চূড়ান্ত স্তরে, দ্বিতীয় অপবাদ ঘটে—“নেতি নেতি”—এ নয়, ও নয়; “তত্ত্বমসি”—তুমি-ই সেই। এখানে সব আরোপ প্রত্যাহৃত হয়: ঈশ্বর, সৃষ্টি, শক্তি, মায়া—সব ভেদ বিলীন। কেবল থাকে স্বয়ং ব্রহ্ম, নির্গুণ, নিরাকার, স্বপ্রকাশ চেতনা।
অতএব, অধ্যারোপ–অপবাদ ধাপে ধাপে ঘটে: প্রথমে জগতের দেবতা-ঈশ্বর ভাব, পরে ঈশ্বরকে চেতনা বলে বোঝা, তারপর ব্রহ্মকে মায়া-সহ ঈশ্বররূপে ধরা, এবং শেষে সমস্ত মায়া-ঈশ্বর-জগৎ প্রতীতিকে প্রত্যাহার করে নিঃশেষে এক ব্রহ্মের প্রকাশ।
এই ক্রমে শেষে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না—না কোনো রূপ, না কারণ, না শক্তি—শুধু অনাদি অনন্ত চেতনা, যা নিজেই নিজের দ্বারা প্রকাশিত। তাই শঙ্কর বলেন, “অধ্যারোপ–অপবাদাভ্যাং নিঃশেষণং পরমার্থতঃ”—আরোপ ও প্রত্যাহারের এই দ্বৈত প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পরমার্থের উপলব্ধি সম্পূর্ণ হয়।
উল্লেখ্য, “অধ্যারোপ–অপবাদাভ্যাং নিঃশেষণং পরমার্থতঃ”—এই বাক্যটি সরাসরি শঙ্করাচার্যের মূল ভাষ্যে নেই, কিন্তু এর ভাব পুরোপুরি শঙ্করীয়। এটি পরবর্তী আচার্যদের দ্বারা গঠিত একটি সংক্ষিপ্ত সূত্ররূপ বাক্য, যা শঙ্করাচার্যের শিক্ষার সারমর্ম প্রকাশ করে।
এর মূল ভাব শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (২.১.১৪), তৈত্তিরীয় উপনিষদ ভাষ্য (২.১.১), এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ ভাষ্য (২.১.২০)-এ পাওয়া যায়। সেখানে শঙ্কর বলেন—অধ্যাসই দুঃখের মূল; শাস্ত্রের উদ্দেশ্য এই অধ্যাসের নিবারণ। শাস্ত্র প্রথমে জগৎ, ঈশ্বর, কর্ম ইত্যাদি আরোপ করে (অধ্যারোপ), পরে অপবাদের মাধ্যমে সেগুলি প্রত্যাহার করে ব্রহ্মজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করে।
এই পদ্ধতির সারাংশকে পরবর্তী আচার্যরা এক বাক্যে প্রকাশ করেছেন—“অধ্যারোপ–অপবাদাভ্যাং নিঃশেষণং পরমার্থতঃ”। অর্থাৎ, আরোপ ও প্রত্যাহারের মাধ্যমে পরমার্থস্বরূপের সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটে।
এই উক্তি পরে স্পষ্টভাবে দেখা যায় মধুসূদন সরস্বতীর “সিদ্ধান্তলেশসংগ্রহ”, বিধ্যারণ্য স্বামীর “পঞ্চদশী”, এবং “তত্ত্ববোধিনী টীকা”, “বেদান্তসার” প্রভৃতি গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, শাস্ত্র প্রথমে জগৎ, ঈশ্বর, মায়া প্রভৃতি আরোপ করে, পরে ‘নেতি নেতি’ প্রক্রিয়ায় সেগুলি প্রত্যাহার করে। এই দুই প্রক্রিয়াতেই পরমার্থ সত্য প্রকাশ পায়।
