এভাবে একাধিকরণত্বম্ ও অনুমান একত্রে সৃষ্টি করে একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো, যেখানে বাস্তবতা বোঝা হয় সম্ভাবনা ও বাস্তবতার মধ্যকার গতিশীল মিথস্ক্রিয়া হিসেবে। ‘কারণ’ কেবল সম্ভাবনা ধারণ করে—আর ‘প্রভাব’ সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন। এখানে কোনো কিছু স্থির নয়, প্রত্যেকটি সত্তা তার পূর্বের অনস্তিত্বকে অতিক্রম করে, সম্পর্ক ও সংগঠনের মাধ্যমে নতুন রূপে উদ্ভূত হয়।
এই কাঠামো তাই আমাদের শেখায়—বাস্তবতা কোনো স্থায়ী বস্তু নয়, বরং এক প্রক্রিয়া; এক অবিরাম প্রবাহ, যেখানে সম্ভাবনা ক্রমে রূপ নেয় অস্তিত্বে, আর অস্তিত্ব আবার বিলীন হয় নতুন অনস্তিত্বে। দার্শনিকভাবে, এই পদ্ধতি যুক্তিকে করে তোলে দ্বন্দ্বমুক্ত ও স্বচ্ছ। এটি চিন্তার অভ্যন্তরে এমন একটি সীমানা নির্ধারণ করে, যেখানে বিরোধ ও ভ্রান্তি প্রবেশ করতে পারে না। “অস্তিত্ব” ও “অনস্তিত্ব” এখানে আলাদা কিন্তু পরস্পর-নির্ভর, এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই প্রকাশ পায় বাস্তবতার রূপান্তরমূলক সত্য।
একাধিকরণত্বম্ দেয় যুক্তির ভিত্তি—যেখানে কোনো সত্তা ও তার অনুপস্থিতি একসঙ্গে থাকতে পারে না। অনুমান দেয় তার বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি—যা দেখায়, কীভাবে সব সৃষ্টি পূর্বের অনুপস্থিতি অতিক্রম করে উদ্ভূত হয়। দুইয়ে মিলে গড়ে ওঠে এক সুসংগত দার্শনিক লেন্স—যা বাস্তবতার কাঠামোকে বোঝায় প্রক্রিয়া, রূপান্তর ও সংগঠনের অভ্যন্তরীণ যুক্তির মাধ্যমে, এবং নিশ্চিত করে যে, চিন্তা ও যুক্তি সর্বদা দ্বন্দ্বমুক্ত, সংগত ও সত্যের পথে স্থির থাকে।
‘অদ্বৈত’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “দুই নয়”—বাস্তবতার গভীরে গেলে কোনো দ্বিতীয়তা থাকে না। এই ঐতিহ্য একদিকে শাস্ত্রব্যাখ্যা, যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সূক্ষ্ম সমন্বয়; অন্যদিকে সাধকের ভেতরে থাকা “আমি কে?” প্রশ্নের কঠিন কিন্তু একরৈখিক উত্তর। কেন্দ্রীয় দাবি হলো—স্বতন্ত্র জীবাত্মা ও পরম ব্রহ্ম আসলে সংখ্যাগতভাবে এক; পার্থক্যটি কেবল দেখা-শোনার স্তরে, জ্ঞানের অপূর্ণতায়। অদ্বৈতের তিনটি স্তম্ভ—সত্তাতত্ত্ব: বাস্তবতার স্তরবিন্যাস; জ্ঞানতত্ত্ব: প্রমাণের পথ; আর ‘মিথ্যাত্ব’: জগতের আপেক্ষিক সত্যতার যুক্তি—এদের নিয়ে এখন লিখছি।
