অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: পঁচাত্তর



অদ্বৈত এই আপত্তির উত্তর দেয় তার ত্রিস্তরীয় বাস্তবতা তত্ত্ব দিয়ে। সে বলে—জগৎ একেবারে অপ্রকাশ বা শূন্য নয়; এটি ব্যাবহারিকভাবে সত্য (vyāvahārika satya), যদিও চূড়ান্ত সত্যে (pāramārthika satya) তা বিলীন হয়। অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়নি, ততক্ষণ জগৎকে বাস্তব ধরা যায়; আলোচনা, যুক্তি, অভিজ্ঞতা—সবই সেই স্তরে অর্থপূর্ণ। কিন্তু মুক্তি বা ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের পর এই স্তরটি “উপহৃত” হয়, অর্থাৎ তখন দেখা যায়—সবই ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই যুক্তি চালানোর জন্য যে অস্থায়ী সত্য প্রয়োজন, সেটি ব্যাবহারিক দৃষ্টিতে যথেষ্ট, যদিও চূড়ান্তে তা বিলীন।

অদ্বৈতের কৌশল এখানে সূক্ষ্ম ও সুনিপুণ—সে প্রতিদ্বন্দ্বীর নিজের বাস্তবতাকে যুক্তির ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করে, কিন্তু সেই ক্ষেত্রের মধ্য থেকেই তার সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত করে দেয়—এ যেন অদ্বৈত দ্বৈতের ভেতর দিয়েই দ্বৈততাকে অতিক্রম করে।

ত্রিস্তরীয় বাস্তবতা তত্ত্ব (Tristharīya Vāstavata Tattva) অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি মৌলিক ধারণা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী জগতের সত্য বা বাস্তবতা এক নয়, বরং তিনটি স্তরে প্রকাশিত হয়—প্রাতিভাসিক (Prātibhāsika), ব্যাবহারিক (Vyāvahārika), এবং পারমার্থিক (Pāramārthika)।

প্রথম স্তর হলো প্রাতিভাসিক সত্য। এটি বিভ্রম বা ভ্রমমূলক বাস্তবতা, যা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বা মানসিক স্তরে সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু পরে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। যেমন, অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে ভুল করা, বা স্বপ্নে দেখা কোনো ঘর-বাড়ি বা মানুষ। এই অভিজ্ঞতাগুলো তখন সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় জানা যায়—এগুলো আসলে মিথ্যা। প্রাতিভাসিক সত্য তাই ভ্রমমূলক বা মানসিক সত্য।

দ্বিতীয় স্তর হলো ব্যাবহারিক সত্য। এটি জাগতিক বা অভিজ্ঞতাজাত বাস্তবতা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কার্যকর। আমরা যা দেখি, করি, অনুভব করি—সমাজ, সম্পর্ক, কাজ, সুখ-দুঃখ—সবই এই স্তরের অন্তর্গত। যেমন, সূর্যোদয় দেখা, আগুনে পোড়া, বা জল পান করে তৃষ্ণা মেটানো—এসব ব্যাবহারিক জীবনে সত্য। তবে এই সত্য চূড়ান্ত নয়, এটি আপেক্ষিক ও নির্ভরশীল। ব্যাবহারিক সত্য তাই জাগতিক বা আপেক্ষিক সত্য।

তৃতীয় স্তর হলো পারমার্থিক সত্য। এটি চূড়ান্ত, অবিনশ্বর, অদ্বৈত সত্য। এই স্তরে কেবল ব্রহ্ম (Brahman) একমাত্র বাস্তব, আর সব কিছুই অনির্বচনীয় বা মিথ্যা। যেমন, জাগরণে দড়ির সত্য জানা গেলে “সাপ”-এর মিথ্যাতা প্রকাশিত হয়, তেমনি ব্রহ্ম-জ্ঞান হলে সমগ্র জগতের আপেক্ষিক অস্তিত্ব বিলীন হয়। পারমার্থিক সত্য তাই চিরন্তন ও অদ্বৈত ব্রহ্ম-সত্য।

