অবিদ্যা-বিদ্যা: ১


ব্রহ্ম একমাত্র সত্য। তিনি অনন্ত, স্বপ্রকাশ, অংশহীন এবং দ্বিতীয়হীন—যেমন উপনিষদ বলে, “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.১.১)। ব্রহ্ম কোনো গুণবিশিষ্ট বস্তু নন; তিনি স্বরূপতই অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দ। এই অবস্থায় কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই—না জগৎ, না জীব, না ঈশ্বর। “সর্বম্ খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩.১৪.১) এই ঘোষণা বোঝায় যে, যা-কিছু আছে, সবই ব্রহ্ম, তার বাইরে কিছুই নয়। তিনি অখণ্ড, অসীম, স্বয়ংজ্যোতির্ময়—যিনি নিজেই সমস্ত আলোর উৎস।

কিন্তু সেই অনন্ত চৈতন্যের মধ্যেই যেন এক সূক্ষ্ম কম্পন ঘটে—যেন নিজের স্বচ্ছ আয়নায় এক হালকা গোধূলি-ছায়া পড়ে। এই ছায়াই অবিদ্যা। এটি না পুরো সত্য, না পুরো অসত্য; না সম্পূর্ণ অস্তিত্ব, না সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব—তাই একে বলে অনির্বচনীয় (অবর্ণনীয়)। এটি অনাদি, কারণ ব্রহ্মের পূর্বে কিছুই নেই, যা একে উৎপন্ন করতে পারে; কিন্তু এটি অনন্ত নয়, কারণ জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে এর লয় ঘটে। শঙ্কর বলেন, “অবিদ্যা অনাদি, কিন্তু বিদ্যাবলে নাশ্যা” (উপদেশসাহস্রী, অধ্যায় ১৮)—অর্থাৎ, এর শুরু নেই, কিন্তু শেষ আছে। জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা বিলীন হয়, যেমন সূর্যোদয়ে অন্ধকার মিলিয়ে যায়।

অবিদ্যা ব্রহ্মের কোনো সৃষ্টি নয়; এটি চৈতন্যেরই প্রতিফলিত বিকৃতি। যেমন অন্ধকার কোনো বস্তু নয়, কেবল আলোর অনুপস্থিতি, তেমনি অবিদ্যা কোনো স্বাধীন সত্তা নয়—এ চৈতন্যের সীমাবদ্ধ প্রতিফলনমাত্র। শঙ্কর বলেন, “অবিদ্যা নাভাবমাত্রম্, কিঞ্চিদস্ত্যবিভাগলক্ষণম্” (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ২.১.১৪)—অবিদ্যা নিছক অভাব নয়, বরং বিভাজন সৃষ্টিকারী একটি নীতি। চৈতন্য যখন নিজের অসীমতাকে ভুলে যায়, তখন সীমার ধারণা জন্ম নেয়, আর সেই বিভ্রান্তি থেকেই মায়ার সূচনা।

যেমন দড়িকে ভুল করে সাপ বলে ধরা হয়, তেমনি ব্রহ্মের উপর অবিদ্যার ছায়া পড়লে জগৎরূপ প্রতিভাস দেখা দেয়। দড়িটি অপরিবর্তিত থাকে, কেবল দৃষ্টিভ্রমেই সাপ বলে মনে হয়; তেমনি ব্রহ্মও অপরিবর্তিত থেকেও বিভ্রমে বহুরূপে প্রতীয়মান হয়। শঙ্কর এই দৃষ্টান্ত বহু স্থানে ব্যবহার করেছেন—বিশেষত বিবেকচূড়ামণি (শ্লোক ১১৮-১২০) ও ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪)-এ। এই বিভ্রমের নামই মায়া। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪.১০) বলে—“মায়াং তু প্রকৃতিম্ বিদ্যান্ মায়িনম্ তু মহেশ্বরম্”—অর্থাৎ মায়া হল প্রকৃতি বা কারণশক্তি, আর মায়ী হল চৈতন্য নিজেই।