অদ্বৈতের ভিত্তি হলো এই ঘোষণা—ব্রহ্মই একমাত্র চূড়ান্ত বাস্তবতা। ব্রহ্মকে বলা হয় শুদ্ধ চেতনা—শুদ্ধ চৈতন্য; সে অনন্ত, অপরিবর্তনীয়, অনাদি, আর সব কিছুর অন্তর্নিহিত আশ্রয়। সে একই সঙ্গে অতিক্রমী ও অন্তঃস্থিত—জগতকে ছাড়িয়ে আছে, আবার জগতের অন্তরেও আছে। এই অদ্বৈত অভিজ্ঞতাকে শাস্ত্রবাক্যে সংক্ষেপে ধরা হয়—“ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা; জীব আসলে ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু নয়”। এখানে “মিথ্যা” বলতে “কিছুই নেই” বোঝানো হয় না; বোঝানো হয়—যা দেখা যায়, তা ব্যাবহারিক স্তরে সত্য হলেও চূড়ান্ত জ্ঞানে তা অবস্থিত থাকে না।
অদ্বৈত বাস্তবতাকে তিন স্তরে পড়ে—পারমার্থিক, ব্যাবহারিক, আর প্রতিভাসিক। পারমার্থিক স্তরে কেবল ব্রহ্ম; এখানে কোনো দ্বিতীয়তা নেই। ব্যাবহারিক স্তরে আমরা ব্যক্তি-জগৎ-ঈশ্বর—এই ত্রিবিধ সম্পর্কের মধ্যে লেনদেন করি; নৈতিকতা, কর্ম, কারণ-কার্য—সব এখানে কার্যকর। প্রতিভাসিক স্তরে রজ্জু-সাপের মতো ভুল ধারণা—যেখানে এক জিনিসকে অন্য মনে হয়। শঙ্করাচার্য দেখান, উচ্চতর স্তরের জ্ঞান নিম্নতর স্তরকে “বাধিত” করে—দড়ি চিনে ফেললে সাপ আর থাকে না, তেমনি ব্রহ্ম-জ্ঞান জগৎ-স্বাতন্ত্র্যের ভ্রম ভেঙে দেয়।
জ্ঞানতত্ত্বে, অদ্বৈত প্রমাণপথকে স্তরভিত্তিকভাবে ব্যবহার করে। ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি প্রমাণ ব্যাবহারিক স্তরে যথার্থ; তবে ব্রহ্মতত্ত্বে সর্বোচ্চ প্রমাণ শ্রুতি—উপনিষদের বাণী—যা নিজের স্বপ্রকাশে নির্ভুল। সেই শ্রুতিজ্ঞানকে স্থিত করার জন্য আছে মনন—যুক্তি দিয়ে সন্দেহ কাটানো, আর নিদিধ্যাসন—অবিরাম ধ্যান-স্থিতি। এই ধারাবাহিকতায় আসে অপরোক্ষ নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—অপরোক্ষ জ্ঞান: “আমি ব্রহ্ম”—যেখানে জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা—এই ত্রিবিধ বিভাজন গলে যায়।
মিথ্যাত্বের যুক্তি বলে, জগৎ—না সম্পূর্ণ সত্য, না সম্পূর্ণ মিথ্যা; সে “সৎ-অসৎ বিলক্ষণ”—না সৎ, না অসৎ, বরং উভয় থেকে ভিন্ন। যেমন মাটির পাত্র—রূপ-নাম-কার্যকারিতা আছে বলে ব্যবহারে সত্য; কিন্তু বিশ্লেষণে বোঝা যায়, সে মাটি-নির্ভর, নিজস্ব স্বভাবগত সত্য তাতে নেই। রজ্জু-সাপের উদাহরণে সাপ “দেখা” যায়, ভয়ও হয়—ব্যাবহারিকভাবে সত্য; কিন্তু দড়ি চিনলেই সেই সত্যতা মুহূর্তে লুপ্ত—চূড়ান্তে অসত্য। জগতের সত্যও এই রকম—জ্ঞান না এলে চলাচলে ঠিক, জ্ঞান এলে বাধিত।
অদ্বৈতের মর্মে রয়েছে “অধ্যাস” বা আরোপ-তত্ত্ব—নিজ-অনিজের পরস্পর আরোপ। “আমি দেহ”, “আমি সুখী-দুঃখী”—এসব বাক্যে চৈতন্যস্বরূপ “আমি”-র ওপর দেহ-মন-গুণ আরোপিত। এই আরোপের ভিত্তি অবিদ্যা—সত্যকে না জানার কারণে ভুল পরিচয়। জ্ঞান এলে আরোপ সরে—দেহ-মন ব্যাবহারিক স্তরে থাকে, কিন্তু “আমি”-র সঙ্গে একাত্মতা ভাঙে; জ্ঞানই তখন মুক্তি।
