অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: সাতচল্লিশ



অধ্যাস (Adhyāsa) ভ্রমটি গড়ে ওঠে কীভাবে? অধ্যাস মানে আরোপ—যা নয়, সেটাকেই “যেন তাই” বলে ধরে নেওয়া। দড়ির ওপর “সাপত্ব” আরোপ হলো—অল্প আলো (alpāloka), দূরত্ব (dūrattva), সাদৃশ্য (দড়ির পেঁচানো আকৃতি সাপের মতো), অতীত স্মৃতি/ভয় (smṛti), মানসের অবসাদ/চঞ্চলতা—এগুলো মিলেই প্রত্যক্ষের বিকৃতি ঘটায়। ফলে, এখানে প্রতীতি (it appears) আছে, কিন্তু সত্তা (it is) নেই। সূত্রবাক্য বলে, “যা প্রতীয়মান, তা-ই সত্য নয়”—প্রতীতি ও সত্তা এক বস্তু নয়।

বাধ/বাতিলকরণ (Bādha/Sublation)—ভ্রম ভাঙে কীভাবে? উচ্চতর জ্ঞান (আলো/সঠিক প্রত্যক্ষ) বলল—“এটা দড়ি।” এই উচ্চতর প্রমাণ (uttara-pramā) পূর্বের প্রতীতিকে বাতিল করল। এটাই বাধ—উচ্চতর সত্য নিম্নতর প্রতীতিকে অতিক্রম করে। সাপ “ছিল”—এই দাবিই টেকে না; যা-কিছু বাধ্য (বাতিলযোগ্য), অদ্বৈত ভাষায় তা মিথ্যা।

মিথ্যাত্বের মানদণ্ড এখানে কীভাবে কাজ করে? অদ্বৈতের কার্যনীতি: “বাতিলযোগ্যতা”-ই মিথ্যাত্বের পরীক্ষা। সাপ-প্রতীতি পরবর্তী জ্ঞানে (দড়ির জ্ঞান) বাতিল হলো; তাই সে মিথ্যা। দড়ি—অর্থাৎ আধারটি—বাতিল হলো না; বরং সে-ই টিকে রইল। যা কখনোই বাধিত (বাতিল) হয় না (অ-বাধ্য), সেটাই চূড়ান্ত সত্য; যা বাধিত হয়, তা-ই মিথ্যা।

“সাপ মিথ্যা”—কিন্তু ভয় ও ঘাম? অদ্বৈত কখনোই বলে না—“যেহেতু সাপ নেই, ভয়ও নেই।” বরং স্পষ্ট করে—অবজেক্টটি (সাপ) মিথ্যা; কিন্তু সাবজেক্টিভ প্রভাব—ভয়, হৃৎস্পন্দন, ঘাম—ব্যাবহারিক স্তরে বাস্তব। এই স্বীকৃতিই অদ্বৈতকে শূন্যবাদ থেকে পৃথক রাখে এবং আধ্যাত্মিক প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা বোঝায়। (অদ্বৈতবাদ এবং শূন্যবাদের মধ্যকার পার্থক্যভিত্তিক আলোচনা যথাস্থানে করা হবে।)

জ্ঞানতত্ত্বের স্তরক্রম: কে কাকে বাতিল করে? প্রত্যক্ষ/অভিজ্ঞতা (pratyakṣa): “সাপ দেখছি”—অস্থায়ী বাস্তবতা দেয়। উত্তর-প্রমাণ/সঠিক প্রত্যক্ষ: “এটা দড়ি”—ভ্রম বাতিল করে। ব্রহ্মজ্ঞানে: জগতের স্বাধীন বাস্তবতা বাতিল; আধার (ব্রহ্ম) অবশিষ্ট। এখানেই দড়ি-সাপ উদাহরণ সারাজগতের ছাঁচ হয়ে দাঁড়ায়: দড়ি—ব্রহ্ম, সাপ—জগৎ-প্রতীতি।

