অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: সাতষট্টি



আধার ও মায়া—অদ্বৈতের মতে, জগৎ নিজে থেকে টেকে না; এর অস্তিত্ব নির্ভর করে ব্রহ্মের ওপর। ব্রহ্ম হচ্ছে পরম, নিরাকার, স্বয়ংপ্রকাশমান চেতনা। মায়া হচ্ছে সেই অজ্ঞান শক্তি, যা ব্রহ্মের ওপর নাম-রূপের আবির্ভাব ঘটায়। অতএব, মায়ার দ্বারা সৃষ্ট জগৎ আধার-নির্ভর বিভ্রম। ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই টেকে না, যেমন সাপের বিভ্রমও দড়ি ছাড়া হতে পারে না। যখন আত্মজ্ঞান আসে, তখন এই মায়াময় বিভ্রম বিলুপ্ত হয়—তবে আধার (ব্রহ্ম) অনন্তভাবে অবশিষ্ট থাকে।

শূন্যতা-দৃষ্টির প্রবক্তা বৌদ্ধের মাধ্যমক দর্শনে, নাগার্জুন বলেন—“স্বভাবশূন্যতা” (svabhāva-śūnyatā) মানে কোনো বস্তু বা সত্তা নিজের মধ্যে স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নয়। কিন্তু এখানে কোনো “আধার” বা “ব্রহ্ম” নেই। জগৎ বিভ্রম নয়; বরং এটি নির্ভরতার সূত্রে উদিত (pratītya-samutpāda)। অদ্বৈত যেখানে বলে—“ভ্রান্তির পেছনে এক চূড়ান্ত বাস্তবতা আছে”, বৌদ্ধ বলে—“ভ্রান্তির পেছনে কিছুই স্থায়ী নেই—শুধু সম্পর্কের প্রবাহ আছে।” অদ্বৈত তাই আধার-নির্ভর একত্ববাদ, আর মাধ্যমক আধার-অস্বীকারী সম্পর্কবাদ।

জ্ঞানের পথে দুই ভিন্ন দিক—অদ্বৈতের পথ: এই অজ্ঞান দূর হলে দেখা যায়—জগৎ ছিল মায়া, কিন্তু ব্রহ্ম একমাত্র সত্য—“ব্রহ্ম সত্যং, জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।” মাধ্যমকের পথ: এই অজ্ঞান দূর হলে দেখা যায়—জগৎ কোনো স্বতঃসিদ্ধ সত্তা নয়; সব কিছুই পরনির্ভর, অনিত্য ও শূন্য। “শূন্যতা প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞাই মুক্তি।”

অদ্বৈত বেদান্তের মিথ্যা ও মাধ্যমক বৌদ্ধের স্বভাব-শূন্যতা—দুটি ভিন্ন ভাষায় একই প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়—“এই যে জগৎ আমরা দেখি, তা কতখানি সত্য?” অদ্বৈত বলে: জগৎ সত্য নয়, কিন্তু এক সত্যের (ব্রহ্মের) প্রকাশ। বৌদ্ধ বলে: জগৎ স্বতন্ত্র নয়, কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে সত্য। অদ্বৈত চায় মায়ার পেছনের “আধার”-কে চিনতে, বৌদ্ধ চায় “আধার”-এর ধারণাটাকেই বিলুপ্ত করতে।

অদ্বৈতের মতে—মায়া হলো অস্তিত্বের ভুল ধারণা, যা জ্ঞানের আলোয় মিলিয়ে যায়, কিন্তু চূড়ান্ত সত্য (ব্রহ্ম) অপরিবর্তনীয়ভাবে থেকে যায়। বৌদ্ধের মতে—জগৎ নিজেই পরনির্ভর শূন্যতা, যেখানে কোনো স্থায়ী বাস্তবতা নেই; শুধু কারণ-কার্য, সম্পর্ক ও প্রবাহ। দু-পথই শেখায়—চূড়ান্ত সত্যকে ভাষায় বেঁধে রাখা যায় না। একজন বলে—“ব্রহ্ম অনির্বচনীয়”, অন্যজন বলে—“শূন্যতা নির্বচনীয়তীত।” এবং, শেষপর্যন্ত—উভয়ের নীরবতাই একে অপরকে স্পর্শ করে।