অদ্বৈত দর্শন তার যুক্তির ভিত্তি সুদৃঢ় করতে অন্বয়-ব্যতিরেকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং সাক্ষী-বোধের সিদ্ধান্তকে ব্যবহার করে। এই দুটি পদ্ধতিকে অবলম্বন করে অদ্বৈতবাদ চূড়ান্ত সত্যের স্বরূপ উন্মোচন করে।
প্রথমত, অন্বয়-ব্যতিরেকের বিশ্লেষণ। অন্বয় অর্থ হলো সহাবস্থান, অর্থাৎ দুটি জিনিসের একসাথে থাকা; আর ব্যতিরেক অর্থ হলো অনুপস্থিতি, অর্থাৎ একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটিরও অনুপস্থিতি। অদ্বৈত বেদান্ত এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখায় যে, জাগরণ, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থাতেই যা অপরিবর্তিত থাকে, তা-ই হলো আমাদের চূড়ান্ত “আমি” বা সাক্ষী-চৈতন্য।
জাগরণ অবস্থা: এই অবস্থায় আমরা দেহ, মন, ইন্দ্রিয় এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকি। জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা আমরা শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করি, কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কাজ করি, এবং মন চিন্তা ও আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
স্বপ্ন অবস্থা: এই অবস্থায় দেহ ও ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় থাকে, কিন্তু মন নিজস্ব এক জগত তৈরি করে। স্বপ্নে আমরা বিভিন্ন দৃশ্য দেখি, অনুভূতি লাভ করি, যদিও সেগুলি বাস্তব বাহ্যিক জগতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়।
সুষুপ্তি অবস্থা: এ হলো গভীর নিদ্রার অবস্থা, যেখানে দেহ, মন, এবং ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণরূপে শান্ত থাকে। এই অবস্থায় কোনো স্বপ্ন থাকে না, কোনো বাহ্যিক অনুভূতি থাকে না, এমনকি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোনো বিশেষ জ্ঞান থাকে না। তবুও, ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা বলি, "আমি খুব শান্তিতে ঘুমিয়েছিলাম, কিছুই জানতাম না।" এই "আমি" কে? এই "আমি"ই হলো সেই অপরিবর্তিত সাক্ষী। “আমি” (সাক্ষী হিসেবে) না থাকলে জানলাম কীভাবে যে, শান্তিতে ঘুমিয়েছিলাম?
এই তিন অবস্থাতেই দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি পরিবর্তিত হয়। জাগরণে তাদের পূর্ণ উপস্থিতি, স্বপ্নে মনের আংশিক উপস্থিতি, এবং সুষুপ্তিতে তাদের অনুপস্থিতি। কিন্তু এসব পরিবর্তনের মাঝেও একটি সচেতন উপস্থিতি বা "সাক্ষী" বিদ্যমান থাকে, যা এই সব অবস্থারই সাক্ষী। এই সাক্ষী-চৈতন্য স্বয়ংপ্রকাশ, অর্থাৎ এর প্রকাশের জন্য অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না। এটি নিজের আলোয় নিজেই প্রকাশিত।
