এই দৃষ্টিভঙ্গি বলে, যেহেতু প্রত্যেকের জগৎবোধ আলাদা—কেউ এক বস্তুকে সুখদ, কেউ দুঃখদ মনে করে—তাহলে প্রত্যেকের ভ্রমের উৎসও আলাদা হতে হবে। যেমন, প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বপ্নের ভেতর নিজস্ব এক জগৎ সৃষ্টি করে, দু-জনের স্বপ্ন এক নয়। ঠিক তেমনি, জাগ্রত অবস্থাতেও সবার অভিজ্ঞতা এক নয়, তাই এক অবিদ্যা দিয়ে সেই বহুবিধ অভিজ্ঞতা বোঝানো যায় না। সুতরাং প্রতিটি জীবের নিজস্ব অবিদ্যা বা অজ্ঞান থাকাই যুক্তিসঙ্গত।
এক অজ্ঞান পক্ষ এই মতের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলে। তারা বলে—যদি অবিদ্যা বহু হয়, তাহলে এই যে আমরা সবাই এক জগৎ দেখি, একই সূর্য, একই আকাশ, একই পৃথিবী অনুভব করি—তার ব্যাখ্যা কীভাবে সম্ভব হবে? সবাই যদি আলাদা আলাদা অবিদ্যার অধীন থাকত, তবে সবার জগৎ-দৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, কোনো সাধারণ অভিজ্ঞতাই থাকত না। তাই তারা বলে, একটিই সমষ্টিগত অবিদ্যা আছে—মায়া, যা ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের অধীনে অবস্থান করে এবং যার দ্বারা সমগ্র জগৎ প্রকাশিত হয়।
শঙ্করাচার্য নিজে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেননি, তবে তাঁর ভাষ্যরীতি এক অজ্ঞান পক্ষের দিকে ঝোঁকে। সুরেশ্বরাচার্যও অবিদ্যাকে একটিই বলেছেন। কিন্তু পরবর্তী অনেক ব্যাখ্যাকার, যেমন বিমলানন্দ, চিৎসুখাচার্য বা মধুসূদন সরস্বতী, নানা অজ্ঞান পক্ষের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, জীবের বৈচিত্র্য ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পার্থক্য বোঝাতে বহু অজ্ঞানই অধিক উপযুক্ত ব্যাখ্যা।
তবে শেষ পর্যন্ত অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এই বহুত্বও কেবল ব্যাবহারিক স্তরে সত্য। পরমার্থে অবিদ্যা নিজেই অনির্বচনীয়—না এক, না অনেক; যেমন জগৎ মায়ার প্রতিফলন, তেমনি অবিদ্যাও ব্রহ্মের ওপর আপাত-আরোপ। তাই নানা অজ্ঞান পক্ষ ব্যাখ্যা করে জীব ও অভিজ্ঞতার আপেক্ষিক ভেদকে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে সব ভেদ মুছে যায় এক পরম ব্রহ্মে, যেখানে কোনো অজ্ঞানই আর অবশিষ্ট থাকে না।
ফলত, যখন কেউ একটি ঝিনুকের রুপা-ভ্রান্তি নিবারণ করে, তখন সে শুধু সেই নির্দিষ্ট অবিদ্যাই দূর করে—সর্বজনীন ব্রহ্ম-অবিদ্যা নয়। ব্রহ্ম-অবিদ্যা এত গভীর ও মৌলিক যে, সেটি কেবল ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারাই দূর করা যায়। এইভাবে, সাধারণ ভ্রান্তি-নিবারণের উদাহরণ (যেমন প্রতিভাসিক উপহরণ) ব্যবহার করেও অদ্বৈত মুক্তির পথের স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা বজায় রাখে।
