অনাত্ম শেখায়—তুমি কোনো বস্তু নও, কোনো কেন্দ্রও নও; তুমি এক প্রবাহ, এক সম্পর্ক, এক জাগ্রত প্রক্রিয়া। যতক্ষণ তুমি বলো, “আমি আছি”, ততক্ষণ দুঃখও আছে; যখন তুমি দেখো, “এই ‘আমি’-র কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই”—তখনই মুক্তি আসে, কারণ আর কিছু আঁকড়ে ধরার থাকে না। এভাবেই অনাত্ম কেবল এক তত্ত্ব নয়, এটি মুক্ত চেতনার অভ্যন্তরীণ জাগরণ—যেখানে জ্ঞানের দীপ্তি অহং-এর ছায়া ভেদ করে উদ্ভাসিত হয়।
বুদ্ধ বলেন—“পাঁচটি স্কন্ধ—রূপ, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান—সবই অনিত্য ও অনাত্ম।” এরা একত্রে ‘ব্যক্তি’-র মিথ্যা ধারণা তৈরি করে, কিন্তু এর মধ্যে কোনো স্থায়ী “আমি” নেই। যেমন, পাঁচটি যন্ত্র একসঙ্গে কাজ করলে একটি “সংগীত” শোনা যায়, কিন্তু “সংগীত” আলাদা করে কোথাও নেই—তেমনি, পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টিতেই “আমি”র ধারণা জাগে, কিন্তু “আমি” নামে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা নেই—যেমন পাঁচটি আলাদা শিখা মিলে এক দীপশিখা মনে হয়। “আত্মা” বলতে কিছু নেই; শুধু পরস্পরনির্ভর পাঁচ প্রক্রিয়ার প্রবাহ আছে—এই উপলব্ধিই অনাত্মবোধ, যা অহং থেকে মুক্তির দ্বার খুলে দেয়।
অনাত্মের তিনটি স্তর:
শারীরিক অনাত্ম (Rūpa-anatta): দেহ বা রূপ অনিত্য; জন্মে, ক্ষয় হয়, নষ্ট হয়। তাই দেহে কোনো স্থায়ী আত্মা নেই।
মানসিক অনাত্ম (Citta-anatta): মন, চিন্তা, বেদনা, সঞ্জ্ঞা, সংস্কার—সবই মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায়। মন কোনো “একক সত্তা” নয়, বরং এক ধারা (stream of consciousness)।
অস্তিত্বগত অনাত্ম (Ontological Anatta): অস্তিত্বের গভীর স্তরে—কোনো কেন্দ্র নেই, কোনো “নিজ”-এর অধিকারী নেই। “আমি” হলো সম্পর্ক-নির্ভর এক নামমাত্র প্রক্ষেপণ (designation)।
অনাত্মবাদ মানব-অস্তিত্বের ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। এটি শেখায়—আমরা কোনো স্থায়ী, চিরন্তন “সত্তা” নই; বরং এক অবিরাম পরিবর্তনশীল সম্পর্কের প্রবাহ। অতএব—জন্ম-মৃত্যু কেবল প্রক্রিয়ার রূপান্তর, দুঃখ কোনো শাস্তি নয়, বরং অজ্ঞতার ফল, মুক্তি মানে “আমি”-বোধের অবসান। যখন কেউ সত্যিই উপলব্ধি করে যে, “আমি” নামে কিছু নেই, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে ভয়, আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি—সব বিলীন হয়। কারণ “যার নেই কোনো মালিকানা, তার নেই কোনো দুঃখও।”