অধ্যারোপ মানে আরোপ বা প্রতিস্থাপন—যেমন জ্ঞানী না হওয়া পর্যন্ত ঈশ্বর ও সৃষ্টির ধারণা মেনে নেওয়া। অপবাদ মানে প্রত্যাহার বা নিবারণ—যেমন ‘নেতি নেতি’ বলে সব আরোপিত ধারণা বিলোপ করা। নিঃশেষণ মানে অবশিষ্টহীন করা, পরমার্থতঃ মানে পরম সত্যের স্তরে। অর্থাৎ, শাস্ত্র প্রথমে আরোপের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়, পরে অপবাদের মাধ্যমে মায়া দূর করে; শেষে যা অবশিষ্ট থাকে, তা-ই পরমার্থ ব্রহ্ম।
মূলাবিদ্যা, আশ্রয়, এবং আচ্ছাদনের আংশিক-সামষ্টিক বিলোপ—এই তিনটি সূক্ষ্ম ধারণা একসাথে ধরলে বোঝা যায়, অবিদ্যা কখনোই পরমার্থে বাস্তব নয়, কিন্তু ব্যাবহারিক ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয়। তাই শঙ্করাচার্যের অধ্যারোপ-অপবাদই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি—প্রথমে মনের হাতে ধারণা তুলে দেওয়া, পরে সেই ধারণাটাই ছেড়ে দেওয়া। জ্ঞানের কাজ হলো ধারণার ওপারে নিয়ে যাওয়া; ধারণা তখন কেবল সিঁড়ি, যেটি সত্য উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজেই বিলীন হয়।
মূলাবিদ্যাকে ‘ভাবরূপ’ বলা মানে অবিদ্যাকে কোনো স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং কেবল বোঝানো যে, নিছক ‘অভাব’ কখনও কোনো ফল সৃষ্টি করতে পারে না। যদি অবিদ্যা কেবল অভাবরূপ হতো, তবে তা থেকে নাম-রূপ, বিভ্রম, জগৎ বা কর্তা-ভোক্তা-ভাবের মতো কার্য প্রকাশ পেত না। তাই বলা হয়, অবিদ্যা কার্যক্ষম এক শক্তি—এমন এক সামর্থ্য, যা লুকিয়ে রাখে (আবরণ) এবং দেখায় বা প্রক্ষেপণ করে (বিক্ষেপ)। এই দুই ক্রিয়া-ক্ষমতাই অবিদ্যার ভাবরূপতা নির্দেশ করে।
তবে এই ‘ভাবরূপ’ কোনো অস্তিত্বগত সত্য নয়, বরং ব্যাবহারিক স্তরে উপযোগী এক ধারণা—শিক্ষণ ও ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজনীয়। প্রাতিভাসিক ও ব্যাবহারিক স্তরে অবিদ্যা কার্যক্ষম, কারণ আমরা তার প্রভাব দেখতে পাই—ভুল ধারণা, দুঃখ, বিভ্রম, মায়াজাল। কিন্তু পারমার্থিক স্তরে অবিদ্যা অনির্বচনীয়—না সত্য, না মিথ্যা; কারণ সত্য হলে জ্ঞানেও থাকত, মিথ্যা হলে অভিজ্ঞতায় আসত না। তাই এর অস্তিত্ব কেবল আপাত, জ্ঞানের আলোয় নিবার্য।
অবিদ্যার শক্তিকে আমরা সরাসরি দেখতে পাই না, তার ফল দিয়েই চিনি। যেমন অন্ধকারকে আলাদা করে দেখা যায় না, দেখা যায় কেবল আলোয়ের অনুপস্থিতি ও কোনো বস্তুর আচ্ছাদনের বিভ্রম; তেমনি অবিদ্যাকে আমরা দেখি না, দেখি তার আবরণ ও প্রক্ষেপণের ফল—চেতনার উপর নাম-রূপের ছায়া, যা আলোকিত হলেই বিলীন হয়।