এই তত্ত্বে আরও একটি দার্শনিক দিক আছে—অদ্বৈতের তিন স্তরের সত্যের প্রেক্ষিতে, যখন প্রতিভাসিক ভ্রান্তি নাকচ হয়, তখন তার অনস্তিত্ব বা অভাব আরও উচ্চ স্তরের বাস্তবতায় স্থাপিত হয়। যেমন, যখন “রুপা আছে” ধারণা ভেঙে “রুপা নেই” জ্ঞান হয়, তখন “রুপার অনস্তিত্ব” (অভাব) নিজেই এখন একটি ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika satyam)। অর্থাৎ, রুপার মিথ্যা উপস্থিতির তুলনায় “রুপার অনুপস্থিতি” আরও বাস্তব, কারণ সেটি উচ্চতর স্তরের জ্ঞান থেকে আসে।
এই যুক্তি থেকে একটি সূক্ষ্ম সমস্যাও উঠে আসে। যদি বলা হয় “রুপার অনুপস্থিতি” অভিজ্ঞতামূলকভাবে বাস্তব, তবে সেটিও একধরনের অস্তিত্ব পায়। অর্থাৎ, “অ-অস্তিত্ব” নিজেই একপ্রকার অস্তিত্ব হয়ে যায়। এটি একটি যৌক্তিক ঝুঁকি, কারণ অদ্বৈতমতে, ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোনো সত্তার স্বাধীন অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কিন্তু “অ-অস্তিত্ব”-কে যদি অস্তিত্বগত মর্যাদা দেওয়া হয়, তবে তা ব্রহ্মের বাইরে নতুন এক বাস্তব সত্তা অনুমান করার মতো হয়ে দাঁড়ায়। এই সম্ভাবনাকেই বলা হয় Arthāntara doṣa—অর্থাৎ, ব্রহ্ম ছাড়া আরেকটি বাস্তব পদার্থ কল্পনা করার ভুল।
অতএব, একাধিক অজ্ঞতার তত্ত্বটি অদ্বৈতের অন্তর্গত এক বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল—যেখানে প্রতিটি বিভ্রম বা ভ্রান্তি নিজস্ব অবিদ্যার ফলে ব্যাখ্যাত হয়, ফলে মুক্তির চূড়ান্ত পথের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা পায়। একই সঙ্গে, এটি দেখায়, জ্ঞান-অজ্ঞানের সম্পর্ক কতটা স্তরবিন্যাসিত ও সূক্ষ্ম, এবং বাস্তবতার প্রতিটি স্তরে কেমনভাবে ভিন্ন ধরনের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব কার্যকর হয়। অবশেষে, সব অজ্ঞতার মূল—ব্রহ্ম-অবিদ্যা—দূর হয় কেবল তখনই, যখন আত্মা নিজেকে চূড়ান্তভাবে ব্রহ্মরূপে জানে: “অহম্ ব্রহ্মাস্মি।”
‘অর্থান্তর দোষ’ হলো এমন এক যুক্তিতাত্ত্বিক ত্রুটি, যেখানে কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা তার মূল উদ্দেশ্য বা প্রকৃত অর্থ থেকে সরে গিয়ে অন্য অর্থে গড়িয়ে যায়। শব্দটি ভাঙলে হয়—“অর্থ” অর্থাৎ বিষয় বা মানে, “অন্তর” অর্থাৎ ভিন্নতা বা পরিবর্তন, আর “দোষ” মানে ত্রুটি। তাই অর্থান্তর দোষের আক্ষরিক অর্থ—যে ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা বিষয়বস্তুর স্বরূপ না ধরে, বরং এমন অর্থ বোঝায়, যা অন্য, অতিরিক্ত বা অপ্রাসঙ্গিক—সেটিই এই ত্রুটি।
