অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: সাতাশি



এই কারণ-শরীরই হলো আত্মার চারপাশে থাকা অন্ধকার পর্দা—অবিদ্যার ঘনতম স্তর—যার মধ্য দিয়ে আত্মা নিজেকে দেহ, মন ও অভিজ্ঞতার সীমায় আবদ্ধ মনে করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই কারণ-শরীরের অবিদ্যা টিকে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত জীব মোক্ষলাভ করতে পারে না। মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন এই কারণ-দেহের অজ্ঞান পর্দা ছিন্ন হয় এবং আত্মা নিজের প্রকৃত সত্তা—ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব—উপলব্ধি করে।

কারণ-শরীর (Kāraṇa Śarīra) অদ্বৈত বেদান্তে মানব-অস্তিত্বের সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং গভীর স্তর—যা দৃশ্যমান বা চিন্তনযোগ্য নয়, কিন্তু সমস্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তি হিসেবে বিদ্যমান। এটি মূল অবিদ্যা (Mūla Avidyā)-রই ব্যক্তিগত রূপ, অর্থাৎ জীবের সত্তায় অজ্ঞানতার সেই সূক্ষ্মতম কেন্দ্র, যেখানে আত্মা নিজের প্রকৃত সত্তা, ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব ভুলে থাকে।

এই দেহ কোনো পদার্থ নয়—না স্থূল (শরীর), না সূক্ষ্ম (মন-বুদ্ধি)—বরং সম্ভাবনার এক নিঃশব্দ আধার। এখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা, কর্মফল, এবং ভবিষ্যৎ জন্মের সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এ কারণে একে “বীজদেহ” বা “কারণ-দেহ” বলা হয়—যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতার বীজ জমা থাকে।

চেতনার তিনটি অবস্থার (জাগ্রত, স্বপ্ন, সুপ্তি) মধ্যে কারণ-শরীরের উপস্থিতি সর্বত্রই অব্যাহত থাকে। জাগ্রত অবস্থায় জীব কর্মে নিযুক্ত, স্বপ্ন অবস্থায় সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি দেখে, আর গভীর নিদ্রায় সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়—তবুও কারণ-শরীর থেকে অজ্ঞানতা ও সম্ভাবনার সূক্ষ্ম ছায়া বিলীন হয় না। গভীর নিদ্রা এই কারণ-শরীরের কার্যকারিতার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রকাশ, যেখানে জীব চেতনাকে অজ্ঞানের আচ্ছাদনে হারিয়ে ফেলে, তবুও সেই অজ্ঞানতার মধ্যে পরম শান্তি অনুভব করে। এই অবস্থাই প্রমাণ করে যে, কারণ-শরীর অজ্ঞানের আধার ও সংরক্ষক—এটি ঘুমন্ত, কিন্তু সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা ধারণ করে।

এই কারণ-শরীরই পুনর্জন্মের বীজ। কর্মের সমস্ত ছাপ বা সংস্কার এখানেই সঞ্চিত থাকে, যা পরবর্তী জন্মে নতুন সূক্ষ্ম ও স্থূল দেহ ধারণের কারণ হয়। যখন এক জীব মৃত্যুর মাধ্যমে একটি স্থূল শরীর ত্যাগ করে, কারণ-শরীর সেই অভিজ্ঞতার সম্ভাবনাগুলি ধরে রাখে এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে নতুন জন্মের মাধ্যমে পুনরায় প্রকাশিত হয়। এইভাবে সংসার বা পুনর্জন্মের অবিরাম চক্র বজায় থাকে, যতক্ষণ না এই কারণ-দেহে নিহিত মূল অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নাশ হয়।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে মুক্তি (Mokṣa) মানে শুধু স্থূল বা সূক্ষ্ম দেহের অপসারণ নয়, বরং এই কারণ-শরীরের অন্তর্নিহিত অজ্ঞানতার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। জ্ঞান (Vidyā) যখন উদ্ভাসিত হয়, তখন অবিদ্যা—এবং তার আধার কারণ-শরীর—দুটিই বিলীন হয়ে যায়। তখন আত্মা নিজের প্রকৃত অবস্থায়, ব্রহ্মরূপে, উদ্‌ভাসিত হয়—যেখানে আর কোনো ব্যক্তিসত্তা, কোনো কর্তা-ভোক্তা, কোনো কর্মফল বা পুনর্জন্মের ধারাবাহিকতা অবশিষ্ট থাকে না।

