অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো ষোলো



বেদান্ত ন্যায়ের অভাব-তত্ত্বকে আংশিকভাবে ব্যবহার করে বলে—যে-বস্তু তিন কালে বাস্তব নয়, কিন্তু কোনো আধারে প্রতীয়মান হয়, সেটিই মিথ্যা। এমন বস্তু না একেবারে সত্য, না একেবারে অসত্য, বরং মধ্যবর্তী—প্রতীয়মান, অথচ চিরকাল অনুপস্থিত। এই অবস্থাকেই বলা হয় সদসদ্বিলক্ষণ, অর্থাৎ “সত্য নয়, অসত্যও নয়”—যা শুধুই প্রতীতি-নির্ভর অস্তিত্ব।

অভাব তত্ত্ব ন্যায়–বৈশেষিক দর্শনের এক বিশেষ ধারণা, যেখানে অস্তিত্বের অনুপস্থিতিকেও একটি বাস্তব পদার্থ হিসেবে ধরা হয়েছে। ন্যায় বলে, অভাব মানে কোনো বস্তুর নির্দিষ্ট কালে বা স্থানে না থাকা। এটি কেবল কল্পনা নয়, বাস্তব, কারণ আমরা অনুপস্থিতিকেও প্রত্যক্ষ করি—যেমন, “এখানে ঘট নেই”। তাই অভাবও একটি জ্ঞানযোগ্য সত্তা, এবং ন্যায়ে এটি সপ্তম পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত।

ন্যায়-দর্শনে “পদার্থ” মানে অস্তিত্বশ্রেণি—যে-সব জিনিস বা সত্তা জ্ঞানের বিষয় হতে পারে। ন্যায় সাতটি পদার্থ মেনে চলে: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সাধারণ, বিশেষ, সমবায় এবং অভাব। এই তালিকায় “অভাব” (অনুপস্থিতি)–কেও আলাদা বাস্তব সত্তা ধরা হয়—কারণ “নেই”-জ্ঞানও তো জ্ঞানই।

দ্রব্য: যা স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল এবং গুণ ও কর্মের আধার। উদাহরণ—মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা, মন।

গুণ: যা নিজে স্বতন্ত্র নয়, দ্রব্যে অবস্থিত হয়ে তার ধর্ম প্রকাশ করে। উদাহরণ—রং, স্বাদ, গন্ধ, সংখ্যা, ভার।

কর্ম: দ্রব্যে সংঘটিত চলন বা ক্রিয়া, যা দ্রব্যকে অবস্থান-পরিবর্তনে প্ররোচিত করে। উদাহরণ—ঊর্দ্ধগমন, অধোগমন, সংকোচন, প্রসারণ, স্থানান্তর।

সাধারণ: বহু দ্রব্যে একভাবে বিদ্যমান সেই শ্রেণীধর্ম, যা তাদেরকে “এক জাতি” বলে চিহ্নিত করে। উদাহরণ—গৌত্ব সব গরুতে, ঘটত্ব সব ঘট/ঘড়ায়।

বিশেষ: পরমাণু বা আত্মার অনন্য ব্যক্তিগত স্বভাব, যা তাকে অন্য সব কিছু থেকে একেবারে পৃথক করে। উদাহরণ—একেক আত্মার স্বাতন্ত্র্য, একেক পরমণুর নিজস্বতা।

সমবায়: আধার-আধেয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, যা বিচ্ছিন্ন করা যায় না। উদাহরণ—কাপড়ে তন্তুর সমবায়, ঘটের সঙ্গে ঘটত্বের সমবায়।

অভাব: অনুপস্থিতি বা ‘নেই’-অবস্থা, যা জ্ঞানযোগ্য এবং চার রূপে ধরা হয়—প্রাগ্‌অভাব (সৃষ্টির আগে না-থাকা), প্রধ্বংসাভাব (ধ্বংসের পরে না-থাকা), অত্যন্তঅভাব (কখনোই না-থাকা), অন্যোন্যাভাব (পারস্পরিক না-হওয়া)। উদাহরণ—টেবিলে এখন ঘট নেই; দড়িতে সাপের চিরকাল অভাব।