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাতিভাসিক হলো ভ্রমের সত্য, ব্যাবহারিক হলো জাগতিক সত্য, আর পারমার্থিক হলো চূড়ান্ত সত্য। এই তত্ত্ব শেখায় যে, একই জগৎ এক এক দৃষ্টিকোণ থেকে এক একভাবে সত্য। স্বপ্নে দেখা সাপের মতো জগৎও আপাত-সত্য, কিন্তু চূড়ান্তভাবে ব্রহ্ম-জ্ঞান অর্জনের পর সেটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। তাই অদ্বৈত বেদান্ত বলে—“ব্রহ্ম সত্যং, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।” অর্থাৎ, চূড়ান্ত সত্য একমাত্র ব্রহ্মই; জগৎ আপাত সত্য মাত্র।

দ্বিতীয়ত, Aprasiddhaviśeṣaṇatā এবং Siddhasādhanatā—অর্থাৎ “প্রেডিকেটের ত্রুটি।” এই আপত্তির মূল বক্তব্য হলো—“মিথ্যা” শব্দটি নিজেই অস্পষ্ট। যদি “মিথ্যা”র অর্থ পরিষ্কার না হয়, তবে “জগৎ মিথ্যা”—এই দাবি প্রমাণ করা যায় না। ন্যায়ের দৃষ্টিতে, অদ্বৈত কখনও “মিথ্যা”-কে বলে অনির্বচনীয় (anirvacanīya), কখনও বলে অবিদ্যা-উৎপন্ন, আবার কখনও বলে উপহরণযোগ্য—এভাবে সংজ্ঞা পরিবর্তিত হওয়ায় ধারণাটি অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। এই অস্পষ্টতা অনুমানকে দুর্বল করে দেয়—এটাই অপ্রসিদ্ধবিশেষণতা বা “অজ্ঞাত বিশেষণ” ত্রুটি।

অন্যদিকে, যদি “মিথ্যা” বলতে এমন কিছু বোঝানো হয়, যা আগেই জানা বা প্রতিষ্ঠিত—যেমন “যা দেখা যায়, তা পরিবর্তনশীল”—তাহলে সেটি নতুন করে প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই। এটিকে বলা হয় সিদ্ধসাধনতা—“যা আগেই প্রমাণিত, তাকে আবার প্রমাণ করা।” এর ফলে যুক্তি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

অদ্বৈতের উত্তর এখানে সূক্ষ্ম ও দার্শনিক। তার মতে, “মিথ্যা” মানে “অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার” নয়, বরং “অভিজ্ঞতার প্রকৃত স্বরূপের সংশোধন।” জগৎ দেখা যায়, কিন্তু তার অর্থ ভুলভাবে বোঝা হয়—এটাই অবিদ্যা। তাই জগৎকে “মিথ্যা” বলা মানে ‘জগৎ নেই’ বলা নয়; বরং বোঝানো হয়—এটি ব্যাবহারিক স্তরে সত্য, কিন্তু চূড়ান্তে (যাত্রার লক্ষ্যে তথা চূড়ান্ত গন্তব্যে) নয়।

অদ্বৈতের এই দ্বিস্তরীয় দৃষ্টিভঙ্গিই তার দর্শনের প্রাণ—যেখানে একই বস্তু দুই স্তরে দুই অর্থে সত্য ও মিথ্যা হতে পারে। এইভাবে, অদ্বৈত যুক্তিকে কেবল প্রমাণের যন্ত্র নয়, বরং উপলব্ধির রূপান্তরের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। শেষপর্যন্ত যুক্তি যে-সীমায় এসে থেমে যায়, সেখানে জ্ঞান প্রত্যক্ষ হয়—এবং সেখানে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না—শুধু থাকে একক চেতনার নিস্তব্ধ বাস্তবতা, যা বলা যায়—“ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা।”

