কৈবল্য (Kaivalya) বলতে ভারতীয় দর্শনে, বিশেষত যোগ ও সাংখ্য এবং কখনো কখনো বেদান্তে, বোঝায় পরম মুক্তি বা একাকিত্ব। এটি হলো পুরুষের (বিশুদ্ধ চৈতন্য) প্রকৃতি (জড় জগত ও মন) থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা বা স্বাতন্ত্র্য। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে পুরুষ (পুরুষ/আত্মা) প্রকৃতির প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে তার নিজস্ব বিশুদ্ধ স্বরূপ লাভ করে।
কৈবল্যের প্রধান লক্ষণসমূহ ধাপে ধাপে নিচে ব্যাখ্যা করা হলো—
স্বরূপে অবস্থান (নিজস্ব স্বরূপে প্রতিষ্ঠা): কৈবল্যের মূলে আছে পুরুষের স্ব-প্রতিষ্ঠা—অর্থাৎ চেতনা নিজের বিশুদ্ধ চৈতন্যময় স্বরূপে স্থিত হয়। তখন দেহ, মন ও বুদ্ধির সঙ্গে একাত্মতার ভ্রান্তি সম্পূর্ণ বিলীন হয়। পুরুষ আর কোনো “আমি” বা “আমার” ধারণার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেখে না।
অ-কর্তৃত্ব (Non-doership): এই অবস্থায় পুরুষ নিজেকে কর্মের কর্তা বা ফলের ভোক্তা বলে মনে করে না। সে জানে, সমস্ত কর্ম প্রকৃতির গুণের দ্বারা সংঘটিত হয়। ফলে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ তাকে প্রভাবিত করতে পারে না; সে থাকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও অচঞ্চল।
প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতা (Separation from Prakṛti): কৈবল্যের আরেক প্রধান লক্ষণ হলো প্রকৃতির সমস্ত বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ। পুরুষ আর প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন মনে করে না। মন, ইন্দ্রিয়, দেহ—সবই প্রকৃতির অংশ, কিন্তু চেতনা তাদের ঊর্ধ্বে।
ক্লেশের বিনাশ (Destruction of Afflictions): কৈবল্য অবস্থায় পাঁচটি ক্লেশ—অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ—সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। অজ্ঞান ও অহংকারের অবসানে মন আর কোনো ভয় বা আসক্তি অনুভব করে না; এটি নির্মল, নির্ভয় ও স্বাধীন হয়।
গুণাতীত অবস্থা (Transcending the Guṇas): মুক্ত পুরুষ প্রকৃতির তিন গুণ—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এর প্রভাবে আর পরিচালিত হয় না। গুণগুলির কার্য সমাপ্ত হয়, কারণ তাদের উদ্দেশ্য (পুরুষের অভিজ্ঞতা ও মুক্তি) পূর্ণ হয়েছে। গুণরা নিস্তব্ধ হয়ে নিজ উৎসে লীন হয়, আর পুরুষ থাকে গুণাতীত, পরম শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
বিবেকখ্যাতি (Discriminative Knowledge): কৈবল্যের জ্ঞান হলো অবিচল বিবেক-প্রকাশ—যেখানে পুরুষ ও প্রকৃতির চিরভেদ স্পষ্টভাবে উপলব্ধি হয়। যোগসূত্রে (২.২৬-২.২৭) বলা হয়েছে, এই নিরবচ্ছিন্ন ভেদজ্ঞানই দুঃখ-নিবৃত্তির উপায়। যখন যোগী সর্বদা সচেতন থাকেন যে “যা পরিবর্তনশীল, তা আমি নই”, তখনই তিনি মুক্ত।
কর্মের অবসান (Cessation of Karma): কৈবল্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কর্মের সম্পূর্ণ নিবৃত্তি—যেখানে সমস্ত পূর্বকৃত কর্ম (সংস্কার ও ফলসহ) বিলীন হয়, এবং নতুন কোনো কর্ম আর জন্ম নেয় না।
প্রারব্ধ কর্মের সমাপ্তি (End of Prārabdha Karma): যিনি জীবন্মুক্ত (জীবিত অবস্থায় মুক্ত), তাঁর ক্ষেত্রে প্রারব্ধ কর্ম—যে-কর্মফল বর্তমান দেহের জন্ম দিয়েছে—তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেহধারণ অব্যাহত থাকে। এই প্রারব্ধই তাঁর শারীরিক অস্তিত্ব বজায় রাখে। কিন্তু মৃত্যুর পর, অর্থাৎ বিদেহ-মুক্তির সময়, সমস্ত কর্ম সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ হয়। তখন আর কোনো কর্মের অবশিষ্ট থাকে না, কারণ কর্মের ভোক্তা ‘আমি’-বোধই আর থাকে না।