সত্তাতাত্ত্বিক পাঠ: প্রতীতি আছে, স্বাধীন সত্তা নেই। সাপ দড়ির ওপর নির্ভর করে দেখা গেল; তাই “সাপত্ব” নির্ভরশীল (paratantra), স্বাধীন সত্তা নয়। মিথ্যাত্বের সংজ্ঞা—নিজস্ব আধারে চরম অনস্তিত্বের প্রতিপক্ষ—এখানে বুঝতে হবে এভাবে: “সাপ” সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান আসামাত্র তার চরম অ-অস্তিত্ব প্রকাশিত—সে নিজে টিকে থাকতে পারে না।

ব্যাবহারিক শিক্ষা: কেন এ উদাহরণ জরুরি?
প্রথমত, এটা শেখায়: দেখা মানেই থাকা নয়—প্রতীতি আর সত্তা এক নয়।
দ্বিতীয়ত, আধারকে জানো—ভ্রম সরে যাবে।
তৃতীয়ত, ভয়/দুঃখের বাস্তবতা মেনে নিয়ে মূল কারণ (অজ্ঞতা) উপড়ে ফেলো; তবেই মোক্ষ—কারণ উঠে গেলে ফলও সরে যায়।

জগতের সঙ্গে মিল: যেমন “সাপ” বাধ্য, “দড়ি” অ-বাধ্য—তেমনি জগত-প্রতীতি বাধ্য (ব্রহ্মজ্ঞান এলে অতিক্রম হয়), আর ব্রহ্ম অ-বাধ্য—কখনোই বাতিল হয় না। এই তুলনাই অদ্বৈতের মিথ্যাত্বতত্ত্বের হৃৎপিণ্ড।

অধ্যাসে দড়ির ওপর “সাপ” ওঠে; বাধে জ্ঞানের আলোয় “সাপ” সরে “দড়ি” টেকে। যা বাধিত হয়, তা মিথ্যা; যা কখনও বাধিত হয় না, সেটাই চূড়ান্ত সত্য। এই এক প্রক্রিয়াতেই অদ্বৈত দেখায়—অভিজ্ঞতা ব্যাবহারিকভাবে সত্য, কিন্তু পরমার্থে সত্য কেবলই আধার—ব্রহ্ম।

অদ্বৈত দর্শনে, ব্রহ্মণ (Brahman) কেবল সর্বোচ্চ সত্যই নয়, বরং সমস্ত অস্তিত্বের একমাত্র আধার (Svāśraya)। অর্থাৎ, যা-কিছু দেখা যায়, অনুভব করা যায় বা চিন্তা করা যায়—সবই ব্রহ্মণের ওপর নির্ভর করে টিকে আছে, যেমন তরঙ্গ সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে। মিথ্যাত্ব (falsity)-এর ধারণা এখানে শুধু “মায়া” বা বিভ্রমের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি পুরো মহাবিশ্বকেই অন্তর্ভুক্ত করে—কারণ সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ ব্রহ্মণের উপর অধ্যাস (superimposition), এবং ব্রহ্মণই তার একমাত্র অবিচল, সর্বব্যাপী আধার (universal substratum)।

“ব্রহ্মণ একচেটিয়া (Exclusive) আধার”, এ দ্বারা বোঝানো হয়—ব্রহ্মণের বাইরে আর কোনো স্থায়ী বা স্বাধীন আধার নেই। যেমন মাটির পাত্র ভেঙে গেলে মাটি থেকে যায়, কিন্তু পাত্র স্বতন্ত্রভাবে থাকে না; তেমনই জগতের সব রূপ, নাম ও ভেদ বিলীন হলেও ব্রহ্মণ অটল থাকে। এই অর্থে, ব্রহ্মণই একমাত্র চিরস্থায়ী সত্তা—সব কিছু তার মধ্যে প্রতীয়মান, তার থেকেই উদ্ভূত, এবং শেষে তার মধ্যেই বিলীন।

