অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: ছাপান্ন



অদ্বৈত বেদান্তে চূড়ান্ত ঐক্য—ব্রহ্মানন্দঃ অদ্বৈত মতে, মুক্ত আত্মা চিরন্তন চেতনা ও আনন্দের অবিচ্ছেদ্য একতায় স্থিত থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় ব্রহ্মানন্দ—যেখানে আনন্দ কোনো অনুভূতি নয়, বরং অস্তিত্বের স্বরূপ। ব্রহ্মানন্দ মানে এমন এক আনন্দ, যা কোনো কারণ বা ফলের ওপর নির্ভর করে না। এটি না ইন্দ্রিয়গত, না মানসিক; বরং চেতনার নিজের মধ্যেই নিজের পূর্ণতা। অদ্বৈত দৃষ্টিতে আনন্দ কোনো অভিজ্ঞতা নয়—কারণ অভিজ্ঞতা মানেই দ্বৈততা (অভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতা); বরং আনন্দ এখানে চেতনার স্বয়ংপ্রকাশ, নিজের অস্তিত্বে নিজের পরিতৃপ্তি।

শঙ্করাচার্য বলেন, “যেখানে কিছুই জানার অবশিষ্ট নেই, যেখানে কোনো আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট থাকে না, সেখানেই পরম আনন্দ বিরাজ করে—যা ব্রহ্মস্বরূপ।” এই অবস্থায় আনন্দ মানে আনন্দের অনুভূতি নয়, বরং আনন্দের অনন্ত উপস্থিতি। চেতনা এখানে কোনো বস্তু নয়, কোনো ব্যক্তি নয়—এটি সর্বব্যাপী, অসীম, ও অপরিবর্তনীয় ঐক্য, যেখানে জগত, আত্মা ও ঈশ্বর—সব এক অনন্ত সত্তায় মিশে গেছে। এটাই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম—অস্তিত্ব (সৎ), চেতনা (চিৎ), ও আনন্দ (আনন্দ)-এর ত্রিবিধ ঐক্য, যা চূড়ান্ত মুক্ত আত্মার প্রাকৃতিক অবস্থা।

মাধ্যমক বৌদ্ধধর্মে নিস্তরঙ্গ শান্তি—শূন্যতার আনন্দ: মাধ্যমকের মুক্তি নির্বাণ, কিন্তু সেই নির্বাণ কোনো অভিজ্ঞতালব্ধ আনন্দ নয়। এটি এমন এক অবস্থান, যেখানে সব ধারণা—“আনন্দ”, “দুঃখ”, “অস্তিত্ব”, “অনস্তিত্ব”—সব বিলীন হয়ে যায়। তবুও, এই নিস্তরঙ্গতা একপ্রকার আনন্দের সমার্থক, কিন্তু ভাষার সীমা অতিক্রম করে। শূন্যতার আনন্দ কোনো ধনাত্মক অনুভূতি নয়; বরং সম্পূর্ণ ক্লেশমুক্তি—যেখানে আর কোনো আকর্ষণ, বিরাগ, দুঃখ বা আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট থাকে না। এই অবস্থায় “আমি সুখী” বা “আমি মুক্ত”—এইরকম ভাবও থাকে না, কারণ “আমি”-বোধটিই অনাত্ম জ্ঞানে বিলীন হয়ে গেছে।

বুদ্ধ নির্বাণকে বর্ণনা করেছেন “নিব্বানম্ পরমং সুখং”—“নির্বাণই পরম সুখ।” কিন্তু এই সুখ কোনো মানসিক উল্লাস নয়; এটি সম্পূর্ণ নিঃসংশ্লিষ্টতা, অনন্ত প্রশান্তি। নাগার্জুন বলেন, “যেখানে ধারণার গতি থেমে গেছে, সেখানেই নির্বাণ; এবং সেখানে না কোনো উত্থান, না কোনো বিলয়।” এইভাবে, শূন্যতার আনন্দ এক নিস্তরঙ্গ, নীরব পরিপূর্ণতা—যেখানে না কিছু পাওয়া যায়, না কিছু হারানো যায়, কারণ সব কিছুর সারসত্তাই বিলীন হয়ে গিয়েছে।

