মিথ্যাত্ব তাই অদ্বৈত দর্শনের মূল চাবিকাঠি—এটি শুধু মায়ার ধারণা নয়, বরং এক দার্শনিক উপায়, যার মাধ্যমে বহুত্ব ও একত্বকে একসাথে বোঝানো যায়। এটি জগৎকে না সম্পূর্ণ সত্য, না সম্পূর্ণ মিথ্যা—বরং “অতিক্রমযোগ্য সত্য” (transcendable reality) হিসেবে ব্যাখ্যা করে। অদ্বৈতবাদে মিথ্যাত্ব মানে হলো—জগৎ যেমন দেখা যায়, তা অভিজ্ঞতার স্তরে সত্য, কিন্তু চূড়ান্ত স্তরে (ব্রহ্মণের আলোকে) তা মিথ্যা, এবং এই সূক্ষ্ম পার্থক্যই অদ্বৈত দর্শনের দার্শনিক ভিত্তি।
অদ্বৈত দর্শনে “মিথ্যাত্ব” কেবল একটি মত বা অনুভব নয়—এটি একটি দার্শনিকভাবে নির্দিষ্ট, যৌক্তিকভাবে প্রমাণযোগ্য সত্তাতাত্ত্বিক অবস্থা (ontological status)। তাই একে সাধারণ ভাষায় “অবাস্তব” বলা যায় না; বরং নির্দিষ্ট যুক্তিশাস্ত্রীয় সংজ্ঞায় বোঝানো জরুরি। এর সংজ্ঞা হলো—“নিজস্ব আধারে (Svāśraya) অবস্থিত চরম অ-বিদ্যমানতার (Atyantābhāva) প্রতিযোগিত্ব (Pratiyogitvaṁ)—এই অবস্থাকেই মিথ্যাত্ব বলে।” অর্থাৎ, যে-সত্তার মধ্যেই তার নিজস্ব সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব (non-existence) নিহিত আছে, অর্থাৎ যে-বস্তু নিজের ভেতরেই নিজের অ-বাস্তবতার সম্ভাবনা বহন করে, সেই বস্তু মিথ্যা (mithyā)।
পদগুলির ব্যাখ্যা:
Svāśraya (স্বাশ্রয়)—“নিজস্ব আধার” বা “নিজের ভিত্তি”—অর্থাৎ, যে-স্থানে বস্তুটি অবস্থিত বা যেখানে তা টিকে থাকে।
Atyantābhāva (অত্যন্তাভাব)—“চরম অ-বিদ্যমানতা”—সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত অনস্তিত্ব; এমন এক অবস্থা, যেখানে কোনো অস্তিত্বের চিহ্নও নেই।
Pratiyogitva (প্রতিযোগিত্ব)—“counter-positiveness”—অর্থাৎ, যে অস্তিত্ব বা সত্তা “অ-অস্তিত্বের প্রতিপক্ষ” বা বিপরীত হিসেবে ধরা হয়।
একসাথে বললে, যে-সত্তা নিজের মধ্যেই নিজের চরম অনস্তিত্বের সম্ভাবনা রাখে, তার অস্তিত্ব মিথ্যা।
যেমন, একটি ঘট (মাটির পাত্র) আছে—তার নিজস্ব আধার হলো “ঘটের বস্তুগত রূপ”। কিন্তু এই ঘট একদিন ভেঙে যাবে, অদৃশ্য হবে, মাটিতে মিশে যাবে। অর্থাৎ, তার অস্তিত্বের অ-অস্তিত্ব (চরম অনস্তিত্ব) তার নিজস্ব প্রকৃতিতেই নিহিত। তাই ঘটের অস্তিত্ব সত্য নয়, মিথ্যা—কারণ এটি টেকসই বা চূড়ান্ত নয়।
মিথ্যাত্বের সংজ্ঞা অদ্বৈত দর্শনের এক গভীর অবস্থান প্রকাশ করে—জগৎকে “অবাস্তব” বলা মানে “অদৃশ্য বা বিভ্রম” নয়, বরং “অস্তিত্বের নিজস্ব স্তরে অনিত্য ও অতিক্রমযোগ্য” বলা। এটি এমন এক সত্তাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, যেখানে জগৎ—না পুরোপুরি আছে, না পুরোপুরি নেই—বরং “মিথ্যা”, অর্থাৎ “অতিক্রমযোগ্য সত্য”।