ব্রহ্মণকে “সর্বব্যাপী (All-pervasive) আধার” বলা হয়, কারণ—কোনো সত্তা বা অভিজ্ঞতা নেই, যা ব্রহ্মণের বাইরে বিদ্যমান। যে যেমন অভিজ্ঞতা করে—শরীর, মন, বেদনা, আনন্দ, জগৎ—সবই ব্রহ্মণের মধ্যে উদ্‌ভাসিত, যেমন আকাশের মধ্যে মেঘ দেখা যায়, কিন্তু আকাশ নিজে অক্ষত থাকে। ব্রহ্মণ তাই অস্তিত্বের পটভূমি, যার মধ্যে সব পরিবর্তন ও প্রকাশ ঘটে, কিন্তু সে নিজে অপরিবর্তনীয়।

মিথ্যাত্ব ও আধারের সম্পর্ক: অদ্বৈত মতে, যা-কিছু “মিথ্যা” (mithyā)—তা নিজের মধ্যে নিজের অস্থিত্ব বহন করে (অর্থাৎ, svāśraya-niṣṭha-atyantābhāva)। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, মিথ্যা সত্তাগুলির কোনো ভিত্তি নেই—তাদের ভিত্তি আছে ব্রহ্মণে, যার ওপর তারা আপাতভাবে আরোপিত। তাই ব্রহ্মণ হলো সর্বমিথ্যা সত্তাগুলিরও চূড়ান্ত আধার—সে-ই একমাত্র বাস্তব ভূমি, যার ওপর মায়িক জগৎ প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।

ব্রহ্মণ “স্বাশ্রয় (Svāśraya)”, অর্থাৎ “নিজেই নিজের আধার”—ব্রহ্মণের অস্তিত্ব কারও ওপর নির্ভরশীল নয়; সে স্বয়ংসিদ্ধ (self-existent), স্বপ্রকাশ (self-luminous)। সব কিছু ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু ব্রহ্মণ কারও ওপর নির্ভরশীল নয়। এই স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অস্তিত্বই তাকে একচেটিয়া ও সর্বব্যাপী আধার করে তোলে।

অদ্বৈত দর্শনে, মায়া ও জগৎ যতই বিভ্রান্তিকর হোক, তাদের সকলের অস্তিত্বের ভিত হলো একটিই—ব্রহ্মণ। জগৎ সত্য নয়, কিন্তু তার প্রতীতি ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল। ব্রহ্মণই সেই একচেটিয়া, সর্বব্যাপী ও অপরিবর্তনীয় আধার, যার মধ্যে সমস্ত মিথ্যা প্রতীতি উঠে আসে, টিকে থাকে, এবং শেষপর্যন্ত তাতে লীন হয়। এককথায়, ব্রহ্মণই একমাত্র সত্য; জগৎ তার ওপর আরোপিত মায়া; আর সেই ব্রহ্মণই সকল অস্তিত্বের একচেটিয়া ও সর্বব্যাপী আধার (Svāśraya)।

মিথ্যাত্ব কেবল ব্যক্তিগত ভ্রম নয়, মহাজাগতিক সত্যের প্রকাশ। অদ্বৈত দর্শনে মিথ্যাত্ব (falsity) কেবল ইন্দ্রিয়ভ্রমের (যেমন দড়ি-সাপ) একটি উদাহরণ নয়, এটি পুরো মহাজাগতিক স্তরে প্রযোজ্য—অর্থাৎ, সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ, সব বস্তু, ভাব, শক্তি, ও অভিজ্ঞতা—সব কিছুই আপাতভাবে সত্য হলেও চূড়ান্ত অর্থে মিথ্যা, কারণ এদের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; তারা সবাই ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল।

ব্রহ্মণ—সমস্ত অস্তিত্বের একক আধার। মিথ্যাত্ব প্রযোজ্য সেই সব সত্তার ক্ষেত্রে, যাদের আধার এক এবং চূড়ান্ত—ব্রহ্মণ; অর্থাৎ যত সত্তা ও বস্তু আছে, তাদের প্রত্যেকটির ভেতরে বা পেছনে যে-অস্তিত্ব রয়েছে, সেটি একটিই—ব্রহ্মণ (Brahman)। ব্রহ্মণ এখানে অদ্বিতীয় (non-dual)—সে-ই সমস্ত কিছুর মূল, ধ্রুবক, এবং অপরিবর্তনীয় ভিত্তি।

