অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: তিরাশি



মূলাবিদ্যার উদাহরণ বোঝাতে অদ্বৈত বেদান্তে প্রায়ই ব্যবহৃত হয় সাপ-দড়ি দৃষ্টান্ত (Rajju–Sarpa Nyāya)। রাত্রে কেউ দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পায়—এটাই অবিদ্যা। এখানে যা ঘটছে, তা বোঝার জন্য তিনটি স্তর আছে—
১. দড়ি (rajju)—এটি আসল বাস্তবতা, যা অটল ও অপরিবর্তনীয়। এটি ব্রহ্মের প্রতীক।
২. সাপ (sarpa)—এটি ভ্রান্ত ধারণা, যা অজ্ঞতার কারণে প্রতীয়মান। এটি জগৎ ও বহুত্বের প্রতীক।
৩. অন্ধকার (tamas)—যার কারণে দড়ি স্পষ্ট দেখা যায় না, আর সাপের বিভ্রম তৈরি হয়। এই অন্ধকারই মূলাবিদ্যা।

অর্থাৎ, অন্ধকার ছাড়া সাপের বিভ্রম হতো না। তেমনি, মূলাবিদ্যা ছাড়া জগত ও জীবের বহুরূপ অভিজ্ঞতাও হতো না। যখন আলো জ্বলে ওঠে—অর্থাৎ জ্ঞান (Brahma-jñāna) উদিত হয়—তখন সাপ মিলিয়ে যায়, দড়ি প্রকাশ পায়। অন্ধকারও দূর হয়। তখন বোঝা যায়, সাপ কখনো ছিল না, ছিল কেবল দড়ি। তেমনি, যখন ব্রহ্মজ্ঞান জাগ্রত হয়, তখন দেখা যায়—জগত, জীব, মায়া—সবই মূলাবিদ্যার সৃষ্টি, এবং চিরন্তন সত্য কেবল একটাই—ব্রহ্ম।

মূলাবিদ্যা-কে বলা হয় অদ্বৈত মহাবিশ্বের প্রথম কারণ (upādāna kāraṇa) বা আদিম উপাদান, যার মাধ্যমে একক ব্রহ্ম বহুরূপে প্রতীয়মান হয়। এক অর্থে, মূলাবিদ্যা এবং মায়া (Māyā) সমার্থক—এ দুটিই সেই শক্তি, যার দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করে, কিন্তু আসলে অপরিবর্তিত থাকে। তবে এই প্রকাশ শর্তাধীন, কারণ এটি ঘটে শুধুমাত্র ঈশ্বরের (Īśvara) মাধ্যমে, যিনি মায়ার নিয়ন্তা বা অধিষ্ঠাতা। ফলে মায়া ও মূলাবিদ্যা উভয়ই ব্রহ্মের আপেক্ষিক বা কার্যরূপ প্রকাশ, কিন্তু পরমার্থত তা ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়।

শঙ্কর নিজে এই “অবিদ্যার উৎস” নিয়ে অনুসন্ধানকে ফলহীন বলেছিলেন—কারণ অবিদ্যা নিজেই যদি অজ্ঞানতার আচ্ছাদন হয়, তবে তার উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে মানুষ আবার অজ্ঞানের মধ্যেই পড়ে যায়। কিন্তু তাঁর শিষ্য ও উত্তরসূরিরা—বিশেষত ভামতী (Bhāmati) ও বিবরণ (Vivarana) স্কুলের আচার্যরা—এই প্রশ্নে গভীর তর্কে প্রবেশ করেন।