এইভাবে ‘ভাবরূপ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় কার্যোপযোগিতার জন্য, এমন নয় যে, অবিদ্যা কোনো দ্বিতীয় সত্তা। এটি এক দার্শনিক অনুপম সূক্ষ্মতা—অবিদ্যা বাস্তব নয়, কিন্তু কার্যক্ষম; অনাদি, কিন্তু অনন্ত নয়; অনুভূত, কিন্তু অনির্বচনীয়। জ্ঞান প্রকাশ পেলেই তার আবরণ ও বিক্ষেপ উভয়ই বিলীন হয়, এবং দেখা যায়—কখনও কোনো দ্বিতীয় সত্তাই ছিল না; যা ছিল, তা কেবল চেতনার ওপর সাময়িক ছায়া মাত্র।
আশ্রয়-সমস্যার সমাধান দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর। অবিদ্যা নিয়ে ভুলটি যার সম্পর্কে হচ্ছে, সেই চেতনার ‘উপরেই’ ভুলটি পড়ে। যেমন দড়ির উপর সাপ আরোপিত হয়, তেমনি ব্রহ্মের উপর জগৎ আরোপিত হয়—এই অর্থে ব্রহ্ম ‘বিষয়’ (viṣaya) বা ‘অধিষ্ঠান’ (adhiṣṭhāna)। কিন্তু ভুলটি টিকে থাকে যে-‘চেতন-আভাসে’ (chidābhāsa)—অর্থাৎ, সেই প্রতিফলিত চেতনা, যা জীব-বুদ্ধিতে প্রকাশ পেয়েছে—তাকে বলা হয় অবিদ্যার ‘আশ্রয়’।
ব্যষ্টি-দৃষ্টিতে বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্তরে তাই বলা যায়, অবিদ্যা জীবাশ্রয়; কারণ অজ্ঞান এবং তার বিলোপ উভয়ই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে ঘটে—“আমার অজ্ঞান আমার জ্ঞানে দূর হয়”। কিন্তু সমষ্টি-দৃষ্টিতে (samaṣṭi-dṛṣṭi) দেখা যায়, এই সমস্ত জীব-বুদ্ধির পটভূমি একটিই—সেই অপরিবর্তনীয় চৈতন্য, ব্রহ্ম। সেই ব্রহ্মই সমষ্টিগত দৃষ্টিতে অধিষ্ঠান, যেহেতু তার উপস্থিতি ছাড়া কোনো বিভ্রমই সম্ভব নয়।
কিন্তু পারমার্থিক স্তরে, অর্থাৎ, চূড়ান্ত সত্যে, আশ্রয়-প্রশ্নের কোনো উপপত্তি (যুক্তি-সমর্থিত ব্যাখ্যা বা প্রমাণ, যার দ্বারা কোনো দার্শনিক বা তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়) থাকে না। কারণ অবিদ্যাই অনির্বচনীয়—না বাস্তব, না অবাস্তব; তাই এর জন্য স্থায়ী আশ্রয় খোঁজা বৃথা। চেতনার প্রতিফলনেই যেন অবিদ্যা ‘দেখা’ যায়, কিন্তু সত্যে পৌঁছালে এই দেখা নিজেই মায়া বলে প্রমাণিত হয়।
এই দ্বিস্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে উভয় আপত্তিই প্রশমিত হয়। ব্রহ্মের উপর কোনো দোষ বা পরিবর্তন আরোপ হয় না, কারণ তিনি অধিষ্ঠান মাত্র, আশ্রয় নন; আর জীবের মনকে যদি নিছক অবিদ্যার ফল বলা হয়, তবু তার মধ্যেই অজ্ঞান কার্যকরভাবে বোঝানো যায়, কারণ এখানে আশ্রয় মানে কোনো সৃষ্টিকারক নয়, বরং মানসিক প্রতিফলনের ক্ষেত্র।
অতএব, অবিদ্যার আশ্রয় সমস্যা মূলত দৃষ্টিভঙ্গির স্তরভেদে সমাধান পায়—ব্যষ্টিতে জীবাশ্রয়, সমষ্টিতে ব্রহ্মাধিষ্ঠান, এবং পরমার্থে আশ্রয়-অনুপপত্তি। এইভাবে দেখা গেলে অবিদ্যা ও জ্ঞানের সম্পর্ক ব্যাখ্যাযোগ্য হয়, অথচ ব্রহ্মের নির্দোষতা ও অদ্বৈত স্বরূপও অক্ষুণ্ণ থাকে।