যখন কোনো ধারণা, সংজ্ঞা বা যুক্তি এমনভাবে দেওয়া হয় যে, তা নির্দিষ্ট বিষয়টির সীমানা ছাড়িয়ে অন্য বস্তুর ওপরও প্রযোজ্য হয়ে পড়ে, তখন বলা হয়—সংজ্ঞাটি অর্থান্তর দোষে আক্রান্ত। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে—“অবিদ্যা হলো জ্ঞান দ্বারা বাধিত বা নিবারিত যা-কিছু,” তখন এই সংজ্ঞাটি আপাতভাবে ঠিক মনে হলেও এতে অর্থান্তর দোষ ঘটে। কারণ এই সংজ্ঞা কেবল অবিদ্যাকে নয়, সেই সমস্ত ভুল জ্ঞানকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যেগুলিও পরে অন্য জ্ঞান দ্বারা নিবারিত হয়। অর্থাৎ সংজ্ঞাটি অবিদ্যার প্রকৃত স্বরূপ না ধরে, তার বাইরের বিষয়েও প্রসারিত হয়েছে; মূল অর্থ থেকে “অন্তর” হয়ে “অন্য অর্থে” চলে গেছে।
ন্যায় ও বেদান্ত উভয় শাস্ত্রেই এই দোষকে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিগত ত্রুটি হিসেবে ধরা হয়। যখন কোনো ব্যাখ্যা মূল বিষয়টির অনন্য ধর্ম প্রকাশ না করে, বরং অন্য কিছুর বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে, তখন সেই ব্যাখ্যা সত্যার্থে অসিদ্ধ হয়। তাই শাস্ত্রকাররা বলেন, কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা এমন হতে হবে, যা “অব্যাপ্ত” বা “অতিব্যাপ্ত” না হয়, এবং মূল অর্থেই স্থিত থাকে; অন্যথায় সেটি অর্থান্তর দোষে পতিত হয়।
অদ্বৈত বেদান্তে এই দোষটি বিশেষভাবে আলোচিত, কারণ প্রতিপক্ষগণ প্রায়ই অবিদ্যা, মায়া বা মিথ্যাত্বের সংজ্ঞা এমনভাবে দেয় যে, তা মূল তত্ত্ব থেকে সরে গিয়ে অন্য বস্তুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে। শঙ্কর ও তাঁর ভাষ্যকাররা এই প্রসঙ্গে বলেন, এমন সংজ্ঞা বা তত্ত্ব প্রকৃত অর্থে অর্থান্তর দোষযুক্ত, কারণ তা ব্রহ্মবিদ্যার উদ্দেশ্যবোধকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পারে না।
অতএব অর্থান্তর দোষ মানে হলো ব্যাখ্যার সেই ত্রুটি, যেখানে নির্দিষ্ট ধারণা তার স্বরূপ প্রকাশ না করে ভিন্ন কোনো অর্থে সরে যায়। এটি একপ্রকার বুদ্ধিগত ভ্রান্তি, যা প্রকৃত জ্ঞান বা সংজ্ঞাকে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্ত করে তোলে।
“অব্যাপ্ত” (Avyāpti) ও “অতিব্যাপ্ত” (Ativyāpti)—এই দুটি শব্দ যুক্তিশাস্ত্রের (Nyāya-Vaiśeṣika) পরিভাষা। এগুলো হেত্বাভাস বা ভুল যুক্তির শ্রেণিতে পড়ে।
“অব্যাপ্ত” মানে যেখানে হেতু (যে-কারণে কিছু প্রমাণিত হয়, অর্থাৎ প্রমাণের ভিত্তি) পর্যাপ্তভাবে ব্যাপিত নয়, অর্থাৎ হেতু কম জায়গায় পাওয়া যায়, কিন্তু সাধ্য (যা প্রমাণ করতে চাই) বেশি জায়গায় সত্য। এতে যুক্তির ঘাটতি থাকে। যেমন “যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে আগুন আছে”, এই নিয়ম ঠিক; কিন্তু কেউ যদি বলে, “মেঘে ধোঁয়া আছে, তাই মেঘেও আগুন আছে”, তাহলে তা ভুল হবে। কারণ মেঘে ধোঁয়া আছে, কিন্তু আগুন নেই। এখানে হেতু (আগুন) সব ধোঁয়া-যুক্ত স্থানে প্রযোজ্য নয়। তাই একে বলা হয় অব্যাপ্ত। অব্যাপ্ত মানে ‘হেতু সীমিত’—সব সাধ্য-যুক্ত (ধোঁয়া-যুক্ত) ক্ষেত্রে উপস্থিত নয়।