অবিদ্যার দুই শক্তি আছে—আবরণ ও বিক্ষেপ। আবরণ-শক্তি চৈতন্যের প্রকৃত রূপ আড়াল করে রাখে, যেমন ঘন মেঘ সূর্যকে ঢেকে দেয়; বিক্ষেপ-শক্তি সেই আড়ালের উপর নাম-রূপ নিক্ষেপ করে, মিথ্যা জগতের চিত্র তৈরি করে। প্রথমে অসীম চেতনা নিজের স্বরূপ ভুলে যায়—এটাই আবরণ। তারপর সেই ভুলে-যাওয়া চেতনা নিজের মধ্যে বহুরূপ কল্পনা করে—এটাই বিক্ষেপ। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি প্রথমে জাগ্রত জগৎ ভুলে যায়, তারপর নিজের মনের মধ্যে স্বপ্নের জগৎ সৃষ্টি করে, তেমনি চেতনা নিজেকে ভুলে গিয়ে নিজের মধ্যেই জগতের মায়া বিস্তার করে।

এই জগৎ কোনো বাহ্যিক বাস্তব নয়। এটি চৈতন্যের নিজের ভুল পাঠ। স্বপ্নে নদী, শহর, মানুষ সবই মনের ভাব, তবু ঘুমন্তের কাছে বাস্তব মনে হয়; তেমনি জাগ্রত জগৎও চৈতন্যের ভ্রান্ত প্রতিচ্ছবি। জ্ঞানোদয়ের পর বোঝা যায়—সবই সেই এক চৈতন্য, যার বাইরে কিছুই নেই। তাই অদ্বৈত বেদান্ত বলে—“ব্রহ্ম সত্যম্, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”—যা শঙ্করীয় দর্শনের মূল বা সার (ছান্দোগ্য উপনিষদের “নেহ নানাস্তি কিঞ্চন”, ৬.২.১-এর ভাবার্থ)।

অবিদ্যা এক অন্তর্বর্তী স্তর, যেখানে চেতনা নিজেকে জানে, আবার জানেও না। এটি সেই গোধূলি, যেখানে আলো ও ছায়া মিশে যায়।

“সদ্ এব্ সোম্য ইদমগ্র আাসীৎ”—ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.২.১)-এর এই বাক্যে ঋষি ঊদ্দালক তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে শিক্ষা দেন যে, এই জগৎ প্রথমে কেবল “সৎ” ছিল—অস্তিত্বমাত্র, এক ও দ্বিতীয়হীন। “একমেব আদ্বিতীয়ম্”—এই কথাটিই অদ্বৈতের প্রথম ভিত্তি। এখানে “সৎ” মানে এমন এক অস্তিত্ব, যা কখনও লোপ পায় না, যার কোনো বিপরীত নেই, যা সব কিছুর মূল কারণ ও ভিত্তি। এই “সৎ” থেকে জগতের উদ্ভব, তাতে স্থিতি, এবং তাতেই লয়। বেদান্তে এটিই ব্রহ্মের অস্তিত্বস্বরূপ বা sat-svarūpa।

“প্রজ্ঞানের ব্রহ্ম”—বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.১৩)-এর এই উক্তিটি বেদান্তের অন্যতম “মহাবাক্য”। এখানে “প্রজ্ঞা” মানে স্বচেতনা, যা সমস্ত জ্ঞান, অনুভব, ও অভিজ্ঞতার উৎস। তাই বলা হয়—চেতনা বা প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম। শঙ্করাচার্য বলেন, “প্রজ্ঞানের” অর্থ কোনো ব্যক্তিগত বুদ্ধি নয়; এটি সেই সর্বব্যাপী চৈতন্য, যা প্রতিটি জীবের মধ্যে সমানভাবে প্রকাশিত। যে-চেতনা দ্বারা দেখা, শোনা, অনুভব ও চিন্তা সম্ভব—সেই চেতনা নিজেই ব্রহ্ম। এই মন্ত্র ব্রহ্মের চৈতন্যস্বরূপ বা cit-svarūpa প্রতিষ্ঠা করে। তাই অদ্বৈত বলে—ব্রহ্ম কোনো জড় পদার্থ নয়; তিনি চৈতন্যময়, স্বপ্রকাশ ও অবিভাজ্য।