“অভাব” জ্ঞানযোগ্য হওয়ার যৌক্তিকতা এভাবে বোঝায়: যখন বলি, “টেবিলে ঘড়া নেই”, তখন আমাদের চেতনায় দুটি জিনিস একসাথে ধরা পড়ছে—(ক) টেবিল (আধার) প্রত্যক্ষ হচ্ছে, এবং (খ) ঘড়া না-থাকার প্রত্যয়ও হচ্ছে। ন্যায় বলে, এই ‘নেই’-প্রত্যয় যদি একেবারে অবাস্তব হত, তবে “নেই” বলে যে সুস্পষ্ট জ্ঞান-অভিজ্ঞতা হয়, তার ব্যাখ্যা দেওয়া যেত না। তাই অনুপস্থিতিও জ্ঞাতব্য—সেই অর্থে “অভাব” একটি পদার্থ।

ন্যায়ে “অভাব” চার ভাগে বিভক্ত:
প্রাগ‌অভাব: উৎপত্তির আগে অনুপস্থিতি (ঘড়া বানানোর আগে ঘড়ার না-থাকা)। এটি অনাদি, কিন্তু উৎপত্তির সাথে শেষ হয়।
প্রধ্বংসাভাব: বিনাশের পর অনুপস্থিতি (ঘড়া ভাঙার পর সেই ঘড়ার না-থাকা)। এটি আরম্ভযুক্ত, কিন্তু সেই ব্যক্তিগত ঘড়ার ক্ষেত্রে অনন্ত।
অত্যন্ত‌অভাব: কোনো কালে, কোনো অবস্থায়, কোনো আধারেই না-থাকা (শশশৃঙ্গ, আকাশপুষ্প)। নিরবচ্ছিন্ন অনুপস্থিতি—আদি-অনন্ত।
অন্যোন্য‌অভাব: পারস্পরিক নৈর্ব্যক্তিকতা/অপরিচয় (ঘড়া ঘড়াই, কাপড় নয়; কাপড় কাপড়ই, ঘড়া নয়)।

এই চার প্রকার অভাবে তিনটি ধারণা সবসময় যুক্ত থাকে—(i) আধার/আশ্রয় (যেখানে অভাবটি ধরা হচ্ছে), (ii) প্রতিযোগী বা প্রতিয়োগী (যার অভাব ধরা হচ্ছে—যেমন ‘ঘড়া’), (iii) কাল-নির্দেশ (কখন না-থাকা বলা হচ্ছে—পূর্বে/পরে/সবকালে)। “টেবিলে ঘড়ার অভাব”—এখানে টেবিল আধার, ঘড়া প্রতিযোগী, আর “এখন” হলো কাল-উল্লেখ।

“অভাব” কীভাবে জানা যায়—এই নিয়ে দর্শন-ভিত্তিক মতভেদ আছে।

প্রথমে সমস্যা স্পষ্ট করি: “নেই”—এই জ্ঞানটা কীভাবে হয়? দর্শনে প্রশ্নটি হলো, উপযুক্ত শর্তে কোনো বস্তু “না-দেখা/না-পাওয়া” থেকে কি সরাসরি “অনুপস্থিতি” জানা যায়, না কি সেটা কেবল অনুমানের ফল।

ন্যায়ের মূল অবস্থান হলো—“অনুপলব্ধি” আলাদা কোনো প্রমাণ নয়। যেখানে, কিছু থাকলে—দেখা/শোনার সব শর্ত পূরণসাপেক্ষে (আলো, দূরত্ব, আড়াল-অনুপস্থিতি, ইন্দ্রিয় ও মনোযোগ সচল) দেখা/শোনা হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, তবু দেখা/শোনা না হয়—সেখানে “নেই” বলে অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত। অর্থাৎ ‘না-দেখা’ নিজে প্রমাণ নয়; ‘না-দেখা + দেখা হওয়ার সব শর্ত ছিল’—এই যুগল থেকে “অভাব” সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। এটিই ন্যায়ে ‘অনুবৃত্তি’-নির্ভর অনুমান।

