্ধ' অর্থ হলো 'যা শুরু হয়ে গেছে' বা 'যা ফল দিতে শুরু করেছে'। এই কর্মফলের কারণে ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য পায়, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পড়ে এবং নির্দিষ্ট সুখ-দুঃখ ভোগ করে। প্রারব্ধ কর্মকে মানুষের বর্তমান জীবনের নিয়তি হিসাবে দেখা হয়, যা ভোগ না করা পর্যন্ত এর থেকে মুক্তি নেই। দেহ ধারণের উদ্দেশ্যই হলো এই প্রারব্ধ কর্মের ফল ভোগ করা। একজন ব্যক্তি যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন এই প্রারব্ধ কর্মের ফল তাকে ভোগ করতে হয়। এটি এমন একটি কর্ম, যা এড়ানো যায় না, কেবল এর ফল ভোগ করার মাধ্যমেই এটি শেষ হয়।

৩. আগামী কর্ম: এটি হলো সেই কর্ম, যা ব্যক্তি বর্তমান জীবনে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে সম্পাদন করছে এবং যা ভবিষ্যতে ফল দেবে। 'আগামী' অর্থ হলো 'যা আসবে' বা 'যা ভবিষ্যতে ফল দেবে'। প্রতিটি চিন্তাভাবনা, কথা এবং কাজের একটি কর্মফল তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে শুভ বা অশুভ ফল হিসাবে ফিরে আসে। আগামী কর্মের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং এর মাধ্যমেই ব্যক্তি তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। বিবেকবুদ্ধি এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে কাজ করলে শুভ আগামী কর্ম সৃষ্টি হয়, যা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে। অন্যদিকে, অবিবেচনাপ্রসূত বা অনৈতিক কাজ করলে অশুভ আগামী কর্ম তৈরি হয়, যার ফলস্বরূপ ভবিষ্যতে দুঃখ ভোগ করতে হয়। এই আগামী কর্মের সমষ্টি আবার নতুন করে সংচিত কর্মের ভাণ্ডারে জমা হয়, যা ভবিষ্যতের প্রারব্ধ কর্মকে প্রভাবিত করে।

এই তিন প্রকার কর্মের ধারণা মানুষকে তার কর্মের প্রতি সচেতন হতে উৎসাহিত করে এবং শেখায় যে প্রতিটি কাজেরই একটি ফল আছে। এটি ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার জন্ম দেয় এবং তাকে মোক্ষ বা আত্মিক মুক্তির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।

আত্মজ্ঞান-প্রাপ্ত হলে সংচিত ও আগামী—এই দুই কর্ম দগ্ধ হয়, কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম শরীর থাকা পর্যন্ত চলতে থাকে। শঙ্করাচার্য উদাহরণ দিয়ে বলেন—যেমন তীর ছোড়া হলে তা লক্ষ্যভেদ না করা পর্যন্ত থামে না, তেমনি জ্ঞানী হলেও প্রারব্ধ কর্মের ফল শরীরের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, কিন্তু তা আর বন্ধন সৃষ্টি করে না।

তাই, “কর্মফলও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়” মানে—কর্মের যে-বন্ধন আত্মাকে সংসারে আবদ্ধ রাখে, তা জ্ঞানের দীপ্তিতে দগ্ধ হয়ে অকার্যকর হয়ে যায়। কর্ম থেকে তখন ফল আসে, কিন্তু সেই ফল আর জীবকে বেঁধে রাখতে পারে না। কারণ তখন আত্মা জানে—“আমি কর্তা নই, আমি ভোক্তা নই, আমি সেই সাক্ষী চেতনা মাত্র।”

তখন কর্ম থাকে, কিন্তু কর্তার ভ্রান্তি থাকে না; ফল আসে, কিন্তু ভোগীর ধারণা থাকে না; জীবন চলতে থাকে, কিন্তু তা আর বন্ধন নয়—লীলা। এ কারণেই উপনিষদ বলে—“ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে” (গীতা, ৪.৩৮)—জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই এত পবিত্র নেই, কারণ জ্ঞানই সমস্ত কর্মফলের দাসত্ব ভেঙে মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে।

এই অবস্থাই জীবন্মুক্তি—অর্থাৎ জীবিত অবস্থাতেই মুক্তি লাভ। এটি এমন এক পর্যায়, যেখানে ব্যক্তি পার্থিব জগতে বাস করেও সকল প্রকার বন্ধন ও দুঃখ থেকে মুক্ত থাকেন। তিনি শারীরিক স্তরে একজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করেন, কিন্তু তাঁর চেতনা ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হয়ে থাকে। তাঁর মন শান্ত, প্রসন্ন এবং সকল প্রকার জাগতিক আকর্ষণের ঊর্ধ্বে থাকে। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি জাগতিক সুখ-দুঃখের দ্বারা প্রভাবিত হন না, কারণ তিনি জানেন যে, তাঁর আসল স্বরূপ এই দেহ বা মনের ঊর্ধ্বে।