অদ্বৈতের ব্রহ্মানন্দ ও মাধ্যমকের শূন্যতার শান্তি—দুটিই দুঃখ ও বিভ্রমের পরম অতিক্রম। কিন্তু তাদের উপলব্ধির প্রকৃতি বিপরীতমুখী। অদ্বৈতের আনন্দ হলো অস্তিত্বের পূর্ণতা—চেতনা নিজের অস্তিত্বে নিজেই পরিপূর্ণ, তাই সেখানে অনন্ত তৃপ্তি। মাধ্যমকের শান্তি হলো অ-অস্তিত্বের পূর্ণতা—সব ধারণা, আত্মা, ও স্থায়িত্বের বিলোপেই সেখানে পরম প্রশান্তি। অদ্বৈতে, মুক্ত আত্মা ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হয়—অখণ্ড সত্তায় ঐক্যলাভ করে। মাধ্যমকে, মুক্ত মন সমস্ত ধারণা অতিক্রম করে—শূন্যতায় নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। একজন বলে, “আনন্দই আমি।” অন্যজন বলে, “আমি নেই—তাই শান্তি।” অদ্বৈতের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হলো পূর্ণতা, মাধ্যমকের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হলো নির্ভারতা। তবু উভয়েরই গন্তব্য—দুঃখ, অজ্ঞতা ও দ্বৈততা থেকে পরম মুক্তি।

অদ্বৈতের ব্রহ্মানন্দ ও মাধ্যমকের শূন্যতার শান্তি একই মুদ্রার দুই পিঠ। একজন বলে, চেতনার পূর্ণতাই আনন্দ; অন্যজন বলে, চেতনার নিস্তব্ধতাই শান্তি। একজন অস্তিত্বে অনন্ততা খোঁজে, অন্যজন অনস্তিত্বে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু দু-জনেই মানুষের মনকে শেখায়—মুক্তি মানে কোনো অর্জন নয়, কোনো সত্তা নয়; এটি এক অতিক্রম—যেখানে “আমি”, “তুমি”, “সুখ”, “দুঃখ”—সবই নীরব হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত, অদ্বৈতের ব্রহ্মানন্দ ও মাধ্যমকের শূন্যতা—একই অপরিমেয় নীরবতার দুই ব্যাখ্যা: একজন তাকে বলে আনন্দ, অন্যজন বলে শান্তি। কিন্তু উভয়েরই পরিণতি এক নিস্তরঙ্গ, অম্লান উপস্থিতি—যেখানে কিছু বলা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

জ্ঞান, ভাষা ও নীরবতার সীমা—শঙ্কর ও নাগার্জুনের দর্শনে বোধের পরিসীমা: চূড়ান্ত বাস্তবতা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা যতই গভীর হোক, এক পর্যায়ে এসে ভাষা ও যুক্তি নিজেই ভেঙে পড়ে। অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম উভয়েই স্বীকার করেছে যে, পরম সত্য কখনো ভাষায় বন্দি করা যায় না। দু-জনেই জ্ঞানের ভূমিকা স্বীকার করে, কিন্তু একই সঙ্গে দেখায় যে, জ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য—নিজেকে অতিক্রম করা। এখানেই দেখা দেয় “বোধের সীমা” ও “নীরবতার দর্শন”—যেখানে ভাষা থেমে যায়, এবং সত্য শুধু অভ্যন্তরীণভাবে উপলব্ধ হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞান ও নীরবতার সীমা: অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানের লক্ষ্য হলো অবিদ্যার অপনয়ন—কিন্তু এই জ্ঞান কোনো বস্তুকে নির্দেশ করে না। এটি “বস্তুভিত্তিক জ্ঞান” নয়, বরং আত্মস্বরূপের প্রত্যাবর্তন। এই জ্ঞান কোনো কিছু “জানে” না, বরং “অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে”—এটি অবজেক্টিভ জ্ঞান নয়, সাবজেক্টিভ জ্যোতি। যখন এই জ্ঞান উদ্‌ভাসিত হয়, তখন ভাষা, ধারণা, ও ভাবনার সমস্ত গঠন ভেঙে যায়। কারণ ভাষা সর্বদা দ্বৈত—বক্তা ও শ্রোতা, নাম ও নামিত, ধারণা ও বাস্তবতা—এই বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু ব্রহ্মানুভূতি অদ্বৈত; সেখানে কোনো বিভাজনই অবশিষ্ট থাকে না।