“আনন্দো ব্রহ্মেত্যবিজানাত”—তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.৭.১)-এর এই বাক্যটি ঋষির উপলব্ধির ফলাফল। তিনি স্তরে স্তরে অন্বেষণ করেছেন—“ব্রহ্ম কী?” প্রথমে অন্নময় (ভৌত দেহ), তারপর প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময় পরত অতিক্রম করে শেষে যে-স্তরে পৌঁছেছেন, সেখানে সব দুঃখ ও ভেদ লোপ পেয়েছে। সেই পরতকে বলা হয়েছে আনন্দময়, এবং সেই আনন্দই ব্রহ্ম। কিন্তু এই “আনন্দ” কোনো ইন্দ্রিয়সুখ নয়; এটি আত্মানন্দ—নিজস্ব স্বরূপে প্রতিষ্ঠার আনন্দ। শঙ্কর বলেন, “আনন্দঃ ন তু ভোগানন্দঃ, কিন্তু স্বরূপানন্দঃ” (তৈত্তিরীয় উপনিষদভাষ্য (আনন্দবল্লী অংশ, বিশেষত ২.৭)-এর ব্যাখ্যার ভাবার্থ-নির্যাস)—এটি অনুভূতির সুখ নয়, অস্তিত্ব ও চেতনার ঐক্যে উদ্ভূত শান্তি। এই মন্ত্র ব্রহ্মের আনন্দস্বরূপ বা ānanda-svarūpa নির্দেশ করে।

তৈত্তিরীয় উপনিষদে আত্মাকে বলা হয়েছে যেন একের পর এক স্তরে আচ্ছন্ন, এবং মানুষ সেই স্তরগুলো পেরিয়ে তার আসল স্বরূপ—ব্রহ্ম—উপলব্ধি করে। এই স্তরগুলিকে বলা হয় পঞ্চকোষ, অর্থাৎ আত্মাকে ঘিরে থাকা পাঁচটি আবরক। এই শিক্ষাটি ব্রহ্মানন্দবল্লী নামে পরিচিত দ্বিতীয় অধ্যায়ে (২.১-২.৬) বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।

প্রথম স্তর অন্নময় কোষ। উপনিষদ বলে, “অন্নাদ্বৈ প্রজাঃ প্রজায়ন্তে। যাঃ কাশ্চ পৃথিবীংশ্রিতাঃ। অথো অন্নেনৈব জীবন্তি।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.১.১) অর্থাৎ, এই দেহ খাদ্য থেকে জন্মেছে, খাদ্যেই বেঁচে থাকে এবং খাদ্যেই ফিরে যায়। এটি মানুষের স্থূলদেহ—খাদ্যনির্ভর, ক্ষয়প্রাপ্ত এবং পরিবর্তনশীল। এখানে আত্মা দেহের সঙ্গে একাকার হয়ে থাকে, তাই মানুষ বলে, “আমি দেহ”। কিন্তু এই দেহ আসল আত্মা নয়, কারণ এটি নশ্বর; এটি আত্মার প্রথম আবরক মাত্র। শঙ্কর বলেন, এটি স্থূল উপাধি, চিরস্থায়ী নয়, ব্রহ্মও নয়।

দ্বিতীয় স্তর প্রাণময় কোষ। উপনিষদ ঘোষণা করে, “অন্যো’ন্তর আত্মা প্রাণময়ঃ তেনৈষ পূর্ণঃ” (তৈত্তিরীয়, ২.২.১)। অন্নময়ের অন্তরে আরেক অন্তরাত্মা আছে, প্রাণময়, যা জীবনের শক্তি। শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, চলনশক্তি—সব এর প্রকাশ। প্রাণময় স্তর দেহকে সচল রাখে, কিন্তু ঘুম বা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এর ক্রিয়া থেমে যায়। উপনিষদ বলে, “প্রাণো ৱা অন্নময়াত্ অতিরিচ্যতে” (২.২.২)—প্রাণময় দেহ অন্নময়ের চেয়ে সূক্ষ্মতর, তবু এটি পরিবর্তনশীল। তাই প্রাণও ব্রহ্ম নয়, আত্মার সূক্ষ্মতর আবরক মাত্র।

