অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: সাতাশ



বৃত্তি-ব্যাপ্যত্বম (মানসিক পরিবর্তন দ্বারা ব্যাপ্ত): অন্যদিকে, “বৃত্তি-ব্যাপ্যত্বম” বোঝায় যে, সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক বস্তু বা ধারণাগুলি মনের পরিবর্তন বা বৃত্তির দ্বারা ব্যাপ্ত। যখন আমরা কোনো কিছু উপলব্ধি করি, তখন আমাদের মন সেই বস্তুর আকার ধারণ করে একটি মানসিক পরিবর্তন বা ‘বৃত্তি’ সৃষ্টি করে। এই বৃত্তিটি বস্তুর সাথে একীভূত হয়ে বস্তুকে প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা একটি ঘট দেখি, তখন আমাদের মনে ঘটের একটি প্রতিচ্ছবি বা বৃত্তি তৈরি হয় এবং এই বৃত্তির মাধ্যমেই আমরা ঘটকে জানতে পারি। এই প্রতিচ্ছবি (অতীতে ঘট দেখার) অভিজ্ঞতা বা (ঘট-সদৃশ বস্তুর) অনুমান থেকে তৈরি হয়। এই জগৎ, যা আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করি, তা মনের বৃত্তির মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। এই বৃত্তিগুলিই আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি। যেহেতু ব্রহ্মকে সরাসরি বৃত্তি দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না, তাই সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক বস্তুর ক্ষেত্রে এই ধারণাটি প্রযোজ্য। এই ধারণাটি জাগতিক জ্ঞানের অস্থায়িত্ব এবং মনের ক্রিয়াকলাপের উপর এর নির্ভরশীলতা প্রমাণ করে।

অদ্বৈত বেদান্তের জ্ঞানতত্ত্বে এদের গুরুত্ব: এই দুটি ধারণা অদ্বৈত বেদান্তের দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি ব্রহ্ম এবং মায়ার প্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করে।

ব্রহ্মের প্রকৃতি: ফল-ব্যাপ্যত্বমের ধারণাটি ব্রহ্মের নির্বিশেষ এবং নিরাকার প্রকৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। ব্রহ্ম কোনো নাম-রূপের দ্বারা আবদ্ধ নয় এবং এটি কোনো জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া বা ধারণার বিষয় নয়। এটি স্বানুভবগম্য, অর্থাৎ কেবল আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমেই এর প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্ভব, যা মন ও ইন্দ্রিয়ের বাইরে।

জাগতিক অভিজ্ঞতার প্রকৃতি: বৃত্তি-ব্যাপ্যত্বমের ধারণাটি আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতার মায়াময় প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করে। আমরা যা-কিছু দেখি, শুনি বা অনুভব করি, তা সবই মনের সৃষ্ট এবং পরিবর্তনশীল। এই জগৎ ব্রহ্মের উপর আরোপিত একটি প্রতীতি মাত্র, যা মনের কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল।

মোক্ষলাভ: মোক্ষ বা মুক্তিলাভের ক্ষেত্রেও এই ধারণাগুলি অপরিহার্য। অদ্বৈত বেদান্তের লক্ষ্য হলো ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা। এই জ্ঞান লাভ করার জন্য, সাধককে বুঝতে হবে যে, ব্রহ্ম ফল-ব্যাপ্য নয় এবং জাগতিক জ্ঞান বৃত্তি-ব্যাপ্য। যখন সাধক এই পার্থক্যটি উপলব্ধি করতে পারেন এবং মনকে তার বৃত্তির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পারেন, তখনই তিনি ব্রহ্মের সাথে তার ঐক্য অনুভব করতে পারেন এবং মুক্তি লাভ করেন।

“ব্রহ্ম ফল-ব্যাপ্য নয়”—ফল-ব্যাপ্য মানে হলো, কোনো কিছু উপলব্ধি করতে গেলে ফল (object, result) আকারে প্রকাশ পেতে হবে। যেমন: চোখে রং দেখা যায়, কানে শব্দ ধরা পড়ে—এগুলো জ্ঞান-বৃত্তির ফল। কিন্তু ব্রহ্ম কোনো ফল আকারে ধরা দেয় না, কারণ ব্রহ্ম সর্বত্রব্যাপী, অব্যক্ত ও অবিনাশী। ব্রহ্ম নিজেই চৈতন্য-স্বরূপ, তাই তাকে আরেকটি “জ্ঞান-ফল” হিসেবে ধরা যায় না।