সুতো-কাপড়ের উপমা (tantu–paṭa dṛṣṭānta): অদ্বৈত এই সম্পর্ক বোঝাতে একটি গভীর দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে—যেমন বহু সুতো একত্রে বোনা হয়ে কাপড় তৈরি করে, তেমনই ব্রহ্মণই সেই উপাদান, যার মধ্য দিয়ে পুরো মহাবিশ্ব বোনা হয়েছে। যদি সুতো না থাকে, কাপড়ও থাকবে না; তেমনি, যদি ব্রহ্মণ না থাকত, তবে কোনো বস্তু, কোনো ধারণা, কোনো চেতনা থাকত না। সুতোর মতোই, ব্রহ্মণ প্রতিটি বস্তুর মধ্যে অন্তর্লীনভাবে বিদ্যমান; তবে কাপড় (জগৎ) পরিবর্তনশীল, কিন্তু সুতো (ব্রহ্মণ) অপরিবর্তনীয়।

ব্রহ্মণের গঠনমূলক ভূমিকা (Constitutive Role): ব্রহ্মণ শুধু আধার নয়, সে-ই উপাদান কারণ (upādāna-kāraṇa)—অর্থাৎ, মহাবিশ্বের সমস্ত রূপ, উপাদান ও চেতনার মূল পদার্থও ব্রহ্মণ। এই দৃষ্টিতে, জগৎ কোনো আলাদা “দ্বিতীয় বাস্তবতা” নয়, বরং ব্রহ্মণের নিজের শক্তি বা প্রকাশ (appearance of Brahman itself)। তবে যেহেতু এই প্রকাশ ব্রহ্মণের অন্তর্নিহিত অজ্ঞতার (māyā) কারণে প্রতীয়মান, তাই এটি আপাত বা মিথ্যা — মায়াময় (mithyā)।

অদ্বৈতের অভ্যন্তরীণ সংগতি: যদি জগৎ ব্রহ্মণের সমানভাবে বাস্তব হতো, তাহলে দ্বিত্ব (দুটি স্বাধীন সত্য)—ব্রহ্মণ ও জগৎ—বিদ্যমান থাকত, যা অদ্বৈত (non-duality)-এর মূল দাবিকে ভঙ্গ করত। অন্যদিকে, যদি জগৎ একেবারে অবাস্তব (asat) হতো, তাহলে কোনো উপলব্ধি, কর্ম, বা মুক্তির পথই অর্থপূর্ণ হতো না। এই দুই চরম অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে অদ্বৈত ঘোষণা করে—জগৎ মিথ্যা, অর্থাৎ অতিক্রমযোগ্য সত্য। এটি ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল বলেই বিদ্যমান মনে হয়, কিন্তু ব্রহ্মণ উপলব্ধ হলে, এই আপাত অস্তিত্ব লীন হয়ে যায়।

মিথ্যাত্বের মহাজাগতিক প্রয়োগ: এইভাবে “মিথ্যাত্ব” কোনো সীমিত বিভ্রমের ধারণা নয়; এটি মহাবিশ্বের প্রতি অদ্বৈতবাদের দৃষ্টিভঙ্গি—সব অব্রহ্মণ সত্তা (non-Brahman entities) একই যুক্তিতে বাতিলযোগ্য (sublatable), কারণ তারা ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল এবং চূড়ান্ত জ্ঞানে অতিক্রমিত হয়।

ব্রহ্মণ হলো মহাবিশ্বের গঠনমূলক ভিত্তি ও একমাত্র আধার (svāśraya)। জগৎ ব্রহ্মণেরই এক আপাত প্রকাশ, যা জ্ঞানের আলোয় মিথ্যা বলে প্রকাশিত হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই মিথ্যাত্ব সর্বজনীন হয়—যা-কিছু “অব্রহ্মণ”, সেটি ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল বলে মিথ্যা, আর যা “ব্রহ্মণ”, সেটিই একমাত্র সত্য (satya)। যেমন সুতো ছাড়া কাপড় নেই, তেমনই ব্রহ্মণ ছাড়া জগৎ নেই। সব দৃশ্যমান রূপই ব্রহ্মণের ওপর আরোপিত; তাই মিথ্যা কেবল বস্তু নয়—সমগ্র জগৎই ব্রহ্মণের মধ্যে, ব্রহ্মণই তার গঠনমূলক বাস্তবতা।