এরও অন্তরে আছে মনোময় কোষ। উপনিষদ বলে, “অন্যো’ন্তর আত্মা মনোময়ঃ তেনৈষ পূর্ণঃ” (তৈত্তিরীয়, ২.৩.১)। এখানে আত্মা মন বা চিন্তাশক্তির স্তরে প্রকাশিত হয়। ইচ্ছা, অনুভূতি, রাগ, প্রেম, সুখ ও দুঃখ—সবই এখানেই জন্ম নেয়। এই স্তরে আত্মা নিজেকে চিন্তাশীল সত্তা বলে ভাবে। উপনিষদ আবার বলে, “মনো ৱা প্রাণময়াত্ অতিরিচ্যতে” (২.৩.২)—মন প্রাণের চেয়ে সূক্ষ্মতর, কারণ এখানেই চেতনার প্রতিফলন ঘন হয়ে ওঠে। কিন্তু মনও পরিবর্তনশীল, কখনও শান্ত, কখনও অস্থির; তাই এটি আত্মা নয়।

মনোময়ের ভেতরে আছে বিজ্ঞানময় কোষ। উপনিষদ বলে, “অন্যো’ন্তর আত্মা বিজ্ঞানময়ঃ তেনৈষ পূর্ণঃ” (তৈত্তিরীয় ২.৪.১)। অর্থাৎ, “এর পর যে অন্তর্গত আত্মা আছে, সে বিজ্ঞানময়—অর্থাৎ বুদ্ধি বা জ্ঞান দ্বারা গঠিত; এই আত্মা সেই বিজ্ঞানময় স্তরে পূর্ণ।” এটি বুদ্ধি বা সিদ্ধান্তশক্তির স্তর, যেখানে বিচার, বিশ্লেষণ, নীতি ও আত্মসচেতনতা প্রকাশ পায়। এখানেই “আমি জানি”, “আমি করি”—এই বোধ জন্ম নেয়। উপনিষদ বলে, “বিজ্ঞানং ৱা মনোময়াত্ অতিরিচ্যতে” (২.৪.২)—বিজ্ঞানময় মনোময়ের চেয়ে সূক্ষ্ম, কারণ এখানে মন স্থিতি পায় জ্ঞানরূপে। কিন্তু এখানেও দ্বৈততা আছে—জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, কর্তা ও কর্মের বিভাজন। তাই বিজ্ঞানময় স্তরও আত্মা নয়; এটি আত্মার আরেক প্রতিবিম্বমাত্র।

এরও অন্তরতম স্তর হলো আনন্দময় কোষ। উপনিষদ বলে, “অন্যো’ন্তর আত্মা আনন্দময়ঃ তেনৈষ পূর্ণঃ” (তৈত্তিরীয়, ২.৫.১)। অর্থাৎ, “এরপর যে আরও অন্তর্গত আত্মা আছে, তিনি আনন্দময়—আনন্দে গঠিত; এই আত্মা সেই আনন্দময় স্তরে পরিপূর্ণ।” এটি গভীর প্রশান্তির স্তর, যেখানে মন, প্রাণ ও বুদ্ধি স্তিমিত হয়ে যায়, আর আত্মা নিঃশব্দ আনন্দে স্থিত থাকে। উপনিষদ বলে, “আনন্দোবা বিজ্ঞানময়াত্ অতিরিচ্যতে” (তৈত্তিরীয়, ২.৫.২)—আনন্দ বিজ্ঞানময়েরও অতিরিক্ত, কারণ এখানেই অনুভূতির দ্বৈততা ক্ষীণ হয়ে আসে। এই স্তর নিদ্রা বা সমাধিতে অনুভূত শান্তির মতো—যেখানে জ্ঞান বা চিন্তা নেই, কিন্তু অচেতন সুখ অনুভূত হয়। তবুও এটি চূড়ান্ত নয়, কারণ এটি সীমিত অভিজ্ঞতা; জ্ঞান উদিত হলে এই স্তরও অতিক্রান্ত হয়।