অদ্বৈতবাদ এখানে শুধু ভাববাদী নয়; এটি কঠোরভাবে যুক্তিশাস্ত্রের পরিভাষা ব্যবহার করে—যেমন pratiyogitva, atyantābhāva, svāśraya—যাতে “জগৎ মিথ্যা” এই উক্তিটি কোনো সাধারণ ধর্মীয় অনুভূতি না হয়ে একটি যৌক্তিক, বিশ্লেষণাত্মক সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে অদ্বৈতবাদ প্রমাণ করে—জগৎ অলীক হওয়া কোনো “বিশ্বাস” নয়, বরং একটি নির্ভুল দার্শনিক নির্ণয়, যা যুক্তি, ভাষা ও অস্তিত্বতত্ত্বের মাপকাঠিতে প্রতিষ্ঠিত।
সংক্ষেপে, অদ্বৈতবাদের ভাষায়, যে-সত্তা নিজের ভিতরেই নিজের সম্পূর্ণ অনস্তিত্বের সম্ভাবনা বহন করে, সেই সত্তা মিথ্যা। এই সংজ্ঞাই “ফলসিটি”-র (Mithyātva) কারিগরি ও অধিবিদ্যাগত অর্থ, যার উপর দাঁড়িয়ে পুরো অদ্বৈত দর্শনের দর্শনশাস্ত্র নির্মিত।
“মিথ্যা” মানে “অসৎ” নয়—অদ্বৈত বেদান্তে মিথ্যাত্ব (Mithyātva) বা “ফলসিটি” কখনোই “অসৎ” (asat) বা “সম্পূর্ণ অ-অস্তিত্ব” বোঝায় না। অসৎ মানে, যা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব, যেমন—“বর্গাকার বৃত্ত,” বা “বন্ধ্যা নারীর পুত্র (vandhyāputra)।” এই ধরনের সত্তা বা ধারণা কখনও অভিজ্ঞতার বিষয় হতে পারে না—না ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে, না মায়ার দ্বারা। অর্থাৎ, এরা একেবারে অবাস্তব—তাদের অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
“মিথ্যা”র অবস্থান অনির্বচনীয় (Anirvacanīya)—অদ্বৈত বেদান্ত বলে—জগৎ “অসৎ” নয়, আবার একে “সৎ” বলাও যায় না। তাহলে এর প্রকৃতি কী? এর অবস্থান হলো অনির্বচনীয় (anirvacanīya)—অর্থাৎ, যা সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, বরং এমন এক অবস্থায় আছে, যা বর্ণনাতীত (indefinable)। এটি একটি স্বতন্ত্র সত্তাতাত্ত্বিক বিভাগ (unique ontological category)—একটি তৃতীয় অবস্থা, যা “অস্তিত্ব” ও “অ-অস্তিত্ব”-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
কেন এই তৃতীয় অবস্থার প্রয়োজন? অদ্বৈত দর্শনের মূল দাবি হলো—ব্রহ্মণ (Brahman) একমাত্র চূড়ান্ত সত্য (the one non-dual reality)। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা নানা বস্তু, মানুষ, অনুভূতি ও পরিবর্তন দেখি। এই দৃশ্যমান জগৎ যদি সত্যিই সৎ (চূড়ান্তভাবে বাস্তব) হতো, তাহলে ব্রহ্মণ আর “অদ্বৈত” থাকত না—কারণ তার প্রতিযোগী হিসেবে এই জগৎও বাস্তব হতো। অন্যদিকে, যদি জগৎ অসৎ (সম্পূর্ণ অ-বাস্তব) হতো, তাহলে আমরা যে আনন্দ, দুঃখ, কর্ম বা জ্ঞান অভিজ্ঞতা করি, সবই অর্থহীন হয়ে যেত—যা অদ্বৈতকে শূন্যবাদ (nihilism)-এর মতো করে তুলত। তাই এই দুই চরম অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে অদ্বৈত এক “তৃতীয় পথ” গ্রহণ করে—জগৎ অনির্বচনীয় (anirvacanīya), অর্থাৎ সাময়িকভাবে বিদ্যমান (provisionally existent), যতক্ষণ না চূড়ান্ত সত্য (ব্রহ্মণ) উপলব্ধ হয়।