এই দুই উপধারার মধ্যে মূল পার্থক্য দেখা যায় অবিদ্যার আশ্রয় (āśraya) নিয়ে—অর্থাৎ, অবিদ্যা ঠিক কোথায় অবস্থান করে। ভামতী স্কুলের মতে, অবিদ্যা অবলম্বন করে জীবাত্মাকে—কারণ ভুল ও বিভ্রম সবসময় জ্ঞান-সীমাবদ্ধ সত্তার মধ্যেই ঘটে। যে জানে, সেই ভুল জানে; তাই অবিদ্যা কেবল জীবের মধ্যে থাকতে পারে। অন্যদিকে, বিবরণ স্কুল—যা জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অদ্বৈতবাদকে ব্যাখ্যা করে—বলছে, যেহেতু ব্রহ্মই একমাত্র সত্য সত্তা, তাই অবিদ্যার আশ্রয়ও ব্রহ্মই হতে হবে। ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু বাস্তব নয়; সুতরাং অবিদ্যাও শেষপর্যন্ত ব্রহ্মের উপরই আরোপিত হতে পারে।

কিন্তু এখানেই দেখা দেয় এক গভীর দার্শনিক প্রশ্ন—শুদ্ধ, স্ব-প্রভাময় চেতনা ব্রহ্ম কীভাবে “অজ্ঞতার অধীন” হতে পারে? ব্রহ্ম তো জ্ঞানের উৎস, তার মধ্যে অজ্ঞান কেমন করে প্রবেশ করে?

বিবরণ স্কুলের উত্তর সূক্ষ্ম ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। তারা বলে—অবিদ্যা কোনো “বস্তুনিষ্ঠ কলুষতা” নয়; এটি চেতনার মৌলিক প্রকৃতিকে স্পর্শ করে না। বরং, অভিজ্ঞতার স্তরে (vyāvahārika plane) অবিদ্যা কার্যকর হয়, কারণ প্রত্যেক বৈধ জ্ঞান (pramā) তার বিপরীতে একটি অবিদ্যার অবসান ঘটায়। অর্থাৎ, অবিদ্যা কার্যত অনুভব ও জ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য পটভূমি; কিন্তু চূড়ান্ত স্তরে (pāramārthika plane) ব্রহ্মের বিশুদ্ধ চেতনা কখনোই এর দ্বারা কলুষিত হয় না।

এভাবে, বিবরণ মতে, অবিদ্যা হলো চেতনার ওপর আরোপিত এক প্রাক-অনুভবীয় অন্ধকার, যা ব্রহ্মকে ঢেকে রাখে না—বরং জীবের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যা অদ্বৈতের অভ্যন্তরে জগতের উদ্‌ভব, মায়া ও মুক্তির প্রক্রিয়াকে যৌক্তিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে।

অদ্বৈত দর্শনে উপাধি (Upādhi) ধারণাটি এক গভীর দার্শনিক কৌশল, যার সাহায্যে পরম অদ্বৈত সত্যের (Brahman-এর একত্ব) সঙ্গে জগৎ ও জীবের আপাত দ্বৈত অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্য ব্যাখ্যা করা হয়। উপাধি শব্দের অর্থ—“আরোপণ”, “সীমাবদ্ধতা”, বা “অস্থায়ী শর্ত”। অর্থাৎ, এটি এমন একটি অবস্থা বা সংযোগ, যা মূলত পরম সত্তার (Ātman/Brahman) প্রকৃত রূপকে আড়াল না করেও সেটিকে সীমাবদ্ধ বা শর্তযুক্ত বলে প্রতীয়মান করে তোলে।

এই ধারণা ব্যাখ্যা করে, কীভাবে একক, অখণ্ড, চিরন্তন ব্রহ্ম স্থান, কাল বা নৈকট্যের (spatial proximity) কারণে আপাতভাবে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে বলে মনে হয়। আসলে ব্রহ্ম কখনও পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু যে-বস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্ক বা সংযোগ তৈরি হয়, সেই বস্তুই তার “উপাধি” হিসেবে কাজ করে এবং আপাত-রূপান্তর বা সীমাবদ্ধতার বিভ্রম সৃষ্টি করে।