“জগৎ মিথ্যা” অনুমান শুধু একটি দার্শনিক দাবি নয়, বরং এক সূক্ষ্ম দ্বান্দ্বিক অনুশীলন। এটি একই সঙ্গে জ্ঞানের সীমা ও বাস্তবতার স্তরভেদ প্রকাশ করে। অদ্বৈতের শক্তি এখানেই—সে দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকেই নিজস্ব সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে, যেখানে যুক্তি ব্যবহার করে যুক্তিকেই ছাড়িয়ে যাওয়া হয়, এবং অবশেষে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক থেমে গিয়ে চেতনার একমাত্র সত্য প্রকাশ পায়—“ব্রহ্মই বাস্তব, বাকিটা মিথ্যা।”

অপ্রসিদ্ধবিশেষণতা এবং সিদ্ধসাধনতা—এই দুটি যুক্তিগত ত্রুটি অদ্বৈত বেদান্তের মিথ্যাত্ব অনুমান-এর সমালোচনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। সমালোচকরা দেখাতে চেয়েছেন যে, অদ্বৈতের “জগৎ মিথ্যা”—এই দাবিটি হয় এমন একটি প্রেডিকেটের (মিথ্যাত্বের) উপর নির্ভর করছে, যা নিজেই প্রতিষ্ঠিত নয়, নয়তো এমন একটি ধারণাকে পুনরায় প্রমাণ করছে, যা আগেই স্বীকৃত; ফলে উভয় ক্ষেত্রেই অনুমানটি যুক্তিগতভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

অদ্বৈত মতে, মিথ্যাত্ব (mithyātva)-এর সংজ্ঞা হলো anirvacanīyatva—যা না সত্য (sat), না মিথ্যা (asat), বরং উভয়েরই বিলক্ষণ। কিন্তু এই সংজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা বলেন, “anirvacanīyatva” নিজেই কোনো প্রতিষ্ঠিত ধারণা নয়; এর কোনো স্বাধীন প্রমাণ নেই এবং এটি অন্য দর্শনগুলির দ্বারা গৃহীতও নয়। তাই ন্যায়-দৃষ্টিতে এটি একটি অপ্রসিদ্ধ বিশেষণ—অর্থাৎ এমন এক প্রেডিকেট, যা প্রমাণিত বা স্বীকৃত নয়। এ কারণেই এই যুক্তিতাত্ত্বিক ত্রুটিকে বলা হয় অপ্রসিদ্ধবিশেষণতা (Aprasiddhaviśeṣaṇatā)। এই অবস্থায় অনুমানটি ব্যর্থ হয়, কারণ প্রমাণ-যোগ্য বিষয়ে যে-গুণ আরোপ করা হচ্ছে, সেটিই অবিদিত এবং বিতর্কিত।

অন্যদিকে, যদি অদ্বৈতবাদী মিথ্যাত্বের সংজ্ঞাকে কিছুটা নমনীয় করে বলেন যে, এটি “সৎ-অসৎ-বিলক্ষণ”—অর্থাৎ বাস্তব ও অবাস্তব উভয়ের থেকে পৃথক—তাহলে আরেকটি বিপদ তৈরি হয়। প্রতিপক্ষরা বলেন, এই সংজ্ঞা এত সাধারণ যে, এটি কোনো নতুন কিছু প্রমাণ করে না। প্রত্যেক বাস্তব বস্তুই অন্য বাস্তব বস্তু থেকে পৃথক, তাই “সৎ-অসৎ-বিলক্ষণ” বলা কেবল একটি পুনরুক্ত সত্য প্রকাশ করে। ফলে এই সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে “জগৎ মিথ্যা” প্রমাণ করতে চাওয়া মানে এমন একটি জিনিস প্রমাণ করা, যা আগেই প্রমাণিত—এটিই সিদ্ধসাধনতা (Siddhasādhanatā) বা “যা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, তা আবার প্রমাণ করার ত্রুটি।”