এইভাবে কারণ-শরীর অদ্বৈতের সম্পূর্ণ অধিবিদ্যাগত ব্যাখ্যার কেন্দ্রে অবস্থান করে: এটি জাগতিক অভিজ্ঞতার কারণ, বন্ধনের অবলম্বন এবং একই সঙ্গে মুক্তির সীমান্তরেখা। যতক্ষণ এটি থাকে, জীব সংসারে আবদ্ধ; কিন্তু একবার এটি অতিক্রান্ত হলে, জীব নিজস্ব ব্রহ্ম-স্বভাবের অনন্ত, অদ্বৈত আলোয় একাকার হয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্তে মানুষের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তিনটি স্তরে—স্থূল শরীর, সূক্ষ্ম শরীর ও কারণ-শরীর। এই তিনটি শরীর আত্মার উপর তিনটি আচ্ছাদনের মতো কাজ করে, যার ফলে চেতনার বিশুদ্ধ দীপ্তি ধীরে ধীরে আবৃত হয়ে সীমাবদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন স্বচ্ছ আলোর সামনে যদি তিনটি কাচের স্তর রাখা হয়—একটি মোটা, একটি পাতলা, আর একটি ঘন রঙের—তাহলে আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে, কিন্তু আলোর স্বরূপ পরিবর্তিত হয় না।

স্থূল শরীর হলো দৃশ্যমান দেহ, যা মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—এই পাঁচটি স্থূল মহাভূত দিয়ে গঠিত। এটি আমাদের জাগ্রত জীবনের বাহ্যিক উপকরণ, যার দ্বারা আমরা দেখি, চলি, খাই, কাজ করি এবং জগৎ অনুভব করি। এই দেহ কর্মফলের দ্বারা গঠিত এবং জন্ম, বৃদ্ধি, বার্ধক্য ও মৃত্যুর নিয়মে আবদ্ধ। দার্শনিক দৃষ্টিতে এটি অস্তিত্বের বাহ্য রূপ, যা নিত্য পরিবর্তনশীল ও নশ্বর। যেমন ঘর ভেঙে গেলে ঘরের বাসিন্দা অক্ষত থাকে, তেমনি স্থূল দেহ নষ্ট হলেও আত্মা নষ্ট হয় না।

সূক্ষ্ম শরীর হলো মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার এবং প্রাণশক্তির সমষ্টি। এটি অদৃশ্য, কিন্তু অভিজ্ঞতায় সর্বদা অনুভূত। চিন্তা, ইচ্ছা, আনন্দ, দুঃখ, সন্দেহ, সিদ্ধান্ত, স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা—সবই সূক্ষ্ম শরীরের কার্য। এটি স্থূল শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে ও সচল রাখে। জাগ্রত অবস্থায় এটি কাজ করে, আর স্বপ্ন অবস্থায় এটি নিজেরই জগত সৃষ্টি করে। সূক্ষ্ম শরীরই আত্মাকে জীবরূপে প্রকাশ করে, যার মাধ্যমে আত্মা বলে, “আমি ভাবি”, “আমি জানি”, “আমি করব”। এটি যেন বিদ্যুতের মতো, যা যন্ত্রকে সচল রাখে, কিন্তু নিজে দৃশ্যমান নয়।

কারণ-শরীর সবচেয়ে সূক্ষ্ম স্তর, যা অবিদ্যার আচ্ছাদন। এটি মায়ার গভীরতম স্তর, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা, কর্মফল, প্রবৃত্তি ও সম্ভাবনা বীজরূপে লুকিয়ে থাকে। এটি গভীর নিদ্রার অবস্থায় সক্রিয় থাকে, যখন মন, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় ও কর্ম সব স্থগিত, কিন্তু অজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে। কারণ-শরীর হলো সেই অচেতন অবস্থা, যেখানে দ্বৈততা নেই, চিন্তা নেই, কিন্তু জ্ঞানের আলোকও প্রকাশিত নয়। এটি হলো সমস্ত জীবনের মূল গর্ভ—যেমন বীজে সম্পূর্ণ বৃক্ষ লুকিয়ে থাকে, তেমনি কারণ-শরীরে স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে।

এই তিন শরীর পরস্পর যুক্ত ও একে অপরের অন্তর্ভুক্ত। কারণ-শরীর মূল বীজের মতো, সূক্ষ্ম শরীর সেই বীজের অঙ্কুর, আর স্থূল শরীর সেই অঙ্কুরের প্রকাশিত বৃক্ষ। একটি অন্যটির মধ্যে নিহিত এবং সব মিলিয়ে গঠন করে জীবনের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ পরিসর। ঘুম ও স্বপ্নের উদাহরণে দেখা যায়—গভীর নিদ্রায় কারণ-শরীর সক্রিয়, স্বপ্নে সূক্ষ্ম শরীর কার্যকর, জাগরণে স্থূল শরীর ক্রিয়াশীল। তিনটি একসঙ্গে আত্মার প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়।