অবিদ্যা (অজ্ঞতা) সৃষ্টি করে অহংবোধ—“আমি”, “আমার”, “আমাকে।” এই অহং থেকেই জন্ম নেয় তৃষ্ণা, আসক্তি ও দুঃখ। যখন কেউ দেখে—“আমি” নামটি কেবল একটি আপাত প্রতীতি, তখনই অবিদ্যা ভেঙে যায়, এবং চেতনা শান্ত হয়। এই শান্ত অবস্থাই নির্বাণ—যেখানে কিছু আঁকড়ে ধরার নেই, কিছু হারানোরও নেই।
পঞ্চস্কন্ধ শেখায়—“ব্যক্তি” কোনো বস্তু নয়, কোনো সত্তা নয়, বরং পাঁচটি পরিবর্তনশীল উপাদানের আপেক্ষিক সংগঠন। রূপ—শারীরিক ভিত্তি, বেদনা—সংবেদন অভিজ্ঞতা, সঞ্জ্ঞা—ধারণা ও চিহ্নিতকরণ, সংস্কার—মানসিক প্রেরণা ও ইচ্ছা, বিজ্ঞান—সচেতনতার প্রবাহ। এই পাঁচটি ক্রমাগত ওঠানামা করে, তবুও আমরা ভুলে যাই—এই সমষ্টিই “আমি” নয়; বরং “আমি” এই সমষ্টিরই শর্তসাপেক্ষ প্রতিফলন। যখন কেউ পঞ্চস্কন্ধের এই অস্থায়ী ও নির্ভরশীল প্রকৃতি উপলব্ধি করে, তখন তার মধ্যে অহংবোধ বিলুপ্ত হয়, আর তখনই জন্ম নেয় প্রজ্ঞা—যা মুক্তির পথে নিয়ে যায়।
নৈরাত্ম্য ও অনিত্যতা (Impermanence and Non-Self): প্রতীত্যসমুত্পাদ বলে—যেহেতু সব কিছু নির্ভরশীল, তাই কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যা নির্ভর করে, তা পরিবর্তনশীল; যা পরিবর্তনশীল, তা অনিত্য; যা অনিত্য, তা স্থায়ী সুখ দিতে পারে না। এই কারণেই বুদ্ধ তিনটি মৌলিক চিহ্নের কথা বলেন:
অনিত্য / অনিচ্চ (Anicca): সব কিছুই ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে। কিছুই একই থাকে না—দেহ বদলায়, অনুভূতি বদলায়, চিন্তা বদলায়, সম্পর্ক বদলায়, এমনকি মুহূর্তটিও বদলায়। এই পরিবর্তনই অস্তিত্বের প্রকৃত স্বরূপ। অর্থাৎ, স্থায়িত্বের যে-ধারণা আমরা আঁকড়ে ধরি, তা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। বুদ্ধ বলেন—যে এই পরিবর্তনকে সত্যভাবে দেখে, সে জানে—জীবনের কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এই বোঝাপড়াই অনিত্যবোধ, যা দুঃখ ও মুক্তি—দুটিরই ভিত্তি।
দুঃখ (Dukkha): যখন আমরা এই পরিবর্তনশীল জগতে স্থায়িত্ব খুঁজতে যাই, তখনই কষ্ট জন্ম নেয়। আমরা চাই, সুখ চিরস্থায়ী হোক; চাই, প্রিয়জন না বদলাক; চাই, দেহ অমর থাকুক—কিন্তু কিছুই স্থায়ী নয়। এই “চাওয়া” এবং “পরিবর্তন”-এর সংঘর্ষ থেকেই জন্ম নেয় দুঃখ। তাই দুঃখ কোনো বাইরের শাস্তি নয়; এটি আসলে অস্থায়ী জগতে স্থায়িত্ব খোঁজার মানসিক প্রতিক্রিয়া। যে দেখে, সব কিছু পরিবর্তনশীল, সে আসক্ত হয় না; আর যেখানে আসক্তি নেই, সেখানে দুঃখও নেই।