‘স্বভাব-শূন্যতা’ মানে কী? মাধ্যমক বলে—জগতে যা-কিছু দেখা যায়, তার নিজের ভেতরে কোনো স্বাধীন, স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় “স্বভাব” (svabhāva) নেই। যদি কোনো জিনিস একেবারেই নিজের জোরে, অন্য কিছুর সাহায্য ছাড়াই, চিরদিন একইভাবে থাকতে পারত, সেটাই হতো “স্বভাব”। বাস্তবে এমন কিছু নেই—এটাই শূন্যতা। শূন্যতা মানে স্বাধীন-স্বভাবের অনুপস্থিতি।

কেন ‘শূন্য’ বলা হয়: শর্ত-নির্ভর উদয়—কোনো ঘটনা বা বস্তু শর্ত (causes & conditions) মিললে দেখা দেয়, শর্ত ভাঙলে মিলিয়ে যায়। উদাহরণ: প্রতিধ্বনি—কণ্ঠস্বর, দূরত্ব, দেয়ালের কোণ, বাতাস—এসব শর্ত না থাকলে আওয়াজ ফেরত আসে না। প্রতিধ্বনি “আছে”, এটা ব্যাবহারিকভাবে সত্য, কিন্তু তার নিজস্ব কোনো স্বাধীন উৎস-সত্তা নেই; সে শর্ত-নির্ভর উপস্থিতি। মাধ্যমক ঠিক এই দৃষ্টিতে সমস্ত ঘটনাকে দেখায়: দেখা দেয়—কারণ আছে বলেই; টেকে—কারণে টেকে; তাই এদের নিজস্ব কোনো সার নেই।

‘আধার’ (substratum) ধারণার স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান—অদ্বৈত বলে, “দৃশ্যজগৎ মায়া; কিন্তু ব্রহ্ম নামে একটি চূড়ান্ত আধার আছে, যার ওপর এই আবির্ভাব।” মাধ্যমক বলে, এমন কোনো স্থায়ী আধারের দরকার একদমই নেই। কারণ ঘটনার সত্যতা—নির্ভরতার জালে। “শূন্যতা” মানে এই—ঘটনা নিজে-নিজে টেকে না, আবার কোনো আলাদা চিরন্তন ভিত্তির ওপরও দাঁড়িয়ে নেই; তারা পারস্পরিক নির্ভর সম্পর্কেই উদিত।

অদ্বৈত উদাহরণ দেয়—অল্প আলোয় দড়িকে সাপ মনে হওয়া। জ্ঞান এলে “সাপ” ভ্রান্তি সরে যায়, দড়ি (ব্রহ্ম) অবশিষ্ট থাকে। মাধ্যমক এখানে বলে, ‘দড়ি’ আর ‘সাপ’—দুটোই ধারণাগত, নির্ভর-নির্দেশিত (dependently designated) নাম। এদের কোনো নিজস্ব, স্বাধীন, অপরিবর্তনীয় সারসত্তা নেই। আমরা প্রেক্ষিত, অংশ-সমগ্র, ভাষা, স্মৃতি, ইন্দ্রিয়—এসব শর্তে “দড়ি” বলি বা “সাপ” বলি। তাই একক, স্বাধীন ‘আধার’ দরকার—এই ধারণাটাই অপ্রয়োজনীয়।

জগৎ-দর্শন থেকে উঠে আসা জ্ঞানতত্ত্ব—দুই পথে দুই ভরসা। অদ্বৈত—একটি ধারণাভিত্তিক-বস্তুনিষ্ঠ (conceptual realist) ভরসা রাখে—সর্বজনীন (universal) ধারণা—ব্রহ্ম/আত্মা—বাস্তব ও চূড়ান্ত আধার। তাই জ্ঞানে স্তরবিন্যাস মেনে নেয়:
১) প্রত্যক্ষ (ইন্দ্রিয়/মন-প্রত্যক্ষ),
২) শাস্ত্র/যুক্তি (শাস্ত্র-জ্ঞান, তর্ক),
৩) চূড়ান্ত ব্রহ্মজ্ঞান (অপরোক্ষ আধ্যাত্মিক উপলব্ধি)—যেখানে নিম্নতর সত্যগুলো “বাধিত” (sublated) হয়ে যায়, শুধু ব্রহ্ম-সত্য থাকে।