আশ্রয়-অনুপপত্তি মানে হলো—যখন সত্তা বা ধারণার কোনো ভিত্তি বা আশ্রয় যুক্তিসংগতভাবে স্থাপন করা যায় না, সেই অবস্থার অনুপপত্তি বা অযৌক্তিকতা। এটি মূলত অদ্বৈত বেদান্তের অবিদ্যা-তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিবাদী আপত্তি, যা অবিদ্যার আশ্রয় কোথায়—এই প্রশ্নকে ঘিরে ওঠে।
আশ্রয় মানে ভিত্তি বা অধিষ্ঠান—যেখান থেকে কিছু স্থিত বা উদ্ভূত হয়। অনুপপত্তি মানে—যুক্তিসংগতভাবে স্থাপন করা যায় না বা অসম্ভবতা। অর্থাৎ, আশ্রয়-অনুপপত্তি মানে—কীসের উপর নির্ভর করে এই জিনিসটির অস্তিত্ব ধরা হবে, তা যুক্তি দিয়ে বলা যায় না।
অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়, অবিদ্যা বা অজ্ঞতা সব দুঃখ ও ভ্রান্তির মূল কারণ। কিন্তু এই অবিদ্যা কোথায় অবস্থান করে—এই প্রশ্নে বিতর্ক ওঠে। যদি বলা হয়, ব্রহ্মের মধ্যে অবিদ্যা থাকে, তাহলে তা অসম্ভব, কারণ ব্রহ্ম তো নিত্য, চৈতন্য, সর্বজ্ঞানস্বরূপ—সেখানে অজ্ঞান থাকতে পারে না। আবার যদি বলা হয়, জীবের মধ্যে অবিদ্যা থাকে, তাহলে সমস্যাটি আরও বাড়ে, কারণ জীব তো অবিদ্যারই ফল; অবিদ্যা ছাড়া জীবের ধারণাই হয় না। ফলে দেখা যায়, অবিদ্যার কোনো স্থির আশ্রয় ধরা যায় না; এই যুক্তিগত দুরবস্থাকেই বলা হয় আশ্রয়-অনুপপত্তি।
বেদান্তে অবিদ্যার অনুপপত্তি চারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে—আশ্রয়-অনুপপত্তি, যেখানে অবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করা যায় না; বিষয়-অনুপপত্তি, যেখানে অবিদ্যা কীসে প্রয়োগ হয়, তা অনির্দিষ্ট; জ্ঞান-অনুপপত্তি, যেখানে প্রশ্ন ওঠে, অবিদ্যা থাকলে জ্ঞান সম্ভব কীভাবে; এবং নিবৃত্তি-অনুপপত্তি, যেখানে অবিদ্যা দূর হলে তার সম্পূর্ণ বিলোপ কীভাবে হয়, তা নিয়ে যুক্তিগত জটিলতা থাকে।
শঙ্কর ও তার পরবর্তী আচার্যরা বলেন, অবিদ্যা না ব্রহ্মে, না জীবেতে; বরং এটি অব্যাবহারিক স্তরে ধরা যায়—যেখানে চেতনা নিজেই আচ্ছন্ন প্রতীয়মান হয়। এটি পরমার্থত সত্য নয়, আবার একেবারে মিথ্যাও নয়; বরং অনির্বচনীয়। তাই এর আশ্রয় নিয়ে যুক্তি-তর্ক বৃথা, কারণ যেখানে অবিদ্যা আছে, সেখানেই আশ্রয়-প্রশ্ন ওঠে; জ্ঞান হলে প্রশ্নই থাকে না।
আশ্রয়-অনুপপত্তি মানে অবিদ্যার কোনো স্থির আশ্রয় যুক্তি দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। ব্রহ্মে দিলে বিরোধ, জীবেতে দিলে চক্রবৃত্তি—অতএব এটি অনির্ণেয়। যেখানে অবিদ্যা, সেখানেই আশ্রয়-প্রশ্ন ওঠে; আর যেখানে জ্ঞান, সেখানে আর কোনো প্রশ্ন অবশিষ্ট থাকে না।