জীবন্মুক্তি জ্ঞানের পরিণতি। এখানে জ্ঞান কেবল পুঁথিগত বা তাত্ত্বিক নয়, বরং এটি এক গভীর উপলব্ধি এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই জ্ঞানই কর্মমোচন ঘটায়, অর্থাৎ কর্মের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি পরম শান্তি ও আনন্দ অনুভব করেন, যা অন্য কোনো জাগতিক প্রাপ্তির মাধ্যমে সম্ভব নয়। মুণ্ডক উপনিষদ এই জীবন্মুক্তির অবস্থাকে সর্বোচ্চ মানবীয় প্রাপ্তি হিসেবে তুলে ধরেছে, যেখানে আত্মা তার প্রকৃত স্বরূপে ফিরে আসে এবং অনন্ত আনন্দ ও জ্ঞান লাভ করে। এটি এক চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক যাত্রা, যার লক্ষ্য হলো জন্ম-মৃত্যু চক্রের বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করা।

এই অবস্থাটি সাধারণ মানবিক অভিজ্ঞতার থেকে ভিন্ন। সাধারণ মানুষ সাফল্য, প্রশংসা বা প্রিয়জনের আগমনে উল্লসিত হয়, আবার ব্যর্থতা, নিন্দা বা বিচ্ছেদে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কিন্তু জীবন্মুক্ত ব্যক্তি এই সকল বাহ্যিক ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হন না। তাঁর চেতনার গভীরে এক স্থির, অচঞ্চল কেন্দ্র বিদ্যমান, যা পার্থিব ঘাত-প্রতিঘাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

জীবন্মুক্ত ব্যক্তি স্বচ্ছ চেতনার মধ্যে স্থিত থাকেন। এই স্বচ্ছতা অর্থ হলো, তাঁর মন কোনো প্রকার পূর্বসংস্কার, কামনা, বাসনা বা আবেগের দ্বারা আবিল (আবদ্ধ) থাকে না। তাঁর দৃষ্টিতে সব কিছু পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয়, যেন আয়নার সামনে কোনো ধুলো জমে নেই। এখানে আবেগ অনুপস্থিত, কারণ সকল আবেগই চঞ্চলতা ও অস্থিরতার জন্ম দেয়। জীবন্মুক্তির ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা, যা নিস্পন্দ ও স্থির, তাই প্রধান। এই প্রজ্ঞা কোনো অর্জিত জ্ঞান নয়, বরং আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধি, যা সকল সংশয় ও ভ্রমের ঊর্ধ্বে।

জীবন্মুক্তির মনোবৃত্তি হলো অচঞ্চল, সমভাবযুক্ত এবং নিষ্কলুষ চেতনা। 'অচঞ্চল' বলতে মনের স্থিরতা বোঝায়, যা কোনো প্রকার বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ আলোড়নে টলে না। 'সমভাবযুক্ত' মানে তিনি জগতের সকল কিছুর প্রতি সমান দৃষ্টি রাখেন—ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, প্রশংসা-নিন্দা—সব কিছুকেই তিনি এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব বা বিদ্বেষ থাকে না। আর 'নিষ্কলুষ চেতনা' বলতে এমন এক বিশুদ্ধ মনকে বোঝায়, যা সকল প্রকার কলুষতা, যেমন লোভ, ক্রোধ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য থেকে মুক্ত। এই চেতনা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ এবং নির্মল।

এই অবস্থায় পৌঁছানো সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন গভীর আত্মানুসন্ধান, আত্ম-বিশ্লেষণ এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। যোগ ও ধ্যানের মাধ্যমে মনের চঞ্চলতা দূর করে বিশুদ্ধ চেতনার দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। যখন ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, তার প্রকৃত স্বরূপ বাহ্যিক জগতের কোনো কিছুর দ্বারা সংজ্ঞায়িত নয়, বরং সে আত্মারূপী এক অনন্ত সত্তা, তখনই সে এই জীবন্মুক্তির অবস্থায় উপনীত হয়। এই অবস্থা ব্যক্তিকে চরম মুক্তি ও শান্তি এনে দেয়, যেখানে দুঃখের কোনো স্থান নেই এবং আনন্দ কোনো বাহ্যিক উদ্দীপনার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত ও অভ্যন্তরীণ।