অনির্বচনীয় জগতের অর্থ: এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে—জগৎ এখন বাস্তব বলে অনুভূত হয়, কিন্তু জ্ঞান উদয় হলে বোঝা যায়—এর নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; এটি ব্রহ্মণের ওপর নির্ভর করে “প্রকাশিত” হয়েছে, এবং ব্রহ্মণের উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি বাতিল (sublated) হয়ে যায়। অর্থাৎ, জগৎ আপাত বাস্তব (vyavahārika satya), কিন্তু চূড়ান্তভাবে অতিক্রমযোগ্য বাস্তব (paramārthika mithyā)।
অদ্বৈতবাদের “অনির্বচনীয়তা” ধারণা জগৎকে তিনটি সম্ভাবনার বাইরে স্থাপন করে—এটি পুরোপুরি সত্য নয়, পুরোপুরি মিথ্যা নয়, বরং অস্থায়ী ও নির্ভরশীল বাস্তবতা, যা চূড়ান্ত জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান) উদিত হলে বিলীন হয়। অনির্বচনীয় (Anirvacanīya) অর্থ—জগৎ না সম্পূর্ণ “আছে,” না সম্পূর্ণ “নেই”; এটি আছে যতক্ষণ না ব্রহ্মণের জ্ঞান উদিত হয়। এই তৃতীয় অবস্থানই অদ্বৈতবাদের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও অনন্য সত্তাতাত্ত্বিক উদ্ভাবন, যা একদিকে ব্রহ্মণের অদ্বৈতত্ব বজায় রাখে, অন্যদিকে মানবীয় অভিজ্ঞতার বাস্তবতাকেও অস্বীকার করে না।
মিথ্যাত্ব (Mithyātva) কোনো স্থির তত্ত্ব নয়; এটি একটি প্রক্রিয়া (process), যা দুটি ধাপে কাজ করে—অধ্যাস (Adhyāsa / Superimposition) এবং বাধ বা নিবারণ (Bādha / Sublation / Cancellation)। এই দুইয়ের মাধ্যমে অদ্বৈতবাদের “জগৎ আপাত সত্য কিন্তু চূড়ান্তভাবে মিথ্যা” দর্শন বাস্তব রূপ নেয়।
প্রথম ধাপ—অধ্যাস (Superimposition): অধ্যাস মানে “এক জিনিসের উপর অন্য কিছু চাপিয়ে দেওয়া”, অর্থাৎ অবাস্তবকে বাস্তব বলে গ্রহণ করা। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা যেমন দেখি—দড়িকে দেখে ভুলে সাপ ভাবা, আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখে সেটাকেই আসল মানুষ মনে করা, তেমনি অদ্বৈতমতে, আমরা ব্রহ্মণের ওপর জগৎকে আরোপ (superimpose) করি। অর্থাৎ, আমরা একক, নিরাকার, চিরন্তন চেতনার (ব্রহ্মণের) ওপর নাম, রূপ, সময়, স্থান, বস্তু—এসব ধারণা চাপিয়ে দিই। এই “চাপিয়ে দেওয়াই” অধ্যাস, যা অবিদ্যা (ignorance) থেকে উৎপন্ন। অধ্যাসের ফলেই জগৎ আমাদের কাছে বাস্তব মনে হয়, যদিও তা চূড়ান্ত অর্থে নয়।