‘অনুবৃত্তি’ মানে কোনো গুণ, বৈশিষ্ট্য বা শব্দার্থের বার বার উপস্থিতি/সাধারণভাবে বহুবস্তুর মধ্যে পুনরাবৃত্ত হয়ে থাকা। প্রসঙ্গভেদে এর দুটি প্রধান ব্যবহার দেখা যায়—দর্শন-তত্ত্বে (ন্যায়/মীমাংসা) এবং ব্যাকরণে (পাণিনীয় সূত্রপ্রণালী)।

প্রথমত, দর্শনে অনুবৃত্তি দিয়ে বোঝানো হয় সাধারণ ধর্মের পুনরাবৃত্ত উপস্থিতি—যে-গুণ বহু সত্তায় সমানভাবে থাকে। যেমন “গৌত্ব” সব গরুতে অনুবৃত্ত; “ঘটত্ব” সব ঘট/ঘড়ায় অনুবৃত্ত; “নীলত্ব” সব নীল বস্তুর মধ্যে অনুবৃত্ত। এখানেই “অনুবৃত্তি”র বিপরীত ধারণা “ব্যাভৃত্তি” (ব্যবহৃত হয় “ব্যাবৃত্তি/বৈবৃত্তি” বলেও)—যা অন্যদের থেকে বর্জন/ভেদ ঘটায়। অর্থাৎ, সাধারণ (সামান্য) চিহ্নিত হয় অনুবৃত্তিতে; বিশেষ চিহ্নিত হয় ব্যাভৃত্তিতে।

ন্যায়ে “সাধারণ” (সামান্য) মানে হলো অনুবৃত্তিধর্মী সত্তা—যা অনেকের মধ্যে সাধারণ। “বিশেষ” (বিশেষধর্মী সত্তা) মানে হলো ব্যাভৃত্তিধর্মী সত্তা—যা প্রত্যেককে অন্যদের থেকে আলাদা করে। “অনুবৃত্তি” সৃষ্টি করে জাতিগত ঐক্য, “ব্যাভৃত্তি” সৃষ্টি করে ব্যক্তিগত ভেদ।

গৌত্ব সব গরুতে অনুবৃত্ত, কিন্তু “গরু” ও “ঘোড়া”-র মধ্যে পার্থক্য যে গুণে তৈরি হয়—যেমন শিং, দেহগঠন, ডাক—তা হলো ব্যাভৃত্তি।
ঘটত্ব সব ঘট/ঘড়ায় অনুবৃত্ত, কিন্তু একঘটের রঙ, আকার, অবস্থান ইত্যাদি গুণ অন্য ঘট থেকে পৃথক করে—এগুলো ব্যাভৃত্তি।
“মানুষ” জাতির মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে পৃথক করে—বুদ্ধি, ভাষা, নীতি—সেগুলোও ব্যাভৃত্তির প্রকাশ।

দ্বিতীয়ত, ন্যায়ীয় অনুমানে “ব্যাপ্তি” স্থাপন করতে আমরা বাস্তবে দেখি—যেখানে যেখানে হেতু আছে, সেখানে সেখানে সাধ্যও আছে; এই “একসঙ্গে থাকার” ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণকে বলা যায় সাধ্যধর্মের অনুবৃত্তি-সহ হেতুর উপস্থিতি। আবার যেখানে হেতু নেই, সেখানে সাধ্যও নেই—এটি ব্যতিরেক/ব্যাভৃত্তির দিক। ফলে অন্বয়-ব্যতিরেক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ‘হেতু-সাধ্য সম্পর্ক’-কে দৃঢ় করি; এই প্রেক্ষিতে “অনুবৃত্তি” শব্দটি সহ-উপস্থিতির ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

ব্যাকরণে “অনুবৃত্তি” মানে সন্ধি/সংক্ষেপের কারণে পূর্বসূত্রের কোনো পদ বা শর্ত পরবর্তী সূত্রে “বয়ে আসা”—অর্থাৎ, আগের নিয়মের শব্দার্থ বা নির্দেশ পরের নিয়মেও অঘোষিতভাবে প্রযোজ্য থাকে। এটি পাণিনীয় সূত্রপদ্ধতির একটি কারিগরি কৌশল, যাতে ভাষা সংক্ষিপ্ত থাকে, তবু প্রযোজন বহাল থাকে।