একটি ধ্রুপদ উদাহরণ প্রায় সব অদ্বৈত গ্রন্থেই পাওয়া যায়—স্বচ্ছ স্ফটিক (crystal) ও লাল ফুলের উদাহরণ। যখন একটি লাল ফুল স্ফটিকের পাশে রাখা হয়, তখন স্ফটিকটি লালচে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে স্ফটিকের কোনো রং নেই; লালত্ব কেবল নৈকট্যের কারণে তার ওপর প্রতিফলিত হয়। এখানে লাল ফুলই “উপাধি”—যার মাধ্যমে স্ফটিক আপাতভাবে লাল দেখা যায়, যদিও বাস্তবে তার কোনো পরিবর্তন ঘটে না।

এই একই প্রক্রিয়া অদ্বৈতের তিনটি প্রধান স্তরের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করে—
জীব (Jīva): দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণ (Antaḥkaraṇa)-এর উপাধিতে সীমাবদ্ধ ব্রহ্ম। জীব আসলে ব্রহ্মই, কিন্তু দেহ-মনকে নিজের রূপ বলে ভুল করে, ফলে সে সীমিত, পৃথক সত্তা বলে মনে হয়।
ঈশ্বর (Īśvara): মায়া (Māyā)-এর উপাধিতে সীমাবদ্ধ ব্রহ্ম। মায়া সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তিমত্তা ও বিশ্বসৃষ্টি পরিচালনার ক্ষমতা আরোপ করে, যার ফলে ব্রহ্ম ঈশ্বররূপে প্রতীয়মান হয়।
ব্রহ্ম (Brahman): যখন সব উপাধি সরিয়ে ফেলা হয়, তখন কেবল ব্রহ্মের স্বরূপ থাকে—অসীম, নিরপেক্ষ, অ-দ্বৈত চেতনা।

শঙ্কর স্পষ্ট করে বলেছেন যে, এই তিন অবস্থার পার্থক্য কেবল উপাধি-নির্ভর; অন্তর্নিহিত সত্য এক ও অবিভক্ত। জীব, ঈশ্বর ও ব্রহ্ম কোনো পৃথক সত্তা নয়—তাদের মধ্যে ভেদ কেবল নামমাত্র, যেমন স্ফটিক, তার প্রতিবিম্ব, এবং রঙের ভ্রমের মধ্যে পার্থক্য আসলে কেবল প্রতিফলনের স্তরে।

উপাধির মিথ্যা প্রকৃতি (mithyā) মুক্তির (mokṣa) দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে। উপাধি বাস্তব নয়, কারণ এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে চেতনার (Ātman)-এর উপর নির্ভরশীল। এর কোনো স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাস্তবতা নেই। মুক্তি মানে হলো এই সীমাবদ্ধতার ভ্রমের অবসান—যখন জানা যায় যে, “আমি সেই বিশুদ্ধ চেতনা, যার মধ্যে সমস্ত উপাধি প্রদর্শিত হয়”।

এই উপলব্ধি আসলে কোনো নতুন কিছু অর্জন নয়; বরং এক বিভ্রমের অপসারণ। যখন উপাধি ধারণাগতভাবে আত্মা থেকে পৃথক করা হয়, তখন সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে যায়—যেমন লাল ফুল সরিয়ে দিলে স্ফটিকের লালভাবও মিলিয়ে যায়। এতে প্রকাশিত হয় যে, সীমাবদ্ধতা কখনোই আত্মার অন্তর্গত ছিল না; তা ছিল কেবল অজ্ঞতার আরোপ।

অতএব, উপাধি ধারণাটি অদ্বৈত দর্শনের এক গভীর দার্শনিক সেতুবন্ধন—যা একদিকে মায়া ও জগতের ব্যাখ্যা দেয়, আর অন্যদিকে আত্মার চিরন্তন অ-দ্বৈত স্বরূপকে অক্ষুণ্ণ রাখে।