নব কর্মের অভাব (Absence of New Karma): মুক্ত পুরুষ কোনো নতুন কর্ম সৃষ্টি করেন না। কারণ কর্মের জন্মের জন্য কর্তৃত্ব ও ফলভোগের ধারণা অপরিহার্য, অথচ মুক্ত পুরুষ সেই ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাঁর সমস্ত কর্ম কেবল প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি হিসেবে ঘটে, তাঁর কোনো ব্যক্তিগত কর্তা-ভাব বা আসক্তি থাকে না। ফলে নতুন কর্মফল (Āgāmi বা Kriyāmāṇa) উৎপন্ন হয় না।
পরম শান্তি (Supreme Tranquility): কৈবল্যের পরিণতি হলো পরম শান্তি—যেখানে চেতনা সমস্ত দুঃখ, আন্দোলন, ও চিত্তবৃত্তি থেকে মুক্ত।
আনন্দ বা শান্ত স্বরূপ (Bliss or Nature of Stillness): যদিও যোগ ও সাংখ্য দর্শনে পুরুষকে “আনন্দস্বরূপ” বলা হয় না (যেমন বেদান্তে বলা হয়), তবু কৈবল্যের অভিজ্ঞতা পরম প্রশান্তি ও অপরিবর্তনীয় জ্ঞানের অবস্থাই নির্দেশ করে। এখানে আনন্দ কোনো অনুভূতির ফল নয়; এটি চেতনার নিজের স্বরূপের প্রশান্ত দীপ্তি—যা সব দ্বন্দ্ব, কামনা ও কষ্ট অতিক্রম করেছে।
এই অবস্থায় মন ও প্রকৃতির গুণত্রয় সম্পূর্ণ শান্ত। কোনো ওঠানামা নেই, কোনো ভয় বা আকাঙ্ক্ষা নেই। চেতনা একাকী, অচঞ্চল, ও স্ব-নির্ভর—স্বপ্রভ, স্বচৈতন্য, স্বতঃস্থিত।
কৈবল্য মানে পুরুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের চূড়ান্ত অবসান। পুরুষ আর কোনো ক্লেশ, কর্ম বা গুণের অধীন নয়। তিনি নতুন কর্ম সৃষ্টি করেন না, পুরনো কর্ম ক্ষীণ হয়ে যায়, এবং চেতনা নিজের বিশুদ্ধ, নিরালম্ব স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়—স্বরূপে স্থিতি, প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছেদ, এবং অবিচল বিবেকজ্ঞান। ফলত যোগী থাকে শুদ্ধ চৈতন্যরূপে—অচঞ্চল, স্বাধীন ও স্বপ্রভ। এই অবস্থাই যোগদর্শনের চূড়ান্ত মুক্তি—এক অবিচল শান্তি, এক চিরন্তন স্বাধীনতা, যেখানে চেতনা কেবল নিজেই নিজের আলোয় উদ্ভাসিত।
যোগদর্শনে পতঞ্জলির সংজ্ঞা দু-জায়গায় বিশেষভাবে স্পষ্ট।
প্রথমটি যোগসূত্র ২.২৫—“তদ্ভাবাত্ সংযোগাভাবঃ হানম্, তদ্দৃষ্টেঃ কৈবল্যম্।” অর্থাৎ, অবিদ্যা বা অজ্ঞান বিলুপ্ত হলে পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগও লুপ্ত হয়। এই সংযোগের অভাবকেই পতঞ্জলি “হান” বা মুক্তি বলেছেন, আর সেই দর্শন বা উপলব্ধিই কৈবল্য।
যতক্ষণ অবিদ্যা থাকে, পুরুষ নিজেকে প্রকৃতির (মন, দেহ, ইন্দ্রিয়) সঙ্গে অভিন্ন মনে করে; কিন্তু যখন জ্ঞান উদিত হয়—“আমি দর্শক, প্রকৃতি দর্শনীয়”—তখন এই ভ্রান্ত সংযোগ ভেঙে যায়। সংযোগের অবসানই মুক্তি, আর যে জ্ঞান সেই অবসান ঘটায়, সেটিই কৈবল্য।
দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি যোগসূত্র ৪.৩৪—“পুরুষার্থশূন্যানাং গুণানাং প্রতিপ্রসবঃ কৈবল্যম্, স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি।” অর্থাৎ, যখন গুণত্রয় (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) তাদের উদ্দেশ্য—পুরুষের অভিজ্ঞতা ও মুক্তি—পূর্ণ করে ফেলে, তখন তারা নিজের উৎসে ফিরে যায় (প্রতিপ্রসব)।
এই গুণদের প্রত্যাবর্তনই কৈবল্য, অথবা চিতিশক্তির নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতির সমস্ত কার্য তখন শেষ হয়; গুণত্রয় নিস্তব্ধ হয়ে যায়; এবং পুরুষ নিজের শুদ্ধ, স্বপ্রভ, স্বাধীন চৈতন্যে স্থিত হয়।