“জাগতিক জ্ঞান বৃত্তি-ব্যাপ্য”—বৃত্তি-ব্যাপ্য মানে হলো, জ্ঞান-প্রবাহ (বৃত্তি) যখন কোনো বস্তুতে গিয়ে মিশে, তখন সেই বস্তুটিকে আমরা জানি। যেমন: চোখের জ্ঞান-বৃত্তি একটা ফুলের ওপর পড়লে আমরা বলি “ফুল আছে”। পৃথিবীর সব বস্তু-জ্ঞানই আসলে এই বৃত্তি-ব্যাপ্য—অর্থাৎ বুদ্ধির সংশ্লিষ্টতা (cognitive function) ছাড়া ধরা যায় না।

ব্রহ্ম কখনোই কোনো জ্ঞান-ফল আকারে ধরা পড়ে না। সে সব ফল, সব বৃত্তির ঊর্ধ্বে। আর জাগতিক জ্ঞান সবসময় বৃত্তির দ্বারা ধরা পড়ে—অর্থাৎ চেতনা কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর দিকে প্রবাহিত হলেই আমরা জানি। জগতের জ্ঞান হলো চেতনার তরঙ্গ (বৃত্তি) কোনো বস্তুকে ছুঁয়ে জানা; কিন্তু ব্রহ্মকে এভাবে জানা যায় না, কারণ ব্রহ্ম নিজেই জ্ঞানের স্বরূপ—যে-জ্ঞান দিয়ে সব জানা হয়, তাকেই আর ফল বা বস্তুর মতো ধরা যায় না। সংক্ষেপে, “ফল-ব্যাপ্যত্বম” এবং “বৃত্তি-ব্যাপ্যত্বম”, এই দুটি ধারণা অদ্বৈত বেদান্তের গভীর দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যা মন, বাস্তবতা এবং চূড়ান্ত সত্যের মধ্যে সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে। এই ধারণাগুলির মাধ্যমে আমরা কেবল জ্ঞানতত্ত্বের সূক্ষ্ম জটিলতাই নয়, বরং আধ্যাত্মিক উপলব্ধির পথও খুঁজে পাই।

ফল-ব্যাপ্যত্বম (Phala-vyāpyatvam) বিষয়ে একটি গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণ:

ফল-ব্যাপ্যত্বম একটি গভীর দার্শনিক ধারণা, যা এমন একটি সত্তাকে বোঝায়, যা কোনো জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষ ‘ফল’ বা তাৎক্ষণিক ফলাফল দ্বারা সম্পূর্ণরূপে পরিবেষ্টিত, আবৃত বা নিঃশেষিত হয় না। এখানে ‘ফল’ মূলত চেতনার প্রকাশকে নির্দেশ করে, যা বস্তুকে আলোকিত করে এবং তাকে জ্ঞানগম্য করে তোলে। এই শব্দটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্বকে তুলে ধরে: বস্তুর সম্পূর্ণ, সূক্ষ্ম এবং মৌলিক প্রকৃতি শুধুমাত্র প্রাথমিক জ্ঞানীয় কাজের পৃষ্ঠ-ফলাফল দ্বারা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি বা প্রকাশিত হয় না।

১. বস্তুর অসম্পূর্ণ প্রকাশ: ফল-ব্যাপ্যত্বমের মূল কথা হলো যে, যখন আমরা একটি বস্তুকে জানি বা উপলব্ধি করি, তখন আমাদের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া একটি ‘ফল’ উৎপন্ন করে। এই ফল বস্তুর একটি দিককে আলোকিত করে এবং আমাদের কাছে তার উপস্থিতি বা কিছু বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে। তবে, বস্তুর একটি গভীর, সম্ভবত আরও সূক্ষ্ম বা লুকানো দিক অবশিষ্ট থাকে, যা এই তাৎক্ষণিক জ্ঞানীয় ‘ফল’ দ্বারা অনাবৃত থাকে। এর অর্থ এই যে, যদিও আমরা একটি বস্তুকে তার পৃষ্ঠের অর্থে ‘জানতে’ পারি (যেমন, এর আকার, রঙ, উপস্থিতি ইত্যাদি), তবুও এর গভীর সারমর্ম, এর অন্তর্নিহিত সত্য, সেই প্রাথমিক উপলব্ধি দ্বারা অ-উপলব্ধ থাকতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা একটি আপেলকে তার বাহ্যিক রূপ, রং এবং স্বাদ দ্বারা জানতে পারি। এইগুলি জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার ‘ফল’। কিন্তু আপেলের গঠনগত অণু, তার রাসায়নিক উপাদান, তার কোষীয় কার্যকারিতা—এইগুলি আরও গভীর স্তরের জ্ঞান, যা প্রাথমিক ‘ফল’ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায় না।