লোভ, ক্রোধ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই পাঁচটি শব্দ ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনে মানুষের অন্তরস্থ পাঁচটি প্রধান অশুভ বৃত্তি বা অন্তঃশত্রু হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এগুলিকে কখনো কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য এই ছয়টি রূপে “ষড়রিপু” বলা হয়—অর্থাৎ, মানুষের আত্মিক বিকাশে ছয়টি শত্রু।

ভগবদ্গীতায় (১৬.২১) বলা হয়েছে—“ত্রিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ । কামঃ ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্ত্রয়ং ত্যজেত্।” অর্থাৎ কাম, ক্রোধ ও লোভ আত্মার তিনটি নরকদ্বার, যা আত্মবিনাশের কারণ। এখানে গীতা এই তিনটিকে নরকের দরজা বলে ঘোষণা করেছে, কারণ এগুলো চিত্তকে অশান্ত করে এবং জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

গীতার (২.৬২-৬৩) আরেক জায়গায় বলা হয়েছে—“ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে, সঙ্গাত্ সঞ্জায়তে কামঃ, কামাত্ ক্রোধো’ভিজায়তে; ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ, সম্মোহাত্ স্মৃতিভ্রংশঃ, স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো, বুদ্ধিনাশাত্ প্রণশ্যতি।” অর্থাৎ, বিষয়চিন্তা থেকে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কামনা, কামনা থেকে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে মোহ, মোহ থেকে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ থেকে বুদ্ধিনাশ, আর বুদ্ধিনাশ থেকে আত্মবিনাশ। এটি কাম-ক্রোধ-মোহের কারণগত শৃঙ্খলাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।

গীতা (৩.৩৭) আরও বলে—“কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ, মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্।” কাম ও ক্রোধ রজোগুণ থেকে জন্মানো ভয়ংকর শত্রু, যা জ্ঞানের আলোককে গ্রাস করে ফেলে।

এই ধারণা পরবর্তী ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণেও বিস্তৃত হয়। মনুস্মৃতি (৭.৪৫) স্পষ্টভাবে বলে—“কামক্রোধলোভমোহমদমাৎস্যান্ সংযম্য নিত্যশঃ।” অর্থাৎ, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এই ছয়টি বৃত্তিকে সর্বদা সংযত করতে হবে। মহাভারতের শান্তি পর্বে (১২.১৭১.২১) বলা হয়েছে—“কামঃ ক্রোধস্তথা লোভো মোহমাদ্যমাৎস্যর্যঞ্চ ষট্, এষা নরকদ্বারাণি শরীরস্থানি নিত্যশঃ।” অর্থাৎ, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এই ছয়টি মানব শরীরের মধ্যেই নরকদ্বাররূপে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে।

বেদান্তসার (সদানন্দ যোগেন্দ্র) অনুসারে মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায় হলো অবিদ্যা ও এই ষড়্‌রিপু—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এগুলোই অন্তঃশত্রু, যা জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে রাখে। শঙ্করাচার্য গীতা ভাষ্যে (১৬.২১) বলেন—“কামলোভক্রোধাঃ ত্রয়ো’পি রজোগুণসম্ভূতাঃ, জ্ঞানবোধবাধকাঃ”—কাম, লোভ ও ক্রোধ রজোগুণ থেকে জন্মানো এবং জ্ঞানবোধকে বাধা দেয়।

কাম মানে ইন্দ্রিয় বা মনে উদ্ভূত ভোগইচ্ছা, সুখের আকাঙ্ক্ষা বা ইন্দ্রিয়বিষয়ে আসক্তি। ভগবদ্গীতায় (৩.৩৭) বলা হয়েছে—“কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ”—কাম হচ্ছে রজোগুণ থেকে জন্মানো সেই আকাঙ্ক্ষা যা চেতনাকে গ্রাস করে। আবার গীতায় (২.৬২-৬৩) বলা হয়েছে—“ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে, সঙ্গাত্ সঞ্জায়তে কামঃ”—বিষয়চিন্তা থেকে আসক্তি জন্মায়, আর আসক্তি থেকে কাম। অদ্বৈত বেদান্তে কাম মানে আত্মবিস্মৃতি—চেতনা যখন নিজের পূর্ণতা ভুলে অনিত্যের মধ্যে আনন্দ খোঁজে, তখন কাম জন্মায়। কাম থেকে ক্রোধ, ক্রোধ থেকে মোহ, মোহ থেকে বুদ্ধিনাশ, আর বুদ্ধিনাশ থেকে আত্মবিনাশ—এই ধারাটিই গীতার মনস্তত্ত্ব।