আত্মা এই তিন শরীরের সাক্ষী। সে কোনো শরীর নয়, কিন্তু তিনটিরই উপস্থিতি তাকে দ্বারা আলোকিত। আত্মা স্থূল শরীরের মাধ্যমে জাগ্রত জগৎ অভিজ্ঞতা করে, সূক্ষ্ম শরীরের মাধ্যমে চিন্তা ও স্বপ্ন অনুভব করে, আর কারণ-শরীরের মাধ্যমে অজ্ঞানতা ও বিশ্রাম অনুভব করে। আত্মা অপরিবর্তনীয় চেতনা, তিন শরীরই তার উপাধি, যা অস্থায়ী ও সীমাবদ্ধ।

একটি দার্শনিক দৃষ্টান্তে, আত্মা সূর্যের মতো—যিনি তিনটি অবস্থায়ও অপরিবর্তিত। স্থূল শরীর সূর্যের ছায়ার মতো, সূক্ষ্ম শরীর তার রশ্মির মতো, আর কারণ-শরীর তার আভামণ্ডলের মতো। সূর্য সব কিছুকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কিছুতে মিশে না। আবার মেঘের দৃষ্টান্তেও দেখা যায়—আকাশ চিরন্তন, মেঘের আর্দ্রতা কারণ-শরীর, মেঘের বর্ণ সূক্ষ্ম শরীর, আর মেঘের ছায়া স্থূল শরীর। আকাশ নিঃস্পর্শ, কিন্তু মেঘের উপস্থিতিতে আকাশ ঢাকা পড়ে বলে মনে হয়।

জ্ঞানলাভ মানে হলো এই তিন শরীরকে আত্মা থেকে পৃথক বলে উপলব্ধি করা। তখন জানা যায়, “আমি দেহ নই, মন নই, অজ্ঞানও নই”—আমি সেই বিশুদ্ধ চেতনা, যার উপস্থিতিতে দেহ বাঁচে, মন চিন্তা করে, আর নিদ্রা প্রশান্তি দেয়। এই উপলব্ধি হলো মুক্তির প্রারম্ভ, যেখানে আত্মা নিজের চিরনির্মল, স্বপ্রভ ও অবিনশ্বর রূপে উদ্‌ভাসিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তের পরবর্তী বিকাশে দুটি প্রধান ব্যাখ্যাশৈলী গঠিত হয়েছিল—ভামতী শাখা (Bhāmatī School) ও বিবরণ শাখা (Vivaraṇa School)। এই দুই ধারাই শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত ব্যাখ্যার উত্তরাধিকারী, তবে জ্ঞানতত্ত্ব, অবিদ্যা ও মুক্তির প্রকৃতি নিয়ে এদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা সূক্ষ্মভাবে ভিন্ন।

ভামতী শাখার প্রতিষ্ঠাতা বাচস্পতি মিশ্র (Vācaspati Miśra)। তিনি শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এর উপর ‘ভামতী’ নামে একটি সুবিখ্যাত টীকা রচনা করেন। তাঁর ভাবনা বেশি যুক্তিনির্ভর ও ন্যায়দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। ভামতী শাখা অবিদ্যাকে জীবাশ্রয়িনী বলে মেনে নেয়—অর্থাৎ অবিদ্যা ব্যক্তির মধ্যে অবস্থিত। প্রতিটি জীবের নিজস্ব অবিদ্যা আছে, যার কারণে সে ব্রহ্মকে ভুলভাবে উপলব্ধি করে। জীবের চেতনার উপরই অবিদ্যার আবরণ পড়ে, এবং জ্ঞান উদিত হলে সেই ব্যক্তিগত অবিদ্যা দূর হয়। তাই ভামতী-মতে, অবিদ্যা ব্যক্তিনিষ্ঠ, মহাজাগতিক নয়।

অন্যদিকে, বিবরণ শাখা শুরু হয় প্রকাশাত্মা (Prakāśātman)-এর পঞ্চপাদিকা বিবরণ (Pañcapādikā Vivaraṇa) থেকে। এই ধারা পরে বিদ্যারণ্য স্বামী, সুরেশ্বরাচার্য, সার্বজ্ঞাত্মা মুনী প্রমুখ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। বিবরণ শাখা অবিদ্যাকে ব্রহ্মাশ্রয়িনী বলে ব্যাখ্যা করে—অর্থাৎ অবিদ্যা ব্রহ্মের ওপর আরোপিত। এখানে অজ্ঞতা কোনো ব্যক্তির সীমায়িত অবস্থা নয়, বরং ব্রহ্মের অনাদি আচ্ছাদনশক্তি, যার ফলে ঈশ্বর ও জগতের প্রতীয়মানতা ঘটে। বিবরণ মতে, ব্রহ্মই অবিদ্যার আশ্রয়, কিন্তু ব্রহ্ম নিজে তাতে স্পর্শহীন—যেমন সূর্যের আলোয় মেঘ সৃষ্টি হলেও সূর্য অন্ধকারে আবদ্ধ হয় না।