“অতিব্যাপ্ত” মানে যেখানে হেতু (যে-কারণে কিছু প্রমাণিত হয়, অর্থাৎ প্রমাণের ভিত্তি) অতিরিক্তভাবে ব্যাপিত, অর্থাৎ হেতু এমন জায়গায়ও সত্য, যেখানে সাধ্য সত্য নয়। এতে যুক্তি অতিরিক্ত পরিসরে চলে যায়। যেমন “যেখানে উষ্ণতা আছে, সেখানে আগুন আছে।” কিন্তু সূর্যেও উষ্ণতা আছে, শরীরেও উষ্ণতা আছে—তবু সেখানে সবসময় আগুন নেই। তাই “উষ্ণতা” নামের হেতু অতিব্যাপ্ত, কারণ এটি এমন জায়গায়ও প্রযোজ্য, যেখানে সাধ্য (আগুন) নেই।
সহজভাবে বলা যায়—অব্যাপ্ত মানে হেতু কম (under-extension)—হেতু < সাধ্য। অতিব্যাপ্ত মানে হেতু বেশি (over-extension)—হেতু > সাধ্য। অব্যাপ্ত হলো হেতুর ঘাটতি, আর অতিব্যাপ্ত হলো হেতুর অতিরিক্ততা। দুটিই যুক্তির ত্রুটি, যাকে হেত্বাভাস বলা হয়।
“হেত্বাভাস” (Hetvābhāsa) শব্দটি এসেছে দুটি শব্দ থেকে—“হেতু” অর্থাৎ কারণ বা প্রমাণ, এবং “আভাস” অর্থাৎ ছায়া বা অনুরূপতা। তাই ‘হেত্বাভাস’ মানে এমন কিছু, যা হেতুর মতো মনে হয়, কিন্তু আসলে হেতু নয়। এটি ভুল যুক্তি বা ভ্রান্ত প্রমাণ। যুক্তিশাস্ত্রে যখন কোনো কারণ (হেতু) সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই হেতুকে হেত্বাভাস বলা হয়। সহজভাবে বলা যায়, হেত্বাভাস হলো এমন হেতু, যা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে না। এর ফলে যুক্তির ভ্রান্তি ঘটে।
হেত্বাভাসের পাঁচটি প্রধান প্রকার রয়েছে:
প্রথমত, অব্যাপ্ত (Avyāpti)—যেখানে হেতু যথেষ্ট পরিমাণে প্রযোজ্য নয়। উদাহরণ: “মেঘে ধোঁয়া আছে, তাই আগুন আছে।” এটি ভুল, কারণ মেঘে ধোঁয়া থাকলেও আগুন নেই।
দ্বিতীয়ত, অতিব্যাপ্ত (Ativyāpti)—যেখানে হেতু অতিরিক্তভাবে প্রযোজ্য, এমন জায়গাতেও যেখানে সাধ্য নেই। উদাহরণ: “যেখানে উষ্ণতা আছে, সেখানে আগুন আছে।” এটি ভুল, কারণ সূর্যেও উষ্ণতা আছে, কিন্তু আগুন নেই।
তৃতীয়ত, অসিদ্ধ (Asiddha)—যেখানে হেতুই সত্য নয় বা প্রমাণযোগ্য নয়। উদাহরণ: “আকাশে ধোঁয়া আছে, তাই আগুন আছে।” এটি ভুল, কারণ আকাশে ধোঁয়া নেই; হেতুই ভিত্তিহীন।
চতুর্থত, বাধিত (Bādhita)—যেখানে হেতু অন্য প্রমাণ দ্বারা খণ্ডিত হয়। উদাহরণ: “আগুন ঠান্ডা, কারণ এটি লাল।” এটি ভুল, কারণ প্রত্যক্ষ প্রমাণে আগুন গরম।
পঞ্চমত, বিরুদ্ধ (Viruddha)—যেখানে হেতু সাধ্যের বিপরীত কিছু প্রমাণ করে। উদাহরণ: “এই আগুন অন্ধকার, কারণ এটি উজ্জ্বল।” এখানে হেতুই সাধ্যের বিপরীত ফল দেখাচ্ছে।