অতএব, পতঞ্জলির মতে, কৈবল্য মানে হলো—অবিদ্যার নিবৃত্তি, পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগের অবসান, গুণত্রয়ের প্রতিপ্রসব, এবং চিতিশক্তির নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠা। এই অবস্থায় আর কোনো কর্ম, পরিবর্তন বা দ্বন্দ্ব অবশিষ্ট থাকে না; কেবল চির স্বাধীন, চির শান্ত, অচঞ্চল চেতনার স্বরূপ প্রকাশিত হয়—যা যোগদর্শনের চূড়ান্ত মুক্তি।
নৈয়ায়িক-বৈশেষিক মুক্তিতত্ত্বে চূড়ান্ত পুরুষার্থ হলো অপবর্গ। এটি দুঃখের সম্পূর্ণ নিবৃত্তি বা সর্বাবসান বোঝায়—অর্থাৎ এমন এক অবস্থা, যেখানে আর কোনো দুঃখ, কষ্ট, বা বদ্ধ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটে না।
বৈশেষিকসূত্রের প্রারম্ভিক আলোচনায় “নিঃশ্রেয়স” ও “অপবর্গ” শব্দ দুটি একত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং সেখানে সেগুলোকে স্পষ্টভাবে “দুঃখ-নিবারণ” বা “দুঃখের সম্পূর্ণ অবসান”-রূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এখানে দুঃখ মানে কেবল মানসিক যন্ত্রণা নয়, বরং সমস্ত প্রকার ইন্দ্রিয়গত, মানসিক, ও আধ্যাত্মিক ক্লেশের মূল কারণ—অবিদ্যা, আসক্তি, এবং জন্ম-চক্রের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি।
ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন পরস্পর সম্পর্কিত দুটি ধারা। ন্যায় দর্শন যুক্তি, প্রমাণ, ও জ্ঞানতত্ত্বের মাধ্যমে দুঃখের কারণ ও নিবারণের উপায় নির্দেশ করে, আর বৈশেষিক দর্শন অস্তিত্বতত্ত্ব বা পদার্থতত্ত্বের মাধ্যমে মুক্ত আত্মার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এই দুই দর্শনের ঐক্যসূত্রে গাঁথা চরম লক্ষ্য হচ্ছে—সব দুঃখ-বিভাগের নিবৃত্তি ও আত্মার নিখাদ স্বাধীনতা।
“অপবর্গ” ন্যায়-বৈশেষিক মুক্তিতত্ত্বে সেই অবস্থা, যেখানে জ্ঞান দ্বারা সমস্ত দুঃখের কারণ ধ্বংস হয়, আত্মা দেহ-মন-বুদ্ধির সীমা অতিক্রম করে, এবং চিরশান্ত, নির্বন্ধ অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত থাকে।
বৌদ্ধ দর্শনে পরম পুরুষার্থ বা চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নিব্বান (নির্বাণ)। নির্বাণ মানে তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিঃশেষ, অর্থাৎ দুঃখের চূড়ান্ত নিরোধ।
আর্যসত্য বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তি। এটি বুদ্ধের প্রথম ধর্মদেশনা ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্রে (সংযুক্ত নিকায়, ৫৬.১১)-এ উল্লিখিত চারটি মহান সত্য। “আর্য” মানে মহৎ বা উত্তম, আর “সত্য” মানে বাস্তবতা। তাই আর্যসত্য মানে মহৎ সত্য বা চূড়ান্ত বাস্তবতা, যা জ্ঞানী ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
বুদ্ধ বলেছেন, যে-ব্যক্তি এই চারটি আর্যসত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করে, সে আর জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরে আসে না।
প্রথম আর্যসত্য হলো দুঃখ আর্যসত্য—জীবনের সর্বত্র দুঃখ বিরাজমান। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, প্রিয় থেকে বিচ্ছেদ, অপছন্দনীয়ের সংযোগ, কামনাপূরণে ব্যর্থতা—সবই দুঃখ। সমস্ত ‘শর্তযুক্ত অস্তিত্ব’ অনিত্য ও দুঃখময়।
দ্বিতীয় আর্যসত্য হলো দুঃখসমুদয় আর্যসত্য—দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা (taṇhā)। এই তৃষ্ণা জন্মায় অজ্ঞান (avijjā) থেকে, এবং তা কামনা, আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তির মাধ্যমে ‘পুনর্জন্মের চক্র’ চালিয়ে যায়।