অদ্বৈত বেদান্তের জ্ঞানতত্ত্বে “প্রমাণ” (Pramāṇa) বা বৈধ জ্ঞানের মাধ্যম অন্যতম একটি মূলভিত্তি। এখানে ছয়টি স্বীকৃত প্রমাণকে গ্রহণ করা হয়েছে—প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa), অনুমান (Anumāna), উপমান (Upamāna), অর্থাপত্তি (Arthāpatti), অনুপলব্ধি (Anupalabdhi), এবং শব্দ (Śabda)। এই ছয়টি প্রমাণ মিলেই জ্ঞানের সেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া গঠন করে, যার মাধ্যমে সত্য উপলব্ধ হয়।

অদ্বৈতমতে, জ্ঞান কোনো নতুন কিছু সৃষ্টি করে না; বরং এটি অজ্ঞানের (Avidyā) পর্দা সরিয়ে যা চিরকাল থেকেই আছে, সেটিকেই প্রকাশ করে। যেমন সূর্য উঠলে (সূর্য আসলে ওঠে না, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। তুলনীয়: ব্রহ্ম) অন্ধকার সরে যায়—অন্ধকার দূর হয়, কিন্তু আলো নতুন করে তৈরি হয় না (আলো তো ছিলই)। তেমনি সত্যও জ্ঞানের দ্বারা সৃষ্টি নয়, বরং তার প্রকাশ।

প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa) হলো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সরাসরি অর্জিত জ্ঞান। এটি বাহ্য জগৎ থেকে আসে এবং তাই সীমিত; ইন্দ্রিয় বিভ্রম বা মায়ার কারণে এটি প্রায়ই ভুলের শিকার হয়।
অনুমান (Anumāna) হলো যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। এখানে হেতু (hetu) বা চিহ্নের সাহায্যে অদেখা বস্তুর সম্পর্কে জানা যায়। এই যুক্তি নির্ভর করে ব্যাপ্তি (Vyāpti)-এর উপর—অর্থাৎ চিহ্ন ও ফলের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন সহাবস্থানের সর্বজনীন সম্পর্কের উপর।
উপমান (Upamāna) হলো সাদৃশ্য বা তুলনার দ্বারা জ্ঞানলাভ। কোনো অজানা বস্তুকে পরিচিত কিছুর সঙ্গে তুলনা করে বোঝা যায়, যেমন—যদি বলা হয় “গণ্ডার গরুর মতো, কিন্তু কপালে শিং আছে”, তবে দেখামাত্রই চেনা যায়।
অর্থাপত্তি (Arthāpatti) হলো যুক্তিসঙ্গত অনুমান, যেখানে কোনো অজ্ঞাত ঘটনা ব্যাখ্যা করতে নতুন কোনো তথ্য কল্পনা করতে হয়। যেমন, যদি জানা যায়, কেউ দিনে উপবাস করে, কিন্তু তার ওজন কমছে না, তবে অনুমান করতে হবে, সে রাতে খাবার খাচ্ছে।
অনুপলব্ধি (Anupalabdhi) হলো অনুপস্থিতি দ্বারা জ্ঞানলাভ—অর্থাৎ কোনো কিছু না-থাকা বোঝা যায় তার না-দেখার মাধ্যমেই। যেমন টেবিলে বই নেই—এই জ্ঞান বইয়ের অনুপলব্ধি থেকেই আসে।
সবশেষে, শব্দ (Śabda) বা মৌখিক সাক্ষ্য হলো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান। অদ্বৈতমতে, এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, কারণ ব্রহ্মের মতো অতীন্দ্রিয় (transcendent) সত্য ইন্দ্রিয় বা যুক্তি দ্বারা বোঝা যায় না; তা কেবল শাস্ত্র বা উপনিষদের শব্দপ্রমাণের মাধ্যমে জানা যায়।