হেতু মানে সঠিক কারণ, যা সত্যকে প্রমাণ করে। কিন্তু হেত্বাভাস মানে সেই ভুল বা ভ্রান্ত কারণ, যা সত্যের পরিবর্তে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাই হেত্বাভাস হলো যুক্তির ত্রুটি, যা দেখতে হেতুর মতো হলেও বাস্তবে প্রমাণ হিসেবে ব্যর্থ।
অদ্বৈত বেদান্তের যুক্তি সবসময় কেবল “ব্রহ্মই একমাত্র সত্য”—এই ইতিবাচক ঘোষণা দিয়ে শেষ হয় না; তার সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো নেতিবাচক দ্বান্দ্বিকতা—যার উদ্দেশ্য হলো দেখানো যে, জগত যেভাবে প্রতিভাত হয়, তা চূড়ান্ত অর্থে সত্য নয়। এই নেতিকরণ বা নিবারণের প্রক্রিয়াকেই দার্শনিকভাবে বলা হয় Prapañca Mithyātva Anumāna—অর্থাৎ, “জগত মিথ্যা”, এই অনুমান।
এই যুক্তি তিনটি ধাপে গঠিত। প্রথমে প্রতিপাদ্য (pakṣa) বা বিষয়বস্তু—জগৎ (prapañca)। দ্বিতীয়ত সাধ্য (sādhya)—এর গুণ, অর্থাৎ “মিথ্যা”। তৃতীয়ত হেতু (hetu)—এর কারণ: “এটি অনুভূত হয়” (dṛśyatvāt)। যেমন “ঝিনুকে দেখা রূপা।” অর্থাৎ, যা দেখা যায়, সেটি পরিবর্তনশীল; পরিবর্তনশীল মানে নির্ভরশীল; আর যা অন্যের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে, তা কখনও চূড়ান্ত বা স্বতন্ত্রভাবে সত্য হতে পারে না। তাই, জগৎও আপাতভাবে দেখা গেলেও, তা স্থায়ী সত্য নয়।
কিন্তু এই অনুমানটি অন্য দর্শনগুলোর কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়নি। দ্বৈত বেদান্ত এবং ন্যায়-দর্শন এই যুক্তির বিশেষভাবে সমালোচনা করেছে। মাধ্বাচার্য তাঁর Mithyātva Anumāna Khaṇḍana এবং শ্রী জয়তীর্থ তাঁর Tīkā-তে যুক্তি দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন যে, অদ্বৈতের এই অনুমানের ভিতেই কয়েকটি বড়ো যৌক্তিক ত্রুটি আছে। এই ত্রুটিগুলি বিশেষত তিনটি জায়গায়—লোকাস (pakṣa), প্রেডিকেট (sādhya), এবং ফল (arthāntara)—এ দেখা যায়।
প্রথমত, Āśrayāsiddhi বা “লোকাস অনির্ধারিত” ত্রুটি। ন্যায়ের মতে, যদি কোনো বস্তু নিজেই অস্তিত্বহীন হয়, তবে তার ওপর কোনো গুণ আরোপ করা যায় না। অদ্বৈত বলে “জগৎ অবাস্তব”—তাহলে এই অবাস্তব জগতের ওপর “মিথ্যাত্ব” নামক গুণ চাপানোই অযৌক্তিক। এখানে একপ্রকার আত্মবিরোধ তৈরি হয়: কারণ “জগৎ নেই”, এটা বলার পরই আবার “জগৎ মিথ্যা” বলা হচ্ছে। যুক্তি চালাতে হলে জগতের অন্তত ব্যাবহারিক অস্তিত্ব মেনে নিতে হচ্ছে, নয়তো আলোচনাই সম্ভব নয়। এই অবস্থান যুক্তির এক বৃত্তাকার ফাঁদ তৈরি করে—যেখানে যে-সত্তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে, তাকেই প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় ধরে নেওয়া হচ্ছে।