অনাত্ম (Anatta): যেহেতু সব কিছুই অনিত্য ও পরিবর্তনশীল, তাই এর মধ্যে কোনো স্থায়ী সত্তা বা “আমি” খুঁজে পাওয়া যায় না। দেহ, মন, চিন্তা, অনুভূতি—সবই ক্রমাগত প্রবাহের মধ্যে বদলায়। এই পরিবর্তনশীল উপাদানগুলির সমষ্টিকেই আমরা “আমি” বলে ভুল করি। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়—এই “আমি” নামটি শুধু ভাষার একটি রীতি, যার ভেতরে কোনো স্থির কেন্দ্র নেই। যে এটি উপলব্ধি করে, তার অহংবোধ বিলীন হয়, এবং সেই শূন্যতাতেই জন্ম নেয় প্রকৃত মুক্তি।
বুদ্ধের এই তিনটি চিহ্ন—অনিচ্চ, দুঃখ, অনাত্ম—একটি পূর্ণ দর্শনের তিন দিক। অনিচ্চ শেখায়, সব কিছু বদলায়। দুঃখ শেখায়, পরিবর্তনকে অস্বীকার করলে কষ্ট আসে। অনাত্ম শেখায়, পরিবর্তনের মধ্যে কোনো “আমি” নেই। এই তিনটি একসাথে বুঝতে পারলেই মানুষ আসক্তি ও ভয় থেকে মুক্ত হয়, এবং তখনই জন্ম নেয় শান্তি—যা বুদ্ধ বলেছিলেন—“নিব্বানম্ পরমং সুখং”—নির্বাণই পরম শান্তি।”
এভাবে দেখা যায়, অস্তিত্ব মানেই অনিত্যতা। অন্যভাবে বললে—চলাচলই অস্তিত্বের একমাত্র ধ্রুবক। যে জানে, সব কিছুই পরিবর্তনশীল, সে বুঝতে পারে, আঁকড়ে ধরা বৃথা। যে আঁকড়ে ধরে না, সে মুক্ত। তাই অনিত্যতা কেবল অস্তিত্বের গুণ নয়, এটি মুক্তির সম্ভাবনাও বটে।
শূন্যতার ভিত্তি (The Ground of Emptiness): মাধ্যমকাচার্য নাগার্জুন প্রতীত্যসমুত্পাদের ওপর দাঁড়িয়ে বলেন—“যা-কিছু অন্যের উপর নির্ভর করে উৎপন্ন হয়, তাকেই আমরা শূন্য বলি।” এখানেই শূন্যতা (śūnyatā) ধারণার জন্ম। এর মানে, কোনো বস্তু বা সত্তা নিজের মধ্যে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। প্রত্যেকটি সত্তা অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল, তাই তার কোনো স্বতঃসিদ্ধ সারবত্তা (svabhāva) নেই। এই স্বতঃসিদ্ধতার অনুপস্থিতিই “শূন্যতা”। কিন্তু শূন্যতা মানে নাস্তিত্ব নয়—বরং, এটি অস্তিত্বের সম্পর্কমূলক প্রকৃতি প্রকাশ করে। সব কিছু আছে—কিন্তু একে অপরের মাধ্যমে; কিছুই নেই—নিজের দ্বারা।
শূন্যতা মানে কিছুই “নেই”, তা নয়; বরং সব কিছু “শুধু সম্পর্করূপে আছে।” এই উপলব্ধিই বৌদ্ধ দর্শনের সর্বোচ্চ জ্ঞান, কারণ এখানেই অহং, পার্থক্য ও দ্বৈততা সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়। প্রতীত্যসমুত্পাদ, অনাত্মবাদ ও শূন্যতা—তিনটি আসলে একই দর্শনের তিনটি ধাপ। প্রতীত্যসমুত্পাদ শেখায়, সব কিছু নির্ভরশীল। অনাত্মবাদ দেখায়, এই নির্ভরতার কারণে “আমি” নামে কোনো স্থায়ী কেন্দ্র নেই। শূন্যতা জানায়, এই নির্ভরতাই অস্তিত্বের প্রকৃত স্বরূপ; সবই আপেক্ষিক, কিন্তু এই আপেক্ষিকতাই পরম সত্য।
শেষপর্যন্ত, যেখানে “আমি” নেই, “আমার” নেই, সেখানেই শান্তি; যেখানে কোনো সারসত্তা নেই, সেখানেই চেতনার নিস্তরঙ্গ মুক্তি। যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, সমস্ত কিছুই শর্তসাপেক্ষ ও অনিত্য, তখন তার মধ্য হতে আসক্তি, তৃষ্ণা ও অহংবোধ বিলুপ্ত হয়। এই উপলব্ধিই প্রজ্ঞা (prajñā)—যা নির্বাণের দ্বার খুলে দেয়। অতএব, প্রতীত্যসমুত্পাদ কেবল এক প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, এটি বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের কারণ ও মুক্তির পথ উভয়ই ব্যাখ্যা করে। প্রতীত্যসমুত্পাদ শেখায়—“কিছুই একা (অনির্ভরশীল) নয়, কিছুই স্থায়ী নয়, সবই নির্ভরশীল সম্পর্কের এক অনন্ত জাল।” এই উপলব্ধি মানুষকে অহং ও আসক্তির মায়া থেকে মুক্ত করে, এবং তাকে এমন এক শান্তিতে স্থিত করে, যেখানে কিছুই আঁকড়ে ধরতে হয় না, কারণ সব কিছুই সর্বদা পরিবর্তনশীল ও পারস্পরিক নির্ভরশীল।
নাগার্জুন ব্যাখ্যা করেন—“যা নির্ভর করে উৎপন্ন হয়, তা-ই শূন্য; এবং শূন্যতা মানেই মধ্যপথ।” অর্থাৎ, জগৎ না চিরন্তন, না নাস্তি; এটি অনিত্য ও নির্ভরশীল। যেমন আগুন কাঠের উপর নির্ভরশীল, তেমনি প্রতিটি অভিজ্ঞতা, চিন্তা, ও বস্তু অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে বিদ্যমান। এইভাবে, জগৎ এক অবিরাম প্রবাহ—যেখানে কোনো স্থায়ী সত্তা নেই, কেবল পরিবর্তনের নিরন্তর গতি আছে। মাধ্যমক দৃষ্টিতে, জগৎ কোনো বিভ্রম নয়, বরং দ্বৈত ধারণার ফল।
আমরা “বস্তু” বলে যা দেখি, তা আসলে সম্পর্কের মুহূর্তমাত্র—কারণ, ফলাফল, ও প্রত্যক্ষতার অনন্ত শৃঙ্খলে এক ক্ষণস্থায়ী সংযোগ। এখানে “মায়া” শব্দটি ব্যবহার না হলেও, এর কার্যকারিতা অনুরূপ—সব কিছু দেখা যায়, অনুভব হয়, কিন্তু কিছুই নিজস্ব সারসত্তা নিয়ে টিকে থাকে না।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ—অবিদ্যা বনাম প্রতীত্যসমুত্পাদ:
অদ্বৈতের অবিদ্যা একটি অজ্ঞতার পর্দা, যা চিরন্তন সত্যকে আড়াল করে। মাধ্যমকের প্রতীত্যসমুত্পাদ একটি নির্ভরতার কাঠামো, যা দেখায়—“সত্য” বলে কিছু স্থিরভাবে নেই।
অদ্বৈত বলে, জগৎ মায়া; তার মূল ব্রহ্ম। মাধ্যমক বলে, জগৎ সম্পর্ক; তার কোনো মূল নেই।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, মুক্তি মানে অবিদ্যা নাশ করে চেতনার মূল উৎসে ফিরে যাওয়া। মাধ্যমকের মতে, মুক্তি মানে ধারণা ও নির্ভরতাজনিত বিভ্রম দূর করে শূন্যতার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
অদ্বৈতে, জগতের ভ্রান্তি এক ভুল জ্ঞান। মাধ্যমকে, জগতের ভ্রান্তি এক ভুল দৃষ্টি—জিনিসকে “স্বতঃসিদ্ধ” ধরে নেওয়ার প্রবণতা।
অদ্বৈতের সত্য অস্তিত্ব, মাধ্যমকের সত্য অ-সারত্ব।
অদ্বৈত ও মাধ্যমক উভয়ের কেউই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে চূড়ান্ত বলে মেনে নেয় না; তবে অদ্বৈত বলে—জগৎ মিথ্যা, কারণ তা ব্রহ্ম নয়। আর মাধ্যমক বলে—জগৎ মিথ্যা নয়, কারণ তার কোনো স্বতন্ত্র “বাস্তবতা” নেই। একজন অজ্ঞতার আচ্ছাদন সরিয়ে সত্য খোঁজে, অন্যজন সকল নির্ভরতার শূন্যতায় সত্য উপলব্ধি করে। তবু উভয়ের লক্ষ্য একই—দ্বৈত দৃষ্টির সীমা অতিক্রম করে এমন এক অনন্ত স্বচ্ছতায় পৌঁছানো, যেখানে “সত্তা” ও “অসত্তা”—উভয়ই নীরব হয়ে যায়।
অভিজ্ঞতার স্তর ও সত্যের শ্রেণি—‘বাধ’ ও ‘দ্বি-সত্য তত্ত্ব’: অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শন উভয়েই মানবজ্ঞান ও বাস্তবতার স্তরভেদ ব্যাখ্যা করতে এক সূক্ষ্ম ধারণাগত কাঠামো নির্মাণ করেছে। অদ্বৈত বেদান্তে তা পরিচিত বাধ (Bādha) বা “অতিক্রম”-এর তত্ত্ব নামে, আর মাধ্যমকে তা প্রকাশ পায় দ্বি-সত্য তত্ত্ব (Twofold Truth) হিসেবে।
এই দুটি ধারণা মানুষকে শেখায়—একই জগৎ বিভিন্ন স্তরে দেখা ও বোঝা যায়, কিন্তু চূড়ান্ত সত্য কেবল তখনই ধরা পড়ে, যখন আপাত সত্যের সীমা অতিক্রম করা যায়। অদ্বৈত বেদান্তে বাধ তত্ত্ব—আপাত থেকে পরমে অতিক্রম—’বাধ’ শব্দের অর্থ হলো “অতিক্রম” বা “বাতিল করা”—কোনো এক নিম্নতর জ্ঞানের সত্যতাকে উচ্চতর জ্ঞানের আলোয় বাতিল করে দেওয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অদ্বৈত দর্শন জগৎ ও অভিজ্ঞতার আপেক্ষিকতা ব্যাখ্যা করে। উদাহরণস্বরূপ, রাতে দড়িকে সাপ মনে হওয়া—এই বিভ্রম প্রথমে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু আলো জ্বালানোর পর দেখা যায়, সেটি আসলে দড়ি। তখন “সাপ”-এর জ্ঞান “বাধ” হয়—অর্থাৎ বাতিল হয়, কারণ উচ্চতর উপলব্ধি তার ভ্রান্ততা প্রকাশ করেছে। তেমনি, জগৎও অবিদ্যার কারণে বাস্তব বলে মনে হয়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের পর তার আপাত বাস্তবতা বিলুপ্ত হয়। অদ্বৈত দর্শনের মতে, এই বাধ প্রক্রিয়াই বাস্তবতার স্তরভেদ নির্দেশ করে—
প্রাত্যক্ষিক সত্য (Vyāvahārika Satya)—যেখানে জগৎ, কর্ম, সম্পর্ক ইত্যাদি আপাতভাবে সত্য।
প্রতিভাসিক সত্য (Prātibhāsika Satya)—স্বপ্ন বা বিভ্রমের মতো, অতি-অস্থায়ী সত্য।
পারমার্থিক সত্য (Pāramārthika Satya)—কেবল ব্রহ্ম; একমাত্র চিরন্তন ও অ-বাধ্য সত্য।
এই তিন স্তরের মধ্যে “বাধ” চলমান—প্রতিটি নিম্নতর স্তর উচ্চতর জ্ঞানের দ্বারা অতিক্রান্ত হয়। শেষপর্যন্ত, পারমার্থিক জ্ঞানে পৌঁছে সমস্ত আপাত সত্য বিলীন হয়, এবং চেতনা কেবল ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত থাকে।