দ্বিতীয় ধাপ—বাধ / নিবারণ (Sublation): যখন জ্ঞান (Brahma-jñāna) উদয় হয়, তখন সেই ভুল ধারণা মুছে যায়—যেমন আলো জ্বালালে দড়ির ওপর সাপের ভ্রম মিটে যায়। এই ভুল ধারণার বিলোপই বাধ বা sublation। এটি “বাতিল” করা নয়, বরং “উচ্চতর সত্যের দ্বারা নিম্নতর সত্যকে অতিক্রম করা।” অর্থাৎ, জগৎ মুছে যায় না, কিন্তু তার প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়—তখন দেখা যায়, যা “জগৎ” বলে মনে হচ্ছিল, তা আসলে ব্রহ্মণেরই প্রকাশ, কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়।
অধ্যাস দেখায়, কীভাবে অবিদ্যা (অজ্ঞান) আমাদের সামনে দ্বৈততা সৃষ্টি করে। বাধ দেখায়, কীভাবে জ্ঞান সেই দ্বৈততাকে অতিক্রম করে একত্ব উপলব্ধি করে। এই দুইয়ের মধ্যে চলমান গতিই “মিথ্যাত্ব”-এর বাস্তব প্রয়োগ—যেখানে জগৎ আপাত-বাস্তব (অধ্যাসের স্তরে), কিন্তু জ্ঞান উদিত হলে অতিক্রমযোগ্য (বাধের স্তরে)।
মিথ্যাত্বের প্রক্রিয়া হলো—প্রথমে অবিদ্যা থেকে অধ্যাস জন্ম নেয়—বাস্তবের ওপর অবাস্তব আরোপিত হয়; পরে জ্ঞান দ্বারা বাধ ঘটে—সেই অবাস্তবতা প্রকাশিত ও অতিক্রমিত হয়। এভাবেই অদ্বৈত দর্শনে “আপেক্ষিক বাস্তবতা” (relative reality) ও “পরম সত্য” (absolute reality) একটি যৌক্তিক, অভিজ্ঞতালব্ধ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়।
এককথায়, অধ্যাস হলো ভ্রমের সৃষ্টি, বাধ হলো জ্ঞানে সেই ভ্রমের অবসান, আর এই দুইয়ের মিথস্ক্রিয়া-ই মিথ্যাত্বের গতিশীল প্রক্রিয়া—যার মাধ্যমে আপাত জগৎ শেষপর্যন্ত নিজের অন্তর্নিহিত সত্য—’ব্রহ্মণ’-কে প্রকাশ করে।
“বাতিলকরণ” বা বাধ (sublation)-এর কার্যপ্রণালি (operational principle) বোঝা যাক। ‘মিথ্যাত্ব’ (Mithyātva) বোঝায় এমন সত্তাকে, যা আপাতদৃষ্টিতে বাস্তব বলে প্রতীয়মান, কিন্তু চূড়ান্ত জ্ঞানের আলোয় অ-বাস্তব (non-real) বলে প্রকাশ পায়। অর্থাৎ, কোনো জিনিস যতক্ষণ পর্যন্ত উচ্চতর জ্ঞান (Brahma-jñāna)-এর দ্বারা বাতিল হয়নি, ততক্ষণ তা কার্যকর থাকে—কিন্তু সেই কার্যকারিতা আপেক্ষিক ও অস্থায়ী।
“বাতিলযোগ্যতা” বা Sublatability হলো যাচাইয়ের মানদণ্ড। অদ্বৈত দর্শনের মতে, কোনো বস্তু মিথ্যা (mithyā) কিনা তা বোঝার মানদণ্ড একটাই—সেটি বাতিলযোগ্য (bādhyamāna) কি না। অর্থাৎ, যদি কোনো সত্তা এমন হয়, যা পরবর্তী বা উচ্চতর জ্ঞানে অতিক্রম করা যায় বা ভুল প্রমাণিত হয়, তবে তা মিথ্যা। যেমন স্বপ্নে-দেখা শহর জাগরণের জ্ঞানে বিলীন হয়, দড়ির উপর সাপের ভ্রম আলোয় মিটে যায়, এবং জগতের বাস্তবতা ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা অতিক্রমিত হয়। এটাই সাধারণ থেকে পরমে যাওয়ার জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্রম (epistemic hierarchy)।