২. জ্ঞানের স্তর এবং সীমাবদ্ধতা: এই ধারণাটি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং বিভিন্ন স্তরকে ইঙ্গিত করে। আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা প্রাথমিক জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াগুলি বস্তুর একটি নির্দিষ্ট অংশকে আমাদের কাছে উন্মোচন করে, কিন্তু তার সমগ্র সত্তাকে নয়। বস্তুর ভেতরের বাস্তবতা, তার মৌলিক প্রকৃতি, অনেকসময় এই তাৎক্ষণিক জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার আওতার বাইরে থাকে। এর ফলে বস্তুর প্রতি আমাদের উপলব্ধি অসম্পূর্ণ থেকে যায় এবং আমরা তার সত্যিকারের স্বরূপ জানতে পারি না।

৩. ব্রহ্মের প্রেক্ষাপটে ফল-ব্যাপ্যত্বম: অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে ব্রহ্মের প্রেক্ষাপটে ফল-ব্যাপ্যত্বমের ধারণাটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রহ্ম, অর্থাৎ চূড়ান্ত বাস্তবতা, ফল-ব্যাপ্য নন। এর কারণ হলো ব্রহ্ম ‘স্বয়ম্-প্রভ’—স্বতঃপ্রজ্বলিত এবং স্বতঃপ্রকাশিত। তিনি চেতনা হিসেবে চিরন্তনভাবে উপস্থিত। ব্রহ্মকে আলোকিত বা প্রকাশিত করার জন্য কোনো জ্ঞানীয় ‘ফল’-এর প্রয়োজন হয় না, কারণ তিনিই আলোকসম্পাতের মূল উৎস, সমস্ত চেতনার ভিত্তি।

ব্রহ্মের স্বতঃপ্রকাশত্ব: ব্রহ্ম কোনো বাহ্যিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ‘জানা’ বা ‘প্রকাশিত’ হন না। তিনি নিজেই জ্ঞান এবং প্রকাশের উৎস। সূর্য যেমন নিজেকে আলোকিত করার জন্য অন্য কোনো আলোর উপর নির্ভরশীল নয়, তেমনি ব্রহ্মও নিজেকে প্রকাশ করার জন্য কোনো ‘ফল’-এর উপর নির্ভরশীল নন।

অবিদ্যা এবং মায়ার প্রসঙ্গ: মানবীয় জ্ঞান সাধারণত অবিদ্যা (অজ্ঞান) এবং মায়া দ্বারা আবৃত থাকে। এই অবিদ্যাই আমাদের ব্রহ্মের স্বতঃপ্রকাশিত প্রকৃতি উপলব্ধি করতে বাধা দেয়। আমরা যখন কোনো বস্তুকে জানি, তখন আমরা আমাদের সীমিত বোধশক্তির মাধ্যমে জানি, যা বস্তুর সম্পূর্ণ প্রকৃতিকে গ্রহণ করতে অক্ষম। ব্রহ্মের ক্ষেত্রে, এই সীমাবদ্ধতা প্রযোজ্য নয়, কারণ তিনি সমস্ত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে।

মুক্তি এবং ব্রহ্মের জ্ঞান: যখন কোনো ব্যক্তি মুক্তি লাভ করে এবং আত্মজ্ঞান অর্জন করে, তখন সে ব্রহ্মকে তার আসল রূপে উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধি কোনো জ্ঞানীয় ‘ফল’-এর মাধ্যমে হয় না, বরং এটি অবিদ্যা দূরীকরণের মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বতঃপ্রকাশিত সত্তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এটি একটি মৌলিক সত্তার উপলব্ধি, যা কোনো জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট বা পরিবেষ্টিত নয়।

ফল-ব্যাপ্যত্বম একটি জটিল দার্শনিক ধারণা, যা বস্তুর প্রকৃতি, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং চূড়ান্ত বাস্তবতার স্বরূপ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমাদের প্রাথমিক জ্ঞান প্রায়শই অসম্পূর্ণ হয় এবং বস্তুর একটি গভীর, অপরিহার্য দিক অনাবৃত থেকে যায়। ব্রহ্মের প্রসঙ্গে, এই ধারণাটি ব্রহ্মের স্বতঃপ্রকাশিত এবং অপরিমেয় প্রকৃতিকে তুলে ধরে, যিনি কোনো মানবীয় জ্ঞানীয় প্রক্রিয়ার ‘ফল’ দ্বারা আবদ্ধ নন, বরং সমস্ত জ্ঞান এবং চেতনার আদি উৎস।