শঙ্করাচার্য বলেন, “যে-ব্রহ্ম সর্বজ্ঞানের প্রত্যক্ষ নয়, যে ভাষার ঊর্ধ্বে, যাকে মন পৌঁছাতে পারে না—তাকেই জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধ করতে হয়।” এই “জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধ করা” মানে কোনো চিন্তা নয়, বরং চিন্তার পরিসীমার অবসান। চিন্তা থামলে, ভাষা থামলে, আত্মা নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই অদ্বৈত বলে—“নীরবতা-ই পরম শিক্ষা।” শঙ্করাচার্যের উপদেশ এই কারণে কখনও কখনও “মৌন বেদান্ত” নামে পরিচিত—কারণ ব্রহ্ম সম্পর্কে যতই বলা যায়, তা সবই উপমা, ইঙ্গিত বা নিকট-সত্য (lakṣaṇā)। সত্য নিজে কখনও কথায় ধরা পড়ে না; সে শুধু অন্তর্লীন সচেতনতায় প্রকাশিত হয়—যাকে বলা হয় aparokṣānubhūti, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

‘অপরোক্ষানুভূতি’ শব্দটি তিনটি অংশে গঠিত—“অ” = নয়, “পরোক্ষ” = পরের দ্বারা, মধ্যস্থভাবে, পরোক্ষভাবে জ্ঞাত, “অনুভূতি” = অভিজ্ঞতা বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি; অর্থাৎ, অপরোক্ষানুভূতি মানে—যে-অভিজ্ঞতা অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়, সরাসরি নিজের মধ্যে ঘটে। এটি এমন জ্ঞান, যেখানে “জানার মাধ্যম” আর “জানার বিষয়”-এর মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না।

জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট—পরোক্ষ বনাম অপরোক্ষ: অদ্বৈত বেদান্তে দুই ধরনের জ্ঞানের পার্থক্য করা হয়—

পরোক্ষ জ্ঞান (Parokṣa-jñāna): যে-জ্ঞান আমরা শুনে, পড়ে বা যুক্তির মাধ্যমে পাই। যেমন “আগুন গরম”—এই কথা আমরা জানি, কিন্তু ছুঁয়ে দেখি না।

অপরোক্ষ জ্ঞান (Aparokṣa-jñāna): যে-জ্ঞান আমরা সরাসরি নিজের অভিজ্ঞতায় পাই। যেমন “আমি গরম অনুভব করছি।”

পরোক্ষ জ্ঞান বুদ্ধির বিষয়, অপরোক্ষ জ্ঞান চেতনার বিষয়। অদ্বৈত বেদান্ত বলে—ব্রহ্মজ্ঞান পরোক্ষ নয়, অপরোক্ষ হতে হবে, কারণ ব্রহ্ম কোনো ভাবনাযোগ্য বস্তু নয়, এটি চেতনার নিজেরই স্বরূপ।

শঙ্করাচার্যের দৃষ্টিতে অপরোক্ষানুভূতি: শঙ্কর বলেন—“ব্রহ্মকে জানার অর্থ ব্রহ্ম হওয়া।” অর্থাৎ, ব্রহ্ম কোনো দূরের সত্য নয়, যাকে কেউ “দেখবে” বা “জানবে”; বরং সেটি সেই চেতনা, যা জানে, দেখে, অনুভব করে। যখন মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয় সব শান্ত হয়, এবং “আমি”-বোধের সীমা বিলীন হয়, তখন যা অবশিষ্ট থাকে—সেই নিস্তরঙ্গ স্বচেতন উপস্থিতিই অপরোক্ষানুভূতি। এখানে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা আলাদা নয়, জানাই হওয়া, হওয়াই জানা।