আবরণ-শক্তির বিলোপ একসঙ্গে সবার মধ্যে ঘটে না—এই আপাত অসংগতি স্তরবিভাগে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। জ্ঞান যখন কারও মধ্যে উদিত হয়, তখন তা প্রথমে তাঁর আত্ম-আবরণ ভেদ করে; এটিই নিবৃত্তি-লক্ষণ জ্ঞান—যা নতুন কিছু সৃষ্টি করে না, কেবল অজ্ঞান সরিয়ে দেয়। কিন্তু বিক্ষেপ-শক্তির গতি সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় না; প্রারব্ধ-কর্মের ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া কিছুদিন অবশিষ্ট থাকে। এই অবস্থায় জ্ঞানী দেহ-মন-জগৎকে দেখে, কিন্তু তা আর তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে না; দগ্ধ দড়ির মতো রূপ থাকে, বাঁধন থাকে না।
ব্যক্তির আবরণ সরে গেলে তাঁর দৃষ্টিতে জগৎ লীলা হয়ে ওঠে—ব্যবহার আছে, বাঁধন নেই। তিনি জানেন, যা দেখা যাচ্ছে, তা ব্রহ্মেরই প্রকাশ, তাই সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে আর আবদ্ধ করে না। কিন্তু সমষ্টিগত মায়া অন্য চিত্তে তখনও সক্রিয় থাকে; তাই জগৎ বহির্দৃষ্টিতে চলতে থাকে—মানুষ কাজ করে, কথা বলে, সুখ-দুঃখ ভোগ করে। জ্ঞানীর কাছে এগুলির আর কোনো সত্য-দাবি থাকে না; সেগুলি বাধিত, অনির্বচনীয়, নির্ভর—মায়ারই অবশিষ্ট প্রতিফলন।
জীবন্মুক্ত সেই অবস্থায় জ্ঞানী যেমন জলের উপর চাঁদের প্রতিফলন দেখেন—চাঁদের ঝিকিমিকি আছে, কিন্তু তা চাঁদ নয়; তেমনি জগৎ দেখেন, তিনি জানেন জগতের অধিষ্ঠান কেবল ব্রহ্ম। দেহ ঝরে পড়লে, যখন প্রারব্ধের শেষ অংশও নিভে যায়, তখন সেই সামান্য ধোঁয়াটুকু—জগতপ্রতীতি, দেহবোধ, কর্মপ্রবাহ—সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়; এই অবস্থাকেই বলে বিদেহমুক্তি। তখন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না—কেবল চিরনির্বাণ, অখণ্ড চৈতন্য, ব্রহ্মস্বরূপ শান্তি।
শঙ্করের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবিদ্যার অনাদিত্ব মানে হলো, এর কোনো কালগত সূচনা নেই—এটি কখনও “শুরু” হয়নি; কারণ এটি কোনো উৎপন্ন বস্তু নয়। অনাদি মানে অনন্তকালব্যাপী নয়, বরং কালের বাইরে থাকা—অর্থাৎ, এমন এক অবস্থা, যার আরম্ভ নির্দিষ্ট করা যায় না। ঠিক যেমন অন্ধকারের কোনো “সৃষ্টিকাল” নেই, তেমনি অবিদ্যা কেবল জ্ঞানের অনুপস্থিতি হিসেবে প্রতীয়মান, নিজস্ব সত্তা হিসেবে নয়।
নিবার্যতা মানে, জ্ঞান উদিত হলেই অবিদ্যা তৎক্ষণাৎ বিলীন হয়। কারণ জ্ঞান ও অজ্ঞান একসঙ্গে থাকতে পারে না—যেমন সূর্য উঠলে অন্ধকার নিজে থেকেই সরে যায়। অবিদ্যা কখনও বাস্তব সৃষ্ট পদার্থ নয় যে, তাকে ধ্বংস করতে হবে; এটি কেবল চেতনার উপরে এক অনাদি আচ্ছাদন, যা জ্ঞানের অভাবে টিকে থাকে।