শঙ্কর এই অংশে বলেন, “আনন্দশব্দেনাত্র ন ভোগানন্দো গৃহ্যতে, কিন্তু আত্মনঃ স্বরূপানন্দ এভ” (তৈত্তিরীয় উপনিষদভাষ্য, ২.৭)। অর্থাৎ, এখানে আনন্দ বলতে ইন্দ্রিয়ভোগের সুখ বোঝানো হয়নি; বোঝানো হয়েছে আত্মার স্বরূপানন্দের আভাস। আনন্দময় স্তর আত্মার প্রতিবিম্ব—যেমন সূর্যের আলো জলে প্রতিফলিত হলে মৃদু কাঁপে, তেমনি আত্মার আনন্দ এই স্তরে সীমিতভাবে প্রতিফলিত হয়। সূর্যের আলোর কম্পনে সূর্যের কোনো ভূমিকা নেই, আত্মার বেলাতেও তা-ই।

এই আনন্দময়েরও অন্তর আত্মা। উপনিষদ বলে, “আনন্দো ব্রহ্মেত্যবিজানাত” (তৈত্তিরীয়, ২.৭.১)—ঋষি উপলব্ধি করেন, আনন্দই ব্রহ্ম। কিন্তু এই আনন্দ আর অভিজ্ঞতার আনন্দ নয়, এটি চিরন্তন আত্মার প্রকৃতি, যেখানে আর কোনো বিভাজন নেই। তখন অনুসন্ধানকারী জানে—আমি দেহ নই, আমি প্রাণ নই, আমি মন নই, আমি বুদ্ধি নই, এমনকি আনন্দময় স্তরও নই; আমি সেই চৈতন্যমাত্র, যার মধ্যে এই সব স্তর প্রতিফলিত হয়েছে, কিন্তু যে কোনো স্তরেই আবদ্ধ নয়।

এইভাবে উপনিষদ শেখায়, মানুষ যখন এই পাঁচ স্তরকে “আমি” বলে ভুল করে, তখন সে সীমাবদ্ধ। কিন্তু যখন জ্ঞানের আলোয় উপলব্ধি করে যে, এই স্তরগুলি কেবল আবরণ, তখন সে সেই আচ্ছাদন ভেদ করে আত্মার প্রকৃত স্বরূপে পৌঁছে যায়। তখন বোঝে—আমি সেই চিরন্তন সৎ-চিৎ-আনন্দ, যিনি এই সমস্ত স্তরের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছি, কিন্তু তাদের দ্বারা কখনও সীমাবদ্ধ হইনি। এই উপলব্ধিই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্ঞানই মুক্তি।

এই তিনটি উপনিষদীয় বাক্য—“সদ্ এব্ সোম্য ইদমগ্র আাসীৎ”, “প্রজ্ঞানের ব্রহ্ম”, এবং “আনন্দো ব্রহ্মেত্যবিজানাত”—মিলে ব্রহ্মের সম্পূর্ণ স্বরূপ নির্ধারণ করে। “সৎ” বোঝায় চিরন্তন অস্তিত্ব, “চিৎ” বোঝায় স্বচেতনা বা প্রজ্ঞা, “আনন্দ” বোঝায় সেই স্বচেতনার পূর্ণতা, শান্তি ও পরিতৃপ্তি। এই ত্রিবিধ স্বরূপই একত্রে ব্রহ্ম—যিনি অস্তিত্ব, চেতনা ও আনন্দের অখণ্ড ঐক্য। বেদান্ত এই ত্রয়ীকে কোনো তিনটি পৃথক গুণ বলে না, বরং একটিমাত্র সত্যের তিনটি দিক—যেমন সূর্যের আলো, তাপ ও দীপ্তি একে অপর থেকে আলাদা নয়, এই তিন মিলেই অখণ্ড-সূর্য-চেতনা। তাই বলা হয়, ব্রহ্ম মানেই সৎ-চিৎ-আনন্দ।