ব্রহ্মজ্ঞান ও অপরোক্ষানুভূতি: অদ্বৈত মতে, মুক্তি (মোক্ষ) কেবল শাস্ত্র-অধ্যয়ন বা যুক্তির মাধ্যমে সম্ভব নয়। সেগুলো কেবল “পরোক্ষ প্রস্তুতি”—জ্ঞান-উপায়। কিন্তু মুক্তি আসে তখনই, যখন সেই জ্ঞান নিজের অস্তিত্বেই প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে—যখন কেউ উপলব্ধি করে—“আমি ব্রহ্মস্বরূপ—সচিদানন্দ। আমি জানার বিষয় নই; আমি জানাই।” এই অবস্থাই অপরোক্ষানুভূতি—যেখানে জানার ও জানার বিষয় এক হয়ে যায়।

অপরোক্ষানুভূতি ও ধ্যান / নিস্তরঙ্গ চেতনা: ধ্যান এখানে শুধু একটি উপায়—মনের সমস্ত তরঙ্গ স্তব্ধ করে চেতনার স্বচ্ছ আয়না উন্মুক্ত করা। এই স্তব্ধতার মধ্যে চেতনা নিজের দীপ্তি অনুভব করে—না কোনো চিন্তা, না কোনো ক্রিয়া, তবু উপস্থিতি আছে—এক নিঃশব্দ দীপ্তি, যাকে শঙ্কর বলেন “স্ব-প্রকাশমান চৈতন্য”। এটাই অপরোক্ষ অভিজ্ঞতা—চেতনার দ্বারা চেতনারই প্রকাশ।

দার্শনিক তাৎপর্য: অপরোক্ষানুভূতি হচ্ছে অদ্বৈতের অভ্যন্তরীণ যাচাই। এখানে কোনো ঈশ্বর বা বাহ্য জগতের ওপর নির্ভরতা নেই; কারণ ব্রহ্ম সর্বদা স্ব-প্রকাশমান (svayam-prakāśa)। যেমন সূর্য নিজেকে আলোকিত করতে আরেক আলো চায় না, তেমনি চেতনা নিজেকে জানার জন্য কোনো মাধ্যম চায় না। তাই ব্রহ্মজ্ঞান অন্য কোনো উপায়ে “প্রমাণিত” হতে পারে না, বরং কেবল নিজের মধ্যেই উদ্‌ভাসিত হয়।

অপরোক্ষানুভূতি মানে সেই প্রত্যক্ষ উপলব্ধি, যেখানে জানার ও জানা হওয়ার বিভাজন মুছে যায়। এখানে কোনো বস্তুর জ্ঞান নয়, বরং নিজেরই স্বরূপে স্থিত চেতনার স্বানুভব। এই অবস্থায়, “ব্রহ্ম কোথায়?”—এই প্রশ্ন অর্থহীন হয়ে যায়, কারণ তখন বোঝা যায়—যে জিজ্ঞেস করছে, সে-ই ব্রহ্ম। শঙ্করাচার্যের ভাষায়—“যে জানে, ‘আমি ব্রহ্ম’, তার জানার কিছু অবশিষ্ট থাকে না।” এই অবস্থাই প্রকৃত অপরোক্ষানুভূতি—চেতনার নিস্তরঙ্গ আত্ম-জাগরণ, যেখানে মুক্তি কোনো লক্ষ্য নয়, বরং অস্তিত্বের নিজস্ব প্রকৃতি।

প্রত্যক্ষানুভূতি হলো এমন এক ধরনের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা, যা সরাসরি ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে ঘটে। এখানে কোনো মধ্যবর্তী মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। যেমন চোখে কোনো বস্তু দেখা, কানে শব্দ শোনা, নাকে গন্ধ পাওয়া, বা স্পর্শে ঠান্ডা-গরম বোঝা—এ সবই প্রত্যক্ষানুভূতির উদাহরণ। এই জ্ঞান তৎক্ষণাৎ ও অভিজ্ঞতালব্ধ, তাই সাধারণত এটি অধিক নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য বলে ধরা হয়। বস্তু, ইন্দ্রিয় ও মনের পারস্পরিক তথা সরাসরি সংযোগে এ জ্ঞান উৎপন্ন হয়।