এই ছয় প্রমাণ একত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করে, যেখানে প্রত্যক্ষ ও অনুমান জগতের (Vyāvahārika Satya) জ্ঞান দেয়, কিন্তু শব্দ (Śabda) প্রমাণের মাধ্যমে প্রকাশ পায় পারমার্থিক সত্য (Pāramārthika Satya)—অর্থাৎ ব্রহ্ম। অদ্বৈতের জ্ঞানতত্ত্বে তাই প্রমাণ কোনো বাহ্যিক অনুসন্ধান নয়, বরং আত্ম-উন্মোচনের মাধ্যম—যা প্রকাশ করে সেই এক চিরন্তন চেতনা, যা সর্বদা ছিল, আছে এবং থাকবে।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানের স্তরক্রম (epistemic hierarchy) এক গভীর দার্শনিক কাঠামো, যা প্রতিটি প্রমাণের (Pramāṇa) কার্যক্ষেত্র ও সীমা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে। প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa) ও অনুমান (Anumāna) প্রমাণ কেবল জাগতিক বা ব্যাবহারিক স্তরে (Vyāvahārika Satya) কার্যকর—অর্থাৎ তারা সেই জগৎ সম্পর্কিত, যা মায়া (Māyā)-র দ্বারা গঠিত এবং পরিবর্তনশীল।

প্রত্যক্ষ জ্ঞান আসে ইন্দ্রিয়-অঙ্গের মাধ্যমে, এবং অনুমান আসে যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ থেকে। কিন্তু এই দুই প্রমাণই ইন্দ্রিয় ও মানসিক ক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল, তাই তারা সীমাবদ্ধ—তারা কেবল মায়ার পরিসরে ঘুরে বেড়ায়, কখনোই চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছতে পারে না।

অদ্বৈতের মতে, ব্রহ্ম হলো অ-দ্বৈত (Advaita), গুণহীন (Nirguṇa) এবং সম্পূর্ণরূপে অতীন্দ্রিয় (Transcendent)। “অতীন্দ্রিয়” মানে এমন এক ক্ষেত্র, যা ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি বা যুক্তির দ্বারা উপলব্ধ নয়; অর্থাৎ, যা অভিজ্ঞতামূলক সংজ্ঞার বাইরে। ব্রহ্মের ক্ষেত্রে কোনো বৈশিষ্ট্য বা গুণ আরোপ করা যায় না, কারণ তা করলেই ব্রহ্ম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে, এবং সীমা থাকলে সেটি আর পরম হতে পারে না।

এই কারণেই অদ্বৈত কঠোরভাবে একটি স্তরক্রম স্থাপন করে—যেখানে নিম্নস্তরের প্রমাণ (প্রত্যক্ষ, অনুমান ইত্যাদি) জাগতিক সত্যে (Vyāvahārika Satya) সীমাবদ্ধ, কিন্তু চূড়ান্ত সত্য (Pāramārthika Satya), অর্থাৎ ব্রহ্ম, উপলব্ধ হয় কেবল শব্দপ্রমাণের (Śabda Pramāṇa) মাধ্যমে।

শব্দপ্রমাণ মানে শাস্ত্র বা উপনিষদের কর্তৃত্বপূর্ণ বাণী, যা কোনো মানবীয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে না। কারণ শাস্ত্রের জ্ঞান আত্মসিদ্ধ (self-validating)—এটি পরম সত্যের প্রকাশ, যা অন্য কোনো প্রমাণের দ্বারা যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না।

অদ্বৈতের এই দার্শনিক বিন্যাস নিশ্চিত করে যে, ব্রহ্মের জ্ঞান ইন্দ্রিয় বা যুক্তি দ্বারা বিকৃত হবে না। শব্দপ্রমাণই একমাত্র মাধ্যম, যা সেই অতীন্দ্রিয় ক্ষেত্রের দ্বার খুলে দেয়, যেখানে জ্ঞান আর বস্তু নয়, বরং জ্ঞান ও জানা একাত্ম হয়ে যায়—এবং সেখানেই প্রকাশ পায় চূড়ান্ত সত্য: “ব্রহ্মই একমাত্র সত্তা, বাকি সব মায়া”।