মাধ্যমক/বৌদ্ধ—একটি নামমাত্রবাদী (nominalist) ভরসা রাখে—সর্বজনীন/রূপাত্মক ধারণাকে স্বাধীন বাস্তবতা দেয় না; আলাদা সত্তা বলে কিছু প্রতিষ্ঠা করে না; কেবল নির্ভরশীল বিশেষ (particulars)—যা শর্তে উদিত—তাকেই মেনে নেয়। এই সর্বজনীনকে বাস্তবতা না দেওয়া-ই মাধ্যমকের দর্শনগত ভিত্তি; তাই সব ঘটনাতেই স্বভাব (সহজাত সার) অস্বীকার করে; ব্রহ্ম-জাতীয় স্থায়ী আধার—সেটাও বাতিল হয়।

নামমাত্রবাদ (Nominalism) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন nomen (নাম) থেকে। এর মূল ধারণা হলো—“সর্বজনীন (universals)” বলে কোনো বাস্তব, স্বতন্ত্র সত্তা নেই; এগুলো কেবল নামমাত্র—অর্থাৎ মানুষের ধারণা বা ভাষার তৈরি লেবেল। এই তত্ত্ব মধ্যযুগে “সর্বজনীন (Universals)” বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। প্রশ্ন ছিল—“‘মানুষ’, ‘বৃক্ষ’, ‘রং’ ইত্যাদি সর্বজনীন ধারণাগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি?” তখন তিনটি প্রধান মত তৈরি হয়—

বাস্তববাদ (Realism): বাস্তববাদের মূল ধারণা হলো—সর্বজনীন বা সাধারণ ধারণাগুলো (যেমন ‘মানবত্ব’, ‘সৌন্দর্য’, ‘লালত্ব’) বাস্তবে সত্যিই অস্তিত্বশীল। এগুলো কেবল আমাদের মনের কল্পনা নয়, বরং স্বাধীনভাবে বাস্তব জগতে বিদ্যমান। আমরা যে ব্যক্তি বা মানুষ দেখি, তারা সবাই “মানবত্ব” নামের এক চিরন্তন সারসত্তার অংশমাত্র। যেমন প্লেটোর “Forms” বা “Ideas”—বাস্তব জগৎ তাদের ছায়া বা প্রতিফলন। অদ্বৈত বেদান্তও এই দৃষ্টিভঙ্গির নিকটে, কারণ সেখানে বলা হয়—সব নাম-রূপের পেছনে এক চূড়ান্ত সারসত্তা আছে, যা ব্রহ্ম। তাই বাস্তববাদের মতে, সাধারণ ধারণাগুলো কেবল চিন্তার নাম নয়, বরং চূড়ান্ত সত্যের প্রকাশ।

ধারণাবাদ (Conceptualism): ধারণাবাদ বলে—সর্বজনীন ধারণাগুলো বাস্তব জগতে নেই, কিন্তু মনের মধ্যে একটি বাস্তব মানসিক ধারণা হিসেবে থাকে। আমরা একাধিক ব্যক্তি বা বস্তু দেখে মনের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা গঠন করি। উদাহরণস্বরূপ, তুমি যদি ১০ জন মানুষ দেখো, তুমি জানো তারা আলাদা, তবুও বলো—“সবাই মানুষ”—কারণ তোমার মনের মধ্যে ‘মানুষত্ব’ নামের একটি সাধারণ ধারণা তৈরি হয়। এই ‘মানুষত্ব’ কোনো চিরন্তন সারসত্তা নয়, বরং বুদ্ধির দ্বারা সংগঠিত একটি মানসিক কাঠামো। অ্যারিস্টটল ও মধ্যযুগীয় চিন্তক অ্যাবেলার্ড এই মতের সমর্থক ছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, সর্বজনীন ধারণা বাস্তব নয়, কিন্তু মনের সংগঠনে তাদের একটি যুক্তিসঙ্গত অবস্থান আছে।

নামমাত্রবাদ (Nominalism): নামমাত্রবাদের মূল অবস্থান হলো—সর্বজনীন ধারণাগুলো বাস্তবে নেই, মনের মধ্যেও কোনো স্বতন্ত্র বাস্তবতা নেই। এগুলো কেবল ভাষার সুবিধাজনক চিহ্ন, যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত নামমাত্র। বাস্তবে আছে কেবল পৃথক বস্তু—রাম, রমেশ, রাখী, রুবি—এমন আলাদা আলাদা মানুষ। “মানুষত্ব” বলে কোনো স্বাধীন সত্তা নেই; আমরা কেবল তাদের মিল-থাকা বৈশিষ্ট্য দেখে এক নাম দিই—“মানুষ”। উইলিয়াম অফ অকহ্যাম এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা। তাঁর মতে, বাস্তবে আছে কেবল নির্দিষ্ট বস্তু, সর্বজনীন ধারণা কেবল নাম। তাই নামমাত্রবাদ বলে—“সর্বজনীন ধারণা” কোনো স্বাধীন সত্য নয়, বরং ভাষার নির্মাণ, মানুষের মানসিক বা সামাজিক প্রয়োজনের প্রতিফলন।

তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, বাস্তববাদ মনে করে, সর্বজনীন ধারণাগুলো বাস্তবভাবে আছে; ধারণাবাদ মনে করে, তারা মনের ধারণা; আর নামমাত্রবাদ মনে করে, তারা শুধুই ভাষার চিহ্ন। বাস্তববাদ খোঁজে একটি চূড়ান্ত সারসত্তা, ধারণাবাদ গুরুত্ব দেয় মানসিক ধারণাকে, আর নামমাত্রবাদ সব সারসত্তাকে অস্বীকার করে সম্পর্ক ও নামের ভেতরেই অর্থ খোঁজে। নামমাত্রবাদ এখানে সবচেয়ে র‍্যাডিকাল অবস্থান নেয়—“‘মানবত্ব’ নামের কোনো একক সত্তা নেই; আছে কেবল পৃথক মানুষ। ‘মানুষ’ শব্দটা কেবল তাদের একত্রে বোঝানোর ভাষাগত সুবিধা।”

মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শন নামমাত্রবাদী এই অর্থে—এটি “সর্বজনীন” বা “স্থায়ী সারসত্তা” (svabhāva) অস্বীকার করে। প্রতিটি বস্তু, চিন্তা বা ঘটনা নির্ভরশীলভাবে উদ্ভূত হয় (প্রতীত্যসমুত্পাদ)। তাই “আত্মা”, “জগৎ”, “চেতনা”—এসবকে বাস্তব স্বাধীন সত্তা হিসেবে নয়, বরং নির্ভরতা-ভিত্তিক নামমাত্র চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়। উদাহরণস্বরূপ, “গাছ” বলতে আমরা যা বুঝি, তা হলো একগুচ্ছ পাতা, কাণ্ড, শেকড়, জল, আলো ইত্যাদির সমষ্টি। কিন্তু “গাছত্ব” নামে কোনো স্বাধীন বাস্তব সত্তা নেই। “গাছ” কেবল এক নামমাত্র ধারণা, যা আমরা নির্ভরশীল অংশগুলোর প্রতি দিই।

অদ্বৈত বেদান্ত ঠিক উলটো পথে চলে। সেখানে বলা হয়—সব পরিবর্তনের পেছনে এক চূড়ান্ত সর্বজনীন বাস্তবতা আছে—ব্রহ্ম। অর্থাৎ, “একটি সারসত্তা” বাস্তবভাবে বিদ্যমান, যার প্রকাশ হলো এই জগৎ। তাই, অদ্বৈত হলো সারবাদী (essentialist) বা বাস্তববাদী (realist); মাধ্যমক হলো নামমাত্রবাদী (nominalist)। অদ্বৈত বলে—“একটাই সত্য আছে (ব্রহ্ম)”। বৌদ্ধ বলে—“কোনো স্বতন্ত্র সত্য নেই; সবই নামমাত্র সম্পর্ক”।

মাধ্যমকে ‘দুই সত্য’—কিন্তু ‘আধার’ ছাড়া। মাধ্যমক দর্শনে বলা হয়, বাস্তবতা দুই স্তরে ধরা যায়—একটি হলো সাংবৃত সত্য (ব্যাবহারিক সত্য), আর অন্যটি পরমার্থ সত্য (চূড়ান্ত সত্য)। তবে এই দুই সত্যের কোথাও কোনো স্থায়ী “আধার” বা “চূড়ান্ত ভিত্তি” নেই।

সাংবৃত বা ব্যবহারিক সত্য হলো সেই স্তর, যেখানে আমরা দৈনন্দিন ভাষা, সমাজ, প্রথা ও কার্যকারণ অনুযায়ী জিনিসগুলোকে চিনি ও নাম দিই। এই স্তরে আমরা বলি “দড়ি”, “সাপ”, “আমি”, “তুমি”—এগুলো ব্যবহারিকভাবে সত্য। কারণ আমাদের ইন্দ্রিয়, চিন্তা ও সামাজিক সম্মতির মাধ্যমে এরা অভিজ্ঞতার মধ্যে বাস্তব মনে হয়। কিন্তু এগুলো কেবল ভাষা ও প্রেক্ষিতনির্ভর সত্য; অর্থাৎ, লাক্ষণিক বা নামমাত্র সত্য।

পরমার্থ সত্য হলো সেই স্তর, যেখানে আমরা দেখি এই সমস্ত নির্ধারণ বা নামকরণগুলোর কোনো স্থায়ী স্বভাব নেই। “দড়ি” বা “সাপ”, “আমি” বা “তুমি”—এসবের কিছুই নিজের মধ্যে স্বাধীনভাবে টিকে নেই; এরা পরস্পরের ওপর নির্ভর করে গঠিত। এই স্তরে যা থাকে তা হলো নির্ভর-নির্দেশ (prajñapti)—অর্থাৎ, কেবল সম্পর্ক ও শর্তের ভেতর দিয়ে যে নাম বা ধারণা তৈরি হয়। এখানে কোনো চিরন্তন সত্তা বা আধার নেই।

মাধ্যমক এই দুই সত্যের মাধ্যমে বোঝায় যে, সত্য কোনো নির্দিষ্ট স্তরে স্থির নয়। প্রেক্ষিত ও নির্ভরতা বদলালে “সত্য”-এর রূপও বদলে যায়। তাই কোনো কিছুকে চূড়ান্তভাবে সত্য বলা যায় না, কারণ তার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল। এভাবে মাধ্যমক দর্শন শেখায়—সব কিছুই শূন্য, কারণ সব কিছুই সম্পর্কনির্ভর; আর এই সম্পর্কের ভেতরেই সত্যের অর্থ ও মূল্য পরিবর্তিত হয়।

মাধ্যমকে জ্ঞানের প্রকৃতি—আপেক্ষিক ও নির্ভরশীল। মাধ্যমক দর্শন বলে, জ্ঞান নিজেও শর্তনির্ভর। যেমন কোনো বস্তু নিজের মধ্যে স্বাধীন নয়, তেমনি জ্ঞানও স্বাধীন নয়। জ্ঞানের উৎপত্তি, প্রযোজ্যতা ও সীমা—সবই নির্ভর করে প্রেক্ষিত, অভিজ্ঞতা, ভাষা ও সম্পর্কের ওপর। তাই কোনো জ্ঞানই চূড়ান্ত, চিরন্তন বা সীমাহীন হতে পারে না। এক প্রেক্ষিতে যা সত্য বলে মনে হয়, অন্য প্রেক্ষিতে তা মিথ্যা হতে পারে।

এই কারণে মাধ্যমকের মতে, জ্ঞানের উদ্দেশ্য কোনো “উচ্চতর সত্তা” বা “চিরন্তন বাস্তবতা” খুঁজে পাওয়া নয়। বরং লক্ষ্য হলো এটা বোঝা যে—সব ধারণা, সব অভিজ্ঞতা, সব অস্তিত্বই স্বভাবশূন্য (নিজস্ব সারবত্তাহীন) এবং নির্ভরশীল (শর্তে গঠিত)। যখন এই উপলব্ধি সম্পূর্ণভাবে আসে, তখন মন বুঝে যায়—বাস্তবতার মধ্যে কোনো স্থায়ী কেন্দ্র নেই, কেবল সম্পর্কের জাল রয়েছে।