অন্যদিকে, অপরোক্ষানুভূতি হলো এমন এক ধরনের জ্ঞান, যা সরাসরি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বরং কোনো মাধ্যম বা পরোক্ষ উপায়ে অর্জিত হয়। যুক্তি, অনুমান, স্মৃতি বা অন্যের বর্ণনা—এসবের মাধ্যমে আমরা যেভাবে কিছু জানি, সেটাই অপরোক্ষ জ্ঞান বা অপরোক্ষানুভূতি। যেমন দূরে ধোঁয়া দেখে বোঝা, “ওখানে আগুন আছে”; বা কোনো বই পড়ে জানা “আমাজন জঙ্গল বিশাল”—এ সবই অপরোক্ষ জ্ঞানের উদাহরণ। এখানে জ্ঞান সরাসরি অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, বরং বৌদ্ধিক বা মানসিক প্রক্রিয়ালব্ধ।

ফলে, প্রত্যক্ষানুভূতি ও অপরোক্ষানুভূতির মধ্যে মূল পার্থক্য হলো—প্রথমটি ইন্দ্রিয়নির্ভর ও তৎক্ষণাৎ, আর দ্বিতীয়টি মাধ্যমনির্ভর ও মানসিক প্রক্রিয়াজাত। প্রত্যক্ষানুভূতিতে কোনো মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অপরোক্ষানুভূতিতে যুক্তি, অনুমান বা অন্য জ্ঞানের সাহায্য লাগে।

দর্শনের ভাষায় বলা যায়—প্রত্যক্ষ জ্ঞান হলো সরাসরি দেখা, শোনা বা অনুভব করা; অপরোক্ষ জ্ঞান হলো কোনো মাধ্যমের দ্বারা জানা বা ধারণা করা। কেন একে “অপরোক্ষ” বলা হয় (যদিও এটি প্রত্যক্ষ)? যদি এটি সরাসরি অভিজ্ঞতা হয়, তবে “প্রত্যক্ষানুভূতি” না বলে “অপরোক্ষানুভূতি” বলা হলো কেন? এর কারণ—দেহ-ইন্দ্রিয় দ্বারা এটি অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, বরং আত্মচৈতন্য (Self-consciousness)-এর দ্বারা উপলব্ধ। ইন্দ্রিয়ের জগতে যা প্রত্যক্ষ হয়, তা সবই বহিঃপ্রত্যক্ষ; কিন্তু আত্মার জ্ঞান ইন্দ্রিয়নিরপেক্ষ, অন্তঃপ্রত্যক্ষ। তাই একে বলা হয়—“অপরোক্ষ” (ইন্দ্রিয়-পরোক্ষ নয়, বরং অন্তঃপ্রত্যক্ষ)। অর্থাৎ, “এটি পরোক্ষ নয়”, কিন্তু ইন্দ্রিয়গোচরও নয়। অদ্বৈত ভাষায়, এটি ‘আত্ম–প্রত্যক্ষ’ (Self-revealed) জ্ঞান—যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় একই সত্তা।

“অপরোক্ষানুভূতি” নামে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে—ঐতিহ্যগতভাবে শ্রী শঙ্করাচার্য-এর নামে পরিচিত (যদিও কিছু পণ্ডিত একে শঙ্করপরম্পরার গ্রন্থ মনে করেন)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে—আত্মা কোনো বাহ্য উপায়ে নয়, নিজের প্রকৃত স্বরূপে জানা যায়। সেই জ্ঞানই মুক্তি, আর সেটিই অপরোক্ষানুভূতি। গ্রন্থে বলা হয়: “ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা; আত্মা ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কিছু নয়।” এই উপলব্ধি শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন-এর ধারাবাহিক সাধনার মাধ্যমে পরিণত হয়, এবং সর্বশেষে আত্মানুভূতিতে (অপরোক্ষানুভূতি) রূপ নেয়।