এই দুই বিপরীত অবস্থার মধ্যে অদ্বৈত অনুমান যেন আটকে যায়—একদিকে যদি মিথ্যাত্বকে “অনির্বচনীয়” বলা হয়, তবে তা প্রতিষ্ঠিত নয়; অন্যদিকে যদি তা “সৎ-অসৎ-বিলক্ষণ” বলে সাধারণীকরণ করা হয়, তবে তা তুচ্ছ ও ইতিমধ্যে গৃহীত। প্রতিপক্ষরা এই দ্বৈত অবস্থা ব্যবহার করে দেখান যে, অদ্বৈতের মিথ্যাত্ব-অনুমান যুক্তিগতভাবে নিজস্ব কোনো অনন্য প্রমাণসত্তা ধরে রাখতে পারে না। ফলে এই দোষদ্বয় মিলে অদ্বৈতের অনুমানকে একধরনের সংজ্ঞাগত ফাঁদে ফেলে দেয়—যেখানে মিথ্যাত্ব হয় অপ্রতিষ্ঠিত, নয়তো অর্থহীন।

অর্থান্তর ত্রুটি (Arthāntara-doṣa) অদ্বৈত বেদান্তের জগৎ-নেতিবাচন তত্ত্বের এক গভীর যুক্তিতাত্ত্বিক সংকটকে নির্দেশ করে। এই ত্রুটি মূলত দেখা দেয়, যখন অদ্বৈতবাদী “জগৎ মিথ্যা”—এই দাবিটি সমর্থন করার জন্য জগৎকে ব্রহ্মের লোকাসে (আশ্রয়ে) পরম নেতিবাচকতার (Atyantābhāva) অধীন বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু এই “পরম নেতিবাচকতা” বা “ত্রিকালনিষেধ”—অর্থাৎ তিন কালেই (অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ) যার অস্তিত্ব নেই—এই ধারণাটি নিজেই সত্তাতাত্ত্বিকভাবে কোথায় অবস্থান করছে, সেই প্রশ্নে দার্শনিক জটিলতা দেখা দেয়। কারণ, যদি এই নেতিবাচকতাকেও কোনো বাস্তবতার স্তরে স্থাপন করতে হয়, তবে সেটির অবস্থান যেভাবেই নির্ধারণ করা হোক না কেন, তা অদ্বৈতের মূল একত্ববাদী নীতিকে বিপদে ফেলে দেয়।

যদি বলা হয় যে, এই পরম নেতিবাচকতা পারমার্থিক (Pāramārthika)—অর্থাৎ চূড়ান্ত বাস্তব স্তরের অন্তর্ভুক্ত—তবে তা ব্রহ্মের পাশাপাশি এক দ্বিতীয় পরম বাস্তবতার অস্তিত্ব স্থাপন করে। এই অবস্থায় “ব্রহ্ম একমাত্র সত্য”, এই মৌলিক নীতি ভেঙে যায়, এবং সমালোচকরা একে “অদ্বৈতহানি” বা অদ্বৈতের ক্ষতি বলে অভিহিত করেন। কারণ নেতিবাচন তখন কেবল এক নাকচ নয়, বরং এক স্বাধীন, সমান্তরাল বাস্তবতা হিসেবে দাঁড়ায়, যা ব্রহ্মের অদ্বিতীয়তাকে অস্বীকার করে।