ভামতী শাখা মানুষের অভ্যন্তরীণ চেতনা ও অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করে—এর দৃষ্টি মনস্তাত্ত্বিক (psychological)। বিবরণ শাখা জগত ও ব্রহ্মের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে—এর দৃষ্টি সত্তাতাত্ত্বিক (metaphysical)। একটির কেন্দ্রে ব্যক্তিগত অবিদ্যা, অন্যটির কেন্দ্রে মহাজাগতিক মায়া। তবু উভয়ই একমত যে, জ্ঞান (ব্রহ্মবিদ্যা) প্রকাশিত হলেই অবিদ্যা বিলীন হয়, এবং তখন জানা যায়—‘জীব’ ও ‘ঈশ্বর’-কে যে দুই ভাবা হচ্ছিল, তারা আসলে একই চেতনার দুটি প্রতীয়মান স্তর মাত্র।

ভামতী শাখা বলে অবিদ্যা জীবাশ্রয়িনী, বিবরণ শাখা বলে অবিদ্যা ব্রহ্মাশ্রয়িনী। একটিতে অজ্ঞতার কেন্দ্র জীব, অন্যটিতে সেই কেন্দ্র ব্রহ্মের উপর আরোপিত মায়া। তবু উভয়েই একমত যে অবিদ্যা অনাদি এবং জ্ঞান দ্বারা নিবারণীয়; পার্থক্য শুধু এই যে—অবিদ্যার প্রভাব কোথায় আরম্ভ হয়—ব্যক্তির চেতনায়, না চূড়ান্ত চেতনায়।

ভামতী ও বিবরণ শাখার মধ্যকার সূক্ষ্ম তত্ত্বমূলক পার্থক্য অদ্বৈতের গভীরতাকে স্পষ্ট করে তোলে, বিশেষত অবিদ্যার আধার (āśraya) নিয়ে বিতর্কে।

বিবরণ (Vivarana) শাখা শঙ্কর-পরবর্তী এক কঠোর অদ্বৈতধর্মী অবস্থান থেকে যুক্তি দেয় যে, যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং অন্য কোনো স্বাধীন সত্তা নেই, তাই অবিদ্যা (Avidyā) —অজ্ঞানতা—ব্রহ্মের বাইরের কিছু হতে পারে না। সুতরাং ব্রহ্মকেই অবিদ্যার আধার (āśraya) ও বিষয় (viṣaya) উভয় হিসেবেই মানতে হবে। এখানে আপাত সমস্যাটি হচ্ছে—কীভাবে এক শুদ্ধ, সর্বজ্ঞ, স্বপ্রকাশমান চেতনা একই সঙ্গে অজ্ঞানতার আধার হতে পারে? এই দ্বন্দ্বই বিবরণ শাখার দর্শনীয় কৌশলের মূল প্রেরণা।

তাঁরা যুক্তি দেন যে, আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞান (pramā) নিজেই অবিদ্যার দ্বারা পূর্বানুমিত বা শর্তাধীন—অর্থাৎ জ্ঞানলাভের পূর্বেই অজ্ঞানতা কার্যকর। ফলে অবিদ্যার উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা যে যুক্তি বা অভিজ্ঞতা ব্যবহার করি, সেটি নিজেই অবিদ্যার ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। এই অবস্থায় ব্রহ্মের মধ্যে অজ্ঞানতা কীভাবে অবস্থান করে, তা প্রমাণ করতে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাজাত যুক্তি প্রয়োগ করা নিজেই অপ্রামাণ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে যুক্তিগতভাবে অবিদ্যার উৎস অনুসন্ধান বৃথা।

বিবরণ ব্যাখ্যা করে যে, অবিদ্যা ব্রহ্মকে প্রকৃতভাবে কলুষিত করে না, বরং ব্রহ্মের সীমাহীন স্বরূপে আপাতভাবে একটি বিভ্রমের ছায়া ফেলে। যেমন সূর্য কখনও মেঘে ঢাকা পড়লেও প্রকৃতপক্ষে মেঘ সূর্যের আলোকে স্পর্শ করতে পারে না, কেবল দৃষ্টিকোণে বাধা সৃষ্টি করে; তেমনই অবিদ্যা ব্রহ্মকে আচ্ছন্ন করে না, বরং জীবের দৃষ্টিতে সেই চেতনা আংশিক ও সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়।

এইভাবে বিবরণ শাখা ব্রহ্মের পবিত্র, নিরপেক্ষ স্বরূপ অক্ষুণ্ণ রাখে, অথচ অভিজ্ঞতামূলক বিশ্বের ব্যাখ্যার জন্য অবিদ্যার কার্য-কারণিক বাস্তবতাকেও স্থান দেয়। এর ফলে অদ্বৈত বেদান্ত তার মৌলিক অ-দ্বৈত নীতি ভঙ্গ না করেই অজ্ঞানতা ও জগতের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।