বৃত্তি-ব্যাপ্যত্বম (Vṛtti-vyāpyatvam): এই গভীর ধারণাটি বোঝায় যে, বস্তু কোনো একটি মানসিক পরিবর্তন বা চিন্তা-তরঙ্গ (বৃত্তি) দ্বারা গভীরভাবে ব্যাপ্ত হয়, যা বস্তুর ব্যাপক উপলব্ধিতে মনের সক্রিয়, গতিশীল এবং আকারদানকারী ভূমিকার ওপর জোর দেয়। এটি কেবলই বাহ্যিক বাস্তবতার নিষ্ক্রিয় গ্রহণ নয়, বরং একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া, যেখানে মন তার নিজস্ব ধারণাগত কাঠামো, ব্যাখ্যামূলক ‘তরঙ্গ’ এবং উদ্দেশ্যমূলক মনোযোগের মাধ্যমে বস্তুকে তার গভীরতায় উপলব্ধি করে।

মন বস্তু থেকে অজ্ঞানের আবরণ সরায়, ফলে চেতনা তাকে আলোকিত করে। একটি বস্তুকে পৃষ্ঠতলে জানলেও এর গভীর প্রকৃতি (উপাদান, উদ্দেশ্য, ব্রহ্মে এর বাস্তবতা) প্রাথমিকভাবে উপলব্ধ হয় না। এই গভীর উপলব্ধি পেতে নিবদ্ধ মানসিক পরিবর্তন দরকার, যা ‘বৃত্তি’-কে বস্তুর লুকানো মাত্রা আলোকিত করতে দেয়। জ্ঞান কেবল তথ্য নয়, বাস্তবতার সাথে মনের এক জটিল, সক্রিয় ও রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া।

এই ধারণাগুলি জ্ঞাতা মন এবং জ্ঞানের বস্তুর মধ্যে একটি গতিশীল মিথস্ক্রিয়া তুলে ধরে। জানার কাজটা নিজেই চেতনার প্রকাশ। এটি বিষয় এবং বস্তুর অদ্বৈততাকে এমনভাবে তুলে ধরে, যা ইঙ্গিত করে যে, সত্য জ্ঞান তখনই অর্জিত হয়, যখন মন তার পূর্ণ শক্তি দিয়ে বস্তুর সাথে একাত্ম হয়, অজ্ঞানের স্তর ভেদ করে এবং অন্তর্নিহিত সত্যকে উন্মোচন করে। এটি কেবল জাগতিক জ্ঞান নয়, আত্ম-জ্ঞানেরও পথ খুলে দেয়।

জ্ঞানতত্ত্ব অনুসারে, জ্ঞান বাইরের তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং ভেতরের চেতনার উন্মোচন। মন বস্তুকে জানার সময় বাইরের রূপের উপর নির্ভর না করে নিজস্ব চেতনার গভীরতা দিয়ে তার সাথে একাত্ম হয়। পূর্ব-ধারণা, কুসংস্কার ও অজ্ঞানের স্তর ভেদ করে বস্তুর প্রকৃত সার ও অন্তর্নিহিত সত্য উন্মোচিত হয়। এই প্রক্রিয়ায়, তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ভেতরের জ্ঞান ও সচেতনতার সেতুবন্ধন হয়, যা বস্তুর মৌলিক প্রকৃতিকে প্রকাশ করে—এটি পৃষ্ঠীয় জ্ঞান নয়, গভীর উপলব্ধি।

জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বিচ্ছিন্ন নয়, বরং অদ্বৈত সত্তার অংশ। উপনিষদের ‘ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা’ দর্শনের মতো, সত্য জ্ঞান অর্জিত হয় যখন জ্ঞাতা নিজেকে জ্ঞানের উৎস এবং বস্তুকে তারই প্রতিচ্ছবি মনে করে। এই উপলব্ধি বাহ্যিক বস্তু ও অভ্যন্তরীণ চেতনার বিভেদ মুছে দেয়। এই জ্ঞান আত্ম-উপলব্ধির জন্যও অপরিহার্য। নিজের সত্তাকে গভীরভাবে জানার মাধ্যমে ব্যক্তি তার সীমাবদ্ধতা, আকাঙ্ক্ষা, ভয় ও সম্ভাবনা বুঝতে পারে, যা তাকে প্রকৃত পরিচয় আবিষ্কার এবং চেতনার গভীরে প্রবেশে সহায়তা করে। এই আত্ম-জ্ঞানই মানুষকে মোক্ষ বা পরম মুক্তির পথে নিয়ে যায়, যেখানে সে মহাবিশ্বের সাথে একাত্ম হয়।

সুতরাং, এই সম্মিলিত ধারণাগুলো জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াকে একটি আধ্যাত্মিক যাত্রায় রূপান্তরিত করে, যেখানে প্রতিটি জানা বিষয় চেতনার প্রসারণ ও অদ্বৈত সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক ধাপ। এটি মনকে তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে এবং ব্যক্তি ও বিশ্বের মধ্যেকার গভীর সংযোগকে উন্মোচন করে।