দ্বিতীয়ত, সাক্ষী-বোধের তর্ক। যেহেতু দেহ, মন এবং ইন্দ্রিয়গুলি প্রতিটি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে—যেমন দেহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, মন চঞ্চল হয়, ইন্দ্রিয়গুলি কর্মক্ষমতা হারায়—সেহেতু "আমি" কোনো পরিবর্তনশীল উপাদান হতে পারে না। যদি "আমি" দেহ, মন বা ইন্দ্রিয় হতো, তাহলে এগুলির পরিবর্তনের সাথে সাথে "আমি"ও পরিবর্তিত হতো বা বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু সুষুপ্তির গভীরে যখন দেহ-মন-ইন্দ্রিয় কোনোটিই সক্রিয় থাকে না, তখনও "আমি" নামক এক সত্তা নীরব দর্শক বা সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান থাকে। এই সাক্ষীই প্রমাণ করে যে, "আমি" এদের থেকে পৃথক।
অতএব, অদ্বৈত দর্শন সিদ্ধান্ত টানে—"আমি" শুদ্ধ চৈতন্য। এটি জন্ম-মৃত্যু, হ্রাস-বৃদ্ধি, পরিবর্তন-পরিবর্ধন—সব কিছুর ঊর্ধ্বে এক অপরিবর্তনীয়, অনাদি, অনন্ত, ও নির্বিকার সত্তা। এই সাক্ষী-চৈতন্যই আত্মস্বরূপ, যা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। এই উপলব্ধিই অদ্বৈতবাদের মূল ভিত্তি—"তত্ত্বমসি" (তুমিই সেই)।
এই কঠোর স্থাপত্যের মাঝেও কিছু দ্বান্দ্বিক আপত্তি উঠে—অবিদ্যার আশ্রয় কোথায়, ব্রহ্মের ওপর কী করে অবিদ্যা কাজ করে, অবিদ্যা—সত্য হলে ব্রহ্মের অদ্বৈততা নষ্ট হয়, মিথ্যা হলে জগৎ কী করে দেখা দেয়। অদ্বৈতের উত্তর—অবিদ্যা নিজেই মিথ্যা; তার “আধার” বিষয়ে প্রশ্ন ব্যাবহারিক স্তরের; জ্ঞানে তা লুপ্ত। দুই স্তরের সত্য আলাদা না করলে প্রশ্নগুলো বৃত্তাকারে ঘুরবে; স্তরবিভাগ মেনে নিলে আপত্তি সরে যাবে। জগৎকে “অনির্বচনীয়” বলা হয়—পরমার্থে না সত্য, না অসত্য—জগৎ না একেবারে “সৎ”, না একেবারে “অসৎ”, বরং উভয়েরই বিলক্ষণ—ঠিক দৃষ্টান্তের মতো—দেখা যায়, কিন্তু তদন্তে গলে যায়।
দ্বৈত দর্শনের সঙ্গে পার্থক্যটি তাই “পার্থক্যের প্রকৃতি”তে। দ্বৈত বলে—ব্রহ্ম ও সৃষ্টি স্বতন্ত্রভাবে সত্য; পার্থক্য মৌলিক। অদ্বৈত বলে—পার্থক্য ব্যাবহারিক–উপাধিনির্ভর; নাম-রূপ-উপাধি সরালেই থাকে এক চৈতন্য। ঢেউ-সমুদ্র-জলের দৃষ্টান্তে সমুদ্রই জল—ঢেউ নাম-রূপ; ঢেউয়ের ভিন্নতা ব্যাবহারিক, জলে কোনো দ্বিতীয়তা নেই। “দ্বৈতপত্তি”—পার্থক্যের উদয়—অবিদ্যার গোড়া; জ্ঞান এলে তা-ই সরে।
সব মিলিয়ে অদ্বৈত বেদান্ত একটি সুসংগত, বিশ্লেষণাত্মক ও সাধনমুখী দর্শন। বাস্তবতার স্তরভাগ দিয়ে জগৎকে মর্যাদা দেয়, কিন্তু তার চূড়ান্ততা অস্বীকার করে; জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ-পথ সাজায়, কিন্তু ব্রহ্মে শেষ কথা রাখে; মিথ্যাত্বের যুক্তি দিয়ে বিভ্রমের কার্য-কারণ বোঝায়, কিন্তু বিভ্রমের স্থায়িত্ব ভাঙে। গন্তব্য একটিই—পরিচয়ের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি: “অহম্ ব্রহ্মাস্মি।” এই স্বীকৃতিতে দ্বৈততার সমস্ত শব্দ থেমে যায়; থাকে কেবল স্বপ্রকাশিত চৈতন্য, যেখানে জ্ঞান-জ্ঞেয়-জ্ঞাতা—সব মিলেমিশে এক।