উদাহরণ ধরে বুঝলে সহজ: “গৌত্ব” সব গরুতে অনুবৃত্ত—এজন্য গরুদের এক “জাতি” বলা যায়; কিন্তু ওই “গৌত্ব” ঘোড়ায় নেই—এখানে ঘোড়ার সঙ্গে গরুর ব্যাভৃত্তি হলো ভেদ। আবার অনুমানে, ধোঁয়া দেখা যায় যেখানে যেখানে, সেখানেই আগুনও দেখা যায়—ধোঁয়ার সঙ্গে আগুনের সহ-উপস্থিতির অনুবৃত্তি থেকে “ধোঁয়া—আগুন” ব্যপ্তি স্থির করি; যেখানে ধোঁয়া নেই, সেখানে আগুনও সাধারণত নেই—এটা ব্যতিরেকের দিক।

সংক্ষেপে, অনুবৃত্তি হলো সাধারণ ধর্মের বহু আধারে পুনরাবৃত্ত উপস্থিতি (দর্শনে), এবং পূর্বসূত্রের উপাদানের পরসূত্রে বহাল থাকা (ব্যাকরণে)। দর্শন-আলোচনায় এটি সাধারণত সামান্য/ব্যাপ্তি/অন্বয় বিশ্লেষণের সঙ্গে যুক্ত; ব্যাকরণে এটি সূত্র-প্রয়োগ সংক্ষিপ্ত করার উপায়।

নব্য-ন্যায় এই আলোচনা সূক্ষ্ম করে বলে—কিছু পরিস্থিতিতে অনুপস্থিতিকে প্রত্যক্ষজ্ঞান হিসেবেও ধরা যায়; একে তারা “অভাব-প্রত্যক্ষ” বলে। তবে তারা এটাকে আলাদা নতুন প্রমাণ বানায় না; এটিই প্রত্যক্ষের বিশেষ রূপ—ইন্দ্রিয়-সংযোগ ঘটে “আধার-সহিত অভাব”-এর সঙ্গে (যেমন, টেবিল এখন ঘড়া-শূন্য—এইটাই প্রত্যক্ষজ্ঞানে ধরা পড়ে)।

ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈত দর্শনের মতে, “অনুপলব্ধি” একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ—অর্থাৎ এটি অন্য কোনো প্রমাণ (যেমন প্রত্যক্ষ বা অনুমান)-এর মধ্যে পড়ে না, বরং নিজেই একটি নতুন জ্ঞানপথ। তারা বলে, আমরা অনেকসময় কোনো বস্তুকে “না-পাওয়া” বা “না-দেখা” থেকেই সরাসরি জানি যে, সেটি নেই; এই জ্ঞানটি মধ্যবর্তী কোনো অনুমান নয়, বরং সরাসরি অভাব-জ্ঞান।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক—তুমি আলো-জ্বালানো ঘরে তাকিয়ে দেখছ, টেবিলের উপর ঘড়া নেই। তুমি এখানে কোনো অনুমান করছ না—“ঘড়া থাকলে দেখা যেত, দেখা যায়নি, তাই নেই”—এই বিশ্লেষণ তোমার মনে আলাদা করে আসে না; বরং তুমি তা একমুহূর্তেই সরাসরি জানো। এই “সরাসরি নেই জানা”—এটাই অনুপলব্ধি-জাত জ্ঞান।

এই সরাসরিত্বই তাদের যুক্তির মূলকথা। তারা বলে, যদি “না-পাওয়া”-কে কেবল অনুমান বলি, তাহলে আমাদের দৈনন্দিন অসংখ্য অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, আমরা প্রতিনিয়ত এইভাবে জ্ঞান লাভ করি—“এখানে কলম নেই”, “ঘরে মানুষ নেই”, “আকাশে সূর্য নেই”—এগুলো কোনো যুক্তিতর্ক বা অনুমান করে নয়, তৎক্ষণাৎ বোঝা যায়। তাই এই ধরনের জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে হলে “অনুপলব্ধি”-কে আলাদা প্রমাণ মানতে হবে।