জ্ঞানতাত্ত্বিক স্তরক্রম (Hierarchy of Knowing): এই প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের একাধিক স্তর কাজ করে—প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa)—ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা জগৎ অনুভব করি; এটি অভিজ্ঞতার স্তরে বাস্তবতা-অনুভব দেয়। বুদ্ধিজাত বা যুক্তিজাত জ্ঞান (Anumāna / Śāstra-jñāna)—আমরা বিশ্লেষণ করে সেই অভিজ্ঞতা বুঝি ও ব্যাখ্যা করি। ব্রহ্মজ্ঞান (Brahma-jñāna)—এটি চূড়ান্ত উপলব্ধি, যা সব নিম্নতর জ্ঞানকে অতিক্রম করে “বাতিল” করে দেয়। এইভাবে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান আপেক্ষিক বাস্তবতা দেয়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানই চূড়ান্ত বাতিলকারী (ultimate sublater)—যা প্রকাশ করে যে, এই জগৎ ব্রহ্মণের বাইরে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নয়।
বাতিলকরণের কার্যনীতি: বাতিলকরণ (Bādha) মানে কোনো জিনিস “নষ্ট হয়ে যাওয়া” নয়; বরং এক উচ্চতর সত্য দ্বারা নিম্নতর সত্যকে অতিক্রম করা। যতক্ষণ পর্যন্ত ভুল ধারণা (অধ্যাস) থাকে, বস্তু কার্যকর মনে হয়। কিন্তু সত্য উপলব্ধি হলে দেখা যায়, সেই বস্তু স্বাধীন নয়—তা ব্রহ্মণের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, বাতিলকরণ মানে জ্ঞান দ্বারা অস্তিত্বের পুনঃসংজ্ঞা।
দর্শনগত তাৎপর্য: এই “বাতিলযোগ্যতা”র কাঠামোই অদ্বৈতবাদের অন্যতম জ্ঞানতাত্ত্বিক সূক্ষ্মতা। এটি প্রমাণ করে যে—ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা (empirical reality) শুধু শর্তসাপেক্ষভাবে সত্য (conditionally true), এবং তা কেবলমাত্র চূড়ান্ত জ্ঞানের (Brahma-jñāna) অধীনে বাতিল হয়। এই কাঠামোর মাধ্যমে অদ্বৈত দর্শন ঘোষণা করে—অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু উপলব্ধি (realization) শ্রেষ্ঠ; কারণ উপলব্ধিই চূড়ান্ত সত্য প্রকাশ করে।
অল্পকথায়, মিথ্যা সত্তার পরিচয়—বাতিলযোগ্যতা। যে-সত্তা উচ্চতর জ্ঞানে অতিক্রম হয়, সে সত্তা আপাতভাবে বাস্তব হলেও চূড়ান্তভাবে মিথ্যা। এইভাবে “বাধ” বা sublation অদ্বৈত দর্শনে সেই সক্রিয় প্রক্রিয়া, যা অস্থায়ী জগৎ থেকে চিরন্তন ব্রহ্মণের সত্যে পৌঁছে দেয়। সত্য হচ্ছে যা কখনও বাতিল হয় না (অ-বাধ্য), আর মিথ্যা হচ্ছে যা জ্ঞানের আলোয় বাতিল হয়ে যায়—এই জ্ঞানগত পার্থক্যই অদ্বৈতবাদের মিথ্যাত্ব তত্ত্বের মূল কার্যনির্বাহী নীতি।
দড়ি-সাপ ভ্রম কী বলে? অল্প আলোতে পেঁচানো দড়িকে কেউ সাপ ভেবে ভয় পেল। এখানে “সাপ”-টি দেখা গেছে, ভয়ও বাস্তবে হয়েছে—কিন্তু পরে আলো জ্বালাতেই ধরা পড়ল: ওটা দড়িই। অর্থাৎ “সাপ” প্রতীয়মান ছিল, কিন্তু চূড়ান্তভাবে নেই—এটাই মিথ্যাত্ব।