অভিন্নতার ধারণা অদ্বৈত বেদান্তের কেন্দ্রীয় দার্শনিক ভিত্তি। এখানে বলা হয়, প্রতিটি ব্যক্তিগত আত্মা বা জীবাত্মা আসলে বিশুদ্ধ চেতনা—অবিভক্ত, স্বপ্রকাশিত, এবং অপরিবর্তনীয়। কিন্তু অজ্ঞানতা বা অবিদ্যার প্রভাবে সেই বিশুদ্ধ আত্মা নিজেকে দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে ভিন্ন মনে করে। এই ভুল পরিচয়ের ফলেই আত্মা নিজেকে সীমিত সত্তা হিসেবে ভাবতে শুরু করে, এবং জগতের বহুত্ব (প্রপঞ্চ) অনুভূত হয়। অর্থাৎ, বহুত্ব আসলে আত্মার প্রকৃত অবস্থার বিকৃতি—একটি ভ্রান্তি বা মিথ্যা দৃষ্টি।
এই ভ্রান্তি ঘটে অবিদ্যা বা অজ্ঞতার কারণে। অবিদ্যা আত্মাকে নিজের প্রকৃত রূপ—ব্রহ্ম—থেকে আড়াল করে দেয়। ফলস্বরূপ আত্মা নিজেকে দেহ-মন-কর্তা বলে মনে করে, এবং "আমি করি", "আমি ভোগ করি" ধরনের অহংবোধ তৈরি হয়। মুক্তি বা মোক্ষ অর্জনের অর্থ হলো, এই ভুল অভিন্নতা ভেঙে ফেলা, এবং নিজের প্রকৃত স্বরূপ—ব্রহ্ম—সম্পর্কে সত্য জ্ঞান (বিদ্যা) লাভ করা। যখন কেউ বুঝে ফেলে যে, তার আত্মা ও ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন, তখন সব বন্ধন বিলীন হয়।
এই সমগ্র মহাজাগতিক বিভ্রম বা অভিজ্ঞতার পরিসর ব্যাখ্যা করার জন্য অদ্বৈত বেদান্তে প্রবর্তিত হয়েছে “মায়া” ধারণা। মায়া হলো ব্রহ্মের সৃজনীশক্তি—যার মাধ্যমে জগত প্রকাশিত হয়। এটি কোনো বাস্তব, স্বাধীন শক্তি নয়; এটি ব্রহ্মের অচিন্তনীয় ক্ষমতা, যা এক অপরিবর্তনীয় সত্য থেকে আপাত পরিবর্তনশীল জগতের উদ্ভব ঘটায়।
মায়া অপরিহার্য, কারণ এটি ব্রহ্মের অখণ্ড, অ-বিভক্ত প্রকৃতি রক্ষা করে, আবার জগতের অভিজ্ঞতাকেও ব্যাখ্যা করে। ব্রহ্ম চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আমরা এক পরিবর্তনশীল, কর্ম-কারণভিত্তিক জগৎ দেখি। যদি এই জগৎকে ব্রহ্মের সরাসরি রূপান্তর বলে ধরা হয়, তবে ব্রহ্মের ঐক্য ও অপরিবর্তনীয়তা ভেঙে যাবে। আবার, যদি বলা হয়, ব্রহ্ম একেবারে আলাদা এবং জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো বাস্তবতা, তবে অদ্বৈতবাদ নষ্ট হবে।
এই দুই বিপরীত অবস্থান এড়ানোর জন্য মায়ার ধারণা প্রয়োজন। মায়া ব্যাখ্যা করে—জগতের প্রকাশ একধরনের আপাত-আরোপ (superimposition), যা কেবল অজ্ঞানের দৃষ্টিকোণে সত্য। ব্রহ্ম এতে কোনো পরিবর্তনের মধ্যে যায় না; যেমন দড়ির ওপর সাপ দেখা গেলেও দড়ি আসলে অপরিবর্তিত থাকে।