তৃতীয় আর্যসত্য হলো দুঃখনিরোধ আর্যসত্য—যখন তৃষ্ণা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়, তখন দুঃখেরও অবসান ঘটে। এই নিঃশেষ অবস্থাই নির্বাণ—যেখানে দুঃখ, আসক্তি ও অজ্ঞান সম্পূর্ণ বিলুপ্ত।
চতুর্থ আর্যসত্য হলো দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপদ আর্যসত্য—দুঃখের নিরোধে পৌঁছানোর পথ। এই পথই অষ্টাঙ্গিক মার্গ—সম্যক দর্শন, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীবিকা, সম্যক ব্যয়াম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।
সংক্ষেপে, আর্যসত্য হলো দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ ও নিরোধের পথ—এই চারটি চূড়ান্ত সত্য। এগুলি বোঝা ও অনুধাবন করাই বৌদ্ধ সাধনার কেন্দ্রবিন্দু এবং নির্বাণ লাভের একমাত্র উপায়।
‘শর্তযুক্ত অস্তিত্ব’ বলতে বোঝায় এমন সব কিছু, যা কারণ ও শর্তের ওপর নির্ভর করে জন্ম নেয় এবং বিলীন হয়। কোনো বস্তু, অবস্থা বা অভিজ্ঞতা নিজে নিজে নয়, বরং অন্য কিছুর প্রভাবে উদিত হয়। তাই একে বলা হয় নির্ভর উৎপত্তি বা পটিচ্চসমুৎপাদ (Paṭicca-samuppāda)।
এর অর্থ—যখন কোনো কারণ থাকে, তখন ফল ঘটে; কারণ না থাকলে ফলও থাকে না। সমস্ত অস্তিত্বই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—অজ্ঞতা থাকলে সংসার অব্যাহত থাকে, তৃষ্ণা থাকলে আসক্তি জন্মায়, জন্ম থাকলে জরা-মৃত্যু ঘটে। তাই কোনো কিছুরই স্বাধীন, চিরস্থায়ী অস্তিত্ব নেই; সবই পারস্পরিক নির্ভরতার ফসল।
বৌদ্ধ দর্শনে এই শর্তযুক্ত জগৎকে সংখার (Saṅkhāra) বলা হয়—যা পরিবর্তনশীল, অনিত্য ও দুঃখময়। কারণ যা শর্তের দ্বারা গঠিত, তা একদিন ভেঙে যায়ই।
বুদ্ধ বলেছেন—“যা শর্তযুক্ত, তা অনিত্য; যা অনিত্য, তা দুঃখ; আর যা দুঃখ, তা অনাত্মা।” অর্থাৎ শর্তযুক্ত বস্তু কখনও আত্মা বা স্থায়ী সত্তা হতে পারে না।
শর্তযুক্ত অস্তিত্ব হলো এই পরিবর্তনশীল জগৎ—দেহ, মন, চিন্তা, অনুভূতি ও কর্ম—যা কারণ ও শর্তের দ্বারা জন্মে এবং বিলীন হয়। যতক্ষণ মানুষ এই শর্তযুক্ত জিনিসকে “আমার” বা “আমি” বলে ধরে রাখে, ততক্ষণ দুঃখের জন্ম হয়।
‘পুনর্জন্মের চক্র’ (সংস্কৃত: সংসার, পালি: Saṃsāra) বলতে বোঝায়—জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের সেই অন্তহীন ঘূর্ণন, যেখানে জীব অজ্ঞতা (অবিদ্যা) ও তৃষ্ণার কারণে বার বার নতুন অস্তিত্বে জন্ম নিতে থাকে।
বৌদ্ধ দর্শনে এই সংসার চক্রের মূল কারণ দুটি—
১. অবিদ্যা (Avijjā)—বাস্তবতার সত্য প্রকৃতি না জানা, অর্থাৎ অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্মা স্বরূপকে না বোঝা।
২. তৃষ্ণা (Taṇhā)—আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি ও ভোগের প্রবণতা।
অবিদ্যা থেকে উদ্ভূত কর্ম (কাম্ম) ও তৃষ্ণা মিলেই নতুন জন্মের বীজ তৈরি করে। মৃত্যুর পর সেই কর্মবীজ অনুযায়ী নতুন অস্তিত্বে জন্ম ঘটে। এভাবে চলতে থাকে জন্ম-জরা-মৃত্যুর অবিরাম চক্র, যাকে বলা হয় সংসার।
বুদ্ধ এই চক্রকে ব্যাখ্যা করেছেন পটিচ্চসমুৎপাদ (নির্ভর উৎপত্তি) সূত্রে—“অবিদ্যা থেকে সংস্কার, সংস্কার থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান থেকে নাম-রূপ, নাম-রূপ থেকে ষড়ায়তন, ষড়ায়তন থেকে স্পর্শ, স্পর্শ থেকে বেদনা, বেদনা থেকে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা থেকে উপাদান, উপাদান থেকে ভব, ভব থেকে জাতি (জন্ম), আর জন্ম থেকে জরা-মরণ, শোক ও দুঃখের উদ্ভব।”