অদ্বৈত বেদান্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির একটি হলো—যদি জগৎ চূড়ান্ত অর্থে মিথ্যা (mithyā), তবে আমরা যে-বাস্তবতা প্রতিদিন দেখি, তাতে কীভাবে চলব? এই দার্শনিক টানাপোড়েনের সমাধানই হল বাস্তবতার দুই স্তরের তত্ত্ব—ব্যাবহারিক (Vyāvahārika) ও পারমার্থিক (Pāramārthika) সত্য। এই বিভাজন অদ্বৈতকে শূন্যবাদের (nihilism)-এর হাত থেকে রক্ষা করে, কারণ এটি স্বীকার করে যে, জগৎ “সম্পূর্ণ অবাস্তব” নয় (শূন্যবাদে, জগৎ “সম্পূর্ণ অবাস্তব”)—এটি অস্থায়ীভাবে, শর্তসাপেক্ষভাবে বাস্তব।

ব্যাবহারিক বাস্তবতা (Vyāvahārika Satya): এই স্তরটি হলো দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সত্য, যেখানে মানুষ দেখে, ভাবে, অনুভব করে, কাজ করে, ও সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে সব কিছু কার্যকর—অর্থাৎ, আগুনে পোড়ে, জলে ভিজে, দুঃখ কষ্টে ব্যথা লাগে, আনন্দে তৃপ্তি আসে। এই স্তরে জগতের একটি অভিজ্ঞতাগত বৈধতা (empirical validity) আছে। এখানেই ধর্ম, নৈতিকতা, যজ্ঞ, ভক্তি, ও মুক্তির সাধনা অর্থবহ। অদ্বৈত স্বীকার করে—যতক্ষণ পর্যন্ত পরম জ্ঞান অর্জিত না হয়, এই ব্যাবহারিক স্তরই মানবজীবনের প্রেক্ষাপট। তাই এটি বাস্তব, কিন্তু শর্তসাপেক্ষভাবে (conditionally real)।

পারমার্থিক বাস্তবতা (Pāramārthika Satya): এটি হল চূড়ান্ত, অদ্বৈত সত্য, যেখানে কেবল ব্রহ্মণই বিদ্যমান—এক, অবিভক্ত, অপরিবর্তনীয়। এই স্তরে “জগৎ” বা “আমি-তুমি-সে”-র কোনো বিভাজন নেই। কারণ, এগুলি সবই মায়ার আরোপ, যা জ্ঞানের আলোয় লীন হয়ে যায়। এখানে জগতের অস্তিত্ব বাতিল (bādha) হয়ে যায়—অর্থাৎ, পরম জ্ঞানে জানা যায় যে, যা-কিছু দেখা গেছে, তা কেবল ব্রহ্মণেরই রূপ, ব্রহ্মণ ব্যতীত কিছুই স্বাধীনভাবে নেই।

এই দুই সত্য একে অপরের বিপরীত নয়, বরং পর্যায়ক্রমিক (hierarchical)। ব্যাবহারিক সত্য হলো সোপান (means)—যার মাধ্যমে সাধক পরম সত্যে পৌঁছায়। পারমার্থিক সত্য হলো গন্তব্য (goal)—যা জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধ হয়। অর্থাৎ, যতক্ষণ আমরা অজ্ঞতায় আছি, জগৎ ও তার কার্যকারণ সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু জ্ঞানলাভের পর বোঝা যায়, এই সমস্ত কিছুই ব্রহ্মণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ও তার উপর নির্ভরশীল।

কর্ম প্রসঙ্গে গীতায় একটি শব্দ আছে—“লোকসংগ্রহার্থং” (Lokasaṁgrahārtham), যার অর্থ, সহজভাবে বললে—“সমাজের কল্যাণের জন্য”, অথবা “সমগ্র লোকের (মানবসমাজের) সংহতি, রক্ষণ ও মঙ্গলের উদ্দেশ্যে।”