অন্যদিকে, যদি অদ্বৈতবাদী বলেন যে, এই পরম নেতিবাচকতা প্রাতিভাসিক (Prātibhāsika)—অর্থাৎ এটি নিজেই মায়াময়, স্বপ্নতুল্য, তাহলে আরেকটি সূক্ষ্ম বিপদ তৈরি হয়। যদি বিশ্বের “অস্তিত্বহীনতা” নিজেই মায়াময় বা প্রতিভাস মাত্র হয়, তবে অদ্বৈতের উপহরণ-নীতির (bādha) প্রয়োগে দেখা যায় যে, “বাতিলকৃত বস্তু”—অর্থাৎ জগৎ—এর তুলনায় এই মায়াময় নেতিবাচন আরও নিম্নতর স্তরে নেমে যায়। ফলে তুলনামূলকভাবে জগৎ বরং উচ্চতর বা স্থিতিশীলতর বাস্তবতা লাভ করে—বিশেষত ব্যাবহারিক বাস্তবতা (Vyāvahārika Satyam)-র মর্যাদা। তখন সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যে, জগৎ অভিজ্ঞতাগতভাবে বাস্তব, যা সরাসরি অদ্বৈতের মূল দাবি—“জগৎ মিথ্যা”—র সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।

এই দ্বন্দ্বই “অর্থান্তর ত্রুটি” নামে চিহ্নিত। কারণ, এখানে যে নেতিবাচন বা অবাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়, সেটি অবশেষে এমন এক বিকল্প অর্থ বা অবস্থায় গিয়ে পৌঁছে, যা মূল উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করে দেয়। জগৎকে অবাস্তব প্রমাণ করতে গিয়ে অবিদিতভাবে জগৎকেই অধিক স্থায়ী বা গ্রহণযোগ্য বাস্তবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। ফলে যুক্তির ফলা বিপরীত দিকে ঘুরে যায়, এবং অনুমানের লক্ষ্য—জগতের মিথ্যাত্ব প্রতিষ্ঠা—নিজের হাতেই নস্যাৎ হয়।

অতএব, অর্থান্তর ত্রুটি এখানে সেই যুক্তিগত আত্ম-বিরোধকে বোঝায়, যেখানে অদ্বৈতবাদী নেতিবাচনের যে-স্তর স্থির করতে চান, তা শেষপর্যন্ত বাস্তবতার অন্য এক স্তরে সরে গিয়ে মূল দার্শনিক অভিপ্রায়কেই নষ্ট করে দেয়।

দৃশ্যত্বের অ-নির্ণায়কত্ব বা Dṛśyatva-hetu-এর অসিদ্ধতা অদ্বৈত বেদান্তের মিথ্যাত্ব অনুমান-এর অন্যতম সূক্ষ্ম যৌক্তিক দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অদ্বৈত অনুমানের মূল কারণ বা hetu হলো—“জগৎ দৃশ্যমান, তাই মিথ্যা।” কিন্তু এই dṛśyatva (দৃশ্যমানতা বা জ্ঞেয়তা) সত্যিই কি মিথ্যাত্ব নির্দেশ করে? সমালোচকরা বলেন, এই কারণটি নিজেই অপ্রতিষ্ঠিত (Asiddha) এবং অ-নির্ণায়ক (Anaikāntika), ফলে এটি অনুমানকে অকার্যকর করে তোলে।

প্রথমত, যদি জগতের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়—যেমন অদ্বৈতবাদী দাবি করেন যে, জগৎ মিথ্যা বা অনির্বচনীয়—তবে সেই জগতের “দৃশ্যমানতা” প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব। কারণ, যে-বস্তুর অস্তিত্বই নেই, সেটিকে দেখা বা জানা যায় কীভাবে? যদি জগৎ কেবল প্রতিভাস বা মায়া হয়, তবে তার dṛśyatva বা “দেখা-যাওয়া” নিজেই অবাস্তব হয়ে যায়। ফলে যে-কারণে মিথ্যাত্ব প্রমাণ করতে চাওয়া হচ্ছে, সেই কারণই প্রথমে অপ্রতিষ্ঠিত (asiddha)—কারণ তা এক অবিদিত বস্তুর ওপর নির্ভর করছে। (জ্ঞানতত্ত্ব বা দর্শনে, “অবিদিত ব্রহ্ম” মানে সেই ব্রহ্ম, যার জ্ঞান এখনও অর্জিত হয়নি—যা “বিদিত” হলে মুক্তি হয়।)