এই প্রমাণ কার্যকর হওয়ার জন্য কিছু শর্ত লাগে—প্রথমত, যা খুঁজছি, তা ওই অবস্থায় থাকলে ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ার কথা; দ্বিতীয়ত, ইন্দ্রিয় ও আলো ঠিক আছে, আড়াল নেই, মনোযোগও আছে। এসব শর্ত পূর্ণ হলে “না-পাওয়া” থেকেই “নেই”—এই জ্ঞান হয়। অর্থাৎ, কোনো বস্তু উপস্থিত থাকলে অবশ্যই প্রতীয়মান হতো—কিন্তু প্রতীয়মান হয়নি—এটাই অভাবের জ্ঞান।

এই কারণেই ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈত বলে, “অনুপলব্ধি” কেবল অনুমান নয়; এটি অভাব-জ্ঞানের স্বতন্ত্র প্রমাণ, যেখানে না-পাওয়া বা না-দেখাই সরাসরি “অভাব”-এর চেতনা সৃষ্টি করে।

অনুপলব্ধি কার্যকর হতে যা যা শর্ত লাগে—(ক) ইন্দ্রিয়-উপায় ঠিক আছে, (খ) আলো/দূরত্ব/আড়াল ইত্যাদি উপযোগী, (গ) মনোযোগ আছে, (ঘ) যে-বস্তুকে খুঁজছি, সে ওই অবস্থায় ইন্দ্রিয়গোচর হওয়ারই কথা। এই সব থাকলে ‘না-পাওয়া’ মানেই ‘নেই’—এটাই অনুপলব্ধি-জাত জ্ঞান।

ব্যাপক ও ব্যাপ্য—এই দুটি ধারণা ন্যায়-দর্শনের অনুমান প্রমাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যাপক মানে, যে ধর্ম বা বস্তু সর্বত্র অন্যটিকে আচ্ছাদিত করে বা অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বৃহত্তর সত্তা। ব্যাপ্য মানে, যে ধর্ম বা বস্তু সর্বদা সেই ব্যাপকের অন্তর্গত থাকে, তার বাইরে কখনও দেখা যায় না। এটি ক্ষুদ্রতর বা নির্ভরশীল সত্তা।

অনুমান বা তর্কে আমরা যখন বলি, “যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে আগুন আছে,” তখন আগুনই ব্যাপক, কারণ আগুন সর্বত্র ধোঁয়াকে ধারণ করে। ধোঁয়া হলো ব্যাপ্য, কারণ ধোঁয়া সর্বদা আগুনের উপর নির্ভর করে; আগুন না থাকলে সাধারণত ধোঁয়া হয় না।

অন্যভাবে বললে, যেখানে ব্যাপ্য আছে, সেখানে ব্যাপক অবশ্যই আছে; কিন্তু ব্যাপক থাকতে পারে ব্যাপ্য ছাড়াও। যেমন, আগুন ধোঁয়া ছাড়াও থাকতে পারে (যেমন শুকনো গরম লোহার পাত)। তাই আগুন ব্যাপক, ধোঁয়া ব্যাপ্য।

এই সম্পর্কই অনুমানের ভিত্তি—যাকে বলা হয় “ব্যাপ্তি-সম্পর্ক”। এটি এমন এক অবিচ্ছেদ্য সংযোগ, যেখানে একটির উপস্থিতি অন্যটির উপস্থিতি নিশ্চিত করে।

উদাহরণ হিসেবে—যেখানে জল আছে, সেখানে বাষ্প হতে পারে। এখানে জল ব্যাপক, আর বাষ্প ব্যাপ্য, কারণ বাষ্প সর্বদা জলের অস্তিত্বে নির্ভরশীল।

ব্যাপক হলো বৃহত্তর বা আচ্ছাদক সত্য; ব্যাপ্য হলো তার অন্তর্গত নির্ভরশীল রূপ। অনুমানে যখন আমরা “যেখানে ব্যাপ্য আছে, সেখানে ব্যাপক আছে”, এই নিয়মে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, তখনই আমরা নিশ্চিতভাবে এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুর অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি।