“যদি কিছুই বেঁধে না রাখে, তবে ভুল বা অকর্তব্য ঘটবে না কেন?”—প্রশ্নটি অদ্বৈত বেদান্তে—নির্মোহভাবে জ্ঞানের নৈতিক তাৎপর্যকে ছুঁয়ে যায়। বাহ্যনৈতিক শাসনের পরিবর্তে এখানে মানুষের অন্তর্গত রূপান্তরই নৈতিকতার ভিত্তি। শাস্ত্র ও দর্শনের উদ্দেশ্য এখানে ‘নিয়ন্ত্রণ’ নয়, বরং ‘অহংকার-নিবৃত্তি’।
কর্তা-ভাবের বিলয়ই নৈতিকতার মূল: অদ্বৈত বলে—ভুল বা অপরাধের উৎস হলো কর্তা-ভাব, অর্থাৎ, “আমি করছি”, এই ভ্রান্ত চেতনা। যতক্ষণ কর্তা-বোধ আছে, ততক্ষণই “আমি সৎ”, “আমি অসৎ”, “আমি অপরাধী”—এই দ্বন্দ্বগুলোও টিকে থাকে।
কিন্তু জ্ঞান উদিত হলে কর্তা-ভাব লুপ্ত হয়—“আমি” আর কর্তা নয়, কেবল সাক্ষী। তখন অপরাধবোধ বা অন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা টিকে থাকতে পারে না, কারণ যার দ্বারা অন্যায় ঘটত—সেই অহংই বিলুপ্ত।
শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্য (৩.১৭)-এ বলেন—“যস্যাহংকারো নাস্তি, তস্য ন কৰ্তৃত্বম্।” অর্থাৎ, যার মধ্যে অহংকার নেই, তার কোনো কর্তা-ভাবও নেই। এই অবস্থায় কর্ম ঘটে, কিন্তু “আমি করলাম”—এই অনুভব আর থাকে না।
জ্ঞান ও নৈতিকতার সম্পর্ক: অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, জ্ঞানই সর্বোচ্চ নৈতিকতা, কারণ জ্ঞান মানে “সত্যে স্থিতি”—যেখানে মিথ্যা প্রবৃত্তি নিজেই ম্লান হয়ে যায়। “যাহা সত্য, তাহাই শিবম্”—এই বোধে যখন মন স্থির হয়, তখন অন্যায় বা প্রতারণা আকর্ষণ হারায়। জ্ঞান তখন কোনো সংযমের প্রয়াস নয়, বরং অন্তরের স্বচ্ছতা।
কঠোপনিষদ (২.১.১) বলে—“যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা যেস্য হৃদি শৃতা। / অথ মর্ত্যোऽমৃতো ভবতি, অত্ৰ ব্রহ্ম সমশ্নুতে॥” অর্থাৎ, যখন হৃদয়ে স্থিত সমস্ত কামনা বিলীন হয়, তখনই মানুষ অমৃত হয়—ব্রহ্মকে উপভোগ করে। জ্ঞানী তাই কামনাকে দমন করে না; জ্ঞানের আলোয় কামনাই নির্বাপিত হয়।
জীবনমুক্তের নৈতিকতা—স্বতঃস্ফূর্ত শুদ্ধতা: জীবন্মুক্তের আচরণ আর নিয়মে বাঁধা নয়। তাঁর শৌচ, শম, দমন, তিতিক্ষা—সবই স্বরূপস্থিত চেতনার স্বাভাবিক প্রকাশ। তিনি নিয়ম পালন করেন না—নিয়ম তাঁর ভেতর থেকেই উৎসারিত। বাহ্য-সংযম তখন নিষ্প্রয়োজন, কারণ মনের বিশুদ্ধতা স্বয়ংপ্রকাশ।
শঙ্কর ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য (৪.১.১৩)-এ বলেন—“জ্ঞানের উদয়াত্ সর্বকর্মণাম্ অনারম্ভঃ।” অর্থাৎ, জ্ঞান উদিত হলে সব বাধ্য কর্মের স্বয়ং অবসান হয়; তবু ব্যাবহারিকভাবে শরীর-মন কিছুদিন চলে—প্রারব্ধ কর্মের বেগে। এই চলা আর “আমার করা” নয়, বরং সাক্ষী-চৈতন্যের নীরব লীলা।
ভক্তি ও জ্ঞানের ঐক্য: এই অবস্থায় জ্ঞান ও ভক্তি একে অপরের বিরোধী নয়। জ্ঞান হলো সেই অগ্নি, যা অহংকারের কাঠ পোড়ায়; আর ভক্তি হলো সেই সুগন্ধ, যা সেই পোড়া কাঠ থেকে মিশে যায় আকাশে—নির্বিকার, নির্মল, মধুর।
শঙ্কর ভক্তি-সূত্র-ভাষ্য (১.৩১)-এ বলেন—“জ্ঞান দ্বারা ভক্তির পারমার্থিকতা প্রকাশ্যতে।” অর্থাৎ জ্ঞানই ভক্তির পরম রূপ প্রকাশ করে—কারণ যখন জ্ঞান অহংকার দূর করে, তখন ভক্তি হয়ে ওঠে চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি।
চূড়ান্ত দৃষ্টি—কর্তা নেই, ভুলও নেই: অতএব, যেখানে কর্তা নেই, সেখানে ভুলও নেই; যেখানে অহংকার ম্লান, সেখানে লালসাও নিঃশেষ। জীবন্মুক্তের নৈতিকতা কোনো বাহ্য নিয়ম নয়—এ এক অন্তরের সুর, যেখানে সত্য নিজেই শিব, কর্ম নিজেই পূজা।
এই অবস্থায় কর্ম চলে, কিন্তু বাঁধে না; শরীর কাজ করে, কিন্তু চেতনা থাকে নিস্পৃহ; এবং সেই নীরব নিস্পৃহতা থেকেই বিশ্বে সর্বোচ্চ কল্যাণ ঝরে—এটাই অদ্বৈতের নীরব মানবতাবাদ, যেখানে মুক্ত মানুষ নিজেই হয়ে ওঠেন ধর্মের জীবন্ত প্রতিমা।
অদ্বৈত বেদান্তের আলোকে এই সত্য গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়—জ্ঞানোদয়ের পর শিক্ষাদান আর ব্যক্তিগত কর্ম নয়, বরং চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত বিকিরণ। এটি কোনো ব্যক্তিগত মেধা, বক্তৃতা-শক্তি বা কর্তা-ভাবের ফল নয়; বরং সেই নীরব চেতনার স্বাভাবিক প্রবাহ, যা ব্যাবহারিক জগতে স্বয়ং “লোকসংগ্রহ” রূপে প্রকাশ পায়।
জ্ঞানের পরে শিক্ষার স্বরূপ: জ্ঞানোদয়ের পর শাস্ত্রাচার্য, গুরু বা জীবনমুক্ত—যখন শিক্ষা দেন, তখন তা আর “আমি শেখাচ্ছি”, এমন মনোভাব থেকে আসে না। কর্তা-ভাব বিলুপ্ত হলে শিক্ষা হয়ে ওঠে প্রমাণের কোমল প্রতিস্থাপন (mṛdu-pramāṇa-vyavahāra)—যেখানে শাস্ত্রের কঠোর তত্ত্ব জীবনের স্পন্দনে মিশে যায়। এ শিক্ষায় নতুন কোনো জ্ঞান সৃষ্ট হয় না, বরং পূর্বপ্রাপ্ত সত্য সহজভাবে উদ্ভাসিত হয়।
গীতায় (৩.২৫) বলা হয়েছে—“কুর্যাদ্বিদ্বাংস্তথা অসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্।” অর্থাৎ, জ্ঞানীও অনাসক্ত থেকে কর্ম করেন, লোকসংগ্রহ তথা মানুষের মঙ্গলার্থে।
শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের ভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন—“লোকহিতার্থং গুরুণা চরণীয়ম্।” অর্থাৎ, জ্ঞানীর জন্যও কর্ম বা শিক্ষা পালনীয়—তবে নিজের জন্য নয়, লোকহিতার্থে, অন্যদের কল্যাণার্থে। এই শিক্ষা তাই চেতনার লীলার অংশ, ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়।
অধ্যারোপ-অপবাদ-মার্গ—শিক্ষার প্রাচীন রূপরেখা: অদ্বৈতের প্রাচীন শিক্ষণপদ্ধতি এই সূত্রে দাঁড়ায়—অধ্যারোপ-অপবাদ-ন্যায় (adhyāropa-apavāda-nyāya)।
প্রথমে ছাত্রের মানসিক স্তরে ব্রহ্মের কিছু গুণ আরোপ করা হয়—বোঝাবার সুবিধার্থে। যেমন ব্রহ্মকে “স্রষ্টা”, “পালক”, “জগতের কারণ” বলা হয়। কিন্তু পরে সেই আরোপ নিজেই প্রত্যাহৃত হয়, যখন মন প্রস্তুত হয়—শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য (২.১.১৪)-এ বলেন—“অধ্যারোপাপবাদাভ্যাম্ নিঃসিদ্ধঃ সর্বঃ প্রপঞ্চঃ।” অর্থাৎ, অধ্যারোপ (আরোপ) ও অপবাদ (নিবৃত্তি)—এই দুই প্রক্রিয়ায় সমগ্র প্রপঞ্চের অবাস্তবতা উপলব্ধ হয়।
শিক্ষক এই নীতি প্রয়োগ করেন সহানুভূতির সঙ্গে—যেখানে ছাত্রের চেতনার পরিপক্বতা অনুযায়ী শিক্ষার ভাষা বদলায়। যে যুক্তি চায়, তার কাছে শিক্ষক যুক্তি হয়ে ওঠেন; যে অনুভবের প্রান্তে পৌঁছেছে, তার কাছে শিক্ষক নীরবতা হয়ে ওঠেন।
জ্ঞানীর ভাষা ও নীরবতার দ্বৈত রূপ: অদ্বৈত বলে—জ্ঞানীর শিক্ষা কখনো বাক্যে, কখনো নীরবতায়। তাঁর দৃষ্টি, উপস্থিতি, এমনকি দৈনন্দিন চলনও শিক্ষারই অংশ।
শঙ্কর কেন উপনিষদ ভাষ্য (১.৩)-এ বলেন—“তত্র না বাচঃ, না মনঃ, না বেদাঃ প্রভর্তন্তে।” অর্থাৎ, যেখানে ব্রহ্মের জ্ঞান, সেখানে বাক্য ও মন নীরব; কিন্তু নীরবতার মধ্যেই সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে।
এখানে শিক্ষা কোনো বচন নয়—এ এক সত্তার সংস্পর্শ। নবীন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক কথা বলেন, যুক্তি দেন, উদাহরণ আনেন; কিন্তু যে প্রস্তুত, তার জন্য শিক্ষক নীরব থাকেন—কারণ নীরবতাই সেখানে সর্বোচ্চ ভাষা।
জীবনমুক্তের উপস্থিতিই শাস্ত্র: জ্ঞানীর উপস্থিতিই এক জীবন্ত শাস্ত্র। তাঁর জীবন হয়ে ওঠে সেই আয়না, যেখানে শাস্ত্রের বাক্য বাস্তব হয়ে ওঠে। তাঁর প্রতিটি কাজ, প্রতিটি নীরবতা মানুষকে স্মরণ করায়—“ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।”
এই শিক্ষণ আর বচন নয়, বরং দর্শন (darśana)—দেখামাত্রই জাগরণ ঘটে। যেমন উপনিষদে বলা হয়েছে—“দৃষ্ট্বা ধীরো ন বিশংতি কিঞ্চন।” (কঠোপনিষদ, ২.৩.১১) অর্থাৎ, যিনি সত্যকে দেখেছেন, তাঁর কাছে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না জানার।
চূড়ান্ত অবস্থায় শিক্ষক ও ছাত্রের ঐক্য: এই নীরব শিক্ষার পরিণতিতে শিক্ষক ও ছাত্রের ভেদ বিলীন হয়। চেতনা চেতনাকেই চিনে ফেলে—এই মিলনেই সত্য শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। এটাই “অপরোক্ষ অভিজ্ঞতা”র (aparokṣānubhava) প্রকৃত অর্থ।
তখন শিক্ষক নেই, ছাত্র নেই—কেবল চেতনার প্রতিধ্বনি এক চেতনায় মিশে যায়। এই অবস্থায় যা অবশিষ্ট থাকে, তা-ই “গুরুতত্ত্ব”—নীরব, দীপ্ত, সর্বব্যাপী।
জ্ঞানীর শিক্ষাদান তখন আর প্রচার নয়, এ এক অন্তঃস্থ অনুকম্পা—চেতনার স্বাভাবিক বিকিরণ, যেখানে কথাও শাস্ত্র, নীরবতাও মন্ত্র, আর জীবন নিজেই হয়ে ওঠে চেতনার ব্যাখ্যামূলক শ্লোক।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এই শেষদৃষ্টি—যেখানে জ্ঞান, মুক্তি ও জীবন একাকার—হলো সর্বোচ্চ সরলতা ও গভীরতার মিলন। মুক্তি এখানে কোনো মুহূর্তের অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং অনন্তের স্বাভাবিক উদ্ভাস; কোনো প্রাপ্তি নয়, কেবল আচ্ছাদন-নিবৃত্তি।
শঙ্করাচার্য বার বার বলেন—মুক্তি (মোক্ষ) কোনো নতুন অবস্থা নয়, কারণ আত্মা সর্বদাই মুক্ত। অবিদ্যা কেবল তার উপলব্ধিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যে-মুহূর্তে অবিদ্যা সরে যায়, তখন আত্মা নিজের স্বরূপেই দীপ্ত হয়।
ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য (১.১.৪)-এ শঙ্কর বলেন—“ন হি ব্রহ্ম জ্ঞানে নূতনং ভবতি, কেবলম্ অবিদ্যা-নিবৃত্তিঃ।” অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞান কোনো নতুন বস্তু উৎপন্ন করে না; এটি কেবল অবিদ্যার নিবৃত্তি ঘটায়।
উপনিষদে এই একই সত্য ঘোষিত—“নান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায়।” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ৩.৮) অর্থাৎ, জ্ঞানের বাইরে মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই; কারণ মুক্তি মানে যা সর্বদা ছিল, সেটির অনাবৃত প্রকাশ।
অবিদ্যা অনাদি, কিন্তু নিবার্য। অদ্বৈত বলে—অবিদ্যা অনাদি (আদিহীন), কিন্তু অনন্ত নয়। এর কোনো সূচনা নেই, কিন্তু অবসান আছে। যেমন অন্ধকার কখনও “তৈরি” হয় না, তবু সূর্য উঠলে বিলীন হয়, তেমনি জ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা টেকে না।
গীতায় (৫.১৬) শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং নাশিতম্ ত্যস্মিনাত্মনঃ।” অর্থাৎ, আত্মায় উদিত জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানের বিনাশ ঘটে। এই জ্ঞানও কোনো বাইরের প্রাপ্ত বস্তু নয়, বরং প্রত্যভিজ্ঞা (নিজেকে চিনে নেওয়া)—যা ছিল, সেটিই কেবল স্পষ্ট হয়।
জ্ঞান উদিত হলে কর্তা-ভাব লুপ্ত হয়, কিন্তু দেহ-মন-যন্ত্র চলা থামায় না। এটি প্রারব্ধ-কর্মের বেগে কিছুদিন সচল থাকে—যেমন ঘূর্ণন থামানোর পরও চাকা কিছুক্ষণ ঘোরে।
শঙ্কর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য (৪.১.১৫)-এ বলেন—“জ্ঞানোদয়াত্ প্রারব্ধকর্মণো ন নাশঃ।” অর্থাৎ, জ্ঞান ওঠার পরও প্রারব্ধ কর্ম বিনষ্ট হয় না; তবে জ্ঞানী তার দ্বারা আবদ্ধ হন না, কারণ তাঁর কর্তা-ভাব লুপ্ত।
গীতায়ও (৫.৮-৫.৯) এই অবস্থার বর্ণনা—“নৈব কিঞ্চিত্ করমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্।” অর্থাৎ, জ্ঞানী জানেন—“আমি কিছুই করি না”—তবু কর্ম ঘটে, যেমন জগতে বাতাস বয়।
জীবন্মুক্তের জীবন কোনো পালাবদল নয়, দৃষ্টিবদল। উপাধি (দেহ-মন) থাকে, কিন্তু তার সঙ্গে আত্মা আর অভিন্ন নয়। মুক্তি মানে উপাধি ত্যাগ নয়, বরং উপাধির মধ্য দিয়েই তার নিরপেক্ষ দর্শন।
গৌড়পাদ মাণ্ডূক্য কারিকা (৩.৩২)-তে বলেন—“নৈব কর্মেণ ন লিপ্যতে।” অর্থাৎ, জ্ঞানী কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না; কারণ তিনি জানেন, কর্ম জড়ের স্তরে, আত্মা সর্বদা নির্বিকার। বাইরে ব্যবহার চলে, ভেতরে থাকে নির্মল নীরবতা। এই দ্বৈত-একতা’র অবস্থাকেই বলা হয় জীবন্মুক্তির স্বাভাবিক প্রকাশ।
যে-অবস্থায় জ্ঞানী স্থিত, সেখানে জানার ও জানার বিষয়ের ভেদ লুপ্ত। চেতনা নিজের মধ্যে পূর্ণ, নিজেই আলো, নিজেই আশ্রয়।
মাণ্ডূক্য উপনিষদ (৭)-এ এই অবস্থাকেই বলা হয়েছে—“নান্তঃপ্রজ্ঞং, ন বহিঃপ্রজ্ঞং, ন উভয়তঃপ্রজ্ঞং…একমেবাদ্বিতীয়ম্।” অর্থাৎ, এটি না অন্তঃপ্রজ্ঞ, না বহিঃপ্রজ্ঞ, না উভয়; এটি একমাত্র অদ্বিতীয় চেতনা—যা সব অবস্থার সাক্ষী।
তখন জানা ও জানার বিষয় মিশে যায় এক অচঞ্চল স্বচ্ছতায়। ব্রহ্ম তখন হয়ে ওঠেন—“সর্ববৃত্তেষু তিষ্ঠান্ সর্বতঃ মুখঃ।” (শ্বেতাশ্বতর, ৩.১৬) অর্থাৎ, সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট রূপে আবদ্ধ নন।
এই চূড়ান্ত অবস্থায় দর্শন ব্যবহারকে অতিক্রম করে না, বরং তাকে আলোকিত করে। জ্ঞান তখন আর চিন্তা নয়—জীবনের রূপ নেয়; আর জীবনও তখন আর উপযোগ নয়—দর্শনের নীরব প্রতিধ্বনি।
যেমন মহর্ষি বদরায়ণ বলেন—“লোকবৎ তু লীলাকৈবল্যম্।” (ব্রহ্মসূত্র, ২.১.৩৩, শঙ্কর-ভাষ্য)
শঙ্কর ব্যাখ্যা করেন যে, ঈশ্বরের সৃষ্টির পেছনে কোনো প্রয়োজন বা অভাব নেই। যেমন সাধারণ মানুষের (বিশেষত জ্ঞানীর) অনাসক্ত আচরণ কেবল একটি স্বাভাবিক প্রকাশ, তেমনি ঈশ্বরের সৃষ্টি বা বিশ্বপ্রকাশও কেবল লীলা—কোনো উদ্দেশ্যসিদ্ধি নয়, কোনো প্রাপ্তিলাভ নয়।
অর্থাৎ, জ্ঞানীর ব্যবহার কেবল লীলা—সত্যে স্থিত চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। তখন কিছু কারণ নেই, তবু সব ঘটে; কিছু বলার নেই, তবু সব স্পষ্ট; কিছু খোঁজার নেই, কারণ যা চাওয়া হচ্ছিল, তা বরাবরই নিজেই ছিল—এক অনন্ত, স্বয়ংপ্রভ, নির্গুণ ব্রহ্ম, যিনি সকল বস্তুর আধার, কিন্তু নিজে অবস্তু; সকল জ্ঞানের কারণ, কিন্তু নিজে অজ্ঞেয়; সব জায়গায় প্রত্যক্ষ, কিন্তু নিজেই অপরিচ্ছেদ্য।